কাজলদিঘী (১৫৩ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৫৩ নং কিস্তি
—————————–

ছোটোমার ফোনে আবার নেপলার ফোন। তখন আমার ফোনে ছোটোমার সিম লাগিয়ে নিয়েছি।

ভয়েজ অন করা, সবাই শুনছে। ঘর ভর্তি লোক। তখন তোকে ফাদার তুমুল ঝাড়ছে। ফাদারের মুখ থেকে অনিকা, পক্কে, ঘণ্টার নাম শুনলাম।

অনিমেষদা মুচকি মুচকি হাসছে।

দেখ তুই কিন্তু জানতে পারিস নি। নেপলা আমাদের শুনিয়েছে।

আমি দু-হাত দিয়ে ওদের গাল টিপে দিলাম।

নেপলার ফোন রেখেছি। রতনের ফোন বাজলো। ওমর ফোন করেছে।

অনিমেষদা বলেই রেখেছে আমাকে সব শোনা।

রতন ফোন ধরে বললো, বল।

রতনদা ওদের চিনা নিয়ে এসে ওর ডেরায় তুলেছে।

চিনা!

হ্যাঁ। আমাকে বলে তুই আমাকে মারতে এসেছিস মার। যা ওরা ও ঘরে আছে। কথা বল।

কেন তুলে নিয়ে গেছে কিছু বলে নি!

বলে, বলা বারণ আছে। বেশি কিছু করবি, তুই নিজে হজম হয়ে যাবি।

ওকে দে।

তারপরেই চিনার গলা পেলাম।

চিনা।

বলো রতনদা।

ওদের তুলে নিয়ে গেছিস কেন?

হুকুম আছে তাই।

কে বলেছে?

বলতে পারবো না।

আমি যাব?

সে তুমি এসে আমাকে পেটাপিটি করতে পারো। তবু সিগন্যাল না এলে ছাড়তে পারব না।

কে সিগন্যাল দেবে?

বলা যাবে না।

ওদের পেটাপিটি করেছিস নাকি?

কথা বলবে।

জিজ্ঞাসা করলি না জানলাম কি করে?

ওদের কাছে ফোন আছে ওরা আবিদকে ফোন করেছিল।

তুই জানিস!

জানতাম না। এখন জানলাম। দিলাম অনিদার নাম করে গালাগালি।

তোকে কি অনিদা ওদের নিয় যেতে বলেছে?

না।

তাহলে অনিদার নাম করে গালাগালি দিলি।

তাই বললাম বুঝি!

ঠিক আছে, এখন রাখ।

অনিমেষদা, বৌদি তখন হেসে কুটি কুটি খাচ্ছে।

অনিমেষদা, রতনকে বললো, একবার ফোন কর অনিকে।

আবার নেপলা ধরলো।

কি হয়েছে। নেপলা ঝাঁঝিয়ে উঠলো।

শোন না, রাগ করছিস কেন—

এখন অনিদার সঙ্গে কথা বলা যাবে না, ধরে নে আমিই এখন অনিদা।

রতন হাসছে।

তাহলে তুই একটা ডিসিসান দে।

তাড়াতাড়ি বল। আমরা এখন চার্চে যাচ্ছি। দাদার মন ভালো নয়। ফাদার বহুত ঝাড় দিয়েছে। আমি পেছিয়ে গিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলছি।

রতন নেপলাকে সব বললো।

বললো তোরা যা পারিস কর। পারলে সবকটাকে তুলে নিয়ে দাদার বাড়িতে চলে আয়। বিকেলে গিয়ে হিসাব হবে।

তারপর ঠেলা বুঝবে কে?

আমি বুঝে নেব। দাদাকে এখন ডিস্টার্ব করা যাবে না। দাদা এখন একটা ঘোরে আছে। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।

নেপলা ফোন কেটে দিল।

অনিমেষদা সব শুনে মাথা দোলায় আর হাসে।

ইকবালভাই বললো। দাদা ব্যাপারটা ঠিক আমার মাথায় এখনও ঢুকছে না।

ঢুকবে না ইকবাল। আমরা ওর কতটুকু জেনেছি। সময়ে সময়ে কিছু জানতে পারছি।

এই তো আয়েষার ব্যাপারটা ধরো। দিদিরা গিয়ে দেখে এসেছে। পছন্দ করেছে। ও যে অনির পরিচিত তোমরা এতদিন জানতে। কথা বার্তায় তোমরা গেইজ করেছো ও ইসলামের মেয়ে। আচ্ছা ইসলামের যে একটা মেয়ে আছে তোমরা এই পঁচিশ বছরে জানতে পেরেছো?

আমি তো সেটাই ভাবছি।

ইকবাল, বুঁচকি যদি না বলতো তোমরা কেউ জানতে পারতে?

একবারেই না।

ওদের এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো।

রতন থাকলো।

ইসলামভাই নিজে গেল।

আবার নেপলার ফোন ছোটোমার ফোনে।

ছোটোমা, এ তো তুমি গো!

এ্যাঁ।

হ্যাঁগো ছোটোমা। এ মেয়ে দাদাভাইয়ের মেয়ে। একবারে তোমার মুখ বসানো।

তখন তুই অনিকা বল চেঁচিয়ে উঠেছিস খুব আস্তে শোনা যাচ্ছিল।

ছোটোমার চোখ-মুখ যন্ত্রণায় কেমন দুমড়ে গেল। বড়োমা চেপে ধরেছে ছোটোমাকে।

তারপর কি যে হলো কিছু বুঝলাম না। শুধু অনিকা কেঁদে উঠলো উসমানচাচা, ফাদার, অনিমামা….। একটা হই হই শব্দ। লাইন কেটে গেল।

তারপর কনটিনিউ ফোন করি, রিং বেজে যায় নেপলা আর ধরে না।

আবার টেনশন।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর ডাক্তারদার নম্বরে নেপলা ফোন করলো।

হ্যালো বলার পরই ডাক্তারদার মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগলো। ঘর থেকে উঠে বেরিয়ে গেল। আমি তখনই বুঝেগেছি গুবলেট কেশ।

উঠেপরে ডাক্তারদাদার পেছন পেছন গেলাম। তনুও উঠে এসেছে।

সব শুনে এবার আমার আর তনুর ঘন ঘন বাথরুম শুরু হয়ে গেল। ডাক্তারদাদা শুকনো মুখে ঘরে এসে বললো, অনির শরীরটা একটু গণ্ডগোল করেছে। ছোটোমা, বড়োমা দুজনেই কাঁদতে শুরু করলো। তাকে আবার সামলায় বৌদি, ইসিদি। এদিকে ঘণ্টা, পক্কে এসে হাজির। কাঁদতে কাঁদতে আয়েষার ষষ্ঠীপূজো করে ছেড়ে দিল, সে কি ঝগড়া তিনজনের!

বলে কি অনিমামার যদি কিছু হয়েছে তোকে শেষ করে দেব তিনজনে মিলে। কতবার বলেছি মামাকে দেখা করে সত্যি কথা বল। অন্ততঃ আমাদের ফোন নম্বরটা দে। আমাদের পুরনো ফোন নম্বর মামার কাছে আছে, নতুনগুলো নেই। শুনলি না আমাদের কথা।

বুঝলাম অনিকা ফোন করে ওদের সব বলেছে। কিন্তু ওদের মুখ থেকে কোনও কথা বেরোয় না। শুধু মেয়েদের মতো ফোঁপায়। আমি গিয়ে ওদের বললাম আমি তোমাদের মামীমা।

আমাকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপানি আরও বেড়ে গেল।

ডাক্তারদাদা নেপলার ফোনে ওখানকার কোন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললো।

কনিষ্করা পক্কেদের সঙ্গে কথা বললো।

শেষে আমাকে এসে বললো, অনির অনেক শাখা প্রশাখা। ওকে আমরা এখনও সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারলাম না। আমাদের সবার দুর্ভাগ্য। খাওয়া দাওয়া তখন মাথায়।

আমি নেপলার সঙ্গে কথা বললাম। শুধু বললো, দাদা অনিকার কোলে শুয়ে আছে। শুধু ভুল ভাল বকে যাচ্ছে। ফাদার আছে। আরও লোকজন আছে। জ্ঞান আসেনি।

অনন্য, সুন্দর তোর মেয়ে কথা বললো নেপলার সঙ্গে। বললো, এখন কথা বলিস না। ভালো লাগছে না কথা বলতে। তোদের সঙ্গে পরে কথা বলছি।

বাবা ভালো আছে নেপলা আঙ্কেল? তোর মেয়ে জিজ্ঞাসা করলো।

ডাক্তার বলছে সব ওকে। উত্তেজনায় জ্ঞান হারিয়েছে।

বড়োমা সেই যে সকালে এসে বিছানয় বসেছে। আর ওঠেনি। তখনও বাসি মুখে বাসি কাপরে। একফোঁটা কিছু মুখে তোলেনি দুজনে। এমনকি বাথরুম পর্যন্ত যায়নি।

তারও প্রায় একঘণ্টা পরে নেপলা ফোন করে ছোটোমাকে বললো, মেঘ কেটে গেছে ছোটোমা। পরে তোমাকে ফোন করে বিস্তারিত জানাচ্ছি।

তুই বিশ্বাস কর তখন যেন মনে হলো ঘাম দিয়ে জ্বর ছারলো সকলের।

বড়োমাকে বাথরুমে পাঠান গেল। ছোটোমাকে একটু চা খাওয়ানো গেল।

দামিনীমাসির তখন না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থা।

শুধু নেপলার ফোনের অপেক্ষায় বসে আছি। আমরা নিজেরাও ফোন করতে পারছি না। বার বার বলেছে তোমরা ফোন করবে না। দাদা ধরে ফেলবে। আমি ঠিক সময় বুঝে তোমাদের ফোন করে জানাব।

আধ ঘণ্টা পরে ফোন এলো।

ছোটোমা—

বল—

তুমি কাঁদছো নাকি—

না—

গলাটা কেমন ভাড়ি ভাড়ি লাগছে—

এমনি—

ভাইঝির সঙ্গে কথা বলবে—

ছোটোমা চুপ।

এই অনিকা পিসির সঙ্গে কথা বল।

তোরা কোথায়?

অনিকার কাপর কিনতে এসেছি। দাদা ব্যাঙ্কে গেল, সঙ্গে এখানকার ডাক্তার, ফাদার।

কখন ফিরবে?

জানি না। যাওয়ার সময় বলে গেল অনিকার কাপর কিনে দে। ও জানে আমি কিরকম কাপর পছন্দ করি।

দাদা কিছু খেয়েছে?

ও-মা, জ্ঞান ফিরতেই আমাকে একচোট ঝাড় দিল। কেনো আমি সকালে মনে করিয়ে দিইনি ওষুধ খাওয়ার কথা। বলো কিরকম লাগে। ফাদার সকালে গডকে যে পাঁউরুটি, জল দিয়েছিল, ফাদার এনে দিল, দাদা তাই খেয়ে ওষুধ খেল।

তারপর ছোটোমা অনিকার সঙ্গে কথা বললো।

কি মিষ্টি গলা। ধরেই বলে তুমি আমার প্রণাম নাও। তুমি কি অনিমামার ছোটোমা।

তারপর একে একে সবার সঙ্গে কথা বললো। সব নামে নামে চেনে। এমনকি অনিসা, অনন্য, সুন্দরের সঙ্গে কথা বললো। ঘণ্টা, পক্কের সঙ্গে কথা বললো।

ঘণ্টা, পক্কেকে বললো, আয়েষাদিকে কিছু বলিস না। মামা সব বুঝেছে।

তারপর ছোটোমা নেপলাকে বললো, অর্জুনের ব্যাপারটা কি বল।

অর্জুন ফোন করেছিল, বলেছে অনিদাকে বলে দিস যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছিল সেটা হয়ে গেছে। অর্জুন ম্যাসেজও করেছে।

পরে সবাই যখন কচুরী খাচ্ছি তখন দামিনীমাসি বললো, ও মনেহয় জাফরকে সরিয়ে দিল।

জাফর! অনিমেষদা বললো।

তখন দামিনীমাসি জাফরের সব ঘটনা বললো।

ইসলামভাই তখন কাঁদে।

এরপর অনিমেষদা চাঁদ, চিনার ইন্টারভিউ নিল। সুজিতদা, তোর সেই অসীম এলো। তাদের মুখ থেকে সব শুনলাম। তখন একটু একটু সব পরিষ্কার হচ্ছে।

তারপর আবার নেপলার ফোন।

ছোটোমা এখন কৃষ্ণনগর মোড়ে। দাদা অনিকার কোলে শুয়ে ঘুমচ্ছে। আমার সঙ্গে উসমানভাই যাচ্ছে। ঘন ঘন অনিকার সঙ্গে কথা বলি। তোরা কোথায় আছিস জানি। পক্কে, ঘণ্টা কথা বলে।

তারপর তুই চলে এলি।

এবার ঘুমিয়ে পরি।

পাওনা গন্ডা মেটা।

হেসে ফেললাম।

নেপলা আজ আমাকে অফিসে নিয়ে এল। যখন ঢুকলাম তখন একটা মতো বাজে। আসার সময় দাদাকে মল্লিকদাকে বাড়িতে দেখিনি। দাদা নাকি এখন একঘণ্টার জন্য অফিসে আসছে।

দিন কয়েক হলো অফিসে যাতায়াত শুরু করেছে।

সকাল বেলা রতন এসেছিল। বললো সাগর দাধিয়া একটা কমপ্রমাইজে আসতে চাইছে। আমি রতনকে প্রবীরদার সঙ্গে কি কথা হয়ছে বললাম।

রতন হেসেছে।

নিউজ রুমের ফ্লোরে এসে থমকে দাঁড়ালাম। একবারে শুনশান। হরিদার ছেলেটাকেও দেখতে পাচ্ছি না। দাদার ঘরের দরজাটা একটু ঠেললাম। দেখলাম দাদা চেয়ারে নেই।

নিউজরুমে এলাম। মল্লিকদার চেয়ার ফাঁকা। অর্ক অপরজিট চেয়ারে বসে আছে।

সন্দীপকে দেখতে পেলাম না।

বৃষ্টি আমাকে দেখতে পেয়েছে। চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এলো।

কেমন আছিস?

ভালো আছি।

চারিদিক একবার তাকিয়ে নিয়ে বললাম।

সব কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

ম্যাডামের ঘরে মিটিং চলছে।

কিসের!

কামিং সিক্স মান্থের প্ল্যানিং।

মল্লিকদা?

সবাই ওই ঘরে।

আমাদের কথাবলার ফাঁকেই অর্ক উঠে এলো।

আমি নিজের চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেলাম।

বৃষ্টি একটা জলের বোতল নিয়ে আয় না।

আনছি।

বৃষ্টি নিজের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। অর্ক কাছে এল।

অফিসের হালচাল।

স্মুথ।

যা একটা নিউজ প্রিন্টের প্যাড এনে দে।

সেদিনের খাওয়াটা কিন্তু জব্বর হয়েছে।

হাসলাম।

সত্যি অনিদা তোমার মধ্যে প্রচুর ভ্যারাইটি।

বৃষ্টি জলের বোতল নিয়ে এসে আমার হাতে দিল। ঢক ঢক করে বেশ কিছুটা জল খেয়ে নিলাম।

অর্ক প্যাড এনে দিল।

একটা পেন দে।

আজকের কভার স্টরি? অর্ক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

না-রে পাগল। আসার সময় একটা জিনিষ চোখে পড়লো। ভাবছিলাম অনেকদিন, লিখবো। লেখা আর হয়ে উঠছিল না। আজ সুযোগ পেয়ে গেলাম। ঘুরে ঘুরে মোবাইলে বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম। তাই ভাবলাম লিখে ফেলি। তোরা যদি দয়া করে ছাপিস।

এই ভাট বকা শুরু করলে। একবারে বিনয়ের অবতার।

এখন ফিচার এডিটর কে?

সুমন্ত।

ওভার অল।

সন্দীপদা দেখছে। তবে দাদাকে একবার জিজ্ঞাসা করে নেয়। নিদেন পক্ষে মল্লিকদা।

টেবিলের চিঠি পত্র একবার উল্টে পাল্টে দেখে নিলাম। তারপর লিখতে বসে গেলাম।

সেই ছোটো থেকে এটা আমার একটা বদ অভ্যাস। একবার নিজেকে কনসেনট্রেট করে ফেললে পাশে কে আছে, কে আসছে যাচ্ছে, কি বলছে, খেয়াল থাকে না। তখন আমি ওই কাজটার মধ্যেই ডুবে থাকি।

লেখাটা শেষ করে আবার জলের বোতলটা টেনে নিলাম। একটু জল খেয়ে পিনের বাক্সটাকে কাছে টেনে নিলাম।

তোকে লাগাতে হবে না। দে আমি লাগিয়ে নিচ্ছি।

তাকিয়ে দেখলাম সন্দীপ।

ভাগ শালা। এটা তোর নয়।

আমি আমার মতো বানিয়ে নিচ্ছি।

কেন লেখার এত অভাব?

বিশ্বাস কর, ভাল লেখা পাচ্ছি না।

পয়সা দিবি না, কে লিখবে।

ফালতু বকবি না। আমাদের কাগজ এখন হায়েস্ট পে করে।

অনিদা কি বক বক করছে গো সন্দীপদা। সুমন্তর গলা পেলাম।

পেছন ফিরে দেখলাম মল্লিকদা, অরিত্র, অর্ক বসে আছে।

কিগো, কখন এলে? আমি বললাম।

অনেকক্ষণ। তোকে পাহাড়া দিচ্ছিলাম।

আমাকে!

হ্যাঁ।

কেন!

কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে।

আমি হাসছি।

তোমরা আমাকে এমন তোল্লাই দিচ্ছ না। বুঝতে পারছি, আমার চাকরিটা এবার খাবে।

আদৌ তুই এই হাউসে চাকরি করিস কি? তোকে যদি এখুনি প্রেসকার্ড দেখাতে বলি দেখাতে পারবি। এই ঘরে ঢোকারই পার্মিশন নেই। তুই মালিক তাও বলতে পারবি না।

সন্দীপ লেখা পাবি না। আগে প্রেসকার্ড বানিয়ে আন তারপর লেখা পাবি।

এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ছাড়া আমরা প্রেসকার্ড ইস্যু করি না।

আমি লেখাটা নিয়ে অপরজিটের হাউসে দিয়ে আসি।

উঠে দাঁড়ালাম।

পেন আর নিউজ প্রিন্টের পয়সা দে।

কত পয়সা বল।

ঘর ভর্তি সবাই হেসে গড়াগড়ি খায়। এদের মধ্যে কিছু নতুন ছেলেমেয়েও আছে।

সুমন্ত এগিয়ে এলো।

তোমার টাকার দরকার?

অবশ্যই।

কি নামে চেক হবে বলো। আমি এখুনি বানিয়ে দিচ্ছি। লেখাটা আমায় দাও।

কত দিবি?

কত শব্দের বলো—

হাজার আষ্টেক।

দশ কলম, মানে দেড় পাতা। নামী লেখকদের আমরা পাঁচ থেকে সাতহাজার টাকা দিই।

আমি সুমন্তর দিকে তাকিয়ে হাসছি।

তুমি আমাদেরে এক্স স্টাফ। তাই দশহাজারে রফা করছি।

কিরে সন্দীপ, তুই কতো দিবি?

নিউজে টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। যারা ফ্রি-ল্যান্সার তারা মাসে কটা নিউজ করছে তার ওপর ভিত্তি করে টাকা দেওয়া হয়।

সুমন্ত আগে চেক, তারপর লেখা পাবি।

আধাঘণ্টা সময় দাও। চেক রেডি করে দিচ্ছি।

দ্বীপায়নকে ল্যাপটপটা নিয়ে আসতে বল।

লাগবে না। আমি নিয়ে নিচ্ছি।

আমি সুমন্তর দিকে তাকিয়ে আছি।

ফুল কনফিডেন্ট রাখতে পারো। আচ্ছা তোমাকে মোবাইলটা দিতে হবে না। তুমি মেল এ্যাটাচমেন্ট করে পাঠিয়ে দাও। আমি রিসিভ করে নিচ্ছি। তুমি নিজেও পাঠাতে পারো।

আমি হাসছি। সুমন্ত নিজের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।

কিরকম বানিয়েছি বল। একটা ছোট্ট করে থ্যাঙ্কস দে।

সন্দীপের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করলাম।

ভালো কথা বললাম, ওমনি গালাগাল শুরু করে দিলি।

সুমন্ত ল্যাপটপ নিয়ে এলো। নিজেই টেবিলে রেখে খোলাখুলি করে নিল।

নাও পাঠাও।

আমি আমার মোবাইল ইন্টারনেট অন করে ওর মেল আইডিতে ছবিগুলি এ্যাটাচ করে পাঠিয়ে দিলাম। লেখাটা ওর হাতে দিলাম।

আন্না কালি তালাও। সুমন্ত চেঁচিয়ে উঠলো।

সুমন্ত আমার হাত থেকে লেখাটা নিয়ে হেডিংটা পরে গলা জড়িয়ে ধরলো।

অর্কদা তোর লেখাটা আর যাবে না। ক্যানশেল।

মানে!

তুই রয়ে বসে লিখলে হবে। দেখ, দাদা ঝেড়ে দিয়েছে। উইথ ফটো।

অর্ক ছুটে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বললো, আমার নামটা দিয়ে দে, দাদার নাম যাবে না।

তোর আঠারো মাসে বছর। এখনও ভেবে যা কোথা থেকে শুরু করবি, কোথায় থামবি।

ছোটো করে একটু চা খাওয়া। আমি সুমন্তর দিকে তাকিয়ে বললাম।

ছবিগুলো দেখে নিই।

খোল খোল আগে। সায়ন্তন খেয়ে ফেলবে, ব্যাটা ঘুরে ঘুরে ছবি করেছে। অর্ক বললো।

ওরা সবাই ছবি দেখলো।

অর্ক আমার দিকে তাকাল।

তুমি এই ছবি কোথা থেকে পেলে?

বলবো কেন—

তুমি নিশ্চই এদের ডেরায় গেছিলে?

গেছিলাম—

সায়ন্তন আসুক, ব্যাটাকে এমন চাপগাব না।

আমি হাসছি।

বলে কিনা এরা ক্যানিং থেকে সব আসে। আমি কি চারপাঁচটা ছবির জন্য ক্যানিং যাব।

চা এলো। চা খেতে খেতে হাসা হাসি ঠাট্টা-ইয়ার্কি হলো।

যাই কাজগুলো সারি, বেড়তে হবে।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।

দারুণ নামিয়েছিস। মল্লিকদা হাসতে হাসতে বললো।

পড়ে ফেললে?

ভালো খাবার ফেলে রাখতে নেই।

আমি হাসছি।

যা খবর পাঠিয়ে দিয়েছি, তুই যাচ্ছিস।

দাদা কোথায়?

মিটিং শেষ হতেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।

আমি এসেছি জানতো?

জানলে কি বাড়ি যেত।

অনেক দিন শুকনো যাচ্ছে। কিছু মাল ছাড়।

সন্দীপ শুকনো মুখ করে বললো।

দাঁড়া তৈরি হচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবি।

দাদা আমি হাফ তুমি হাফ। অর্ক হাতটা চেপে ধরেছে।

তুই, অরিত্র করবি। আমি পিকচারে থাকব না।

আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি।

ভিড়ের থেকেই কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠলো, তার মধ্যে বৃষ্টি-রাত্রিও আছে।

আমি হাসতে হাসতে নিউজ রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।

এইবার মিত্রার ঘরের সামনে হরিদার ছেলেকে দেখতে পেলাম। ব্যাটা আমাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে মিত্রার ঘরের দরজাটা খুলে দিল। আমি গেটের সামনে দাঁড়ালাম। মিত্রা, তনু পাশাপাশি চেয়ারে বসে। আমাকে দেখে হাসলো।

আসবো ম্যাডাম।

ঢং দেখে আর বাঁচি না।

ভেতরে এলাম। দেখলাম মিলিরাও আছে।

মিত্রাদি তাড়াতাড়ি ফাইলগুলো বার করো, দেখিয়ে নিই। মিলি উঠে এলো।

কমসে কম একটু বসতে দে।

মিত্রা, তনুর দিকে তাকালাম।

বেশ ভালো লাগছে।

লাগবে লাগবে, এরপর দেখবি আরও ভালো লাগবে। মিত্রা চোখ নাচিয়ে বললো।

লেখা শেষ হলো? তনু বললো।

হ্যাঁ।

তুমি লিখতে বসলে আজকাল সবাই পাহাড়া দেয়—

কেন!

মল্লিকদা ফোন করে বললো, অনি এসেছে, লিখতে বসেছে, প্লিজ তোমরা কেউ এখন ফোন করো না। তাহলে ওর কনসেনট্রেশন ব্রেক হয়ে যাবে।

না না সেরকম কিছু নয়।

তুমি তো চায়ের দোকানে বসেও লিখতে। তনু বলে উঠলো।

আবার পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটে। মিত্রা বলে উঠলো।

মিত্রা আমার দিকে তাকাল।

দাদা জানে না তুই এসেছিস। জানলে আমাকে ভীষণ বকবে।

বকুনি খাবি।

হরিদার ছেলে মুখ বারালো।

ম্যাডাম খাবার নিয়ে আসি।

কি খাবি। মিত্রা আমার দিকে তাকাল।

ছেঁড়া পরটা, ঘুগনি, জিলিপি। বলো অনিদা?

মিলি বলেই হেসে ফেললো, ওরাও সাথে সাথে হাসছে।

যাঃ ছাতু মাখা, পেঁয়াজ আর তেঁতুলের চাটনি। খেয়ে এক লোটা জল। ব্যাশ সারাদিন ইঞ্জিনে দম দেওয়া হয়ে গেল। টিনা বললো।

টিনা সাবধান। দেখছিস তো কিরকম মুচকি মুচকি হাসছে। এখুনি গলাটিপে ধরবে। অদিতি বলে আর হেসে গড়িয়ে পরে।

প্রতিদিন যা নিয়ে আসো তাই নিয়ে এসো। মিত্রা, হরিদার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো।

কয়েক প্লেট বেশি আনতে বলো। মিলি বললো।

কেনো?

অনিদা এই ঘরে, আর কেউ আসবে না, এটা হয় নাকি?

দশটা নিয়ে এসো।

আচ্ছা ম্যাডাম, হরিদার ছেলে বেরিয় গেল।

মিলি আমার মুখের সামনে ফাইল জড়ো করেছে।

এগুলো কি?

একবার চেক করে দাও।

পিকু কোথায়রে? মিত্রার দিকে তাকালাম।

প্রেসরুমে আছে। এখন বাবুর আলাদা চেম্বার।

একটু চা খাওয়া।

খেয়ে নে আগে, তারপর খাবি।

ম্যাডাম আসছি। সুমন্তর গলা পেলাম।

তোমরা এতোজন! আবার কি হলো? মিত্রার চোখ বড়ো বড়ো।

পেছন ফিরে দেখলাম সুমন্তরা এসে হাজির।

বেশি সময় নেব না। মাত্র পাঁচ মিনিট। সুমন্ত বললো।

আমি ওদের দিকে তাকিয়ে।

মিলিদি, ফাইলগুলো একটু সরাবে।

কেনরে!

অনিদাকে দিয়ে কয়েকটা সই করাতে হবে।

সুমন্ত আমার দিকে তাকাল।

পেন এনেছো।

তোদের ফেরত দিয়ে দিয়েছি।

অর্কদা তুই ম্যাডামকে দিয়ে সই করিয়ে নে। তারপর ল্যামিনেট করিয়ে দিচ্ছি।

সুমন্ত একটা জায়গায় রাইট চিহ্ন দিয়ে বললো সই করতে। পেনটা আমার হাতে গুঁজে দিল।

এটা কি বলবি তো?

তোমার বায়োডাটা।

ওদিকে দেখলাম মিত্রা, তনু বেদম হাসছে।

মিলি দেখবি আয়।

আমার বায়োডাটা তুই বানিয়েছিস!

জানা থাকলে অসুবিধে কোথায়—

ব্যাটা তুমি বহুত ধরিবাজ। আমাকে ফাঁদে ফেলার কল করেছো।

এগুলো সাইন না হলে টাকা দেওয়া যাবে না।

যা ভাগ, এরপর থেকে সব লেখা ওই হাউসে দেব। ওরা এ্যাডভান্স টাকা দেবে।

অনিদা ফ্রি-ল্যান্সার? টিনা চেঁচিয়ে উঠলো।

আমাদের দিকে তাকিয়ে, তুই পারিস সুমন্ত।

ঘরে তখন খুব জোড় হাসাহাসি চলছে। মিত্রা কার্ডে সাইন করলো। আমি বায়োডাটাতে বাঁহাতে সাইন করলাম।

এটা কি হলো! সুমন্ত বললো।

কেন?

এতক্ষণ ওপরে বসে ডান হাতে লিখলে সাইন করছো বাঁ হাতে।

বাবাঃ ঘরে তো দেখছি দাঁড়াবার জায়গা নেই।

বরুণদা দেখবেন আসুন। অনিদাকে সুমন্ত আজ চেপে ধরেছে। টিনা বললো।

শিষ্য, গুরুকে চেপে ধরতেই পারে।

তুই কি নাম লিখেছিস? সুমন্তর দিকে তাকালাম।

হ্যাঁ। তোমার অসুবিধে আছে?

হাসলাম। সই করলাম।

কি অর্কদা মিললো আমার কথা। সুমন্ত, অর্কর দিকে তাকাল।

তুই বিশ্বাস কর। ব্যাপারটা মাথাতেই ছিল না।

কিরে তোরা আমার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করেছিলি না। নিজের চোখে দেখলি। অনিদা এই জায়গাটায় কোনওদিন ভুল করবে না। আর ডানহাতে সই করতে পারলেও করবে না।

ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলো মুচকি মুচকি হাসছে।

এবার দেখ দুটো সই এক কিনা।

ওরা আমার সই করা বায়োডাটা নিয়ে নিল।

সুমন্ত একটা খাম এগিয়ে দিল।

এটা কি?

ক্যাশ। তোমাকে চেক দিয়ে ছোটো করবো না।

মিত্রা, তনু আবার হাসে।

সওদা ইজ সওদা। এটা তোমাকে নিতে হবে।

কতোরে সুমন্ত? মিত্রা বললো।

অনিদার জন্য দশ।

একটা আর্টিকেলে দশ! তনু চোখ বড়ো বড়ো করলো।

আমি ভাউচারে সই করে দিলাম।

অর্কদা কার্ডটা দাও।

অর্ক কার্ডটা দিল।

এখানে তোমার একটা সই করো।

পরে করে নেব।

এখুনি করে দাও। আমি ল্যামিনেট করে দেব।

আগে তুই তোর জায়গায় সই কর। তারপর।

তোমার সামনেই করছি।

সুমন্ত সই করলো। আমিও সই করে দিলাম।

সুমন্ত গলা জড়িয়ে ধরলো।

আবার কি হল?

তোমাকে কার্ড ইস্যু করবো, স্বপ্নে কোনওদিন ভাবতে পেরেছি?

এই পগলামো শুরু করে দিয়েছিস।

সুমন্ত কোনও কথা বললো না।

ছাড় কে এসে পরবে আবার।

জানো দাদা, আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। কার কি ফিলিংস বলতে পারবো না। আমার কাছে এই দিনটার অর্থই আলাদা। সারাটা জীবন আমার স্মৃতিতে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মাকে গিয়ে বলবো, দাদাকে আমি আজ প্রেস কার্ড ইস্যু করেছি। বাবা থাকলে আরও ভালো লাগত।

এই দেখো আবার গণ্ডগোল করে।

না-গো বিশ্বাস করো। তুমি আমার আয়ুটা আরও কয়েক বছর বাড়িয়ে দিলে। আমি সবাইকে জোড় গলায় এখনও বলি, তোমার রক্ত আমার শরীরে বইছে। তুমি যতদিন এই পৃথিবীতে থাকবে আমিও ততদিন এই পৃথিবীতে থাকবো।

ঘরের পরিবেশটা হঠাৎ কেমন ভারি হয়ে গেল।

সুমন্তর চোখ ছল ছল করছে।

ছিদামকে বল ডিম পাঁউরুটি পাঠাতে।

সুমন্ত গলা ছাড়লো।

আমি ছিদামদার কাছ থেকে নিজে হাতে নিয়ে আসছি।

সুমন্তরা বেরিয়ে যাচ্ছিল।

শোন।

সুমন্ত ফিরে এলো।

খামটা সুমন্তর হাতে দিয়ে বললাম, তোর বউ-ছেলেকে এখনও দেখলাম না। কিছু দেওয়াও হয়নি। এই খামটা তোর বউকে দিয়ে দিবি।

আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেব না। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি নিজে হাতে গিয়ে দেবে।

কাল সকালে আসিস, আমি যাব।

ওরা সবাই বেরিয়ে গেল।

তনু, মিত্রা আমার দিকে কেমন ভাবে যেন তকিয়ে। বরুণদা স্থবিরের মতো বসে।

ম্যাডাম খাবার দেব। হরিদার ছেলে দরজা খুলে মুখ বারালো।

আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে বললাম দে।

করুর মুখে কোনও কথা নেই।

মিলি তোমার ফাইলগুলো দাও। খেতে খেতে দেখে নিই।

মিত্রার দিকে তাকালাম।

একবার পিকুকে ডাক। বরুনদা—

বলো।

তুমি বসো এখন যেও না।

হরিদার ছেলে প্লেটে করে খাবার দিয়ে গেল।

খেতে খেতে আমি মিলিদের দেওয়া ফাইলগুলো দেখছি। সমস্যা কোথায় আছে বলে দিচ্ছি।

বিতান আর পিকু ঘরে ঢুকলো।

আরি ব্যাশ কি গন্ধ বেরিয়েছে। পিকু বললো।

একবারে মশাইয়ের প্লেটে হাত দিবি না। তোদের আছে। মিত্রা বললো।

আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। মিত্রা তার মধ্যেই বেল বাজিয়েছে।

বরুণদা—

বলো—

পজিশন কি?

একটু ব্যক লগ হয়ে গেছে।

কেন! পিকু সমস্যা করেছে?

না। আমার গাফিলতি।

হরিদার ছেলে বিতান, পিকুকে খাবর দিয়ে গেল।

খাওয়া চলছে, ছেঁড়া ছেঁড়া কথাও চলছে। ভালো মন্দের ইতিহাস। হাসাহাসি।

বিতান—

বলো—

আবিদের রিসেপশনে বহুত মাল খেয়েছিস। টাল খাচ্ছিলি।

তনু হাসলো।

বেশি খাইনি। একটুতেই কেমন লেগে গেল।

পিকুবাবু তোর থেকে বেশি খেয়েছে। কিন্তু দেখ ও ঠিক ছিল।

পিকু চোরা চাহুনি মেলে আমার দিকে একবার তাকাল, আর একবার ওর মনির দিকে তাকিয়ে ইশারা করল ব্যাপারটা কি?

ওর মনিও ইশারায় বললো, কিছু না।

আমি ফাইল দেখছি আর ওদের সঙ্গে কথা বলছি।

বরুণদা।

বলো।

তোমার ফোন থেকে ইসিকে একবার ডায়াল করে আমাকে দাও।

মিত্রা আমার দিকে তাকাল। দেখলাম বরুনদা পকেট থেকে ফোনটা বার করে টেপাটিপি করে কানে ধরেছে।

ধরো অনি তোমার সঙ্গে কথা বলবে।

বরুণদা ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিল।

ভয়েজ অন করে দাও। কানে দেব না।

বরুণদা তাই করলো।

হ্যালো। বলো—

আমি ও নয়।

ইসি জোড়ে হেসে উঠলো।

দুপুরে খেয়েদেয়ে সুখ নিদ্রা দিচ্ছিস—

স্কুলে বসে ঘুমচ্ছি।

তাই তো, ভুলেই গেছিলাম, তুই তো আবার প্রিন্সিপাল।

তুই এখন ভিভিআইপি, ছোটোখাটো ব্যাপার মনে রাখবি কেন?

তোকে কেন ফোন করলাম বলতো—

সেটাই ভাবছি। নিজের ফোন থাকতে ওর ফোন থেকে কথা বলছিস।

তোর স্কুলে আমাকে একটা চাকরি দিবি—

চাটার একটা সময় আছে। এই ভরদুপুরে কেউ চাটে জানতাম না।

তোর ছেলে আমার পাশে বসে আছে, শুনছে।

শুনুক। ও জানে ওর মশাই কি চিজ।

তৈরি হয়ে গেছে বল—

তা হয়েছে—

তুই এতে খুশি হোস নি—

একটুও না—

পিকুবাবু মা কি বলছে শুনছো?

পিকুর খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।

ঠিক আছে তোর সঙ্গে পরে কথা বলছি।

লাইনটা কেটে দিলাম।

মিত্রার দিকে তাকালাম।

তোর রুমালটা দে।

পকেটে নেই।

বরুণদা হেসে উঠলো।

একবারে হাসবে না। তনুকে জিজ্ঞাসা করো, সকালে সব গুছিয়ে রেখে এসেছি।

তুই বিশ্বাস কর খুঁজে পাইনি।

তনু রুমালটা এগিয়ে দিল।

হাত ধুবি না।

হাতে কিছু লাগে নি। দেখ।

চস্বর। মিত্রা দাঁতে দাঁত চিপে গজগজ করছে।

হাতটা মুছে তনুকে রুমালটা ফেরত দিলাম।

পিকুবাবু।

পিকু কোনও কথা বললো না। আমার দিকে তকিয়ে থাকলো।

আমরা এখানে যারা বসে আছি, তাদেরকে তুমি আমাদের পরিবারের লোক বলে মনে করো?

পিকু মাথা নিচু করলো।

মিত্রা, তনু একটু একটু করে খাচ্ছে।

হ্যাঁ না বলো। তুমি যদি এদের সকলকে আমাদের পরিবারের লোক বলে মনে না করো তাহলে তুমি আমি আলাদা ঘরে বসে আলোচনা করবো।

হ্যাঁ।

তারমানে তুমি মনে করো এখানে যাঁরা বসে আছে সবাই আমাদের পরিবারের লোক।

পিকু মাথা দোলালো।

নম্রতা দাধিয়াকে ছেড়ে দাও।

আমি খুব সাধারণ ভাবে কথাটা বলে ফাইল থেকে মুখ তুললাম।

পিকু চমকে আমার মুখের দিকে তাকাল। স্থির দৃষ্টিতে চোখে চোখ রেখেছে। মুখটা থমথমে। একবারে সরিয়ে নিচ্ছে না। মুখের খাবার মুখেই রয়ে গেছে। গিলতেও পারছে না।

বুঝতে পারছি মিত্রারা আমার দিকে তাকিয়ে।

ভাবছো বিতান ছাড়া এই ভূ-ভারতে ব্যাপারটা আর কেউ জানে না। জানারও কথা নয়। মশাই জানলো কি করে?

আমি মিলির দেওয়া ফাইলগুলো দেখতে শুরু করলাম। সারাটা ঘর নিস্তব্ধ।

তোমার দিদানকে আমি জ্যেঠিমনি বলে ডাকি। আজ নয়, আমার কলেজ লাইফ থেকে। তখন তোমার বাবা-মার বিয়ে হয়নি। দেখাই হয়নি, বিয়ে তো দূরের কথা। তারমানে তোমার জন্মেরও আগে তোমাদের ওই বাড়িতে আমার যাওয়া আসা। মনি, তোমার মা পিঠোপিঠি বোন। তাই তোমার মনি আমার বান্ধবী হওয়াতে তোমার মাও আমার বান্ধবী হলো। আমরা তিনজনেই কিন্তু একই ইয়ারে পাশ করেছি। শুধু বিষয় আলাদা। মনি আমার সহধর্মিণী। তোমাকে আমি প্রথম দেখি তোমার মনিকে যেদিন আমার সহধর্মিণী হিসাবে সামাজিক স্বীকৃতি দিলাম। তুমি তখন আমাকে আঙ্কেল বলতে। তোমার বয়স তখন তিন কিংবা চার।

তোমার মনে আছে কিনা জানিনা। সেদিন তোমাদের বাড়িতে সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ গেছিলাম। তোমাদের সকলকে নিয়ে তোমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম দেড়টা নাগাদ। সেদিন তোমার মা ছাড়াও তোমার দিদানের সঙ্গে আমি টানা চারঘণ্টা মানসিক যুদ্ধ করেছিলাম। তোমার মা আমার ডেড এগেনস্ট। শুধু এগেনস্ট বললে ভুল হবে, সেদিন সে আমাকে অনেক ছোটোবড়ো কথাও বলেছিল। তোমার বাবা তার সাক্ষী। এককথায় বলতে পারো আমাকে বাড়ি থেকে প্রায় ঘার ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছিল। নতুন জামাই, বিয়ে করে প্রথম শ্বশুর বাড়ি গেল, তার রিসেপশনের বহর দেখেছো।

তোমার বাবা আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।

একবার ভেবে দেখতে পারো। সেদিন আমার বিয়ের রিসেপশন। আমার জীবনের সবচেয়ে রিমার্কেবল ডে বলতে যা বোঝায় তাই।

আমার তখন প্রভূত ক্ষমতা, ইচ্ছে করলে তোমাদের পরিবারকে আমি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারতাম। সব জেনেও তাঁদের আমি এতটুকু অসম্মান করিনি। যুক্তি দিয়ে আমার দাবি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলাম। শেষমেষ সেই যুদ্ধে আমি জিতি। তারপর থেকে তোমরা আমার পরিবারের একটা পিলার। আজও।

সারাটা ঘরে পিন পড়লে শব্দ হবে। সবাই বুঝতে পারছে এটা ঝড়ের একটা পূর্বাভাস।

টিনা তোমার ফাইলগুলো আমাকে দাও।

অদিতিরটা আগে দেখে দাও, তারপর আমারগুলো দিচ্ছি।

তোমরটায় ঝামেলা আছে নাকি?

সামান্য।

অদিতি আমার সামনে ফাইলগুলো এগিয়ে দিল।

জানো পিকু।

একটু থামলাম।

জ্যেঠিমনিকে আমি মায়ের মতো শ্রদ্ধা করি। বলতে পারো ছোটোমা, বড়োমা আমার মনে যে আসনে বসে আছে। জ্যেঠিমনিও সেই আসনে বসে আছে। একটা সময় তোমাদের বাড়িতে গেলে, জ্যেঠিমনি বটিচচ্চড়ি লুচি করে দিত। এখনও দেয়। আমার প্রিয় খাবার। বলতে পারো এটাই আমার চরমতম চাহিদা। তোমার থেকে জ্যেঠিমনির সম্বন্ধে আমার কাছে অনেক বেশি তথ্য আছে। কিন্তু কোনওদিন আমি তাঁকে চ্যালেঞ্জ করিনি। কিংবা তাঁর দুর্বল জায়গায় আঘাত দিইনি। কি পরিস্থিতিতে তিনি ওই অবস্থার শিকার হয়েছিলেন, তা অনুভব করার চেষ্টা করেছি। মনে মনে কষ্ট পেয়েছি।

এই কষ্টের ভাগ এখনও পর্যন্ত তোমার মনির সঙ্গে শেয়ার করিনি। এমনকি তনু মনির সঙ্গেও না। ওটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত। নিজের সঙ্গে নিজে ভাগ-বাটোয়ারা করি। মনকে এই বলে শান্তনা দিয়েছি, ওই পরিস্থিতে আমি যদি পরতাম, তাহলে হয়তো এর থেকে অনেক বেশি কিছু করতাম। কম করতম না। গুরুজনকে শ্রদ্ধা করা একটা শিল্প। কিভাবে করতে হয় এটা তোমাকে শিখতে হবে।

আমি পিকুর দিকে তাকালাম। মুখ নিচু করে বসে আছে।

অদিতি এই ফাইলটায় প্রবলেম আছে। রেকটিফাই করে আমাকে দেখিও।

ফাইলটা অদিতিকে ফেরত দিলাম।

মিত্রার খাওয়া শেষ। রুমালে মুখ মুছছে। তনু চুপচাপ।

বিতান টিয়াকে একটু ডাকতো। 

আজ অফিসে আসেনি।

কেন!

চুপচাপ।

বাচ্চাটার শরীর খারাপ?

না।

টিয়ার শরীর খারাপ?

কয়েকদিন ধরে একটা সমস্যা চলছে।

কি সমস্যা?

বিতান চুপ।

কে করছে?

বিতান কোনও কথা বলছে না।

স্কাউন্ড্রেল তোমার এতো বড়ো সাহস। চেঁচিয়ে উঠলাম।

ঘর শুদ্ধু সবাই কেমন থতমত খেয়ে গেছে। হঠাৎ আমি এরকম বায়াস হয়ে যেতে পারি কেউ ভাবতেই পারেনি।

বিতান মাথা নিচু করে। মিত্রার চোখে মুখে বিষ্ময়।

ওপরে গিয়ে দেখে আয়। সুমন্ত যে চায়ারটায় বসে ওই চেয়ারে একসময় সুনীত বলে একজন ভদ্রলোক বসতেন। সেই সময় সে তোর বৌদির আত্মীয় ছিল, তার কি হাল করেছিলাম, অফিসের আনাচে কানাচে একবার খোঁজ খবর করে জেনে নিস।

ঘরে পিন পরলে শব্দ হবে।

বেশ কিছুক্ষণ চুপাচাপ ফাইল দেখে গেলাম। ওরা সবাই আমাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে।

পিকু।

পিকু আর মুখ তোলে না। বুঝতে পারছি ভয়ে থর থর করে দুজনেই কাঁপছে।

দিদানের সম্বন্ধে তুমি কি কি জানতে চাও আমাকে প্রশ্ন করতে পারো।

ফাইল থেকে মুখ তুলে পিকুর দিকে তাকালাম।

আমি তোমার প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দেবো। যা তোমার দিদান কোনওদিন দিতে পারবে না।

দেখলাম খাবার প্লেটে টপ টপ করে জল পড়ছে।

এটা অফিস। কান্নার জায়গা নয়। কাঁদতে গেলে বাড়িতে গিয়ে নিজের ঘরের বলিশ ভেঁজাও। আমি দেখতে যাব না।

আবার চুপ করে রইলম। ফাইল দেখি।

এই কাগজে তোমার দাদুর ফাইভ পার্সেন্ট শেয়ার ছিল। যার বিনিময়ে তোমার ছোটোদাদু তাঁর বাড়ির ভাগ ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই সময় ফাইভ পার্সেন্ট শেয়ারের মূল্য তাই ছিল। বাকি তুমি তোমার দিদানকে যে বিষয় নিয়ে বার বার বিরক্ত করেছো, সেগুলো সবার সামনে জানতে লজ্জা করলে, আমার কাছ থেকে পার্সোনালি জেনে নেবে। যদি তোমার প্রবৃত্তিতে আসে।

আবার চুপ চাপ।

ক্লাবে তোমার মেম্বারসিপ আছে?

কোনও কথা নেই।

তুমি কি তোমার মনির কার্ডে ক্লাবে যাও?

পিকু মুখে কুলুপ এঁটেছে।

আমার কথার জবাব দিচ্ছ না কেন?

স্পিকটি নট।

তুমি যদি মনে করে থাকো সাগর দাধিয়া কাঁচা ব্যবসায়ী তাহলে ভুল করবে।

নিস্তব্ধ ঘর শুধু আমার গলা থেমে থেমে গমগম করে উঠছে।

আমি কারুর দিকেই তাকাচ্ছি না। আমি আমার মতো কাজ করছি কথা বলছি।

তার হয়ে এই স্টেটের চিফ মিনিস্টার কাল আমাকে দেড়শো কোটিটাকার অফার করে গেছে। ক্যাশ চাইলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বাড়িতে পৌঁছে যাবে।

তোমার ফাইভ পার্সেন্ট শেয়ারের ভ্যালু মেরে কেটে পঞ্চাশ কোটি।

বাড়ি সমেত ওই জমিটার মূল্য মেরেকেটে তিরিশ কোটি।

তুমি যদি আমার আত্মীয় না হতে, সাগর দাধিয়া এতদিনে তোমার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিত। এটা কখনও ভেবেছ?

পিকু, বিতান দুজনেই মাথা নিচু করে রয়েছে।

নম্রতা দাধিয়ার ফোন নম্বরটা মোবাইল থেকে ডিলিট করে দেবে। বলে দেবে সে যেন আজ থেকে তোমাকে ফোন না করে। তা না হলে আজ থেকে ঠিক ষাট বছর পর তুমি যেভাবে তোমার দিদানকে ক্রশ করেছো, সেই ভাবে তাকেও তার নাতি ক্রশ করবে।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/zf0HSri
via BanglaChoti

Comments