❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৭৮ নং কিস্তি
—————————–
ফোনটা বন্ধ করেই রতনের দিকে তাকালাম। রতন মুচকি মুচকি হাসছে।
রতন সামনে ওই যে চূড়োটা দেখা যাচ্ছে।
হ্যাঁ।
ওটা মনসা মন্দির। তোকে ডানদিকের লেনে যেতে হবে।
সামনে নিশ্চই একটা ক্রসিং পাব।
বলতে পারবো না। বহু দিন আসিনি।
রতন রাইটটার্ণ ইন্টিগেটার জ্বালিয়ে দিল।
একটুখানি যেতেই ডানদিকের লনের ঘোরার রাস্তা পাওয়া গেল। সামান্যক্ষণ দাঁড়াতে হলো, মুর্হূ মুর্হূ গাড়ি আসছে। জানলা দিয়ে মুখ বারিয়ে পেছনে তাকালাম আমাদের গাড়িগুলো সব পর পর পেছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
থিক থিক করছে কালো মানুষের ভিড়।
মন্দির থেকে একটু দূরে রতন গাড়ি দাঁড় করাতেই শিবু, দারু, ছুড়কি হুমড়ি খেয়ে পরলো।
আমাকে দেখে তিনজনেই হাসছে।
শিবু অনিদার বডিগার্ড দেখছু। দারু বললো।
মাম্পি-মিকি দুজনেই আমার শরীরে সঙ্গে সেঁটে গেছে। কট কট করে দারুর দিকে তাকিয়ে।
এউটা কনিষ্কদার মায়ঝি। শিবু বললো।
হ।
শিবু জনলা দিয়েই মাম্পির গাল টিপে দিয়েছে।
মাম্পি ভ্যাট করে উঠলো।
ও রে কটকটি।
দুষ্টু।
মাম্পি বাঁ হাত দিয়ে নিজের গাল মুছছে। ওরা হাসছে।
তুই চল সেউঠি তোর গালে করে সিঁদুর ল্যাপবো।
এক থাপ্পর।
দু-জনেই আমার কোলে বসে। দারু, শিবু ওদের কথায় হাসে।
নীরুরা হাসতে হাসতে গাড়ি থেকে নমলো।
চল এবার নামি। আমি বললাম।
না। ওরা ধরে নিয়ে যাবে।
দারুরা দরজা ধরে হেসেই যায়।
তুর আঙ্কেলকে মোরা ধরি লিয়ে যাবে তুই রুখতি পারবেক লাই।
দারুর কথায় ওরা আরও রেগে যায়।
চল, ওই দেখ মা নেমে পড়েছে।
ওরা তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে?
যাবে না। তোকে ওই আঙ্কেলটা ক্যাটবেরি দিয়েছিল মনে আছে।
এবার মিকি আমার মুখের দিকে একটুক্ষণ তাকাল।
ওরা ভালো।
আমি মাথা দোলালাম।
ততক্ষণে মিত্রারা গাড়ির সামনে এসে ভিড় করেছে। ওদের কীর্তিকলাপ দেখে হাসে।
ছুড়কি দেখি বড়োমার পায়ে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়েছে।
শিবুও এগিয়ে গেছে।
আমি ওদের দু-টোকে সঙ্গে নিয়ে নামলাম।
দারু দু-টোকে কোলে নিতে চাইলো কিছুতেই উঠলো না। আমার হাত শক্ত করে ধরেছে।
নীরু মনে হয় মিলির পেছনে লেগে পড়েছে। এবার শ্রীপর্ণাকে দেখলাম।
সবাই বেশ খুশী।
আমি দু-টোকে নিয়ে নড়তে চড়তে পারছি না। ঠ্যাং চেপে ধরে আছে।
বড়োমা নিজেই কাছে এগিয়ে এলো।
কিরে মন্দিরে যাবি না?
ওই তো মন্দির, যাও।
ছোটোমা এগিয়ে এসে মাম্পির হাত ধরতে চাইলো। ছাড়িয়ে নিল।
তোর আবার কি হলো?
ওর আঙ্কেলকে ওরা ধরে নিয়ে যাবে। তাই। কনিষ্ক বললো।
দারুরা হাসে।
ও অনি মিষ্টির দোকান।
হাসলাম। বড়োমার দিকে তাকালাম।
এ কি তোমার কালীঘাট। যে প্যাঁরা পাবে?
বড়োমা মুখ ভ্যাটকাল।
পাশের ওই ঝুপড়িতে চিঁড়ে, মধু আর দুধ পাওয়া যায় ওটাই প্রসাদ। তাও বেশি চাইলে পাবে না। এবার যদি মন চায় কিনে পূজো দাও।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
ঠিক আছে তুমি দারুকে জিজ্ঞাসা করো।
দারু হাসছে। হঁ রে বড়োমা, অনিদা মিছে বলে নাই, মন্যে গরিব মানুষ মিষ্টি কাই পাব, ঘরের গরুর দুধ, খেতের ধানের চিঁড়া আর বনের মধু। মন্যেও তাই খাই ঠাকুরও খায়।
বড়োমা কেমন থম মেরে গেল।
ছুড়কির দিকে তাকলাম।
দেখ তোর দিদা এসেছে। বুড়িকে নামিয়ে নিয়ে আয়।
দিদা মন্দিরকে গেছে।
বড়োমাকে বললাম যাও ওরা সব ব্যবস্থা করে দেবে।
বড়োমা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল।
ছুড়কি বড়োমাদের সকলকে মন্দিরের দিকে নিয়ে গেল।
অদ্ভূত নিস্তব্ধতা চারদিকে। মাঝে মাঝে সুই সুই আওয়াজে গাড়িগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে।
মন্দিরটা কতো প্রাচীন জানি না। শরীরটা একবারে জরার্জীর্ণ। মন্দিরের গায়ের ইঁটগুলো নোনা ধরে একবারে শেষ। একটা বিশাল বটগাছ তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে মন্দিরটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। ঠাকুর বলতে একটা শিলা। লাল সিঁদুরে ঢাকা পরে গেছে তার আদি অকৃত্তিম রূপ।
শুনেছিলাম এই তল্লাটে একসময় এক ভদ্রলোক বৃটিশদের কাছ থেকে এই জঙ্গলের ইজারা নিয়েছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে জমিদার বনে যান। মন্দির নাকি তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সে যে কতো কাল আগের কথা কে জানে।
মন্দিরের ভেতরটা অন্ধকার অন্ধকার। রাতে কেউ এই তল্লাটে থাকে না। পাবলিক বাস এই রাস্তায় খুব কম চলে। যেটুকু চলে তারা যাওয়া আসার পথে পয়সা ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিয়ে যায়। মন্দিরের যেটুকু আয় সেইখান থেকে। বাকি সব ভোঁ ভাঁ।
মাম্পি মিকি কিচির মিচির করছে। বড়োমারা কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় মধু দিয়ে চিঁড়ে মাখা আর মাটির ভাঁড়ে দুধ নিয়ে মন্দিরে উঠছে। হাতে সবার বনফুলের মালা। কোনটার রং গাড় কমলা কোনটার রং টকটকে হলুদ। একটা ফুলেরও নাম জানি না। কিন্তু দেখতে কি মিষ্টি। এখানকার মানুষের মতোই এদের স্বভাব। শহরের লোকেরা এদের মাহাত্ম্য বোঝে না। এরা এদের মতো ফুটে নিজেকে প্রকাশ করে।
অংশু, সুবীর, বরুণদা কাউকেই মন্দিরের আশে পাশে দেখছি না।
এলাকায় নতুন মানুষ তাই আমাদের দেখার আগ্রহ সকলের। আমাদের কেতাদুরস্ত কথাবার্তা, চালচলন দেখে অনেকেই অবাক। বাচ্চাগুলোর কারুর কোমরেই এক ফোঁটা বস্ত্র নেই। কারুর আদিম মানুষ দেখার সখ থাকলে অনায়াসেই এখানে চলে আসতে পারে।
বুবুন বড়োমা ডাকছে।
মিত্রার গলা পেয়ে তাকালাম। দেখলাম মন্দিরের ছোট্ট চাতালে দাঁড়িয়ে মিত্রা হাসছে। কপালে জ্বল জ্বল করছে ডগ ডগে লাল সিঁদুরের টিপ। সিঁথিতেও তার পরশ লেগে। হঠাৎ খেয়াল পরলো মাম্পি, মিকি হাত ছেড়ে কখন চলেগেছে।
বুকটা ধরাস করে উঠলো। এদিক ওদিকে ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে দেখলাম।
ওরা মন্দিরে, তোকে আর খুঁজতে হবে না। মিত্রা বললো।
এতক্ষণে খেয়াল পরলো আরে সুন্দররা এসেছে। গেলো কোথায়? পাঁচ পাঁচটা গাড়ি সব কটা গাড়িতেই মানুষে ঠাসা। কম লোক নয়।
আমি ধীর পায়ে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলাম।
দেখলাম মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি ভিড় করেছে। পুরুষ বলতে একমাত্র মিকি। বৌদিকে ধারে কাছে দেখতে পেলাম না।
কাছে আসতেই ব্রাহ্মণ মশাই আমার দিকে তাকিয়ে। হয়তো এই তল্লাটে এই একটা পরিবারই ব্রাহ্মণ। এক মাত্র উচ্চ বর্ণের মানুষ।
আপনার কথা আমার বাবার মুখ থেকে শুনেছি।
ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। বয়স নেহাত খারাপ নয়, আমার বয়সী কিংবা আমার থেকে দু-চার বছরের বড়োই হবে।
বাবার কাছ থেকে কেন শুনতে হবে! আপনি কি এখানে থাকতেন না?
আমি ঘাটশিলাতে থাকতাম। ওখানে আমার একটা দোকান আছে। বাবা গতো হতে চলে এসেছি। ছেলেরা এখন সব দেখা-শুনো করে। এই দেবতার পূজো আমরা তিনপুরুষ ধরে করে আসছি। এখন সেই জমিদারও নেই। মন্দিরের সেই জৌলুষও নেই।
বুঝলাম পরবর্তী প্রজন্ম আদৌ এই মন্দিরের শিঁড়ি মারাবে কিনা সন্দেহ।
উনি আমার মাথায় রক্ত তিলক এঁকে দিলেন হাতে দিলেন চরণামৃত। খেলাম।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
মৌসুমীমাসি মন্দিরের এক কোনায় বসে। ঘসা কাঁচের মতো চোখে সব ফ্যাকাশে।
ও বড়োমা অনি আসছে?
এসেছে।
ওকে টুকু ঠাকরের জল দাও।
ব্রাহ্মণ ঠাকুর দিয়েছেন।
দিছে।
মাসি চুপ করে গেল। এদিক ওদিক তাকায় আমি কোথায় ঠিক ঠাহর করতে পারে না।
তনু দেখলাম বেশ গুছিয়ে ছোটোমা, জ্যেঠিমনির মাঝখানে বসেছে। মাথায় লাল টিপ জ্বলজ্বল করছে।
ছেলেগুলো গেল কোথায় মিত্রা? বড়োমা বললো।
কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
একবার ডাক না।
ডাকলেও এখন কেউ আসবে না। তারা এপাশ ওপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছে।
এবার চলো বেলা হয়ে যাচ্ছে। যেতে কষ্ট হবে। আমি বললাম।
সবাই উঠলো। ছোটোমা গিঁট বাঁধা আঁচল আমার গায়ে মাথায় বুলিয়ে দিল।
এটা কি!
সব জানার উৎসাহ কিসের।
হাসলাম।
বড়োমা একটুখানি চিঁড়ে মধু আমাকে দিল। মুখে দিলাম। মন্দিরের বাইরে এসে দেখলাম সবার হাতেই চিঁড়ে মধুর ঠোঙা।
বরুণদা হাসতে হাসতে বললো, তোমার এক্সপিরিয়েন্স সকলের সঙ্গে শেয়ার করছি।
আমি হাসছি।
আর আছে না শেষ?
শেষ।
দারু কাছে এসে বললো, আর বড়ো রাস্তা দিয়ে যাবক লাই। নদী ধর দিয়ে চইলে যাব। টুকু কম সময় লাগবে।
রতনরা চালাতে পারবে না।
ঠিক পারবেক। অইস্তে চালাইবে।
বিপদ হলে গণ্ডগোল।
হবেক লাই।
রতনকে ডেকে বললাম দারু কি বলছে শোন।
শুনেছি। পারবো।
শুধু তুই পারলে হবে না। সবাই পারবে কিনা জিজ্ঞাসা কর।
পারবে বলেছে।
মিত্রা কাছে এসে দাঁড়াল। চোখ হাসছে। বড়োমা বললো, মাঝে একটা জায়গায় একটু থামাস অনেক খাবার আছে একটু সদগতি করতে হবে।
হাসলাম। মধু চিঁড়ে খেয়েছিস?
অমৃত। তনু প্যাকেট করে নিয়েছে পরে আবার খাব।
যা গাড়িতে উঠে বোস।
মিত্রা চলে গেল।
যে যার গাড়িতে উঠলাম। মন্দিরকে পেছনে রেখে আবার যাত্রা শুরু।
এবার ডান দিকের রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে লালমাটির রাস্তায় গাড়ি নেমে এলো।
অসমান রাস্তা। নতুন হাঁটতে শেখা শিশুর মতো গাড়ি টাল খেতে খেতে হেলতে দুলতে এগিয়ে চলেছে। প্রত্যেকটা গাড়ির মাথায় চারটে করে ছেলে। বুঝলাম কেউ খালি হাতে নেই। আমার গাড়ি সবার প্রথমে দারু তার মাথায় রয়েছে।
মাম্পি, মিকি এবার তাদের মায়ের কাছে।
রতন গাড়ির কাঁচ নামিয়ে আর এসি চালাল না। মনে হচ্ছে সকাল বেলা বেশ কয়েক পসলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে জল জমে আছে।
ধীরে ধীরে শালবনের গভীর জঙ্গল আমাদের গাড়িটাকে গ্রাস করে নিল। আমরা ঢুকে পরলাম গহীণ অরণ্যে। বিশাল বিশাল শালগাছ তার মাঝখান দিয়ে এঁকে বেঁকে রাস্তা চলে গেছে। ধারে কাছে কোনও জনপ্রাণী নেই। যে দিকে তাকও সবুজ আর সবুজ।
কিছুটা এগিয়ে এসেই পাহাড়ে চরা শুরু হয়ে গেল। পাহাড় বললে ভুল বলা হবে। তার থেকে টিলা বলা ভালো। তবু এই অঞ্চলের লোকেরা বলে পাহাড়।
জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দারুকে বললাম।
গাঙনার মুখে গাড়িটাকে একটু দাঁড় করাস। বড়োমাদের খিদে পেয়েছে।
সেঠি খাইলুনি কেনে।
কেন, কোনও সমস্যা আছে।
মোনকার ঘর, সমস্যা কিসের।
বুঝিস তো সব।
ঠিক আছে তোকে আর কইতি হবে নি।
কনিষ্ক, নীরু গাড়ির দুই জানলার ধারে বসেছে। এক দৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে।
বটা, দেবা সামনের উইন্ড স্ক্রিন দিয়ে বাইরে চোখ রেখেছে।
কনি আমরা এই রাস্তায় জন্মেও আসিনি। বটা বললো।
আমরা এসেছি ট্রেনে। তারপর ওরা সাইকেলে কিংবা বাইকে নিয়ে গেছে।
শালা না এলে কি মিস করতাম বল। ঢ্যামনা নিজের বউদের নিয়ে এই পথে ফস্টি নস্টি করতে করতে যেত। আর আমরা গল্প শুনতাম।
রতন ফিক করে হেসে ফেললো।
যাই বল রতনদা এখানে পুলিশ ঢুকে দারুদাদের খেদাবে! আর একবার জম্মে আসতে হবে। শালারা এমনি লাঠি ধরতে পারে না। চাঁদ চেঁচিয়ে উঠলো।
খালি বক বক চুপ থাক। চিনা বলে উঠলো।
শালা কলকাতায় এ্যাকসান করা আর এখানে এ্যাকসান করা আকাশ পাতাল তফাৎ।
রতন সামনের দিকে তাকিয়েই মুচকি হাসলো।
দিনের বেলা যদি এই হাল হয় রাতের বেলা তাহলে কি অবস্থা একবার ভাব। চিনা বললো।
নীরু এই গাছগুলো কেন্দু গাছ। আমি বললাম।
বিড়ির পাতা। চিনা বললো।
হ্যাঁ।
নিচে দেখছিস পাকা পাতা পড়ে রয়েছে।
হ্যাঁ।
এখানকার মানুষের একমাত্র জীবিকা। একশো পাতা জোগাড় করতে পারলে দু-টাকা।
সারাদিনের ইনকাম দুটাকা! চিনা বললো।
না। দশ বারোটাকা হয়। হায়েস্ট কুড়ি টাকা।
শালা সাগরটাকে গিয়েই গিড়িয়ে দেব। অনিদা বারন করলেও শুনবো না।
চিনার কথায় কনিষ্করা জোড়ে হেসে উঠলো।
হেসো না কনিষ্কদা, একটা মানুষ সারাদিন পাতা কুড়িয়ে কুড়ি টাকা!
