❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৪৭ নং কিস্তি
—————————
নেপলা মাথা নিচু করে বললো, পরে সব বলছি। তুমি শোনো না।
তোকে কথা বলতে বলেছি। শুনে যেতে বলেছি। আমরা সবাই ওর কাছে পুঁটি মাছ। বুড়ো আঙুলে টিপে মেরে দেবে। তুই এজন্মে চেষ্টা করলেও অর্জুন হতে পারবি না। চাঁদ বললো।
চিনা হাসছে।
কথা বলার রিদিমটাই নষ্ট করে দিল। এখন থেকে শুধু শুনে যাবি কোনও কথা বলবি না। রতন বললো।
আমার বিরাট একটা হাই উঠলো।
কিগো ঘুম পাচ্ছে। নেপলা আমার দিকে তাকাল।
বড়োমাকে গিয়ে বল না।
চা?
মাথা দোলালাম।
ঝেঁটা নিয়ে তাড়া করবে।
দাদার কথা বলবি কিছু বলবে না। রতন বললো।
যা, তাহলে আমরাও একটু পাই। চাঁদ, নেপলার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
ফিরে এসে আমার কথা বলবো। নেপলা চলে গেল।
আয়।
রতন কাল তুই, চাঁদ, চিনা, আবিদ সকালের দিকে আসবি। আমি বসবো।
কি ব্যাপারে বলো। তাহলে….
বিরাট একটা হাই উঠলো।
….আগে হাই তুলে নাও তারপর বলো।
হাসলাম। কি বলছিলি?
তাহলে একটু প্রিপারেসন নিতে পারি।
এ্যাকাউন্টসগুলো সঙ্গে আনবি। নোটের পজিশন দেখবো। তারপর সেইভাবে সব ঠিক করবো।
সে দেখে তুমি কি করবে। তুমি কাজ দেবে, তোলার দায়িত্ব আমাদের।
ফাইনান্সার কে? অবতার না সাগির—
তোমাকে জানতে হবে না। টাকা দেওয়ার অনেক লোক আছে। সেরকম বুঝলে ম্যাডামের কাছে চাইবো। তুমি দেবে না ম্যাডাম দেবে, সুজিতদা দেবে।
ওরে বাবা, তোর তো বহু ফাইনান্সার।
অনিদা। নেপলা চেঁচালো।
দেখলাম অনিকাকে সঙ্গে নিয়ে নেপলা আসছে। অনিকার হাতে চায়ের ট্রে। দু-জনে কাছে এলো।
কে বানাল?
ছোটোমা ওকে বললো, ও সবার জন্য বানাল।
তার মানে চা দিয়ে এ বাড়ির কাজ শুরু করলি। অনিকার দিকে তাকালাম।
কিরে খেতে পারবো।
কেন আগে তোমাকে বানিয়ে দিইনি?
সবাই চা নিলাম।
এই কাপরটা কোথায় পেলি। জাম্পেশ লাগছে দেখতে।
পিসি দিলো। কিনে রেখেছিল।
তারমানে পিসি জানতো তুই আসবি।
তুমি তো পিসিকে বলেগেছ, আমাকে আনতে যাচ্ছ।
শুধু তুই জানতিস না।
আমি জানতাম।
কি করে জানলি।
ফাদার কাল রাতে ফোন করলো, সকালে ঘণ্টা ফোন করে বললো, অনিমামা কৃষ্ণনগর যাচ্ছে।
কটার সময় বল।
তখন আমি স্টেশনে নেমেছি।
আটটা পনেরো কুড়ি।
না।
তাহলে।
আটটা দশ।
একবারে রাইট টাইম।
ওই ট্রেনটা লেট করে না।
ঘণ্টা কি বললো?
বললো, ওদের কারা যেন ধরে নিয়ে গেছে। কেন ধরে নিয় গেছে ঠিক বুঝতে পারছে না। জামাই আদর করেছে। ও আয়েষাদিকে ফোন করে সব জানিয়েছে।
ও জানলো কি করে আমি কৃষ্ণনগর গেছি।
উসমানচাচা ফোন করেছিল, বললো কাল অনি আসবে তোরা আসবি নাকি, ওরা না বলেছে।
ঘণ্টাকে ডাক কোন লোকদুটো ওর মুখ থেকে শুনি। তারপর ঢিসুম ঢিসুম।
চিনা গরম চায়ে বিষম খেল।
নেপলা হেসে গড়িয়ে পরে।
অনিকা ওদের দিকে ভাষা ভাষা চোখে তাকিয়ে।
যা ড্রেস করে নে। আয়েষাদির রিসেপশনে যেতে হবে।
আমি আয়েষাদিকে কিছু দেব না?
কি দিবি!
কিছু কিনতে যাই চলো।
টাকা কোথায় পাবি?
আমার কাছে আছে।
আমাকে ধার দে। পকেট একবারে খালি। তোর পেছনে অনেক খরচ হয়ে গেছে।
তোমার অনেক টাকা। আমার থেকে বেশি।
তুই জেনে বসে আছিস।
অনিকা আমার দিকে তাকিয়ে।
তোর বাপেরও অনেক টাকা।
আমি নেব না। অনিকার মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
ঠিক আছে, তুই এখন যা।
তুমি যাবে না?
তুই রেডি হয়ে নে। যাব।
অনিকা ট্রে নিয়ে চলেগেল। কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে এলো।
কি হলো।
কাপগুলো নিয়ে যাই।
তোকে নিতে হবে না। ভজুমামাকে পাঠিয়ে দে।
আবার ফিরে গেল।
পরিবেশটা একটু থম থমে হয়ে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার শব্দ। আমি সকলের চোখ মুখের দিকে তাকাই। রতনের দিকে তাকিয়ে বললাম, কিছু বুঝলি।
বুঝলাম। তোমার কাঁধে আর একটা ঝামেলা চাপলো।
শুধু ঝামেলা না। আদৌ এ্যাডজাস্ট হবে কিনা সন্দেহ। ছোটোমাকে ও ভালো মনে মেনে নেবে ইসলামভাইকে মেনে নিতে ওর সময় লাগবে।
ওরা তিনজনেই আমার দিকে তাকিয়ে।
চাঁদ, চিনা কথাটা যেন ইসলামভাইয়ের কানে না যায়।
গেলে আমাদের জিভ কেটে নিও। চাঁদ বললো।
তুই নিজেকে নিয়ে একবার ভাব রতন, দেখবি আমার কথাটা মিলে যাবে।
ঠিক কথা। মাকে যত তারাতারি মেনে নেওয়া যায়, বাবাকে মেনে নেওয়া যাবে না।
দেখ ঘটনাটা মিথ্যে নয়। কৃষ্ণনগর জেলা হাসপাতালে ওর জন্ম। ওর মায়ের সই আছে ওর বার্থ সার্টিফিকেটে, সেখানে ওর মা ওর বাবার নাম বসিয়েছে। নিজের মেয়ের নামকরণ করেছে।
ওর যখন একমাস বয়স তখন থেকে ছবি তুলতে শুরু করেছি। ওর মার সঙ্গে ওর প্রায় একশোটা মতো ছবি আছে। আমার সঙ্গেও ওর প্রচুর ছবি আছে। আমি মেরিনাদি অনিকা তিনজনের ছবি আছে। মেরিনাদি একবছর বয়স পর্যন্ত ওর কাছে ছিল। তারপর সব কেমন গণ্ডগোল হয়ে গেল।
দাদাভাই জানতো না!
জানতে পারলে মেরে দিত। তখন ইসলামভাইয়ের এই রূপ ছিল না। হাতে অঢেল টাকা। প্রচুর ক্ষমতা। ধরাকে সড়াজ্ঞান করছে। তখন মল, ব্যানার্জী, রাজনাথের সঙ্গে ওঠা বসা।
নাসরিনের সঙ্গে দাদাভাইয়ের কোনও মিল নেই। রতন বললো।
ছোটোমার সঙ্গে আছে।
কি আস্তে আস্তে কথা বলে। তাই না রতনদা—চাঁদ বললো।
ফাদারের কাছে মানুষ যে।
চায়ের কাপটা ঝুঁকে চেয়ারের তলায় রাখলাম।
তবে আমার বিশ্বাস ছোটোমা ওকে তৈরি করে নেবে। তারপর অনিসা আছে, মিত্রা, তনু আছে।
ওকে কাগজের অফিসে নিয়ে নিলে কেমন হয়।
মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়াশুনা করেছে। মামার মতো সাংবাদিক হবে, সেটাই ইচ্ছে ছিল। আমিও মনে মনে তাই ভেবে রেখেছিলাম। সৎপাল ব্যাটা সব গণ্ডগোল করে দিল। আমি একটু থেমে গেলাম।
ও কিন্তু এখনকার মেয়েদের মতো নয়। তখন ওকে নিয়ে দোকানে গেলাম। দেখলাম, সবচেয়ে কমদামী জিনিস। অত্যন্ত সাধারণ জিনিস ওর পছন্দ। আমি জোড় করতে দুটো তাঁতের শাড়ি পছন্দ করলো। নেপলা বললো।
মিশনারি শিক্ষাটা মানুষকে ভদ্র নম্র করতে শেখায়। তুই একটু ধমকে কথা বললে ও কেঁদে ফেলবে। ঘণ্টা, পক্কের ক্ষেত্রেও তাই। তাহলে আয়েষা ওরকম হলো কেন?
তোমাকে ঠিক এই কথাটাই বলতে যাচ্ছিলাম। নেপলা বললো।
লোভ বুঝলি নেপলা। তারপর চার্চে অতগুলো বাচ্চা। সবাইকে সমান নজর দেওয়া যায় না। আনিকা, ঘণ্টা, পক্কে সে অর্থে কিন্তু অর্ফান নয়। ওদের একজন গার্জেন ছিল, জানে সে সময় করে ওদের কাছে আসে। ওদের কাছে থাকে। খেলা করে। বাবা-মা নেই তো কি আছে? সবচেয়ে বড়ো কথা উসমানকে পেয়ে গেলাম। উসমান ওদের জন্য অনেক করেছে।
ফেরার সময় উসমানভাই অনেক কথা বললো।
নেপলা আমার দিকে তাকিয়ে হেসেফেললো।
এখন বুঝি তুমি এতো রোজগার করার পরও কেন তোমার পকেটে পয়সা নেই। নেপলা বললো।
একটা সিগারেট দে।
চাঁদ পকেট থেকে লাইটার আর সিগারেটের প্যাকেট বার করলো।
একটা নিয়ে ধরালাম।
সাগির, অবতারকে দেখ। কি ছিল, কি হলো। পড়তে বসে আমার হাতে তোরা কতো মার খেয়েছিস। হয়তো তখন রাগ করেছিস, কিন্তু এটুকু জানতিস দাদা কোনওদিন আমাদের জন্য খারাপ কিছু ভাবে না। তোদের চোখে আমি আমাকে খুঁজে পেয়েছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার জন্য তোরা জীবন দিতে পারিস। তাই আজ তোরা এই জায়গায় আসতে পেরেছিস। ভালো কাজের রিটার্ণ একটু দেরি করে আসে।
নেপলা মোবাইলটা এগিয়ে দিল।
একটা অন্যায় করেছি।
কি।
তখন চিনা, অর্জুনের ব্যাপারটা তোমাকে বেফাঁস বলে ফেলেছে।
আমি নেপলার দিকে তাকিয়ে!
আমি ওদের ম্যাসেজটা দেখিয়েছি।
কি লিখেছে?
ন্যাকামো করবে না। তুমি সব জানো। সকালে ছোটোমা অর্জুনের কথা বললো, আর বারোটার মধ্যে কাজ হয়ে গেল ব্যাপারটা কি?
নেপলা এমনভাবে ধমকালো হেসে ফেললাম।
তখন অনিকা তোমাকে একটা জিনিষ চাইতেই তোমার মুখটা কেমন থমে থমে হয়ে গেল। তারপর বললে প্রমিস যখন করেছি তোকে দেব। জাফর কে?
তার আগে বল, আমি যখন বাথরুমে, ওই ঘরে এতো হাসাহাসি হচ্ছিল কেন? কেন আমার পার্মিশন ছাড়া ব্যাগ খোলা হলো।
ওটা তুমি বুঁচকি আর অনিকাকে জিজ্ঞাসা কর। আমি শুধু ওখানে যা ঘটেছিল বলেছি।
কেন?
পেট ফুলে যাচ্ছিল। আর একটু হলে দমবন্ধ হয়ে মরে যেতাম।
রতনরা হাসছে।
জাফরের ঘটনাটা ইনভিসিবিল, আমি শুনতে চাই।
আর কে দেখেছে?
আসার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাডাম, তনুদিদি ফোনটা নিয়ে নিয়েছিল, ওরা দেখতে পারে।
তাহলে তুই অনিদা হবি কি করে?
ওই জায়গায় কোনওদিন অনিদা হতে চাই না।
জাফর ইউপির ডাকসাইট ডন। আসল নাম ইউনিস খান কলকাতায় একসময় এর ডেরা ছিল। ইসলামভাইয়ের বয়সী। মেরিনাদিকে মার্ডার করেছিল।
ওরা সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
পঁচিশ বছর পর!
আমি না অর্জুন কথা দিয়েছিল। অর্জুন অনিকাকে দেখেছে। আমার সঙ্গে চার্চেও একরাত কাটিয়ে এসেছে। সেদিনটা অনিকার জন্মদিন ছিল। অর্জুন অনিকাকে বনের মতো ভালোবেসে ফেললো। জন্মদিনে ওকে কথা দিয়েছিল। তোর মাকে যে মেরেছে তার মৃত্যু আমার হাতে লেখা রইলো। তুই আজ এ্যাডাল্ট হলি তোকে কথা দিয়ে গেলাম।
আমাকে বলেছিল, তুমি যেদিন ওকে তোমাদের বাড়িতে তোমার মেয়ে হিসাবে নিয়ে যাবে, তার চব্বিশ ঘণ্টা আগে আমাকে খবর দেবে। ও নিষ্কলঙ্ক হয়ে তোমার বাড়িতে পা দেবে।
সেই জন্য অনিকা তোমার কাছে চাইল!
হ্যাঁ, ও নিষকলঙ্ক কিনা যাচাই করে নিল।
ধরো যদি অর্জুন না থকতো?
আর একটা অর্জুনের জন্ম হতো। সে কাজটা করতো। আলটিমেট চ্যাপ্টারটা ক্লোজ করতাম।
অনিরে।
তারস্বর চিৎকারে চমকে তাকালাম।
বেলা পরে গেছে। সূর্যের দেখা নেই। ঠিক গোধূলি বলা যাবে না। গোধূলির ঠিক আগের মুহূর্ত। একটু শীত শীত করছে।
চিকনা অনিকাকে জড়িয়ে ধরে এদিকে আসছে।
পেছন পেছন মীরচাচা, বাসু, ভানু, ঘণ্টা, পক্কে।
কাছে এসে চিকনা হাসতে হাসতে বললো।
তিনখান বড়ো বড়ো ভাইগনা, ভাইগনী পাইলাম।
চিনতে পেরেছিস? অনিকার দিকে তাকালাম।
হাসছে। মামীমা বললো।
আমার গল্পের সঙ্গে মিলছে?
মাথা দোলায়। মিলছে।
জিজ্ঞাসা করেছিস?
পিটানের কথা। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেছে। চিকনা বললো।
রতনরা হেসে ফেললো।
ঘণ্টা, পক্কে দেখি অনিকাকে খোঁচাচ্ছে। চোখে চোখে তিন ভাইবনের কি কথা হলো।
অনিকা নিচু হয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো।
অনিমামা, এই সেই লোক যে ঘণ্টা, পক্কেকে তুলে নিয়েগেছিল। ফিস ফিস করে আমার কানে কানে বললো।
সবাই দেখলো ব্যাপারটা, কিছু বুঝতে পারলো না।
আমি চিনার দিকে তাকালাম।
গম্ভীর হয়ে বললাম ঘণ্টা এদিকে আয়।
কাছে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো।
ঠিক বলছিস এই লোকটা।
চিনা এবার ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে, না পারছে হাসতে না পারছে গম্ভীর হতে।
রতনরা হেসেফেললো।
ঘণ্টা তোর মামাকে ধরে মার। চিকনা চেঁচিয়ে উঠলো।
ঘণ্টা, পক্কে দুজনেই চিকনার দিকে কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
বুঝেছি। বৈষয়িক বুদ্ধি এখনও হয়নি।
চিনা ওদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নে। এরকম ভুল আর কোনওদিন করবি না।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম।
না উনি কিছু করেননি। আঙ্কেল যেতে ছেড়ে দিয়েছে। পক্কে বললো।
ওরে অনি, এ তো ঢের সময় লাগবে। এরা এখনও পাঁচু, পচাতে পড়ে রয়েছে। চিকনা বললো।
ওরা সবাই হাসাহাসি করে।
অনিকার দিকে তাকালাম।
কিরে কোথায় যাবি বললি—রেডি হলি না?
ওর কোমড়টা জড়িয়ে ধরলাম।
মামীমা বলেছে যেতে হবে না মামীমার কাছে আছে, যাওয়ার সময় দেবে।
ঘণ্টা আর পক্কের?
ওদেরটাও দেবে বলেছে।
মামীমাকে পয়সা দিয়ে দিস।
না।
কেন?
অনিকা মুখনিচু করে আছে।
তাহলে ওই পয়সাটা আমায় দে।
পক্কের কাছে আছে চেয়ে নাও।
তুমি আর ওদের মাথা খারাপ করো না। নেপলা চেঁচিয়ে উঠলো।
উঠে দাঁড়ালাম।
মীরচাচা আমার ছেলে মেয়েদের দেখলে।
সে-তো আজ এসে জানলাম।
তুমি এখনও অনেক কিছু জানো না মীরচাচা। নেপলা বললো।
মীরচাচা চুপ করে রইলো।
আমি অনিকা আর পক্কের কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এদিকে চলে এলাম।
অনিকা।
বলো।
ভানুমামার সঙ্গে কথা বলেছিস?
বলেছি।
কি বললো।
সেউঠি চ, দুধ খাওয়াইবো।
ঘণ্টা খিক খিক করছে। মামাকে ওইটা বল।
অনিকার দিকে তাকালাম।
তন্যে কাইনু আইসুঠুরে।
মানেটা চিকনামাম বলে দিল।
অনিকা মাথা দোলাচ্ছে।
তুমিও এইভাবে কথা বলতে?
হ্যাঁ।
ভানু আমাদের কথা শুনে হাসছে। বাইরের ঘরে প্রচণ্ড হই হই হচ্ছে।
বারান্দায় উঠতে গিয়ে পক্কে হাতটা চেপে ধরলো।
কিরে?
আমি, ঘণ্টা পাজামা-পাঞ্জাবী পরবো।
নিয়ে এসেছিস?
মামীমা দেবে বলেছে।
হাসলাম।
তোমার সঙ্গে যাব।
আচ্ছা।
নেপলা আমার দিকে চেয়ে আছে।
যা রেডি হয়ে নে।
ওরা তিনজনে আমার ঘরের দিকে চলে গেল। আমি বাইরের ঘরে এলাম। দেখলাম অনিমেষদা এসেছে। বৌদি সকলকে চা দিচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকালো। অনিমেষদা মুচকি মুচকি হাসছে।
আমি গোল টেবিলে এসে বসলাম।
দাদা, ডাক্তারদাদা কথা বলছে। আমার দিকে একবার তাকাল।
তুই চা খাবি? বৌদি বললো।
এটা জিজ্ঞাসা করতে হয়? গম্ভীর হয়ে বললাম।
বৌদি চলে গেল।
কখন এলি? অনিমষদা বললো।
সাড়ে তিনটে, চারটে হবে।
সব কাজ মিটলো?
আর একটু বাকি আছে।
কখন সারবি?
এবার সেরে নেব।
অনিমেষদার দিকে একটু হেলে পরে বললাম, তুমি যাবে নাকি?
অনেক করে যেতে বলেছে।
যাবে না।
অনিমেষদা আমার দিকে তাকাল।
তোর বৌদি?
না গেলেই ভালো।
ওদের সবাইকেও যেতে বলেছে।
বারন করে দাও। সবাইকে এ বাড়িতে ডেকে নাও। ওখান থেকে খাবার নিয়ে চলে আসুক।
ঠিক আছে।
আর একটা কথা বলবো?
বল।
অন্যভাবে নেবে না।
না।
তুমি বৌদি এবাড়িতে কিংবা ডাক্তারদাদার বাড়িতে চলে এসো না। ওটা ভাড়াবাড়ি, দাদাকে কিংবা ডাক্তারদাদাকে ওই ভাড়াই দেবে।
অনিমেষদা চায়ের কাপটা সেন্টার টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসলো। ভাব ভঙ্গিটা এরকম, তোর ব্যাপার স্যাপার কি বল?
এরমধ্যে কোনও প্যাঁচ-পয়জার নেই। হঠাৎ মনে হল তাই।
মনে হওয়ার কারণ?
বৌদি চা নিয়ে এলো।
সুতপা একটু বসো।
কেনোগো! আবার কি করলো? বৌদি চোখ পাকিয়ে বলে উঠলো।
বসো না, বলছি।
দাদা মনে হয় বুঝতে পারলো।
কি হয়েছে অনিমেষ?
কিছু না, একটু কথা বলছি।
ডাক্তারদাদা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি চায়ে চুমুক দিয়েছি।
অনিমেষদা চাপা স্বরে বৌদিকে সব বললো।
তোকে এমন দেব না, সব সময় মাথার মধ্যে ঘুরঘুরে পোকা নাচে, তাই না।
তারপর আমার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো।
অনিমেষদা আমার দিকে হাসি হাসি চোখ তাকিয়ে।
কিগো সুতপা তোমার চোখ ছলছল করছে কেন! অনি বান মারলো বুঝি? ডাক্তারদাদা বললো।
বৌদি কোনও কথা বললো না। শুধু মাথাটা সামান্য দুলিয়ে বললো, না। গলাটা সামান্য ভারি হয়ে গেল।
অনিমেষ?
অনিমেষদা টেবিলের ওপর থেকে আবার চায়ের কাপটা তুলে নিল। চুমুক দিয়ে বললো।
পড়ে বলছি।
ডাক্তারদাদা চুপ করে গেল। কিন্তু চোখে হাজার প্রশ্ন।
বৌদি উঠে বড়োমার ঘরে চলে গেল।
মিনিট চারেকের মধ্যেই বড়োমা গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। আগুন ঝরা চোখে আমার দিকে তাকালো।
আমার কোনও বিকার নেই। আমি কাপে চুমুক দিয়ে চলেছি।
অনিমেষদা মাথা দুলিয়ে না না করছে।
ডাক্তারদাদা দাদা একটু অবাক, হঠাৎ কি হলো! বোঝাই গেল না।
ওই ঘর থেকে হইহই শব্দ ভসে আসছে। মল্লিকদা, ছোটোমা মনে হয় ওপরে আছে।
জ্যেঠিমনি, বড়োমার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বড়োমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গল।
দাদা অবাক হয়ে একবার বড়োমার ঘরের দিকে, একবার আমার মুখের দিকে, একবার অনিমেষদার মুখের দিকে তাকায়।
অনিমেষদা সিগারেট ধরিয়েছে। ছোটোমা ওপর থেকে এসে ঘরে ঢুকলো।
দাদা, সব চুপ চাপ বসে?
এমনি। অনিমেষদা বললো।
ছোটোমা সোজা বড়োমার ঘরে ঢুকে পড়লো।
কি হলো বলোতো ডাক্তার, সব কেমন থম মেরে গেল।
ডাক্তারদাদা, দাদার দিকে তাকালো।
একটু অপেক্ষা করো জানতে পারবে। হাইডোজের ওষুধ মনে হচ্ছে। হজম হতে সময় লাগবে।
অনিমেষদা হেসে ফেললো।
ছোটোমা হাসি হাসি মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সোজা আমার পাশে এসে বসলো।
এক থাপ্পর মারবো। হাত তুললো। কিন্তু গালে পড়লো না।
যা বাবা, আমি কি করলাম!
ডাক্তারদার থম থমে মুখ হাসিতে ভরে গেল।
ছোটো, ওষুধে কাজ হয়েছে?
ছোটোমা, ডাক্তারদাদার দিকে তাকাল। হাসছে।
কি এডিটর কিছু বুঝছো?
দাদা, ডাক্তারদার দিকে তাকিয়ে।
অনিমেষ তুমি কিন্তু বড্ড চুপচাপ হয়ে গেলে। ডাক্তারদাদা বললো।
না দাদা, আমার তো কোনও পুত্র সন্তান নেই। জামাইটাও সেইরকম। সেই শূন্যস্থানটা অনি বুঝতে দেয় না। ওই জায়গাটা ও ঠিক ভরাট করে দেয়।
ডাক্তারদাদা হো হো করে হেসে উঠলো।
তাই বুঝি। ছোটো, সুতপাকে একবার ডাকো।
থাক। ওরা বেরিয়ে গেলে, আমরা আলোচনা করবো। অনিমেষদা বললো।
তুমি যাবে না?
ও সবাইকে যেতে বারন করছে।
আমরা যাব না, আগ থেকেই ঠিক আছে।
আমাদেরও বারন করলো।
ডাক্তারদাদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
তোর প্ল্যান প্রোগ্রামগুলো খুব নিখুঁত। একবারে তারাহুরা করিস না।
ছোটোমা আমার দিকে তাকিয়ে।
ছোটো তাকিয়ে লাভ নেই, আজ আমরা বুড়ো-বুড়িরা পিকনিক করবো। ডাক্তারদাদা হাসছে।
বড়োমা, জ্যেঠিমনি, বৌদি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
অনিমেষ তুমি ওকে ধরে দু-ঘা দিতে পারছো না—বড়োমা বললো।
ডাক্তারদাদা পেছন ফিরে তাকাল।
না দিদি, সে জোর আমার হাতে নেই।
তোমরা কথা বলো, আমি ড্রেস লাগাই, বিয়ে বাড়ি বলে কথা।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। ঝেড়ে একটা আলিস্যি ঝাড়লাম। ছোটোমা পেছনে একটা থাপ্পর লাগাল।
অনিমেষদা হাসছে।
প্যান্ট-গেঞ্জি পরবি না। পাজামা-পাঞ্জাবী পরবি। বৌদি নিচু স্বরে বললো।
আমি হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
বড়োমা, জ্যেঠিমনি হাসি হাসি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।
বাগানে দেখলাম চিকনা, বাসু, মীরচাচা, ভানু, নেপলা দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
ঘরের দরজা বন্ধ। নক করলাম।
দাঁড়াও খুলছি। ভেতর থেকে তনুর গলা পেলাম।
দাঁড়িয়ে রইলাম।
তনু দরজা খুললো। একটা জমপেশ বেনারসী চড়িয়েছে। এখনও মেকআপ পুরো হয় নি।
আমি দেখে হেসে ফেললাম।
এই টুকুতেই—এখনও মেকাপ করি নি—
করো।
ভেতরে এসো—
আর কে আছে?
সবাই।
মহিলা মহল?
হ্যাঁ।
তুমি একটা পাজামা-পাঞ্জাবী দাও।
তনু মুখ ঢোকাল।
দিদি ও পাজামা-পাঞ্জাবী চাইছে।
ভেতরে এসে নিয়ে যেতে বল।
থাক, তোমরা রেডি হও। আমি বড়োমার ঘরে আছি, হয়ে গেলে নিয়ে এসো।
এ ঘরে ঢুকতেই দেখলাম গোল টেবিল বৈঠকে খুব জোর হাসাহাসি চলছে। আমাকে দেখেই অনিমেষদা বলে উঠলো, কিরে তাড়িয়ে দিল।
হ্যাঁ।
আমি বড়োমার ঘরে এসে ঢুকলাম।
খাটটা খালি, আমি আর অপেক্ষা করলাম না। বালিশটা টেনে নিয়ে শুয়ে পরলাম।
বাইরের গোল টেবিল থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া কথা ভেসে আসছে। সবই আমাকে নিয়ে।
আমি চোখ বন্ধ করে হাতটা ভাঁজ করে চোখের ওপর দিয়ে আছি।
সারাদিনের কথা চিন্তা করছি। একের পর এক ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভেসে আসছে। অতীতের ঘটনাগুলো এখনও দগদগে ঘায়ের মতো। একটা সামান্য ঘটনা, কেমন যেন জটপেকে গেছিল। জাস্ট কমিউনিকেশনের অভাব। ওদের ফোন নম্বরটা থাকলে সমস্যা হতো না। কিন্তু দময়ন্তী এটা কি করলো? ওর সঙ্গে আলাদা করে বসতে হবে। আজ ও এলো না।
কিরে শুয়ে আছিস?
হাতটা সরালাম। দেখলাম চারজনে সোফায় বসলো।
এখানে এলে কেন, বেশ তো ওখানে বসে গল্প করছিলে।
কেন, তোর অসুবিধে আছে? ছোটোমা বললো।
আমার কিসের অসুবিধে, বড়োমা।
বল।
তখন যে ব্যাগটা নিয়ে এসেছিলাম সেটা কোথায়?
ছোটোর ঘরে।
ছোটোমা একটু কাউকে দিয়ে ওটা নিয়ে আসবে?
কেন!
দরকার আছে।
ছোটোমা উঠে দাঁড়ালো।
যাচ্ছ কোথায়!
তুই ব্যাগটা নিয়ে আসতে বললি।
অনিসাকে একটা ফোন করে দাও।
ছোটোমা হেসেফেললো।
হাসছো কেন?
তোর সব বড়ো বড়ো ব্যাপার।
বসো।
ছোটোমা দাঁড়িয়ে রইলো। আমি পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে অনিসাকে একটা রিং করলাম।
নাও কথা বলে নাও।
ছোটোমার হাতে ফোনটা দিলাম। ছোটোমা অনিসার সঙ্গে কথা বলে নিল। আমাকে ফোনটা দিল।
এই টুকুর জন্য উঠে বাইরে যেতে চাইছিলে।
তোর মতো আমি বড়োলোক নই।
তুমি গরীবলোক, এই কথাটা কোথায় লেখা আছে?
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আমার মুখে কিছু লেখা নেই, ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থেকে কোনও লাভ নেই।
তুই হঠাৎ সুতপাকে ওই কথা বললি?
সেই জন্য চারজনে ওখান থেকে উঠে চলে এলে। চলো একলা আছে এই সময় পাকড়াও করি।
জ্যেঠিমনি হেসেফেললো।
দেখছো জ্যেঠিমনি হাসছে।
দিদি তোকে চেনে না। আমি চিনি।
উরি বাবা। গাল ফোলালাম।
গাল টিপে ফাটিয়ে দেব।
ছোটোমা দাঁতে দাঁত চিপে কথা বলতে বলতে এসে গালটা টিপতে গেল।
আমি হেসে মুখটা সরিয়ে নিলাম।
ইসলামভাই, দামিনীমাসিকে দেখতে পাচ্ছি না, কোথায় গেল দুটোতে।
সবাই কি তোর পেছন পেছন ঘুরবে।
পেছনে ঘুরতে হবে না। সামনে ঘুরলেই চলবে, তাহলে দেখতে পাব, আর জিজ্ঞাসা করবো না।
ছোটো বক বক করালেই ও পিছলে পালিয়ে যাবে। বড়োমা বললো।
বলো কি জানতে চাও।
আমি পাশ ফিরে বড়োমাদের মুখোমুখি হলাম।
তুই সুতপাকে বলেছিস কেন।
বক বক না করে সত্যিটা বলে ফেলি কি বলো।
তাই বল।
একসময় আমি রান্নাকরে খেতাম। সে কি কষ্ট তোমায় কি বলবো। সুরো থাকলে তবু হতো। এখন অনিমেষদা বৌদি দু-জনেরই বয়স হয়েছে। প্রত্যেকদিন রান্নাকরে খায়, এটা আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তার থেকে এখানে চলে এলে সবাই একসঙ্গে থাকা যাবে। প্রতিদিন ভালোমন্দ খাওয়া যাবে। বৌদিকে বলতে পারবো, তুমি আজ আলুরদমটা করো, বেগুন-ইলিশ মাছের ঝোলটা একটু কষা করে সরষে বাটা দিয়ে করো।
এটা সাদা কথা, কালো কথাটা কি বল?
বাবাঃ, তুমি যে সাদা, কালো শিখে গেছ! সেরেছে, অনিবাবু তোমার কাজ শেষ, এবার বড়োমা খেল শুরু করবে, তুমি তারাতারি পাত্তারি গোটাও।
বৌদি, জ্যেঠিমনি হেসে গড়িয়ে পরে।
তুই ভীষণ তেঁয়েটে জানিস। ছোটোমা বললো।
সেটা আজকে জানলে?
ছোটোমা উঠে এসে আমার গা ঘেঁষে খাটে বসলো।
তুমি আবার উঠে আসছো কেন। যুদ্ধটা জোড় করবার ধান্দা। সেটি হবে না মনে রেখ।
দাদা, দিদিরা কোথায়?
বাইরে ইসলামভাইয়ের গলা পেলাম। ওখান থেকে নিশ্চই ইশারা হলো।
তারপরেই দুজনের মুখ দেখলাম দরজার গোড়ায়।
জোড় মিটিং চলছে মনে হয়।
ইসলামভাই সোফায় গিয়ে বসলো, দামিনীমাসি আমার পায়ের কাছে।
ইসলাম একটি কথাও বলবে না, চুপ করে শুনে যাবে। বড়োমা বললো।
ইসলামভাই হাসছে। ছোটদি, লেগে গেছে?
ছোটোমা হাসলো।
তুমি এখন দলে ভাড়ি। আরও দুজনকে পেলে। সিক্স হর্স পাওয়ার। বড়োমার দিকে তাকালাম।
ছোটোমা আমার হাতটা চেপে ধরলো।
ঝামেলা করবে না, অজ্ঞান হয়ে যাব।
ছোটোমা হেসেই চলেছে।
আচ্ছা একটা সাধারণ কথাকে তোমরা এতো ঘোর প্যাঁচ মনে করছো কেন বলো?
তুই প্যাঁচোয়া তাই। ছোটোমা বললো।
ঠিক আছে আমি উইথড্র করে নিচ্ছি।
উইথড্র করে নিলেই হবে, মুখ থেকে যখন বার করেছিস তখন তুই করবি।
তাতে খারাপটা কি হবে।
খারাপের কথা বলছি না।
ছোটোমা আমার হাতদুটো চেপে ধরে আছে।
আঙুল মুটকে ভেঙে দেব।
আমি হাসছি। অনিসারা গেটের কাছে এসে দাঁড়ালো।
দিদাই তুমি বাবার সঙ্গে মারপিট করছো! দিদিভাই দেখবি আয়, দিদাই বাবা মারপিট করছে।
অনিকা গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ছোটোমা হাত ছেড়ে দিয়েছে।
আমি হাতদুটো জড়ো করে মাথায় ঠেকালাম।
প্রণাম করলেই ভাবলি রক্ষে পেয়ে গেলি।
এই যাত্রায়।
সুরোকে বলবো চিমটি কেটে তোর পেট থেকে কথা বার করে নেবে।
অনিকার দিকে তাকালাম। মুচকি মুচকি হাসছে। একবারে চেনাই যাচ্ছে না। সবাইকে ঝুঁকে পড়ে প্রণাম করলো। ইসলামভাইকেও বাদ দিল না।
শোন কেউ যদি চোখ মারে, এসে বলতে পারবি না।
বাবা…. তুমি না কি—
দেখ না দেখ। ছোটোমা বললো।
বৌদি হাসছে।
কিরে এতো সেজেছিস? অনিকার দিকে তাকালাম।
আমি সাজি নি, মামীমা, মিলিমনি সাজিয়ে দিল।
পুতুল সাজালো।
অনিকা মাথা নিচু করে রয়েছে।
যা বোনের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে আয়।
বাবা, এতে কি আছে বলোতো এতো ভাড়ি।
মা কোথায় রে?
ও ঘরে।
সাজা হয় নি?
ডাকবো।
ডাকতো।
আমি উঠে বসে টি-টেবিলটার ওপর ব্যাগটা রেখে ব্যাগের চেনটা খুললাম।
অনিমেষদা। চেঁচালাম।
কি হলো রে—
তোমরা সবাই একবার এদিকে এসো।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
অনিসা।
বলো।
আমার টেবিলের ড্রয়ারে দেখ একটা চামড়ার চাবির ব্যাগ আছে, ওটা একটু নিয়ে আয়।
অনিসা চলে গেল।
দাদারা একে একে ঘরে এসে খাটে বসলো।
এটা আবার কি করবি! অনিমেষদা বললো।
তখন তোমায় বললাম না একটা ছোটো কাজ আছে শেষ করবো।
অনিমেষদা হাসছে।
তারজন্য সাবইকে ডাকলি?
সাক্ষী রাখতে হবে না। পরে যদি কেউ পুলিশে খবর দেয়। ব্যাটা তুই সব মেরে দিয়েছিস।
ডাক্তারদাদা হেসে ফেললো। বান্ধবী ছেলের কথা শুনছো?
বোলো না। গরম খেয়ে আছে। এখুনি বলে বসবে এগুলো সব সাদা, কালোটা লুকিয়ে রেখেছি।
ছোটো ওর কানটা ধরতো, বজ্জাতের হাঁড়ি। বড়োমা দাঁতে দাঁত চিপে চেঁচিয়ে উঠলো।
অনিমেষদা, বৌদি হাসছে।
আমি ব্যাগের চেনটা খুলে ভেতর থেকে তিনটে বাক্স বার করলাম।
কিরে এ্যালবামগুলো কোথায়? অনিকার দিকে তাকালাম।
আমার কাছে।
নিয়েছিস কেন?
আমার, তাই।
বাবাকে দেখিয়েছিস?
মাথা দোলাল, দেখিয়েছে।
আমাকে ফেরত দিবি।
বোন নিয়ে নিয়েছে। সব ছবি স্ক্যান করেছে।
ওই আর একটা সব্বনেশে।
সব্বনেশে বলে তো এতো সব জানতে পারছি। আরও কতো কিছু করে রেখেছিস কে জানে। ছোটোমা বললো।
অনির মা হবে, টেনশন নেবে না, একটু কান্নাকাটি করবে না তা হয়।
দরকার নেই যা।
ঠিক আছে কাল ভোর হওয়ার আগেই অনি ফুরুত। রইলো ঝোলা, চললো ভোলা।
গেটের বাইরে যা না দেখি। বড়োমা চেঁচালো।
আমি চুপ করে গিয়ে কাজে মন দিলাম।
একটা বাক্সের ওপর লেখা নাসরিন স্ল্যাশ অনিকা। ইসলামভাই একবার আমার মুখের দিকে একবার বাক্সটার দিকে তাকাচ্ছে। মুখের ছবিটা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
আমি বাক্সের তালাটা একবার দেখলাম মরচে পরে একবারে আটকে রয়েছে। চাবিতে মনে হয় কাজ হবে না। তবু একবার নাড়াচাড়া করলাম।
আমার একপাশে অনিমেষদা আর একপাশে ছোটোমা। সবাই খাটে বসেছে। দামিনীমাসি দাঁড়িয়ে।
অনিসা চাবির গোছাটা এনে আমার হাতে দিল। ওর পেছন পেছন সবাই চলে এসেছে। কেমন যেন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে।
মাসি তালাটা মনে হয় খুলতে পারবো না। ভাঙতে হবে।
আজ থাক না, কাল সকালে খুলিশ।
না মাসি আজকের কাজটা আজকেই করতে হবে, কালকের জন্য ফেলে রাখবো না। রান্নাঘর থেকে ষাঁড়াসিটা নিয়ে এসো।
সারাটা ঘর নিস্তব্ধ। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে।
অনিমেষদা।
বল।
অনিকার মাকে দেখেছ?
সকালে ছবিটা দেখলাম।
ব্যাগে যে ফাইলটা ছিল সেটা নাড়া চাড়া করেছিলে?
অনিমেষদা চুপ করে রইলো।
দেখবে ওখানে কৃষ্ণনগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালের বার্থ সার্টিফিকেট রয়েছে। ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে আমার সই আছে। বার্থ সার্টিফিকেটে অনিকার মায়ের সই। আর দুটো সার্টিফিকেট মেডিকেলের। পক্কের মা পক্কে হতে গিয়ে মরে গেছে। নীরু, কনিষ্ক বহু চেষ্টা করেছিল বাঁচাতে, পারেনি। ঘণ্টার মা আমার কথা না শুনে রোগে ভুগে মরেছে। ঘণ্টার বার্থ সার্টিফিকেটে নীরুর সই পাবে, আর পক্কেরটায় কনিষ্কর সই দেখতে পাবে। বাবার পরিচয় জানি না।
মাসি এসে গেটের কাছে দাঁড়াল।
অনিকা সাঁড়াসিটা দে—
অনিকা মাসির হাত থেকে সাঁড়াসিটা দিল।
জানো দাদা এই বাক্সটা পঁচিশ বছর আগে তালা দেওয়া হয়েছিল তখন কিন্তু জানতাম না আজকে ঠিক এই মুহূর্তে তোমাদের সামনে বাক্সটা খুলবো। তবে একটা স্বপ্ন দেখতাম অনিকাকে নিয়ে। তখন তুমি, বৌদি, সুরো ছাড়া আমার জীবনে কেউ ছিল না। মিত্রা হারিয়ে গেছে। জীবনে প্রথম মেরিনাদিকে দিদি বলে ডাকি। কলকাতায় আমার গণিকাপল্লীর অলিখিত লোকাল গার্জেন।
গণিকা পল্লীতে যে দুটো মানুষ আমাকে নিঃসার্থ ভাবে ভেলোবেসেছিল তার মধ্যে ভজু প্রথম। এমনও দিন গেছে, ভজুকে কেউ কিছু আনতে দিলে যদি দুটো টাকা ফিরতো তাহলে মুড়ি-ফুলুরি দু-ঠোঙা কিনে আনতো, একঠোঙা আমার একঠোঙা ওর। এছাড়া ভজুর ভাতের থালাতেও অনেকদিন ভাগ বসিয়েছি।
ওর মাধ্যমেই মেরিনাদি প্রথম আমার ঘরে এলো। ধীরে ধীরে তৈরি হলো ভাই-বোনের সম্পর্ক। কিন্তু কেউ জানলো না। একমাত্র ভজু ছাড়া। এইরকম বহুদিন গেছে, মেরিনাদিকে আমার ঘরে আসার জন্য মাসির হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে আসতে হয়েছে। কথাটা যেন ইসলামভাইয়ের কানে না যায়। তবু পৌঁছে যেত।
কলকাতায় এসে আমার জীবনের প্রথম মেয়ে মিত্রা। দ্বিতীয় মেরিনাদি। তৃতীয় সুরো। ভজুকে আমি এদের সঙ্গে কখনও গুলিয়ে ফেলি নি। ও একবারে স্বতন্ত্র ধারার মানুষ। ওর সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্কের থেকেও বড়ো সম্পর্ক।
একটু থামলাম।
সব কথা বললেও এই কথাটা তোমাদের কাছে গোপন রেখেছিলাম। কেন জানিনা কথাটা মুখ ফুটে বলতে সাহসে কুলোয় নি। তাই তোমাকে ডাকলাম। আজ তোমাদের সকলের সামনে খুলছি। শেষ বার তালাটা মেরিনাদি নিজে হাতে দিয়েছিল।
ঘরে পিন পরলে শব্দ হবে।
আমি তালাটা ভাঙলাম। বড়োমার দিকে তাকালাম। বাক্সের ঢাকনা খুললাম।
সবার চোখ বাক্সের ভেতর। সোনার গয়নায় ঠাসা।
অনিমেষদা।
আনিমেষদা কোনও কথা বললো না, আমার দিকে হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে রইলো।
এই গয়নাগুলো মেরিনাদি তার নিজের রোজগারে বানিয়েছিল মেয়ের জন্য। প্রত্যেকটা গয়না বড়ো দেকান থেকে কেনা। তাদের শিলমোহর আছে। কিছু ইসলামভাই মেরিনাদিকে কিনে দিয়েছিল।
ইসলামভাই ওর্না দিয়ে চোখ মুছছে।
সামান্য গুঞ্জন, ঘরের দরজার দিকে তাকালাম। বিধানদা, অনুপদা, রূপায়ণদা, ইকবালভাই এসে দাঁড়িয়েছে।
আসুন বিধানবাবু।
সব এই ঘরে ভিড় করেছো ব্যাপারটা কি অনিমেষ!
বসুন সব বলছি।
বিধানদা ঘরে ঢুকে দাদার পাশে বসলো।
ওরা দাঁড়িয়ে রইলো।
ইসলামভাই—
ইসলামভাই কোনও কথা বললো না। ছল ছলে চোখে আমার দিকে তাকাল।
আমি আজ একটু পরে অনিকাকে নিয়ে একটা শুভকাজে বেরবো। আমার আসল নকল সব ছেলেমেয়েরা আমার সঙ্গে থাকবে। আমি মন থেকে চাই অনিকার সঙ্গে মেরিনাদিও আমার সঙ্গে থাকবে।
তুমি জীবনে প্রথম যে লকেটটা মেরিনাদির গলায় পড়িয়ে দিয়েছিলে সেটা খুঁজে বার করে অনিকার গলায় পড়িয়ে দাও।
আমি পারবো না। ইসলামভাই ডুকরে কেঁদে উঠলো।
কেন পারবে না! আমি পঁচিশ বছর ধরে যা পরলাম, তুমি একমিনিটের জন্য এটা পারবে না! খুব একটা কঠিন কাজ নয়। এর থেকেও অনেক কঠিন কাজ তুমি তোমার জীবনে করেছো।
আমার হয়ে তুই পড়িয়ে দে। তুই ওর আসল বাবা।
ডিএনএ টেস্ট করতে পারো।
থম থমে ঘর কারুর মুখে কোনও কথা নেই।
আমি গয়নাগুলো সব বাক্স থেকে বার করে টেবিলের ওপর রাখলাম। সোনার নিক্কনের সুর চারদিকে ভেসে বেরাচ্ছে। আমি বড়ো লকেট দেওয়া হারটা হাতে তুলে নিলাম।
মাসি।
বল।
এই হারটা আমরা তিনজন ছাড়া এ ঘরের কেউ চিনবে না। আমি কি ঠিকটা তুলেছি।
মাসি চুপ করে রইলো। মাথা নিচু করে রয়েছে। চোখ ছলছলে।
আমি লকেটের পেছনের হুকটা খুলে ফেললাম। লকেটের ভেতরের অংশটা উন্মুক্ত হলো। অনিকার হাতে হারটা দিলাম।
দেখ, তুই অনাথ নয়। অন্ততঃপক্ষে তোর মাতৃ পরিচয়, পিতৃ পরিচয় আছে। এটা তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। তুই আমাকে অনেক জ্বালিয়েছিস। তার সঠিক উত্তর তোকে তখন দিতে পারিনি। নিজের চোখে দেখে নে। বাবার কাছে গিয়ে গলায় হারটা পর। তোর মা অন্ততঃ শান্তি পাবে।
অনিকা স্থানুর মতো ইসলামভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেল। ইসলামভাই উঠে দাঁড়িয়ে অনিকাকে জড়িয়ে ধরে অঝোড়ে কেঁদে ফেললো।
থম থমে পরিবেশ।
কেঁদো না। অনিমামার বুকে অনেক জ্বালা। তোমাকে বলবো। দেখো, আমি কাঁদছি না।
বড়োমার দিকে তাকালাম। কেমনভাবে যেন আমার দিকে তাকিয়ে।
জানো বৌদি, এই হারটা যেদিন ইসলামভাই মেরিনাদিকে দিয়েছিল, তার পরদিন আমার এমএ-র ফার্স্ট পেপার।
তোমার বাড়ি থেকে রুটি বাটি চচ্চড়ি খেয়ে ফিরেছিলাম। রাতে আর খাওয়া জোটে নি।
মাঝ রাতে মেরিনাদি এলো আমার ঘরে। ভজু শুয়েছিল। আমাকে খোলা ছাদে নিয়ে গেল। বাচ্চা মেয়ের মতো ফুপিয়ে কেঁদে ফললো। আমি জানালাম অনিকা মেরিনাদির শরীরে আশ্রয় নিয়েছে। মাতৃত্বে একটা মেয়ের পরিপূর্ণতা। তার ভালোবাসার প্রথম ফল।
কিছুতেই ওই পঙ্কিল পথে সে থাকতে চায় না। প্রথমে দিদির ডাকে সারা দিইনি। তারপর বলেছিল তুই আমাকে দিদি বলে ডাকিস। আমার থেকে ছোটো। দিদির বিপদের সময় পাসে দাঁড়াবি না? আমার পা ধরে ফেলেছিল।
ওকে সেদিন ফিরিয়ে দিতে পারিনি। অনেক ঝুঁকি নিয়ে আমি মেরিনাদিকে সাহায্য করেছিলাম। অনেক ঝড় সামলেছি। অনিকার যখন ন-মাস বয়স, তখন মেরিনাদিকে আমি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হই ফাদারের কাছ থেকে। ইসলামভাই সেই রাতে পার্টি দিয়েছিল, খানাপিনা হয়েছিল, সেইরাতে ইসলামভাই মেরিনাদিকে এই হারটা উপহার দিয়েছিল।
একটা বিছে হার গয়নার মধ্যে থেকে তুললাম।
একটু থামলাম।
এরপর মা মেয়ের একবার সাক্ষাৎকার হয়েছিল। সেটাই শেষ।
অনেক ইতিহাস আছে এই হারটার। দেখবে অনিকাকে নিয়ে এই হার পড়া অবস্থায় মেরিনাদির মাত্র দুটো ছবি আছে।
তোমরা হয়তো ভাবছো, অনি এই পাগলামোটা তুই এই মুহূর্তে করছিস কেন। এটা কি কাল করলে হতো না?
হয়তো হতো। কিন্তু এই তারিখটার জন্য আমাকে একবছর অপেক্ষা করতে হতো। বিগত পাঁচবছর ধরে এই খেলাই আমি খেলে চলেছি।
একটা মেয়ে মরে গিয়ে কর্মের জগতে অনি ব্যানার্জীর জন্ম দিয়েছিল। আজ থেকে ঠিক পঁচিশ বছর আগে।
তখন আমার পরিবারে আমাকে নিয়ে ছটা প্রাণ। ভজু, আমি, তোমরা তিনজন, সর্বকনিষ্ঠ অনিকা।
চলবে —————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/P7NIYCu
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment