❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৪০ নং কিস্তি
—————————
এত বানিয়ে বানিয়ে বলো কেন? মিলি বললো।
ওই হলো আমি যে ভাবে বললাম সে ভাবে না বলে একটু সাধু ভাষায় বলেছে।
মিত্রাদিরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরেছে। এখন এয়ারপোর্টে। আর এক ঘণ্টা পর প্লেনে উঠবে।
মিলির কথার উত্তর দিলাম না।
পুলিপিঠে মুখে দিলাম। ইসি বেশ ভালো তৈরি করেছে। মাসি মাত্র দুটো দিয়েছে। মাসির মুখের দিকে তাকালাম।
আর নয়, কনিষ্ক বারন করেছে। মাসি বললো।
তাহলে দিলে কেন। সেদিন বাসি পিঠে খাব ভাবলাম, তাও কপালে জুটলো না।
মাসির মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল।
এই দেখ তোমাদের একটুতেই যদি মন খারাপ হয়ে যায়, তাহলে কথাই বলা যাবে না।
ইসির দিকে তাকালাম।
চা নিয়ে আয়। ইসলামভাইকে একবার ডেকে দে।
মাসির হাতটা ধরে খাটে আমার পাশে বসালাম।
আবিদ কিছু বলেছে?
মাসি মাথা দোলাল বলেছে।
আগামী শুক্রবার, দিন ঠিক করেছে।
বহুদিন আগে করেছে।
তাই!
দিদির সঙ্গে কথা বলেই ঠিক করেছে। ঘরও মনেহয় বুক করেছে।
তুমি আবিদদার বৌকে দেখেছো। মিলি আমার দিকে তাকাল।
এখনও সৌভাগ্য হয় নি।
সে কি-গো! সাতমাস হয়ে গেল।
কিসের সাতমাস?
যাঃ যতো সব বাজে কথা। মাসি বললো।
আবিদ মুখ নিচু করে খিক খিক করে হাসছে।
ওটাও ওকে বলতে হবে। মাসি গম্ভীর হয়ে বললো।
রতনদা বলেছে। নেপলা বললো।
ইসলামভাই, ইকবালভাই ঘরে ঢুকলো।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
তুমি কখন এলে!
এই তো সবে মাত্র এসে ওঘরে ঢুকেছি। ইসি বললো তুই ডাকছিস। চলে এলাম।
মিলির দিকে তাকাল।
মিলি কাজু-বরফি নিয়ে এসেছি। একটা এনে দে অনিকে।
ইসিদি ঠিক নিয়ে আসবে।
ইকবালভাই রতনের দিকে তাকাল।
কিরে আসতে না আসতেই জ্বালাতন শুরু করে দিয়েছিস?
আমি না আবিদকে বলো।
ইসলামভাই হাসছে।
দুজনেই চেয়ারে বসলো।
তোর শরীর এখন কেমন?
ভালো। মাঝে মাঝে বিগড়ে যাচ্ছে। এরা হাতুড়ে, ঠিক ধরতে পারছে না। ডাক্তারদাদা আসুক একবার ভালো করে দেখাতে হবে।
মিলি চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে।
চোখ পাকালে হবে না। যা বলছি ঠিক বলছি।
ইকবালভাই-এর দিকে তাকালাম।
আবিদের বক্তব্য শুনেছো?
শুনেছি।
তাহলে একটা খুব জোড় খাওয়া দাওয়া হবে কি বলো।
তা হবে। আর কোনও বক্তব্য শুনিস নি।
এখনও বলে নি।
বৌ-এর নামে বিজনেস শুরু করেছে।
তাই নাকি?
রতন হাসছে।
কিসের বিজনেস?
হিমাংশুও তোকে কিছু বলে নি?
ওর সঙ্গে কথা বললাম কোথায়।
ইন্ডিয়ার সাতটা স্পটে জায়গা কেনা হয়ে গেছে। ডেভেলপ চলছে। অবতারের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার। তবে অবতার নেই, আছে লক্ষ্মী।
ওরে বাবা, এ-তো সব বড়ো খলিফা।
আবিদের দিকে তাকালাম।
তোর বৌ-এর নামটা কি রে?
তুই এখনও ওর বৌ-এর নামটাও জানিস না। ইসলামভাই হাসতে হাসতে বললো।
আমি তো অনিদার ভাই নই তাই আমার বৌ-এর খোঁজ খবর রাখে না। আবিদের গলায় অভিমানের সুর।
ঠিক বলেছো আবিদদা। দুনিয়ার স্বার্থপর। নিজেরটা ছাড়া কারুরটা বোঝে না। মিলি বলে উঠলো।
ঘরে ইসি, নীপা, সুবীর, চিকনা ঢুকলো।
ইসি টেবিলে জায়গা করে নিয়ে চায়ের পট, কাপ-ডিস রাখলো। নীপা সবাইকে প্রসাদ দিল।
কিরে ইসি কাজু বরফি নিয়ে এলি না?
এখন খাবি? ইসি আমার দিকে তাকাল।
এই যে মিলি বললো, বলতে হবে না। ঠিক নিয়ে আসবি।
সুরো বললো, এখন কিছু বলো না। বললেই চাইবে।
ইকবালভাই হাসছে।
দাঁড়া আমি নিয়ে আসছি। মাসি উঠে দাঁড়াল।
তুমি বোস। আমি নিয়ে আসছি। মিলি বেরিয়ে গেল।
কি চিকনাবাবু কালীঘাটে পুজো দেওয়া হলো।
দুর, সুরোমাসি বললো কালীঘাট দেখে নি, তাই নিয়ে গেছিলাম।
গঙ্গায় স্নান করলি।
কি নোংরা জল। স্নান করা যায় নাকি। আমি করি নি। বারন করলাম তা সুরো মাসি ওই জলেই ডুব দিয়েছে।
ইসি চা দিল।
মাসির দিকে তাকালাম।
আবিদের বৌয়ের নাম কি?
আমরা আয়েষা বলে ডাকি। ও নাম দিয়েছে কাহেকসান।
নামটা খুব শোনা শোনা মন হচ্ছে।
হবে তো।
আমি মাসির দিকে তাকিয়ে। চোখে প্রশ্ন।
তুই নাকি কবে কথায় কথায় বলেছিলি আবিদ বিয়ে করলে তোর বৌয়ের নাম রাখবি কাহেকসান তাই ও ওর বৌকে ওই নামেই ডাকে।
আবিদের দিকে তাকালাম।
ভালো নাম।
চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর রাখলাম। মিলি সবার জন্য কাজু বরফি নিয়ে এসেছে।
মিলি পুঁচকে দুটো কোথায়?
সুরো খাওয়াচ্ছে।
তাই বলো, কোনও সারা শব্দ নেই।
আবিদের দিকে তাকালাম।
হ্যাঁরে তোদের ব্যবসায় সাগির, নেপলাকে চান্স দিস নি?
ওরা আরও বড়ো খলিফা। ইসলামভাই হাসতে হাসতে বললো।
কেন!
তুই প্রজেক্ট করবি সেখানে কন্ট্রাকটরি করবে। রতন, নেপলা, সাগির কোম্পানী ফর্ম করেছে।
এটা নিশ্চই নেপলার টিপস।
রতন হে হে করে হেসে উঠলো।
ব্যাটা গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল।
কেন তুমি করবে না? নেপলা আমার দিকে তাকাল।
তুই খুব ভালো জায়গা থেকে টিপ্ পেয়েছিস না।
হাসছে।
তাহলে বললে কেন।
আমি হাতটা তুললাম আমার হাতটা চেপে ধরলো।
এখন সব ব্যবসা গোটাতে শুরু করেছে। ইকবালভাই বললো।
আমার কমিশন?
ফিফটি ফিফটি। রতন বললো।
খুশি? নেপলা বললো।
আবিদ মাঝে মাঝে তোর হোটেলে গিয়ে থাকবো, বিনা পয়সায় থাকতে দিস।
দেখলি আবিদদা কোথা থেকে কোথায় এসে থামলো। নেপলা বললো।
ওরা সবাই হাসছে।
রতন তোকে একটা কাজ দেব, আমাকে একটু করে দিস।
রতনদাকে দিয়ে কাজ করাবে কমিশন দেবে না। নেপলা বললো।
কাজটা ঠিক মতো করতে পারলে পুরোটাই ওর।
রতন হাসছে।
আবিদবাবু তাহলে লেগে পরো সময় আর নেই। নেপলা তোকে নিয়ে বিকেলে একটু বেরোব।
না কোথাও যাওয়া হবে না। দিদি আসবে তারপর বেরবি। মাসি বললো।
দেখলে মিলি। হিসাবটা মিললো কিনা।
তোমাকে আর বক বক করতে হবে না।
আবিদরা উঠে দাঁড়াল।
রতন কোথাও বেরোস না। খেয়ে বেরবি। তোকে কাজটা বুঝিয়ে দেব।
আচ্ছা।
তুমি এখন ইসলামভাইকে নিয়ে পরবে। মিলি বললো।
আমি হাসছি।
ওরা সবাই বেরিয়ে গেল। আমি উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে এলাম।
খাটে বসে ইসলামভাইয়ের কাছে সিগারেট চাইলাম। ইসলামভাই দিল।
কাল যা যা বলেছিলাম ইকবালভাইকে বলেছো?
ইকবালভাই হাসছে।
হাসছো কেন?
আমাকে তোর কথা ও শুনিয়েছে।
তাহলে মিটেই গেল। এবার বলো কে সেই ব্যক্তি?
তুই বল, তুই তো জানিস।
আমি জানলে তোমাকে জিজ্ঞাসা করবো কেন?
তুই যখন আমাকে তিনটে অপসন দিলি তাহলে তুই জানিস।
সেদিন পার্কসার্কাস সেমিট্রিতে গেছিলে কেন?
ইসলামভাইয়ের হাসি হাসি মুখটা গম্ভীর হয়েগেল। চোখদুটো ছল ছল করে উঠলো।
কাঁদবে না। সত্যের সামনে দাঁড়াবার চেষ্টা করো।
ইকবালভাইয়ের মুখটা কেমন থম থমে।
নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গেছিলাম।
এতদিন পর!
ইসলামভাই চুপ করে রইলো।
আমি যতদূর জানি তুমি একটা মেয়েকেই জীবনে ভালোবেসেছিলে।
ইসলামভাই মাথা নিচু করে রয়েছে।
তারজন্য তোমার কিছু করার ছিল না?
সুযোগ পেলাম কোথায়?
তোমার এই কথাটা মানতে পারছি না। সুযোগ তুমি যথেষ্ট পেয়েছো।
সে তুই এখন বলবি। দোষ আমার।
এগুলো ছেঁদো কথা। আমাকে এসব কথা বলে তুমি ভোলাতে পারবে না।
তুই যা বলবি আমি মেনে নেব।
তোমার তখনকার মানসিকতার সঙ্গে এখনকার মানসিকতার অনেক ফারাক। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর যাকে তুমি অবজ্ঞা করেছ তার জন্য তুমি এতো উতলা কেন?
ইসলামভাই চুপ চাপ।
ইকবালভাইকে সব বলেছো?
মাথা দোলাল, বলেছে।
লণ্ডনে পৌঁছে নাতনি তোমাকে কতটা বিরক্ত করেছে?
ইসলামভাই হেসে ফেললো। গলার ওর্ণা দিয়ে তখনও চোখের জল মুছছে।
ইকবালভাইও হাসছে।
আমাকে নতুনভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে।
যাক নাতনি তাহলে তোমার এই উপকারটুকু করেছে।
তুই বুঝলি কি করে? ইকবালভাই বললো।
এই বাড়িতে আমার সম্বন্ধে ওর ইন্টারেস্ট সবচেয়ে বেশি। তাই আমার গোপন জায়গা থেকে মেটেরিয়ালটা খুঁজে পেয়েছে। তবে বুদ্ধিতে এখনও পাক ধরে নি, তাই ধরা পড়ে গেছে।
একদিকে ভালো হয়েছে। না হলে একটা ইতিহাস চাপা পড়ে থাকতো। ইকবালভাই বললো।
তাতে কার কি ক্ষতি হতো।
এটা তোর অভিমানের কথা।
না ইকবালভাই, আমি কারুর ওপর কোনওদিন অভিমান করি না। অভিমান করবো কার ওপর, যে আমাকে বুঝবে তার ওপর। সত্যি কথা বলতে কি আমাকে বোঝার লোক কম আছে। মেয়ে ইদানীং কিছুটা বুঝতে শিখেছে। বাকিটা ছোটোমা। মিত্রা, তনু, বড়োমা আমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে।
একটু থামলাম।
আর একজন আমাকে বুঝতো। সে মেরিনাদি।
গলাটা ভারী হয়ে এলো।
মেয়েটা সারাজীবন কষ্ট পেয়েছে। মরার সময় তাকে চোখের দেখাও দেখিনি। আমি তাকে দিদি বলে ডেকেছি। সে আমাকে ভাই বলে আঁকড়ে ধরেছিল। দুজনেরি পৃথিবীতে মা-বাবা কেউ ছিল না। এই পৃথিবীতে আমরা ছিলাম অনাথ।
সে বিজাতীয় হয়েও ভাই ফোঁটার দিন না খেয়ে আমার কপালে ফোঁটা দিয়েছে। তাই নিয়ে ইসলামভাই মাসি হাসাহাসি করেছে। আমার দিদি যেভাবে মারা গেছে, তোমায় বলে রাখলাম ইকবালভাই তাকেও সেইভাবে মরতে হবে।
ইসলামভাই তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে এগিয়ে আসতে চাইলো। ইকবালভাই জাপটে ধরে ফেললো। চেঁচিয়ে উঠলো, ইসলাম।
ইকবালভাইয়ের গলাটা বেশ চড়া হয়ে গেল। বুঝলাম গলার আওয়াজ ওই ঘর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ইকবালভাই তখনও ইসলামভাইকে জড়িয়ে ধরে আছে। ইসলামভাইয়ের চোখে আগুন ঝড়ে পড়ছে। চেঁচিয়ে উঠলো।
একবার নামটা বল।
কেন বলতে যাব। আঠাশ বছরে যাকে খুঁজে বার করতে পার নি। তার নাম আমার মুখ থেকে শুনেই খুঁজে পেয়ে যাবে, ভাবছো কি করে।
গেটের দরজা খুললো। দেখলাম চিকনা, রতন, মাসি, ইসিরা দাঁড়িয়ে।
ইকবালভাই তখনও ইসলামভাইকে ওই ভাবে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
মাসির চোখে মুখে বিষ্ময়। ধীর পায়ে ঘরের ভেতর এলো।
কি ব্যাপার কি ইসলাম। আবার কি শুরু করলে। তুমি কি ভাবছো, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
আমি ইশারায় রতনকে বললাম দরজা বন্ধ কর।
মাসি তুমি বসো। আমি বললাম।
ও বলছে মেরিনাকে যে মেরেছে সে বেঁচে আছে।
উত্তেজনায় তখনও ইসলামভাই থর থর করে কাঁপছে।
মাসি আমার দিকে তাকাল। মুহূর্তের মধ্যে মুখের চেহারায় পরিবর্তন হলো।
আমার পাশে বসে গলা জড়িয়ে ধরলো। গালে গাল ছুঁইয়ে চোখ বন্ধ করে বললো।
তাকে তুই খুঁজে পেয়েছিস।
পেয়েছি।
কে খোঁজ দিল?
মেরিনাদির দেওয়া পথ নির্দেশে।
কোথায় থাকে?
বলবো না।
বলতে হবে না। শুধু মেরিনার আত্মাটা যেন শান্তি পায় তার ব্যবস্থা করিস।
আমার হাত থেকে সে পালাতে পারবে না।
আগে যেখানে থাকতো সেখানেই থাকে।
জায়গা বদল করেছে।
হ্যাঁরে ও যে বলেছিল বাচ্চাটা বেঁচে নেই।
তোমাকে মিথ্যে কথা বলেছিল। সত্যি কথা বললে তুমি ইসলামভাই তাকে রাখতে।
মাসি চুপ করেগেল।
জড়িয়ে ধরা আমার গলা থেকে হাত সরিয়ে নিল।
হয়তো তুই ঠিক কথাই বলছিস। মাসির গলাটা ঘর ঘর করে উঠলো।
তোর সান্নিধ্যে না এলে কিভাবে বাঁচতে হয় সেটাই জানতাম না। আর দশটা বাজারের মেয়ের মতো ওই গলিতেই হয়তো পচে মরে পরে থাকতাম।
আবার বাজে বকা শুরু করে দিলে।
নারে অনি। সেই দিনগুলোর কথা মনে পরে গেলে আজ নিজেরই খুব খারাপ লাগে। অহেতুক তোকে কতো নোংরা কথা বলেছি। সন্দেহ করেছি। তোর ওপর কতো অত্যাচার করেছি। তুই মুখ ফুটে একবারও প্রতিবাদ করিস নি। হাসি মুখে সব কথা মেনে নিয়েছিস। আজ পর্যন্ত কাউকে সেই কথা বলিস নি। এতো নোংরামিতেও তুই আমাদের ছেড়ে চলে আসিস নি।
যাও মেলা বোক না। চা নিয়ে এসো। ইকবালভাই বললো।
মাসি মরা হাসি হাসলো।
ইসলামভাই, ইকবালভাই নিজের জায়গায় বসেছে।
থম থমে ঘর কেউ কথা বলছে না।
তুই এই কাজটা আমায় করতে দে।
কেন? সে কি তোমার বিয়ে করা বউ ছিল। বরং সে আমার দিদি। প্রথম দিন থেকে আমাকে ভাইয়ের মতো ভালোবাসতো। তুমি আমার পরিচয় জানা সত্ত্বেও আমাকে দিয়ে মাল, মাংস আনিয়েছ। রাতের বেলা সে এসে আমার কাছে কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চেয়েছে।
একটু থামলাম।
কারণ তোমাকে ভালোবেসে সে অপরাধ করে ফেলেছিল। তোমার খোমায় সে বুদ্ধি ছিল। তখন তুমি বাজারের শের। ডন ইসলাম। আজকের দিনটা যে তোমার আসতে পারে সেটা ভাবো নি।
আমি কি তোর জন্য কিছু করিনি।
বলতে পারবে অস্বীকার করেছি। ঋণ স্বীকার আমি করি না। যতটুকু করেছো তার জন্য তোমাকে মাথায় করে রেখেছি।
আমার ভুল হয়ে গেছে।
তোমার রক্ত তো ছোটোমার শরীরেও আছে, ছোটোমা তো তোমার মতো নয়।
তিনজনেই কোনও কথা বলছে না।
আমার তখন রাগে সারাটা শরীর জ্বলছে।
সবাইকে নিয়ে পার্কসার্কাস সেমিট্রিতে যাওয়ার খুব দরকার ছিল। যে গোপনে ছিল তাকে গোপনে রাখলে কি খুব ক্ষতি হতো। সে তোমাকে মাথার দিব্যি দেয়নি। একদিন যখন অনির মুখ থেকে আমার আত্মত্যাগের কথা শুনবে, তখন আমার কবরে গিয়ে দুটি ফুল ছড়িয়ে এসো।
ইসলামভাই ফুলে ফুলে কেঁদে উঠলো।
এই ইসলাম এই সব কি পাগলামো শুরু করেছো। দেখো তো ইকবাল।
মাসি আমার পাশ থেকে উঠে গিয়ে ইসলামভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলো। ইসলামভাইয়ের হাতটা চেপে ধরলো।
কনিষ্ক, নীরু দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো।
আবার কি শুরু করেছিস?
ইসলামভাই কান্নাভেঁজা চোখে ওদের দিকে তাকাল।
তোকে নিয়ে সত্যি পারা যাবে না।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
দু-জনে দু-পাশে এসে বসলো।
কি হলো ইকবালভাই। আবার কান্নাকাটি কিসের? সব তো মিটে গেছে।
হিসেব নিকেশ চলছে। কেউ মাটি ছেড়ে দিচ্ছে না।
কনিষ্ক হেসে ফেললো।
যতো সব পাগলামো।
ও মাসি তুমি ওখানে থম মেরে বসে আছো কেন। যাও যাও চা নিয়ে এসো। নীরু বললো।
যাচ্ছি।
যাচ্ছি না। আগে ওঠো।
মাসি ইসলামভাইয়ের হাত ছেড়ে দিল।
ইসলামভাই ওর্ণা দিয়ে চোখ মুছছে।
যাও বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে এসো। ওরা দেখলে কি ভাববে। কনিষ্ক বললো।
ইসলামভাই মাথা নিচু করে রইলো।
দাদাভাই তুমি তোমার মনের অবস্থাটা দেখছো। ওর মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছো না। কাল আমাদের ও সব বলেছে। কি বলেছে তোমাকে বলবো না। তবে নীরু আমি দুটো বাচ্চার ক্ষেত্রে সাক্ষী দিতে পারি। সেই দুটো বাচ্চা নীরু আর আমার হাতে ডেলিভারি হয়েছে। হয়তো ইয়ার আর টাইম ধরলে হাসপাতালের রেজিস্টারে নামধাম সব খুঁজে পেয়ে যাব। এমনকি বাচ্চার মার নাম। তবে গার্জেন হিসাবে ওকে পাবে। ওই দুটো বাচ্চা ও ওই বয়সে দত্তক নিয়েছে। এতদিন ধরে তাদের ভরন পোষণ সব ও সামলেছে। তুমি তোমার জিনিষটা চাইলে এত সহজে পেয়ে যাবে ভাবছো কেন।
কনিষ্ক কেটে কেটে ধীর স্থির ভাবে বললো।
আবার তিনজনে সোজা হয়ে বসলো। মাসি আমার দিকে তাকিয়ে।
এর মধ্যে লক্ষী আছে? ইসলামভাই বললো।
লক্ষী রিসেন্ট। তবে লক্ষীকে নিয়ে এসে একবার এ্যাবোরেসন করিয়ে নিয়ে গেছে।
কিগো মাসি চা আনবে না। নীরু আবার বললো।
আনছি। এখন কোনও কথা আলোচনা করবি না।
ঠিক আছে যাও।
মাসি বেরিয়ে গেল।
কনিষ্ক তোর সেই মেয়েটার মুখ মনে আছে। ইসলামভাই ধরা গলায় কনিষ্ককে বললো।
সত্যি কথা বলবো দাদা।
বল।
মনে নেই। কাল যখন ও কয়েকটা ঘটনা বললো, তখন যেন মনে হলো, আরে তখন আরও দুটো কেশ ও হ্যান্ডেল করেছে। আমি, নীরু তখন ছিলাম। ওকে চেপে ধরতে ও স্বীকার করলো।
আমি যদি ছবি দেখাই।
দেখাতে পারো। মনে করতে পারবো কিনা বলতে পারছি না।
ইসলামভাই উঠে গট গট করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল।
ইকবালভাই হাসছে।
অনি খুব জোর ঠুসছে তাই না ইকবালভাই। নীরু বললো।
ইকবালভাই মাথা দোলাচ্ছে।
দু-জনকে না একজনকে।
শুধু ইসলামকে। দামিনীর গায়ে হাত পরেনি এখনও।
ওটা রয়ে সয়ে পরবে।
মাসি চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
ইসলাম গেলো কোথায় ইকবাল?
ছবি আনতে গেল।
কার!
কি করে জানবো।
পাগল সব।
টেবিলে চায়ের ট্রে রাখল। আমার দিকে তাকাল।
ও ঘরে গিয়ে সকলকে বলবি এতক্ষণ এ ঘরে কি হচ্ছিল।
কেন তুমি বলো নি?
না।
নাচতে নাচতে বলে দেবে।
নীরু হাসলো।
আমি নাচলে দোষ, তুই যে নাচাস তার বেলা কিছু হয় না।
আমি নাচালে তুমি নাচবে কেন, তোমাকে কে নাচতে বলেছে। চুপ করে ঠ্যাং জোড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।
মাসি হাসলো।
মুখ দেখেছিস তোরা। ঝগরুটে মেয়ে কোথাকার।
নীরু, কনিষ্ক, ইকবালভাই হেসে উঠলো।
ইসলামভাই ঘরে ঢুকে কনিষ্ককে একটা ছবি দেখাল।
কনিষ্ক অনেকক্ষণ দেখে বললো, যতদূর মনে হচ্ছে ইনি নন।
দেখি ছবিটা। আমি বললাম।
তোকে দেখতে হবে না।
ওটা কাছে রাখো, জিনিষটা দেওয়ার সময় মিলিয়ে নেব। না হলে দেব না। মনে রাখবে।
কনিষ্ক ছবিটা ওকে দে। সঙ্গে সঙ্গে ইসলামভাই বলে উঠলো।
মাসি হেসে ফেললো। কনিষ্করাও হাসছে।
আগে হাতে পাই, তারপর দেখবি কি করি।
অনির লবডঙ্কা। কিসসু করতে পারবে না। আমে দুধে মিশে যাবে, আঁটি গড়াগড়ি খাবে।
কনিষ্ক আমার হাতে ছবিটা দিল।
দেখলাম। মেরিনাদির সেই সময়কার ছবি। এই ছবি এক কপি আমার কাছে আছে। তখন ভালোবাসার টানে ইসলামভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে স্টুডিওতে তোলা।
বাঃ একবারে কাত্তিক কাত্তিক লাগছে।
মাসি জোরে হেসে উঠলো।
পুরো খেঁড়ো কাত্তিক
দে দে কনিষ্ক ছবিটা দে, নাহলে এটা নিয়ে আবার কপচাতে শুরু করবে। ইসলামভাই বললো।
কনিষ্ক ছবিটা ইসলামভাইয়ের হাতে দিল।
ইসলামভাই আমার দিকে তাকিয়ে।
তাহলে নাতনি ভাইদাদাইয়ের গলা জড়িয়ে বললো, দাদাই দাদাই তোমায় একটা কথা বলবো—
বল কি কথা—
মেরিনা আন্টি কে গো?
ব্যাস ভাইদাদাই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললো, তুই এই নাম জানলি কি করে!
নাতনি হাততালি দেয় আর নাচে।
তারপর গম্ভীর হয়ে বললো—
জেনেছি, আগে বলো সে তোমার কে?
ব্যাশ কেশ জণ্ডিস।
ওরা সবাই আমার কথা শুনে খিক খিক করে হাসে।
তারমানে বুঁচকি মেইন অপারেটর! নীরু বললো।
আমি নীরুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম, জিজ্ঞাসা কর।
ইকবালভাই গরম চায়ে চুমুক দিয়ে প্রায় বিষম খেয়ে যাচ্ছিল, খুব জোড় সামলে নিল।
ইসলামভাই কাপে চুমুক দেয় আর মুচকি মুচকি হাসে।
সত্যি তুই ভালো অভিনয় করতে পারিস। নীরু বললো।
খালি নায়িকার অভাব।
দুটো আছে।
ভোগাস। কথা বলা দুরে থাক, হাত-পা-টাও ঠিক মতো নাড়তে পারে না।
তাহলে মাম্পিকে নিয়ে নে।
এটা ভালো কথা বলেছিস। একবার চেষ্টা করে দেখতে হবে।
ওরা তিনজনেই উঠে দাঁড়ালো। তোরা কথা বল। আমরা আসি।
কেনো বসো।
না।
শুনে যাও।
তিনজনেই দাঁড়ালো।
বয়স হয়েছে। ঘুণাক্ষরেও ওই তিনটে যেন জানতে না পারে। তাহলে আমার হাতে তোমার মৃত্যু অবধারিত এটা মনে রাখবে।
ইসলামভাই ছুটে এসে মাটিতে বসে আমার কোলে মাথা রাখলো।
কবে মারবি বল। আমি রাজি। তোর হাতে মরেও শান্তি।
আবিদের প্রোগ্রামের সমস্ত দায়িত্বটা নিজের হাতে নেবে।
কথা দিচ্ছি নেব।
ওদের যেন কোনও টেনশনের মুখে পরতে না হয় সেটা দেখবে।
সে রকম কিছু হবে না।
যাও।
ওরা বেরিয়ে গেল।
নীরু খোঁচা মারলো।
তুই শালা বহুত হারামী। খেলিয়ে খেলিয়ে যেন কাতলা মাছ তুলছিস।
নীরু বহুত খিদে লেগেছে চল খেয়ে নিই। বিকেলে আবার গ্যাটিস মারতে হবে। নাহলে কাল যাওয়া যাবে না। কনিষ্ক বললো।
কাল কোথায় যাবি?
এরই মধ্যে ভুলে গেলি!
স্যারের কাজে আমাকে নিয়ে যাবি?
তাই তো কথা হলো কাল। সেই জন্য বিকেলে গিয়ে আগামীকালের কাজগুলো সারতে হবে।
কখন বেরবি?
যতোটা ভোরে সম্ভব। সন্ধ্যের আগে আগে ফিরে আসবো।
আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তোরা আমাকে যেভাবে বেঁধে ফেলছিস। আমি হয়তো আর আমার মতো ঘুরতে পারব না।
একটু সুস্থ হয়ে যা। আর ভয় নেই। তখন তুই তোর মতো ঘোর না।
চল তাহলে খেয়ে নিই।
খাওয়ার পর নীরু, কনিষ্ক চলে গেল। নীরু বললো, রাতে ও আর আসবে না। কাল সকালে ওর বাড়ি থেকে ওকে তুলতে হবে। যাওয়ার সময় আমাকে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে গেল।
ইসলামভাই এখন খোশ মেজাজে। বাগনের সবুজ গালিচায় শীতের রোদে আবিদদের নিয়ে গোল করে বসেছে। হয়তো আবিদদের বৌভাতের প্ল্যান-প্রোগ্রাম চলছে। আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসলো।
নীপারা সুরোমাসিকে নিয়ে কলকাতা দেখতে বেরিয়েছে। রবিন এসেছিল ওদের নিতে।
আমি নিজের ঘরে এলাম।
দরজাটা ভেজিয়ে সোজা টেবিলের কাছে গেলাম। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরালাম। ফোনটা খাটের ওপর পড়েছিল। তুলতেই দেখলাম একটা মিস কল। ওপেন করতে দেখলাম মেয়ের নম্বর ভেসে উঠলো।
মেয়ে ফোন করেছিল!
রিং ব্যাক করলাম।
কয়েকবার টঁ টঁ আওয়াজ হয়ে থেমে গেল। বুঝলাম প্লেনের মধ্যে মোবাইলের ব্যবহার বন্ধ।
এতক্ষণে হয়তো ওদের প্লেন আকাশে উড়ে গেছে।
জানলার কাছে এসে দাঁড়ালাম।
শীতের বেলা বিকেল হতে না হতেই রোদে মরচে পড়ে যায়। সূর্যের রংটা কেমন ফিকে।
উসমানকে ফোনে ধরলাম।
ফোনটা ধরার পর কোনও সারা শব্দ পেলাম না। নিজেই বললাম, হ্যালো।
যাক তোমার গলা পেলাম।
হাসলাম। চুপ করে ছিলি কেন?
ধরলেই যদি কেশ খাই। তাই কে ফোন করছে আগে তার গলা শুনি তারপর ধরবো ভাবলাম।
না হলে…
অন্যগলা পেলে ফোনটা কেটে দিতাম।
সেদিন ফোন করেছিলি শুনলাম।
করেই তো ফেঁসে গেলাম।
কি হয়েছে।
কি জেরা গো। ভয়ের মারে রেখে দিয়েছি। ওমা দেখি বার বার রিং ব্যাক করে। আর ধরি নি। সারাদিন স্যুইচ অফ করে রেখে দিয়েছি।
খবর কি বল?
তোমার সঙ্গে সেদিন কথা বলার পর নাসরিন এসেছিল। ফাদারের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছে। ওর সঙ্গে ঘণ্টা, পক্কে দুজনেই এসেছিল। কথায় কথায় জানতে পারলাম শেয়ালদায় বরুণ হোটেলের আশেপাশে একটা মেশ মতো আছে সেখানে থাকে।
আমার কথা কিছু জিজ্ঞাসা করেছে?
না। শুধু বললো, খবর পেলাম অনিমামার শরীর খারাপ।
মনটা কেমন আনচান করে উঠলো, তোমাকে ফোন করলাম, ফেঁসে গেলাম।
পরদিন তোর কাছে যাওয়ার কথা ছিল।
হ্যাঁ।
নাসরিন কি বললো?
আমি ওকে টাকার কথা বললাম। অনির টাকা এসে ব্যাঙ্কে পড়ে আছে চল তুলে দিই।
লাগবে না।
তাহলে ছেলেটাকে একটা ফোন করে বলে দে। মাসের পর মাস টাকা দিয়ে যাচ্ছে তোদের এ্যাকাউন্টে শুধু শুধু পড়ে থাকছে। আর পাঠাবে না।
যে আমাদের ভালোমন্দের খবরা খবর রাখে না। তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কি লাভ।
কি করে জানলি তোদের খবরা খবর রাখে না।
একটা ফোন করতে পারে।
করে না কে বলেছে। তোরা কি ওর থেকে ব্যস্ত মানুষ। দিলাম ঝাড়। চুপ করে তিনজনে শুনে গেল।
আচ্ছা ও যে একটা স্কুলে কাজ করতো সেটা কি হলো?
ছেড়ে দিয়ে ওই চাকরিতে ঢুকেছে। কানা ঘুষো শুনলাম ওই কোম্পানীর মালিকের সঙ্গেই নাকি ওর বিয়ে হয়েছে। আগে নাকি লোকটা ভালো ছিল না। এখন অনেক ভালো হয়ে গেছে। প্রচুর পয়সা। বেহালার দিকে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে এখন ওখানেই থাকে।
ঠিকানা চাস নি?
বলেছে কারুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না।
ঠিক আছে আমি এর মধ্যে তোর কাছে একদিন যাব। এই কদিনের মধ্যে কোথাও যাবি না। ফাদারকেও বলবি আমি যাব। আলাদা করে আর ফোন করলাম না।
তোমার শরীর এখন ঠিক আছে?
মাঝে মাঝে গণ্ডগোল করে কি করবো বল। এখনও নাকি মাস তিনেক লাগবে পুরো সুস্থ হতে।
তুমি ভালো থাক, না হলে আমরা মরে যাব।
না-রে ঠিক আছি, এতো তারাতারি মরবো না। রাখিরে।
রাখো।
ফোনটা বন্ধ করে পেছন ঘুরতেই চমকে উঠলাম। সুরো আমার পেছনে দাঁড়িয়ে। কখন নিস্তব্ধে এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পাই নি।
আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসেফেললাম।
কার সঙ্গে কথা বললে।
কোনও কথার উত্তর দিলাম না।
টেবিলের কাছে এগিয়ে এলাম। সুরো আমার পেছন পেছন এলো।
সিগারেটের প্যাকেটে হাত দিতেই আমার হাতটা চেপে ধরলো।
তুমি এখুনি খেয়েছো।
কথা বলিস না। এখন যা। আমাকে একটু একা থাকতে দে।
প্লিজ অনিদা। কে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না বলো।
আবার পাগলামো করে। এখন যা।
আমার হাতটা টেনে নিয়ে নিজের মাথায় রাখলো।
আমার মাথায় হাত দিয়ে বলো, তুমি আমাকে বলবে।
আচ্ছাই পাগল মেয়ে!
তুমি তো আগে আমাকে সব বলতে।
এটাও বলবো, একটু সময় লাগবে।
তোমাকে এরকম টেনসড লাগছে কেন?
তুই ভুল দেখছিস।
তোমাকে এতদিন দেখছি বুঝবো না।
মিকি, মাম্পি উঠেছে?
উঠেছে।
যা ওদের পাঠিয়ে দে।
ওদের নিয়ে কিছু?
আচ্ছাই পাগল মেয়ে।
তোমাকে বলতে হবে।
বললাম তো বলবো।
তুমি কি উসমানের সঙ্গে কথা বললে?
কে উসমান!
সেদিন যে ফোন করেছিল?
না।
তাহলে উসমান উসমান করছিলে?
ওরে বাবা তোকে তো বললাম সব বলবো। আমার কিচ্ছু হয়নি।
আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
তোকে বিশ্বাস করতে হবে না।
নিরূপায় হয়ে সুরো বাইরে বেরিয়ে গেল।
কি কুক্ষণে দরজাটা বন্ধ না করে ফোন করছিলাম।
খাটে এসে বালিশটা টেনে নিয়ে দরজার দিকে মুখ করে শুলাম।
সিগারেটে টান দিয়ে একটা একটা করে ধোঁয়ার রিং ছারছি। কিছুটা উড়ে রিংগুলো কেমন ভেঙে দুমড়ে যাচ্ছে। তারপর মিলিয়ে যাচ্ছে। শরীরে কেমন যেন একটা ক্লান্তির ভাব। বার বার হাই উঠছে। উঠে গিয়ে জানলা দিয়ে সিগারেটটা ফেলে দিলাম। টেবিল থেকে বোতলটা নিয়ে একটু জল খেলাম। ফোনটা স্যুইচ অফ করে দিলম। না হলে সদিনের মত আবার গণ্ডগোল হতে পারে।
আবার এসে শুলাম।
মিকি, মাম্পি ছুটতে ছুটতে এসে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
বেশ কিছুক্ষণ ওদের নিয়ে থাকলাম। কিছু ভালো লাগছে না। আরও পড়ে মিলিরা এলো চা নিয়ে।
মিকি, মাম্পি দুজনে ভাগবসালো। প্লেটে রাখা বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে খেয়ে দে দৌড়।
ওরা চেয়ে চেয়ে কিছুক্ষণ আমাকে দেখলো।
কাল কখন যাবে? মিলি বললো।
কনিষ্ক বললো, যতোটা সকালে সম্ভব বেরবে।
সঙ্গে কে যাবে?
নেপলাকে নিয়ে নেব।
বলেছো?
বলবো।
নেপলাকে ওরা কোনও কাজ দেবে না?
ওরা জানে এই ক-দিন নেপলা আমার সঙ্গে থাকবে।
কথাগুলো বড্ড বেশি রস কষ হীন হয়ে যাচ্ছে মিলি সেটা বুঝতে পেড়েছে। চায়ে চুমুক দিল।
ইসি, সুরো আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে। সুরো কথা পেটে রাখতে পারেনি। নিশ্চই উগরে দিয়েছে। হয়তো রাতে কনিষ্কর কাছ থেকে কনফার্মেশন নেবে।
সুরো, রতন চলে গেছে?
বললো, তোমার সঙ্গে কি কাজ আছে।
ইসি, পিকু কি রাতে আসবে?
আসার কথা। দুপুরে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলো, মশাই আফিসে আসবে কিনা।
ও।
মিলি, বড়োমা ফোন করেছিল?
বড়োমা করে নি। মিত্রাদি করেছিল।
আমার ফোনে মেয়ের মিশ কল দেখলাম। ফোন করলাম, ধরলো না।
রিং বেজেছিল?
না। তারপর মনে পরে গেল আরে প্লেনের ভেতরে থাকলে মোবাইল ধরা যাবে না।
ওরা কাল দশটার দিকে দিল্লিতে নামবে।
রাতে না দিনে?
দিনে।
তারপর কটার ফ্লাইট?
কাল মনে হয় আসতে পারবে না।
কেন?
মিঃ রাঘবন ওদের নিয়ে নিজের বাড়ি যাবে। পর্শু সকালের ফ্লাইটে আসবে।
রতন গেটের কাছে এসে দাঁড়াল।
আয়।
এই অবেলায় শুয়ে আছো?
কি করবো, তোরা সব ঘিরে ধরে রাখলি।
কোথায় যেতে চাও বলো, নিয়ে যাচ্ছি।
হাসলাম।
টেবিলের ওপর একটা হলুদ রংয়ের ফাইল আছে নিয়ে আয়।
রতন নিয়ে এলো।
চা খেয়েছিস?
দু-বার।
ফাইলের ভেতর যা আছে এককপি করে জেরক্স করে নিয়ে আয়।
এখুনি।
হ্যাঁ। নিজে যাবি। কাউকে সঙ্গে নিবি না।
বুঝেছি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
মেনু কি ঠিক করলি?
ইসিদি, মিলিদি কনফারেন্সে ঠিক করলো।
কনফারেন্স মানে!
অমনি বলতে হবে। তাই না? কই অনিদার কথা যখন জানতে চাই তখন কিছু বলো?
মিলি ঝাঁজিয়ে উঠলো। রতন হাসছে।
যা জেরক্স করে নিয়ে আয় ঘণ্টা খানেক তোর সঙ্গে বসবো।
মিলি, সুরোকে আগের থেকে বেশ মিষ্টি দেখতে লাগছে তাই না?
একবারে কথা ঘোরাবার চেষ্টা করবে না। সকাল থেকে অনেক ঝামেলা করেছো। সব শুনেছি।
আরে বাবা এতো একবারে গনগনে আগুন।
তখন তুমি সুরোকে কি বলেছো? মিলি তাকালো
ও তো সামনে বসে আছে জিজ্ঞাসা করো।
তোমায় জিজ্ঞাসা করেছি।
বলেছি তুই যা শুনলি পরে তোকে সব বলবো।
তোমার এতো টেনশনটা কিসের শুনি?
তোমাদের অনিদা টেনশন ছাড়া কখনও বেঁচে থাকতে পারে।
একবারে মন ভোলানর চেষ্টা করবে না।
তোমরা কি মিকি, মাম্পি—মন ভোলাবার চেষ্টা করবো।
তাহলে বলো।
এখনও বলার মতো সময় আসে নি। আসলে নিশ্চই জানতে পারবে।
ইসলামভাইকে তুমি কি বলেছো?
কিছু না!
তাহলে কথাবলতে গেলেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে কেন!
বুড়ো বয়সে একটা কচি মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছে।
দেখছিস কি ভাবে কথা বলছে। ইসি বললো।
তাহলে কি বলবো।
সবাই চুপ করে গেলো।
সুরো মাথাটা একটু টিপে দে।
সুরো সোফা ছেড়ে উঠে এলো। খাটে বসতে আমি ওর কোলে মাথা রাখলাম।
তোমাকে মিত্রাদি কি করে যে ভালোবাসলো ভাবি।
মিলির কথায় আমি হাসলাম।
ইসি গায়ে চাদরটা দিয়ে দে শীত শীত করছে।
কিরে আবার শরীর গণ্ডগোল করছে নাকি!
তোকে দিতে হবে না, থাক।
সব সময় রেগে যাস কেন।
তুই আমার বিয়ে করা বউ, তাই।
ইসি গায়ে চাদরটা দিয়ে দিলো। আমি সুরোকে জড়িয়ে ধরলাম।
বুঝলি সুরো মিকি যদি এই সময় দেখে আমার সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে।
সুরোর মুখের দিকে তাকালাম। ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
অনেকদিন পর মাথা টিপে দিচ্ছিস। যথাযথ পরিশ্রমিক পাবি।
তুমি ভালো থাক। এটাই আমার পারিশ্রমিক।
আমি ভালো থাকতে চাইলেও আমাকে ভালো থাকতে দেবে না। বুঝলি।
ছেড়ে দাও না। যে যা করছে করুক।
সুরোর মুখের দিকে তাকালাম, এখন মুখটা অনেকটা পরিষ্কার, মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো নয়।
দেখ সুরো তুই তোর বাগানে একটা চারা গাছ পুঁতলি। তিলে তিলে তাকে জল, মাটি, সার দিয়ে বড়ো করলি। সে যখন ফলবতী হলো। তখন একদল এসে গাছটা কাটতে চাইল তুই দিবি?
তা দেব কেন!
আমার অবস্থা তাই।
সুরো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আমি গাছটাকে বাঁচাতে চাই। অনেক কষ্টে তাকে বড়ো করেছি। আর একদল গাছটা কাটতে চাইছে। বল আমার অপরাধটা কোথায়?
না তোমার কোনও অপরাধ নেই।
সংঘাতটা এখানে। শুধু অভিমান করলে চলে। এদের থেকেও তুই আমাকে বেশি দেখেছিস। রাতের পর রাত দুই ভাইবোনে একখাটে শুয়েছি। তুই এরকম করলে মন ভালো থাকে।
আর করবো না।
শোন মিকি, মাম্পির ব্যাপারে তোরা একবারে চিন্তা করবি না। ওদের গায়ে কেউ যদি এসে ফুঁ দেয় তার মুখটা মুহূর্তের মধ্যে আগুনে পুড়ে যাবে। হাত দেওয়া দূর কি বাত।
মিলি, ইসির চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেল।
এরকম কেউ আছে নাকি! মিলি বললো।
এখনও জম্মায় নি। জম্মালে খোঁজ পেয়ে যেতাম।
তুমি এরকম ছিলে না!
পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে মিলি। তুমি নিজেকে দিয়ে বিচার করো।
মিলি মুখ নামিয়ে নিল।
এই যে ইসলামভাই ঘন ঘন কাঁদছে। আজ থেকে পনের দিন আগে কাঁদতো? কাঁদতো না। পরিবেশ বললো তোকে তিনচার সপ্তাহ কাঁদতে হবে। তারপর তুই হাসবি। একবারে অন্য মানুষ হয়ে যাবি।
সুরো বললো, ছেড়ে দাও না। যে যা করছে করুক।
তোর বাবা পার্টির হর্তা কর্তা বিধাতা, এটা মানিস?
সুরো মাথা দোলাল।
আমি পিতার মতো তাকে সম্মান করি। বৌদিকে নিজের মায়ের মতো ভালোবাসি। ওখানে গিয়ে আফতাবভাইয়ের সাথে মিটিং করলো। ফল কি? আফতাবভাই কি বললো? অনি যদি ইন্টারেস্ট নেয় তবে সে কটি কটি ডলার ইনভেস্ট করবে। কেন?
অনিকে সে কাছ থেকে দেখেছে। অনিকে সে জানে বোঝে। কে অনিমেষ, কোথায় থাকে, কোন পার্টির হর্তা-কর্তা তার জনার দরকার নেই। এবার আফতাবভাই যে এখানে ইনভেস্ট করবে, কেন করবে? সে জানে অনি তাকে এই টাকাটা ফিরিয়ে দেবে। অনি হজম করবে না। একটা প্রজেক্ট তৈরি করতে গেলে কত ঝামেলা এটা বুঝিস।
কেউ কোনও কথা বলে না। আমার মুখের দিকে জুল জুল করে চেয়ে থাকে।
মিলিরা একাটা কাগজের একটা ডিপার্টমেন্ট চালাচ্ছে তাতেই ওদের মাথা খারপ হয়ে যাচ্ছে।
আর একটা প্রজেক্ট।
মানে সেখানকার জমি, আশে পাশের মানুষ। সেখানকার পার্টির মধ্যে খেয়ো খেয়ি। এ ওকে পেছন থেকে ছুঁড়ি মারবে। যতটা কামিয়ে নেওয়া যায়। তারপর সিমেন্ট বালি কনস্ট্রাকশন নিয়ে মাফিয়া গিরি। তুই আমাকে বল সব ছেড়ে দিয়ে আমি চুপ চাপ বসে থাকব? তোর মা-বাবা, বিধানদা, অনুপদা, রূপায়ণদা, প্রবীরদা আমাকে বসে থাকতে দেবে? আমাকে ছেড়ে দেবে?
সুরোর মোলায়েম হাতের আঙুল আমার মাথায় খেলা করে বেরাচ্ছে।
এই যে ইসলামভাইকে তোরা এখন দেখছিস। একসময় এর দাপট দেখলে তোদের মাথা খারাপ হয়ে যেত। ইসলামভাই জেনে হোক না জেনে হোক মিত্রার অনেক ক্ষতি করে দিয়েছিল। তাই সামলাতেই আমার কুড়ি বছর কেটে গেল। ছেলে মেয়ে যদি সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, বাবা হয়ে তুমি আমাদের জন্য কি করেছো? কি উত্তর দেব?
আমার কাছে চুপ করে থাকা ছাড়া কোনও উত্তর আছে?
না হলে বলতে হয়, তোর মায়ের যত গণ্ডগোল তা সামলাতে আমার এতদিন সময় লাগলো। এখনও কিছুটা বাকি আছে। সেগুলো খুব শিগগিরি সামলে দেব। শুনবে ওরা আমার কথা?
কিন্তু ওরা আমার কথা শুনবে। আমাকে বোঝার চেষ্টা করবে।
কেন?
ছোটোমা, বড়োমা। সব সময় ওদের বুকে করে আগলে রেখেছে। ওদের নিজেদের দাদু, দিদা নেই। সেই শূন্যস্থান এরা কোনওদিন বুঝতে দেয়নি। তারা বুঝিয়েছে, তার বাবা কিরকম মানুষ।
ইসির দিকে তাকালাম। কিছু মনে করবি না একটা কথা বলছি। ধর আজ ইসি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি যদি ওর পাশে না থাকতাম ও এই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো? কখনই পারতো না।
এর জন্য ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি হতে হয়েছে।
কিন্তু তৈরি হলেই সব হয় না। তাকে সঠিক ভাবে ইমপ্লিমেন্ট করার দরকার।
কি করে করবো! আমার ভাগ্য অত্যন্ত ভালো। তোর বৌদি আমাকে ভুলতে পারেনি।
ওর মতো একজন আর্থিক সম্পন্ন মানুষকে আমার পাশে পেলাম।
তোর বৌদি দরাজ হাতে এই কাজটুকু করেছে।
সে আমাকে ভালোবেসে তার ক্ষমতার কিছুটা আমাকে দিয়েছে। আর আমি সেই ক্ষমতার বলে বলিয়ান হয়ে তার হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করে দিলাম। আমার জীবনে টেনশন এসেছে অনেক পরে। কিন্তু তোর বৌদির জীবনে টেনশন এসেছে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসার পরই। তখন অনেক কিছুই তার নামে শুনেছি। সে সব ইতিহাস।
তোর বৌদি জীবনে কোনও দিন বুবুনের কাজে বাধা দেয় নি। এটুকু জেনেছে বুবুন তার নিজের জন্য কিছু করবে না। সব তার জন্য। তাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য।
এটুকু বিশ্বাসই বা কজন মানুষ করতে পারে। মিত্রা শুধু করেনি সবার সামনে জোর গলায় বলে দিয়েছে ওইই আমার জীবনে শেষ কথা। অন্ধ বিশ্বাস করেছে।
তাহলে তার জন্য জীবন দিয়ে করবো না তো কার জন্য করবো?
তাই আমি আমার মতো করে সব করে গেছি, কারুর কোনও বাধা শুনিনি। জীবনে প্রচুর ঝুঁকি নিয়েছি। ফুল ফর্মের ইসলামভাইকে বুঝিয়ে দিয়েছি। আমিই শেষ কথা। তোমাকে আমার বশ্যতা মানতে হবে। না হলে প্রয়োজনে তোমাকেও পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে।
চলবে —————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/IMmAvX1
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment