❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩৭ নং কিস্তি
—————————
একবারে বিটকেল মার্কা হাসি হাসবে না। মিলি মুখ ঝামটে উঠলো।
হাল্কা হলে আবার ভারি করো। অদিতি সরবৎ নিয়ে এসেছে।
জল তো খাও না। ভারি হাল্কার কি বুঝবে। মিলি চেঁচিয়ে উঠলো।
সবাই হাসছে।
তোরা কেউ বুঝেছিস। দেখ যে বললো….। নীরুর কথা শেষ হল না।
তোমাকে আর খোঁচাতে হবে না। সুরো বলে উঠলো।
কতো সূক্ষ্ম ব্যাপার বলতো। বটা বললো।
তোমার বর খুব পরিশ্রম করেছে একটু বেশি করে জল দাও। অদিতির দিকে তাকালাম।
কেন বেশতো মিলির সঙ্গে হচ্ছিল।
শতো গোপিনী….।
নীরুদা চুলের মুটি ধরে নেড়ে দেব। মিলি আবার চেঁচাল।
রতন, আবিদ একটা বস্তা বয়ে নিয়ে এসে ঘরে রেখে বললো—কি ভারি রে বাবা, মিলিদি কি আছে বলো।
খুলে দেখো।
রতনদা আগে দুধের জারগুলো নামাও নাহলে নষ্ট হয়ে যাবে। সুরো বললো।
ওই জার দুটো দুধের!
তাহলে কি ভেবেছ—
আমি অন্য কিছু ভাবছিলাম।
মাসি এখন শুধু দুধের চা খাব। জল দেবে না। আবিদ চেঁচাল।
মাসি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো, সত্যি দিয়েছে!
হ্যাঁ-গো, তোমায় তখন বললাম না। মিলি বললো।
আমি ভাবলাম তুই এমনি এমনি বলছিস।
কুড়ি লিটার।
দাঁরা কালকে গুছিয়ে পিঠে করবো।
মাসি পুলি হলে কুড়িটা আমার জন্য। নীরু চেঁচাল।
নীপা যেগুলো পাঠিয়েছে। সুরো বললো।
সত্যিতো মনে ছিল না। আমি ওগুলো নামাই। নীরু উঠে দাঁড়াল।
সকাল থেকে তোর নামে অনেক রিপোর্ট পেয়েছি, কনিষ্ক সার্ভ করেছে। বটা বললো।
নীরুর সঙ্গে বটার লেগে গেল।
আমি অর্কর দিকে তাকালাম।
কি অর্কবাবু অফিসে নিশ্চই পোস্টার লাগিয়ে দিয়েছ।
বিশ্বাস করো, কেউ জানে না। এই বাড়ির লোক বাদ দিলে আসার সময় শুধু সন্দীপদাকে হাল্কা করে আওয়াজ দিয়েছি। তাতেই বলে এখুনি চলে যা, এলেই আমাকে খবর দিবি।
খবর দিয়েছিস?
সে বলতে। না হলে কালকে সিএল মেরে দেবে।
এখন কি এরকম অবস্থা?
বস বলে কথা। ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বরুণদারা এসে হাজির।
ইসি, জ্যেঠিমনির মুখ শুকনো শুকনো। আমাকে দেখে চোখ ছল ছলে।
এ-তো মহা মুস্কিল। তোমাদের নিয়ে আর পারা যাবে না।
সোফা থেকে উঠে এগিয়ে গেলাম।
তুই তো সকলকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিস। ইসি বললো।
দেখছো বরুণদা, মিছি মিছি এরা….।
কেন তুমি এসব করতে যাও। সবার জন্য অনেক করেছো।
বরুণদার গলায় অভিমানের সুর ঝড়ে পরছে।
চুপ করেগেলাম।
জ্যেঠিমনিকে ধরে এনে সোফায় বসালাম।
ইসি দেখলাম রান্নাঘরের দিকে গেল। মাসির সঙ্গে কি কথা বললো। তারপর বড়োমার ঘরে গিয়ে মিলি, সুরোদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলো। পিকু, বরুণদা চেয়ারে বসেছে।
ঘুম থেকে উঠে তোমার খবর পেলাম। তখন কনিষ্করা পৌঁছে গেছে। বরুণদা বললো।
আমরা সারে তিনটে নাগাদ বেরিয়েছি। তখন মেয়ে, মিকি ঘুমচ্ছে। কনিষ্ক বললো।
মাসি তাই বলছিল। তারপরই তোমাকে ফোন করলাম।
তখন আমরা ওর ঘরে বসে আছি।
গিয়ে কি দেখলে?
অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কোনও সেন্স নেই।
খোকন ছেলেটা খুব ভালো বলতে হয়।
আমাদের জুনিয়র ব্যাচ। নার্সিংহোমেও কয়েকদিন ছিল। তুমি দেখে থাকবে। দেবা তুলে নিয়ে গেছে। ভাগ্যিস ওর কাল বাজারে চেম্বার ছিল।
ও এবার থেকে যেখানেই যাবে তোমরা একজন করে ওর পেছন পেছন যেও।
একটু মেনে চললে কোনও অসুবিধে নেই। ও মেনে চলে নাকি?
সত্যি টাইমলি ওষুধটা খেতেও তোমার এলার্জি। বরুণদা আমার মুখের দিকে তাকাল।
বুঝছি এসব আবেগের কথাবার্তা চলছে। এখানে মাথা ঢোকালেই সমূহ বিপদ। একটাই মাত্র পথ বোবার শত্রু নেই।
মাসি চা দিল সকলকে।
অদিতি মাসিকে সাহায্য করছে।
মাঝে ইসি এসে মুখ ঝামটানি দিয়ে গেল। সুরো, মিলি তালে তাল ঠুকলো। তর তর করে সময়টা কোথা দিয়ে চলে গেল বুঝতে পারলাম না। ইসি, জ্যেঠিমনি, পিকু থেকে গেল। বরুণদা ফিরে গেল।
অদিতি, টিনারাও গেল। অংশু এলো একটু বেশি রাতে। যে যার মতো ঘরে ঢুকলো। আমার ঘরে ভজুরাম। আজ কিছুতেই ড্রইংরুমে শোবে না। নিজে নিজেই সব রেডি করে দিল।
খাওয়া দাওয়ার শেষে ওষুধ গিলে ঘরে এলাম।
ভজু একবাটি সর্ষের তেল নিয়ে এসেছে।
ওটা কি হবে রে?
মা বলেছে পায়ে মালিশ করে দিতে।
তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে।
মাকে বলো।
বুঝলাম এরা আমাকে বাচ্চা ছেলে পেয়ে গেছে। এখন যা বলবে মানতে হবে, না হলে একটা হই চই বাধিয়ে দেবে। বাধ্য হয়ে লেপের তলায় ঢুকে পরলাম। ভজু তার কাজে মনোনিবেশ করলো। তেল মালিশটা খুব খারাপ লাগছিল না। ভজু বক বক করে চলেছে। কাল রাতে চিকনার ফোন আসার পর কি কি হয়েছে। একটুও এডিট না করে বলে চলেছে। আমি নির্বাক শ্রোতা। চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে। বেশ লাগছিল। কখন ঘুমিয়ে পরলাম জানি না।
সকালে যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখলাম সোফায় ইসলামভাই, ইকলবালভাই বসে আছে।
একবার মুখ ঘুরিয়ে চারদিকটা দেখে নিলাম।
আমার পায়ের কাছে মাসি বসে। মাথার শিয়রে জ্যেঠিমনি। চারজনে কথা বলছিল।
আমি উঠে বসলাম।
ইসলামভাই, ইকবালভাইকে বেশ চকচকে লাগছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
কখন এলে?
এই তো আধাঘণ্টা হলো।
মর্নিং ফ্লাইট ছিল?
হ্যাঁ।
আমি মুড়িশুড়ি দিয়ে খাট থেকে নামলাম। আমার জবুথবু অবস্থা দেখে ওরা হেসে গড়িয়ে পরে।
তোর কি খুব শীত করছে?
হ্যাঁ, কয়েকদিন শীতটা যেন একটু বেশি পরেছে।
শীত পরে নি। তোর শরীরটা এখনও ঠিক হয় নি।
টেবিলের ওপর থেকে ব্রাস আর মাজন নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম। গিজারটা চালিয়ে গরম জলেই সব কাজ সারলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম ঘরে কেউ নেই। বাইরের দরজাটা ভেজান। বিছানার চাদর বদল করা হয়েছে। একপাশে আমার পাট ভাঙা পাজামা, পাঞ্জাবী রাখা। পরনেরগুলো ছেড়ে রেখে ওগুলো পরে নিলাম। ঘরের বাইরে এলাম, বেশ বেলা হয়েছে। ঝকঝকে রোদ। ধারে কাছে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। পায়ে পায়ে এই ঘরে এলাম। ইসলামভাই, ইকবালভাই দু-জনে সোফায় মুখো মুখি বসে।
আয়।
কাউকে দেখতে পাচ্ছি না সবাই গেল কোথায়?
একটু বেরিয়েছে, আসছে।
তারপর, খবর কি বলো?
আগে তোর খবর বল। শরীরটা হঠাৎ হঠাৎ বিগড়ে যাচ্ছে কেন?
চেষ্টা করি ঠিক রাখার, যদি সমস্যা করে কি করবো।
মাসি ওষুধ আর জলের গ্লাস নিয়ে এলো।
কিগো আজ এতো সকালে!
কনিষ্ক দিয়েছে। বলেছে খালিপেটে সাতদিন খেতে। খাওয়ার দশমিনিট পর সব কিছু খাবি।
এরা ওষুধ খাইয়ে খাইয়ে আমাকে মেরে দেবে।
মাসি মুখ টিপে হাসলো।
আমি মাসির হাত থেকে ওষুধটা নিয়ে খেলাম।
এখন একটু গরম দুধ দিই।
কেন! চা খেতে বারণ করেছে?
তুই ওরকম করিস কেন? ইসলামভাই বললো।
কি করলাম?
যাও দুধ নিয়ে এসো। ইসলামভাই মাসির দিকে তাকাল।
নেপলা তোমাদের সঙ্গে আসবে শুনলাম, কোথায়?
সবাই একসঙ্গে বেরিয়েছে। এসে পরবে।
পুঁচকে দুটো?
স্কুলে গেছে। মাসি বললো।
জ্যেঠিমনি?
বাথরুমে।
মাসি আবার রান্নাঘরের দিকে গেল।
ইকবালভাই কেমন ঘুরলে বলো।
দারুণ।
তোমাকে কিন্তু বেশ চকচকে লাগছে।
ইকবালভাই হাসছে।
তোর সাম্রাজ্য দেখে এলাম।
আমার!
তুই যে আঠারো বছর কতো পরিশ্রম করেছিস নিজের চেখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না। ইসলামভাই বললো।
তোর কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে আমরা জীবনে কিছুই করতে পারি নি। ইকবালভাই বললো।
না না একথা বলছো কেন। আমি সুযোগ পেয়েছি তাই করেছি। তাও সব ব্যাঙ্ক লোন, জানিনা ওরা শোধ করছে কিনা।
এসব দিক থেকে নেপলা একবারে পাক্কা। ব্যাঙ্কের লোক ওর কাছে এসে বসে থাকে টাকা লাগবে কিনা।
আর দুটো সপিং কমপ্লেক্স?
ওগুলোও তো দেখলাম নেপলাই সামলায়। সাগির, অবতার শুধু যাওয়া আসা করে।
একথা বলো না, ওরাও খেটেছে। সবাই অন্তত ব্যবসাটা বোঝে।
তোর ফার্মের মালের বহুত ডিমান্ড। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় লেগে যায়। ইসলামভাই বললো।
ভালো জিনিষ দিতে পারলে, তোমার ক্রেতার অভাব থাকবে না।
এটা ঠিক।
এবার তোমরা দু-মাস অন্তর অন্তর যে কোনও একজন গিয়ে ওদের ফিডব্যাক দেবে।
তোর ধান্দাটা বেশ ভাল।
কেন খারপ বললাম।
তুই কখনও খারাপ বলতে পারিস।
ইকবালভাই হাসছে।
আফতাবভাইয়ের সঙ্গে আলাপ হলো?
ওনার বাড়িতে গেলাম। ইসলামভাই বললো।
কে নিয়ে গেল?
নেপলা।
কিরকম দেখলে?
অবাক হচ্ছিলাম।
কেন?
সেই নেপলা আর এই নেপলা। অফতাবভাই নেপলাকে ভীষণ স্নেহ করে।
দামিনীমাসি দুধের সঙ্গে কিছু একটা মিশিয়ে এনেছে। টেবিলে রাখলো।
আজ থেকে কুড়িবছর আগের নেপলা আর এখনকার নেপলার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য।
তুমি থাকলে তোমারও পরিবর্তন হতো।
তা ঠিক। আমি অবাক হয়েছি সাগির আর অবতারকে দেখে। ব্যাটারা এখানে ছ্যাঁচড়ামি করতো। আর ওখানে এক একজন বিজনেস ম্যাগনেট।
আমি হাসছি।
তবে কি, এখনও সেরকম আছে। আমি সপিং মলে যেতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জোড় করে নিজের চেয়ারে বসিয়েছে। বার বার বলেছে, যা দেখছো সব অনিদার জন্য, আর তোমার জন্য অনিদাকে পেয়েছি। অনেকদিন পর খুব ভালো লাগছিল।
আরও অবাক হয়েছি লক্ষ্মীকে দেখে। লক্ষ্মী খুব ছোটোসময় ওপাড়ায় এসেছিল। তখন লক্ষ্মীকে দেখেছি। লক্ষ্মীর ওই জীবনটাও দেখেছি। এখন লক্ষ্মীর জীবনটা দেখে এলাম। মাসিকে তাই বলছিলাম, স্বপ্নেও কখনও কল্পনা করতে পারি নি ওরা এইভাবে লাইফ লিড করবে।
মাসি সোফায় আমার পাশে বসেছে।
ঘুরে একটা উপকার হয়েছে। কাজ করার ইচ্ছেটা অনেক বেড়ে গেছে। ইকবালভাই বললো।
কেন?
কুয়োর ব্যাঙ ছিলাম, সমুদ্র দেখলাম।
হাসলাম।
সাগির, অবতার তোমার এ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছে।
ইকবালভাই হাসলো। এবার অনেক বেশি পাঠিয়েছে।
মাঝে মাঝে তোকে খুব মিশ করছিলাম।
কেন?
তুই যেখানে গিয়ে প্রথমে ওদের নিয়ে থাকতিস নেপলা সেই জায়গায় নিয়ে গেল। জায়গাটা দেখলাম। যখন তোদের সেই সময়কার বেঁচে থাকার গল্প বলছিল, তোর কথাটা বার বার মনে পরছিলো। তোর সেই পাঁচ ডলারের গল্প শুনলাম। ছেলেটার সঙ্গে আলাপ করালো। বাংলাদেশের ছেলে। যখন জানলো আমিও এক সময় বাংলাদেশে থাকতাম, বলে তুমি চলো ইসলামভাই, তোমার স্থাবর আস্থাবর যা আছে সব তোমাকে ফিরিয়ে দেব।
এবার একবার ছোটোমাদের সঙ্গে নিয়ে নিজের জন্মভিটেটা দেখে এসো।
বিশ্বাস কর, কেন জানিনা খুব যেতে ইচ্ছে করছে।
একবার সময় করে চলে যাও।
হ্যাঁ একবার যাবো। তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?
কি!
সত্যি কথা বলবি?
আমি মিথ্যে কথা বলি না। এটা তুমি জানো।
ওখানে যখন ছিলাম তখন ভাষা ভাষা একটা খবর কানে এলো। তারপর যখনই একা একা থেকেছি বার বার অতীতে ফিরে যাচ্ছিলাম। আমার সুখের জীবনটা খুব কম, এটা তুই দামিনীমাসি ছাড়া আর কেউ জানে না।
আমি ইসলামভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। দামিনীমাসি, ইকবালভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
বুঁচকি, বোচন, সুন্দর ছাড়াও আর একজনকে তুই তোর নিজের সন্তানের মতো বড়ো করেছিস।
আমার চোখ স্থির, ইসলামভাইয়ের মুখ ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে।
জানলো কি করে!
বুঁচকি, বোচনদের কিছু হলে, তুই যেমন ভেতরে ভেতরে ছটফট করিস, তার জন্যও তুই সেই ভাবে ছট ফট করিস। কিন্তু কেউ জানে না সে কে—
দামিনীমাসির কপালের ভ্রু-দুটো কেমন ছুঁচলো হয়ে ছোটো হয়ে যাচ্ছে। ইকবালভাইয়ের মুখ কেমন থম থমে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন কিছু পড়ার চেষ্টা করছে।
তোর সবচেয়ে কাছের মানুষ নেপলা পর্যন্ত জানে না সে কে—
তুমি যার কাছেই শুনে থাকো ঠিক খবর পেয়েছ। তবে সময় না হলে জানতে পারবে না। আমি সবার সামনেই তাকে নিয়ে আসবো। মাস দশেক তার সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ নেই।
তাকে তুই খুব ভালো জায়াগায় রেখে পড়াশুনা করিয়েছিস।
ঠিক কথা।
যে ফাদারের স্কুলে বুঁচকিরা পড়েছে সেই ফাদারের অন্য আর একটা স্কুলেই তাকে পড়াশুনা করিয়েছিস।
হ্যাঁ।
তুই তো মেরিনাকে তোর দিদির মতো ভালোবাসতিস। বলতিস মেরিনাবহিন।
আজ হঠাৎ তুমি এসব কথা বলছো কেন!
কেন বলছি বলতে পারবো না।
আমি যখন ফেরার তখন মেরিনাকে নিয়ে গিয়ে তার বাড়িতে রেখে এসেছিলি। কিন্তু তার বাড়ির ঠিকানা আজও পর্যন্ত তুই কাউকে জানাস নি। মাসি তোর ওপর সেই সময় অনেক মেন্টাল টর্চার করেছিল। আমিও তোকে ভুল বুঝেছিলাম। তবু তুই আমাদের ছেড়ে চলে যাস নি।
তখন আমার যাওয়ার আর কোনও জায়গা ছিল না। তাই যাই নি। যাওয়ার কোনও জায়গা থাকলে হয়তো চলে যেতাম।
আমি যখন তোকে মারতে গেলাম, তার পর তুই মেরিনাকে ফিরিয়ে আনলি।
ওসব ফালতু কথা রাখো। ওখানে কে কেমন আছে বলো।
এড়িয়ে যাস না। তুই শুধু একা সব জায়গায় জিতে যাবি তা হয় কি করে।
ওই একটা জায়গায় ঈশ্বর আমাকে ধনী ব্যক্তি করে রেখেছে। সেখান থেকে তোমরা কেউ আমাকে দরিদ্র বানাতে পারবে না।
তোকে বলতে হবে—
খবরটা আর কারা জেনেছে?
সবাই জেনেছে।
কজন কেঁদেছে, কজন হেসেছে।
ইসলামভাই আমার দিকে তাকিয়ে। আমি ব্যাপারটার কোনও গুরুত্বই দিলাম না। দুধটা খাওয়া হয়ে যেতে উঠে দাঁড়ালাম।
ইসলামভাই উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাতটা চেপে ধরলো।
প্লিজ অনি। আমি তোর কাছে ভিক্ষা চাইছি।
ইসলাম!
ইকবালভাই, দামিনীমাসি দুজনেই অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো।
তুমি জানো না মাসি। গতো পনেরো দিন আমি রাতে ঠিক মতো ঘুমতে পারিনি। কাউকে আমার মনের কথা ঠিক মতো বলে বোঝাতে পারিনি। মামনি, তনু, দিদিকে বলেছি। ওরা শুধু বললো, এরকম একটা খবর আমরা শুনেছি। কিন্তু সাহস করে কোনওদিন ওকে জিজ্ঞাসা করিনি।
আমার যা সোর্স ছিল কাজে লাগিয়েছি। কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। শুধু অনির নাম বলে গেছে ও সব জানে। এই কটা দিন শুধু সময়টাকে জাপ্টে ধরে দিনরাত ভেবেছি। মেলাবার চেষ্টা করেছি। কিছুতেই মেলাতে পারছি না।
জীবন থেকে একটা অধ্যায় আমার মুছে গেছিল, কে যেন আমার মনের দরজাটা দমকা হাওয়ায় খুলে দিল। কেনো হলো, কি কারনে হলো, বলতে পারবো না। কথাটা শোনার পর থেকে ইকবালকে বার বার বলেছি, দেখো না গুণেটুণে কিছু পাও কিনা।
ও কোনও সঠিক উত্তর দিতে পারে নি। বার বার বলেছে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখো দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ইসলামভাই ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম, একবার ইসলামভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। ওর্ণাদিয়ে চোখ মুছছে। সোজা নিজের ঘরে চলে এলাম।
ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে জনলার সামনে এসে দাঁড়ালাম। সেই এক দৃশ্য। ভজু বাগান ঝাঁট দিয়ে শুকনো পাতা একজায়গায় জড়ো করছে। ঠাণ্ডার চোটে আম, পেয়ারা গাছের পাতাগুলো কেমন দুমড়ে মুচরে গেছে। এবার ওরা ঝড়ে পরবে। আবার নতুন পাতা গজাবে। সারাটা শরীরে বসন্তের ছোঁয়া লাগবে। বুকে ধরবে আম্রমুকুল। প্রকৃতি সত্যি তার আপন খেয়ালে চলে। এখানে কারুর কারিকুরি চলবে না।
ডালিয়াগুলো বেশ সুন্দর ফুটেছে। গাঁদাগুলোর সাইজ কি বড়ো বড়ো। রং-এর গভীরতা কত বেশি। বেশ ভালো লাগছে। ভজুরাম বাগানটাকে ভীষণ ভালোবাসে। কেউ নোংরা করলে ভীষণ চেঁচামিচি করে। কিন্তু মাম্পি, মিকি করলে কিছু বলে না।
দু-একটা ফুল, গাছ থেকে ছিঁড়ে ওদের দেয়।
দুটোই ভজুর খুব নেওটা।
সেদিন যেন কি নামে ডাকছিল, বজু।
নিজের মনেই নিজে হেসে ফেললাম।
আচ্ছা, ইসলামভাইকে খবরটা দিল কে?
এই খবর ইসলামভাইয়ের কানে ওঠার কথা নয়।
আমি ঘুনাক্ষরেও কাউকে এই কথা বলিনি।
ফাদার?
না ফাদার আমাকে প্রমিস করেছিল কাউকে কোনও দিন এই কথা বলবে না। এমনকী সব ডকুমেন্টস ফাদারের কাছেই আছে। তাছাড়া ফাদারের সঙ্গে ইসলামভাইয়ের আলাপ নেই।
তাহলে!
কিছুতেই মনে করতে পারছি না।
এরকমটা হওয়ার কথা কখনই ছিল না।
এখন ওর বয়স কত? মেরেকেটে চব্বিশ কিংবা পঁচিশ।
পঁয়তাল্লিশ দিন আগেও ইসলামভাই মানসিক ভেবে এতটা চঞ্চল ছিল না। ফিরে এসেই একবারে প্রথম মুহূর্তে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পরলো!
গত সাত মাস নাসরিন আমার টাকা নেয় নি। ফেরত পাঠিয়েছে।
উসমান বলেছে। নাসরিন একটা ভালো চাকরি পেয়েছে। তাই নেবে না বলেছে।
তারমানে নাসরিন এখন চাকরি করে। ও তো চাকরি করতো। ভালো চাকরি বলতে উসমান কি বোঝাতে চাইল। তখন ওকে বেশি জেরা করিনি। এখন মনে হচ্ছে এটা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমার কাছে নাসরিনের খবর একমাত্র উসমানই পৌঁছে দেয়। উসমানকে এরা কেউ চেনে না। কৃষ্ণনগরের এক অঝঝোড় গ্রামের দেহাতী চাষী। ফাদারের কাছে কাজ করে।
নাসরিন গত সাত মাস ফোনেও আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেনি।
শেষ বার যখন গেছিলাম, তাও বছর দুয়েক হবে। তখন ও কাছাকাছি একটা স্কুলে পার্টটাইম চাকরি করছে। ফাদারই জোগাড় করে দিয়েছে।
সুরোর বিয়ের সময় যখন এসেছিলাম তখন ও এমএতে সবে ভর্তি হয়েছে।
আমার দেখাদেখি মাস কমিউনিকেসন নিয়ে পড়বে বলেছিল। আমি রাজি হয়েছিলাম। তারপর ফাদারই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ওকে শুধু বলে এসেছিলাম তুই কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়বি না। উত্তরবঙ্গ ইউনিভার্সিটিতে পড়।
ও প্রথমে আমার সঙ্গে বেদম ঝগড়া করেছিল। বলেছিল কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়বে। তারপর বলেছিল ঠিক আছে তুমি যখন বলছো উত্তরবঙ্গ ইউনিভার্সিটিতেই পড়বো। কিন্তু আমি কলকাতায় থাকতে চাই।
বার বার বলেছে, শুধু গল্প বলো আমার মা বেঁচে নেই কিন্তু বাবা তো বেঁচে আছে। আমার বাবার পরিচয় দাও। ওকে বুঝিয়ে বলে এসেছিলাম যখন সময় হবে, তোকে নিশ্চই দেব। আমি আছি। তোর চিন্তা কি।
বার বার ঘুরে ফিরে এক কথা। তোমার কিসের সার্থ, আমার জন্য তুমি এতো করছো।
যতো বড়ো হয়েছে। তত ওর চোখা চোখা প্রশ্নের মুখো মুখি হয়েছি। অনেকদিন অভিমান করে আমার সঙ্গে দেখা করেনি। তখন আমি নিজেকে সামলাব না ওকে সামলাব। অবুঝকে বুঝিয়ে উঠতে পারিনি।
বাইরে থাকার সময় কলকাতায় যতবার এসেছি দেখা করেছি। না হলে সপ্তাহে একবার অন্ততঃ ফোনে যোগাযোগ করেছি।
ওকে কিছুতেই আমার ভেতরের অবস্থা বোঝাতে পারিনি। ফিরে আসার সময় ফাদারকে বলে এসেছিলাম তুমি ওকে একটু বোঝাও।
মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলো। ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে।
ফোনটা পকেট থেকে বার করে উসমানকে ধরলাম।
হ্যালো।
উসমান?
বলছি।
আমি অনিদা।
এটা তো তোমার নম্বর নয়!
নতুন নিলাম।
তোমার ওই ফোনটা বন্ধ কেন?
মাঝে মাঝে বন্ধ করে রাখি। নাসরিনকে এমাসের টাকা পাঠিয়েছিস?
যে এ্যাড্রেসে পাঠিয়েছিলাম ফিরে এসেছে।
তার মানে তুই সঠিক এ্যাড্রেস লিখিস নি?
ফাদার যে এ্যাড্রেস বলেছিল তাই লিখেছিলাম।
ফাদারকে বলেছিস?
ফাদার শুধু হাসে, কি বলবো বলো।
তোকে বলেছিলাম গিয়ে একবার খোঁজ নিতে, নিয়েছিলি?
ও এখন ওখানে থাকে না।
এ্যাঁ। কি বলিস!
তোমাকে অনেকবার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। পাইনি। মাঝে একবার তোমাকে ফোন করেছিলাম, এক ভদ্রমহিলা ধরেছিলেন। বললেন তুমি নার্সিংহোমে ভর্তি।
তারপর সব কাগজে দেখলাম। একবার খুঁজে খুঁজে তোমাকে দেখতে গেছিলাম। কপালে জোটে নি। গ্রামের মানুষ কেউ পাত্তা দেয়নি।
সেই সময় শেষবার নাসরিনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ফাদারের কাছে এসেছিল। তোমার খবর নিতে। সব বললাম। ও বললো একটা নতুন চাকরি পেয়েছে। এখন ওর অনেক টাকা। ওর এখন টাকার প্রয়োজন নেই।
আর কি বললো?
তোমার ওপর ওর এক বুক অভিমান নিয়ে কিছুটা কাঁদলো।
কোথায় আছে কিছু বলেছে?
কিছু বলেনি। আমি খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি, ফাদারের এক বন্ধু আছে পার্কস্ট্রীটে, তার কাছে পেয়িংগেস্ট হিসাবে থাকে।
পক্কে আর ঘণ্টা?
ওরা তিনজনেই এক অফিসে কাজ করে।
ওই দুটোকে কি নাসরিন ঢুকিয়েছে?
হ্যাঁ।
ওরা দুজন থাকে কোথায়?
শুনেছি শিয়ালদহর কাছে একটা মেসে থাকে।
খোঁজ নিয়েছিলি?
কেউ কিছু বলতে চায় না। এখন সব বড়ো হয়ে গেছে। বুঝতে শিখেছে।
তোর সঙ্গে ওরাও আর যোগাযোগ করে না?
না।
আমার কাছ থেকে দায়িত্ব নিয়ে তুই এতদিন ওদের সামলালি, তাহলে কি করলি?
তুমি ফিরে আসার পর যোগাযোগ করতে পারলাম কই। তারপর এই সব ঘটনা ঘটে গেল। তবে ফাদারের কাছে ওরা নিয়ম করে আসে। মাসে একদিন করে এসে থাকে।
নাসরিনও?
না।
তাহলে?
শুনলাম নাসরিন বিয়ে করেছে। ফাদার সব জানে। ও ফাদারের অনুমতি না নিয়ে কিছু করে না।
কাকে বিয়ে করেছে কিছু জানিস?
তুমি একবার এসো। সব ফোনে বলা যাবে না।
আমি কাল সকালে কৃষ্ণনগর লোকালে যাব। তুই স্টেশনে থাকবি।
ফোনটা পকেটে রাখলাম। টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে তুলে নিয়ে আবার জানলার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
না শান্তি নেই। যে দিক থেকে চোখ সরাব সেদিকেই গণ্ডগোল। আবার একটা টেনশন। মেয়েটা গেল কোথায়? তবে উসমানের কথা শুনে মনে হচ্ছে ও সব জানে। না হলে ফাদারের কাছ থেকে সব খবর পেয়ে যাবো।
ফাদারকে একটা ফোন করলে কেমন হয়।
না থাক, বিরক্ত করে লাভ নেই।
একটা সিগারেট বার করে ধরালাম।
কাল কৃষ্ণনগর যাব বললাম যদি ফাদার না থাকে?
আবার উসমানকে ফোন করলাম।
বলো।
তুই এখন কোথায়?
গির্জার মেঝে মুছছি।
ফাদার ওখানে না কলকাতায়?
আজ কলকাতা গেছে। রাতে ফিরে আসবে।
ঠিক আছে তোকে রাতে ফোন করবো।
ফোনটা পকেটে রাখলাম।
দেখলাম দরজার সামনে সুরো, মিলি দাঁড়িয়ে মুখটা কেমন থম থমে।
একটু অবাক হলাম। তাহলে কি ওরা আমার কথা শুনতে পেয়েছে?
শোনার কথা নয়। আমি যেভাবে কথা বলেছি খুব বেশি হলে তিনফুট দূরের লোক শুনতে পাবে।
নিজেকে সামলে নিলাম, ওদের কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না।
এসো, ভেতরে এসো।
ওরা ধীর পায়ে ভেতরে এলো।
আমার মুখ থেকে চোখ সরায় না।
মিলি মাসিকে কিছু খেতে দিতে বলবে।
মিলি মুখ নিচু করলো।
সুরো কাছে এগিয়ে এলো। জড়িয়ে ধরলো। বুকে মাথা রেখেছে।
তোমার কি হয়েছে অনিদা?
কই, কিছু হয় নি।
ভাইদা কাঁদছে কেনো। মাসিকে জিজ্ঞাসা করলাম। কেমন গম্ভীর।
কাঁদতে দে। যত কাঁদবে তত হাল্কা হবে।
তুমি কিছু বলোনি তো?
না।
ভাইদাদা আসার পর কালীঘাটে গেছিলাম পূজো দিতে। এরইমধ্যে কি এমন হলো?
তোর অনিদা একটা ভ্যাগাবণ্ড, বুঝলি। তার অনেক সমস্যা। সবাইকে তো সুখী রাখার ক্ষমতা তোর অনিদার নেই। কি করবি। চেষ্টা করি। কখনও পারি কখনও পারি না। তাই কেউ কাঁদে, কেউ হাসে।
মিলি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
তোমার সঙ্গে অন্য কিছু হয়নি।
না রে বাবা না, কেন হতে যাবে! আচ্ছা চল, আমি কথা বলে নিচ্ছি।
তুমি এতো নিচু স্বরে কার সঙ্গে কথা বলছিলে?
মিলির চোখে অবিশ্বাসের ছোঁয়া।
হেসেফেললাম।
সত্যি অনিদা তোমাকে এতদিন দেখছি, তবু চিনে উঠতে পারলাম না।
ঠিক আছে চলো আমি যাচ্ছি, তাহলে হবে।
তবু ওরা আমার মুখের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে।
আমি ওদের নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
শীতের মিষ্টি রোদ বারান্দায় লুটোপুটি খাচ্ছে। বাগানে সবুজ গালিচার মতো ঘাস। জগন গেটের কাছে একটা চেয়ারে বসে খৈনি ডলছে।
এ ঘরে এলাম। ওরা আমার পাশে।
ইসলামভাই মুখ নিচু করে বসে আছে।
দু-পাশে নেপলা, রতন। আবিদ একটা চেয়ারে বসে। তিনজনেরই চোখমুখ শুকিয়ে কাঠ।
ইসলামভাই।
ইসলামভাই আমার গলা শুনে মুখ তুললো। চোখদুটো জবাফুলের মতো লাল করে ফেলেছে। উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো।
মাসি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
তুমি কেঁদে আমার মুখ থেকে কিছু বার করতে পারবে?
তুই একবার বল আমি যা শুনেছি সব সত্যি কিনা?
তখনও তোমায় এক কথা বলেছি।
একবার তাকে দেখা।
বলেছি তো সময় হলে দেখতে পাবে।
প্লিজ অনি আমি তোর পায়ে মাথা রাখছি।
ইসলামভাই দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পরলো।
আমি চুপচাপ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
সবার চোখে বিস্ময়।
ইসলামভাই আমার হাঁটু দুটো প্রাণপণে জাপ্টে ধরে চোখ বন্ধ করে কেঁদে চলেছে।
তোমায় অপেক্ষা করতে হবে। তখনও বলেছি, এখনও বলছি।
একবার। একবার তাকে দেখা, চোখের দেখা দেখি।
পা জড়িয়ে ধরে আমার মুখের দিকে তাকালো। চোখদুটো জলে ভিজে গেছে।
আমার চোখে মুখে কাঠিন্য ফুটে উঠলো।
তোমার থেকে আমাকে বেশি কেউ চেনে বলে মনে হয় না। শান্ত হও। অনি সময়ের বাইরে গিয়ে কোনও কাজ করে না।
মিলিরা কেমন থতমত খেয়ে গেছে।
আবিদ, রতন, নেপলা উঠে দাঁড়িয়েছে। ইকবালভাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। মাসি স্থবীরের মতো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। চোখ দিয়ে অনবরতো জল গড়িয়ে পড়ছে।
আমি ইসলামভাইকে তুলে ধরলাম। গোপন কথা গোপনে রাখতে হয়, মনকে শক্ত করো।
ইসলামভাই অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।
তোমাকে এতোটা দুর্বল ভাবে কোনও দিন দেখতে হবে ভাবি নি।
একবার।
ইসলামভাই করুণ মিনতি করে উঠলো।
এতো বড়ো একটা দুর্দণ্ড প্রতাপ মানুষ। স্নেহ-মায়া-মমতরা কাছে নতি স্বীকার করছে।
তোমার জিনিষ তুমি ফেরত পেয়ে যাবে। আমি তাকে সারাজীবন আগলে রাখবো না।
ইসলামভাই হঠাৎ কেমন যেন পাগলের মতো হয়ে গেল।
আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বন বন করে ঘুরতে লাগলো।
মিলিরা সবাই চেঁচিয়ে উঠলো।
দাদাভাই তুমি এ কি করছো। অনিদার শরীর খারাপ।
ইকবালভাই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে আমাকে ছাড়াবার চেষ্টা করলো।
কে কার কথা শোনে।
দামিনী আমি পেয়েছি, আমার খুন। আমার খুন অনির কাছে আছে।
তারপর আমাকে মাটিতে নামিয়ে পাগলের মতো আমার সারাটা মুখে চুমু খেতে শুরু করলো।
বিকট একটা হাসি হেসে ইকবালভাইয়ের দিকে তাকাল।
তোমার গণনা যা বলতে পারেনি, অনি তা বলে দিয়েছে। আমাকে ছেড়ে দিয়ে, ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নেপলা, আবিদ, রতন ছুটলো ইসলামভাইয়ের পেছন পেছন।
আমার মাথাটা তখনও কেমন যেন টাল খাচ্ছে।
একদিকে সুরো আর একদিকে মিলি আমার হাতটা চেপে ধরেছে। একটা ঝাঁকুনি দিলো।
অনিদা শরীর খারাপ লাগছে? সুরো কাঁদো কাঁদো মুখে বললো।
আমি তখন হাঁপাচ্ছি।
কোনও প্রকারে মাথা দুলিয়ে বললাম, না। হাতটা তুললাম দরজার দিকে।
ইকবালভাই ছুটে বেরিয়ে গেল। গাড়ির আওয়াজ পেলাম।
চেঁচামিচির শব্দ শুনে, ঘরের গেটের মুখে ছগনলাল ওর ছেলে জগন ভজু এসে দাঁড়িয়েছে।
আমি সুরোকে বললাম, আমাকে একটু বড়োমার ঘরে নিয়ে চল।
তোমার শরীর খারাপ লাগছে!
ওদের কিছু বলতে পারছি না। বুকের ভেতরটা ভীষণ ধরফর করছে।
বড়োমার ঘরে এসে খাটে একটু বসলাম। মাম্পিদের জিনিষপত্র খাটের এক কোনে।
ইসারায় সুরোকে বললাম। বালিশটা একটু দে।
সুরো তারাহুরা করে খাটে উঠে গিয়ে বালিশটা নিয়ে এলো।
হ্যালো, শোন শোন তুমি এখুনি একবার বাড়িতে এসো….পরে বলছি, তুমি আগে এসো….অনিদা….হ্যাঁ অনিদার শরীরটা কেমন করছে….এখুনি শুনতে হবে….।
তাকিয়ে দেখলাম, মিলি ফোনের স্যুইচ অফ করছে।
ইকবালভাই মাথা দোলাতে দোলাতে ঘরে ঢুকলো।
মাসি রান্নাঘর থেকে একগ্লাস জল নিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে।
চোখে মুখে উৎকন্ঠার ছাপ স্পষ্ট। কারুর মুখে কোনও কথা নেই।
আমি মাসির হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে একটু জল খেলাম।
বিছানায় শুয়ে পরলাম।
ইকবালভাই আমার মাথার শিয়রে এসে বসলো।
বুকের ভেতরটা তখনও ধুকপুক ধুকপুক করছে।
এতো ইনস্ট্যান্ট ঘটনাটা ঘটে যেতে পারে বুঝিনি। পরের পর সমস্ত ছবিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মিলি-সুরো-মাসির মুখ থেকে উৎকন্ঠার চিহ্ন মুছে যায় নি।
তোমার এখন কেমন লাগছে অনিদা?
সুরো হাঁটু মুড়ে খাটের সামনে বসেছে। আমার একটা হাত চেপে ধরেছে।
ওর দিকে তাকালাম।
বুকে কষ্ট হচ্ছে।
আমার বুকে হাত রেখেছে।
মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো, ঠিক আছি।
চোখটা কেমন যেন বুঁজে বুঁজে আসছে। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলাম।
তারপর আর কিছু জানি না।
চোখমেলে যখন তাকালাম দেখলাম আমি বিছানায় শুয়ে আছি। পরিবেশটা চেনা চেনা ঠেকল না। ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদকটা একবার দেখলাম। সেই পরিচিত ঘর। তার মানে আমি নার্সিংহোমে! কেন?
পায়ের কাছে সোফায় মিলি, টিনা, অদিতি। চেয়ারে কনিষ্ক, নীরু।
হাতে স্যালাইন ঝুলছে।
নীরু আমার দিকে তাকিয়ে। গায়ে একটা কম্বল চাপা দেওয়া।
কিরে আমায় এখানে কি করতে নিয়ে এসেছিস?
কনিষ্কর দেকে তাকালাম। গম্ভীর মুখ। নীরু আমার কথা শুনে হাসছে।
শুনতে পাচ্ছিস না?
আমার পিণ্ডি চটকাবার জন্য। কনিষ্ক গম্ভীর হয়েই বললো।
মিলিরা মুখ নিচু করে হাসছে।
বাড়িতে খবর দিয়ে দাও। কনিষ্ক, মিলির দিকে তাকাল।
হলোটা কি বলবি তো?
কনিষ্ক কথা বলে না।
নীরু আমার দিকে তাকিয়ে বললো, এখন কেমন লাগছে?
তোর সঙ্গে কথা বলছি বুঝছিস না। কনিষ্কর দিকে তাকিয়ে গলা চড়ালাম।
রেগে যাচ্ছিস কেন।
নীরুর কথা কানে না তুলে কনিষ্কর দিকে তাকালাম।
শালা বক্তৃত্বা মারতে শুরু করলো। কনিষ্ক বললো।
উঠে বসতে গেলাম। নীরু বাধা দিল।
তারাহুড়ো করছিস কেন। বসবি তো, আমি কি বারণ করছি। আস্তে আস্তে ওঠ।
নীরু আমাকে ধরলো।
ধরতে হবে না নিজেই পারবো।
কনিষ্ক আমার দিকে তাকিয়ে।
ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে।
এটা খোল।
সময় হলে খুলে দেব।
শালা কিছু হলেই ফোঁড়াফুঁড়ি, আর নার্সিংহোম।
কনিষ্ক এবার হেসেফেললো।
মিলি।
বলো।
মাম্পিদের স্কুল থেকে এনেছো?
মিলি হাসছে।
শালা খিদের চোটে ঘুমিয়ে পরলাম, ওরা ওমনি নাচতে শুরু করে দিল।
মিলিরা মুখ নিচু করে হেসেই চলেছে।
ড্রিপটা আর কতটা বাকি আছেরে নীরু? কনিষ্ক গম্ভীর গলায় বললো।
মিনিট দশেক চলবে।
শেষ হোক খুলে দিস।
চা খাওয়া। আমি বললাম।
তুই যেভাবে কথা বলছিস তুই ততটা সুস্থ নোস। নীরু বললো।
গুষ্টির ঠ্যাঙ।
চেপে ধরে ইঞ্জেকসন দিয়ে দেব আবার ঘুমিয়ে পরবি।
জীবনে ওই কাজটুকু ছাড়া কি করতে পারিস, কটা বাজে?
কেন কোথাও বেরবি?
অবশ্যই।
কনিষ্ক মুখ ঘুরিয়ে হাসছে।
চিকনা ঘরে ঢুকলো।
চিকনাকে দেখে আমি একটু অবাক হলাম।
তুই কি করতে এখানে এসেছিস?
চিকনা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
কি বলছি শুনতে পাচ্ছিস না?
শুনলাম তোর শরীর খারাপ।
বুঝেছি। গ্রাম শুদ্ধু সবাই চলে এসেছিস।
চিকনা এবার হেসে ফললো।
কনিষ্ক খাবার ব্যবস্থা কর। বহুত খিদে পেয়েছে। মাসি সকাল থেকে স্রেফ একগ্লাস দুধ খাইয়ে রেখে দিয়েছে। আর যেন কি একটা মিশিয়ে দিয়েছিল। চা খাওয়ার মেজাজটাই চটকে চাটনি বানিয়ে দিল।
এই তো বললি চা খাবি।
চা খেলে গর্ত ভর্তি হবে না।
ওরা কেউ কথা বলে না, শুধু হেসেই যায়।
চিকনা, নেপলাকে একবার ডাক। একটু বেরবো। শালারা কাজ নেই কম্ম নেই, ঘুমিয়ে পরেছি, ওমনি নার্সিংহোমে তুলে নিয়ে এসে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
কনিষ্ক আমার মুখের দিকে তাকাল।
বহুত বক বক করছিস।
করবো না, তোকে কে এখানে তুলে আনতে বলেছে।
আমার বাবা বলেছে।
দেখলাম অনিকেত, বটা ঘরে ঢুকলো।
কিরে কনিষ্ক ও উঠে বসেছে! বটা বললো।
কেন কি হয়েছে—নিমতলা গেছিলাম। আমি বটার দিকে তাকালাম।
বটা আমার কথায় হেসে ফেললো।
তুই বহুত জ্বালাস। অনিকেত বললো।
ওর জন্য কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা কর। সকাল থেকে মাসি একগ্লাস দুধ খাইয়ে রেখেছে। কনিষ্ক গম্ভীরভাবে বলে চলেছে।
বটা হাসছে। যাঃ শুধু মাত্র একগ্লাস দুধ। আরও অনেক কিছু খাইয়েছে, বলছে না।
হাসিস না। নেপলাকে ডাক, গাড়িটা নিয়ে আসুক, ওর এখন অনেক কাজ। কতো জায়গায় কতো ঝামেলা করে রেখেছে, সেগুলো সাল্টাতে হবে।
আমি কনিষ্কর দিকে তাকালাম।
খুব ঠেস মেরে মেরে কথা বলছিস।
আমি সত্যি বলছি, না মিথ্যে বলছি—কনিষ্ক বললো।
মাঝা মাঝি। নীরু বললো।
মিলি তোমরা একটু ঘর থেকে বেরোও তো।
কেন খিস্তি দিতে সুবিধে হবে। ওরা শুনুক, ক্ষতি কি।
চুপ করে গেলাম।
নীরু ড্রিপটা খুলে দে। কনিষ্ক বললো।
নীরু খাটের এপাশে চলে এলো। অনিকেতও এলো।
চ্যানেলটাও খুলে দিই। নীরু বললো।
দে। লাগলে আবার করে নেব।
ওরা হাত লাগাল।
শালা গরু পেয়েছিস নাকি। লাগে না।
বাদাবার সময় মনে থাকে না। বটা বললো।
কি বাদিয়েছি রে, তখন থেকে গরম গরম বাতেলা মেরে যাচ্ছিস সবকটা।
নীরু কোনও কথা বললো না। সব খুললো।
দরজা ঠেলে ঠেলে একে একে সুরো, নীপা, দামিনীমাসি, সুবীর ঢুকলো।
ওদের মুখটা কেমন থমথমে। আমি ওদের দিকে তাকালাম।
তোমার দাদা এখন পুরো ফিট। টেনশন করার কোনও দরকার নেই। নেপলাদাকে একটা ফোন করো, গাড়িটা নিয়ে আসুক। কাজে বেরবে। অসমাপ্ত কাজগুলো খুব তারাতারি শেষ করতে হবে।
কনিষ্ক প্রতিটা কথার মধ্যে দিয়ে চিমটি কাটছে।
সুরো আমার দিকে কেমনভাবে যেন তাকিয়ে। নীপা মুখে হাত দিয়ে হেসে ফললো।
কনিষ্ক মাসির দিকে তাকাল।
সকাল থেকে শুধু দুধ খাইয়ে রেখেছ। সঙ্গে একটা কি মিশিয়ে দিয়েছিলে, চা খাওয়ার মেজাজটা চটকে একবারে চাটনি, খেতে চেয়েছিল, খেতে দাওনি, খিদের চোটে ঘুমিয়ে পরেছিল, আমরা নার্সিংহোমে তুলে নিয়ে এসেছি।
মাসি ফ্যাকাশে মুখে হেসে ফেললো।
আমি কনিষ্ককে দেখে যাচ্ছি।
চোখমুখটা দেখেছ, ঘুমিয়ে কেমন ঝক ঝকে হয়ে গেছে।
অনিকেত সবাইকে টপকে আমার খাটের পাশে টেবিলটার কাছে চলে এলো। জলের জগ থেকে গ্লাসে জল ঢেলে খেতে শুরু করে দিল। গ্লাসটা রেখে কনিষ্কর দিকে তাকাল।
কিরে কনিষ্ক, তাহলে ডিসচার্জ সার্টিফিকেট লিখে দিই।
কেন, না চুলকোলে হচ্ছে না।
আমার কথা শুনে অনিকেত হেসে ফেললো।
লিখে দে, নাহলে নেপলাকে নিয়ে বেরবে কি করে। নীরু বললো।
সুরো আমার ফোনটা কইরে?
তুমি এতো কথা বলছো কেন?
তাহলে কি বোবা হয়ে বসে থাকবো।
তোমার শরীরটা ঠিক নেই।
ঘেঁচু। তোরা সব জেনে বসে আছিস। কিছু খাবার নিয়ে এসেছিস?
কি খাবি বল? কনিষ্ক বললো।
ভাত নিয়ে আয়।
ভাত না খেয়ে অন্য কিছু খা।
কি খাওয়াবি?
একটু স্যুপ আর ন্যুডুলস আনতে বলি।
সবার জন্য বল।
আমরা একটু আগে খেয়েছি।
নীরু কটা বাজে বলতো?
কি বললে তুই খুশী হবি।
সব খুপরিতে গুছিয়ে রাখছি মাথায় রাখিস।
এবার বল হাতি যখন কাদায় পরে চামচিকিতে লাথি মারে। অনিকেত বললো।
না, সে কথা বলবো না। তোরা আজ সবাই মিলে বহুত চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছিস।
এখন রাত এগারোটা। নীরু বললো।
এতক্ষণ ঘুমলাম!
তোকে পর্শু সকালে এখানে নিয়ে এসেছিলাম। ফেজটা শুরু হয়েছিল দেশের বাড়িতে, এখন মনেহয় শেষ হলো।
আমি নীরুর দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
হ্যাঁ ঠিক বলছি। তুই এখানে আটচল্লিশ ঘণ্টা রয়েছিস।
কি হয়েছিল?
একটু শরীর খারাপ হয়েছিল।
তাতেই দুদিন ঘুমলাম!
কনিষ্ক হাসছে।
চলবে —————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/a20R56K
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment