কাজলদিঘী (১৪৬ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৪৬ নং কিস্তি
—————————

ওই ঘরে বেশ হই চই হচ্ছে। যে ভয়টা সকাল থেকে পাচ্ছিলাম সে ভয়টা মনে হয় নেই। একটা ঘোটালা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল মাত্রায় ছিল।

কিন্তু আবিদ, আয়েষা, ইসলামভাই গেল কোথায়? বিশেষ করে ইসলামভাই? যার মেয়ে তারই এখনও পাত্তা নেই। যার জন্য এত কিছু, সে বেপাত্তা!

ওই ঘর থেকে আবার হইচইয়ের শব্দ ভেসে এলো। দেখে শুনে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। এটাই যেন ঘটতে চলেছে?

বড়োমা, ছোটোমা, দামিনীমাসির মুখ লক্ষ্য করেছি যেন অনিকা ওদের কতদিনের পরিচিত? অনিকার মধ্যেও সেইরকম কোনও অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলাম না। ভাবটা এরকম আমি সকলকে চিনি? তোমাকে আলাদা করে কারুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না।

আমি দরজাটা বন্ধ করলাম। বাগানের দিকের জানলা ভেজানই আছে।

আমার মোবাইল?

ব্যাটা নেপলা পকেটে রেখে দিয়েছে।

সবেমাত্র ড্রয়ারটা গলিয়ে পাজামাটা গলিয়েছি দরজা ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল।

চেঁচিয়ে উঠলাম দাঁড়াও যাচ্ছি।

কে কার কথা শোনে ঘটাঘট ঘটাঘট দরজা যেন ভেঙে ফেলবে।

কোনওপ্রকারে পাজামার দড়িটা বেঁধে আদল গায়েই দরজা খুললাম।

নিমেষের মধ্যে ঘর ভড়ে গেল আমি ইসলামভাইয়ের বুকে বাঁধা পড়েছি। কে যে কোনখান থেকে জড়িয়ে ধরছে বোঝা মুস্কিল। চারদিকে হই হই। যেন মোছ্ছব লেগে গেছে।

আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কোনওপ্রকারে মুখটা বার করে দেখি, মিলি-টিনা-অদিতিরা খিল খিল করে হাসছে। বড়োমারা সব ঘরে ঢুকছে। ডাক্তারদাদা এসে ইসলামভাইয়ের পিঠে হাত রাখলো।

ইসলাম ওর শরীরটা কিন্তু মজবুত নয়। সকালে কি ঘটনা ঘটেছে নেপলার মুখ থেকে শুনেছ।

ইসলামভাইয়ের বুক থেকে মুক্ত হলাম। ইসলামভাই আমার কপালে চুমু খেল।

তোকে আর এই নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। যা সত্যি তা সকলে মেনে নিয়েছে।

আমি ইসলামভাইয়ের দিকে তাকিয়ে।

তুই তো সকলকে সত্যের দাসত্ব করতে শিখিয়েছিস। আবিদ, আয়েষা একটুও দুঃখ পায়নি। ওরা তোর কাছে আসতে লজ্জা পাচ্ছে।

আমি কোনও কথা বলছি না।

আমি জানি তুই ওদের খুঁজছিস। তুই আবিদকে তোর ছোটো ভাই বলিস। ছোটোভাই একটা ভুল করে ফেলেছে। আমি তোর কাছে ওদের হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

কাকে কি কথা বলবো। চারিদিকে ক্যাঁচর ম্যাচর।

পিঠটা দেখি ভিঁজে ভিঁজে লাগছে।

কে কাঁদেরে?

আমি পক্কে।

ঘুরে দাঁড়ালাম।

পক্কে, ঘণ্টা বুকে মুখ লুকিয়েছে।

ডাক্তারদাদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

ভালোবাসার জ্বালা দেখেছিস। আমি কিন্তু বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছি।

কিরে ব্যাটা তোরা ব্যাটাছেলে না মেয়েছেলে?

জানিনা। শুধু জানি আমরা তোমার ছেলে।

তোর বাপ যখন কাঁদে না তখন তোরা কাঁদিস কেন?

কিছুতেই ছাড়ে না জড়িয়ে ধরে থাকে।

ছাড়, অনিমামা টেঁসে গেলে গণ্ডগোল।

আমরাও সেদিন মরে যাব।

ভ্যাটকাস না।

ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়ে সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো।

শরীর ছুঁয়ে নিলি এবার ভালো করে মুখটা দেখ, কেমন চাঁদ বদন বানিয়েছি তোদের জন্য। সাতমাস এখানে পড়ে আছিস। বাড়ির গেটের সামনে দিয়ে ঘুরে গেছিস। ভীতুর ডিম। সাহস করে ভেতরে এসে ডাকার সৌজন্য বোধটুকু তোদের হয়নি। এই জন্য তোদের মাস্টার ডিগ্রী করিয়েছি। সব বিএ, এমএ পাশ করে এক একটা ছাগল তৈরি হয়েছিস।

দেখ দেখ আমার চাঁদবদন দেখ।

দু-জনের থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা তুললাম।

অনিকাদি বারণ করেছে।

ও-তো একটা ডেঁপো মেয়ে। ওর মা স্বার্থপর, ওর বাপ স্বার্থপর ও নিজেও একটা স্বার্থপর তৈরি হয়েছে। নিজেরটা ছাড়া কিছুই বোঝে না।

ইসলামভাই হেসে উঠলো।

ভাগ্যিস ছোটোমার কথাটা জুড়ে দেয়নি—মিলি বলে উঠলো।

দেবে না। ওটা যে নিজের মা। ডাক্তারদাদা বললো।

মিত্রা এগিয়ে এসে পাঞ্জাবীটা দিল।

আর বডি দেখাস না। সবাই লজ্জা পেয়ে যাবে।

তনু খিল খিল করে হেসে উঠলো।

আমি মিত্রার হাত থেক পাঞ্জাবীটা নিয়ে ভাঁজ খুলে পড়ছি, দেখি অনিকা সামনে এসে হাত পেতে দাঁড়ালো।

আবার কি চাস, অনেক জ্বালিয়েছিস। ভাগ এখান থেকে। আমার ব্যাগ কোথায়?

