কাজলদিঘী (১৩৯ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY-জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৩৯ নং কিস্তি
—————————

ফাদারের সঙ্গে তোর পরিচয় পর্বটা একটু বল। নীরু বললো।

হাসলাম। খুব জরুরী—

খোলসা করে যখন বলছিস একটু শুনি। ফাঁকি মারবি না।

হাসলাম।

এখন থাক পরে বলবো।

না না এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় না।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের ভেতর থেকে।

তখন প্রতিদিন খাওয়ার পয়সা জুটতো না। কাকা রিটায়ার করেছে। আমাকে ঠিকমতো পয়সা পাঠাতে পারে না। তখন মাস্টারদের মাইনে কতো আর হতো। সেখানে চারজন পোষ্য। যা ধান হয় তাতে সংসার টানাই কাকার পক্ষে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

বলতে পারিস কাকা টাকা পাঠানই বন্ধ করে দিয়েছিল। কলেজের হস্টেলে তিনমাস পয়সা দিতে পারি নি। আমার জিনিষপত্র রেখে চলে এসেছিলাম। ড. রায়ের সাহায্যে রাহু মুক্তি ঘটলো।

তারমানে স্যার তোর টাকা শোধ করলো।

মাথা দোলালাম।

ওদের চোখে মুখে বিষ্ময়।

তারপর বাসা খুঁজতে গিয়ে দামিনীমাসির পাল্লায়। নিজেকে ওই পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারতাম না। মাঝে-মাঝেই মন বিদ্রোহ করে উঠতো—

তারমানে ডা. আর এল দাসের কেসটা ওই সময়ে? নীরু বললো।

শিয়ালদহ জি আর পি। অনিকেত বললো।

আমি তোকে প্রথম এসটিডি বুথ থেকে ফোন করলাম না। বটা বললো।

তারপর। কনিষ্ক বললো।

সেই সময় মাসি মাস খানেক সময় চেয়েছিল।

তখন তুই থাকতিস কোথায়?

তোদের হাসপাতালের পেছনে ডোমদের যে ঘড় আছে ওখানে।

ওরা সকলে আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।

তারপর!

একদিন ড. রায়কে বললাম, স্যার আমাকে কয়েকটা টিউশনি জোগাড় করে দিন না। স্যার সুরোকে ঠিক করে দিল। তখন সুরো ক্লাস টু-র ছাত্রী। মাস গেলে পঞ্চাশটাকা মাইনে।

নীরু হাসছে।

হাসলি কেনো—

ওই যে পঞ্চাশ টাকা বললি।

সেটাই তখন আমার কাছে অনেক।

কলকাতায় থাকতে খরচ পাঁচশো টাকা। আমার ইনকাম সাকুল্যে দুশো টাকা পঞ্চাশটাকা বাদে মাসির ফাই ফরমাস খেটে বাবুদের কাছ থেকে কিছু টিপস আসতো।

তাও মাঝে মধ্যে ভালো লাগতো না। কেমন যেন লাগতো।

একদিন সকালে উঠে বেরিয়ে পরলাম। সুরোকে বলেছি বারোটার দিকে পড়াতে যাব। ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ক্লাসটা করে কাট।

তখন ম্যাডামের সঙ্গে তোর কোনও রিলেশন ছিল না? নীরু বললো।

না। তবে ওর স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাওয়ার চেষ্টা করছি।

তারমানে ম্যাডাম তোর জীবনে আলোর দিশারী।

না আলোর দিশারী বললে ভুল হবে। আমার শয়নে স্বপনে তখন মিত্রা জড়িয়ে রয়েছে। বলতে পারিস ও আমার কাছে তখন নবগ্রহ কবচ। আমি সেই কবচ ধারণ করে আছি। কাঁচা বয়েস পদস্খলন হতেই পারতো। কিন্তু বার বার ওর ছায়া মূর্তি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পদস্খলন হয়নি এ কথা বলবো না। হতে গিয়ে কবিতা থাপ্পর খেয়েছে। সে এক হুলুস্থূলুস কাণ্ড।

মাসি তখন জানতো না?

এই ঘটনার পর থেকে মাসির চোখটা মাইক্রোস্কোপ হয়ে গেল।

সেদিন মাসি বুঝেছিল অনি আর যা কিছু করুক অন্ততঃ চরিত্রটা এখনও ধরে রেখেছে।

কবে জানলো?

আরও পরে জেনেছিল।

আমরা কবে জেনেছি। কনিষ্ক বললো।

সে তো অনেক পরে। মৈনাক একদিন ইয়ার্কি মেরে বলতে, যখন অনিকে চেপে ধরলাম, তখন ব্যাটা বললো। সামথিংস হ্যাজ।

তারপরেই সুমন্ত কেশ। অনিকেত বললো।

না ওটা অনেক পরের ঘটনা। তখন ও কাগজে চাকরি পেয়ে গেছে। নীরু বললো।

তারপর বল। কনিষ্ক বললো।

সেদিন দাদা ডেকে পাঠিয়েছে। তার আগের দিন শুভঙ্করবাবুর একটা চিঠি দাদাকে দিয়েছিলাম।

সকাল থেকে খাওয়া দাওয়া জোটে নি। মৌলালি পার হয়ে জোরা গির্জার কাছে এসে দেখি বেশ ভিড়। খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম গির্জা থেকে খিচুরি খাওয়ান হবে। পেটকা জ্বালা বড়ো চিজ। লাইন দিলাম। পেটপুরে খিচুরি খেয়ে সুরোকে পড়াতে গেলাম। বিকেলে দাদার কাছে।

লেখার চাকরি জুটলো। ছাপলে পয়সা, না ছাপলে পয়সা নেই। জীবনে প্রথম লিখে পেয়েছিলাম একশো টাকা।

বেড়াল রান্নাঘর দেখে ফেলেছে। আমি প্রায়ই সকালের দিকে সুরোকে পড়াতে শুরু করলাম। প্রথম ক্লাসটা করেই দৌড়। উদ্দেশ্য একটাই খাওয়া দাওয়া করে পড়াতে চলে যাও।

যতই হোক নিজেকে ওদের মধ্যে আড়াল করে রাখতে পারলাম না। একদিন এক লালমুখো সাহেব এসে সামনে দাঁড়াল। আমার দিকে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললো খাওয়ার পর একবার আমার সঙ্গে দেখা করো।

গেলাম।

সাহেব চেপে ধরলো। মনে মনে ভাবলাম ফোঁকটসে খাওয়াটা মনে হয় আজ থেকে গেল। কি আর করবো, উপায়ন্তর না দেখে সব বমি করে দিলাম। ফাদার সব শুনে চুপ করে থাকলেন।

তারপর গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, কাল থেকে তুমি ওদের সঙ্গে বসবে না। আমার ঘরে চলে আসবে। কেউ কিছু বললে বলবে ফাদার হ্যারিসের কাছে যাব।

এই কি সেই ফাদার যার স্কুলে বুঁচকিরা পড়েছে? অনিকেত বললো।

না সেই ফাদার এই ফাদারের পরের জন। ইনি হচ্ছেন মেইন।

এরপর চার্চে ঘন ঘন যাওয়া আসা বারলো। পরিচিতি বারলো। মেইন চার্চ সেন্টপলসে যাওয়া আসা শুরু করলাম। ফাদার মাঝে মাঝে কাজ দিতেন, করতাম। কিছু কিছু পয়সা পেতাম। পরে আর লজ্জায় নিতাম না। যতটা সম্ভব দেওয়ার চেষ্টা করতাম।

মেরিনাদির ব্যাপারটা ফাদারকে বলতে ফাদার বললো, নিয়ে আয় আমি রাখার ব্যবস্থা করবো।

সেদিন রাতে মেরিনাদি আবার এলো। সব বললাম। নিচে চলেগেল। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এলো। একটা ছোটোব্যাগ দিয়ে বললো এগুলো তুই রাখ। কালকে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিবি। আমি মাসিকে বলবো বাড়ি যাচ্ছি কয়েকদিনের জন্য, তারপর তোর সঙ্গে গিরিশপার্কে দেখা করবো।

তোমার আবার বাড়ি আছে নাকি?

তোকে বুঝতে হবে না। মাথা মোটা। বেশ্যা বাড়িতে থেকেও মাথা খোলে না। তোর থেকে ভজু অনেক বেশি বুদ্ধি রাখে।

চুপ করে রইলাম।

পরের দিন আমি গিরীশপার্কের মুখে এসে দাঁড়ালাম।

মেরিনাদি একটা ট্যাক্সি করে এলো। আমি উঠে বসলাম। মেরিনাদিকে ফাদারের কাছে নিয়ে এলাম। ফাদার মেরিনাদিকে পঙ্খানু-পুঙ্খরূপে সব জিজ্ঞাসা করলেন। মেরিনাদি সেদিন কোনও কিছু গোপন করলো না। সব বললো। আমিও মেরিনাদির না বলা অনেক কিছু জানলাম।

একটু বল। নীরু বললো।

না বলা যাবে না।

তারপর ফাদারের গাড়ি করে কলকাতার বাইরে চলেগেলাম।

কোথায় গেলি?

সে বলবো না।

প্লিজ।

রিকোয়েস্ট করবি না। তবে আমি জায়গা দেখে এসেছিলাম। প্রায়ই যেতাম। সেখানে একটা সরকারী হাসপাতালে মরিনাদি একটা কন্যা সন্তানের জন্ম দিল।

এতক্ষণে খুনের ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। বটা হাসতে হাসতে বলে উঠলো।

থাম না, ওকে বলতে দে না। আমাদের কপচাবার অনেক সময় আছে। কনিষ্ক বিরক্ত হলো।

এদিকে ইসলামভাই ফিরে এসেছে। হুলুস্থূলুস কাণ্ড বাধিয়ে দিল। মেরিনা কোথায়? মাসিকে হুমকির পর হুমকি। মাসি একদিন বললো, অনি তাকে বাড়িতে রেখে এসেছে।

আমি রাতে ফিরতে জেড়া শুরু হলো। আমাকে প্রায় তুলে আছাড় মারে। ওই দশা সই চেহারা।

কিছুতেই স্বীকার করলাম না।

আমি তখন ইসলামভাইয়ের টার্গেট হয়ে গেছি। আমি মেরিনাদিকে ভাগিয়ে নিয়ে চলে গেছি।

সে নানা কথা। কাকে কি বলবো। বলতে পারিস চিলে কোঠার ঘরটায় কোনও প্রকারে টিঁকে আছি।

একদিন মরিনাদিকে গিয়ে সব বললাম, ফাদারকেও বললাম, আমার এই অবস্থা। তখন মেয়েটা তিন মাসের।

ফাদার বললো, তুই না গেলে ওরা অনিকে মেরে দেবে। তার থেকে তুই বরং যাওয়া আসা কর। তোর মেয়ের দায়িত্ব আমাদের। মেরিনাদি নিশ্চিন্ত হলো। কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এসে গেল।

আমি সেই রাতটা ওখানে থাকলাম।

পরের দিন ব্যাঙ্কে মেরিনাদি আমি একটা জয়েন্ট এ্যাকাউন্ট করলাম। ফাদারই সব ব্যবস্থা করে দিলো। মেরিনাদি মেয়ের নামে কিছু ফিক্সড করলো। লকার ভাড়া নেওয়া হলো। সেখানে মেরিনাদি অনেক কিছু রাখলো আমাকে সব দেখিয়ে দিল। বার বার বললো। আমার কিছু হলে মেয়ের দায়িত্ব তোর, তুই ওর মামা, এটা মাথায় রাখবি।

তখন ইসলামভাইয়ের কথা কিছু বলে নি।

কাঁচা কাঁচা খিস্তি। এই নটা মাস আমার খুব কষ্ট হয়েছে। হোটেলে কাজ করে ইনকাম করে মেরিনাদিকে দিয়ে এসেছি। মেরিনাদি চার্চের কাজ করে কিছু ইনকাম করেছে। সব মেয়ের জন্য।

যাক মেরিনাদিকে ফিরিয়ে আনলাম। আমি নয় ফাদারের কথা মতো মেরিনাদি একদিন একা একা চলে এলো।

ইসলামভাই মেরিনাদি ফিরে আসার জন্য পার্টি দিল। আমি যাই নি। তারপর দুজনের মধ্যে কি চুক্তি হয়েছে জানি না। যে সপ্তাহে মেরিনাদি পারল গেল না হলে আমি সপ্তাহে তিনদিন যাই। মেরিনাদি আমাকে টাকা দেয় আমি সেই টাকা কিছুটা ফাদারকে, কিছুটা ব্যাঙ্কে জমা দিই।

ইসলামভাই কোনও খবরা খবর নেয় নি। কনিষ্ক বললো।

দুজনেই তো শেয়ানা। মেরিনাদি কমতি ছিল নাকি।

তখন আমি একটু একটু নাম করেছি।

ইসলামভাই আমার খোঁজ খবর নেয়। মাসিরও অনেক কাজ কর্ম করে দিয়েছি। মাসি তখন দিনে দু-বেলা ভালো মন্দ খেতে দিতে শুরু করেছে।

আগে যে দিত না, তা নয়। পয়সার বিনিময়ে। আর বাড়িতে কুকুর বেড়াল থাকলে যেরকম দেয় সেরকম। এ্যাকচ্যুয়েলি আমি কাউকেই দোষ দিই না। এ্যাডজাস্ট হতে একটু সময় লেগেছে।

বেশ চলছিল। আমি আমার মতো থাকি। রাত বিরেতে ঢুকি।

একদিন অফিস থেকে ফিরতে মাসি এলো।

কিগো নিশ্চই কোনও বিশেষ ফন্দি এঁটেছো মনে হচ্ছে।

চুপ করে রইলো।

বলবে তো কি হয়েছে?

অনি ইসলাম বলছে মেরিনাকে বিয়ে করবে।

করুক, তোমার কি?

একটা গণ্ডগোল হয়ে আছে।

আচ্ছা তোমাদের গণ্ডগোল ছাড়া কি কিছু নেই।

মেয়েছেলে নিয়ে ব্যবসা। থানা-পুলিশ, খুন-জখম, না থাকলে ব্যবসা কিসের।

আমি শুনে থ।

তুই অনেকদিন এখানে কাটালি কিছু বুঝিস না তা হয় নাকি।

এই প্রথম মাসি আমাকে শেয়ানা ভাবলো। এতদিন আমি মাসির চোখে গাধা ছিলাম।

পরে অবশ্য মেরিনাদির কাছে শুনলাম মাসিকে মেরিনাদি হিন্টস দিয়েছে, তবে সে বাচ্চা বেঁচে নেই মারা গেছে। আমিই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। ব্যাশ এইটুকু।

তা গণ্ডগোলটা কি। মাসিকে বললাম।

মাসি বললো, ইসলামভাইয়ের এ্যাবসেন্সে মেরিনাদির ঘরে যাকে ঢুকিয়েছিল। সে নাকি ইউপির আর এক ডন। নাম তার জাফর।

ব্যাপারটা খুলে বলো।

সে আসতো, আমি অন্য মেয়ের ঘরে ঢোকাতাম। এখন সে আসবে বলছে। মেরিনাকে তার চাই।

তার মানে দুই ডনের ঝামেলা।

মাসি চুপ করে রইলো।

আমাকে একটু সময় দাও। দেখি কি করা যায়।

কপাল খারাপ, পরের দিন দাদা ম্যাড্রাস পাঠিয়ে দিল। ফিরলাম সাতদিন পর।

এসে শুনি মেরিনাদি মার্ডার হয়ে গেছে। ইসলামভাই ফেরার। পুলিশ খুঁজছে। আমাদের কাগজ রসিয়ে নিউজ করেছে। মাসি বিপাকে পড়ে গেছে।

আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো।

মাসি বাঁচার তাগিদে আমাকে আঁকড়ে ধরলো। আমি দাদার কাছ থেকে ওই পাড়ার ওপর একটা সিরিয়াল লেখার অনুমতি আদায় করলাম। প্রাণ ঢেলে আমার দেখা যতো আজানা কাহিনী লিখলাম। খুব সুন্দরকরে মেরিনাদির গল্পটাও লিখলাম। শুরু হলো আমার জয়যাত্রা। আর পেছন ফিরে তাকাই নি। সেই সময় থেকে অনি ব্যানার্জী সাংবাদিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেল। নাম ফাটলে যা হয় ক্ষমতাও এসে গেল। অনেকেই নাম শুনে ধ্বস খেতে শুরু করলো। একটু একটু করে বাঘ রক্তের স্বাদ পেল।

ফাদারের কাছে গেলাম। তখন ওর বয়স দু-বছর। ফাদর সব জেনেছিল, আমিও সব বললাম। ফাদার সব শুনেটুনে বললো। কি আর করা যাবে আমাদের কাছেই থাক। তুই তো আছিস। এক কাজ কর খাতায় কলমে তুই ওর গার্জেন হয়ে যা। রাজি হয়ে গেলাম।

মেরিনাদির মেয়ে ওখানেই রয়েগেল। কেউ জানলো না তার হদিস।

মেরিনাদির মেয়ে ফাদারের কাছে বড়ো হচ্ছে। সিরিয়াল লিখতে লিখতেই আমার চাকরি জুটলো। ফাদার খাতায় কলমে মেরিনাদির মেয়ের দায়িত্ব আমাকে দিল। আমি ওকে দত্তক নিলাম।

আচ্ছা এখন একটু একটু মনে পড়ে যাচ্ছে সেই সময় আরও দুটো ছেলেকে তুই ফাদারকে দিয়েছিলি। দুটোই ওই পাড়ার মেয়ের সন্তান। নীরু বললো।

তারাও ফাদারের কাছে আছে। তাদের দায়িত্বও আমার। তাদেরও আমি দত্তক নিয়েছি।

শালা বিয়ে করার আগেই বাপ। কনিষ্ক বললো।

আমি হাসছি।

তারা এখন আর ছোটো নেই। নীরু বললো।

হ্যাঁ তা পঁচিশ-ছাব্বিশ হয়ে গেল।

আছে কোথায়?

আমার সঙ্গে বিগতো সাত মাস কোনও যোগাযোগ নেই। ওখান থেকে ফিরে আসার পর কাকার শ্রাদ্ধ, আমার মাথায় চোট, সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল। তবে সিস্টেম করা আছে টাকা পয়সার কোনও অভাব ওদের হবে না।

আর বেচাল হতে পারবে না। ফাদার আছে।

ওরা কোথায় আছে ফাদার জানে না? কনিষ্ক বললো।

তাহলে তো ল্যাটা চুকে যেত। তবে ফাদারের কাছে আসে।

ফাদারও জানে না!

না।

তুই যে বললি সাতদিনের মধ্যে মিটিয়ে দেব।

খুঁজে বার করে নেব। সে সোর্স আমার আছে।

উসমান?

ও কেয়ার টেকার। ওর সঙ্গে দেখা করে, কিন্তু জানায় নি কোথায় থাকে কি বৃতান্ত।

তাহলে এই হচ্ছে ইসলামভাইয়ের খুন। নীরু বললো।

আমি হাসছি।

চিকনা হাততুলে আড়মোড়া ভাঙলো।

নীরু উঠে দাঁড়িয়ে বাথরুমে গেল।

কিরে গল্প শুনে বাথরুম পেয়ে গেল।

অনেকক্ষণ চেপে রেখেছি। বাথরুমের দরজা বন্ধ করলো।

এবার একটু ঘুমো, অনেক রাত হয়েছে। কনিষ্ক বললো।

তোরাও ঘুমো।

নিচে একটু লাট খেয়ে যাব।

তোকে কিন্তু আজ অনেকটা হাল্কা লাগছে। বটা বললো।

আমার চোখটা ছল ছল করে উঠলো।

এই দেখো মন খারাপ করে। তুই তো কখনও কাঁদিস না।

প্রায় পঁচিশ বছর একটা জিনিষ গোপন করে রেখেছিলাম। মেরিনাদির কথাটা রাখতে পারলাম না।

দূর, তুই তো কোনও খারাপ কাজ করিস নি।

শুনেছি তিনজনেই কোথায় ভালো চাকরি করছে। অনেক টাকা রোজগার করছে। এখন আর আমার টাকা নেয় না। যা টাকা পাঠাই ফিরে আসে।

তাতে কি হয়েছে। তোর আনন্দ হচ্ছে না। তারা যে যার নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।

ওদের অনেক অভিমান। আমাকেও ওরা ওদের জীবনে ঠিক ঠিক ভাবে পায় নি।

সেটা কি করা যাবে। তোর ব্যাপারটাও ওদের বুঝতে হবে।

নীরু বাথরুম থেকে বেরোল।

কি হলো!

অনি মন খারাপ করছে।

দূর শালা, তোর মতো হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। তুই কি বিশাল কাজ করেছিস তা কল্পনাও করতে পারছি না।

কনিষ্কর দিকে তাকাল।

হ্যাঁরে কিচেনে ফোন করলে কফি পাওয়া যাবে।

কেনো পাওয়া যাবে না। রাতের সিফটে যারা আছে তারা দিয়ে যাবে, ফোন লাগা।

অনিকেত ইনটরকম থেকে ফোন করে কফির কথা বললো।

আমি চিকনার দিকে তাকালাম।

স্যারের শ্রাদ্ধ কবে রে?

তোকে যেতে হবে না। কেউ মন খারাপ করবে না। নীরু বললো।

আমার এই জায়গায় পৌঁছোবার জন্য স্যারেরও অনেক অবদান আছে।

তুই তার যথেষ্ট প্রতিদান দিয়েছিস। শেষবারে গিয়েও দিয়ে এসেছিস। যার জন্য তোর শরীর খারাপ করেছে। মাথায় রাখবি, আমাকে দারু সব বলেছে। কনিষ্ক বললো।

না না সে জন্য হয় নি। ওটা দারুর মনগড়া কথা।

তোর কিছু হলে আফসোসের সীমা থাকবে না।

আমি চুপ করে গেলাম।

পর্শু তুই যেতে চাইছিস। পরের দিন বড়োমারা আসবে। তোর কোথাও যাওয়া চলবে না। নীরু বললো।

হ্যাঁরে নীরু আমি, তুই যদি ওর সঙ্গে যাই। ঘণ্টা খানেক থেকে চলে এলাম। কনিষ্ক বললো।

কালকের দিনটা দেখি, সেরকম হলে যাওয়া যাবে। ওকে ওই কথাটা বলেছিস…

কোনটা বলতো! কনিষ্ক নীরুর দিকে তাকালো।

ভেঁদোদা।

ভেঁদোদার কি হয়েছে! আমি বললাম।

সব সময় এতো উত্তেজিত হোস কেন। কিছু হয় নি। নীরু বললো।

তাহলে ভেঁদোদার কথা বললি কেনো?

তোকে দেখতে এসেছিল। কনিষ্ক বললো।

আমাকে!

হ্যাঁ।

জানলো কি করে আমি এখানে!

তোকে যেদিন নার্সিং হোমে নিয়ে এসেছিলাম সেদিন বিকেলের দিকে পদু আর ঝুনে এসেছিল।

কেন?

ভেঁদোদা তোকে দেখতে চেয়েছে। তাই বলেত এসেছিল।

তারপর?

বাড়িতে কেউ ছিল না। জগন বলেছে ছোটোবাবুকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে শরীর খারাপ, সবাই নার্সিংহোমে গেছে।

ব্যাশ পরদিন সাত সকালে পদু এসে হাজির। আমি বাগানে ছিলাম।

আমি তো কোনওদিন দেখিনি। প্রথমে দেখে অবাক হয়েছিলাম। তাও আবার সটাং এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করছে তোর কথা। মিলি দেখেছিল। মিলিকে ডাকলাম। বললো, অনিদার বন্ধু পদুদা।

তখন মনে পরলো।

সব বললাম। বিশ্বাস করবি না বারান্দায় পর্যন্ত উঠলো না। মিলি কতবার বললো। আমার নাম জিজ্ঞাসা করলো। তারপর নার্সিংহোমের নাম আর তোর বেড নম্বর নিয়ে চলে গেল।

বিকেলে বাড়ির সবাই এসেছে। আমাকে রিসেপশন থেকে ফোন করলো। পদুর নাম বললো।

নিচে গেলাম। দেখলাম পাঁচ-ছয় জন এসে হাজির। ওপরে নিয়ে এলাম।

তোর ভেঁদোদাকে সেদিন প্রথম দেখলাম বার বার ভজুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। কি ইনোসেন্ট মুখটা। পরণে একটা হাফ প্যান্ট আর হাফ হাতা জামা। খালি পা। তার ওপর একটা কোট।

আমাদের আগে আগে উঠে এলো। তারপর চারদিকে তোকে খোঁজে আর ঝুনের দিকে তাকায়।

তুই তারাহুরা করসি না, ডাক্তারবাবু আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন অনির কাছে।

ঝুনের সাথে পরিচয় হলো। সেই রেশন দোকানের জ্যেঠু তার ছেলে আর ছেলের বৌ পর্যন্ত এসেছিল। ভদ্রলোক আবার স্ট্রোকের পেসেন্ট।

ঘরে ঢুকে ভেঁদোদা কারুর সাথে কথা বললো না। সোজা তোর কাছে চলে গেল।

মুখটা তোর মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখল। একবার তোর মাথায় হাত দিতে গেল, তারপর কি মনে হলো হাতটা সরিয়ে নিল।

জ্যেঠুর দিকে তাকালো। সে কি করুণ চোখ।

কি হয়েছে বল?

পকেট থেকে একটা কাগজের পুরিয়া বার করলো।

জ্যেঠু আমার দিকে তাকিয়ে বললো। ওকে একটু অনিকে ছুঁতে অনুমতি দাও। ঝুনেরা আসার সময় পই পই করে বুঝিয়েছে, দূর থেকে অনিকে দেখবি, কাছে যাবি না, এমনকী ওর গায়ে পর্যন্ত হাত দিবি না।

জ্যেঠুর কথাটা প্রথমে বুঝি নি।

আবার রিপিড করতে বললাম, নিশ্চই ছোঁবে।

সেই কাগজের পুরিয়াটা তোর ঠোঁটে আলতো করে ছুঁইয়ে তোর মাথার শিয়রে রাখলো। আর এক মুহূর্ত ঘরে থাকলো না। ঘরের বাইরে চলে গেল। বাইরে বেরিয়ে দরজার একপাশে চুপচাপ বসে রইল। কেউ একটা কথা মুখ থেকে বার করতে পারলো না। কেউ কিছু বললে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে।

জ্যেঠু, ঝুনে, পদু তোর সম্বন্ধে কতো কথা বললো। যা আমরা কোনও দিন জানতামই না। টিনারা সব গোগ্রাসে গিললো। তোর জ্যেঠুর বৌমা বললো তার কে এক আত্মীয় আবার তোদের কাগজে কাজ করে, মিলি দেখলাম তাকে চেনে।

হঠাৎ দেখি ভেঁদোদা ঘরে ঢুকলো। জ্যেঠুর কাছে হাত পাতলো।

আমরা একটু অবাক হলাম।

এখানে কিছু চিনিস না। কোথা থেকে আনবি।

খুঁজে আনবো।

ভেঁদোদার গলার শব্দ প্রথম শুনলাম। কি আস্তে কথা বলে।

জ্যেঠু নিরুকে বললো, একটা গ্লাস দিতে পারবে।

নীরু অবাক।

কি হবে?

ততক্ষণে আমি টেবিল থেকে তোর গ্লাসটা এনে দিলাম।

কজন আছে গুনেছিস।

মাথা দোলালো।

দশটাকা দিই।

দাও।

মাসি বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, নিচে বললে চা দিয়ে যাবে।

সেই সময় ভেঁদোদার তাকান একবার দেখলে তোর মাথা খারাপ হয়ে যেত, কি ঘৃণা চোখে মুখে। তারপর জ্যেঠু দশটাকা পকেট থেকে দিল। গ্লাসটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি আবার নীচে ফোন করে সিক্যুরিটিকে সব বললাম।

আমি শুধু প্রথম থেকে ওকে দেখে যাচ্ছি। কি চুপচাপ। চোখে মুখের কি অভিব্যক্তি।

তারপর তোর সর্বেশ্বর জ্যেঠু বললো।

জানো কনিষ্ক, আমি দিনরাত ঠাকুরের কাছে একটা প্রার্থনা করি। আমার মরার আগে যেন ভেঁদো মারা যায়। না হলে ওর কথা কে বুঝবে। ওর ভাই পর্যন্ত বোঝে না।

আমরা কথাটা শুনে সবাই স্টাণ্ট হয়ে গেলাম।

ভাবছো আমি এ কি কথা বললাম।

আমরা তাকিয়ে আছি জ্যেঠুর মুখের দিকে।

এই পৃথিবীতে ঋণ স্বীকার করার মানুষ কম আছে। ভেঁদো আর বাঁশী ঋণ স্বীকার করতে জানে। অনি মনেহয় এই বিদ্যেটা ওদের দুজনের কাছ থেকে শিখেছে।

ভাবছো বুড়ো মানুষটা কি সব আজেবাজে বকছে।

সত্যি জ্যেঠু আপনার কথা শুনে আমরা কেমন অবাক হয়ে যাচ্ছি।

আমার ছেলেটা ওকে কোনওদিন বুঝবে না। যদি অনি ওকে নিজের কাছে নিয়ে এসে রাখে, সেটা আলাদা। হয়তো অনির কথায় ও জায়গা পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু আর কাউকে ও পাত্তা দেবে না। তাতে রাস্তায় পরে মরতে হয় মরবে।

কেন বলছি?

জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম।

অনির মাথার শিয়র থেকে পুরিয়াটা নিয়ে এসো।

আচ্ছা তোমাদের কোনও ইন্টারেস্ট হয়নি ও পুরিয়াতে করে কি নিয়ে এসেছে।

ঠাকুরের ফুল নিয়ে এসেছে অনিদার জন্য। মিলি বললো।

না মা। ও ঠাকুরকে নমস্কারও করে না। আর ওর ওসবে বিশ্বাস নেই। ও এমন একটা মানুষ কোথাও যদি দরিদ্র নারায়ণ সেবার খিচুরি খাওয়া হয় সেখানে ও যাবে না। তার থেকে না খেয়ে পরে থাকবে। কিন্তু তুমি যদি একটা পাঁউরুটি কিনে ওর হাতে দিয়ে বলো ভেঁদোদা তুমি এটা খাও। দেখবে সেটা ও খাবে।

এই ওই পুরিয়াটা দাও দেখি কি আছে। মিলি আমার দিকে তাকিয়ে বললো।

জ্যেঠু হাসছে।

নীরু তোর মাথার শিওর থেকে পুরিয়াটা তুলে বললো কেমন দানা দানা ঠেকছে।

নিশ্চই ফুল নয়।

সবার চোখ তখন পুরিয়ার দিকে।

নীরু পুরিয়া খুলে বললো এতো চিনি।

পদু হাসতে হাসতে বললো, অনি চিনি খেতে ভালোবাসেতো তাই জ্যেঠুর দোকান থেকে নিয়ে এসেছে।

আমি হাসলাম।

মিলির মুখ থেকে শোনা তোর গল্পটা মনে পরে গেল। কনিষ্ক বললো।

তারপর জ্যেঠু বললো।

কনিষ্ক তোমাদের ডাক্তারী শাস্ত্রে এই সাইক্লোজির কোনও ব্যাখ্যা আছে।

জ্যেঠুকে কি বলি। চুপ করে রইলাম।

জানো ওর মাথাটা ডাল, কোনও কথা মনে রাখতে পারে না। কিন্তু কোনও কোনও ছবি ওর চোখে ফ্রেমের মতো বাঁধানো হয়ে আছে। তার মধ্যে অনি যখন হোস্টেল লাইফে আমাদের পাড়য় থাকতো খেলাধুলোর ফাঁকে ফাঁকে ভেঁদোর কাছ থেকে চিনি চেয়ে খেত। শুধু অনি বললে ভুল হবে পদু, ঝুনে ওদের ব্যাচের সবাই।

তা অনির শরীর খারাপ ওর তো কিছু অনার দরকার, কি আনবে। একটু চিনি নিয়ে এসেছে।

সকালে পদু গিয়ে যখন আমাকে বললো। তখন আমি দোকানে বসে আছি। ও আমার চেয়ারের পাশে নীচে বসে আছে। কথাটা শুনে ও কেমন ছটফট ছটফট করছিল। আমি বললাম এখন যাব না, বিকেল অনিকে দেখতে যাব।

হন হন করে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। আবার কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো।

আমি দেখেছি ওষুধের দোকান থেকে ও একটা ঠোঙা চেয়ে নিয়ে এসে চিনি ভরেছে। তখনই আমি বুঝেছি এটা নিয়ে ও অনির কাছে যাবে। আমার অনুমান কতটা ঠিক এখন বুঝতে পারছো।

এর ব্যাখ্যা তোমরা দিতে পারবে না। অনি ওকে চিনেছে ও অনিকে চিনেছে। ওর কিছু দেওয়ার নেই, অনিরও ওর কাছে কিছু চাওয়ার নেই ওইটুকু চিনি ছাড়া।

জ্যেঠু তখন এক নিঃশ্বাসে কথা বলে যাচ্ছে। আমরা তখন সবাই শ্রোতা।

আমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা কর ও কিন্তু দোকানে ছিল, ওর চোখে পরে নি।

সম্ভব নাকি। তুমি যেভাবে ভেঁদো কাকাকে বুঝবে আমার পক্ষে সম্ভব। জ্যেঠুর ছেলে বললো।

এবার তোমাদের আর একটা অনুমানের কথা বলি দেখবে মিলে যাবে। গ্লাস নিয়ে ও চা আনতে গেছে। এনে তোমাদের কাউকে দেবে না। ভাঁড়ে করে প্রথমে অনিকে দেবে।

ভাবছো অনিতো শুয়ে ঘুমচ্ছে। ও নিজেও জানে অনি ঘুমচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে খাবে।

তাই অনি ফার্স্ট। তারপর আমাকে দেবে, তারপর তোমরা সবাই। শেষে গ্লাসে যেটুকু থাকবে, সেটা নিয়ে বেরিয়ে যাবে।

বিশ্বাস কর অনি জ্যেঠু যা বললো হুবহু তা মিলে গেল। তার আগে ওই চিনির প্যাকেটটা তোর মাথার শিয়রে রেখে দিয়েছিলাম। চিনির প্যাকেটটা চায়ের ভাঁড়ের পাশে রেখে দিল।

যাওয়ার সময় নিজের কোটের এক কোনা দিয়ে তোর ঠোঁটটা মুছিয়ে দিয়ে গেল।

কনিষ্ক থামলো।

ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, নিজেকে কোনওপ্রকারে সামলে নিলাম।

কিরে মন খারাপ করলি?

কথা বলতে গিয়ে গলায় আটকে গেল। মাথা দোলালাম। না।

ভেঁদোদা কেন তোকে এতোটা রিঅ্যাক্ট করেছিল কাল বুঝলাম।

নীরু অনিকে ওষুধ দিবি না। বটা বললো।

থাক কাল সকালে খাবে।

যদি না ঘুমোয় আবার গণ্ডগোল।

তাহলে একটা দিয়ে দিচ্ছি। অনিকেত ড্রয়ারটা খুলে দেখতো আছে কিনা।

তুই রাখলে না থাকার কি আছে।

আমি এই কদিন চ্যানেলে পুশ করেছি।

অনিকেত ড্রয়ারটা টেনে বললো আছে।

একটা ছিঁড়ে অনির হাতে দে। খেয়ে নিক।

হ্যাঁরে তোরা কফি খাবি, আমি ঘুমবো।

কফি খেয়ে খাবি। আমি কি তোকে এখন খেতে বলছি।

দিয়ে যা, লাগলে খাবো।

তাহলে এখন খেয়ে নে।

তারপর হাফ কফি খাবো আর ঘুমিয়ে পরবো।

তাহলে তো ভালই আমরা নিশ্চিন্তে যেতে পারবো।

নার্সিংহোমের সব ফর্মালিটি সেরে বেরতে বেরতে প্রায় এগারোটা হয়ে গেল।

নেপলা ভীষণ ফাজলামো করছে।

ছাড়ো একটা ধজামার্কা শরীর বানিয়েছ। একটুতেই নার্সিংহোম।

ইসলামভাই হাসছে।

তবে হ্যাঁ, দাদাভাইয়ের গায়ে যা জোর, তোমার ওই প্যাটকা শরীর নেবেই বা কি করে।

আমি হেসে যাচ্ছি।

কনিষ্ক বললো, তোরা যা আমরা দুপুরের দিকে যাচ্ছি।

কনিষ্কদা, আজ দাদাভাই অনিদার গাড়ির ড্রাইভার।

কেন?

কি জানি নতুন চুক্তি হয়তো।

ইসলামভাই, নেপলার কথা শুনে হাসছে।

আবিদ, রতন, নেপলা একটা গাড়িতে বসলো, আমি ইসলামভাইয়ের গাড়িতে।

আমি সামনে বসলাম। ইসলামভাইকে আজ বেশ ঝকঝকে লাগছে। কথা মতো সকালেই এসেছে। ইসলামভাই বিশেষ কথা বলছে না। কিছু বললেই শুধু হেসে যাচ্ছে। গাড়িতে বেশি কথা বললাম না। শরীর কেমন আছে কি বৃতান্ত বলেই শেষ করে দিলাম।

মিনিট পনেরোর মধ্যেই বাড়ি পৌঁছেগেলাম।

আবার হই হই শুরু হয়ে গেছে। আমি ফিরেছি।

মাম্পি, মিকি গাড়ি থেকে নামার সময়েই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো।

তোমাকে সেই দুষ্টু লোকটা ধরে নিয়ে গেছিল?

প্রথমে ওদের কথা ঠিক বুঝতে পারি নি। মিলির ইশারায় বুঝলাম।

আমি হাসলাম।

আসুক আচ্ছা করে দেব।

আমি দুটোকে কোলে তুলে নিয়ে বারান্দায় এলাম। সবার চোখ, মুখ বেশ পরিষ্কার।

সবাই কলকল করছে। ঘরে ঢুকে দেখলাম জ্যেঠিমনি সোফায় বসে, ইসি রান্নাঘরে।

কাছে এসে বসলাম। জ্যেঠিমনি হাসছে।

তোমাদের মাঝে মাঝে খুব বিপদে ফেলি না।

আঙ্কেল আঙ্কেল দুজনে গাল ধরে টানাটানি শুরু করেছে।

ওদের দিকে তাকালাম।

মনিকে বকো।

কেন।

মনি দিদাকে বকেছে।

দাঁড়া বিচ্চু যাচ্ছি। ইসি রান্নাঘর থেকে চেঁচাল।

তুই বকে দিতে পারিস নি।

ওইটা বল। মিকি বললো।

দেখছিস, সুরোরটা কিরকম মনে করিয়ে দিচ্ছে। ইসি রান্নাঘর থেকে এগিয়ে এলো।

কিছুক্ষণ ওদের কথা শুনতে হলো। তারপর বললাম যা ভজু বাগানে কি করছে দেখ।

ওরা বেরিয়ে গেল।

তুই এখন ফিট। ইসি বললো।

কেন, দেখে কি আনফিট মনে হচ্ছে।

তাহলে তোর বরুণদাকে একটা ফোন করবো।

হাসলাম।

মাসি জলের গ্লাস নিয়ে এগিয়ে এলো। হাত থেকে নিয়ে জল খেলাম।

ইসলামভাই সমানে মুচকি মুচকি হেসে যাচ্ছে।

চা খাবি?

দুধ নয় কিন্তু।

মাসি হাসলো।

দামিনী ওকে দেবে না। জ্যেঠিমনি বললো।

এখন থাক, পরে দেব।

তাই ভালো।

কি জ্যেঠিমনি?

তোকে শুনতে হবে না। ইসি বললো।

ভালো।

নেপলারা দেখলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে উসখুস করছে। বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। বুঝলাম আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। উঠে দাঁড়ালাম।

কোথায় যাচ্ছিস? ইসলামভাই বললো।

দাঁড়াও বাবুরা খুব উসখুস করছে, একটু কথা বলে আসি।

ওদের অনেক কথা, আজ শেষ হবে না।

তুমি জানো?

আমাকে বলেছে। তুই অনুমতি না দিলে এগোতে পারছে না।

জ্যেঠিমনি হাসছে।

মাসি, আমি ও ঘরে আছি।

আমার গলা শুনে মিলি বড়োমার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

তুমি ও ঘরে কি করতে যাচ্ছ, এ ঘরে বসো।

যা বাবা। এ ঘর থেকে ও ঘরে যেতে পারবো না?

নিশ্চই আবিদদা, নেপলা খুচ খুচ করছে। মিলি বলে উঠলো।

নেপলা ছিটকে বারান্দার ওপাশে চলে গেল। রতন, আবিদ আমগাছের দিকে মুখ ঘুরিয়ে।

মিলি বারান্দায় বেরিয়ে এলো।

তোমাদের কি আর কোনও কাজ কর্ম নেই? অনিদাকে এখুনি বলতে হবে।

নেপলা মুখে আঙুল দিয়ে চুপ চুপ করছে।

মাসি শুনুক না, মাসিকে শোনানর জন্যই বলেছি।

ব্যাপারটা কি মিলি! মাসি রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে।

যাও গিয়ে শোনো।

নেপলারা হাসছে।

মাম্পি, মিকি ভজুর সঙ্গে বাগানে পাতা কুড়চ্ছে।

কাছে আসতেই আবিদ, নেপলা প্রায় কোলে তুলে নিয়ে চলে এলো এ ঘরে।

রতনদা দরজা বন্ধ কর। কিছুতেই ফাঁকে পাই না। আজ এই, কাল সেই।

কি হয়েছে বলবি তো?

খাটে বসো আগে।

বসলাম।

আবিদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। রতন বললো।

মাথা খারাপ কেন! আবার কি ঝামেলা পাকালি?

সে অনেক ঝামেলা।

আবিদ ফিক ফিক করে হাসে।

আবিদদার আর তর সইছে না। নেপলা বললো।

আমি হাসছি।

তোমার শরীরটা গণ্ডগোল হয়ে বেচারা ঝামেলায় পড়েগেছিল। যেই শুনেছে তুমি ফিট আবার চনমন করে উঠেছে। বৌদিও বলেছে আর দেরি করা চলবে না। এরপর দেরি হয়ে গেলে করা না করা দুই সমান।

দাঁড়া দাঁড়া তারমানে আবিদ অলরেডি গণ্ডগোল করে ফেলেছে।

তাহলে! দেখলি আবিদদা, শুধু একটু ছুঁয়ে দিবি, তাহলেই ব্যাস। নেপলা খাটে আমার পাশে বসে জড়িয়ে ধরলো।

নীরুদাকে দেখিয়েছিস। আবিদের দিকে তাকালাম।

নীরুদা কনফার্ম করে দিয়েছে। রতন বললো।

আবিদ মুখ নিচু করে মাথা দোলাচ্ছে।

তোর বৌটাকেই আজ পর্যন্ত চোখের দেখা দেখলাম না। এ বাড়িতে এসেছে?

দু-বার।

আমি ছিলাম না?

কলকাতায় ছিলে, বাড়িতে ছিলে না।

দেখ আমাকে কেউ বলে নি।

চলো আজ।

এতদিন যখন দেখি নি। কয়েকদিন পরই দেখবো। বড়োমারা জানে?

সব কথা বলা হয়ে গেছে। দাদাভাই ঝামেলা করলো তাই—নেপলা বললো।

খালি বাজে বকে।

বাজে বকি, তোমাকে এমন টিপে ধরলো একবারে নার্সিংহোম।

নারে দাদাভাই-এর দোষ নয়। ইমোসন্যালি ঘটনাটা ঘটে গেছে। আবার নাও ঘটতে পারতো।

সত্যি এ্যাক্সিডেন্টের পর তোমার শরীরটা একবারে ধ্বসে গেছে। রতন বললো।

এর থেকেও বড় ফাঁড়া গেছে ওই সময়। নেপলা বললো।

আবিদ মুখ তুললো।

ঠিক বলেছিস। তখন আমরা চোখের দেখা দেখি নি। দেখলে কি করতাম জানি না।

সেই সময় মারানভাই-এর ক্ষমতা দেখেছিলাম।

কবে ডেট ঠিক করলি। রতনের দিকে তাকালাম।

এখনও ঠিক করিনি তুমি গ্রীণ সিগন্যাল দিলে তবে আজ থেকে কাজে লেগে পরবো।

এই কয়টা দিন আমাকে তোরা পাবি না।

সে জানি। তুমি দাদাভাইকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।

সেদিন তোরা ইসলামভাইকে নিয়ে কোথায় গেলি?

দাদাভাই তোমায় কিছু বলে নি!

কথাই বলি নি।

তাহলে গাড়িতে একসঙ্গে এলে যে!

চুপচাপ ছিলাম।

সেদিন পার্কসার্কাস সেমিট্রিতে গেছিলাম। রতন বললো।

কেন!

একজন ভদ্রমহিলার কবরের সামনে বসে অনেকক্ষণ কাঁদলো। নেপলাকে ফুল আনতে বললো। নিজে হাতে সাজালো। প্রার্থনা করলো।

তোরা কিছু জিজ্ঞাসা করিস নি?

দাদাভাইকে! আমরা! সেই সাহস আছে? রতন বললো।

তারপর থেকে আমাদের সাথে সেইভাবে কথাই বলে নি। আবিদ বললো।

আজ নিজে থেকে বললো। নেপলা বললো।

কি বললো?

অনেক সকালে উঠেছে। আমি এই ঘরে শুয়েছিলাম। আমাকে ডেকে বললো, আবিদ, রতনকে খবর দে অনিকে নার্সিংহোম থেকে আনতে যাব। তখন জানলাম তোমাকে ছাড়া হবে।

কেনো কাল জানতিস না?

সাড়ে দশটার সময় দাদার সঙ্গে কনিষ্কদার কথা হলো, বললো এখনো ঘুমচ্ছে। সেটা শুনে আবিদদা, রতনদা চলে গেল। দাদাভাই কিছু খেল না। শুয়ে পরলো। দুটো দিন যা গেল না।

ইকবালভাই আসে নি?

সারাটাদিন এখানেই পরে থাকে। আজ শুক্রবার, তাই একটু দেরি হবে আসতে।

দাদারা মনে হয় কাল রাতের দিকে আসবে।

হ্যাঁ।

মাসি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো।

মুখে কপট গাম্ভীর্য।

পেট ফুলে যাচ্ছিল না।

তুমি থামো মাসি, দাদাকে না বললে হয়। এরপর বড়োমারা এসে পরবে দাদাকে আর পাওয়া যাবে। দাদারও একটা মতামত নেওয়া দরকার। নেপলা বললো।

মাসি আমার দিকে তাকাল।

ইসি গরম গরম পুলি পিঠে তৈরি করছে। খাবি।

সেই দুধ!

মাসি হেসে ফেললো।

কার মনের অবস্থা ঠিক ছিল বল যে করবে। কালকে তোকে দেখার পর ইসিকে ফোন করলাম, বললো, মাসি আমি সকালে পৌঁছে যাব। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।

তোমার মামনির সঙ্গে ট্যাঙস ট্যাঙস করো নি।

করেছি।

নিয়ে এসো দুটো, খাই।

তাহলে পরে চা খাস।

তাই হোক।

মাসি চায়ের কাপ নিয়ে চলে যাচ্ছিল।

ও মাসি কাপটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছ। নেপলা ছুটে গেল।

কাপটা হাত থেকে নিয়ে নিয়েছে।

আনলেই বা কেন ফিরিয়েই বা নিয়ে যাচ্ছ কেন।

মাসি নপলার হাতে কাপটা দিয়ে চলে গেল। ওরা তিনজনে ভাগ করে খেল।

দিন-টিন কিছু ঠিক করেছিস। রতনকে জিজ্ঞাসা করলাম।

দাদভাই বলেছে আগামী শুক্রবার।

তাহলে তাই কর।

এ বাড়িতে হবে না। আবিদ বললো।

কোথায় করবি?

আমি পার্ক হল ভাড়া নেব। আবিদ বললো।

অন্য কোনও অসুবিধে আছে।

আছে। সকালে এই বাড়িতে আসবো। এখানে খাওয়া দাওয়া হবে। সারাদিন থেকে বিকেলের দিকে সবাই বেরিয়ে যাবে। পার্টিটা ওখানে হবে।

বড়োমাদের এসব কথা বলেছিস?

বলেছি।

বড়োমা কি বলেছে?

বড়োমা রাজি হয়েছে।

তাহলে হয়েই গেল।

আর একটা কথা আছে।

বল।

আমি এখনও রেজিস্ট্রি করি নি। সেদিন করবো। অনুপদাকে তুমি একটু বলো।

কেন হিমাংশুদা করলে হবে না।

হিমাংশুদা বলেছে আমি এসব করি না। লোক দিতে পারি। তবে অনুপ করতে পারে।

অনুপদাকে নেমন্তন্ন করে দে।

কার্ডটা তুমি তৈরি করে দাও।

দ্বীপায়ণকে বল, আমার থেকে ভালো তৈরি করে দেবে।

তুমি বলে দাও।

ঠিক আছে বলে দেবো।

মাসি, ইসি, মিলি ঢুকলো।

মাসি—নীপা, সুবীর, চিকনা গেল কোথায়? আসার পর একবারও মুখ দেখলাম না।

কালীঘাট গেছে।

কেন?

ওখানে কি করতে যায় শুনি।

তা ঠিক। মনে হচ্ছে হাই অথরিটির সঙ্গে ফোনে কিছু কথাবার্তা হয়েছে।

ইসি হাসছে। টেবিলের ওপর ট্রে রাখল।

কথা হয় নি। মাসি বললো।

হতেই পারে না। আমি বললাম।

তুই কি করে বুঝলি? ইসি বললো।

বুঝলাম।

বলনা একটু শুনি।

গলার টিউনটা শুনছিস না। বলে দিয়েছে, বাড়ির থেকে বেরবার নাম করলেই তুমি ঠ্যাঙ ভেঙে রেখে দেবে, তারপর আমি গিয়ে বুঝে নেব। পাওয়ার, বুঝলি ইসি পাওয়ার।

মাসি হাসছে।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/ywAKYf0
via BanglaChoti

Comments