আর আমরা এক প্যাকেট সিগারেট কিনি পঞ্চাশ টাকা দিয়ে। অনিদা এদের জন্য কিছু করতে চাইছে আর হারামী সাগর, অনাদি ঘুঁটি বসাচ্ছে।
কুড়ি টাকা হচ্ছে ভালো পাতার রেট। মাঝারি পাতার রেট পনেরো। বাকি সব দশটাকা।
কোন শালারা কেনে কলকাতায় গিয়ে পাত্তা লাগাতে হবে। ওরা শালা এখান থেকে কড়কাবে আমি শালা ওদের থেকে কড়কাবো। তারপর সব এখানে পাঠিয়ে দেব। এবার থেকে তোলার রেটটা বাড়িয়ে দিতে হবে।
কনিষ্ক-বটা চাঁদের কথা শুনে হাসতে হাসতে কেশে ফেললো।
সত্যি অনিদা তোমার সঙ্গে না এলে কিছুই জানতে পারতাম না। চাঁদ বললো।
এসব শুনলে আবিদটা খুব গালাগাল করবে-রে। রতন বললো।
অনিদা। দারু গাড়ির মাথা থেকে চেঁচাল।
আমি জানলা দিয়ে মুখ বার করলাম।
বল।
হা সাইমনে সেউ টিলায় যেউ ঝোড়াটা আইছে সেউঠি দাঁড়াইঠি এন্যে জল খাতি পাইরবেক।
তাই দাঁড় করা।
পাহাড়ী রাস্তা শুরু হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে আমরা ওপরের দিকে উঠছি। আবার নেমে পড়ছি। চারদিকে শালগাছে ঘেরা একটা সমতল জায়গায় এসে আমাদের গাড়িটা দাঁড়াল। মাথার ওপর খোলা আকাশ, ঝকঝকে রোদ। যেদিকে তাকাও সেদিকেই সবুজ।
দারুরা ঝপাঝপ গাড়ির মাথা থেকে নেমে এলো।
এবার আর কোনও লুকো-ছাপার বালাই নেই। প্রত্যেকের হাতেই এসএলআর ঝক ঝক করছে। একেবারে আধুনিক অস্ত্র। অস্ত্রের স্থান কারুর হাতে কারুর পিঠে।
গাড়ি থেকে নেমে এসে একটু নিচের দিকে তাকালাম, দেখলাম পেছনের গাড়িগুলো বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসছে।
সব কটা গাড়িই কিছুটা সময় নিয়ে ওপরে উঠে এসে একে একে দাঁড়াল।
সুন্দর, পক্কে, ঘণ্টা গাড়ি থেকে নেমেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো।
তুমি এবার আমাদের গাড়িতে, কিছুই জানতে পারছি না। মনের সুখে ছবি তুলে যাচ্ছি।
একে একে সবাই গাড়ি থেকে নামছে।
ভজু, বড়োমাদের ধরে ধরে নামাচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে ছোটোমা হাসলো।
সুরো কাছে এসে বললো। এবার তোমাকে আমাদের গাড়িতে উঠতে হবে।
বরুণদারা নেমে চারিদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে।
ইসি এখান থেকে একবার ওই দিকটায় তাকাও। বরুণদা চেঁচিয়ে উঠলো।
বরুণদার গলার স্বর পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে রিনি-ঝিনি সুরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
অনি তোমার মতো লিখতে পারলে দু-পংক্তি কবিতা লিখে ফেলতাম।
হাসলাম।
অংশু কাছে এগিয়ে এলো। হাতটা টেনে নিয়ে শক্ত করে ধরলো।
সত্যি অনিদা এতো সবুজ আগে কখনও দেখিনি। চোখ আর কানের আয়ু বেড়ে গেল।
ওরা সব নিজের মতো করে এলোমেলো হয়ে গেল। মৌসুমিমাসি ছুড়কিকে ডেকে মনেহয় কিছু বলছে। ছুড়কি মাথা দোলাচ্ছে। আরও তিন-চারজন মৌসুমিমাসির পাশে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে কথা শুনছে। কেউ হয়তো মাসিকে দেখেছে, কেউ দেখেনি।
চারিদিকে পাহাড় ঘেরা খোলা আকাশের তলায় সবাই যেন সবুজের মধ্যে হারিয়ে যেতে চাইছে।
ছোট্ট এই টিলাটায় আমাদের গোটা তিরিশেক প্রাণীর হই হই শব্দে নিঝুম নিস্তব্ধতা টুকরো টুকরো হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
ছোটোমারা গাড়ি থেক নেমে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বুঝলাম পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরে গেছে।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
সুরোর দিকে তাকালাম।
কিছুই বুঝতে পারছি না। যেদিকে তাকাও খালি শালবন।
এই জায়গাটার নাম ডুলুংপোতা। তুই যদি এই নামের অর্থ খুঁজতে যাস বৃথা। অঞ্চলটায় শাল, সেগুন, মহুয়া, মেহগিনি সব মূল্যবান গাছে ভরা। তবে শাল গাছের সংখ্যা বেশি।
আর আছে কেন্দুপাতার গাছ। যার থেকে বিড়ি তৈরি হয়।
গাছটা দেখাও।
ছুড়কিকে বল দেখিয়ে দেবে।
আর তুই প্রচুর মৌচাক পাবি। বেশ বড়ো বড়ো মৌচাক। আমরা চিনি খাই এরা মধু খায়। তাই আদিবাসীদের স্বভাব এতো মিষ্টি।
তনু আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে।
মহুয়া গাছও পাবি। যার থেকে মৌল মদ তৈরি হয়। হাতিরা এখানে দল বেঁধে আসে মহুয়া ফুল, ফল খেতে। খেলে নেশা হয়। মনে ফুর্তি জাগে।
সুরো হাসছে।
বিশ্বাস হচ্ছে না?
