কাজলদিঘী (২০২ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

২০২ নং কিস্তি
—————————–

তুই কি আমাকে একটু সুস্থির ভাবে চিন্তা ভাবনা করতে দিবি না।

সকাল থেকে দু-জনে বহু তরপাচ্ছ, এখন আবার একজন পুরনো টিম লিডার জুটিয়ে নিয়েছ। মাঝে মাঝে বুদ্ধি ধার করছো। সব দোষ আমার। কেন আমি কি করেছি?

বৌদি রান্নাঘরের কাছ থেকে এগিয়ে এসেছে।

মাসিমনি মুচকি মুচকি হাসছে।

কিগো অনিমেষ?

আপনি তখন যে ধারনা করেছিলেন সেটাই ঠিক।

ওটা আমারা ধারনা নয়। কালকে আমি ডাক্তারবাবু নার্সিংহোমে বসে অনেকক্ষণ এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলছিলাম। আমাদের আলোচনায় এটাই শেষ অব্দি বেরিয়ে এসেছিল, ও যেভাবে ঘুটি সাজিয়েছে এ ছাড়া ওর পথ নেই। থাকতে গেলে মাথা নীচু করে থাকতে হবে। না হলে সরে যেতে হবে। কম্প্রমাইজ করার মতো মানসিকতা ওর নেই। তবে কম্প্রমাইজ করলে ওর আখেরে অনেক লাভ হতো।

সেটা কালকে আমরা ওকে বুঝিয়েছি।

কাজ হয়নি।

না।

তোমায় কি প্রবীর খবর পাঠাল?

হ্যাঁ।

ওকে একবার আলাদা করে কথা বলতে বলো।

পায়ে আর একটা কাঁটা ফুটেছে।

সেটা আবার কি রকম।

খানিকক্ষণ আগে কনিষ্ক ফোন করছিল। সেটায় মননিবেশ করেছিলাম। তার মধ্যে এই বিপত্তি।

ডাক্তারবাবুকে ধরো উনি বেশ ভাল খবর রাখেন।

সামন্তদা, বিধানবাবুর সঙ্গে কথা বলছেন।

তোমরা বড়োর ঘরে বসো, যাচ্ছি।

ওর কোনও হেলদোল দেখছেন। দিব্যি গলদাচিংড়ির ভাজা খাচ্ছে। যেটাকে পাঠিয়েছিল সেটার ফোনের স্যুইচ অফ।

মিত্রা, তনু আমার দিকে কুত কুত করে তাকিয়ে। আফতাবভাই অনিমেষদার একটা কথাও বুঝতে পারে নি। হ্যাঁ করে অনিমেষদার মুখের দিকে এতক্ষণ তাকিয়েছিল।

গলদাচিংড়ির শেষটুকু মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে বড়োমার দিকে তাকিয়ে বললাম, একটু কফি খাওয়াবে।

আচ্ছা তোর কি একটুও কিছু মনে হচ্ছে না।

কেন হবে? আমার পায়ে কাঁটা ফুটেছে। যার ফুটেছে সে যন্ত্রণা উপভোগ করবে।

অনিমেষদা হাত উঁচিয়ে এগিয়ে এলো।

সবাই তোর কান ধরে এবার আমি তোর কান ধরবো।

আমি হাসতে হাসতে বলে উঠলাম, বৌদির কাছ থেকে তোমাকে সাব-লিজ নিতে হবে।

মিত্রা, তনু হাসছে।

আমরা কিন্তু আজ জোড়ায় এসেছি।

গেটের দিকে তাকালাম। সুরোর সঙ্গে সুরোর শ্বশুড়-শাশুড়ী।

আবার কি হলো অনিমেষবাবু। মারপিট কেন?

কিগো বাবা আবার গণ্ডগোল! সুরো কোমড়ে কাপর পেঁচিয়ে ঝগরুটে মেয়ের মতো তেরে এলো।

আফতাবভাই দিদি কাথা বুঝছে না। কিন্তু পরিবেশের বশবর্তী হয়ে হাসছে।

আমি সুরোকে পাশ কাটিয়ে সুরোর শ্বশুড়, শাশুড়ীকে প্রণাম করলাম।

আমার মাথায় হাত ঠেকিয়ে সুরোর শ্বশুড়, শাশুড়ী বলে উঠলেন, থাক থাক বাবা…তরপর আফতাবভাই-এর দিকে তাকিয়ে—

কেমন আছেন আফতাবভাই। অচিন্তবাবু বলে উঠলেন।

ভালো।

আপনারা বসুন এখন কথা বলতে পারবো না। অনিমেষদা বললো।

কেন আবার গণ্ডগোল! সকাল থেকে তো একপ্রস্থ হলো। গাড়িতে আসতে আসতে সুরোমার মুখ থেকে সব শুনলুম।

এর কি আর শেষ আছে।

তোমরা বসো আমি আসছি।

না তুই কোথাও যাবি না। অনিমেষদা বলে উঠলো।

ভারি মুস্কিল।

সুরো।

রান্নাঘরের সামনে থেকে সুরো চেঁচাল।

বলো।

যা তো, তোর অনিদার পেছন পেছন একটু ঘোর তো।

বৌদিরা সবাই শব্দ করে হেসে উঠলো। মাসীমনি, তনুরাও হেসে চেয়ারে বসে পড়েছে।

ভালো দাদাই তুমি না….। অনিকা চেঁচিয়ে উঠলো।

ভালোদাদাই কতটা ফাঁদে পরলে একথা বলে সে তো তুই বুঝবি না।

চল সুরো আমি তুই একসঙ্গে বাথরুমে যাই।

কেন বড়দির ঘরে নেই। অনিমেষদা বলে উঠলো।

মিত্রার দিকে তাকাল।

ওর ফোনটা কইরে?

পকেটে।

ট্যাঁ-টু করেছে কিনা শুনেছিস?

ভাইব্রেসন মুডে থাকে।

তোরাও আজকাল ফেল করছিস।

আজ নয় চিরটাকাল। উচ্ছিষ্ট যেটুকু পাই, তোমাকে বলি।

বিধানদা, দাদা, ডাক্তারদাদা ঘরে ঢুকলো। আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বললো।

চালটা ভাল দিলি। কিস্তি দিলি না। নড়াচড়া করার পথ একবারে বন্ধ করে দিলি। শেষ দুটো চাল হাতে রাখলি। নয় মরো নাহলে আমার কথা শোনো।

বিধানদা, বৌদির দিকে তাকাল।

সুতপা আমাদের খেতে দাও। আমরা একসঙ্গে বসি।

উইথড্র করেছে? অনিমেষদা বললো।

না করে যাবে কোথায়?

রিজাইন করলে ওর বিপদ ও নিজে ডেকে আনবে। এই তো অর্ক অমিতাভবাবুর কাছে পার্মিশন নিতে এসেছে নিউজটা ছাপবে কিনা।

দাদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

যদি সত্যিই ও ছাপবে মনে করতো তাহলে অমিতাভবাবুর পার্মিশনের ও থোড়াই কেয়ার করতো। ছেপে দিত। এইবার তুমি বুঝে নাও। আমাকে কিছু বার্তি কথা খরচ করতে হলো। তুমি কিছুটা টেনশন ভোগ করলে। তবে রুমা, ডাক্তারবাবুর কনভার্সেসনটা খুব কাজে লাগল। এটা প্রবীরও গেইজ করতে পারেনি।

ছোটোমা, বিধানদার কাছে এসে দাঁড়াল।

দাদা মিঃ রাঘবন এয়রপোর্টে নেমেছে।

সত্যিতো মনে ছিল না। গতকাল সেরকমই বলেছিলেন, তাহলে একটু চা দাও।

একটু মিষ্টি খেয়ে জল খান।

তাই দাও। কি ডাক্তার তাহলে রাঘবন আসুক একসঙ্গে বসা যাবে।

ডাক্তারদাদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।

আফতাবকে বলেছো? বিধানদা, অনিমেষদার মুখের দিকে তাকাল।

না।

তুই যা, অর্ক তোরজন্য অপেক্ষা করছে। বিকেলবেলাটা একটু শান্তিতে মিটিংটা করতে দে। ভালয় ভালয় সব চুকে বুকে যাক তারপর তুই যা ইচ্ছে করিস।

বিধানদা আমার মুখের দিকে তাকাল।

মাসীমনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

আমি ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

সারাটা বিকেল সত্যি একটা ঝড় বয়েগেল। মিটিং মিছিল করে সত্যি ক্লান্ত। আজকে সই-সাবুদ আর কিছু হয়নি। কাল সব হবে। প্রেস কনফারেন্স হবে। কত কিছু।

বলতে গেলে ঘটা করে সব কিছু হবে। এটাই একটা রাজনৈতিক ইস্যু করে সামনের ইলেকসনে ক্যাম্পেনিং হবে। বিধানদা, অনিমেষদার চোখে মুখে এক নতুন দিশা। ধীরে ধীরে পায়ের তলার জমি যেন খুঁজে পাচ্ছে।

সুরোর দেমাকে পা পড়ছে না। তার দাদা এই প্রজেক্টের কারিগর। বার বার বাবা-মাকে সেই কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। অনুপদা, রূপায়ণদা, প্রবীরদাকেও বলতে ছারছে না। চারিদিকে একটা খুশির ছোঁওয়া। সবার মধ্যেই একটা নতুন উদ্দীপনা।

প্রেস কনফারেন্সের সমস্ত দায়িত্ব অনিমেষদা, রূপায়ণদা, অনুপদার হাতে তুলে দিয়েছে। অর্ক-অরিত্রদের জামার কলার আজ ভাঁজ করা নেই। সবাই সোজা করে ঘুরছে। খবরটা এরি মধ্যে কানাকানি হয়েছে। বেশ কিছু চ্যানেলের গাড়ি, বাড়ির সামনে হাজির। তারা আফতাবভাই-এর ইন্টারভিউ নিতে চায়। অনিমেষদা খুব সুন্দরভাবে সকলকে ব্রিফ করেছে। আজ কিছু নয় কাল মৌ সই করার পর সব কিছু।

রাঘবন রাতে আর থাকেনি। হোটেলে গেছে। এখানে থাকলে কাজ হবে না। শুধু গল্প হবে। তাই আজ হোটেলে থাকবে, কাল এখানে থাকবে। রাতে পার্টি হবে। ঘরোয়া কিন্তু সরকারি অতিথিরা থাকবে। বড়োমা রাঘবনের ওপর একটু অভিমান করেছিল।

রাঘবন বড়োমার হাতটা ধরে বলেছে শুধুমাত্র আজকের দিনটা।

অনুপ-হিমাংশু, রাঘবনের সঙ্গে হোটেলেই থাকবে। আবুভাইও রয়েছে। অনিকা অনিসারা রাঘবনের সঙ্গে হোটেলেই গেছে। বলেছে কাল সকালে বাড়িতে এসে একসঙ্গে বেরবে।

অনিমেষদা, বিধানদাকে অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে। রাতে অনুজ সেন মিটিং-এ এসেছিল। আমার সঙ্গে আলাদা করে অনেকক্ষণ কথা বলেছে। ব্যাপারটা অনিমেষদা, বিধানদার চোখ এড়ায়নি। তখন আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। তবে ব্যাপারটা তোলা রয়েছে। পরে একবার ব্যাপারটা নিয়ে কাটাছেঁড়া করবে।

প্রবীরদা যাওয়ার সময় একচোট হেসে নিল।

ছোটোমাকে বার বার বললো, ছোটবৌদি, অনি শুধু ব্যবসায়ী হলে অনেক সমস্যা এ্যারাইজ করতো কিন্তু ও যে সাংবাদিক প্রতিটা পদে পদে তা মনে করিয়ে দেয়। মনে হচ্ছে আমার মতো অনুজের লাইফটাও ও বদলে দেবে।

ছোটোমা আমাকে জড়িয়ে ধরে হেসেছে।

জানো আজও মাঝে মাঝে সেই দিনটার কথা মনে পড়ে যায়। বনানী প্রায়ই মনে করিয়ে দেয়। তুমি কিন্তু জীবনে আর দ্বিতীয়বার ভুল করবে না।

অনি সত্যি আমার জীবনটা বদলে দিয়েছে। সত্যি বলতে কি কাজের টেনসন আছে। কিন্তু বেশ শান্তিতে আছি। অনুপদের পরিষ্কার বলে দিয়েছি। যখনই মনেহবে আমি অন্যায় করছি সরিয়ে দিস। এতটুকু আপত্তি করবো না।

কথা বলতে বলতে প্রবীরদা মাঝে মাঝে বেশ ইমসন্যাল হয়ে পরছিল।

রাতে খাওয়ার টেবিলে প্রবীরদা আলাদা করে আরও দুটো ছোট প্রজেক্ট আফতাবভাই-এর কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে।

আফতাবভাই-এর এক কথা। অনির মাধ্যমে আপনাদের সঙ্গে আমার পরিচয়। অনি যদি মনে করে ও সামলাতে পারবে আমার কোনও আপত্তি নেই।

ঠিক হয়েছে কালকে এখানকার ঝামেলা মিটলে পর্শু আমার ওখানে যাওয়া হবে।

তিন্নীরা সপরিবারে আজ এখানে থেকে গেছে।

তনু তখন বলেছিল, মাছ দিতে আসার সময় মাসীমনি মনাকে বলেছিল, মনা বাড়িটা খালি পরে আছে, মনা হাসতে হাসতে বলেছে তুমি যতদিন খুশী এখানে থাক। তোমাকে বাড়ি নিয়ে ভাবতে হবে না। তোমার বাড়ির একটা ইঁটেও কেউ হাত দেবে না।

রাতে যখন নিজের ঘরে শুতে এলাম তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত সোয়া একটা।

মিত্রারা ঘরের ছোট লাইট জ্বালিয়ে শুয়ে পড়েছে।

এমনভাবে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়েছে যাতে আমাকে দুজনের মাঝখানেই শুতে হয়।

বাথরুমের কাজ সেরে ঘরে এলাম। একবার কাছে গিয়ে ওদের ভালো করে দেখলাম।

না ঘুমিয়ে পড়েছে।

আস্তে করে সোফায় বসে বেশ কয়েকটা ম্যাসেজ করলাম।

একবার করে ওদের মুখের দিকে তাকাই আর ম্যাসেজ করি।

কিছুক্ষণের মধ্যে তার উত্তরও পেলাম।

আজ নিজেকে অনেকটা হাল্কা অনুভব করছি।

মাবাইলটা অফ করে নিস্তব্ধে খাটে উঠে এসে আর একবার ওদের মুখটা দেখলাম, না দুজনেই ঘুমচ্ছে। নিস্তব্ধে শুয়ে পরলাম।

ঠিক মাথার ওপর চোখের সামনে পাখাটা বন বন করে ঘুরচ্ছে। চোখটা কেমন জ্বালা জ্বালা করছে। কিছুতেই ঘুম আসছে না। দেবা… অনাদি… সাগর…।

আমার হাতে এখন তিনটে পুতুল। আমাকে মন দিয়ে পুতুল খেলা খেলতে হবে।

নয়না বলেছে, না মেরে তুমি ওকে যা খুশি শাস্তি দাও।

ব্যাটা বড্ড জালিয়েছে।

অনিমেষদা বার বার আমার কানের কাছে এসে ফুস মন্ত্রণা দিয়েছে। ওটা আমাদের প্রশাসনিক পার্ট। মাথায় রাখবি আমাদেরও বাঁচতে হবে। তুই এর মধ্যে আর মাথা গলাস না। নিজের কাজ কর।

আমি অনিমেষদার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছি।

বহুত ধরি বাজ লোক। হবেই বা না কেন। এতবড়ো একটা পার্টিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তো।

অনুপদা যাওয়ার সময় হাত ধরে বলেগেছে। সব খবর পেয়েছি। এখন কোনও ঝামেলা করিস না। এই ব্যুমটাকে ক্যাশ করতে দে। আমরা কথা দিচ্ছি….।

কিরে ভাব জগতে প্রবেশ করলি নাকি।

চমকে ঘার ঘুড়িয়ে তাকালাম। মিত্রা ড্যাব ড্যাব করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

ঘুমস নি!

মিত্রা পাশফিরে একটা হাতের ওপর মাথাটা রেখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

হেসেফেললাম।

ভাবলি যাক আজ দুটোতে ঘুমিয়েছে, আমি একটু ঠাণ্ডা মাথায় কালকের স্কিমগুলো সারি।

তনু একটা ঠ্যাঙ আমার ওপর তুলে দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো।

তোরা সত্যি ঘুমোস নি!

তুই মটকা মেরে পরে থাকতে পারিস, আমরা পারি না।

তনু ঘারের মধ্যে মুখ গুঁজে ঠোঁট ছোঁয়াল।

গত সাতদিন ফাঁকি মেরেছিস। আজ কড়ায় গণ্ডায় সব মেটাবি। তোর জন্য বড়োমা, ছোটোমা ম্যায় মাসীমনির কাছে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। সব সুদে আসলে তুলে নেব।

ঘুমিয়ে পর। অনেক রাত হয়েছে। তনু আমার শুরশুরি লাগছে।

শয়তান।

মিত্রা আমার মুখটা ওর বুকে চেপে ধরলো।

মিত্রা আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। আমি গঁ গঁ করছি।

যাক। তবু বুঝবো তুই আমার বুকে….। উ। শয়তান।

কি হলো! তনু বলে উঠলো।

মিত্রা ঠেলে ঠুলে আমার শরীরে উঠে এলো।

আমার বুকে কামরে দিল।

মিত্রা ঘুসি তুললো আমি ওর হাতটা ধরে ফেললাম।

দুজনে মিলে যুদ্ধ শুরু করে দিল। কিছুটা ধস্তা ধস্তি। আবার দুজনে আমার বুকে নেমে এলো।

তিনজনেই একটু হাঁপিয়ে গেছি।

দুজনের বুকের লাবডুব শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। দুজনেই আমাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।

বুবুন।

উঁ।

গত সাতদিন তোকে একটু ভাল করে ছুঁতেও পারিনি।

কি করবো বল। নিজেরা সব চোখের সামনে দেখলি। সারাটা দিন যুদ্ধ করার পর রাতেও কয়েকদিন যুদ্ধ করেছি। শরীরটা ঠিক আগের মত আর দেয় না।

এখন তো তুই তোর অনেক কাজ ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিস।

দিয়েছি ঠিক। তবে তারও নার্সিং করতে হয়। সেটা আরও বেশি ঝামেলা। এক কথায় বলতে পারিস বড়ি বানিয়ে ফেলেছি। মেইনটেনান্স করে যেতে হবে। সেটুকু না করতে পারলে বাড়িটা ভেঙ্গে পড়ে যাবে।

মিত্রা আমার বুকে ঠোঁট ছোঁয়াল।

মাসীমনি তোকে পেয়ে ভীষণ খুশী।

আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।

মাঝে মাঝে তোকে নিয়ে আমি, তনু রিসার্চ করি।

তনুর মুখের দিকে তাকালাম।

মিটি মিটি হাসছে।

ওর নাকটা ধরে টিপে দিলাম।

উ। লাগে না। তনু দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ঘুসি তুললো।

মিত্রা ওর দিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিল।

মাসিমনি কি বলেছে জানিস।

কি।

জানিস মিত্রা এতদিন নিজের বলতে কেউ ছিল না। বাপ-মা, মাসি-মেসো, ভাই-বোন কবে মরে হেজে গেছে। বিনয়ের দিকে তাকিয়ে প্রায়ই মনে হতো। ঝুমুর ছেলেটা যদি বেঁচে থাকতো…, ওরই পিঠো-পিঠি ছিল। আমারই ভুল, বুঝেছিস। তাই এতদিনে তার প্রায়শ্চিত্ত করলাম।

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

জ্যোতিষদাদার কথাটা বলো। তনু বললো।

ওকে বলে কি হবে বল, ও কি এসব বিশ্বাস করে।

তোর একটুও জানতে ইচ্ছে করে না। মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকাল।

করে তো। ভেবেছিলাম, দেশের বাড়িতে গিয়ে তোদের মুখ থেকে সব শুনবো।

তোকে যে একটু নিশ্চিন্তে দুজনে দু-দণ্ড কাছে পাব সে উপায় নেই। সব সময় তুই তোর তালে আছিস। আর তোর পেছন পেছন সবাই ঘুর ঘুর করছে।

আমি দুজনের শরীরটাকে জাপ্টে ধরে আরও কাছে টেনে নিলাম।

জ্যোতিষদাদা, মিত্রাদিকে কি বলেছে জানো? তনু বললো।

মিত্রার দিকে তাকালাম।

আমি, তনু দুজনে গেছিলাম। বড়োমা পাঠিয়েছিল।

কেন!

মাসীমনির ঠিকুজি কুষ্টি দেখাতে।

হেসেফেললাম।

দেখলি তনু এই জন্য বলতে চাইছিলাম না।

ছাড়োতো।

ঠিক আছে বল।

মাসিমনি সুস্থ হয়ে উঠবে। মাসিমনির একটা ব্যাড টাইম চলছিল সেটা কেটে গেছে। তবে একটু ভোগাবে। তারপর আমার মুখ থেকে সব কথা শুনে বললো, জানিস মিত্রা তোর মুখ থেকে সব শুনে মন হচ্ছে আমার পড়াশুন করাটা সার্থক।

আমি বললাম, কেন!

তোকে একদিন বলেছিলাম। অনি তার বংশের মেন জিনটার ধারক। বংশপরম্পরায় কেউ না কেউ এটা বহন করে। যাকে খুব চিফ ভাষায় আমরা বলি পেডিগ্রি।

প্রথম দিন ওর ডেট অফ বার্থ তুই যখন দিলি, তখন আমি একটু অবাক হয়েছিলাম।

এই ধরণের গ্রহনক্ষত্রের পজিসন সকলের হয় না। তোকে ওর সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছিলাম। তুই কিছু বিশ্বাস করেছিলি, কিছু করিসনি।

একচ্যুয়েলি কি জানিস একটা দিনের ওই একটা মুহূর্তই মহেন্দ্রক্ষণ। ঠিক ওই মুহূর্তে তিনটি শিশু পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়। তিনটেই যে বেঁচে থাকবে তার কোনও মানে নেই। বাঁচতেও পারে নাও বাঁচতে পারে। অনেকটা ডারউইনের থিওরির মতো সার্ভাইভ অফ ফিটেস্ট। তবে তিনজনেই কিন্তু জিনিয়াস। অনি তাদের মধ্যে একজন।

তোদের বিয়ের দিন ওর চোখমুখ দেখে আমার স্থির বিশ্বাস জন্মেছিল, আমি যা বলেছি সেটা ঠিক, একবর্ণও মিথ্যে নয়। আজ তুই দেখ আমার কথা মিলছে কিনা।

আজ আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। জানিস আমাদের রুটটাও নবদ্বীপ। মায়ের মুখ থেকে শুনেছি। আমার দাদামশাইয়ের বাবা রায়গুনকর মহাশয়ের খুব বন্ধু লোক ছিলেন। সেই সময় তিনিও অনেক পুঁথি লিখেছিলেন।

তখন তো এপার বাংলা ওপার বাংলা বলে কিছু ছিল না। পায়ে হেঁটে কিংবা নদী পথে মানুষ যাতায়াত করতো। ফলে তাদের জ্ঞানের পরিধিও ছিল বিশাল।

কতো মানুষ দেখতো বলতো? ফলে জ্ঞানের আদান-প্রদান হতো।

অনিকে দেখ ওর জীবনের ব্যাপ্তিটাও অনেকটা ওর পূর্বপুরুষের মতো। এইরকম মানুষ তুই সচরাচর পাবি না। ঈশ্বর ওঁকে দু-হাত ভরে দিয়েছেন। তুই দেখিস শত বাধা এলেও ও খুব স্মুথলি ওভারকাম করে বেরিয়ে যাবে। আমরা যেটাকে বলছি টাফ ওর কাছে সেটা খুব সহজ—সরল। বলতে পারিস একেবারে জলভাত। কেউ ওকে আটকাতে পারবে না।

আচ্ছা তুই নিজে কখনও ভাবতে পেরেছিস তুই তনু এক সঙ্গে ঘর করবি।

এটা বাস্তবে সম্ভব? তাও এই আধুনিক মনস্ক যুগে। তুই যাকে হোক জিজ্ঞাসা করবি, সে একটু অবাক চোখে তোদের দু-জনের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কিন্তু ওকে দেখ।

তোমাকে বললাম না ও অসম্ভব মানুষকে শ্রদ্ধা করতে জানে।

এই গুণটা কজনের থাকে বল। হলপ করে বলতে পারি তোর ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই গুণটা আছে ঠিক কিন্তু অনির মতো এতটা গভীর নয়।

অনি প্রকৃতির দান, ওকে কেউ তৈরি করেনি।

অনেক ভাষণ দিয়ে ফেলেছিস। এবার লাট খা। তনু তুমি কিন্তু সমানে খোঁচা খুঁচি করে চলেছ।

সাতদিন ধৈর্য ধরে ছিলাম।

আমার হাত আছ।

আমি বারন করিনি।

তেঁদর। মিত্রা আবার মুখটা ধরে টানাটানি শুরু করলো।

শোন না।

বল।

হাসবি না।

যা বাবা হাসির কথা বললে হাসবো না।

দেব না। আমাদের পেট ফুলে যাচ্ছে ও ফিচলেমি করছে। তনু বললো।

কেন আবার হবে নাকি!

দেখছো মিত্রাদি।

মিত্রা আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।

আচ্ছা বল, এবার মন দিয়ে তোদের কথা শুনছি।

একটু নড়ে-চড়ে শুলাম।

সেদিন তুই ঘুমিয়ে পড়র পর আমি, তনু দুজনে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলাম।

জল বেড়িয়ে ছিল?

তনু দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আমার ঠোঁটটা টিপে ধরলো।

তুমি তো তখন মরার মতো ঘুমচ্ছিলে।

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

আচ্ছা বল, এবার ডোন্ট ডিস্টার্ব।

কাকে আর মনের কথা জানাই। তোর ঘুমন্ত শরীরটা দেখে বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে উঠলো। আমি তনুকে শান্তনা দিই, তনু আমাকে শান্তনা দেয়।

তারপর তনুই বললো, দিদি তুমি একবার কনিষ্ককে ফোন করো। ওর বন্ধুদের মধ্যে ওই-ই একমাত্র অনিকে সবচেয়ে বেশি বোঝে।

তখন রাত তিনটে। ওই কানারাতে কনিষ্ককে ফোন করলাম।

কনিষ্ক ফোন ধরেই বলে, ম্যাডাম এত রাতে! আগে বলো অনি কেমন আছে?

বললাম, ভাল। ঘুমচ্ছে।

কার কি হয়েছে বলো?

কারুর কিছু হয় নি।

তোমরা কোথায় ও বাড়িতে না এ বাড়িতে?

এ বাড়িতে।

কাল ফিরে যাও নি!

না।

তারপর কনিষ্ককে ধীরে ধীরে সংক্ষেপে সব কথা বললাম।

শুনে বললো, সব্বনাশ। কানা রাতে এ কি কথা শোনালে তুমি!

মিলি কোথায়?

মিলি তোমার কথা শুনছে।

মিলি।

বলো।

টিনাকে একবার ফোন কর। তোরা একবার আয়।

তুমি মন খারাপ করবে না। আমরা এখুনি যাচ্ছি।

কনিষ্ক।

বলো।

নীরুকে একবার জানাও। আমি এখুনি মাসীমনির কাছে যাব।

এত রাতে! দাঁড়াও আগে আমরা যাই, তারপর একটা ডিসিসন নেওয় যাবে।

মিলি।

বলো।

তোর অনিদার কথা কিছু বুঝছিস?

আমি কিছু ভাবতে পারছি না মিত্রাদি। মানুষ এতটা চাপা হয় আমার ধারনা ছিল না। তুমি কি সত্যি এখনই যাবে?

হ্যাঁ।

তুমি একটু ভাব মিত্রাদি। হিতে বিপরীত হলে আবার গণ্ডগোল। বুঁচকিরা পর্শু আসছে।

এই সুযোগে এই কাজটা করতে হবে।

বড়োমাকে বলেছো।

এখনও বলিনি। কনিষ্ক কোথায়?

আমার ফোন থেকে মনে হয় নীরুদার সঙ্গে কথা বলছে।

তোর কাছে আছে?

না বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

মাম্পি কোথায়?

সে ও বাড়িতে, সুরোর কাছে। কাল কিছুতেই আনতে পারলাম না।

ভালো হয়েছে। তোরা আয়। আমি রেডি হচ্ছি।

তুমি মন খারাপ করো না।

মন খারাপ করছি না। ভাবছি কোন মানুষের সঙ্গে আমি, তনু ঘর করছি।

তুমি একটু অপেক্ষা করো এখুনি তৈরি হয়ে বেরচ্ছি।

সত্যি তোর বন্ধুরা তোকে যে কতটা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে আর একবার প্রমাণ পেলাম।

একে একে ওরা সবাই এলো।

নীরু ঘরে ঢুকেই প্রথম তোর প্রেসার চেক করলো। কনিষ্ককে বললো, একটু ওপরের দিকে আছে। দেখলাম শ্রীপর্ণাও এসেছে।

সকলেরই চোখে মুখের চেহারা আমাদরে মতো।

তোকে দেখে শ্রীপর্ণার চোখ ছল ছল করে উঠল। নীরু ধমকাল।

সব সময় ন্যাকামো। অনিকে যেন আগে এই অবস্থায় দেখেনি।

বটাকে বললো। তুই একবারে এখান থেকে নরবি না। আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর প্রেসার চেক করবি। আমার মন বলছে ও এখন উঠবে না। বেগতিক দেখলে আমার ব্যাগে ইঞ্জেকসন আছে পুস করবি। দেখবি আবার ঘুমিয়ে পড়বে।

বটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো।

এক কাজ কর।

বল।

কনিষ্ক যাক তুই বরং থেকে যা। পারলে জয়ন্তীকে একটা ফোন কর ও মাসীমনিকে দেখছে।

কনিষ্ক, বটা কথাটা মন্দ বলেনি। নীরু বললো।

আর একটা কাজ করলে হয়। বটা বললো।

বল।

ওখানে গিয়ে পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে বড়োমাদের জানা। তারপর বড়োমা স্যার এখানে এলে আমরা যাব। অনিকেত নার্সিংহোমে আছে। ওকে একবার বলে রাখ, এ্যামবুলেন্সটা রেডি রাখতে। এই সব কথা শোনার পর মাসীমনির শরীরের কি অবস্থা হয় কে জানে।

ঠিক আছে, কনিষ্ক তোরা বেরিয়ে যা। আমি, বটা ঠিক সামলে নেব। মিলি একটু চা বানাও।

নীরু খাটে উঠে বসলো।

আমি আলমাড়ি খুলে তোর সব জিনিষ বার করলাম।

ওরা দ্যাখে, আর অবাক হয়ে যায়।

তোমরা করেছ কি!

আমি তনু কাল সব একটু একটু করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করেছি।

সত্যি ম্যাডাম মাল বহুত সরেস। তুমি আগে শুভ কাজটা সারো, তারপর এসব দেখা যাবে। এগুলো কি তুমি এ্যাভিডেন্স হিসাবে নিয়ে যাচ্ছ? নীরু বললো।

হ্যাঁ।

কাল মিলির মুখ থেকে ভাষা ভাষা শুনলাম। সেটার গভীরতা যে এতটা বুঝি নি। কনিষ্ক বললো।

আমি ভেবেছিলাম আন্টি কেশ। স্যারেরটা আবিষ্কর হয়েছে এবার বিধানদার পর্দা ফাঁস। নীরু বললো।

সেরকমই কানা ঘুষ শুনছিলাম। বটা বললো।

শ্রীপর্না বললো। ওনার একবার গাইনীর প্রবলেম হয়েছিল, জয়ন্তী আমাকে দেখিয়েছিল।

দেখো জয়ন্তী হয়তো এর ভেতরের রহস্য কিছুই জানে না। নীরু বললো।

জানলে নিশ্চই একটা হাল্কা আওয়াজ পেতাম। বটা বললো।

মিলি, টিনা চা নিয়ে এলো। আমরা চা খেয়ে বেরলাম।

আমি ড্রাইভ করতে যাচ্ছিলাম। কনিষ্ক কিছুতেই ড্রাইভ করতে দিল না। বললো তুমি পেছনে বসো। আমি ড্রাইভ করছি।

তখন কটা হবে চারটে। একটু একটু অন্ধকার আছে।

রাস্তা-ঘট একবারে শুনসান। কনিষ্ক বেশ জোড়েই গাড়ি চালাল। সেই বটতলায় যখন পৌছলাম তখন সারে চারটে। অনেক মানুষের ভিড়। অন্ধকার অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। ভেঁড়িতে জালটানা হচ্ছে। মাছ নিয়ে দরাদরি চলছে। ছোটোছোটো ভ্যান রিক্সায় বড়োবড়ো ড্রামে মাছ ভড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে।

ওই সাত সকালে ওখানে যেন বাজার বসে গেছে।

আমরা তিনজন গাড়ি থেকে নামলাম। স্বাভাবিক, ওই রকম একটা সময় আমাদের মতো ধোপ দুরস্ত মানুষ দেখে সকলে কেমন যেন একটু অবাক হয়ে গেছে।

তোর কথা মতো গোটা কয়েক সাইকেল ভ্যানের চায়ের দোকান দেখলাম।

কনিষ্ককে বললাম, এই সামনের ইঁটের রাস্তা দিয়ে আমরা গেছিলাম।

কনিষ্ক গাড়ি থেকে নেমে লক করছে, আমরা তিনজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছি।

দেখি বেচা এসে হাজির।

ম্যাডাম আপনি!

ওই সময় ওকে দেখে সত্যি আমি অবাক হয়ে গেছি। সাত সকালে পরিচিত কাউকে দেখবো ভাবিনি।

প্রথম প্রশ্ন, অনিদার কি হয়েছে?

ও মা তোর নাম শুনে গুটি গুটি পায়ে আরও চার-পাঁচজন এসে হাজির।

কিছুতেই বোঝাতে পারি না তোর কিছু হয়নি।

বেচা কাকে যেন বললো এই আলা থেকে টনা-মনাকে ডাক। আর শোন, কেনাকে বল স্পেশ্যাল চা নিয়ে আসতে সঙ্গে ভাল বিস্কুট আনিস।

নিমেষের মধ্যে দুটো লোক উধাও। ও মা দেখি আরও কয়েকজন এসে হাজির।

উৎসাহী মানুষের ভিড় বড়ো একটা কম নয়।

তারপর বেচা আমার দিকে তাকিয়ে বললো। সত্যি বলছেন ম্যাডাম অনিদার কিছু হয়নি?

হ্যাঁ গো, সত্যি বলছি।

আপনার কথা বিশ্বাস করতে পারি। না হলে এখুনি ফোনা-ফুনি চালু করবো।

না না কাউকে ফোন করতে হবে না।

কনিষ্ককে মনে হয় আগে দেখেনি। পরিচয় করিয়ে দেবার পর বললো, টনা-মনার মুখে ওনার নাম শুনেছি। পেসেন্টও পঠিয়েছি ওনার কাছে। আজ চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হলো।

টনা, মনা ছুটতে ছুটতে এলো। তাদেরও এক কথা, অনিদার কি হয়েছে!

তারপর কনিষ্ককে দেখে একটু আস্বস্ত হলো।

কনিষ্ক আবার একটু আড়ালে গিয়ে টনা, মনাকে মনেহয় সংক্ষেপে বললো।

ওরা তখন কনিষ্ককে কোলে তুলে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে।

তারপর আমাকে তনুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে কনিষ্কর দিকে তাকিয়ে বললো, তোমরা কখন জানলে?

কালকের থেকে চলছে, বাবু রাতে খোলসা করেছে। কনিষ্ক বললো।

মনা আমার মুখের দিকে তাকাল। জানেন ম্যাডাম আমরা কিছু একটা সন্দেহ করতাম। কিন্তু দাদাকে সাহস করে জিজ্ঞাসা করার মতো বুকের বল আমাদের নেই।

কেন!

ঘারে গর্দান থাকবে না।

বেচা, টনা হাসছে। বেচা বললো।

দাঁড়ান ভ্যান নিয়ে আসি। এতটা পথ হাঁটতে পারবেন না।

তোমরা ওই পথে এলেনা কেন? মনা কনিষ্কর দিকে তাকাল।

দূর ব্যাটা, ম্যাডাম চেনে নাকি। তোর অনিদাকে চিনিস না।

তাও ঠিক।

এই পথে এসেছিল তাই চিনতেই দম বেড়িয়ে যাচ্ছিল। কনিষ্ক বললো।

ওখানে চা খেলাম। তারপর রওনা হলাম। মনা, বেচা সঙ্গে এল।

কাকে যেন বললো, গাড়িটা ওই পাশের রাস্তা দিয়ে বিনয়দার বাড়ির সামনে নিয়ে এসে রাখ।

কনিষ্ক আবার মনার হাতে চাবি দিল।

তখন সবে ভোর হয়েছে। বাড়ির গেটের কাছে এসে বুকটা ভীষণ ধুকপুক করছিল।

ঠিক কাজ করছি, না ভুল কাজ করতে যাচ্ছি, নিজেরাই জানি না।

কনিষ্ক বললো, টেনসন করো না। যা হবার তাই হবে।

গতকাল এসে ঘুরে গেছি। এখনও চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়নি। আজ আবার এই কাকভোরে এসে হাজির, বুড়ি সব শুনে যদি গরবর করে তাহলেই হয়েছে।

বেচাই গেটের বাইরে থেকে ডাকল বিনয়দা, বিনয়দা বলে।

মিনিট চারেক পর গেট খুলেই আমাদের দেখে বিনয়দার চোখ চড়কগাছ।

তোমরা এত সকালে! অনির কি হয়েছে? সে হাজার প্রশ্ন।

তারপর তাকে বোঝাতেও সময় লাগল। প্রথমে কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না।

তাহলে এত সকালে এসেছ কেন?

যাই হোক তাকে ঠাণ্ডা করলাম।

জিজ্ঞাসা করলাম, মাসীমনি কোথায়?

সবে উঠেছে। এই তো মাকে দাঁত মাজিয়ে মুখ ধুইয়ে চা দিলাম। কেন কি হয়েছে বলো?

মহা মুস্কিল এখানে দাঁড়িয়ে কথা শেষ করবে?

ঠিক আছে ভেতরে চলো।

তারপর মনার দিকে তাকাল।

কিরে তোরাও মিছে কথা বলবি।

নাগো অনিদা ঠিক আছে, একটা সুখবর আছে। তাই ম্যাডাম সক্কাল সক্কাল এসেছে।

তারপর কনিষ্কর সঙ্গে পরিচয় করালাম। বললো, নার্সিংহোমে দেখেছে।

দরজা পেড়িয়ে বাগান। ভেতর মহলে ঢুকেই বুকের ধুকপুকুনি আরও বেড়ে গেল। তনু কেমন ম্যাদামারার মতো হয়ে রয়েছে। কোনও কথা বলে না।

পায়ে পায়ে মাসিমনির ঘরে এলাম।

যাই বলো মিত্রাদি তখন আমার যা বাথরুম পাচ্ছিল না।

আমারও পেয়েছিল। তারপর পেটের ভেতর কোথায় যে উধাও হয়ে গেল বুঝিনি।

আমি মুচকি মুচকি হাসছি।

তারপর শোন না।

আবার মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।

ঘরে ঢুকে দেখি মাসিমনি খাটের ওপর বালিসে ঠেসান দিয়ে বসে। সেদিন তুই যেভাবে বসিয়েছিলি সেই ভাবে। সামনে একটা ট্রের ওপর চায়ের কাপ।

আমাদের ঘরে ঢুকতে দেখে মাসিমনির চোখ ছানাবড়া।

কিরে তোরা এত সকালে! অনির শরীর কেমন আছে?

বললাম। ভাল আছে।

সে কি বুড়ী বিশ্বাস করে। চোখে মুখে সেই ছবি ফুটে উঠেছে।

গিয়ে বুড়ীকে প্রণাম করলাম। দু-জনে দু-পাশে বেশ গুছিয়ে বসলাম। কনিষ্ক দাঁড়িয়ে রইলো। বুড়ি কিন্তু বেশ স্বাভাবিক। একবার আমার মুখের দিকে তাকায়, একবার তনুর মুখের দিকে তাকায়। একবার কনিষ্কর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায়।

চোখে মুখে অতটা উতলা দেখলাম না।

বিনয়দাকে বললো, যা বৌমা, তিতাসকে ডাক, কালকে ওদের সঙ্গে দেখা হয়নি।

আমাদের দিকে তাকাল।

এদিকে কোথায় এসেছিলি?

তোমার কাছে।

এত সকালে আস্তে হবে কেন, একটু বেলা করে এলে চলতো না?

মাসির সঙ্গে কথা বলি আর কনিষ্কর মুখের দিকে তাকাই। ও মাসিকে তখন গিলে খাচ্ছে। বলতে পারিস চোখ দিয়ে শীরর মাপছে।

সবার শরীর ঠিক আছে?

হ্যাঁ।

চা খেয়েছিস?

খেয়েছি।

কখন বেরিয়েছিস?

চারটে।

ওকে চিনতে পারলাম না।

ও বুবুনের বন্ধু।

নাম কি?

কনিষ্ক।

হ্যাঁ। ওর মুখ থেকে মাঝে মাঝে এই নামটা শুনেছি। মেডিকেলের ডাক্তার।

হ্যাঁ। এখন আমাদের নার্সিংহোমের সঙ্গে এ্যাটাচ।

কিরে তনু তুই ওরকম শুকনো মুখে বসে আছিস?

তনু মাথা নীচু করে হাসছে।

তিতাস, তিন্নী এলো।

ঘরে ঢুকে তাদেরও একই প্রশ্ন অনি কেমন আছে। অনিকাকার কি হয়েছে?

কাউকে বিশ্বাস করাতে পারি না, তুই ঠিক আছিস।

কনিষ্ক একটা কথাও বলেনি। মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মাসি একে একে সবার খোঁজ খবর নিল। কালকের অনুষ্ঠান কেমন হয়েছে তা জিজ্ঞাসা করলো।

কিছুতেই কথাটা উত্থাপন করতে পারি না। বার বার কনিষ্ককে ইসারা করি তুমি শুরু করো।

তারপর কনিষ্ক খাটে উঠে এসে মাসির কব্জিটা ধরে দেখলো।

কেনরে তুই পাল্স দেখছিস?

কনিষ্ক হাসছে।

অনি তোকে এই সাত সকালে এদের সঙ্গে আমার পাল্স দেখতে পাঠিয়েছে? আমি ঠিক আছি।

কালকে তোমার বিষয় নিয়ে একটু কথা বলছিল।

কি বলছিল?

ওর একজন বিশেষ পরিচিত মাসীমনি আছে। তাকে দেখতে হবে।

সেই জন্য সাত সকালে হাজির হলি। তুইও তো দেখি অনির মতো গল্প বলিস।

তুমি অনির গল্পগুলো বিশ্বাস করো?

একসময় করতাম, এখন করি না। বড্ড জল মেশায়।

আমরা দু-জনে মুচকি মুচকি হাসি।

দেখো আমাদের কিন্তু এই সাতসকালে ঠেলে পাঠিয়েছে। এটা নিশ্চই গল্প নয়।

এই গল্পের ভেতরে আরও একটা গল্প আছে, সেটা বল।

কনিষ্ক মুচকি মুচকি হাসে। মাসীমনির চোখ থেকে চোখ সরায় না।

আচ্ছা মাসি তুমি অনিকে কতদিন চেন?

তুই যতদিন দেখছিস তার থেকে কম।

কালকে তোমার সঙ্গে ও একটা অন্যায় কাজ করেগেছে। আমরা ওকে শাস্তি দিতে চাই।

তাই এত সকালে আমার কাছে ছুটে এসেছিস?

হ্যাঁ।

ও কোথায়? এই প্রথম মাসির গলাটা সামান্য কাঁপা কাঁপা মনে হলো।

ঘুমচ্ছে।

তোরা ঠিক বলছিস!

তুমি বিশ্বাস করো। কনিষ্ক মাসীমনির হাতটা চেপে ধরে আছে।

তোদের তিনজনের চোখ মুখটা ভাল ঠেকছে না। বল না ওর কি হয়েছে, আমার কিছু হবে না।

ঘরে তখন তিতাস, তিন্নি, বিনয়দা দাঁড়িয়ে। মাসির চোখ দুটো কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। স্পষ্টতঃ চোখে মুখে তখন একটা ভয়ের ছাপ।

জীবনে অনেক ঝড় সহ্য করেছি। এখন আর কোনও দুঃখটাকে দুঃখ বলে মনে হয় না।

কনিষ্ক কিছুক্ষণ মাসির হাত ধরে মাথা নীচু করে বসে রইল।

আমরা মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখ দুটো কেমন যেন ছল ছলে।

কিরে মিত্রা অনির শরীর খারপ? কোনও অঘটন ঘটেছে?

না।

তাহলে তোরা কথা বলছিস না কেন!

আমরা তোমাকে ঠিক গুছিয়ে বলতে পারবো না। তুমি এই এ্যালবামটা দেখে আমাদের একটা ডিসিসন দাও। অনির লকার থেকে ম্যাডাম সকালে চুরি করে নিয়ে এসেছে।

কনিষ্ক মাথা নীচু করে কথাটা বলে আমার মুখের দিকে তাকাল।

আমি ব্যাগ থেকে তোর এ্যালবামটা বার করে মাসির হাতে দিলাম।

মাসির চোখমুখ তখন উত্তেজনায় ভরপুর। কাঁপা কাঁপা হাতে এ্যালবামের পাতা ওল্টাতে শুরু করলো।

আমরা তিনজন মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে। কয়েক পাতা উল্টেই মা-বাবার সঙ্গে তোর ছবিটা দেখে বিষ্ময়ে আমার মুখের দিকে তাকাল।

চোখের কোলে জল টল টল করছে। কান্না ভেঁজা চোখে মুখেও সে এক অদ্ভূত প্রশান্তি। টোল খাওয়া চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে না বলা অনেক কথা। হাসছে না তবু যেন মনে হচ্ছে হাসছে।

চোখে চোখ রেখে বলতে চাইছে এই সাত সকালে এ তুই আমাকে কি দেখাচ্ছিস?

আমি মাসিমনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। মাথা নীচু করে নিলাম।

পাতার পর পাতা উল্টে উল্টে দেখে। আর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে।

সারাটা ঘর নিস্তব্ধ কারুর মুখে কোনও কথা নেই।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/Tdlc6MQ
via BanglaChoti

Comments