অনিকা আমার মাথাটা টেনে নিজের মুখের কাছে নামিয়ে এনে ফিস ফিস করলো।

সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখটা সামান্য পরিবর্তন হলো। গম্ভীর গলায় বললাম।

দাঁড়া অপেক্ষা কর, এটা তোকে দেব। প্রমিস করেছি যখন পাবি।

ইসলামভাই, দামিনীমাসির চোখের পলক পরে না। আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

অনিকা জড়িয়ে ধরলো।

আবার আদর কিসের, এখন ছাড় পেটে আগুন জ্বলছে।

বড়োমা এবার কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে। চেঁচিয়ে উঠলাম।

চেঁচাচ্ছিস কেন, দেব মুখে নোড়ার বাড়ি। ছোটোমা হাত মুঠো করে তেড়ে এলো।

ছোটো ওরকম করিস না। বেচারা সাতদিন ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে নি। বড়োমা বললো।

তনু শুরু হয়ে গেছে—মিত্রা বললো।

শুরু হয়ে গেছে, না। সকাল থেকে তোরা গণ্ডায় গণ্ডায় গিলিস নি—বড়োমা চেঁচাচ্ছে।

মিত্রা, সুরো কেথায়রে? আমি বললাম।

চোখে পড়ে নি?

না।

ভালো করে দেখ সবাইকে পেয়ে যাবি?

ঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে সুরো আমার অবস্থা দেখে হাসছে।

সুরোপিসির সঙ্গে আলাপ করেছিস? অনিকার দিকে তাকালাম।

মাথা দোলাল। করেছে।

সুরো কাছে এগিয়ে এলো।

পুঁচকে দুটো কোথায়?

গেটের বাইরে যায় নি এটুকু বলতে পারি।

এটা উত্তর হলো?

তোমার মতো।

তনু হাসছে।

বোতামগুলো লাগাতে দে। তোরা তিনজনে একবারে এঁটুলে পোকার মতো জড়িয়ে রয়েছিস। পরিষ্কার জামাটাও লাট করে দিলি।

মিত্রা ওকে আর একটা বার করে দে। ছোটোমা বললো।

আর উপকার করতে হবে না।

খাওয়া দাওয়া করেছিস? ঘণ্টার দিকে তাকালাম।

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।

কেন, যারা নিয়েগেছিল খাওয়ায়নি?

হেসে ফেললো।

মাথা দোলাচ্ছে। খাইয়েছে।

খারাপ ব্যবহার করেছে?

দু-জনেই মাথা দোলাল। না।

আবিদ মাইনে দিয়েছে?

দু-জনে চুপ করে রইলো।

তোরা তিনজনে যে যা পাস তার থেকে বেশি টাকা দেব। আমার কাছে চাকরি করবি?

তোমার খিদে পেয়েছে, তাই না? অনিকা ভাষা ভাষা চোখে আমার দিকে তাকালো।

হেসে ফেললাম।

মিত্রাদি, অনিকা অনিদাকে চিনে ফেলেছে। মিলি ফুট কাটল।

ওর যখন একমাস বয়স তখনকার ছবিটা দেখলি না। অনিকা কার কোলে ছিল?

কোথায়! দেখিনি!

ওই ঢাউস ব্যাগে আছে।

মিত্রার দিকে তাকালাম, ব্যাগ কে খুলেছে?

তোর বড়ো মেয়ে। ইন্সপিরেশন দিয়েছে ছোটটা। বলেছে দু-জনে তোর সঙ্গে বুঝে নেবে। আমরা দর্শক ছিলাম।

মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে হাসছে।

ওইটুকু শুধু বাকি ছিল, বাকিটা তুমি সব জানো।

মেয়ের কথায় আমি হাসছি।

অন্ততঃ আমাকে একটা থ্যাঙ্কস দাও। ভাইদাদাইকে খোঁচাটা না মারলে তুমি এতো তারাতারি দিদিভাইকে নিয়ে আসতে?

এটা কিন্তু বুঁচকি হক কথার এক কথা বলে ফেলেছে। ডাক্তারদাদা বললো।

মহা মুস্কিল, ছেলেটাকে তোমরা খেতে দেবে না। দাদা গেটের কাছে এসে দাঁড়াল।

বড়োমা এগিয়ে গেলো।

বলো না, আর থাকতে পারলাম না।

আমি দাদার দিকে তাকিয়ে হাসছি।

বুঝলি অনি, অনিমেষ সকালে বললো, আমরা বুড়োগুলো তোর কাছে ক্লাস নেব। তা বললাম, এ জন্মে পারবো না। যদি আগামী জন্মে কাজে লাগাতে পারি।

আমি ঘরের বাইরে এলাম। দাদার হাতটা চেপে ধরলাম।

এই শিক্ষাটা তোমার কাছে পাওয়া।

তুই জেনেশুনে মেয়েটাকে এতদিন কষ্ট দিলি।

আমি দিই নি। ওর কপাল, আমি সময়ের দাসত্ব করি।

দাদার হাত ধরেই বারান্দা দিয়ে এই ঘরে এলাম।

আবিদ, আয়েষা, ইকবালভাই সোফায় বসে। দু-জনেই আমাকে দেখে উঠে এসে প্রণাম করলো।

দু-জনকে কাছে টেনে নিলাম।

ওখানে কখন যাবি?

এবার বেরবো।

আয়েষার মুখটা তুলে ধরলাম। চোখে জল টল টল করছে।

কাল সকালে আসবি, আমি নেমন্তন্ন করলাম। দু-জনেই পিঠে একটা করে কুলো বেঁধে নিবি।

দু-জনেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

দময়ন্তী কোথায়?

আসে নি। আয়েষা বললো।

কেন?

তুমি বকবে।

নেপলা।

মাঠে রতনদের কাছে। মিত্রা বললো।

ওকে একবার ডাক। অনিসার দিকে তাকালাম।

আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে খাব। বলেই বেরিয়ে গেল।

ইকবালভাই সোফায় বসেই সারাটা শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো।

কিছু বুঝলি?

আমি ইকবালভাইয়ের দিকে তাকিয়ে।

অনেক লাইন, তাই প্রথম লাইনটা রেখে গেল।

তুমি কখন যাবে? আবিদ হাতটা চেপে ধরলো।

কখন গেলে চলবে বল।

এখুনি চলো।

পাগল। যা আর দেরি করিস না। আয়েষা আবার সাজুগুজু করবে।

আবার দু-জনে নিচু হয়ে প্রণাম করলো।

ঘন ঘন করলে এবার ট্যাক্স দিতে হবে।

বলো কি বলছো? নেপলা এসে দাঁড়ালো।

আমার ফোন কই?

পকেটে।

দে।

এখন না।

সেকিরে!

আর একটু কাজ আছে। তুমি খেয়ে নাও। তারপর সব বুঝিয়ে দেব।

গণ্ডগোল করেছিস?

একটুও না। তুমি দেখে নিও।

তুই খেয়েছিস?

কি বলি বলো।

কেন?

হ্যাঁ বললেও ঝাড়, না বললেও ঝাড়।

বলনা হাফ খেয়েছি, আর হাফ তোমার সঙ্গে খাব। ছোটোমা বললো।

নেপলা হাসছে।

উসমান কই?

ওকে খাইয়ে দিয়েছি। ছগনদার সঙ্গে গেটে বসে পরেছে।

অর্কদাকে বল দময়ন্তী যেন একবার এখানে আসে।

আচ্ছা।

যা তোরা এবার এগিয়ে যা। আবিদ, আয়েষার দিকে তাকালাম।

ওরা সবাইকে প্রণাম করে বেরিয়ে গেল।

অনিমামা। অনিকার ডাকে ফিরে তাকালাম।

ফোনটা এগিয়ে দিল। ফাদার।

ওর হাত থেকে ফোনটা নিলাম।

হ্যাঁ ফাদার বলো।

শরীর ঠিক আছে?

কানের কাছ থেকে ফোনটা সরিয়ে নিলাম। অনিকা যে ভয়েজ অন করে দিয়েছে বুঝিনি। অনিকা হাসছে, মিত্রারাও ওকে সঙ্গ দিলো।

এখনও খাওয়া জোটে নি। কি করে ঠিক থাকে বলো।

ফাদার হাসলো।

উসমানের কাছে সব শুনলাম। খুব ভালোলাগছে।

হঠাৎ তোমার মুখে এই কথা?

তোকে আজ নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম। আঠাশ বছর ধরে অনিকে দেখছি। সে দেখার সঙ্গে এই দেখার অনেক পার্থক্য।

তুমি ইমোশন্যাল হয়ে পড়ছো।

নারে। ত্যাগের ব্রত নিয়েছি বলে কি আমি মানুষ নই।

অনিকার বাবার সঙ্গে কথা বলেছো?

বলেছি।

অনিকা তোমাকে কি বললো?

কিছু বলেনি।

ঘণ্টা, পক্কের সঙ্গে কথা বললে?

ওরা তোকে পেয়ে গেছে। এই পৃথিবীতে ওদের আর কিছু চাওয়ার নেই।

এই সপ্তাহে কি কলকাতা আসবে?

সোমবার যাব।

রাত্রিটুকু আমার এখানে কাটিও।

যাবরে যাব। তুই ডাকলে না গিয়ে থাকতে পারি। অর্গল যখন ভেঙেছে নিশ্চই যাব।

তুমি এলে তোমার সঙ্গে ওদের পাঠাবো।

ঠিক আছ, এখন খেয়ে নে। বেলা হয়ে গেল।

তুমি রাখো।

রাখছি।

ফোনটা কঁ কঁ করে উঠলো। অনিকার হাতে দিলাম।

ইকবালভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

ফাদার হ্যারিস?

হ্যাঁ।

জীবনে একবার দেখেছি।

কবে!

বছর পঁচিশ হবে। তুই ওনাকে নিয়ে গঙ্গার ঘাটে এলি। নৌকো করে দুজনে মাঝ গঙ্গায় গেলি।

মনে পড়েছে।

মনে পড়বে না। তুই সেদিন খুব অফ মুডে ছিলি।

সেদিন পক্কেটার মা মরে গেল। কোনওপ্রকারে পক্কেটাকে বাঁচাতে পেরেছিল নীরু।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম, চোখের সামনে ছবির মতো সব ভেসে আসছে।

জানো ইকবালভাই।

ইকবালভাইয়ের দিকে তাকালাম।

নীরু, কনিষ্ক আমার অনেক আকাম কুকামের সঙ্গী।

ইকবালভাই সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পায়ে পায়ে কাছে এগিয়ে এসে আমার দু-কাঁধে হাত রাখলো।

তুই ওদের দিয়ে এই আকাম করিয়েছিলি বলেই আজ অনিকাকে চোখের সামনে ঘোরা ফেরা করতে দেখছি। পক্কেকে দেখতে পাচ্ছি, ঘণ্টাকে দেখতে পাচ্ছি।

আমি ইকবালভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম।

তখন কি জানতিস, এক সময় ইসলাম তোর এতোটা ঘনিষ্ট হবে। একটা সম্বন্ধ তৈরি হবে। তোকে তার মেয়ে চেয়ে বসবে। আর তুই গাছ থেকে তাকে ফলের মতো পেড়ে নিয়ে ইসলামকে দিয়ে দিবি।

আমি ইকবালভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি।

অনি, ছাব্বিশ বছর ধরে কেউ আকাম করতে পারে না।

সকাল থেকে তুই একা যুদ্ধ করেছিস। এখানে দাদার নেতৃত্বে আমি, অনিমেষবাবু যুদ্ধ করেছি। ডাক্তারবাবু কো-অর্ডিনেটর, মল্লিক খানিকটা দৌড়োদৌড়ি করলো, ইসলাম-ছোটো সারাক্ষণ কেঁদেই গেল।

সারাটা ঘর নিস্তব্ধ।

ইকবাল এবার বসে পরো। বড়োমা বলে উঠলো।

দিদি ওকে একটা কাজু বরফি দিন।

এখন দিলে ওর কপালে জুটবে না। বড়োমা বললো।

মিত্রার কটকটে হাসি কানে বিঁধলো।

সবাই একসঙ্গে খেতে বসলাম।

একপাশে আমি, ছোটোমা, বড়োমা আর একপাশে ইকবালভাই, দামিনীমাসি। দু-পাশে তনু, মিত্রা।

আবার একচোট হই চই শুরু হয়ে গেল। নীরু পর্যন্ত আমার পাত থেকে ছোঁ মেরে মাংসের টুকরো তুলে নিয়ে চলে গেল।

অনেকক্ষণ পর বনি, নাগেশকে দেখলাম, ঢুকেই দুজনে আমার পাতে হামলা করলো।

মিত্রা মুচকি হেসে একবার বনির দিকে একবার বড়োমার দিকে তাকাল।

বনি মুরগির ঠ্যাঙটাতে একটা কামড় দিয়ে মিত্রার দিকে তাকাল।

বড়োমা কুছ বোলা।

মিত্রা হাসছে। বড়োমার গম্ভীর হাসি হাসি মুখ।

বনি চেঁচিয়ে উঠলো, সুরো।

সুরো বড়োমার ঘর থেকে বেরলো।

লিয়া।

নেহি।

লে লো।

ছোটোমা এবার জোড়ে হেসে উঠলো।

আমি বনির দিকে তাকালাম।

তোর বাপ দেখলে হার্টফেল করবে।

বাবা জানে।

সুরো আর একটা ঠ্যাঙ তুলতেই বড়োমা খ্যাড় খ্যাড় করে উঠলো, ও খাবে কি।

এতোক্ষণ চুপ ছিলে কেন। আমি নিতেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল।

সবাই হাসি হাসি করছে।

আমি বনির দিকে তাকালাম।

কোথায় গেছিলি?

মার্কেটিংয়ে।

কিসের মার্কেটিং?

রাতে পার্টি আছে।

খুব তৃপ্তি সহকারে সুরো, বনি মাংসের ঠ্যাঙ চিবচ্ছে।

মাসি হাঁড়ি ফাঁকা। সুরো, দামিনীমাসির দিকে তাকাল।

রান্নাঘরে যা ইসি আছে।

কেন খাবার লোকের অভাব। বড়োমা আবার তরপে উঠলো।

মাসি হাসতে হাসতে বললো, রাতে আবার করে নেব।

ছোটোমাকে বললাম অনিকাদের খাইয়ে দিয়েছো।

খাইয়ে ও ঘরে দিদির সঙ্গে বসিয়ে দিয়েছি।

বড়োমা আমার দিকে তাকাল।

কি গায়ের রং। ছোটোর থেকে দেখতে সুন্দর।

অনেক যত্ন আত্তি করতে হয়েছে বুঝলে।

কোনও ছেলেটেলে পটায় নি?

মিত্রা খিক খিক করে হেসে উঠলো। দামিনীমাসি মাথা নিচু করে হাসছে।

দেখে কি মনে হয়?

কি ভালো মেয়ে। কি আস্তে কথা বলে।

ও জানে ছেলে পটালে অনিমামা দু-টোকেই মেরে দেবে। তার থেকে অনিমামা যা বলে তাই শুনবো।

কিভাবে ওকে নিয়ে গেলি গল্পটা বল। ছোটোমা বললো।

শোনো নি?

ফোনে বললি বুঝলাম না।

শুনে কাম আছে?

তুই তো কাল বললি কাজ শেষ হলে বলবি।

এখনও কাজ শেষ হয়নি।

কবে শেষ হবে?

চিতায় উঠলে।

বালাই ষাট, খেতে বসে ও কথা বলতে নেই। বড়োমা বললো।

তুমি কিন্তু খেতে দিচ্ছ না, বার বার ইন্টারাপ্ট করছো। ছোটোমার দিকে তাকালাম।

আর বলবো না।

মিত্রা, তনু হাসে।

মসি।

বল।

তারাতারি খেয়ে উঠে ওর কাছে গিয়ে বসো। ও অস্বস্তি বোধ করছে।

ছোটোমা আমার দিকে তাকাল।

কটাদিন খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করবে। আমার মুখ থেকে তোমাদের গল্প শুনে ও একটা ছবি এঁকে রেখেছে। সবটা হয়তো নাও মিলতে পারে।

তুই কি ওকে সব বলেছিস! ছোটোমা বললো।

না বললে নিয়ে আসতে পারতাম। ঘণ্টা, পক্কেকে দেখলে না। আমাকে দেখবে বলে এই বাড়ির দোরগোড়া থেকে ফিরে গেছে।

জানিস টেবিলে বসে খেল না। তিনটেতে নিচে বসে খেল। বড়োমা বললো।

সময় লাগবে। ছোটো থেকে একভাবে মানুষ হয়েছে, তার পরিবেশ সম্পূর্ণ অন্যরকম, এসে পড়েছে আর এক পরিবেশে। দেখবে ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে যাবে।

ও যে কাজ করতো। বড়োমা বললো।

মিত্রাদের ক্লাবের লাইব্রেরীতে। তাও সেখানে মাস তিনেক হলো কাজ করছে।

মাসি উঠে দাঁড়ালো।

ঘরে জ্যেঠিমনি ছাড়া আর কে আছে?

দেখে বলছি।

আমাদের খাওয়ার শেষের দিকে পিকু আর বরুনদা এলো।

ঘরে ঢুকেই বরুনদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

পিকু এসে সোজা আমার পাতে যেটুকু মাংস অবশিষ্ট ছিল তুলে নিল।

আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, দিদি কই।

বরুনদা ওখান থেকেই চেঁচালো, ছোটোমা নতুন অতিথি?

ইসি ছোটোমার পাত থেকে একটা মাংসের টুকরো তুলে নিয়ে চুষতে চুষতে বললো, বড়োমার ঘরে, মার কাছে বসে আছে।

বরুনদা সোজা বড়োমার ঘরে চলেগেল।

চারিদিকে কিচির মিচির। ইসলামভাই ঘরে ঢুকলো।

কিরে সকলে পেল আমি বাদ?

আমর পাত খালি। একটা ছিল পিকু নিয়ে নিল।

ইসলামভাই হাসছে।

অনিসা ছোটোমার পাত থেকে আর একটুকরো মাংস তুলে নিয়ে গিয়ে ইসলামভাইয়ের মুখে দিল।

তুই আর একটু নে।

ছোটোমা আমার দিকে তাকাল। তারপর ইসির দিকে।

ইসি যা না মা।

আর পারবো না। আবার রাতে কিছু না কিছু খেতে হবে। আমি বললাম।

ছোটোমা।

বরুনদা বড়োমার ঘরের গেটে। একবার অনিকার মুখ দেখে, একবার ছোটোমার মুখ দেখে।

অনি তোমাকে ধরে আনলো কোথা থেকে? তুমি তো সকাল থেকে বাড়িতেই ছিলে—

অনিকা মুখ নিচু করে নিয়েছে। ছোটোমা হাসছে।

এদিকে আয়। আমি বললাম।

অনিকা আমার কাছে এলো।

তোকে গিয়ে পিকুর কথা বলতাম। মনে আছে।

অনিকা পিকুর দিকে তাকালো।

পিকু অনিকার কাছে এগিয়ে গেছে।

যখন দেখতে চেয়েছিলি তখন দেখাতে পারি নি। আজ ভাল করে দেখে নে।

আমি উঠে দাঁড়ালাম।

কিরে উঠে দাঁড়ালি? বড়োমা বললো।

বসে থেকে কি করবো!

ইকবাল কষ্ট করে তোর জন্য বরফি বানিয়ে আনলো, একটা খা।

বললে যে আমাকে দিলে কপালে জুটবে না।

ইকবালভাই জোড়ে হেসে উঠলো।

পিকু ঘর থেকে দামিনীকে ডাক।

ওখানে দাঁড়িয়েই পিকু মাসিদিদা বলে চেঁচিয়ে উঠলো।

ষাঁড়ের মতো চেল্লাছিস কেন—ছোটোমা চেঁচিয়ে উঠলো।

তনু, মিত্রা দু-জনে দু-জনের দিকে টেরিয়ে তাকাল। ওদের তাকানতেই বুঝলাম কিছু  একটা গণ্ডগোল করে বসে আছে। হাতে দেখলাম একটা করে মাংসের টুকরো।

দামিনীমাসি বেরিয়ে এলো। বড়োমা দামিনীমাসিকে বরফির কথা বললো।

তুমি ওকে দাও নি! দামিনীমাসি গম্ভীর কিন্তু হাসছে।

কেন ওরা সব খেয়ে নিয়েছে?

মনেহয়, তখন যেভাবে কামড়া কামড়ি করছিল বাক্স নিয়ে।

দামিনীমাসি রান্নাঘরে গেল।

তনু, মিত্রা মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসছে।

কিরে তোরা হাসছিস। বড়োমা খ্যাঁক করে উঠলো।

কি করে জানবো, ওকে দাও নি।

তার মানে!

ইকবালভাই আবার এনে দেবে।

রাক্ষসের বংশ। অতগুলো আনলো একটা রাখতে পারলি না। লুভী কোথাকার।

নাতি, নাতনিদের বলতে পারছো না। আমাকে একা বলছো কেনো।

তুই তো পালের গোদা, সকলকে নাচিয়েছিস।

ভালো জিনিসের সদ্ব্যবহার করতে হয়। মিত্রা হাড় চুষছে।

হিংশুটে কোথাকার।

বড়োমা এমনভাবে কথাটা বললো। মিত্রা, তনু দুজনেই শরীর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করলো।

তনু উঠে পর। ছেলে বরফি পায় নি। মাথা এখন ফোরফর্টি ভোল্ট।

ছোটোমা মুচকি মুচকি হাসছে।

দামিনী। বড়োমা তারস্বরে চেঁচালো।

একটাও নেই দিদি। দামিনীমাসি রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে।

থাকবে কোথা থেকে। আরও দুটো এসে জুটেছে।

মিত্রাদের দিকে তাকালো।

পালের গোদা দুটোর জন্য ফ্রিজে কিছু রাখার যো নেই। এবার থেকে ফ্রিজে তালা মেড়ে রাখবো।

প্লিজ চাবিটা মাঝে মাঝে দিও, আর বিরক্ত করবো না।

কথাটা বলেই তনু, মিত্রা দুজনেই উঠে দাঁড়াল।

দামিনী—

হ্যাঁ দিদি—

ফ্রিজে আর কোনও মিষ্টি নেই?

দুটো রসগোল্লা পরে আছে।

সব শেষ!

এতো লোকজন এলো।

তুমি আর সাউকিরি করো না। নিয়ে এসো ওই দুটো। আর কাউকে খেতে হবে না।

ঘরের সবাই বড়োমার দিকে তাকায়, আর এদিক ওদিক মুখ ঘুরিয়ে হাসে। অনিকা প্রথমে বুঝতে পারেনি। পিকু ওকে ব্যাপারটা বুঝিয়েছে। চোখ পাকিয়ে মুখে হাতচাপা দিয়ে হাসছে।

বড়োমার চোখ পড়ে গেছে।

এই মেয়ে তুই হাসছিস কেনরে—ওদের দলে যোগ দিয়েছিস—

অনিকা জোড়ে হাসতে গিয়েও হাসতে পারছে না। চেপে রেখেছে। অদ্ভূত লাগছে মুখটা।

দামিনীমাসি প্লেটে করে মিষ্টি নিয়ে এলো।

তুমি খেয়েছিলে? বড়োমার দিকে তাকালাম।

খাব কিরে! ছোটো সকাল থেকে জলস্পর্শ করেনি। বললো অনি এলে তবে খাব। তোর দাদা, দিদি আর মল্লিককে একটা করে দিয়ে ফ্রিজে রেখেছি। পঞ্চাশ/ষাটটা বরফি সব ফাঁকা! ও মা রাঘবনের মেয়ে জামাইটাও সেরকম, ঠিক এদের সঙ্গে ভিড়ে গেছে।

সকলেই বড়োমার কথায় কমবেশি হাসছে।

মাসি চামচে নিয়ে এসো।

কেনো! ওটুকু আর ভাগ করতে হবে না।

তাহলে আমি উঠলুম।

দামিনী চামচ নিয়ে এসো।

মাসি হাসছে।

চারটে টুকরো বানাও। একটা তুমি হাফ আর ছাটমা। আর একটা আমি হাফ আর দামিনীমাসি।

তাহলে তুই কি খেলি?

মাসি।

বল। মাসি রান্নাঘর থেকে চেঁচালো।

রসোগোল্লার হাঁড়িতে রস আছে।

মাসি রান্নাঘর থেকে মুখ বার করলো। হাসছে।

সেটাও নেই! বড়োমা চোখ বড়ো বড়ো করলো।

ইকবালভাই আর থাকতে পারলো না। জোড়ে হেসে উঠলো।

সেটাও খেয়েছে!

সুন্দর, বোচন তখন চেয়ে নিয়ে গেল।

দু-দিন পর এরা আমাকে গিলে খাবে।

বড়োমা কনটিনিউ বকে যাচ্ছে। ঘরের সবাই হাসছে, কেউ শব্দ করছে, কেউ করছে না।

দামিনীমাসি চামচ নিয়ে এলো।

দিদান। সুন্দর আর বোচন ভেতরে এলো।

আবার কি খেতে এসেছিস—

তুমি নাকি ঝামেলা শুরু করে দিয়েছো, মা গিয়ে বললো।

অনন্য বড়োমার সামনে এসে গেঞ্জিটা তুলে দাঁড়ালো।

কি হলো?

পেটে হাত বোলাও দেখবে বরফি বেরিয়ে আসবে।

বড়োমা উঠে দাঁড়াতে গেল।

বোচন চেপে বসিয়ে দিল। গলাটা জড়িয়ে ধরলো।

আমার গায়ের জোড়ের সঙ্গে পারবে।

মাসিদিদা চার টুকরো করেছে সাঁটিয়ে দাও, নাহলে ওটাও পাবে না।

বড়োমা কোনও কথা বলতে পারছে না।

মাসিদিদা। অনন্য ডাকলো।

দামিনীমাসি তাকালো।

ঠ্যাং-ঠুং নেই, মুখটা কেমন শুর শুর করছে। একটু চিবোতাম।

দামিনীমাসি না পারছে হাসতে না পারছে কথা বলতে।

ছোটো তুই এদের সামলা আমি আর পারবো না। বড়োমা বললো।

আমি একটা টুকরো মুখে দিয়ে বেসিনের কাছে চলে এলাম।

অনিকা বড়োমার পেছনে দাঁড়িয়ে তখনও কঁত কঁত করে চলেছে।

আমি মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলাম। বারান্দায় এসে দেখলাম একদিকে দাদারা সকলে বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে, আর একদিকে রতনরা রয়েছে। হাত দেখালাম। দাঁড়া আসছি।

ঘরের দরজা বন্ধ। নক করলাম।

ভেতরে আয়, খোলা আছে। মিত্রার গলা পেলাম।

দরজা খুলে ভেতরে গেলাম। সবাই ইচ্ছে মতো খাটে শুয়ে গড়াচ্ছে।

অনিদা ঝামেলা মিটল। টিনা বললো।

এখন সুন্দর-অনন্য ভার্সেস মাসি-বড়োমা চলছে।

বড়োমার দমও আছে। সেই সকাল থেকে শুরু করেছে।

কি গালাগাল, কি গালাগাল। ইসলামভাইকে ধুয়ে মুছে পুরো সাফ করে দিল। তারপর রতনদাদের বলে কী ঝেঁটিয়ে যমের দক্ষিণ দুয়াড় দেখিয়ে দেব। ঘণ্টা, পক্কে আসতে একটু শান্ত হলো।

কনিষ্করা কোথায়?

ওপরে সুখ নিদ্রায়। মিলি বললো।

এখন!

বললো সকাল থেকে অনি অনেক ঝামেলা করেছে। খাওয়াটাও বেশি হয়ে গেছে, ওর অনারে একটু ঘুমিয়ে নিই। রাতে আবার আবিদের রিসেপশন।

বনি, নাগেশ?

সকালের টেনশনটা ঠিক মতো নিতে পারলো না। বললো, একটু সিনেমা দেখে আসি।

কে নিয়ে গেল?

রবীনদা।

মামীমা। অনিকার গলা।

আয় ভেতরে আয়।

অনিকা ভেতরে এলো।

এসে একটু গড়িয়ে নে। সকাল থেকে অনেক ধকল গেছে। মিলি বললো।

বড় পিসি তোমায় ডাকছে। মিত্রার দিকে তাকাল।

কেনো?

কারা এসেছে।

অনিকা আমার দিকে তাকাল।

অনিমামা।

কি হলো।

আমার কেমন সব গুলিয়ে যাচ্ছে।

কেন?

কাকে কি বলে ডাকবো?

যা মনে-প্রাণে চায় তাই বলে ডাকবি। তারপর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।

মিলি হাসছে।

আয় আমার কাছে আয়। এ তো কিছুই নয়, আরও পঙ্গপাল আসছে। একদিনে তোর মাথার সব স্ক্রু ঢিলে হয়ে যাবে। কাকে মামা বলেছিস এবার বুঝতে পারছিস?

যাই নাহলে এখুনি এসে হাজির হবে। মিত্রা অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠলো। তনু তখনও শুয়ে হাসছে।

তোরও ডাক পড়বে। মাথা ঘুরিয়ে মিত্রা বললো।

মিত্রা বেরিয়ে গেল।

আমি টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে এলাম।

বাগানের এক কোনে মাম্পি, মিকি সবার সঙ্গে হুড়ো হুড়ি করছে। পিপটুও আছে দেখছি। ভাষা যে কোনও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে না। তা ওদের দেখে বোঝা যাচ্ছে। কেউ কারুর ভাষা বুঝছে না। কিন্তু ঠিক একে অপরের সঙ্গে কথা বলে চলেছে। মাঝে মাঝে মাম্পির তারস্বর গলা ভেসে আসছে। নেহি।

আমি রতনদের দিকে এগিয়ে গেলাম। ওরা উঠে দাঁড়িয়েছে।

চেয়ারগুলো নিয়ে এদিকে আয়।

আমি বাগানের একবারে পেছন পাশে চলে এলাম। ওরা পেছন পেছন এলো।

আমগাছের তলায় গোল করে চেয়ার পাতলো। আমি বসার আগেই চাঁদ, চিনা জড়িয়ে ধরলো।

তোদের দু-টোর সাথে অনেক দিন পর দেখা হলো।

তুমি তো আমাদের খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছ।

তাহলে এসেছিস কেন?

চাঁদ, চিনা দু-জনেই হাসছে।

আমি চেয়ারে বসলাম।

নেপলা সিগারেট দে।

চাঁদ, চিনার চোখ বড়ো বড়ো।

রতনদার কাছ থেকে নাও, আমার শেষ।

তুমি সিগারেট খাও? চাঁদ বললো।

দু-একটা। নেপলা বললো

রতন পকেট থেকে বার করলো।

তোর মুখটা এরকম ভ্যাটকানো কেনো? রতনের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

সকাল থেকে ঝাড় খেয়ে খেয়ে পেট ভরে গেছে। নেপলা বললো।

আমি সিগারেট ধরালাম।

কে ঝাড় দিল?

তোমার ওপর এতো রাগ হচ্ছে না। রতন গম্ভীর থাকতে পারলো না।

কেন?

কাল রাতে একবার হিন্টস দিতে পারলে না।

কি করতিস?

আবিদটাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলতাম।

হাসলাম।

শালা ঘাউড়া কোথাকার। আমরা এখনও তোমাকে মেপে উঠতে পারলাম না। ও বৌয়ের কথায় নেচে কুঁদে আটখান।

দোষ ওর নয়।

তুমি আর ওকে সাইড কোরো না। আজেকর দিনটা কোনওপ্রকারে কাটুক। কাল থেকে শুরু করে দেব।

তুই ওর কথায় নেচেছিস কেন?

আমি নাচি নি। ভাইদাদা প্রেসার করলো।

তুই বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলি না কেন?

যখন করলাম তখন খেল খতম।

কেন? কাল রাতে তোকে একটা হিন্টস দিয়েছি।

সেটা অনেক পরে বুঝলাম।

আগে বুঝিস নি কেন?

ওখানেই গড়বড়ি হয়ে গেছে।

বয়স অনেক হলো, হাতে ধরে আর কতো শেখাব। তোকে বলে যাব, জানিস রতন আমি নেপলাকে নিয়ে নাসরিনের খোঁজ করতে যাচ্ছি। নাসরিন ইসলামভাইয়ের মেয়ে।

আর বোলো না নিজের ওপর নিজেরই রাগ হচ্ছে।

চাঁদ ব্যবসার খবর কি?

ভাল।

অবতারের টাকা ফেরত দিয়েছিস?

শুয়োর তুই বলেছিস অনিদাকে।

চাঁদ, চিনাকে লাথি মারলো। চিনা উঠে চাঁদের গলা টিপে ধরেছে।

তুই গজব করবি আমরা সাফার হবো কেন। বেশ করবো বলবো অনিদাকে।

রতন হাসছে।

ছাড়। আমি বললাম।

দু-জনেই হাসছে।

নেপলা মোবাইলটা দে।

দিচ্ছি। যে সেসানটা চালু করলে সেটা শেষ হোক।

বুঝলি রতন চাঁদ আর চিনার দ্বারা কিছু হবে না। মাথায় বড়ো বড়ো প্ল্যান কিন্তু কি করে ইমপ্লিমেন্ট করতে হয় সেটা জানে না। তুইও ঠিকমত দেখছিস না।

কতো দিকে মাথা গলাই বলো। রতন বললো।

চাঁদ।

বলো।

অবতারের কাছ থেকে টাকা টানলি ইন্টারেস্ট দিবি।

তুমি ওদের নিজের হাতে তৈরি করেছো, আমাদের করোনি।

এবার করবো।

চাঁদ চেয়ার থেকে নেমে পা ধরে ফেললো।

কবে থেকে বলো।

এতে পা ধরার কি হলো!

তোমার কাছে তৈরি হবো একটু পা ধরবো না।

অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। ওঠ। তোর ফাইল পত্রগুলো কাল নিয়ে আসবি।

সব হিমাংশুদার কাছে।

হিমাংশুকে বলবি দাদা চেয়েছে।

চাঁদ চুপ করে গেল।

এ বছরেরটা দেখো না, গত বছরেরটা দেখো।

বুঝে গেছি।

চিনা হাসছে। চিনার দিকে তাকালাম।

তুই আবার নিজে বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু কাজ করতে পারিস না। কখনও আবিদের পেছন ধরিস কখনও রতনের পেছন ধরিস। টাকা হাতে এসে গেলে ফুর্তি করে উড়িয়ে দিস।

কখনই না।

লিস্ট দিয়ে দেব।

শেষ কাজটা শুধু একটু হেল্প নিয়েছি।

নেপলা উঠে গিয়ে চিনার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

কি হলো!

হাতটা মেলা।

কেন?

আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। নেপলা চিনার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

তোকে তখন বলেছিলাম, দাদা তোর পেট থেকে কথা বার করে নেবে। তুই সাবধানে থাকবি।

কই বললাম!

তুই বলেছিস দাদাও বুঝে গেছে।

চিনা নেপলার দিকে তাকিয়ে। রতন হাসছে।

তোকে আর খোলসা করে বলতে হবে না। আমি চাঁদের কাছ থেকে ছেলে নিয়েছি।

রতন হাসছে।

তুই একটু ভাব তুই কি বললি।

চিনা জিভ বার করে ফেলেছে।

তোর সঙ্গে দাদা গল্প করলো, তোকে কিন্তু দাদা কিছু জিজ্ঞাসা করে নি। করেছে?

চিনা হাসছে।

রতন সকালে অনিমেষদা এসেছিল?

হ্যাঁ।

ঘটনাটা কি একটু বল।

আমাকে দানা করার জন্য ওমরকে পাঠিয়েছিল। চিনা বললো।

রতন কট কট করে চিনার দিকে তাকালো।

তোকে জিজ্ঞাসা করেছে।

কেন দাদা সব বুঝে ফেললো।

দাদার মাথাটা তোর মতো গোবর পোড়া।

চিনা, রতনের দিকে তাকিয়ে আছে।

নেপলার কাছে দাদার ফোন আছে। এখনও দাদাকে দিয়েছে?

চিনা অবাক চোখে ঘার নাড়াচ্ছে।

আমি, নেপলা, তুই, চাঁদ কতবার চেষ্টা করলাম নম্বরগুলো ডেল করার জন্য। পারলাম।

চিনা মাথা দোলাচ্ছে। না।

পাসওয়ার্ড চাইছিল?

হ্যাঁ।

দাদা নম্বর দেখলেই বুঝে যাবে। কে কখন কি কারণে ফোন করেছে।

চাঁদ, চিনা চেয়ার নিয়ে রতনের কাছে এগিয়ে এলো। নেপলা হাসছে।

শোন দাদা মাছ ধরার আগে চার ফেলে রাখে। যা দরকার তার থেকে বেশি ফেলে। লোভের মারে গিললেই ধরা পড়ে যাবি।

আজ সকালে পার্ক হোটেলের অসীমবাবু এসেছিলেন, কি বললেন? ভাল করে বোঝার চেষ্টা করেছিস—

চাঁদ, চিনা দুজনে রতনের দিকে হ্যাঁ করে তাকিয়ে।

করিসনি—

দু-জনেই আলতো করে মাথা দোলাল।

তোকে দাদা সকালে পার্কে যেতে বলেছে।

হ্যাঁ।

তার আগে যা কথা বলার অসীমবাবুর সঙ্গে কথা বলে বুঝে নিয়েছে। এবং এও বুঝে নিয়েছে গেম হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। শেষ অস্ত্র ফাদার। নিজে না বলে উসমানকে দিয়ে বলিয়েছে, আমি কাল যাব।

তার মানে?

উসমান যদি নাসরিনকে ফোন করে ভাল, না হলে ফাদার ফোন করবেই নাসরিনকে। নাসরিন দাদাকে দেখার জন্য পাগল। নাসরিনের প্রতি ফাদার দুর্বল। আয়েষা যদি নাসরিন হয়, কিছুতেই কাল যাবে না। অরিজিন্যাল নাসরিন সামনা সামনি চলে আসবে। নাসরিনকে একমাত্র দাদাই অনিকা বলে ডাকতো, আর কেউ ওই নামে ডাকতো না একমাত্র ফাদার ছাড়া।

কখনও ফোনে ভুলেও দাদার মুখ থেকে অনিকা নামটা শুনেছিস।

একবারে না। তাহলে ঘণ্টা, পক্কে? চিনা বললো।

একমাত্র ঘণ্টা, পক্কেই নাসরিন কোথায় থাকে জানতো। তুই দাদাকে তার ইনফর্মেশন দিয়েছিস। তোকে যে ঠিকানা দিয়েছিল অসীমবাবু, সেখানে গিয়ে তুই নাসরিনকে পেয়েছিস?

চিনা মাথা দোলাচ্ছে।

ধর ফাদার ফোন করার পরও নাসরিন গেল না। তখন ঘণ্টা, পক্কে নাসরিনকে নিয়ে আসতো।

তোকে দাদা ফোন করে কি বলেছিল?

ওদের তুলে নিয়ে আসবি, কিন্তু কোনও অসুবিধে যেন না হয়।

বলেছিল কি ওদের মোবাইলটা পকেট থেকে নিয়ে নিবি?

না।

তুই মোবাইলটা নিয়েছিলি?

না।

তারমানে ওপেন গেম। তোকে কেউ তুলে নিয়ে যাবে। তোর পকেটে মোবাইল থাকবে তুই পরিচিত লোকজনের সঙ্গে কথা বলবিনা তা হয়—

দাদা বলেছিল নিজের লোক।

নিজের লোক আমরাও।

তুই কিন্তু জানতিস ঘণ্টা, পক্কে দুজনেই আবিদের কাছে কাজ করে।

চিনা মাথা দোলাচ্ছে।

ওদের তুই তুলে নিয়ে যাবি। ওরা ওদের বসকে ফোন করবে না তা হয়।

ঠিক।

আবিদকে ফোন করার মানে কি? আয়েষা জানবে। আয়েষা কাল পর্যন্ত ইসলামভাইয়ের মেয়ে হিসাবে জানতাম। আমরা কতো হাসাহাসি করেছি। তুইও তাতে যোগ দিয়েছিস।

তারমানে ইসলামভাই একটা ডাস্ট্রিক এ্যাকসন নেবে সেটা জানা কথা।

এটা অনিদা সব জানতো। জেনে শুনেই একটা ব্যুহ্য রচনা করলো।

অনিদার ফোন কার কাছে না নেপলার কাছে।

তুই অনিদাকে ফোনে পাচ্ছিস না। অতএব কোনও ডিসিসান নিতে পারবি না।

অতএব অনিদা যতক্ষণ না ফিরছে তোকে অপেক্ষা করতে হবে।

এর মধ্যে যদি তেমন কোনও ঘটনা ঘটতো তাহলে নেপলা অনিদাকে ফোন দিতো। ঘটেনি। ফোন দেওয়ারও কোনও প্রশ্ন নেই।

যদি সেরকম কিছু হতো অনিদা তোকে দিয়ে কাজটাই করাতো না। না জানতিস তুই না জানতাম আমি। কাজ শেষ সব জানতে পারতাম।

মাঝখান থেকে কি হলো। টেনশনে অনিদার শরীরটা গরবর হয়ে গেল। সেটাও তুই জানলি অনিদা ফিট হওয়ার পর।

তাহলে অর্জুন কেশ।

আমি নেপলার দিকে তাকালাম।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/Buv86Yk
via BanglaChoti

Comments