মিত্রা, তনু, ইসি, মিলিরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
জানিস আমি আমার অনুভূতি দিয়ে যে টুকু বুঝেছি, প্রকৃতি সবসময় নিরপেক্ষ। কারুর দিকে ঝোল টানে না। নিজের শরীরটাকে কি সুন্দর সাজিয়ে-গুছিয়ে সবার ভোগের জন্য রেখে দিয়েছে। তুমি যথেচ্ছ ভোগ করো। কিন্তু লোভ কোরো না। করলেই বিপদ। সে তুই বনের প্রাণী জগত বল, আর আমাদের মতো সভ্য মানুষের কথা বল। নিয়মটা এখানে সবার জন্য সমান।
এখান থেকে এবার ওই দিকটা তাকিয়ে দেখ। যে পথে উঠে এলি সেটা কিরকম লাগছে।
ওরা আমার কথা শুনে তাকাল। সবার চোখ স্থির।
ধীরে ধীরে সকলে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
এঁকে বেঁকে রাস্তাটা গহীন বনের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তার হদিস মেলা ভার।
দূরে ওই মন্দিরের চূড়োটা দেখতে পাচ্ছিস।
মিত্রা পরিতৃপ্ত চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আস্তে করে বললো।
আজ বুঝতে পারছি কেন তোর ভালোপাহাড়ের সঙ্গে এতো ভালোবাসা।
বড়োমা শুনতে পেয়েছে, মুখ টিপে হাসছে।
এক সময় এই তল্লাটটা ছিল ভঞ্জদেওরাও বলে এক রাজাদের। রুট যদি জানতে চাস তাহলে তারা ছিল এমপির লোক। মোগলদের হাতে পায়ে ধরে এই তালুকটা পেয়েছিল। সেই সময় প্রচুর টাকা উপঢৌকন দিতে হতো রাজাকে। কেননা এটা ছিল মিনারেল বেল্ট। এরপর ভঞ্জদেওরাওরা আবার দুটো পার্টে ভাগ হয়ে গেল। একটা পার্ট ভঞ্জ টাইটেল নিয়ে চলে এলো বেঙ্গল, আর একটা পার্ট দেওরাও টাইটেল নিয়ে চলে গেল ওড়িষ্যা। আবার আর একটা পার্ট অন্ধ্রে গিয়ে দেওটাকে ছেঁটে দিয়ে রাও টাইটেল নিয়ে বসবাস করতে লাগলো। এরাও সব রাজা। জায়গা প্রচুর, মানুষ বাসের লোক নেই। তাই ছত্রিশগড় অঞ্চল থেকে এই সব আদিবাসীদের ধরে নিয়ে এলো। এই অঞ্চলটা খনিজ সমৃদ্ধ। আদিবাসীরাও কাজ পেল। কিন্তু ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত।
দেখিসনি বৃটিশরা কেন বিপ্লবীদের দ্বীপান্তরে পাঠাত। শাস্তি দেওয়ার জন্য? শাস্তি অবশ্যই ছিল কিন্তু তার পাশা পাশি আন্দামানে তৈরি করতে হবে জনবসতি। সমুদ্রের মাঝে অতোবড়ো ল্যান্ডটা কি এমনি এমনি খালি ফেলে রেখে দেবে।
তোকে যদি পাঠাই তুই যাবি। যাবি না। তাই জোর করে তোকে তুলে নিয়ে যেতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সমাজ, সভ্যতা। তার জন্য মানুষ চাই। সেটাও যে সম্পদ।
সুরোরা হেসে ফেললো।
না হেসে একটু ভাবার চেষ্টা করিস, সহজ-সরল সত্যটা বুঝতে পারবি।
এই যে তুই আগে কি ছিলি বিশ্বাস তোর গোত্র ছিল আলাদা। এখন তুই মজুমদার। অংশুকে বিয়ে করার পর তোর শুধু পদবী পরিবর্তন হলো না, তোর গোত্রটাই বদলে গেল। কেন?
কখনও ভেবে দেখেছিস?
তুই যে কোনও গৃহ পালিত পশু পোষার চেষ্টা করবি, সে তুই গরু থেকে কুকুর পর্যন্ত। বা যে কেউ পুষছে লক্ষ্য রাখবি পুরুষ যদি দুটো থাকে মেয়ে পাঁচটা পুষবে। কেন?
উত্তরটা কি হবে আমাকে জেনে বলবি। খুব সহজ সরল উত্তর, আমি বললে তোরা এখুনি আমার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দিবি। কিন্তু আবহমানকাল ধরে এটাই চির সত্য।
ওরা আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
ইসলামভাই ওর্ণাদিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে কাছে এলো।
কি ইসলামভাই অসুবিধে হচ্ছে?
চালাইনি কোনও দিন, তাই একটু ঝামেলা হচ্ছে। মাঝে মাঝে ফল্স গিয়ার পড়ে যাচ্ছে।
দাদাভাই আমি একটু চালাব। চাঁদ বললো।
না। আমি চালাব। একটা নতুন এক্সপিরিয়েন্স।
কেমন লাগছে?
গল্প শুনেছি তোর মুখ থেকে, এখন চাক্ষুষ দেখছি।
ভিড়টা আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে গেল।
অনুপদা চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে।
বৌদি হাসতে হাসতে বললো তোর দাদার জন্য মনটা খারাপ লাগছে।
দাদাকে নিয়ে আসবো।
বৌদি হাসলো।
সামনে যে পাহাড়টা দেখছো ওটা ভালোপাহাড়। আমরা পাহাড়ের ওই পাশে যাব।
আমরা এখন কোথায়? বড়োমা আমার দিকে তাকাল।
আমরা ভালোপাহাড়েরই একটা পাহাড়ের মাথায়। এবার নিচের দিকে নামবো, তারপর আবার ওপরে উঠবো। এইভাবে পৌঁছে যাব।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
চলো সামনে একটা ঝোড়া আছে। ওখানে গিয়ে সকলে খেয়ে নাও।
ওরা খাবে না?
এখন খাবে না। ওদের পূজো আছে, পূজো শেষে খাবে।
পূজো কখন হবে?
সূর্য যখন অস্ত যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে।
বড়োমা আমার চোখে চোখ রেখেছে। কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। বৌদি, ছোটোমা একটু দূরে দাঁড়িয়ে অবাক বিষ্ময়ে চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে।
সবাই সবার মতো হারিয়ে যেতে চাইছে। এলেম নতুন দেশে। অতএব এখন গিলে খাও। পরে সময় মতো জাবর কেটো।
আমাকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে তনু, মিত্রা, বড়োমা, জ্যেঠিমনি। দারু কাছে দাঁড়িয়ে।
কনিষ্ক এগিয়ে এলো।
কিরে দারু অনিদাকে এখানে নিয়ে এসেছিস, আমরা এতো বার এসেছি একবারও এই পথে নিয়ে আসিসনি। এবার ওষুধ বন্ধ। কোনও চিকিৎসা করবো না।
তন্যে সেউ পাশ নু আসতু, তাই আইসিসনি। অনিদার কি আসার ঠ্যাক ছ্যাল, ফোন কইরে কইতো যাইঠি, মনসামন্দিরে দাঁড়াইস।
কখনও সাইকেল কখনও মোটর সাইকেল লিয়ে আইসতি অনিদাকে লিয়ে চইল্যা যাতি।
কনিষ্ক বড়োমার মুখের দিকে তাকাল।
দেখছো বড়োমা, তুমি জেদ না ধরলে কতো বড়ো একটা ট্যুর মিশ করতাম।
ছোটোমা-বৌদি পরিতৃপ্ত চোখে সামনে এসে দাঁড়াল।
তুই ভীষণ বেইমান।
কনিষ্কর দিকে তাকাল।
বলো কনিষ্ক, না এলে কি ভীষণ মিশ করতাম।
একটু আগে ঠিক এই কথাটা বড়োমাকে বলেছি। আমরা বন্ধুরা এতো বার এসেছি। এই পথে কখনও আসিনি। তোমাকে ভালোপাহাড়ের গল্প বলেছি। তাতেই তুমি বিভোর। এই জায়গা চর্ম চক্ষে দেখিইনি তোমাকে বলবো কি।
দেখলাম দারুদেরই তিনটে ছেলে মাথায় করে তিনটে পেটি নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে।
এগুলো কি! কনিষ্কর দিকে তাকালাম।
ভয় পাস না। এতো লোক আছি। দেখবি শেষ হয়ে যাবে।
আমরা ঝোড়ার দিকে এগোলাম। পাহাড়ের নুড়ি পাথর এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
বড়োমা, জ্যেঠিমনি আমার হাত শক্ত করে ধরেছে। দামিনীমাসি, ছোটোমা বৌদি পেছনে।
মাম্পি-মিকি তাদের মতো। ওদের পেছনে ছুড়কির মতো একটা ছেলে।
তোমরা সবাই একটু দেখে শুনে পা ফেল। নিচে ছোটো বড়ো পাথর আছে পা হড়কে যেতে পারে।
ছোটোমার মুখের দিকে তাকালাম। রোদে ফর্সা মুখটা আপেল রঙা হয়ে গেছে।
ঝির ঝিরে বাতাস গাছের পাতায় ধাক্কা খেয়ে একটা মধুর শব্দ তুলেছে।
বুঝলে বড়োমা গাড়ি কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে থেমে যাবে। তারপর আর যাবে না। তোমাদের হাফ কিলোমিটার মতো এই রকম পথে হাঁটতে হবে।
শ্যাম বড়োমানকার জন্যি দোলা ঠিক কইরে রাখছে। দারু বললো।
বড়োমার দিকে তাকালাম। বড়োমা আমার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে। সেটা আবার কি?
নতুন এক্সপিরিয়েন্স। উঠলেই দেখতে পাবে।
ঝোড়ার কাছে আসতে দেখলাম সবাই বিষ্ময়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
তির তির করে শরু সুতোর মতো জল ওপর থেকে নিচে ঝড়ে পড়ছে। নিচে বেশ কিছুটা গর্ত করে সেই জল ধরে রাখা হয়েছে। কাঁচের মতো টল টলে জল।
গর্ত থেকে উপচে পরা জল পাহাড়ের কোল বেয়ে নাম না জানা পথে নিচের দিকে নেমে গেছে। জায়গাটা অনেকটা পাহাড়ের একটা গহ্বরের মতো।
বড়োমা আমার হাতটা চেপে ধরলো।
আমি বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম।
এই জল কোথা থেকে আসছে?
বড়োমা চোখের ইশারায় হ্যাঁ বললো।
জানি না। এইরকম ভাবেই রাত দিন বছরের পর বছর ঝরে পড়ছে। বর্ষার সময় বৃষ্টির জল পেলে একটু মোটা হয়। আর নয়তো যা দেখছো এই রকম।
একটা সময় এখান থেকে খাওয়ার জল নিয়ে যেত শ্যামের বউ চূড়ামনি, দারুর বউ ময়না। আরও অনেকে। দঙ্গল বেঁধে দশ বারোজন মেয়ে আসতো। সঙ্গে দু-তিনজন ব্যাটাছেলে।
হেঁটে!
তাহলে কিসে আসবে গাড়িতে?
বড়োমা, জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
এই তল্লাটে ভাল্লুক, বুনো শুয়োরের উপদ্রব আছে। হাতিও আছে।
এ্যাঁ! বড়োমার চোখ গোল্লা গোল্লা।
বড়োমার গলা জড়িয়ে ধরলাম। হাসলাম।
ওদের হাত থেকে বাঁচতে ছেলেরা সঙ্গে আসতো। হাতে তীর-ধনুক।
এ তো গল্পে পড়ি!
এখন বাস্তবে দেখ। গল্প কখনও বাস্তব ছাড়া লেখা যায় না।
বড়োমা আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
ভয় করছে।
বড়োমারা সকলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
মিত্রারা জলে নেমে পরে হাতে মুখে জল দিচ্ছে।
বুবুন জলটা কি ঠাণ্ডা, আর কি মিষ্টি। বড়োমা একবার চোখে মুখে দাও ভীষণ ভালো লাগবে।
বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম। এখনও ঘোর কাটেনি।
সত্যি তুই যা বললি ওরা ধারে কাছে আছে!
তোমার ভাগ্য ভালো থাকলে তাদের দেখাও পেয়ে যেতে পার।
শেষ পর্যন্ত তুই ভাল্লুকের পেটে পাঠাবি।
এই তো ভয় পেয়ে গেলে, এতক্ষণ অনিকে মনেমনে গালাগাল দিচ্ছিলে, এখানে নিয়ে আসেনি বলে।
ও ছোটো অনি কি বলে শোন।
ছোটোমা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
অনি বলছে আশেপাশে ভাল্লুক আছে।
আমাদের একা খাবে না। ওকেও খাবে।
তনুরা জল থেকে উঠে সকলে মিলে খাবার ভাগাভাগি করতে লেগে পরেছে। সকলের হাতেই কাগজের প্লেট। সেই এক খাবার। আলুর পরটা, মাংস, মটর পনির।
ছোটো ছোটো দলে সকলে ভাগ হয়ে বসেছে।
চরুই ভাতির মেজাজ।
এখানে কারুর আর টেবিল-চেয়ারের দরকার নেই।
আমি কাছে গিয়ে সকলকে বললাম কেউ জায়গাটা নোংরা করবে না। খাওয়া হয়েগেলে একটা বাক্সে সকলে ফেলবে। ওরা তারপর সেটা একজায়গায় ফেলে দেবে।
দারুদের সঙ্গে যারা এসেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ খেল, কেউ কেউ খেল না।
একটা ছেলে এসে বললো, দারুআকা শ্যামআকা ছুড়কিরে ফোন করিছে হাতির পাল বারাইছে। অখন বারাইতে না কইছে।
বড়োমারা আমার মুখের দিকে তাকাল।
ছোটোমা, বৌদি, দামিনীমাসি, আন্টির খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।
আমি মুচকি মুচকি হাসছি।
খবরটা ছড়িয়ে পড়তে বেশিক্ষণ সময় লাগল না।
প্রথমে একটু হই হই করে উঠেছিল সকলে। তারপর থেমে গেল। একবারে নিশ্চুপ।
দারু আবার শ্যামকে ফোন করে কথা বলে নিল।
সুন্দরদের উৎসাহ বেশি ওরা হাতির পাল দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলো।
আমি ওদের রকম সকম দেখে হাসি। যেন ব্যাপারটা কিছুই নয়।
ইসলামভাই, ইকবালভাই, অনুপদা নিজেদের প্লেট হাতে নিয়ে আমাদের সামনে এসে বসলো।
কি হলো উঠে এলে?
তুই তো আফ্রিকান সাফারি শুরু করলি। অনুপদা বললো।
ওরা দলমার হাতি।
ভালোপাহাড়ের ওপাশটা দলমা রেঞ্জ!
খাওয়ার সংস্থানে নেমে এসেছে। পেট ভড়ে গেলে আবার চলে যাবে।
অনুপদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
ভাবছো অনি কি সহজ সরল ভাষায় বলে দিল।
ইসলামভাই, ইকবালভাই হাসছে।
আজ থেকে বাইশ বছর আগে এখানে যতো গাছ দেখেছি, তার থার্টি পার্সেন তুমি দেখছো। বাকি সব কেটে বিক্রী হয়ে গেছে।
কারা করছে?
তোমার বন দফতরের কন্ট্রাক্টররা। দুটো গাছ কাটতে বললে দশটা গাছ কাটে।
বড়বাবু, ছোটোবাবু, মেজবাবু, রেঞ্জার কতোজনকে পয়সা দিতে হয় বলো।
অনুপদা মাথা নিচু করে নিল।
ঠান্ডা ঘরে বসে অনেক বক্তব্য রাখা যায় বুঝলে অনুপদা, বাস্তাবটা কতটা কঠিন বুঝতে পারছো। দুনিয়াটা চলছে কাম, লোভ, ক্ষুধাকে নির্ভর করে। এর পাশাপাশি হাঁটে ক্রোধ, মাৎসর্য। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরে তো আমারা কেউ নয়।
অনুপদার মুখটা থম থমে হয়ে গেল।
তুমি রাগ করো না। চোখ মেলে শুধু তাকিয়ে দেখ, আমাকে কিছু বলতে হবে না, তুমি নিজেই সব বুঝতে পারবে।
একটু আগে বড়োমাদের বলছিলাম। দারুদের বউরা আগে এই ঝোরা থেকে সারাদিনের রান্না, খাবর জল নিয়ে যেত। বিশ্বাস করবে না। এত কষ্ট করে নিয়ে যাওয়া জল খেতেও কষ্ট হতো। আমি এখানে এলে পারতো পক্ষে কম জল খেতাম।
এখান থেকে ওই পাহাড়টার দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। তারমানে একটা মানুষ দু-ঘড়া জলের জন্য এতটা পথ হেঁটে আসতো আবার ফিরে যেত। দিনে একবার এরা আসতো। যাওয়ার পথে শুকনো ডালপালা কুড়িয়ে নিয়ে যেত, উনুনের জালন করার জন্য।
ক্লাস টেনের পরীক্ষা দিয়ে মৌসুমী মাসির হাত ধরে প্রথম এখানে আসি। তখন শ্যাম-দারু-শিবুর বয়স বছর দশেক হবে। আমি মাসির ছোটোবাবুর ছেলে। কদরই আলাদা। আমাকে ভালমন্দ খাইয়ে ওরা দেখতাম পান্তা খাচ্ছে। আমি মাংস খেলাম ওরা খেল কাঁচালঙ্কা পেঁয়াজ। আমি সেদিন শুধু দেখেছি। কাউকে কিছু বলতে পারিনি। মনে মনে কষ্ট পেয়েছি। দারিদ্রতা কাকে বলে, সেদিন প্রথম অনুভব করেছিলাম। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার সময় মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যেদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব, সেদিন এদের জন্য অবশ্যই কিছু করবো। এটা যে আমার সেই বয়সের ইমোসান ছিল না, আজ তা আমি প্রতিষ্ঠা করেছি।
ঠিক এই জায়গাতে আমি নিজেকে নিয়ে ভীষণ গর্ব বোধ করি। আমি আমার কাজটা করেছি, অন্ততঃ নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছি এটা আমার শুধুমাত্র ইমোসান ছিল না। চাকরি পাওয়ার পর প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে এখানে ছুটে এসেছি। দারু, শ্যামকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ঘাটশিলা বাজারে গিয়ে দুটো সাইকেল কিনেছি। প্লাস্টিকের গোটা দশেক জার কিনেছি।
দারু বললো, অনিদা এগুলো দিয়ে কি করবি।
বলেছি, তোরা যে ভাবে জল নিয়ে আসিস দেখলে আমার খারাপ লাগে। সাইকেল চালিয়ে ঝোরাতে যাবি এতে করে খাবার জল নিয়ে এসে মাটির কলসিতে ঢালিস। দেখবি পরিশ্রম কম হবে। আর চূড়াদেরও এতো কষ্ট করতে হবে না। বলতে পারো সেই শুরু।
পরের মাসে আরও দুটো সাইকেল। আরও গোটা দশেক জাড়। এইভাবে ছয়মাসে বারোটা সাইকেল ওদের কিনে দিলাম। বারোটা ছেলেকে ঠিক করলাম জল আনার জন্য। অন্ততঃ পক্ষে একটু তৃষ্ণার জল যেন ঠিক মতো খেতে পারে। ওদের ওই ছোট্ট একটুখানি গ্রামে আমার হাত ধরে প্রথম সাইকেল ঢোকে। বলতে পারো পায়ে হাঁটার থেকে গতিশীল যান-বাহন। এর আগের যানবাহন বলতে দোলা কিংবা পালকি। আজ সেখানে ঘরে ঘরে একটা করে সাইকেল আছে। গোটা কুড়ি বাইক আছে।
জানো সেদিন ওদের ওই কয়েকটা সাইকেল ঘাটশিলা বাজারটাকে হাতের কাছে নিয়ে এসেছিল।
ঘাটশিলা বাজার থেকে বস্তায় করে চাল আনার পয়সা দিলাম।
শ্যাম, দারু, শিবুকে বললাম, সবাই ভাগ করে খাবি। কেউ যেন বেশি-কম না হয়। তাতে একবেলা খেতে হয় সে ও ঠিক আছে। আর সবার প্রথমে খাওয়াবি বাচ্চাদের।
সবচেয়ে বড়ো জিনিষ ওরা আমার কথা কখনও অমান্য করেনি। তবে এর জন্য মৌসুমি মাসির অবদান যথেষ্ট। আমি যে তার ছোটোবাবুর একমাত্র সন্তান। মা-বাপ হারা।
তারপর মিত্রা মালিক বানালো, মাইনে বারলো, সেই পয়সায় দুটো ইঁদারা করে দিলাম। সেই থেকে এই ঝোরাতে আসা বন্ধ হয়েছে। গ্রীষ্মকালে ইঁদারার জল অনেক নিচে নেমে যায়। কপিকলের সাহায্যে বালতি করে জল তোলে।
বর্ষাকালটা খুব একটা অসুবিধে হয় না। তবে কি জানো, সব সময় যে এখানে বর্ষা হয় তাও নয়। তখন সুবর্ণরেখা আছে। সেটাও গ্রীষ্মকালে শুকনো খটখটে।
এখন ওদের চোখ ফুটেছে। তোমাদের মতো তথাকথিত শিক্ষিত মানুষদের অবহেলার যন্ত্রণা ওদের কুরে কুরে খায়। তাই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য, ওদের এই ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছে।
এখনও এখানকার পঞ্চাশভাগ মানুষ দুবেলা দুমুঠো পেট ভরে ভাত পায় না। তোমরা সব খাতা কলমে পাঠাও। বিডিওগুলো এখান পর্যন্ত আর পৌঁছে দেয় না। লড়ি লড়ি চাল, গম চলে যায় পাশের স্টেটে। কারুর ল্যাজ মোটা হয়, কেউ না খেয়ে মরে। তাই এরা বিদ্রহী।
খিদের তাড়নায় বাধ্যহয়ে এরা লড়িকে লড়ি মাল ডাকাতি করে। যে পথে এলে এই পথেই লড়ি ঢুকিয়ে সব মাল নামিয় নেয়। ভাগ বাটোয়ারা করে।
তুমি একটু হিসাব করে দেখবে। খাদ্যবস্তু ছাড়া এরা কিছু লুঠ করে না।
তুমি যদি দু-বেলা দু-মুঠো পেট ভরে এদের খেতে দাও, দেখবে এরা অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছে।
জানো অনুপদা, আজ তোমাকে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণার কথা বলছি।
অনুপদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
বড়োমা তোমরা আমার গুরুজন আমার কথা শুনে মনে কিছু করো না।
ছোটোমা, বৌদি, জ্যেঠিমনি, সোনাআন্টি, দামিনীমাসির চোখ স্থির।
জানো, একথালা ভাতের জন্য এরা শরীর বিক্রি করে। গলাটা সামান্য বুঁজে এলো। হয়তো চোখ দুটোও ছল ছল করে উঠলো।
অনি! অনুপদা খাওয়া থামিয়ে দিয়েছে।
অনুপদা ছাড়াও সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
ইসলামভই, ইকবালভাই-এর চোখ দুটো কেমন ছোটো ছোটো হয়ে গেছে।
একটা মেয়ে কোন পর্যায়ে গেলে এটা করতে পারে সেটা আমি নিজে অনুভব করেছি। তোমরা হয়তো ঠিক বিশ্বাস করতে পারছো না।
আমিও একদিন এদের শরীরের ক্রেতা হতে পারতাম।
একটু থামলাম। ওরা আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
সে সুযোগ আমি বহুবার পেয়েছি। গ্রহণ করতে পারিনি। আর যতবার এই সুযোগ পেয়েছি। তত মনকে শক্ত করে এদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেছি।
আজ এরা বিদ্রহী, আমি এদের এই বিদ্রহকে পূর্ণ সমর্থন করি।
এতে তোমরা যদি আমাকে খারাপ চোখে দেখ, তাতে আমার কিছু এসে যায় না।
শুধু তোমাদের একটা প্রশ্ন করবো, তোমরা যদি আমার জায়গায় থাকতে, ওইরকম পরিবেশ পরিস্থিতে, তোমরা তাহলে কি করতে।
অনুপদার চোখমুখ পরিবর্তন হলো। আমি বৌদি, বড়দি, ছোটদি সকলকে সাক্ষী রেখে বলছি। আমি লড়বো অনি। শরীরের শেষ বিন্দুটুকু দিয়ে লড়বো। প্রবীরকে তুই যেমন ভাবে সাহায্য করছিস, আমাকেও একটু কর। তুই কাজ করার সুযোগটুকু করে দে।
চলবে —————————–
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/2uacPWr
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment