কাজলদিঘী (১২৩ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১২৩ নং কিস্তি
—————————

সামান্য দাপাদাপিতে ঘুমটা ভাঙলো। উপুর হয়ে শুয়ে আছি। বুঝলাম পিঠের ওপর খুব জোড় যুদ্ধ চলছে। জায়গা দখল নিয়ে। মিলির মেয়ে, সুরোর ছেলে। চুপ চাপ ঘুমের ভান করে পরে রইলাম।

একজন যদি পিঠের ওপর শুয়ে পরে। তার ওপর আর একজন শুয়ে পরে।

কোস্তাকুস্তি, ধস্তাধস্তি।

একজন কানে আঙুল দেয় তো আর একজন নাকের ফুটোয় আঙুল চালিয়ে দেয়। সুর সুর করে ওঠে। দু-জনে দু-জনের সঙ্গে ত ত করে কতো কথা বলে চলেছে। কিছুটা বুঝতে পারছি। বেশির ভাগটাই দুর্বোধ্য। ওদের নরম শরীরের দাপাদাপিতে বেশ আরাম লাগছে। সামান্য ঝিমুনি ভাব।

তাই বলি দুটোতে গেল কোথায়, তোরা কি মানুষটাকে একটু সুস্থির ভাবে ঘুমতেও দিবি না। তবে-রে দেব দুটোকে।

মনেহয় তেরে এলো, দুজনে পিঠ থেকে নেমে খাটের এক কোনায় চলে গেলো। হাসছে।

ভেবেছিস খাটে উঠতে পারবো না।

আয় এদিকে আগে।

আঙ্কেলকে বলে দেবো।

আঙ্কেলকে বলে দেবো। মুখ ভ্যাঙচালো। আঙ্কেল কি তোর বাপ।

বালিশের থেকে মুখ তুলে তাকালাম।

মিলি একবারে খাটের কাছে দাঁড়িয়েছিল। চোখা চুখি হলো। হেসে ফেললাম।

মিলি মুখে কাপর চাপা দিয়ে দৌড় মারলো।

দু’টতেই লাফিয়ে উঠে হাততালি দিচ্ছে।

ওদের দিকে তাকালাম। কাছে ডাকলাম। নিমেষে চলে এলো। মিলির মেয়েটার কোলে মাথা দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।

আঙ্কেল তুমি আমার ছেলে।

মাথা দোলালাম।

তোমার বাবা কে। সুরোর ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরলাম।

প্রচণ্ড হাসির শব্দে মাথাটা একটু উঁচু করলাম। দেখলাম ইসি আর সুরো দরজা দিয়ে ঢুকছে।

হেসে ফেললাম।

ঘুম ভাঙলো।

বালিশটা নিয়ে আবার উপুর হয়ে শুলাম।

ওরা দুটোতে আবার পিঠে চড়ে বসেছে।

ওকিরে আঙ্কেলের লেগে যাবে।

আঙ্কেল আমার ছেলে, ও বাবা। সুরোর ছেলেকে দেখালো। মিলির মেয়ে কট কট করে উঠলো।

ওরা হেসে গড়িয়ে পরে।

তোকে এসব কথা কে শেখালো?

বারবি বলেছে।

সুরো কপালে হাত ঠেকিয়েছে।

পাছায় দেব এক থাপ্পর, দাঁড়া তোর পাকা পাকা কথা বার করছি।

আঙ্কেল তুমি ঘোড়া হও তো।

পড়ে যাবি। আমার গলা ধর।

ওরা গলা ধরে রইলো। আমি কিছুক্ষণ ঘোড়া হলাম।

তারপর দুজনে পিঠ থেকে নামলো।

ইসি হাসছে।

সকাল থেকে সবাইকে আসতে বলে দিয়ে নিজে পরে পরে ঘুমচ্ছিস।

কাউকে আসতে বলিনি।

সুরো আমার হাতদুটা টেনে নিয়ে ভালো করে ওপর নিচ করে দেখলো।

কি দেখলি?

ওঠো, বিছানা গোছাতে হবে।

সে তো বুঝলাম।

বুঝে আর কাজ নেই। দাঁত মেজে ওষুধ খেয়ে নাও। অনেক বেলা হয়েছে।

বৌদি আসে নি?

সব এসেছে। ওঠো ওঠো।

হাত ধরে টান মারলো।

খাট থেকে নিচে নেমে এলাম।

বাচ্চা দুটো দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কাল কখন ফিরলি? ইসি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

সারেদশটা এগারটা হবে।

কোথায় ছিলি?

কেন তোর বোন-ঝি কিছু নালিশ করে নি।

হাসছে।

হোলো। ঘুম থেকে উঠলে কতো প্যাঁচ পয়জার করে জানবে বলেছিলে, খাটলো?

সুরো, ইসির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো।

বিছানার চাদরটা গুছিয়ে একদিকে ভাঁজ করে রাখলো। আর একটা চাদর পেতে দিল।

আমি টেবিলের ওপর থেকে ব্রাশে মাজন লাগিয়ে বাথরুমে গেলাম।

কাল মেয়ের ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারলাম না। ও সব কিছুই বললো, কিন্তু অনেকটা বুড়ি ছোঁয়া গোছের। আসল জায়গাটা খুব সন্তর্পণে উহ্য রাখলো। আজ কোথাও বেরোব না। আলমাড়িটা খুলে একবার দেখে নিতে হবে সব কিছু ঠিক ঠাক আছে কিনা।

কিগো আর কতোক্ষণ? তুমি একেবারে সন্ধ্যে করে দিলে।

মেয়ে দরজায় ধাক্কা মারছে।

তারাতারি স্নান সেরে বেরিয়ে এলাম।

কি করো কি এতক্ষণ?

পার্টে পার্টে সব কাজ শেষ করতে হয়। সময় লাগবে না।

মা বিরক্ত হতো না?

হতো হয়তো।

কিছু বলতো না?

তোর মা এদিক থেকে খুব ভালো মেয়ে।

মেয়ে পাজামা, পাঞ্জাবী এনে দিল।

ওষুধগুলো দে একবারে খেয়ে নিই।

মেয়ে টেবিলের কাছে গেল।

কনিষ্কমামা বললো আজ থেকে একটা ওষুধ বাদ।

যাক বাবা বাঁচা গেল।

এবার প্রতি সপ্তাহে একটা করে ওষুধ বাদ যাবে।

তারমানে এখনও চার সপ্তাহ! ততদিনে তোর মা চলে আসবে।

মেয়ে জড়িয়ে ধরলো।

আমি চলেগেলে তোমায় কে ওষুধ দেবে?

ও ঠিক ম্যানেজ করে নেব।

মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখটা কেমন ছলছলে হয়ে গেল।

ভাবিসনা ইকবালভাই, ইসলামভাই চলে আসছে। সুরো থাকবে বলেছে। তারপর মিলি, টিনা, অদিতিরা আছে। তারওপর তোর ইসিমনি, জ্যেঠিদিদা। লোকের অভাব?

মেয়ে ছারলো।

তুমি জামা-কাপর পরে ও ঘরে এসো।

যা যাচ্ছি।

ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে পাজামা পাঞ্জাবীটা গলিয়ে নিলাম। চুলটা আঁচড়ে নিলাম। আগের থেকে মুখের ছিড়ি ছাঁদটা একটু ভালো হয়েছে।

এঘরে এসে দেখলাম মিলি, সুরো দুজনে রান্নাঘরে গোঁতাগুঁতি করছে। দামিনীমাসি রান্নাঘরের সামনে বসে আনাজ কাটছে।

মাসি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

মিলি চা দাও। কনিষ্ক আসে নি?

মিলি আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসলো।

বুঁচকির ঘরে ঘুমচ্ছে।

ইসি, জ্যেঠিমনি আসে নি?

একটু বেলায় আসবে। পিসির বাড়ি থেকে সব এসেছে। ইসি বললো।

কেন?

পিসির ছেলের বিয়ে। ছুটকি ফিরে না এলে ডেট ফিক্সড করতে পারবে না। সেই নিয়ে কথা বলতে এসেছে।

বাপ, ব্যাটা?

অফিসে।

টেবিল থেকে কাগজটা তুলে দেখলাম।

মিলি চা নিয়ে এলো।

পরটা করেছি দুটো খাও।

দাও।

কাগজটা দেখতে দেখতে চা পরটা খেলাম।

কাগজের চেহারা চরিত্র বদলেছে। সন্দীপরা কাগজটার পেছনে বেশ খাটছে।

বাচ্চা দুটোকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।

মিলিকে জিজ্ঞাসা করলাম। ওরা কোথায়?

ভজুদার সঙ্গে বাগানে গাছ লাগাচ্ছে।

সোফা থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে এলাম। কেন জানিনা দাদারা চলে যাবার পর এ ঘরে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না। বার বার মনে হয় বড়োমা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, কিছু খাবি। দাদাকে অনন্য ধরে ধরে নিয়ে এসে সোফায় বসাচ্ছে।

টেবিলের ওপর থেকে পামটপটা নিয়ে এসে সোফায় বসলাম।

অন করে নিজের মেল বক্সটা খুললাম। প্রচুর মেল জমা হয়েছে। বেশির ভাগ বাইরের। মিত্রা, তনু, সুন্দর, অনন্য সবাই মেল করেছে। প্রত্যেকটা মেলের উত্তর দিলাম।

মেয়ে ঘরে ঢুকলো।

বাবা পামটপ খুলে বসেছে….। কানে ফোনটা ধরা।

মেয়ের দিকে তাকালাম।

মা।….ধরো কথা বলো।

মেয়ে আমার হাতে ফোনটা দিল।

হ্যালো।

কিরে, গল্প শুনিয়ে মেয়েকে কাঁদিয়ে দিলি।

হাসলাম।

হাসছিস যে।

কি বলবো। মেয়ের মা একদিন কেঁদেছে, এখন মেয়ে কাঁদছে।

মেয়ে আমার হাত থেক ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে বললো, নাগো মা আমি কাঁদি নি।

ভয়েজ অন করা ছিল।

মাসিদিদা তাহলে মিথ্যে কথা বললো বল?

না তা নয়, গল্পটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

বাবাকে ওষুধ দিয়েছিস?

পরটা চা খাওয়া হয়ে গেল।

বাবাকে দে।

তোমার কথা বাবা শুনছে।

ভয়েজ অফ কর।

না করবো না। তুমি আমার নামে বাবাকে লাগাবে।

মিত্রা হাসছে।

মেয়ে আমার হাতে ফোনটা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ভয়েজ অফ করলাম।

বল, দাদা কেমন আছে?

মেয়ে চলে গেছে।

হ্যাঁ।

দাদা খুব ভালো ইমপ্রুভ করছে। বুড়ো বয়সে মারপিট করতে ভালো লাগলো।

তোকে আবার এই খবরটা কে দিল!

তুই কি ভাবিস, তোর একার নেটওয়ার্ক আছে। আমারও আছে।

আরি ব্যাস, তাহলে এবার সন্ন্যাস নেওয়া যেতেই পারে।

ভৈরবী জোগাড় কর।

চাইলেই পেয়ে যাব।

মুড়ো ঝেঁটা দেখেছিস।

হাসছি।

তনু কই।

পাশে শুয়ে আছে, তোর গলা শুনছে।

দুজনে মিলে লেগে পরেছিস নাকি!

দেখছো কি অসভ্য। তনুর গলা শুনতে পেলাম।

তুই শোন, আমি শুনে শুনে হদ্দ হয়েগেছি।

কবে যে দুই সখীকে নিয়ে শোব কে জানে।

এ জন্মে শুলেও কিছু হওয়ার নেই।

তা না হোক তবু….।

চলে আয়। সুযোগ হয়ে যাবে।

কটা বাজে ওখানে।

সবে ভোর হলো।

সবাই উঠেছে।

না, এখনও ওঠে নি।

জানলি কি করে?

মাসি কাল ফোন করেছিল।

কুট কুট করে লাগিয়েছে।

মিত্রা হাসছে। একটু আগে অনিমেষদা ডিটেলসে জানাল।

বাঃ তাহলে তো তোর বিরাট নেটওয়ার্ক।

হুঁ।

তনু।

বলো।

তোমার সঙ্গে আফতাবভাইয়ের কথা হয়েছে?

কয়েকদিন আগে এসেছিল। দাদাকে দেখে গেছে।

ওকে কে খবর দিল?

আমাকে ফোন করেছিল, সব বললাম। তখনই বললো আমি একবার দেখতে যাব।

তাই! কই আমাকে খবরটা দাও নি?

তোমার সঙ্গে আমার কথা হয়।

তা ঠিক। সত্যি কথা বলতে কি….।

কি হলো চুপ করে গেলে কেন।

না থাক। তোমরা ভালো থেকো।

কেন জানিনা ফোনটা কেটে দিলাম।

পাশে রাখলাম।

নিজের পামটপের অন্যান্য মেলগুলো সব চেক করলাম।

আফতাবভাইকে একটা মেল করলাম। দাদাকে দেখে আসার জন্য কৃতজ্ঞতা জানালাম।

অনাদির ডকুমন্টসগুলো অগোছাল হয়ে পরেছিল। ধীরে ধীরে সব এক জায়গায় নিয়ে এসে একটা ফোল্ডারে রাখলাম।

অনাদি এখনও বেল পায় নি। পুলিশ এখনও চার্জসিট দেয় নি। নব্বইদিনের মধ্যে দিতে না পারলে ও এমনিই জামিন পেয়ে যাবে। ওই দিকটা নিয়ে একবারে নারাচারা করি নি। এবার ওই দিকটায় মন দিতে হবে।

অনিমেষদাকে শর্ত দিয়েছিলাম মাস খানেকের মধ্যে সুকান্তর ব্যাপারটা ফাইন্যাল করতে হবে। সেটাও খোঁজ খবর নিই নি। সুমন্ত মাঝে একদিন কথায় কথায় বলেছিল, সুকান্ত এখন বিন্দাস আছে। এই পর্যন্ত।

বাবা।

দরজার দিকে তাকালাম।

দেখলাম পদু, ঝুনে দাঁড়িয়ে।

পামটপটা ছোট টেবিলের ওপর রেখে সোফা থেকে উঠেগেলাম।

ঝুনেকে এখনও দেখতে সেইরকম রোগা প্যাটকা তবে গায়ে সামান্য মাংস লেগেছে।

আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

আমি ভাবিনি তোর সঙ্গে আবার এই জীবনে দেখা হবে।

কেন!

কাগজে কলমে তোর সব কথা জানতে পরি। মাঝে মাঝে ভাবতাম একবার তোর কাছে এসে দাঁড়াই কিন্তু আবার ভাবতাম, তুই যদি চিন্তে না পারিস।

ঝুনের পেটে একটা খোঁচা মারলাম।

তুই কালকে আমাকে মিথ্যে কথা বললি কেনো? পদু বলে উঠলো।

মিথ্যে কথা!

বাঃ তুই বলিস নি, ভালো মেয়ে পাচ্ছিস না বলে বিয়ে করতে পারিস নি।

মেয়ে খিল খিল করে হেসে উঠলো।

পদু আঙ্কেলরা সকালে এসেছিল, তুমি ঘুমচ্ছিলে বলে চলে গেছিল। বললো, তোর বাবাকে একবারে বলবি না। আমরা ঘুরে আসি তারপর দেখাচ্ছি।

পদু আঙ্কেল, ঝুনে আঙ্কেলের জন্য একটু খাবার আর চা নিয়ে আয়।

সকালে পেট ঠেসে পরটা খেয়ে গেছি দু-জনে। পদু বলে উঠলো।

কটায় এসেছিলি?

সাতটা দশ পনেরো হবে।

তাই! কাল রাতে ঘুমোস নি?

সে অনেক কথা। বলছি তোকে।

মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে?

ঝুনে, আমি তো গুছিয়ে বলতে পারবো না। তুই ওর বায়োডাটাটা দিয়ে দে। পদু বললো।

ঝুনে হাসছে।

তিনজনে এসে সোফায় বসলাম।

ঝুনে এখনও সেরকম লাজুক লাজুক, কম কথা বলে।

খুব অবাক হয়েছিস নারে ঝুনে?

অবাক বললে কম বলা হবে, আমি কখনও কল্পনাই করতে পারি নি, এরকম একটা ঘটনা সত্যি সত্যি আমার জীবনে ঘটতে পারে।

পদু বললো, আমিও ভাবতে পারি নি বিশ্বাস কর ঝুনে। ওকে তো দেখে প্রথমে চিনতেই পারি নি। নাম বলতে জড়িয়ে ধরলাম।

তুই সরকারি চাকরি করিস। কোন ডিপার্টমেন্টে আছিস।

ইউনিভার্সিটিতে আছি। রেজাল্ট সেকসনে।

বাঃ। ভেঁদোদা কেমন আছে পদু?

ভেঁদোদা এখন চিফ মিনিস্টার।

হেসে ফেললাম।

হাসিস না। ঝুনেকে জিজ্ঞাসা কর। আমাদের পর্যন্ত পরিচয় দিয়ে ভেঁদোদার কাছে পৌঁছতে হচ্ছে।

আমি হেসেই চলেছি।

আর একটা ব্যাপার হয়েছে।

পদুর দিকে তাকালাম!

জানিস অনি। চিটিংবাজ, ঢপবাজ, বাওলিবাজ পদু রাতারাতি সমাজসেবী হয়ে গেছে।

পদুর গলাটা ধরে এলো। হয়তো চোখটাও ছল ছল করে উঠলো। মাথা নীচু করে আছে।

ওরকম বলছিস কেন?

না-রে অনি, সত্যি বলছি।

মাথাটা তুললো।

এই রাতটা আমি সারাজীবন মনে রাখবো। একটা রাত আমাকে জিরো থেকে একবারে হিরো বানিয়ে দিয়েছে। কালকে তোকে বার বার বলেছিলাম, অনি পালিয়ে যাই। তুই ধমক লাগালি। কেমন যেন তোর কথার ওপর নির্ভর করে রয়ে গেলাম। তোর কথা না শুনে সত্যি যদি পালিয়ে যেতাম, তাহলে হয়তো নিজেকে আজ ক্ষমা করতে পারতাম না।

কেন একথা বলছিস?

কালকে আমি থানায় ঢুকতে চাইছিলাম না। তুই বলেছিলি কেন যাবি না, চল। তোকে বলেছিলাম পরে বলবো।

মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এখন বলি।

মেয়ের দিকে তাকালাম।

পদু হাসলো।

যার বউ, মেয়ে চিটিংবাজ বলে। ওতো আমার মেয়ের মতোই, শুনুক, আমার কোনও অসুবিধে নেই।

মেয়ে মাথা নীচু করে নিল।

আমি ওই থানায় তিনরাত কাটিয়ে এসেছি। সৌজন্যে চাঁদু চৌধুরী। উনিই আমাকে প্রথম চিটিংবাজ স্ট্যাম্পটা আমার পেছনে গুছিয়ে সাঁটিয়ে দিয়েছিলেন। তখন এই ওসিটা ছিল না। তবে সেই সময়কার কয়েকজন অফিসার এখনও রয়ে গেছে। কাল তারাই দেখলাম সিগারেট চা খাওয়াচ্ছে। পুলিশের পয়সায় কোনওদিন চা সিগারেট খাবো, এতোটা ভাবি নি। বার কয়েক স্বপ্নে দেখেছি, কাল সত্যি হলো।

ভেঁদোদাকে ওষুধ খাইয়েছিস?

সে সুযোগ আর আমার কপালে জোটে নি।

তার মানে!

অনিসা, মা একটু জলের বোতলটা দে না। গলাটা একেবারে শুকিয়ে গেছে।

অনিসা টেবিলের ওপর থেকে জলের বোতলটা নিয়ে এসে পদুর হাতে দিল।

মিলি একবার উঁকি মারলো।

চা দিয়ে যাই।

পদু জল খেতে খেতেই বললো, ম্যাডাম একটু কড়া করে।

বোতলের ছিপিটা আটকে আমার দিকে তাকাল।

কাল তুই চলে আসার পর আমি ওষুধ কিনতে গেলাম। ওষুধ নিয়ে এসে ওপরে গিয়ে দেখি ওসি ভেঁদোদার সঙ্গে কথা বলছে। ভেঁদোদাও টুক টুক করে কথার উত্তর দিচ্ছে, না হলে চুপ করে আছে। আমাকে দেখে হাউ হাউ করে আবার কেঁদে উঠলো।

পাঁউরুটি কলা খাইয়ে ওষুধ খাওয়ালাম।

ভেঁদোদার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শুইয়ে দিলাম। নিচে নেমে এলাম।

একজন কনস্টেবল বললো, বড়োবাবু আপনাকে ডাকছেন।

আবার বড়োবাবুর ঘরে গেলাম।

তখন দেখলাম বড়োবাবু রাগে ফুঁসছেন।

আমাকে দেখে বললেন, আপনি আমার একটা উপকার করতে পারবেন।

আমতা আমতা করে বললাম, বলুন।

খাওয়া দাওয়া হয়েছে?

না।

আপনি এক কাজ করুন চট করে বাড়ি থেকে খেয়ে আসুন। আপনাকে গাড়ি করে নামিয়ে দিচ্ছে।

তুই নেই, ভাবলাম এ কি গণ্ডগোলে জড়ালাম আবার। উনি মনেহয় আমার মুখ চোখ দেখে কিছু বুঝতে পারলেন, বললেন ভয় নেই, আপনি আসুন, একটা উপকার করবেন আমার?

গাড়ি করে পৌঁছে দিলেন। পাড়া তখন শুনসান। তবে এদিক ওদিক জটলা লেগেই আছে। আমি গাড়ি থেকে নামলাম। দু-জন আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিল।

বাড়িতে ঢুকতেই বৌ কান্নাকাটি জুড়ে দিল।

তুমি আর এই ঝামেলায় জড়িয়ো না।

আবার কিসের ঝামেলা!

বললো, চাঁদু এবং তার লোকজন গিয়ে বৌকে মেয়েকে ধমকে এসেছে। দেখে নেবে।

কেন জানিনা হঠাৎ করে জেদটা চেপে গেল। মনকে বোঝালাম যদি কিছু করার থাকতই তাহলে ওরা হুমকি দিত না, কাজে করে দেখিয়ে দিত। এর আগে তাই করেছে।

বৌকে মেয়েকে বুঝিয়ে দুটো খেয়ে চলে এলাম।

বৌ কেঁদে কেটে একসা।

ভাড়াটেগুলো বরং বৌকে বোঝালো। বড়োবাবু যখন ডেকেছেন পদুদাকে যেতে দাও, দেখি না শেষ পর্যন্ত কি হয়।

থানায় আসতেই বড়োবাবু বললেন, আপনি একবার আপনার বন্ধু ঝুনেকে নিয়ে আসুন। আমি মধ্যমগ্রাম থানার ডিউটি অফিসারকে বলে দিয়েছি। উনি আপনাকে সাহায্য করবেন। আমাদের গাড়িটা নিয়ে যান।

রাত তখন সাড়ে বারোটা পৌনে একটা। গেলাম প্রথমে মধ্যমগ্রাম থানায়। সত্যি থানার ডিউটি অফিসার সজ্জন লোক, ওনার গাড়িতেই ঝুনের বাড়ি গেলাম।

সে আর এক কাণ্ড। অতো রাতে ঝুনের বাড়িতে পুলিশের গাড়ি। হই হই করে পাড়ার লোক জন সব বেরিয়ে এলো। কি না কি হয়েছে। মাসিমা কেঁদে কেটে একসা। ঝুনেও অবাক। রক্ষে আমি ছিলাম। সব ঘটনা বললাম, মাসিমা বললেন, আমি যাব ভেঁদোকে দেখতে।

সেই ডিউটি অফিসার মাসিমাকে বোঝালেন আপনার কোনও চিনতা নেই, উনি ভালো আছেন, কিছু ফর্মালিটি আছে। তাই ওনাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

দু-জনে আবার থানায় ফিরে এলাম কাগজপত্র সইসাবুদ করে আমি ঝুনে থানায় পৌছলাম রাত আড়াইটে নাগাদ।

এসে দেখি হাট বসে গেছে। আমাদের পাড়ার সব ছোটো বড়ো নেতা হাজির।

আমাকে দেখে এই মারে তো সেই মারে। সব মুখে। চাঁদুবাবু রাজনীতির ডায়লগ আওড়াচ্ছেন।

তারপর শুনলাম আমি যাদের যাদের নাম বলেছিলাম, সব কটাকে তুলে এনে লকাবে ভড়ে দিয়েছেন বড়োবাবু।

দু-জনে ওসির ঘরে বসলাম, ঝুনেকে দিয়ে সব সইসাবুদ করাল। তারপর ভেঁদোদার কাছে গেলাম। দেখলাম অঘোরে ঘুমচ্ছে। ঝুনে একটু কান্নাকাটি করলো।

নিচে এলাম।

বড়োবাবু বললেন। আপনাদের বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি। কাল সকালে একবার আসবেন। ওনাকে পাভলভে ভর্তি করবো।

ঝুনেকে বললাম এতরাতে কোথায় যাবি, চল আমার ঘরে কোনওপ্রকারে শুয়ে পরবি।

চাঁদু তরপাচ্ছিল। ওসি দেখি শুধু এক কথা বলে, আপনার নেতাদের ফোন করুণ আর সিপির সঙ্গে কথা বলতে বলুন। কেশটা আমার হাতে আর নেই। সিপির কথা মতো আমি চলছি।

বুঝলাম জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে।

এই চাঁদু পার্টি অফিসে বসে ফোন করতো, আর বড়োবাবু ছেলেগুলোকে তুলে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিত। আজ সেই বড়োবাবু পুরো পাল্টি।

মিলি চা এনে টেবিলের ওপর রাখলো। মেয়ে খাটে বসে সব শুনছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

সুস্থ হয়েছো বোঝা যাচ্ছে।

ও অসুস্থ কোথায়, সকালে কি বললাম আপনাকে। পদু বললো।

মিলি মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল।

পদু চায়ে চুমুক দিল।

তারপর।

আবার পুলিশের গাড়িতে দু-জনে আমার বাড়িতে ফিরলাম। তখনও দেখি পাড়াভর্তি লোকজন। গজল্লা চলছেই। আমাদের দু-জনকে দেখে দু-একজন যে আওয়াজ দেয় নি, তা নয়, মুখ বুঁজে রইলাম।

বাড়িতে ঢুকতেই বউ আবার হাঁউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। তখন যারা ছাড়তে গেছিল বললো, কোনও অসুবিধে হলে এই নম্বরে একবার ফোন করবেন, তারপর পিটিয়ে সব কটার পেছনের চামড়া গুটিয়ে দেব। ঝুনে আবার নম্বরটা মোবাইলে সেভ করলো।

বৌকে, মেয়েকে পাশের ভাড়াটের ঘরে পাঠিয়ে দুজনে শুয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।

সকালে দেখি বৌ তারস্বরে চিৎকার করছে আর দরজা ধাক্কাচ্ছে।

ভয়পেয়ে গেলাম, পরি কি মরি করে উঠে দরজা খুললাম। ঝুনেরও ঘুম ভেঙে গেছে। কাঁচা ঘুম ভেঙেছে, চোখ জ্বালা জ্বালা করছে। বৌয়ের মুখ দেখে বুঝলাম কোনও গণ্ডগোল হয় নি।

তোমাকে কারা ডাকতে এসেছে।

আবার কে এলো!

জানি না। চিনি না।

বলো দেখা হবে না।

সেকিগো! পাড়ার সবাই কেমন স্যার স্যার করছে।

বৌকে জিজ্ঞাস করলাম, তুই এসেছিস কিনা। বললো না।

বাধ্য হয়ে গেঞ্জিটা কোনওপ্রকারে গলিয়ে বেরিয়ে এলাম।

দেখি আমাদের এলাকার এমএলএ, এমপি আরও কতো লোক। ওই টুকু গলিতে জায়গা হয় নাকি। শালাদের ভোটের সময় একবার দেখি। তারপর আবার পাঁচ বছর সময় লাগে মুখ দেখতে। সাত সকালে আমার বাড়িতে সবাই হাজির, বুঝলাম খেলা বেশ জমে গেছে।

আমি পদুর গল্প শুনছি। ওকে কোনও বাধা দিচ্ছি না।

আমাকে দেখে বললো, আপনি পদুবাবু। জীবনে প্রথম শুনলাম বুঝলি অনি। সবাই তো চোর-ছ্যাঁচর ছাড়া আমাকে কিছুই ভাবে না। মনে মনে হাসলাম।

মাথা দোলালাম।

ঝুনেবাবু আপনার সঙ্গে আছে?

ঘুমচ্ছে।

আপনারা দু-জন একবার একটু পার্টি অফিসে আসুন দরকার আছে।

কি জানি মাথাটা কেমন গরম হয়ে গেল। শালা আজ প্রয়োজন হয়েছে তাই এসেছিস। না হলে পেছন মোছা ন্যাকড়া দিয়েও মুছতিস না।

আমাকে এখন থানাতে যেতে হবে, ওখানে প্রথম যাব, তারপর।

থানাতে আর যেতে হবে না। আমরা ভেঁদোবাবুকে নিয়ে এসেছি।

মনে হলো কানটা যেন ভোঁ ভোঁ করছে। ঠিক শুনতে পাচ্ছি তো?

ভেঁদোদা আবার কবে থেকে বাবু হলো? পাড়ার ছোট থেকে বড়ো পর্যন্ত সবাই ভেঁদোদাকে ভেঁদো বলেই ডাকে। কেউ কেউ আবার আগে পরে কাঁচা কাঁচা বিশেষণ ব্যবহার করে।

উনি ভালো আছেন, আপনাকে চিনতা করতে হবে না। আপনি একবার আপনার বন্ধুকে নিয়ে একটু আসুন, দরকার আছে।

আমার ব্রেনের তার তখন কেটে গেছে। পুরো ফিউজ। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছি।

ভেঁদোবাবু, পদুবাবু। আপনি আজ্ঞে করছে।

বৌ, মেয়ে, বাড়ির আর যতো ভাড়াটে ছিল বেরিয়ে গিয়ে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়েছিল। সব শুনলো। ভেতরে এলাম। ঝুনেকে সব বললাম।

ও তো সব শুনে বললো, অনি যে কি করে গেল, কপালে যে কি লেখা আছে কে জানে।

মুখ হাত ধুয়ে বৌয়ের তৈরি চা খেয়ে বেরিয়ে এলাম।

ওরে পার্টি অফিসে যেতে যেতে আমি আর ঝুনে কতোবার যে ঠোক্কর খেলাম তোকে কি বলবো। বিশেষ করে যারা পাড়ার বয়স্ক তারা বললো, পদু এতদিন পরে তুই একটা ভালো কাজ করলি। সত্যি ছেলেটাকে দেখে দুঃখ হতো। কত ছোটো থেকে ছেলেটাকে দেখছি।

কাউকে তো আর বলতে পারছি না এর আসল কারিগর কে।

চারিদিকে শুধু ভেঁদোদার কথা শুনতে শুনতে কানের খোল সব পরিষ্কার হয়ে গেল।

পার্টি অফিসে দেখলাম সবাই জামাই আদর করে বসাল।

চাঁদুর মুখ শুকিয়ে জুতোর শুকতলা হয়ে গেছে। টেরিয়ে টেরিয়ে আমাদের দু-জনকে দেখছে।

এমএলএ সাহেব, এমপি সাহেব কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছেন। হাত দেখিয়ে ইশারা করে বললেন, বসুন।

খুব ধৈর্য ধরে কাল রাতের সমস্ত ঘটনা শুনলেন। এমনকী তোর সঙ্গে আমাদের রিলেশন কি, কি ভাবে হলো, সব। সব শুনে ওদের আক্কেল গুড়ুম। তোকে যে গালাগাল দিয়েছে, কলার ধরতে এসেছিল, সব বলেছি।

উনি ফোন তুলে কার সঙ্গে কথা বললেন।

কথা শুনে বুঝলাম ওসিকে ফোন করে বললেন। ওরা যাতে কেউ বেল না পায় তার ব্যবস্থা করুণ। বাকিটা আমরা বুঝে নেব। আপনাকে চিনতা করতে হবে না।

তারপর চাঁদুকে নিয়ে পরলো। কাপর জামা সত্যি আর চাঁদুর কোমরে রইলো না।

পরকে পর লোক আসছে। কেউ হেঁদি পেঁদি নয়। দেখেই মনে হচ্ছে সব ওপর তলার নেতা। চাঁদুকে যারা সাপোর্ট করতো তাদের কারুর দেখা পাই নি।

আমাকে এমপি সাহেব বললেন, আপনি কি অনির কাছে যাবেন?

বললাম হ্যাঁ। যতো সকালে সম্ভব ওর কাছে যাওয়ার কথা, ওকে খবর দিতে হবে।

আপনি গাড়ি নিয়ে চলে যান, ওকে খবর দিয়ে তাড়িতাড়ি ফিরে আসুন।

এসে দেখি সব শুনসান, তোদের গেটের দারোয়ান গেট খুলে জিজ্ঞাসা করলো কাকে চাই। তোর নাম বলতে, বলে কি ঘুমচ্ছে, দেখা হবে না।

মামনি মনে হয় তখন বাগানে ছিল। গেটের কাছে এলো।

মেয়ে খিল খিল করে হেসেই চলেছে।

গিয়ে বলে কি পদু আঙ্কেল কে? ঝুনে আঙ্কেল কে? চোখ কপালে উঠে গেল। বলে কি মেয়েটা! তখন জানতাম না তোর মেয়ে। তারপরেই বলে ভেঁদোজ্যেঠু কেমন আছে?

তখনই আমি একটু একটু ধরে ফেলেছি। তারপর ভেতরে এসে সব শুনলাম, সব জানলাম।

তোর যে এতোবড়ো একটা এ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, তোকে দেখে কালকে বুঝতেই পারি নি।

ছাড় ভেঁদোদার সঙ্গে আলটিমেট দেখা করতে পেরেছিস?

তাহলে বলছি কি। তোর এখান থেকে আবার পাড়ায় ফিরে গেলাম।

গিয়ে দেখলাম, ভেঁদোদা ভিআইপি হয়ে গেছে।

সর্বেশ্বরজ্যেঠুর বাড়িটা যে প্রমোটার করেছে। সেখানে গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা ঘর ছিল। সেই ঘরে ভেঁদোদাকে রাখা হয়েছে।

নতুন খাট বিছানা বালিশ এসেছে। ভেঁদোদার নতুন জামাকাপর এসেছে। কালকের সেই ডাক্তরবাবু নিজে থেকে গিয়ে ভেঁদোদার চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছে। তোর পাভলভ হাসপাতালের থেকে ভেঁদোদা এখন রাজার হালে আছে। তোর যে হাত এতো লম্বা চওড়া বুঝবো কি করে। ভেঁদোদার জন্য পাড়ার যারা সিনিয়ার লোক তারা সকলে চাঁদা তুলেছে। সে এক এলাহি ব্যাপার।

ভেঁদোদার সঙ্গে দেখা হতেই ঝুনেকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। আগে ওকে ডেকে নিয়ে আয়। সর্বেশ্বরজ্যেঠু ওপর থেকে নিচে নেমে এসে কতো বোঝাল। ও এখন আসতে পারবে না। ওর শরীর খারাপ। সে কি আর বোঝে, বলে এখুনি আমাকে নিয়ে চল।

তারপর তাকে অনকে করে বোঝাতে তার কান্না থামে।

আর একটা খবর ভাষা ভাষা পেলাম, চাঁদুকে পার্টি থেকে মনে হয় সাসপেন করা হচ্ছে। এটা পাড়ার অনেকে মনে মনে চাইছিল, সেটা মনে হয় এবার হচ্ছে। ব্যাটা বহুত কামিয়েছে। প্রমোটার থেকে আরম্ভ করে পাড়ার চায়ের দোকান। এমনকী স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া থেকেও ব্যাটা কামাই করতো।

এতো তাড়াহুড়ো করলো কেন! আমি বললাম।

একরাতে পাড়ার বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলে পার্টির এগেনস্টে চলে গেছিল।

বিরোধী পার্টি লুফে নেবার আগেই কাজ সেরে দিল।

একবারে তাই। ঝুনে বললো।

পাড়ায় একটা নাগরিক কমিটি বানিয়ে দিয়েছে। সর্বেশ্বরজ্যুঠুকে বলেছে আপনারা সিনিয়াররা জুনিয়ারদের দিয়ে কাজ করাবেন। আমাকে আমাদের পুরো বস্তিটা দেখা শোনার ভার দেওয়া হয়েছে। ঝুনেকে বলেছে আপনি পারলে প্রতিদিন একবার করে আপনার দাদাকে দেখে যাবেন। ও এই পাড়াতেই থাকবে। আজ বিকেলে পাড়ায় একটা বড়োসড়ো মিটিং হবে।

পতাকা লাগান শেষ, ম্যাড়াক বাঁধা শুরু হয়ে গেছে।

তাহলে তুই নেতা বনে গেলি।

নারে অনি, তুই ভগবান, সব তোর জন্য।

পদুর গলাটা ভাড়ি হয়ে এলো।

তুই যদি কালকে না যেতিস, ভেঁদোদা হয়তো কয়েকদিনের মধ্যে মরে যেত। ওরা যা অত্যাচার শুরু করেছিল। চোখের সামনে দেখেছি, কিন্তু কিছু বলতে পারিনি। সহ্য করতে না পারলে চোখের আড়ালে চলে যেতাম।

ঝুনের চোখ থেকে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পরলো।

আমি ঝুনের হাতটা চেপে ধরলাম।

সত্যি অনি, তুই তো কাল নাও যেতে পারতিস। হয় তো আর কোনওদিন তোর সঙ্গে দেখা নাও হতে পারতো। কেন তুই কালই গেলি, কেনই বা তোর সঙ্গে বড়দার অমন ভাবে দেখা হবে। তাহলে ভগবান তোকে পাঠালো না তো কে পাঠালো বল? ঝুনে বললো।

ঝুনে রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে।

একদিন পয়সার অভাবে বড়দার চিকিৎসা করতে পারি নি। যখন সেই সুযোগ এলো, তখন বড়দাকে ধরে রাখতে পারলাম না। জানিনা সর্বেশ্বরজ্যেঠুর ওই দোকানটায় ওর কি আছে। চব্বিশঘণ্টা ওখানে বসে থাকতো। একদিন দুলু দূরছাই করলো। তারপর থেকে এখানে সেখানে ঘুরে বেরায়। কিন্তু ওই পাড়ার বাইরে এক পাও নড়ে না।

মেয়ে আমার চোখে চোখ রেখে মাথা নীচু করে নিল।

ওর জন্য বাড়িতে আলাদা এ্যাটাচবাথ ঘর বানিয়েছিলাম।

ভাই-বোনদেরও ওকে নিয়ে অনেক অসুবিধা। নিজের ভাই, ফেলে দিতে পারি না।

বেশ কিছুদিন ভালো ছিল, তারপর পালিয়ে এলো। ধরে নিয়ে গেলাম। আবার পালিয়ে এলো। কাঁহাতক কতো করি বলতো। এই নিয়ে মায়ের সঙ্গে অশান্তি, বোনেদের সঙ্গে অশান্তি। আর ভালো লাগে না।

তুই একটা কাজ করতে পারবি?

বল। দাদার জন্য আমি সব করবো। ঝুনের কান্নাভেঁজা গলায় আবেগের সুর।

তুই গিয়ে সর্বেশ্বরজ্যেঠুকে একবার রিকয়েস্ট কর, প্রতিদিন সকালে একবার আর বিকেলে একবার দুলুর জায়গায় আধঘণ্টার জন্য দোকানে এসে বসতে। সর্বেশ্বরজ্যেঠু ভেঁদোদাকে ডাকবে। চায়ের গ্লাসটা দিয়ে বলবে চা আর বিস্কুট নিয়ে আয়। তারপর যেমন চা এনে ভেঁদোদা সর্বেশ্বরজ্যেঠুকে দিত তেমন দেবে, নিজে খাবে। তারপর সর্বেশ্বরজ্যেঠু ওপরে চলে যাবে। আবার বিকেল বেলাও ঠিক একইভাবে দোকানে এসে বসবে। ভেঁদোদার সঙ্গে একই ব্যবহার করবে। পারলে দু-একজনেকে মেমো লিখে রেশন দেবে। ভেঁদোদা যদি ওই দু-একজনকে মেপে দিতে পারে ভালো, না হলে করবে না….।

ঝুনে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

মাঝে মাঝে সর্বেশ্বরজ্যেঠু ওকে ধমকাবে। যেমন আগে করতো।

আগে হলে সেটা হতো, এখন তা হবার নয়। পাড়ার লোক বিরোধিতা করবে।

প্রয়োজন পরলে আমি যাব। তোরা একবার আমার নাম করে সর্বেশ্বরজ্যেঠুকে বল না।

এক-দু সপ্তাহ ব্যাপারটা করে দেখ না, ভেঁদোদার কোনও উন্নতি হচ্ছে কিনা। যদি হয় কনটিনিউ করবে। যতদিন জ্যেঠু বাঁচবে। আমি ডাক্তার নই তবে ব্যাপারটা মনে এলো তাই বললাম।

পদুর দিকে তাকালাম।

পদু তোকে ওয়াচে রাখতে হবে।

সে আমি রাখবো।

তুই যদি দুধের বিজনেসটা আবার করতে চাস করতে পারিস।

ভেবেছি করবো। কাল রাত থেকে ভয়টা চলে গেছে।

পয়সা লাগলে বলিস, লজ্জা করিস না। ধার নে, শোধ করে দিবি।

লাগবে না। সকালে মাল নিয়ে আসবো বেচে বিকেলে পয়সা দিয়ে দেব। কমিশন আমার।

এমনি এমনি দেবে।

কম কম নিয়ে আসবো।

ভাত খেয়ে যা।

আজ নয়। অনেকদিন পর ভালোবেসে বিয়ে করা বৌ বেরোবার সময় বলেছে, ঠিক সময়ে ফিরে এসে খেয়ে নেবে, তারপর যা কাজ আছে করবে।

পদু মাথা নীচু করলো।

আর একদিন এসে খাবো।

একটু চা খা।

তাই দে।

পদু মেয়ের মুখের দিকে তাকাল।

মেয়ে উঠে দাঁড়াল।

চায়ের সঙ্গে একটু কিছু নিয়ে আসি।

নিয়ে আয়।

আমার দিকে তাকালো।

তোর মেয়েটা সত্যি খুব মায়াবী। যে দেখবে তারই ভালো লাগবে।

আমি ওর কোনও যত্ন আত্তি করতে পারি নি।

একটু একটু শুনেছি। তোর আত্মীয়রা সব লণ্ডনে গেছে।

হ্যাঁ।

আমার ফোন নম্বরটা তোর কাছে আছে?

আমার কোনও নম্বর নেই, ঝুনের কাছে দিয়েছি।

মাঝে মাঝে ফোন করে একটু খবর দিস।

ঝুনের খোঁজ খবর নিলাম। ওরা চা খেয়ে চলে গেল।

ওদের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম।

এ ঘের এলাম। দেখলাম টিনা এসেছে। বাচ্চাগুলো বড়োমার ঘরে দাপাদাপি করছে।

সব খবরা খবর নেওয়া হলো। মিলি আমার দিকে তাকাল।

হাসলাম। কনিষ্ক এখনও ওঠে নি।

উঠেছে, এবার নামবেন। আপনার খোঁজ খবর নিলেন।

সুরো, বৌদি এখনও এলো না?

আসবে, একটু অপেক্ষা করো।

বাচ্চাগুলোর খাওয়া হয়ে গেছে।

কোন পেটে খাবে। সকালে অতগুলো করে পরটা খেলো।

স্নান করিয়েছিস?

এবার করাব।

মিলি দুটো বড়া এনে দিল।

কিসের গো।

মাছের ডিমের, খাও।

মাসিকে দেখতে পাচ্ছি না।

ফুল তুলে ঠাকুর ঘরে গেছে।

সেরেছে, বড়োমার ব্যামো ধরেছে।

কেন তুমি করবে। সুরো ঝাঁঝিয়ে উঠলো।

তোমরা সেই সকাল থেকে রান্না করেই যাচ্ছ, এখনও শেষ হলো না।

টিনা হাসছে।

তুমি মনে হয় কথা বলার কোনও সাবজেক্ট খুঁজে পাচ্ছ না, তাই না। মিলি বললো।

হাসলাম। অতো ধমকাচ্ছ কেন?

মিত্রাদি না আসা পর্যন্ত যা বলবো শুনে যাবে।

দেবা, নীরুকে একটু তারাতারি আসতে বলো।

দেখলাম বৌদি, অনিমেষদা এসে ঘরে ঢুকলো।

আমাকে দেখে দুজনেই হাসলো।

দেখে মনে হচ্ছে বেশ সুস্থই আছিস।

কথা বলতে বলতে অনিমেষদা পাশে এসে বসলো।

মাছের ডিমের বড়া খাচ্ছি। খাবে?

অনিমেষদা হাসছে।

এতো দেরি করে এলে?

কাজ কর্ম কিছু আছে, তুই মাঝে মাঝে কাজ বাড়াস কিনা।

আমি আবার তোমার পাকা ধানে মই দিলাম কোথায়!

ভেবে দেখ।

সুরো হাসছে।

তুই হাসছিস কেন?

হাসি পেল তাই। হাসতেও মানা।

আমি বেশ আয়েস করে বড়াটা একটু একটু করে ভেঙে খাচ্ছি।

অনিমেষদা আমার হাতের বাইসেপটা টিপছে।

বৌদি হাসছে।

ওটা আবার কি হচ্ছে?

দেখছি কতটা শক্তি সঞ্চয় হলো। লোককে এক ঘুসিতে রাস্তায় উল্টে দিচ্ছিস। মেয়েকে লুকিয়ে রক্তমাখা গেঞ্জি বাথরুমের টাবে ভিঁজিয়ে দিচ্ছিস।

এবার সত্যি সত্যি সুরোরা জোড়ে হেসে উঠলো।

টিনা, অনিমেষদা, বৌদির জন্য চা আর মাছের বড়া এনে দিল।

সকালে আমি আর তোর বৌদি ছেলেটাকে দেখে এলাম।

অনিমেষদার মুখের দিকে তাকালাম।

ওই জায়গায় আমি না থেকে অন্য কেউ হলে যেতে?

অবশ্যই না!

কেন?

এই প্রশ্নের উত্তরও তোর অজানা নয়।

আমি অনুরোধ করবো, মাঝে মাঝে একটু মাটিতে নেমে এসো। একসময় তো করতে। বন্ধ করে দিলে কেন? এখনও মানুষের মন থেকে তোমরা হারিয়ে যাও নি।

সেটা আজ নিজের চোখে পরখ করলাম। অনিমেষদার গলাটা ভাড়ি শোনালো।

একটা মাছের ডিমের বড়া দাঁতে কেটে চায়ের কাপে চুমুক দিল।

যে জায়গায় আমাদের কোনও অস্তিত্বই ছিল না। আজ সাধারণ মানুষ সেই জায়গায় আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই জন্য তোকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করবো না।

এই রকম হাজার হাজার ভেঁদোদা আছে।

অনুপ কাল মাঝ রাত থেকে ওই তল্লাটে পরে আছে। ব্যাপারটা ও নিজে হাতে ট্যাকেল করছে। পার্টি থেকে ওকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।

শুনলাম এমপি, এমএলএ গেছিল।

ওরা ওই অঞ্চলের প্রতিনিধি।

ওরাও তো ভালো মানুষ নয়।

হাতের পাঁচটা আঙুল তুই সমান পাবি। তবু তুই কি কেটে বাদ দিয়ে দিস।

বাদ দিই না। সঠিক ব্যবহার করি।

একটু বেনো জল ঢুকেছিল। আজ একটু পরিষ্কার করলাম। এই দায়িত্বটা আমরা অনুপকেই দিয়েছি। আশা রাখছি ও সঠিক ভাবে পালন করবে।

মেয়ে অনিমেষদার পাশে বসে গলা জড়িয়ে ধরলো।

ভালোদাদু, ভেঁদোজ্যেঠুকে কেমন দেখতে গো।

তার আগে বল কেন কেঁদেছিলি।

মেয়ে অনিমেষদার কাঁধে মাথা রাখল।

কি জানি, বাবার কথা শুনে মনটা কেমন খারপ হয়ে গেল।

তাহলে তোর বাবার আরও কথা শুনলে তুই কেঁদে কেঁদে একটা সমুদ্র বানিয়ে ফেলবি?

বাবা কাল রাতে শুয়ে শুয়ে ভেঁদোজ্যেঠুর সম্বন্ধে অনেক কথা বললো, আজ দেখলাম ঝুনেজ্যেঠুর সঙ্গে সব মিলে গেল। কাল বাবার সঙ্গে ঝুনেজ্যেঠুর দেখা হয় নি।

আমরা খালি চোখে দেখি। তোর বাবা মাইক্রস্কোপ দিয়ে দেখে।

মেয়ে হেসে ফেললো।

অনিমেষদা একটা বড়া দাঁতে কামড়ে মেয়ের মুখের সামনে ধরলো, মেয়ে একটুখানি দাঁত দিয়ে কামড়ে নিল।

কাল রাতে তোর বাবা কি বললো?

তোমাকে বাবার মতো গুছিয়ে বলতে পারবো না। তবে মোদ্দা কথা ভেঁদোজ্যেঠু মানসিকভাবে ভীষণ দুর্বল। বাবা তো ভেঁদোজ্যেঠুর বাবা বাঁশীদাদুর কথা বললো, সর্বেশ্বরদাদুর কথা বললো, আরও কত কি বললো। সব কেমন গুলিয়ে দলা পাকিয়ে গেল।

অনিমেষদা হাসছে।

এতো সব মনে রাখতে না পারলে বাবার মতো হবি কি করে।

আমার দ্বারা হবে না। দাদা হবে। আজও তো বাবা ঝুনে জ্যেঠুকে বললো।

কি বললো?

বললো, সর্বেশ্বরজ্যেঠুকে অনুরোধ করিস প্রত্যেকদিন আধঘণ্টার জন্য দোকানে এসে বসতে, সর্বেশ্বরদাদু ভেঁদোজ্যেঠুকে গ্লাস দিয়ে চা অনতে বলবে, ভেঁদোজ্যেঠু নিজে হাতে সর্বেশ্বরদাদুকে চা এনে দেবে, নিজে খাবে। এই সব।

অনিমেষদা বৌদির দিকে তাকাল। হাসলো। বৌদিও হাসছে।

তুই এরই মধ্যে ভুলে গেলি? বৌদি বললো।

বাবা যখন বলছিল তখন বেশ মনে থাকছিল, এখন ভুলে গেছি।

একটু মনে করার চেষ্টা কর।

মনে আসবে না। বাবা আবার যখন গল্পটা বলবে তখন মনে পড়ে যাবে। সব এমন ভাবে জড়িয়ে-মরিয়ে বলে।

বৌদি হেসে ফেললো।

কনিষ্ক ঘরে এসে ঢুকলো।

কখন এলেন দাদা?

এই তো এসে সবেমাত্র চা পর্ব শেষ করলাম।

তুই চা খাবি? বৌদি বললো।

খাচ্ছি।

আমার দিকে তাকাল।

শরীর সুস্থ।

হাসলাম।

সকালে তোর গল্প শুনে ভয় পেয়েগেছিলাম। মাথায় রাখিস তোর বয়স এখন আঠাশ বছর নয়। হাফ সেঞ্চুরি পার করে এগিয়ে চলেছিস।

অনিমেষদা হাসছে।

বুঝলে কনিষ্ক আমাদের একটা প্রচলিত কথা আছে, ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙে।

সবাই হাসলো।

তুমি তোমার ডাক্তারী করবে, ও ওর মতো চলবে।

একটু থেমে।

মাঝে মাঝে আমি কালকের সিচ্যুয়েশনের কথাটা ভাবছি।

কনিষ্ক, অনিমেষদার দিকে তাকিয়ে। আমি মুচকি মুচকি হাসছি।

মিলি বলছিল।

ভাবো একবার। চ্যাংরা ছেলে, রাগের মারে ওর মাথায় যদি আঘাতই করে দিত কি ঘটনা ঘটতো। বা বে-টক্কর একটা ঠেলা দিল ও মাটিতে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেল। আমি দিদিদের কাছে মুখ দেখাতে পারতাম।

কনিষ্কর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেছে।

ও বলবে এতবড়ো ক্ষমতা কারুর হয় নি।

পাগলকে বোঝাবে কে, যারা তাদের বাপ-মাকে ঠিক ভাবে সম্মান দিতে জানে না। তারা তোকে সম্মান দেবে আশা করিস কি করে। ওদেরকে নিয়েও আমাদের চলতে হয়। আফটার অল মানুষ। কখনও ভয় দেখিয়ে কখনও ভালোবেসে। যেগুলোকে মানুষ করতে পারি না, ছেড়ে দিই।

ছেলেগুলো কি কাল মারতে তেরে গেছিল।

গেছিল মানে! গোটা পনেরো ছেলে সবার হাতে হকি স্টিক। তবে হ্যাঁ, পুলিশ ঠিক সময়ে চলে এসেছিল, এটাই রক্ষে।

অনিমেষদা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/Xast0Jf
via BanglaChoti

Comments