❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৫৬ নং কিস্তি
—————————–
ডাক্তারী শাস্ত্র অনুযায়ী দিনক্ষণ মেপেই ওর কাছে গেছিলাম। আমার কাছে দুটো অপশন ছিল, এক ও যদি আমাকে স্বীকার করে না নেয় তাহলে ওর সঙ্গে শরীরিক সম্পর্ক স্থাপন করবো। যদি কনসিভ করি তাহলে অজু আমাকে ফেলে দিতে পারবে না।
আমি তখন ডেসপারেট।
আমি ওর সঙ্গে তিনদিন শারীরিক সম্পর্ক করেছি। কপাল খারাপ কনসিভ করতে পারিনি। বাড়ির প্রেসার দিন দিন বাড়লো। আমি মাথা নত করলাম।
জেদ ধরলাম আমাকে বিয়ে করলে ছেলে কোনওদিন তার বাড়িতে ফিরতে পারবে না, ঘর জামাই হিসাবে থাকতে হবে, আর আমি বিদেশে যাব পড়াশুন করতে। আমার পরিবার মেনে নিল।
পুরুষ জাতটার ওপর তখন ঘৃণায় মুখ ফিরিয় নিতে ইচ্ছে করছে। সবচেয়ে বড় কথা কি জানিষ মেয়েদের কোনও স্বাধীন অস্তিত্ব নেই, পরিবারের গুরুজনেরা ভাবে মেয়েদের একটা ভাল সংসার করে দিতে পারলেই সব চুকে বুকে গেল। তারপর আমাদের এই কাস্টের ব্যাপারটা এখনও দগদগে ঘার মতো এই অদ্ভূত সমাজে রয়ে গেছে।
তোমার ছেলে মেয়েরা?
রক্তে আছে। যাবে কোথা থেকে। তবে আগের থেকে অনেকটা পলিশড। আমার বড় নাতনি একটা বাঙালী ছেলেকে বিবাহ করেছে। শুনেছি ওদের খুব বড় ব্যবসা।
তুমি এমনভাবে বলছো, তোমার সঙ্গে তোমার নাতনির যেন কোনও সম্পর্ক নেই।
সবাই পয়সা চেনে বুঝিস।
তোমার ছেলে মেয়েরা তোমার কাছে থাকে না কেন?
ওদের বাবা মারা যেতে প্রপার্টি ভাগ হলো, আমিও পেলাম। প্রত্যেকটা ছেলে মেয়ে ওর বাপের মতো স্বার্থপর। খালি টাকা রোজগার ছাড়া জীবনে কিছু শিখলো না।
ওটা তো পেট্রল অফ লাইফ।
মানুষ কি যন্ত্র।
পুরুষ জাতটার ওপর তোমার ভীষণ রাগ তাই না?
ঠিক রাগ নয়, একটা অভিমান।
অভিমানের জায়গাটা কি ডাক্তারদাদা?
আন্টি চুপ করে রইলো।
তোমার এই ব্যাপার কেউ জানে?
আমার স্বামীকে আমি কোনও কথা গোপন করি নি। বিয়ের আগে তাকে সব বলেছিলাম। সে সব শুনে আমাকে স্বীকার করে নিয়েছিল।
কেন বলেছিলে?
শোনার পর যদি ভেগে যায়।
ভাগলো না।
ভাগবে কিরে! ভালো ছেলে পেল, আমার মা-বাপ সোনায় মুড়ে দিল। সম্পত্তি পেল। কোন পুরুষ ভাগে।
তোমায় একটা কথা বলবো?
বল।
রাগ করবে না?
না।
আমার সম্বন্ধে তুমি কতটা জেনেছ?
হঠাৎ তুই এতদিন পর জিজ্ঞাসা করছিস!
তুমি সেই সুযোগটা দাওনি।
তুই যেদিন প্রথম পেসেন্ট নিয়ে আমার কাছে এসেছিলি। তোর চলনে বলনে ওদের পরিবারের সঙ্গে তোকে মেলাতে পারিনি। তবে বিশেষ একটা ভাবিও নি তোকে নিয়ে। আমার ভিজিট ঠিক ঠিক পাচ্ছি কিনা সেটা দেখে নিতাম।
তুই যে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আমার কাছে আসছিস সেটাও ধরতে পারিনি। সামান্য সন্দেহ থাকলেও সেটা উল্লেখ করার মতো নয়। তোর মতো অনেকেই আমার কাছে আসে।
কবে প্রথম সন্দেহ করলে?
যেদিন তুই এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আমার বাড়িতে প্রথমে এলি।
কেন তার আগেও তোমার কাছে অজন্তাকে রেখে এসেছি।
ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। মেয়েটা বড়ো ভাল মেয়ে।
সেদিন চলে আসার পর তোমার রি-এ্যাকসন।
প্রথমে কেমন গুলিয়ে গেল। আমার ছেলে মেয়েরা কলকাতায় অনেক আগে এসেছে। আমি এসেছি অনেক পরে। ভাবলাম শেষ জীবনটা বিদেশ বিভুঁইতে মরতে চাই না। দেশের মাটিতে মরবো। আমার জন্ম যেখানে সেই কলকাতাতেই শেষ জীবনটা কাটাতে চাই।
বিশ্বাস কর অনি কলকাতায় এখনও সেই প্রাণের স্পর্শ পাই আমি।
এখানে এসে প্রথমে বড়ো ছেলের কাছে উঠেছিলাম। বৌমার সঙ্গে মতে মিললো না। আমার পরিচিতদের মধ্যে একমাত্র রথীনদাকে পেলাম। শুনলাম রতনদা মারা গেছেন।
আর.এল. দাস?
হ্যাঁ।
কেন ডাক্তারদাদা ছিল না?
খবর নিয়ে জানলাম ওকে নাকি ছোঁয়া যায় না। তা রথীনদাকে বললাম প্র্যাক্টিশ করবো কিছু পেসেন্ট দিন।
রথীনদাই সব ব্যবস্থা করে দিল।
ডাক্তারদাদার ব্যাপারে রথীন ডাক্তার কোনও কথা বলেনি।
একবারে উচ্চবাচ্য করতো না। চল্লিশ বছর আগের একটা ঘটনা।
তুই সেদিন চলে যাওয়ার পর রথীনদাকে ফোন করলাম। পরদিন রথীনদার বাড়িতে গেলাম।
সল্টলেক না শ্যামবাজার।
সল্টলেক।
সব শুনে বললো অনি তোমার কাছে পৌঁছল কি করে?
এরপর তুই যতটুকু বলেছিলি। তার থেকেও বেশি বললো। তোর কীর্তি কলাপ শুনে গা হিম হয়ে গেল। শেষে বললো, সোনা ও কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়া কারুর কাছে যায় না।
অজুর কথা জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তোর নাড়ি নক্ষত্র সব উজার করে দিল।
সেই দিন রাতে ফ্ল্যাটে ফিরে এসে প্রথম অজুকে ফোন করলাম।
গলার স্বরে চিনতে পারলাম আমার অজু এখনও সেইরকম আছে। সেই আপন ভোলা। জাস্ট খালি ভালো মন্দের খবর নিল।
লোভ সামলাতে পারলাম না। প্রত্যেকদিন ফোন করতে শুরু করলাম।
ও কোনও দিন প্রত্যাখ্যান করলো না। আমি যেন চল্লিশ বছর আগে ফিরে যেতে চাইছি।
ও ফিরে এলো। ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ ফোনে কথা বলতাম, একদিন তোর কথা বলতেই বললো, এবার সব বুঝে গেছি সোনা। আমাকে খুঁজে পাওয়ার ইতিহাস, তোমাকে আর গুছিয়ে বলতে হবে না। অনি গেলে ওর কাছ থেকে খোঁজ নেবে তোমার, আমার ডাক্তারী পাশ করার ফাইন্যাল মার্কসিট পর্যন্ত ওর কাছে আছে।
অজু তোকে এতটা ট্রাস্ট করে! তোকে ডেকে পাঠালাম। তোর প্রতিও আমার ভীষণ অভিমান হচ্ছিল। কিন্তু তোর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছু বলতে পারতাম না। তোকে যেন প্রশ্রয় দিয়ে ফেললাম।
আজকে হঠাৎ কি হলো, ডাক্তারদাদার শরীর খারাপ হয়ে গেল? তনু বললো।
ঠিক বলেছিস তনু। মিত্রা বললো।
পিকুকে, বিতানকে ঝাড়ার পর মনটা কেমন খারাপ খারাপ লাগলো। বাইরে বেরিয়ে এসে আন্টিকে ফোন করলাম।
চেম্বারে যাবে নাকি?
না।
কোথাও বেরবে?
কেন তুই আসবি?
তাহলে যেতাম।
চলে আয়। আমি কাথাও যাব না।
তারমানে তুই কম বেশি আন্টির কাছে যেতিস। মিত্রা বললো।
সপ্তাহে দু-তিনদিন যেতাম। তোদের কথা বলেছি, আমার কথা বলেছি। পদুর কথা বলেছি। পদুর ওপর দায়িত্ব ছিল আন্টির কোনও সমস্যা হলে ও যেন দেখাশুন করে। পদু অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করতো।
ডাক্তারদাদা জানতো।
সব জানতো। কেন জানিনা আমার দু-জনকেই খুব ফুরফুরে দেখতে ইচ্ছা করতো। এখনতো বিয়ে হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। তবু দুজনে যদি একটু কথা বলে ফুরফুরে থাকে।
মাঝে মাঝে আন্টিকে বিরক্ত করতাম তোমারা যদি শেষ বয়সটা এক ছাদের তলায় বন্ধু হিসাবে থাকো কেমন হয়। আমার বাড়িতে অনেক বুড়ো বুড়ি আছে। তুমি আমার কাছে চলো, আমি তোমায় দেখবো। মাঝে মাঝে সেন্টুতে ঘা মারতাম।
বার বার এক কথা, সে হয় না অনি। লোকলজ্জা আছে। ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি, ছেলে-বউ। তোকে কত বোঝাব।
ডাক্তারদাদার চলনে বলনে বুঝতাম আন্টি ডাক্তারদাদাকে আমার কথা বলে।
আজ মনে মনে ঠিক করেই গেছিলাম আজ অনি তার আসল রূপ বার করবে।
কথায় কথায় দিলাম ঝাড়। এও বলে এলাম, তোমার ছেলে জামাইদের কতো ক্ষমতা আছে আমার কথার অবাধ্য হয়ে কলকাতার বুকে ব্যবসা করে খায়, আমি দেখবো। এই বুড়ো বয়সে তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছায় কে বাধা দিতে আসে আমি একবার দেখে নিতে চাই। আমি যাব তোমার ছেলেদের কাছে, গিয়ে সব বলবো।
রাগের চোটে বেরিয়ে এলাম।
তারপরই ডাক্তারদাদাকে ফোন। আমার রাগ ডাক্তারদাদার ওপর। ব্যাশ শরীর গড়বড়।
মিত্রা তনু দু-জনে হেসে আমার বুকের ওপর গড়া গড়ি খায়।
তুই তো এই ঘরে চলে এলি। ও ঘরে ঢুকে ডাক্তারদার দিকে অনেকক্ষণ তাকাল। চোখটা কেমন ছল ছল করছে। ডাক্তারদার মুখটা তখন কী ভীষণ যন্ত্রণা কাতর। নিচু হয়ে ডাক্তারদাকে প্রণাম করে আস্তে আস্তে বললো।
বুড়ো বয়সে বিয়ে করতে চায়নি। একটু আশ্রয় চেয়েছিলাম। তোমাকে খাওয়াতে হবে না, পরাতে হবে না। এখন তোমার ভাই, বোনেরাও নেই। জাত, ধর্মেরও কোনও প্রশ্ন আসছে না, যে আমাকে ঠেলে ফেলে দেবে। এতেই প্রেসার বেড়ে গেল। কই ছেলেটা যে এমন পাগলামো করলো, তাকে কিছু বলতে পারলে না। শেষ পর্যন্ত এই বুড়ী বয়সে খুনের দায়ে জেল খাটাতে চাও।
সে কি হাসি সকলের।
ডাক্তারদা মুখ নিচু করে আছে।
সেই শুনে অনিসা কি বললো দিদি। তনু বললো।
মিত্রা বলবে কি হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
তোর মেয়ে বলে, তাহলে! কোমরে হাত দিয়ে ঝগড়ুটে মেয়ের মতো। সে কি ভুরু নাচান।
দাদাই আমি ঠিক ধরেছিলাম, তুমি ওখান থেকে আন্টিদিদাই-এর সঙ্গে প্রেম করতে। আমি বলেছিলাম বলে আমার সঙ্গে ঝগড়া করেছিলে। আমার কথাটা মিথ্যে ছিল না। দাঁড়াও আমি গিয়ে বাবাকে বলছি।
ঘর ভর্তি সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে।
অনিকা সেই শুনে ডাক্তারদাদাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে।
কেন তুমি এত দিন ঝুলোলে বলো।…
দুই মেয়ে আন্টির পক্ষ নিয়ে সে কি ঝগড়া। কি হম্বিতম্বি।
শেষে বলে কি তোমাকে আজই আন্টিদিদাইকে বিয়ে করতে হবে, আমি এখুনি হিমাংশু মামাকে খবর দিচ্ছি। কাল বৌভাত খাব।
এই কথা শুনে কেউ চুপ করে থাকতে পারে।
আন্টি?
আমাদের হইহুল্লোড় দেখে কেঁদে ফেলেছিল। বড়োমা আবার নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বোঝাল।
তারপর সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।
আন্টির চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম। ডাক্তারদাদা যে এরকম একটা পরিবেশে থাকে কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখ দুটো খুশিতে চক চক করছে।
একটু ফ্রেস অক্সিজেনের দরকার ছিল বুঝলি মিত্রা। আমি সেটুকু দিতে পেরেছি এটাই আমার কাছে সব চেয় বড়ো পাওয়া। আমি বললাম।
তুই কি ঋণ স্বীকার করলি?
কখনই না। কোনওদিন চেষ্টা করলেও ডাক্তারদাদার ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। ডাক্তারদাদার সব আছে কিন্তু কোথাও যেন বড্ড একা। গত মাস দুয়েক তুই যদি ডাক্তারদাদাকে একটু লক্ষ্য করে থাকিস তাহলে বুঝতে পারবি ডাক্তারদাদা কতটা ফুর ফুরে ছিল।
এটা লক্ষ্য করেছি।
আমি ডাক্তারদাদাকে কিছু দিতে পারবো না। সে ক্ষমতাও আমার নেই। শুধু কিছুটা হারিয়ে যাওয়া সময় ডাক্তারদাদাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। অন্ততঃ একটু অবসর সময়ে দুজনে কিছুটা নিখাদ গল্প করতে পারবে। মাঝে মাঝে অতীতে ফিরে যেতে পারবে। তুই, আমি, তনু ফিরে তাকাই না?
দু-জনেই আমার বুকে মুখ লুকিয়েছে। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম তিনজনে।
ঢং ঢং করে ঘরিতে তিনটে বাজলো।
এবার একটু ঘুমই।
পিকুর কথা শুনবি না।
তাহলে সারারাত আর ঘুম হবে না।
না হোক অনেক জটিল পর্যায়ে চলে গেছে পিকুর ব্যাপারটা।
মিত্রার চোখের দিকে স্থির হয়ে তাকালাম।
জানিস তো ঘরামীর ঘরের চাল ফুটো।
আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে।
ওমনি তোর চোখের ভাষা বদলে গেল।
কি গণ্ডগোল বল।
তুই আগে তোর চোখ ঠিক কর। তারপর বলবো।
আমার চোখ ঠিক আছে।
দেখছিস তনু। ওমনি রনংদেহি মূর্তি ধারণ করলো।
তোর চোখ গলার স্বর কোনওটাই ঠিক নেই। আমাদের কথাটা একটু শোন।
বলছিস কোথায় যে শুনবো।
বড়োমা তোকে আলাদা করে বলবে। তবু তোকে বলছি।
কি হয়েছে কি! তোতলাচ্ছিস কেন?
তোর চোখ মুখ দেখে আমাদের নাইটি নষ্ট হয়ে যাবে।
ঠিক আছে বল।
দু-জনকে আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলাম।
তুই বেড়িয়ে যাবার পর, জ্যেঠিমনি ফোন করলো। ছুটকি তুই এখুনি একবার আয়।
আমি তো জ্যেঠিমনির গলা শুনে ভয়ে মরি। কি হয়েছে বলো!
এমন কিছু না, সব ঠিক আছে, তুই একবার আয় তোর সঙ্গে কথা বলবো। পারলে বরুণকে আসতে বলিস।
তিনজনে পরি কি মরি করে ছুটলাম। যাওয়ার সময় বড়োমাকে ফোনে তোর ব্যাপার স্যাপার বললাম।
বললো দিদি সব বলেছে, তুই গিয়ে সব শোন তারপর অনি ফিরুক আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো।
তখন বুঝলাম তাহলে পরিবেশ অন্ততঃ ঠিক আছে।
আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম।
নিচে দিদিভাই ছিল। হেসে বললো, মশাই এমন ঝাড় দিয়েছে পিকুর অবস্থা খারাপ, মায়ের পা ছেড়ে কিছুতেই উঠছে না। আমাকে কিছু বলেনি। শুধু বলছে মশাই জানতে পারলে আমাকে খুন করে দেবে। আমি মশাইকে চিনি। মশাইয়ের কাছে বিশ্বাস ঘাতকদের কোনও স্থান নেই।
সব শুনে বরুণদা বললো, আমি যে ভয়টা করছিলাম ও সেটাই করেছে।
তুই কিছু বুঝতে পারছিস?
ও কি নম্রতার সঙ্গে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করেছে?
হ্যাঁ।
হে ঈশ্বর। আমারই ভুল। সাগর দাধিয়া বহুত ধুরন্ধর লোক। আমি যেটা ভেবেছিলাম সেটাই হয়েছে। রতনকে আমি ওপর ওপর খোঁজ নিতে বলেছিলাম।
প্লিজ বুবুন তুই কোনও ডিসিশন নিয়ে নিস না। আমার কথাটা একবার শোন তারপর তুই যা পারিস কর। আমি তোকে একটুও বাধা দেব না।
বল শুনি।
ওপরে গেলাম। দেখলাম জ্যেঠিমনির পা ধরে পিকু বসে আছে।
ঘরে ঢুকতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। মনি আমি ভুল করে ফেলেছি। আমি সব আজই তোমার নামে ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। শুধু আমাকে তোমার কাগজে কাজ করার সুযোগ দাও। আমি পেইড স্টাফ হিসেবে থাকতে চাই।
গম্ভীর হয়ে বললাম, চুপ করে বোস, একবারে ঘ্যানর ঘ্যানর করবি না।
দেখলাম শুর শুর করে জ্যেঠিমনির পায়ের কাছে গিয়ে বসলো।
আমি তনু জ্যেঠিমনির দুই পাশে। জ্যেঠিমনিকে বললাম তুমি বলো।
কি বলবো ছুটকি আমার কপাল। শুধু ছেলেটার কথা চিন্তা করলে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
জ্যেঠিমনি কাঁদতে শুরু করে দিল। কান্না থামিয়ে বললো।
পিকু জ্যেঠিমনির আলমাড়ির চাবি ডুপ্লিকেট করে আমাদের সব সম্পত্তির কাগজ জেরক্স করে। সেখানে নাকি জ্যেঠুর ভাগে সাগর দাধিয়া যে বাড়ি করেছে সেই সম্পত্তির কথা লেখা রয়েছে দেখেছে।
এইবার পিকু নিজের মতো করে খেলা শুরু করে। আমার কাছ থেকে ক্লাবে যাওয়ার পার্মিশন নেয়। আমি সরল বিশ্বাসে পার্মিশন দিয়েছিলাম।
সেখানে গিয়ে নম্রতাকে খুঁজে বার করে তার সঙ্গে আলাপ করে। ভাব করে। তার বাড়িতেও যাওয়া আসা করে।
কিন্তু পরবর্তীকালে বাবা, জ্যেঠিমনির সঙ্গে যে প্রপার্টি ভাগ হয় তার উইল ওর চোখে পরেনি। সেই উইলে দাধিয়ার সম্পত্তির মালিকানা বাবার। কারণ ওটা দামানিদের ছিল। বাবা পরে মিউটেশনও করে নি। তুই সেই দলিল দেখেছিস।
ও কি করেছে নম্রতার সঙ্গে ভাব জমিয়ে ওর সঙ্গে প্রথমে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে। ভেবে নিয়েছে, নম্রতা বাবার একমাত্র মেয়ে পরবর্তী কালে সম্পত্তির ভাগীদার মেয়ে হবে।
নম্রতাকে দিয়ে একটা পাওয়ার অফ এ্যাটর্নি করে নিয়েছে। তোমার বাবার অবর্তমানে তোমার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মালিক আমি হবো। মেয়েটি সরল বিশ্বাসে সই করে দেয়। সেই ডিড রেজিস্ট্রিও করে নেয়।
এবার বেশ চলছে। ও ভেবে বসে আছে ওর পরিবারের সম্পত্তি ও ফিরে পেল।
ইদানীং মনে হয় ও নম্রতার সঙ্গে ঠিক মতো মিশতো না। মাঝে মাঝে নম্রতাকে ইসলামভাইয়ের নাম করে ধমক ধামকও দিত। মেয়েটি এবার তার বাবাকে সব ঘটনা খুলে বলে।
সাগর দাধিয়া নাকি দু-একদিন আমাদের বাড়িতে গেছিল। জ্যেঠিমনিকে সব খুলে বলেছে। আমি কিছুই জানতাম না। দিদিভাই, বরুণদা, জ্যেঠিমনি কিছুই বলেনি।
ওই সময়ে তোর ওই অবস্থা, তুই নার্সিংহোমে। কার মনের অবস্থা ঠিক থাকে।
সাগর দাধিয়া নাকি প্রথমে কয়েকদিন ধমকেছে। চাঁদ নাকি একদিন গেছিল আমাদের বাড়িতে। সব দেখে শুনে এসে সাগর দাধিয়েকে বলে আপনি চুপ করে যান। এখন কিছু করতে যাবেন না, ওরা অনিদার আত্মীয়। আমি ওদের চিনি। দাদা ভাল হোক তারপর আপনার সঙ্গে বসিয়ে দেব।
সব চুপ চাপ হয়ে যায়। তুই যেদিন অনিকাকে এখানে আনলি সেদিন চাঁদ এখানে এসেছিল। দিদিভাইকে হাতে ধরে রিকয়েস্ট করেছে আপনি একবারে দাদার কানে ওসব তুলবেন না। দায়িত্ব আমার, দাদা শুনলে আমাকে স্পটে ঝেড়ে দেবে, ভুল আমি করেছি। আপনি চান আপনার ভাই মরে যাক।
রতন সব জানে তোকে এখন কিছু বলছে না। দাধিয়াকে প্রেসার করেছে যে ভাবে হোক দাদার জমি দাদাকে ফেরত দিন, না হলে টাকা দিয়ে রফা করে নিন। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
দাধিয়ার সঙ্গে প্রবীরদার খুব ভাল রিলেশন। ভেবেছিল ওখান থেকে যদি কিছু হয়। সেখানে তুই সেদিন প্রবীরদার মুখের ওপর ওসব কথা বলে দিলি।
তুই এ ঘরে চলে আসার পর, আমাকে বললো, অনিটা আমাকে পাগল কুত্তা বানিয়ে দেবে। মিত্রা তুই তো আমার বোন, অনির হাত থেকে তুই আমাকে রক্ষা কর।
সেদিন কিছু বুঝিনি। কাল ও বাড়িতে গিয়ে সব শোনার পর। পরিষ্কার হলো।
আমি গুম হয়ে আছি।
মিত্রা আমার মুখে হাত দিয়ে বললো। প্লিজ বুবুন আমি জানি তুই ভেতর ভেতর ভীষণ ভাবে গুমরে মরছিস। আমি কি করবো বল।
আমি মিত্রার দিকে স্থির চোখে তাকালাম।
তুই পিকুকে না মেরে তোর মিত্রাকে মেরে দে তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।
তনু আমার বুকে লুটিয়ে পরলো।
তোমার এই হাসিটা স্বতঃস্ফূর্ত নয়। তুমি ভেতর ভেতর ভীষণ কষ্ট পাচ্ছ। প্লিজ তুমি হেসো না।
কেন তনু, আমার হাসিতে জাদু আছে। আমি হাসলে সকলে ভুলে যায়, তুমি বারণ করো না।
দু-জনেই আমার বুকে মুখ লুকিয়েছে।
তোমরা দুজনে বলো না, সব এবার ছেড়ে ছুড়ে দাও। অনেক হয়েছে আর নয়।
মিত্রা, তনু দু-জনেই আমার দিকে তাকাল। চোখ ছল ছল করছে।
আর কোনও দিন বলবো না।
একবার ভেবে দেখ। চাঁদের সঙ্গে আমার কোনও রিলেশন নেই। তাহলে পিকু বাঁচতো।
আমি সেটা মিত্রাদিকে বলেছি। তনু বললো।
তাহলে কালকে দাধিয়ার ব্যাপারে পিকুকে যে বলেছি সেটা মিথ্যে নয় এটা বুঝতে পারছ।
খুব পারছি।
এখন এটা থাক তোকে আর একটা কথা বলি। যদি কাল সকালে মরে যাই তাহলে আর বলা হবে না।
মিত্রার কথায় আমি আবার হাসলাম।
তুই হাস আর যাই কর। আমরা তোকে ছাড়া বাঁচব না।
আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে।
বিতানকে নিয়েও বড়োমা সমস্যায় পড়েছে।
আমি জোড়ে হেসে উঠলাম।
পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।
নিয়ে যায়নি। পুলিশ এসেছিল। বড়োমা, অনিমেষদাকে দিয়ে ফোন করিয়েছে।
তাহলে বোঝ এক একটা কি রকম রত্ন। সব অনিদার নাম ভাঙিয়ে দাদা হয়ে যাব। তোর বুবুন এখনও দাদা হতে পারলো না।
মিত্রা আমার বুকে মুখ ঘষছে।
আমার কি লজ্জা করছে বুবুন। নিজের সব আত্মীয়।
লজ্জার কিছু নেই মিত্রা। এটাই বাস্তব। কষ্ট না করে সব পেয়ে গেছে। টিয়া কোথায়?
কনিষ্ক কাল নার্সিংহোমে ভর্তি করেছে। চোখটা মনে হয় একটু সমস্যা করেছে।
আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম।
কাল কনিষ্ক বিতানকে উত্তম মধ্যম দিয়েছে। দুই বাড়ির লোককেও আচ্ছা করে শুনিয়ে দিয়েছে। বলেছে, অনির কানে কথাটা ঘুণাক্ষরেও তুলবেন না। তাহলে বিতান জেল খাটবে। আপনারা চান আপনাদের জামাই জেল খাটুক। টিয়াও চাইবে না। তখন উল্টো কেশ। দুই পরিবার স্থিতাবস্থা বজায় রাখুন।
টিয়াকেও বলেছে, তুই কেমন ধারা মেয়ে। আমাদের না জানাস একবার তোর মিলিদিকে জানাতে পারতিস। তাহলে জলটা এতদূর গড়াত না। একবার তোদের অনিদার কথা ভেবে দেখলি না।
টিয়া, কনিষ্ককে ধরে ভেউ ভেউ করে খানিকটা কেঁদেছে।
ও বাড়িতেই খবর পেলাম ডাক্তারদাদার শরীর খারাপ।
বড়োমা ফোন করে কান্নাকাটি শুরু করে দিল।
তুই কোথায়, এখুনি আয় ডাক্তারের বুকে ব্যাথা করছে। অনিকে ফোনে পাচ্ছি না, ওর ফোন বন্ধ। ব্যাশ পড়ি কি মরি করে দে ছুট। জ্যেঠিমনিরাও সবাই সঙ্গে এলো।
শেষ পর্যন্ত আর জ্যেঠিমনির সব কথা শোনা হয়নি। তবে মনে হয় এখানে এসে অনিমেষদাকে বলেছে। অনিমেষদা বলেছে একবারে অনির কানে তুলবেন না কথাটা, আমি দেখছি।
আর ভালো লাগছে না। তোদেরকে জাপ্টে ধরে একটু ঘুমই।
মিত্রা তনু দুজনেই বুকে মাথা রাখলো।
সকালে বাথরুমের কাজ সেরে যখন বেরলাম মিত্রা পাজামা-পাঞ্জাবী দিয়ে বললো, সাগর দাধিয়া এসেছেন তোর সঙ্গে দেখা করতে চান। ওনার স্ত্রী মেয়েও সঙ্গে এসেছেন।
মিত্রার চোখে চোখ রাখলাম। আমি ঘুমবার পর কাল সত্যি ও ঘুমিয়ে ছিল কিনা। চোখে মুখে সামান্য ক্লান্তির ছাপ। হয়তো আমার ওঠার কিছুক্ষণ আগেই ওরা উঠেছে। দাধিয়া এসেছে। ও এতটা ক্যাজুয়েলি আমাকে বলছে! কোনও উত্তেজনা ওর চোখে মুখে দেখতে পাচ্ছি না।
দরজার দিকে তাকালাম। ভেজান। ছিটকিনি দেওয়া নেই।
আমি টাওয়েল ছেড়ে পাজামাটা গলাতে গেলাম।
ভেতরে কিছু পরবি না।
না।
প্লিজ এরকম করিস না। বাড়িতে অনেক অপরিচিত লোকজন আছে।
বার কিরস নি কেন?
দিচ্ছি।
মিত্রা আলনা থেকে ড্রয়ারটা দিল।
আমি খাটে বসে পড়তে শুরু করলাম।
কিছু বললি না?
কি!
সাগর দাধিয়া এসেছে যে।
তার প্রয়োজনে সে এসেছে। নিশ্চই আমার কোনও সমস্যার সমাধান সে করতে আসেনি।
মিত্রা এক দৃষ্টে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
বড়োমা তোকে আমার মন বুঝতে পাঠিয়েছে?
না।
তাহলে?
তুই ভদ্রলোককে কিছু বলিস না।
বলার পরিস্থিতি তৈরি হলে বলবো, না হলে বলবো কেন।
মিত্রা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
কে নিয়ে এসেছে?
নিজেই এসেছেন।
এ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া ঢুকতে দিলি কেন?
রতন সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।
ও ঘরে জামাই আদরে বসিয়ে রেখেছিস?
না। অনিমেষদার সঙ্গে কথা বলছেন।
আমি একবার মিত্রার দিকে তাকালাম। কোনও কথা বললাম না। ওর চোখদুটো ভালো করে দেখলাম। স্থির চোখ। কোনও উত্তেজনা নেই। নেই কোনও চিন্তার ছাপ।
মিত্রা আগের থেকে অনেক পাকা হয়েছে।
আমি আলমাড়ির সামনে চিরুনি নিয়ে দাঁড়ালাম।
মিত্রা আর একটা পাঞ্জাবী থেকে বোতাম খুলে এই পাঞ্জাবীতে লাগাচ্ছে।
তনু কোথায়?
ও ঘরে।
ডাক।
তুই তো ও ঘরে যাবি।
না। চা নিয়ে আয়, আর সাগর দাধিয়াকে পাঠিয়ে দে।
মিত্রা মিট সেফের সামনে গেল। প্যাকেট থেকে ওষুধ বার করে জলের বোতলটা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।
আমি পাঞ্জাবীটা গলিয়ে ওর হাত থেকে ওষুধ নিয়ে খেলাম।
আমার মোবাইলটা কোথায়?
টেবিলে আছে।
তোকে যা বললাম তাই কর।
আন্টি সকাল থেকে চা খায়নি।
কেন?
তোর সঙ্গে একসঙ্গে চা খাবে।
ঠিক আছে তুই যা। আন্টিকে গিয়ে বল, আমি পাঁচমিনিট পর যাচ্ছি।
তুই আমার সঙ্গে চল।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
তুই ওরকম ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা চোখে তাকাবি না।
ভয় করছে?
মিত্রা মুখ নামিয়ে নিল।
অনিকা, মেয়ে কোথায়?
ইসলামভাই-এর সঙ্গে বেরিয়েছে।
ছেলেরা?
ওরাও গেছে।
কাল যা বলেছিলাম তার ব্যবস্থা করেছিস?
তোকে আন্টি সব বলবে।
ডাক্তারদাদা আছে?
আছে।
ঠিক আছে তুই যা আমি যাচ্ছি।
মিত্রা এগিয়ে এলো।
অনেকক্ষণ থেকে ঘ্যানর ঘ্যানর করছি, তোর অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছি। তোর যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে। এবার কিন্তু মারপিট শুরু করে দেব।
একলা পারবি না, আর একজনকে ডাক।
দেখলাম তনু দরজাটা সামান্য খুলে মুখ ঢোকাল।
মিত্রাদি গ্রীণ সিগন্যাল?
আমি তনুর দিকে তাকিয়ে।
ভেতরে আয়। মিত্রা বললো।
তনু ভেতরে এলো। এবার দরজাটা বন্ধ কর।
মিত্রা আমার দিকে তাকাল।
ভাবছিস এটা নতুন স্কিম কিনা।
আমি হেসে ফেললাম।
মিত্রা জড়িয়ে ধরলো।
মিত্রা-তনু যতই অন্যায় করুক তুই ওদের বকতে পারিস, মারতে পারবি না।
আমি কোন দিকটা ধরবো। তনু বললো।
তনুর গালটা টিপে দিলাম।
এই হাসিটা কালকের থেকে অনেক পরিষ্কার।
হাসির আবার পরিষ্কার, অপরিষ্কার আছে নাকি?
তোমার কাছ থেকে শিখেছি।
চেলুয়া ভালই বানিয়ছিস। মিত্রার দিকে তাকালাম।
কেন তোর নেপলা চেলুয়াটা খারপ নাকি?
এর মধ্যে নেপলা আবার ঢুকলো কোথা থেকে!
মিত্রার দিকে তাকালাম।
দেখলি তনু, আবার ভুল করলাম।
তনু হাসছে।
চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম।
তুমি বলেছো? তনু মিত্রার দিকে তাকাল।
বলার সঙ্গে সঙ্গে চোখ দেখলি না-তো। যেন গিলে খেয়ে নেবে।
সারাদিন তোমাকে আর পাবো না। একটা দাও। তনু গাল এগিয়ে দিল।
আমি দু-জনের গালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম।
বারান্দায় আসতেই দেখলাম নেপলা, রতন বাগানে চেয়ার পেতে বসে আছে। নেপলা আমাকে দেখে হাসলো। মর্নিং স্যার।
হাসলাম। তোকে নিয়ে একটু বেরবো ঘণ্টা খানেকের জন্য।
আমি রেডি, তুমি চান্স পাবে?
হাসলাম। রতন কি বলছে?
প্রেসারটা একটু বেরেছে, ওষুধ দিচ্ছি।
আমি এ ঘরে এসে ঢুকলাম। মিত্রা, তনু আমার দু-পাশে।
সিঙ্গেল সোফার একটা ডাক্তারদাদার দখলে আর একটা দাদা দখল করে বসে আছে। মাঝের বড়ো সোফায় অনিমেষদা, আন্টি, বিধানদা। বৌদি, ছোটোমাকে রান্নাঘরের সামনে দেখলাম।
বড়োমাকে দেখতে পেলাম না। নতুন মুখ বলতে সাগর দাধিয়া এবং তার স্ত্রী। দুজনেই চেয়ারে বসে। ডাক্তারদাদার দুইপাশে দুজন। সবাই আমাকে দেখছে।
এরাই তাহলে সাগর দাধিয়া এবং তার স্ত্রী? কন্যাটি গেল কোথায়? মিত্রা বললো সপরিবারে এসেছে! তাছাড়া একেবারে অন্দরমহলে এন্ট্রান্স! কোথাও মনে হচ্ছে গণ্ডগোল ঠেকছে?
ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা দু-জনেই আমাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আন্টি, বিধানদা হাসছে।
ডাক্তারদাদা, অনিমেষদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
সবার দিকে একঝলক তাকিয়ে হেসে ফেললাম।
তোমাদের কোনও কাজ নেই, সক্কাল সক্কাল আড্ডা মারতে বসে গেছে।
বিধানদার দিকে তাকালাম।
দাধিয়ারা আমার দিক থেকে কোনও রেসপন্স না পেয়ে, দুজনেই নিজের চেয়ারে আবার বসলো।
তুই তো বেকার করে দিয়েছিস, তাই এখানে বসেই যতটুকু কাজ করার ততটুকু করছি। বিধানদা বললো।
অনিমেষদা মৃদু হাসলো।
সরো চারজনের সিটে তিনজন বসলে চলে।
আমি অনিমেষদা আন্টির মাঝে নিজেকে গুঁজে দিলাম।
বড়োমা। চেঁচিয়ে উঠলাম।
একটু বেরিয়েছে। এখুনি এসে পরবে। ডাক্তারদাদা বললো।
ছোটোমা। আবার চেঁচালাম।
অপেক্ষা করো, সবে মাত্র জলটা ফুটলো। ছোটোমা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো।
ডাক্তারদাদার মুখের দিকে তাকালাম।
বড়োমাকে তুমি পাঠিয়েছ?
নিজেই গেছে।
কাজে না অকাজে?
দুটোই।
একবারে ফুলস্টপ মেরে দিলে।
অনিমেষদা আমার পিঠে হাত রাখল। বিধানদা আমার কথা শুনে হাসছে।
আন্টি তুমি নাকি চা খাও নি?
ছোটোমা একবার রান্নাঘর থেকে মুখ বার করে আমাকে দেখল।
ভাবলাম তুই আমি সকালে একসঙ্গে চা খাব। তুই যে এত বেলা করে উঠিস কি করে জানবো।
কাল মিত্রাদের সময় দিতে গিয়ে ভোর হয়ে গেল।
সারারাত গল্প করলি!
হ্যাঁ। তোমার গল্প, ডাক্তারদাদার গল্প, পাঁচ মিশেলি আরও কত কি? ওদেরও অনেক কথা আছে, শোনা হয় না। ধৈর্য ধরে শুনলাম।
আদর্শ স্বামীর পরিচয় দিলি বল। অনিমেষদা বললো।
স্বামী নয়। বন্ধু। তুমি ওদের জন্য ছেলে দেখতে পার।
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। দাধিয়া তার স্ত্রীও হাসছে।
সুতপা শুনছো তোমার ছেলের কথা। বিধানদা বললো।
সুরো ঠিক বলে তোর মুখ না থাকলে সারমেয়….।
হাসির রেশ তখনো থামেনি।
তনু-মিত্রা এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে। মুচকি মুচকি হাসছে। ব্যাপারটা এরকম আমি তোর খেলাটা শেষ পর্যন্ত দেখতে চাইছি।
ডাক্তারদাদার দিকে তাকালাম, তুমি চা খেয়েছো না আমার জন্য বসে আছো?
একটুখানি খেয়েছি, ছোটো আবার দেবে বলেছে।
ছোটোমা। আবার চেঁচিয়ে উঠলাম।
নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
তুমি তো ট্রেনের ঘোষনা শুরু করে দিলে, আপ চা লোকাল সেন্টার টেবিলে আসবে, আপ চা লোকাল সেন্টার টেবিলে আসছে।
সবাই হাসছে।
ছোটোমা, বৌদি রান্নাঘর থেকে চায়ের ট্রে নিয়ে বেরলো। তনু, মিত্রা উঠে গেল।
দিদি দিনতো ওর কানটা মূলে। ছোটোমা, আন্টির দিকে তাকিয়েছে।
সে তো তোমাদের নাইনটি নাইন ইয়ার্সের জন্য লিজ দিয়ে দিয়েছি এবার আন্টি নতুন সংযোজন।
আন্টি আমার গলা জড়িয়ে ধরলো।
আজ একটু তোমার অনারে খাওয়া-দাওয়া নাচা-নাচি হবে না? স্পন্সর ডাক্তারদাদা।
ছোটো শুনছিস অনির কথা। আন্টি বললো।
অনিমেষদার দিকে তাকালাম। মিটি মিটি হাসছে।
যতই মাপার চেষ্টা করো। ব্যাপারটা বিধানদা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ওখানে নো এন্ট্রান্স।
একটু চাপা স্বরে কথাটা বললাম।
অনিমেষদা সারাটা শরীর কাঁপিয়ে জোরে হেসে উঠলো।
কিগো তুমি ওরকম পাগলের মতো হাসছো কেন! বৌদি বললো।
অনিমেষদা হাতের ইশারা করছে, তুমি থামো সুতপা আগে প্রাণভরে হেসে নিই। তারপর বলছি।
দাদাও দেখছি মুচকি মুচকি হাসছে। আমার দিকে কুত কুত করে দেখছে।
আপনি শুনেছেন ?
দাদা মাথা দোলাচ্ছে, শুনেছি।
মিত্রা-তনু হাসছে কিন্তু ওদের চোখ বলছে আমরা তোর ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছি না।
কিগো অনিমেষ? আন্টি বললো।
পরে বলছি আপনাকে দিদি?
ছোটোমা, অনিমেষদাকে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলো, অনিমেষদা ইশারাতেই উত্তর দিল। বৌদি দেখে ফেলেছে। দুজনে নতুন করে হাসা শুরু করলো। ডাক্তারদাদাও বুঝতে পেরেছে মুচকি মুচকি হাসছে।
অনিমেষ ও নিশ্চই কালকের তাসটা ওপেন করলো তাই না। বিধানদা হাসতে হাসতে বললো।
অনিমেষদা হাসতে হাসতেই মাথা দোলাচ্ছে।
বদ বুদ্ধির বাসা। বিধানদার স্নেহের উক্তি।
দাধিয়া তার স্ত্রী না বুঝেই হাসছে। সবাই হাসছে তাই।
মিত্রারা টেবিলের ওপর কাপ সাজিয়ে চা ঢালছে।
তুই ওনাদের কথা জিজ্ঞাসা করলি না?
অনিমেষদার মুখের দিকে তাকালাম। চোখ সরিয়ে নিয়ে সাগর দাধিয়া তার স্ত্রীর দিকে তাকালাম।
চিনতে পারলাম না।
এতক্ষণ জিজ্ঞাসা করলি না?
হয়তো তোমার কিংবা বিধানদার পরিচিত, কোনও কাজে এসেছেন।
দিদির মেয়ে জামাই।
কথাটা শোনা মাত্রই উঠে দাঁড়ালাম। সাগর দাধিয়া তার স্ত্রী উঠে দাঁড়িয়েছেন। সাগর নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। আমি বুকের ওপর হাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গিতে দাঁড়ালাম।
সাগর দাধিয়া। নিজেই নিজের নাম বললেন। তারপর নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন আমার স্ত্রী নয়না দাধিয়া।
আমি অনিন্দ ব্যানার্জী। লোকের মুখে নামটা ছোটো হয়ে অনি ব্যানার্জী হয়ে গেছে।
একবার চারদিক লক্ষ করে নিলাম। মিত্রা-তনুর চোখে মুখে বিষ্ময়।
কাল আপনাদের না জানিয়ে একটা অন্যায় কাজ করে ফেলেছি। বলতে পারেন হঠাৎ একটা অঘটন ঘটে গেল। আপনারা যখন এই বাড়ির অন্দর মহলে ঢুকে পড়েছেন তখন নিশ্চই সব শুনে থাকবেন।
দুজনেই হাসছে।
আপনার নাম শুনেছি। চাক্ষুষ দেখি নি। আজ দেখছি। সাগর বললো।
আপনি খুব ভালো বাংলা বলেন।
আমার তিনপুরুষ কলকাতার বাসিন্দা।
বসুন।
আমি নিজেও বসলাম।
ছোটোমা কচুরী নেই?
বুঁচকিরা আনতে গেছে।
মিত্রারা সকলকে চা এগিয়ে দিয়েছে। চায়ে চুমুক দিলাম। আন্টির দিকে তাকালাম।
মেয়ে জামাইকে বলেছো?
ওরা জানে।
তোমারও ক্রনিক আছে নাকি?
আন্টি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
হ্যাঁরে শয়তান, আমাশা বলতে মুখে বাধছে। বৌদি খ্যার খ্যার করে উঠলো।
আন্টি, বৌদির দিকে তাকাল।
কি হলো সুতপা অনি কি বললো, ঠিক বুঝলাম না। আন্টি বললো।
ডাক্তারদাদা হাসতে হাসতে সোফায় হেলে পড়েছে।
বুঝলেন না? বৌদি হাসছে।
না।
একটু আগে আপনাকে কি বললো? মেয়ে জামাইকে বলেছো? আপনি উত্তর দিলেন ওরা জানে।
হ্যাঁ। আমি তাই বললাম।
তারমানে এরই মধ্যে সব কিছু মেয়ে জামাইকে খুলে বলে দিতে হবে, একটু রয়ে সয়ে বললে হতো না। তারমানে আপনার আমাশা রোগের ধাত আছে, আপনি পেটে কিছু রাখতে পারেন না, আপনাকে এবার থেকে সব কথা বলা যাবে না।
ওরি বাবা, ও এতো ভাবে!
এতো না। এর পরের পাঁচ ছটা ধাপ ওর ভাবা আছে। কার পর কি হবে।
সেই জন্য অজু একদিন কি কথায় বললো, আমার তোমার কলেজ লাইফের মার্কশিট পর্যন্ত অনির কাছে আছে। ডকুমেন্টস ছাড়া ও কথা বলে না।
আন্টি আমার পিঠে হাত রাখলো।
তোর পেটে পেটে এতো বুদ্ধি!
বুদ্ধির কথা বলবেন না। আপনার পাশে একজন ওই পাশে একজন দু-জনকে ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। একটু আগে আমরা সকলে এত হাসাহাসি করেছি কিছু বুঝতে পেরেছিলেন?
এই দেখো আবার ব্যাড় ব্যাড় করে। বিধানদা, বৌদির দিকে তাকাল।
ছোটোমা খিক করে হেসে উঠলো।
ডাক্তারদাদা, দাদা সবাই মুচকি মুচকি হাসছে।
আন্টি, বৌদির দিকে জিজ্ঞাসা ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে।
বলবো আপনাকে সময় করে। কয়েকদিন থাকুন সব বুঝতে পারবেন।
আমার কোনও বিকার নেই। আমি মিত্রা, তনুর দিকে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছি। চোখে প্রশ্ন, কি বুঝছিস? ওরাও আমার চোখে চোখ রেখেছে।
বাইরে গাড়ির হর্ণ বেজে উঠলো। বুঝলাম সকলে ঢুকছে।
ডাক্তারদাদা, নাতনি কিছু বলেছে? আমি বললাম।
কাল থেকে সমানে ঝগড়া করে চলেছে।
তোমাকে একটা টিপস দেব।
সত্যি! ডাক্তারদাদা সোজা হয়ে বসলো।
দেখবে তোমার সঙ্গে আর ঝগড়া করবে না। মিউচ্যুয়াল আন্ডারস্ট্যানডিংয়ে চলে যাবে।
আন্টি খুব জোড় হেসে উঠলো।
দে দে সিগগির দে। সবার সামনে বেজায় বেইজ্জত করছে। বুড়ো বয়সে সহ্য করা যাচ্ছে না।
তনু, মিত্রা এতক্ষণে জোড়ে হাসলো।
তোরা হাসিস না মামনি, কাল থেকে দিদান, নাতনি আমাকে একবারে বাটনা বেটে দিচ্ছে।
বাবা।
দরজার দিকে তাকালাম। অনিকা, অনিসা দাঁড়িয়ে। মাঝখানে একটা নতুন মেয়ে। আধুনিক সাজ-পোশাকে শরীর ঢাকা। মেয়েটার মুখটা বেশ মিষ্টি, বেশ ধারালো।
অনিকা, অনিসা দুজনেরি মুখ লাল হয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে রোদে ঘুরেছে। মেয়েটি অনিসার বয়সী। আমাকে দেখে মুখ নামিয়ে নিল। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।
মাই ফ্রেন্ড নম্রতা দাধিয়া। অনিসা বললো।
মেয়েটি এগিয়ে এসে আমাকে প্রণাম করলো।
আঙ্কেল, আন্টির সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে। মেয়ে বললো।
মাথা দোলালাম। হ্যাঁ।
নম্রতা তার বাবা-মার পাশে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলো।
তোর বাবা আমাকে টিপস দেবে বলেছে। তাহলে তুই আর ঝগড়া করবি না। ডাক্তারদাদা বললো।
বললেই হলো, বাবা কোনওদিন বলবে না।
তারমানে তোরও একটা বয়ফ্রেন্ড আছে বল। অনিমেষদা বললো।
একটা না অনেক। বাবা সব জানে।
মার দিয়া কেল্লা। ডাক্তারদাদা শরীর নাচিয়ে বলে উঠলো
হ্যাঁ বুড়ো, আজ রাতে তোমার কেল্লা ভাঙবো।
সবাই হাসছে।
তিনজনের কপালেই দেখলাম লাল টিপ। তারমানে মন্দিরে গেছিল।
বড়োমা, দামিনীমাসি, জ্যেঠিমনি, ইসি ঘরে ঢুকলো। প্রত্যেকের হাতে পূজোর প্রসাদ।
সর না সংয়ের মতো এখানে দাঁড়িয়ে রইলি কেন। বড়োমা তরপে উঠলো।
বেশ করেছি, তুমি কিছু করতে পারবে। অনিসা ঝাঁঝিয়ে উঠলো।
বাপ সোহাগী হয়েছো। সারাটা রাস্তা বাবা আর মামা করে দুজনে পাগল করে দিল।
অনিকা, অনিসা দুজনে হাসে।
বড়োমা এসে আমার কপালে ফুল ছোঁয়াল। হাতে প্রসাদ দিল। এরপর সবাইকে দিল।
আমি প্রসাদ মুখে দিলাম।
কখন উঠলি?
ঘণ্টা দুয়েক।
আমি গেলাম এক ঘণ্টা আগে! তাই না দামিনী?
মাসি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
উপলক্ষ?
কিসের উপলক্ষ। মন চাইল তাই মন্দিরে গেলাম।
ঝামেলা মিটল কি বলো, তাই ঠাকুরকে ঘুষ দিয়ে এলে।
ছোটো ওর মুখটা টিপে ধরতো।
ছোটোমা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
নার্সিংহোমের পেসেন্ট তাহলে ভাল আছে। আমার যাওয়ার আর দরকার নেই।
বড়োমা হেসেফেললো। মিত্রার দিকে তাকাল।
চলবে —————————–
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/miEWaqf
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment