❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
২০৬ নং কিস্তি
—————————–
একদিন হঠাৎ উদয় হলো। হাসতে হাসতে বললো, তাহলে দাঁড়ে বসলে।
তখন বুলা অফিসে আসে।
কথার ফাঁকেই বললো একটা চাকরি জুটলো বুঝলে।
কোথায়?
যেখানে ফ্রি-ল্যান্সিং করতাম ওখানে, এখন রেগুলার যেতে হবে। লেখার ওপর পয়সা।
কি খাবি বল।
কে খাওয়াবে, তুমি না আমি? যদি বলো আমি, তাহলে ক্যানসেল। পকেট গড়ের মাঠ।
তোর তো বিয়ের খাওয়াটা পাওনা আছে।
তাহলে চলো তুমি আমি আর বৌদি তিনজনে ছেঁড়া পরোটা, ঘুগনি আর জিলিপি দিয়ে লাঞ্চটা সারি।
খুব ক্যাজুয়েল কথা।
প্রথমটায় একটু আমতা আমতা করছিলাম। বিয়ে করলাম কি ছেঁড়া পরোটা ঘুগনি খাব।
অনেক পরে বুঝেছিলাম বুলা অনির কথাটা গেড়ো মেরেছিল।
সেদিন বলতে পারো বুলার জেদা-জিদিতে পার্ক স্ট্রীটের ফুটে দাঁড়িয়ে ছেঁড়া পরোটা ঘুগনি জিলিপি খেলাম। অনি, আমি বহুবার খেয়েছি। বুলা সেদিন প্রথম আমাদের সঙ্গে খেলো।
আমর থেকেও বুলার সঙ্গে ওর বেশি ভাব।
তিনজনে খাচ্ছি কথা বলছি। হঠাৎ বুলা বললো।
তাহলে লাঞ্চটা ভালই খাচ্ছিস কি বল। আর দুটো ছেঁড়া পরটা নে।
দেখলাম খেতে খেতে অনি থেমে গেল, মুচকি হাসলো।
কথাটা আমার কানে কেমন খটকা লাগল। সেই মুহূর্তে কিছু বললাম না। ও আমাদের সঙ্গে ফিরে এলো না। ওখান থেকেই কাজের অছিলায় চলে গেল।
ফেরার সময় বুলাকে বললাম।
হঠাৎ অনিকে তুমি তখন ও কথাটা বললে।
বুলার চোখ দুটো কেমন যেন লাগল। ঠিক ভালোলাগল না। ভাবলাম, হয়তো ওই মুহূর্তে কথাটা জিজ্ঞাসা করে ওকে অন্য কোনও ইঙ্গিত দিয়ে ফেলেছি।
নিজের মনটা খারাপ হয়ে গেল।
সারাটা রাস্তা বুলা আমার সঙ্গে কথা বললো না।
এমন কি অফিসে এসেও আর সেইভাবে কথা বললো না।
রাতে শুয়ে আমাকে বললো, তখন তুমি আমার কাছে অনিকে কেন ঠিক ওই সময়ে ওই কথাটা বললাম জানতে চেয়েছিলে।
বললাম হ্যাঁ।
তখন বলিনি এখন বলছি।
আমি বুলার দিকে তাকালাম।
অনি চার দিন ছাতু গোলা খেয়ে রয়েছে। পকেটে পয়সা নেই। খাওয়া জোটে নি। কম পয়সায় পেট ভরা খাবার।
তুমি কি বলছো বুলা!
ঠিক বলছি।
আমাকে আগে বল নি কেন! তাহলে ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে ভাত খাওয়াতাম।
ওর যেটুকু প্রাপ্য তুমি সেটুকুও ওকে দাও না। তাই তোমার কাছে ও বিশেষ একটা চায় না।
বিশ্বাস করো দিদি বুলার সেদিনের সেই কথা আমার শরীরের মাংস ভেদ করে হাড়ে বিঁধেছিল। নিজেকে সেদিন সবচেয়ে বেশি অপরাধী মনে হয়েছিল।
আবার সুজিতদার চোখ ছল ছল করে উঠলো। বৌদি মাথা নীচু করে সুজিতদার পাশে বসে আছে। ছলছল চোখেই সুজিতদা বললো।
বুলা বললো, তুমি মনে কিছু করো না। আমি ক্যাশ থেকে অনিকে একশোটা টাকা দিয়েছি। ওর কাজের সঙ্গে এ্যাডজাস্ট করে নিও। নাহলে আমার মাইনে থেকে কেটে নিও।
বিশ্বাস করো দিদি, কথাটা এতটা খারাপ লেগেছিল তোমাকে কি বলবো। সুজিতদা আবার কাঁদতে শুরু করে দিল। কাঁদতে কাঁদতে বললো।
বার বার মনে হচ্ছিল অনিকে যদি ওই মুহূর্তে হাতের কাছে পেতাম তাহলে ওর পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নিতাম।
বুলা আমার মুখ দেখে বুঝেছিল।
বললো মনখারাপ করো না।
আর মন খারাপ। পরের দিন অফিসে এসেই ওর খোঁজ নিলাম। মল্লিকদাকে ফোন করলাম। কোথায় অনি। বাউন্ডুলে নম্বর ওয়ান।
ওর বুজুম ফ্রেন্ড সন্দীপ। ওকে বললাম, বল অনি কোথায় থাকে আমার খুব দরকার।
তা বললো আমার সঙ্গে সাতদিন দেখা নেই। অফিসেও আসে না।
প্রায় দু-সপ্তাহ পরে সূর্যের উদয় হলো।
সেই নিপাট হাসি। ঘরে ঢুকেই বললো।
মালকিন বললো, তুমি আমাকে নাকি খোঁজা খুঁজি করছো।
ক্ষমা ওর কাছে চাইতে পারিনি। তবে অনেক কাজ দিলাম। বুলাকে বললাম আজ থেকে অনির হিসাব পত্র তুমি করবে। যা পয়সাগড়ি দেওয়ার তুমি দেবে। আমি এ ব্যাপারে আর কোনও দিন মাথা গলাব না।
ওকে অবশ্য সেটা জানাইনি। আমার বুলার মধ্যে চুক্তি।
ছাতুর কাজটা করার পর বেশ নাম হলো। একটা চা কম্পানীর প্রমোর কাজ পেলাম।
আবার অনিকে হন্যে হয়ে খুঁজি। আর অনি।
আবার মল্লিকদার স্মরনাপন্ন হলাম। বললো আমারই খুব দরকার, পাচ্ছি না। দাঁড়া ওর ছোটোমাকে জিজ্ঞাসা করি। সেদিন প্রথম তোমাদের কথা জানলাম।
তোমরাও কোনও হদিস দিতে পারলে না। তারপর তনুকে ডাকল।
সেই প্রথম তনুকে দেখলাম।
ভাবলাম এ অনির পাল্লায় পড়েছে। হায়, এর কপালে যা দুর্ভোগ আছে।
তনু বললো পর্শু একবার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। হোটেল হিন্দুস্থানে একটা প্রগ্রাম আছে।
কখন বল। টাইম দিল।
সেদিন সময় মতো গেলাম। বাবুর পাত্তা নেই, তনুর সঙ্গে কথা বললাম, ওকে সব জানালাম।
তনু তখন কথায় কথায় বললো দেখুন ও হয়তো এই হোটেলে বয়ের কাজ করছে।
বয়ের কাজ করছে মানে!
তখন ও সেই নাটকের নিউজের কথা বললো। শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম।
ওর পক্ষেই সম্ভব। বিফল হয়ে ফিরে এলাম।
পরের দিন মল্লিকদার ফোন।
অনি এসেছে।
ছুটে গেলাম। কথা বললাম। বললো বিকেলের দিকে এসে দেখা করবে।
এবার তনু বলবে আমি একটু জল খাই।
আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে।
কেন?
এই ঘটনাটা আমারও জানা হয়নি। তনুকে বলেছিলাম তনু বলেছিল পরে বলবে।
আমি তনুর মুখের দিকে তাকিয়েছি।
তোমার মনে আছে?
ঠোঁট বেঁকিয়ে মাথা দোলালাম। না।
ঢং।
জানো দিদি সেদিন মল্লিকদা আমাকে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিল। কাজটা করে অফিসে গেছি। গিয়ে দেখলাম বাবু নিজের টেবিলে বসে কি লিখছেন।
মল্লিকদাকে ইসারায় জিজ্ঞাসা করলাম ব্যাপার কি?
বললো, তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার চোখ কপালে।
আমার জন্য!
হ্যাঁ। আমাকে তোর কথা জিজ্ঞাসা করলো। বললাম একটা অ্যাসাইনমেন্টে পাঠিয়েছি। কিছু বললো না। নিজের টেবিলে গিয়ে মুখ গুঁজে বসে গেল।
ভাবলাম আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে।
বললাম, বাবুর কাছে এখন যাওয়া যাবে?
তুই মেয়ে যেতে পারিস। অন্য কেউ গেলে হয়তো খিঁচিয়ে উঠবে।
আমাকেও মুখ খিঁচুনি দেয়।
মল্লিকদা হাসছে।
মল্লিকদাকে নিজের কাজ বুঝিয়ে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
কি লিখছিল, লিখতে লিখতেই একবার মুখ তুললো। বেশ বুঝলাম আমাকে দেখলো বটে কিন্তু ওই পর্যন্ত, তারপর ইশারায় বললো, বসো।
পাশে একটা চেয়ারে বসলাম।
মল্লিকদা যে আমার দিকে লক্ষ্য করছিল বুঝতে পারিনি। চোখচুখি হতে হেসে ফেললো।
মিনিট পনেরো পর বাবুর ধ্যান ভঙ্গ হলো।
বিকেলে তোমার কোনও কাজ আছে?
না। ভাবলাম হয়তো সিনেমা-টিনেমায় যেতে বলবে। ওমা বলে কি….।
উপরি টাকা কামাবার ইচ্ছে আছে।
এই কথার কি উত্তর দেব। মনে মনে নিজেকে নিয়ে ভীষণ গর্ব করতাম। আমাকে দেখে এই অফিসের কত বাবুর জিভে জল আসে। আর এই মানুষটা কি নির্লিপ্ত। বললাম।
পেলে ভালো হয়।
তাহলে আমার সঙ্গে চলো। মিনিট পনেরো পর বেরবো।
এই যে বললে বিকেলে।
একবার আমার দিকে কট কট করে তাকাল।
আর কোনও কথা নেই। সোজা মল্লিকদার টেবিলে চলে গেল। লেখাটা দিয়ে কি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। বোঝার চেষ্টা করছি। ভাবলাম একবার বলি না আমি তোমার সঙ্গে যাব না। তারপর ভাবলাম গিয়ে দেখি কোথায় নিয়ে যায়।
আমি তখনও ওকে ঠিক মিলিয়ে উঠতে পারছি না। ও কি আমার সঙ্গে অভিনয় করছে। না ওর স্বভাব চরিত্রটাই এই রকম।
একটা ব্যাপার খুব ভাল ভাবে লক্ষ করেছি। ওর ওই রকম আচরণে কেউ টেঁ ফুঁ করে না।
কেউ কেউ তো কানা ঘুঁস করে অনি হচ্ছে এডিটরের কোলের ছেলে।
কথাটা খারাপ লাগলেও কাউকে কিছু বলি না।
সন্দীপদা আভাস ইঙ্গিতে বোঝাবার চেষ্টা করতো, তনু সাবধান।
আমি মল্লিকদার টেবিলে উঠে গেলাম। সন্দীপদা বসেছিল। আমি আর একটা চেয়ারে বসলাম।
মল্লিকদা মুচকি মুচকি হাসছে।
কিরে কি বললো?
বললো উপরি টাকা কামাবার ইচ্ছে আছে নাকি।
সেই শুনে সন্দীপদার কি হাসি।
আমি সন্দীপদার মুখের দিকে তাকালাম।
তুমি হাসলে যে!
তুমিও ওর পাল্লায় পরলে?
কেন!
ও একটা বদ্ধ পাগল।
কই! পাগলামর তো কোনA চিহ্ন দেখছি না। বেশ তো স্বাভাবিক।
দূর আমি কি ওই পাগলামর কথা বলেছি। ও কাজের পাগল। তোমাকেও নাকানি চোবানি খাইয়ে দেবে। তুমি হাঁপিয়ে উঠবে।
কাজ করতে আমার ভালই লাগে।
তুই মরেছিস। মল্লিকদা বললো।
বাবু গেলেন কোথায়? আমি বললাম।
বটাদার কাছে।
তখন কি তোর সঙ্গে ওর ….? মিত্রা বললো।
হ্যাঁ ঝাড়গ্রামের সেই কভারেজটা সবে মাত্র করে এসেছি। বিশ্বামিত্র মুনির ধ্যান ভঙ্গ করেছি।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো। মল্লিকদাকে বললো, সাত-আটদিন দেখা পাবে না। কোনও ইনফরমেসন থাকলে ছোটোমাকে দিয়ে দেবে। সময় মতো নিয়ে নেব।
তার আগে ছোটোমা, বড়োমার পরিচয় পেয়েছি।
দুজনে বেরিয়ে এলাম।
নামার সময় দুজনকে একসাথে অনেকেই দেখলো। অবাক হলাম ওকে কেউ কোনও কথা জিজ্ঞাসা করলো না। কিন্তু চোখের ইশারায় আমায় অনেকেই জিজ্ঞাসা করলো।
নিচে এসে বললো, আমি হেঁটে চলা ফেরা করতে ভালোবাসি, তোমার আপত্তি আছে।
কিছু বললাম না।
দেখলাম মুখ গুঁজে বড়ো রাস্তায় এসে দাঁড়াল। আমি পেছন পেছন।
তুমি একটু দাঁড়াও।
বলেই রাস্তার অপজিটে পানের দোকানে চলে গেল। ভাবলাম হয়তো সিগারেট কিনতে গেল, ও মা বেশ কিছুক্ষণ পানওয়ালার সঙ্গে কথা বলে ফিরে এলো। কেমন খটকা লাগলো।
তারপর হাঁটতে হাঁটতে সোজা সুজিতদার অফিস। আমি ওর পাশে পাশে হাঁটছি।
বিশেষ একটা কথা বলেনি।
একটা মেয়ে পাশে থাকলে ছেলেরা কিরকম চনমন করে ওঠে। কতো কথা বলে। ওর সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই। মুখ নীচু করে হাঁটে। তিনবার ঠোক্কর খেল।
প্রথম বার মেট্রো সিনেমার তলায়।
ছেলেটাকে দেখে বুঝলাম ব্ল্যাকার। আগে দু-একবার ওকে দেখেছি টিকিট ব্ল্যাক করতে।
দ্বিতীয়বার ওয়াইএমসিএ-র তলায় আমাকে দাঁড় করিয়ে মিনিট দশেক কোথায় ঘুরে এলো।
তারমানে রতনের চায়ের দোকান? মিত্রা বললো।
এখন সেটা বুঝছি। তখন বুঝিনি। জিজ্ঞাসা করার সাহস দেখাইনি।
তৃতীয়বার ঠোক্কর খেলাম….।
কাগজের ফুল? মিত্রা বললো।
না তখন ওকে দেখিনি। আমাকে ফাইন আর্টসের সামনে দাঁড় করিয়ে জিএসআই-এর ভেতর ঢুকেছিল। তাও মিনিট দশেক।
খুব রাগ হয়েছিল। ফিরে আসতে বলেছিলাম, একটা মেয়ের সঙ্গে চলা ফেরার নর্মসটা তোমার জানা নেই।
মাথা নীচু করে ছোট্ট উত্তর, সরি।
আমাকে সঙ্গে রাখলে তোমার খুব অসুবিধে হতো।
ওরা ঠিক সুবিধার লোক নয়। তাছাড়া তুমি মেয়ে।
রাগে গা রি-রি করছিল। বললাম, আমার খিদে লেগেছে।
দেখলাম রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমার মুখের দিকে তাকাল।
কি খাবে বলো?
কোথায় যাবে?
সুজিতদার অফিসে।
আর কতটা?
ফ্লুরিসের কাছে।
ট্রিংকাসে খেয়ে ঢুকবো।
বাইরের খাওয়া আমার সহ্য হয় না।
বিশ্বাস করো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলাম না।
সুজিতদার অফিসে দেখলাম গট গট করে ঢুকে গেল। রিসেপসনিস্ট মেয়াটা কিছু জিজ্ঞাসাও করলো না। আমি ওর পেছন পেছন।
তখন সুজিতদার অফিসটা এতো বড়ো ছিল না ছোট ছিল। বৌদি আর সুজিতদার দুটো ঘর। বাকি একটা ঘরে সবাই কাজ করতো।
প্রথমে বৌদির ঘরে ঢুকলো।
ওমা সুজিতদার অফিসে গিয়ে দেখি একবারে অন্য মানুষ।
হাসি-ঠাট্টা-ইয়ার্কি।
আমার সঙ্গে বৌদির আলাপ করাল। দুজনে চেয়ারে বসলাম।
বৌদি জিজ্ঞাসা করলো, তোর বান্ধবী।
না।
তাহলে।
ফটোগ্রাফার। আমার অফিসে কাজ করে।
তা তুই ওকে ঠিক করলি।
মনে হলো কাজটা পারবে তাই।
মনে হওয়ার কারণ।
অনি ফাঁদে পা দেয় না।
বৌদির কি হাসি।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো।
ওকে কতো দিন চেনো।
ও মা, ও দেখি উঠে দাঁড়াল।
তোমরা দুজনে একটু কথা বলো, আমি দাদার সঙ্গে বসি। ওরা কখন আসবে।
ফোন করেছিল আসছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
তারপর বৌদির জেরা শুরু। আমি সাতটা কথার একটা উত্তর দিই।
শেষে বললো, তুমি ওকে আঘাত করো না।
কি বলি বৌদিকে, কিছুই বলিনি।
শেষে বৌদি বললো, তুই মরেছিস।
তারপর মিটিং শুরু হল। চললো প্রায় ঘণ্টা দুয়েক।
সেদিন ওকে নতুন করে চিনলাম। তখন ও একবারে অন্য মানুষ।
সেই চায়ের বিজ্ঞাপন।
হ্যাঁ।
সেদিন জানলাম ও বিজ্ঞাপনের কপি লেখে, জিঙ্গেল তৈরি করে। ক্যাপসান করে।
এর দু-একটা আমাদের কাগজে প্রায়ই ছাপা হয়।
আমি ওর সঙ্গে কাজ করবো, ফলে সকলেই একটু আলাদা চোখে দেখল। তারপর আমি এই হাউসের ফটোগ্রাফার ফলে কেউ ট্যাঁ-ফুঁ করলো না।
কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয়েছিল বলে আমাকে ছেড়ে দিয়ে এলো।
তখন তুই কি নিউ আলিপুরে? মিত্রা বললো।
হ্যাঁ।
ও বলতে ভুলে গেছি। বেরবার সময় বৌদি বললো, আসার সময় কিসে এসেছিস।
হেঁটে।
দাঁড়া বলে বৌদি নিজের ঘরে গেল। ফিরে এসে আমার হাতে একশো টাকা দিয়ে বললো, ট্যাক্সি করে যা। এখন আর বাসে যেতে হবে না।
তখন কথাটা বুঝিনি। পরে বুঝেছিলাম, বৌদি ওর স্বভাব চরিত্রটা হাতের তালুর মতো চেনে।
যাওয়ার সময় বললো ছবি তোমাকে একা একা তুলতে হবে আমি তোমার পেছন পেছন ঘুরতে পারবো না।
কোনও কথা বলিনি। আমাকে নামিয়ে দিয়ে ও ফিরে গেল। বললাম ট্যাক্সি নিয়ে যাও। বললো এইটুকু রাস্তা ঠিক চলে যেতে পারবো।
এইটুকু রাস্তা! মিত্রা বললো।
দক্ষিণ কলকাতা থেকে উত্তর কলকাতা ওর কাছে একটুখানি।
আমি হাসছি।
একসপ্তাহ ধরে ছবি তুললাম।
ওর সঙ্গে কোনও দেখা সাক্ষাৎ নেই। সুজিতদার কাছে যাই। বললো কি ফাঁসান ফেঁসেছি তনু, অনির পাত্তা নেই। এদিকে পার্টি তাড়া লাগাচ্ছে। কত মিথ্যে কথা বলি বল।
তারপর ও এলো দশদিনের মাথায়। দেখে বুঝলাম কাজে একবারে ফাঁকি দেয়নি।
পার্টি ওর কনসেপ্ট দেখে কনট্রাক্ট করতে চাইল।
স্ট্রেট বলে দিল সুজিতদার সঙ্গে কনট্রাক্ট করুণ তাহলে আমার সঙ্গে কনট্রাক্ট করা হয়ে যাবে।
ওর সঙ্গে বসে কাজ করলাম। সত্যি বলছি মিত্রাদি তখন আমি অনির প্রেমে পাগল।
ওর কিন্তু কোনও হেল দোল নেই।
যেদিন ফার্স্ট প্রমো হলো সেদিন পার্টি হলো, বাবু হাওয়া।
কতো খোঁজা খুঁজি হলো। বাবুকে পাওয়া গেল না।
মালিক পক্ষের লোকেরাও একটু অবাক। কি করা যাবে।
দু-সপ্তাহ বাদে বাবুর উদয় হলো। তখন কাগজে বিজ্ঞাপন বেড়িয়ে গেছে। পাবলিক বিজ্ঞাপনটা মার্কেটে ভাল খেয়েছে।
জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় ছিলে এতদিন?
তার তো কোনও উত্তরই দিল না। বললো টাকা-পয়সা ঠিক মতো পেয়েছো।
এতো অভিমান হয়েছিল, কথাই বলিনি পাঁচ-ছয় দিন। তাতে ওর বয়েই গেছে। ও ওর মতো।
তারপর সুজিতদার সঙ্গে আমি কিছু কাজ করেছি। তারপর আমিও যাওয়া আসা ছেড়ে দিলাম।
এবার একটু ঘুমতে দে।
জানলার দিকে তাকিয়ে দেখ।
দেখেছি।
দাদা উঠে পড়েছে।
উঠুক, আমি একটু ঘুমই।
না। আজ ভাল করে ঘুমবি।
তাহলে একটু চা করে নিয়ে আয়।
তনু উঠে বসলো।
ওরা কখন বেরবে দিদি।
দশটা। দুই বোন বলে গেছে এখানে এসে বেরবে।
মিত্রা।
বন্ধ গেটের বাইরে বড়োমার গলার আওয়াজ।
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
এর প্রতিশোধ তুলবো মাথায় রাখিস।
সে তুই প্রতিদিন তুলছিস।
তনু উঠে গিয়ে দরজা খুললো।
অনিকে ডাক। অনিমেষ, বিধানবাবু ডাকছেন।
জেগে আছে।
কখন উঠেছে।
এই তো উঠলো।
মিত্রা খাটে উঠে বসেছে।
বড়োমা ভেতরে এলো।
মিত্রা বড়োমার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমি তখনও শুয়ে আছি।
রাঘবন ফোন করেছিল। ওর মেয়ে, জামাই, নাতি সকালের প্লেন ধরেছে। এখানে আসছে।
আমি বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম।
ওঠ।
কেন?
নাজমা ডাকছে।
মাথার ঠিক আছে।
কেন?
এখুনি বললে অনিমেষ, বিধানবাবু ডাকছে, আবার এই বলছো নাজমা ডাকছে।
বড়োমা হেসে ফেললো।
তোর সঙ্গে আর পারি না বাপু।
মনে হচ্ছে কোনও গণ্ডগোল।
ওরা সবাই উঠে পড়েছে। একসঙ্গে চা খাচ্ছে।
তোমার মনটা আনচান করে উঠলো। অনিকে ডাকি।
বড়োমা মিত্রার দিকে তাকাল।
মেয়ে দুটো কাল সারারাত বাড়ির বাইরে থাকলো।
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
সারা রাত ঘুমিয়েছিলে। মিত্রা বললো।
ঘুম হয়, তুই বল। মেয়েদুটো বাড়ির বাইরে। বিদেশে বিভুঁইয়ে থাকলে ঠিক ছিল। কলকাতাতেই আছে। এখানে থেকে কাজ করা যেত না। এতগুলো ঘর পড়ে আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। এলে নাতনিদের জিজ্ঞাসা করবে। আর সবাই উঠেছে?
ছোট বললো, কেউ ঘুমোয়নি। রাত জেগে সব কাজ করছিল।
তুমি কি এখন ঠাকুর ঘরে যাবে?
দামিনী গেছে। ও পরিষ্কার করুক।
তুমি রেডি হও যাচ্ছি। একসঙ্গে চা খাব। আমি বললাম।
আয়।
বড়োমা ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
দিদি কানের পাশ দিয়ে বেড়িয়ে গেছে। ছোটোমা হলে ধরা খেয়ে যেতাম। তনু বললো।
শুনলি না। নিজেও তো ঘুময়নি। এটা বুবুন না হয়ে আমরা হলে এতক্ষণে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে যেত।
আমি ওদের কথায় হাসছি।
সাংসারিক খুঁটি-নাটি আমার বোধ গম্য হয় না। এরজন্য ছোটোমা, বৌদির কাছে প্রায়ই ঝাড় খেয়ে থাকি। মিত্রারা সাহিত্যের ঢঙে বলে। খাট থেকে নামলাম।
কোথায় যাচ্ছিস!
বাথরুমে।
আগে আমরা যাবো তারপর তুই।
তাহলে ঘুমিয়ে পড়ি।
শুনলি তো বড়োমা কি বলে গেল।
বলুক।
আচ্ছা তুই এত কুল কি করে থাকিস বলতো। সবাই কিছু না কিছু টেনসনে ভুগছে। এতো বড়ো একটা কাজ। অনিমেষদা, বিধানদা হয়তো কাল সারারাত ঘুময়নি। আর তুই দিব্যি…।
কি করবো। কাঁসর ঘণ্টা নিয়ে বেড়িয়ে পড়বো।
নাগেশ, বনি আসছে কেন?
হয়তো রাঘবন ইনভাইট করেছে।
রাঘবন ইনভাইট করবে কেন?
এতোবড়ো একটা কাজ হচ্ছে। তাছাড়া রাতে পার্টি হবে। খানা-পিনা হই-হুল্লোড়।
আমার প্রশ্নটা তুই বুঝেও না বোঝার ভান করছিস।
হেসে ফেললাম। তোদের ভীষণ সন্দেহ বাতিক মন।
তৈরি করলো কে?
আমি!
তাহলে কে বল?
বাথরুমে যাবি, না আমি ঢুকবো।
তনু তুই চটপট সেরে নে।
তনু মুচকি হেসে আমার দিকে তাকাল। আলনা থেকে টাওয়েলটা নিয়ে বাথরুমে গেল।
আমি আবার বিছানায় লাট খেলাম।
আমার কাছে একটা খবর আছে।
আমি চুপ করে থাকলাম।
কিরে চুপ করে থাকলি।
খবরটা কি বল শুনি।
আগে নাগেশ আর বনির ব্যাপারটা বল।
যা বাবা কি করে বলবো। ওদের ইচ্ছে হয়েছে তাই আসছে। কেন আসতে মানা আছে নাকি?
কাল রাঘবন সারাদিন প্রায় এখানে কাটাল, কই বনি, নাগেশের নামটা একবারও উচ্চারণ করলো না। একবারও বলেনি তারা আজ সকালের ফ্লাইটেই আসবে।
মহা মুস্কিল।
তুই কি ওই দুটোকে অংশুর মতো কাজে লাগিয়েছিস?
হেসে ফেললাম।
বলবি না, এই তো।
লেবু বেশি নিংরোলে তেঁতো হয়ে যায় জানিস।
ঠিক আছে। এবার বল বিনোদ, অর্জুনের জোড়া লাগার কেমিস্ট্রিটা কি?
ওরে বাবা, তুই তো দেখছি দিদিগিরি শুরু করলি।
তুই দাদাগিরি করতে পারিস আমি দিদিগিরি করলে দোষ।
দিদি একটা ম্যাক্সি দাও না। তনু বাথরুমের দরজায় মুখ বাড়িয়েছে।
মিত্রা উঠে গেল। আলমাড়ি খুললো।
আমি তনুর দিকে তাকিয়েছি। এখান থেকেই বুঝতে পারছি। তনুর শরীরে একটিও বস্ত্র নেই।
তনু আমার চোখের ভাষা বুঝে গেছে। হাসছে।
নোংরা ব্যাটাছেলে।
উঠবো।
ওঠো না।
মিত্রা তনুর ম্যাক্সি নিয়ে বাথরুমের দিকে গেল। ফিরে এসে পাশে বসলো।
বল।
কি!
অর্জুন, বিনদের কেমিস্ট্রি।
মস্তানদের আবার কেমিস্ট্রি থাকে নাকি। এতদিন ধান্দাতে পটতো না তাই হিঁচাহিঁচি ছিল, এখন ধান্দাতে পটে গেছে তাই এক হয়ে গেল।
আমার কথার জবাব যে এটা নয় তুই খুব ভালোকরে বুঝিস।
সক্কাল সক্কাল চাটা চাটি শুরু করেছিস।
ঠিক আছে বিনদ, অর্জুন চ্যাপ্টার জানতে চাই না। ওটা তোর ব্যাপার।
আঙ্কেল। তারস্বর চিৎকার।
দরাম করে ঘরের দরজা খুলে গেল।
মাম্পি, মিকি ছুটে এসে আমার ঘাড়ে উঠে বসলো।
জানো মিকি কাল রাতে বিছানায় হিসি করেছে।
মিত্রা মুচকি মুচকি হাসছে। আমিও হাসছি। তনু বাথরুম থেকে ধোপ দুরস্ত হয়ে বেরিয়ে এলো।
এই তোরা কি করতে এসেছিস।
ছোটোবোম মিকি না…মিকি না….।
থাম। খালি বক বক। কোথা থেকে নাম পেয়েছে ছোটোবোম, বড়োবোম।
আমি হাসছি।
ভাবলি এ যাত্রায় বেঁচে গেলি। তোকে বাঁচাব দাঁড়া।
তনু, মিত্রার দিকে তাকাল।
স্পিকটি নট।
তাহলে কি ভেবেছিস জিজ্ঞাসা করলাম ও গড় গড় করে বলে দিল।
মিত্রা খাট থেকে নেমে সোজা বাথরুমের দিকে চলে গেল।
তনু আমাকে একটা কাপর বার করে দে।
তুমি যাও দিচ্ছি।
তনু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আঙ্কেল।
বল।
ব্রাশ উইথ টিথ।
দাঁড়া আন্টির হোক।
দুদুনরা ঝগড়া করছে। মিকি বললো।
ঝগড়া না, কথা বলছে। মাম্পি বললো।
আজ স্কুল নেই?
ছুটি। নেমন্তন্ন খাব।
তোর বিয়ে।
ধ্যাত।
তনু জোড়ে হেসে উঠলো।
কিরে তোদের কি এখনও হয়নি। ওরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
ছোটোমা ঘরে ঢুকলো।
কিরে তুই এখনও শুয়ে আছিস। ছোটোমা আমার দিকে তাকাল।
মিত্রা কোথায়?
দিদি বাথরুমে। তনু বললো।
ও ঘরে কাক উড়ছে চিল পড়ছে।
কেন?
সব অনিবাবুর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাবু না গেলে ব্যাপারটা ঠিক জমছে না।
মাম্পিরা পিঠের ওপর বসে গাড়ি চালিয়েই চলেছে। বুরুর বুরুর সঙ্গে কিচির-মিচির। খুনসুটি লেগেই আছে। ছোটোমার সঙ্গে তনুর ইশারায় কথা হচ্ছে।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।
মাম্পি, মিকিকে জাপ্টে ধরে উঠে বসলাম।
সারারাত! ছোটোমার গলায় বিষ্ময়।
তোরা পারিসও বটে।
তোর মল্লিকদা ব্যাকর ব্যাকর শুরু করেছিল, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। আর ভাবতে ভালো লাগে না। ভেবে তো কিছু করতে পারবো না।
ছোটোমা আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে। মিত্রা বেরিয়ে এলো।
আমি খাট থেকে নামলাম।
কিছু পেলি? ছোটোমা মিত্রার মুখের দিকে তাকাল।
এতো সহজে পাওয়া যায়। সাধিতে সাধিতে কৃষ্ণ যদি কৃপা করে।
মাম্পি, মিকি জানলার ধারে গিয়ে বকে চলেছে। আমি টেবিলের ওপর থেকে ব্রাস, মাজন নিয়ে বাথরুমের দিকে এগলাম।
বাইরে হুটারের আওয়াজ হলো।
আজ আমি সারাদিন আর কোথাও বেরলাম না। আফতাবভাই একবার মৃদু বায়না ধরেছিল। কিরে চল। আমি মুচকি মুচকি হেসেছিলাম।
দিদি বললো, ও না গেলে কি তোমার কাজ হবে না।
আফতাবভাই আর কিছু বলেনি।
ছেলে, মেয়েরা আজ সবাই স্যুট-টাই লাগিয়েছে। একেবারে কর্পোরেট চেহারা।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হেসেছি। দু-জনেই বলেছে ফিরে এসে এই হাসির হিসেব মেটাবে।
বনিও কথা শোনতে ছাড়ে নি। নাগেশ নাকি ওকে ডিটেলস রিপোর্ট করেছে। তার হিসেবটা ফিরে এসে ওকে পাই টু পাই নিতে হবে।
ঘটা করে সবাই প্রণাম করলো। মিকি, মাম্পি বাগানে ভজুর পেছনে ঘুরঘুর করছে।
একে একে ওরা সবাই দঙ্গল বেঁধে চলে গেল।
বাড়িতে আমি, ছোটোমা, বড়োমা, দামিনীমাসি, জ্যেঠিমনি, মাসীমনি।
সবাই গল্প করছি আর টিভির পর্দায় চোখ রেখেছি।
প্রথমে সই সাবুদ করে ফাইল দেওয়া নেওয়া তারপর প্রেস কনফারেন্স।
প্রবীরদা হাসি মুখে বেশ গরম গরম লেকচার দিল। দু-একজন সাংবাদিক যে ফুট কাটল না তা নয়। প্রবীরদার কথার তোড়ে তারা থেমে গেল।
বুঝলাম রাজনৈতিক ফয়দা বেশ ভালভাবেই তুলতে শুরু করলো।
পাশে অনুজবাবু দাঁড়িয়ে। আলি সাহেব, আমিন সাহেব, কেষ্টবাবু হাসি হাসি মুখে পোজ দিচ্ছে।
তারপর আফতাবভাই তাঁর কথা বললো। দেখলাম অনিকা, অনিসার পরিচয়টাও এই মওকায় সেরে নিল। বেশ চোখা চোখা শব্দের ভাষণ। বুঝলাম দুই মেয়ে বেশ গুছিয়ে ব্রিফ করেছে। এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কথাবার্তা এই কদিনে বেশ ভালো রপ্ত করে ফেলেছে।
দশমিনিটের বক্তব্যেই সমস্ত কিছু গুছিয়ে বলে দিল।
একে একে সবাই বক্তব্য রাখলো। কখনও এই চ্যানেল কখনও ওই চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে গেলাম। কম বেশি সব এক ছবি। দুই মেয়েকে আজ ভীষণ স্মার্ট লাগছে।
সাংবাদিকদের চোখা চোখা প্রশ্নের উত্তর বেশ ঠাণ্ডা মাথায় দিল।
প্রাসঙ্গিক ভাবেই আগের সরকারের না হওয়া প্রজেক্টের ব্যাপারে প্রশ্ন ধেয়ে এলো।
অনিকা তার উত্তর বেশ গুছিয়ে দিল।
কমা, সেমিকোলন, কোশ্চেন মার্ক, বিষ্ময় বোধক চিহ্ন, ফুলস্টপ সব এক সঙ্গে বলে দিল। ওরা যে সত্যি সত্যি বাঙ্গালী দেখে মনেই হচ্ছে না। পোষক পরিচ্ছদ ছেড়ে দিলে কথাবার্তাতেও তার ছপ স্পষ্ট। ঘণ্টা-পক্কে অতীশ ব্যানার্জী, অতনু ব্যানার্জী নামে পরিচিত হলো।
সত্যিতো আমার দেওয়া ওদের ভালো নামগুলো ভুলেই গেছিলাম!
প্রসঙ্গান্তরে অনিসাকে ফেস করতে হলো আপনি কাগজের মালিক, এই প্রজেক্টরও একজন ওয়ান অফ দেম ডিরেক্টর কোনও কোলাবরেসন?
অনিসা খুব সুন্দরভাবে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল।
ইন্টারভিউ-এর নব্বই শতাংশ ইংরেজীতে বললো।
ছোট্টর ওপর বেশ সুন্দর করে গোটা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল। টিভির পর্দায় অনিমেষদা, বিধানদার চোখ মুখটা যথেষ্ট পরিষ্কার লাগছে। মনে হচ্ছে এখন অনেকটা চিন্তামুক্ত।
পার্টির ভেতরে তৈরি হওয়া বিরাট একটা অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে দুজনে মুক্তি পেল।
যার যার ব্যক্তিগত ঢঙে নিজের নিজের বক্তব্য রখলো।
ছোটোমা একবার বলেছিল, অনি, তোর নামটা কেউ উচ্চারন করলো না।
দামিনীমাসি শুনে হাসল।
ছোটো তুই সত্যি দিন দিন যেন গবেট গোবিন্দ হয়ে যাচ্ছিস।
কেন?
ও যদি সামনে থেকে, পেছন থেকে কল কাঠি নারবে কে?
আমি হাসছি।
ওইটা সবথেকে বড়ো কাজ। ভীষণ মজা।
মেরিনা মারা যাওয়ার সময় ওর এই গুণটা প্রথম আবিষ্কার করেছিলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত কাগজে ছাপা না হলa ও চুপচাপ থাকল। সাত চড়ে মুখে রা-টি করেনি। যেই কাগজে ছাপা হতে শুরু করল, তখন ওর মূর্তি একবারে অন্য। পুলিশের লোকগুলোকে কি দাবড়ান।
ওমা! তারপর পুলিশের লোক এসে দেখি আমার সঙ্গে শলাপরমর্শ করে।
এখানেও তুই দেখবি। এতদিন ও চুপচাপ ছিল। আজ ভালয় ভালয় সব মিটে গেল এবার মজাটা দেখবি। চড়কি নাচন নাচিয়ে দেবে সব কটাকে।
একটু থেমে, দামিনীমাসি বড়োমার মুখের দিকে তাকাল।
আচ্ছা দিদি তুমি একটা জিনিষ একটু ভাল করে লক্ষ করেছ।
কি?
মাসীমনি, দামিনীমাসির মুখের দিকে তাকিয়ে। মুচকি মুচকি হাসছে।
তুমি হাসছো কেন নিশ্চই ওর চালটা ধরতে পেড়েছ।
মাসীমনি মাথা দোলাল। সম্পূর্ণ না একটু একটু।
কি বলোতো?
ওর সেই কাগজের ছেলেগুলোকে আশেপাশে দেখছি না। শুভ, অংশুকেও সকাল থেকে দেখতে পাচ্ছি না।
বাবা তুমি কি সাংঘাতিক গো!
দামিনীমাসির কথায় সকলে জোড়ে হেসে উঠলো।
কারা গো দামিনী। বড়োমা হাসতে হাসতেই বললো।
ওই যে তিন মর্কট অর্ক, অরিত্র, সায়ন্তন। আর একটা আছে না ওর কার্বন কপি সুমন্ত।
সত্যি তো!
সুমন্তটাকে ঘরের বাইরে বেরতে দেয় না। ওটা রুগ্ন। দৌড়-ঝাঁপ সহ্য করতে পারবে না।
টেবিলে বসে বসে ফন্দি আঁটে। আর এরা দৌড়ে মরে।
তোমরা থামবে। খালি বক বক। তোমাদের কথা শুনবো না টিভিতে ওদের কথা শুনবো।
কেন, এলে শুনতে পাবি না। এর থেকে আরও বেশি করে খাঁজ খবর নিবি। নিবি না?
দামিনীমাসি ঝাঁজিয়ে উঠলো।
আমি হেসেফেললাম। একটু চা খাওয়াও।
করে দেওয়া হচ্ছে।
আমি কথা বলছি আর রিমটে একবার এই চ্যানল একবার ওই চ্যানেল ঘুরিয়ে ফলো-আপ করছি।
মাসি।
মাসি রান্নাঘরের সামনে থেকে চেঁচাল।
বল।
হ্যাঁগো চিবোবার মতো কিছু নেই।
ভাজা হয় নি। ভেজে দিতে হবে।
ছোটোমা, জ্যেঠিমনি হেসে উঠলো।
মাসীমনি, বড়োমা মুচকি মুচকি হাসছে।
দামিনী কতটা ওকে বোঝে বল। ওর চাওয়া দেখেই বুঝে ফেললো। মাসীমনি বললো।
মাসি রান্নাঘর থকে আবার এগিয়ে এল।
রাস্তায় উড়েগুলোকে দেখেছ গুটলি গুটলি করে ডালের বড়া তৈরি করে। এক ঠোঙা দু-টাকা একটু বিটনুন ছড়িয়ে দিয়ে দেয়।
ডাল বড়া। ছোটোমা বললো।
ঠিক ডাল বড়া নয়, ওরও একটা কি নাম আছ।
আবার গল্প ঝাড়ে।
তুই তো নিজেই একটা গল্প, বলবো না।
আগে ভেজে ফেলো, খেত খেতে বলবে।
বলে নিই, না হলে ভুলে যাব।
কেন, অমনি মনে পড়ে গেছে।
মাসি হাসতে হাসতে মাসীমনির চেয়ারটা ধরে ফেললো।
খানিকক্ষণ নিজেও হেসে নিল।
কিগো দামিনী তুমি অতো হাসছো যে। বড়োমা বলে উঠলো।
ও যে কি শয়তানের হাড্ডি তুমি জানো না দিদি। ওর কাছ থেকে তোমায় শয়তানি শিখতে হবে।
হ্যা হ্যা করে, আর বলতে হবে না। আমি বললাম।
কেন বলবে না রে।
ছোটোমা পাশে বসেছিল দাঁত মুখ খিঁচিয়ে হাত বারাল। আমি মাথাটা সরিয়ে নিলাম।
তোমাদের অতো নোলা কিসের। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
তুই খেতিস, বলতিস মুখ বে-স্বাদ লাগলে খাবে রুচি ফিরে আসবে। তাই একদিন সখ করে খেতে চেয়েছিলাম।
দেখে খেতে পারতে।
লঙ্কা খাইয়েছিল? ছোটোমা বললো।
দামিনীমাসি হেসেই চলেছে।
বিশ্বাস করো ঘণ্টা খানেক কুকুরের মতো জিভ বার করে ছিলাম। খালি জল পড়ে।
আর কোনওদিন ওর কাছে খেতে চাইনি।
একটুক্ষণ হাসাহাসি হলো।
আবার টিভির দিকে নজর দিলাম।
দামিনীমাসি চা বানিয়ে নিয়ে এল। সঙ্গে কুচি কুচি করে ডালের বড়া ভাজা।
সবে মাত্র কয়েকটা ডালের বড়া মুখে দিয়ে চায়ে চুমুক দিয়েছি। বাইরের গেটে হর্ণের আওয়াজ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বনি, নাগেশ, সুরো ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলো।
আমি একটু অবাক চোখে তাকালাম। এত তাড়াতাড়ি!
বনি সোজা এসে আমার পাশে বসে পরলো। আমার চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে নাগেশের দিকে তাকাল।
চলবে।
নাগেশ উত্তর দেওয়ার আগেই সুরো চেঁচিয়ে উঠলো।
বনিদি আমার জন্য একটু রেখো।
কাপ নিয়ে আয়।
ছোটোমা ওদের কীর্তি কলাপ দেখে হাসছে।
সুরো রান্না ঘর থেকে কাপ নিয়ে এলো। বনি তিনভাগে ভাগ করলো প্লেটটা নাগেশের দিকে এগিয়ে দিল।
কিরে তোরা সব চা খেয়ে নিলি। সবে মাত্র ওকে দিয়েছে। বড়োমা বললো।
আবার দাও। দিতে কেউ মানা করেছে। সুরো বললো।
বনি হাসছে।
প্লেট থেকে দু-তিনটে ডালের বড়াও মুখে তুলে নিয়েছে।
আমি বনির দিকে তাকিয়ে আছি।
তাকিয়ে লাভ নেই। আমারটাও বহুবার এইভাবে খেয়েছো।
বনি রান্নাঘরের দিকে তাকাল।
দামিনীমাসি বেশি করে ভাজো সবাই আসছে।
টিভি তার মতো চলে চলেছে।
সুরোর চা খাওয়া শেষ, ঠকাস করে কাপটা টেবিলে রেখে বললো।
বুঝলে বড়োমা দারুণ এক্সপিরিয়েন্স। কোনওদিন তো এইরকম প্রোগ্রামে যাইনি। আজ প্রথম গেলাম।
অনিকা, অনিসার জন্য এবার বডি গার্ড রাখতে হবে বুঝলে। যা সব হ্যাংলা ব্যাবসায়ী।
বড়োমা মুচকি মুচকি হাসছে।
তোরা এলি, ওরা এলো না।
এখন আসবে কিগো! সবে একটা মিটিং শেষ হলো। এরপর আরও কতো মিটিং হবে। ওদের আস্তে আস্তে সেই সন্ধ্যে। এখন তাজে একটা কনফারেন্স হবে। সেখানে কি সব বক্তৃত্বা দেবে সকলে। বৌদিরা অবশ্য চলে আসছে।
বিকেলে যে পার্টি হবে?
তাতে তোমার আমার কি? ঘণ্টা খানেক পর দেখবে সকলে চলে এসেছে। জায়গা দেখান আছে সাজিয়ে গুজিয়ে দেবে। খাবার বলা আছে গোছ-গাছ করে চলে আসবে। বুফে সিস্টেম, একটু গল্প-গুজব, খাওয়া-দাওয়া, পার্টি শেষ। আবার তল্পি-তল্পা গুটিয়ে যে যার বাড়ি।
সুরো এক নিঃশ্বাসে কথা বলে গেল।
বনিরা হাসছে। আমি সুরোর দিকে তাকিয়ে।
দামিনীমাসি ট্রেতে সাজিয়ে চা নিয়ে এলো।
সুরো উঠে হাতে হাতে সকলকে এগিয়ে দিল।
দিদি এর মধ্যে শুভকে দেখেছ। দামিনীমাসি বলে উঠলো।
কেন রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে প্ল্যান ভাঁজলে, কোনটা কোনটা বলা বাকি আছে। আমি বলে উঠলাম।
মাসীমনি হেসে ফেললো।
ওতো কাল বলে গেল দাদুকে নিয়ে যাবে। তাই সকালে আসবে না। বড়োমা বললো।
গেছিল তো। এলে একবার চেহারাটা দেখবে। দ্বিতীয় অনিদা। বৌদি বললো, শুভ তোমার আর জামাকাপর ছিল না। বললো, কে দেখবে। ব্যাশ ফুরুত। কোথায় ছিল কে জানে। যখন বেরচ্ছি বললো, সুরো পিসী দুপুরের পার্টিতে এ্যাটেণ্ড করা হবে না। রাতের পার্টিতে অবশ্যই এ্যাটেণ্ড করছি।
চলবে —————————–
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/TRWYmjS
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment