কাজলদিঘী (১৯৫ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯৫ নং কিস্তি
—————————–

দৃশ্যটা দেখে বুকের ভেতরটা ভীষণ যন্ত্রণা করে উঠলো। চোখ দুটো কেমন জ্বালা জ্বালা করছে। বিছানা থেকে উঠতে চাইলাম। সমস্ত শরীরটা কেমন ভারিভারি ঠেকল। আমি কিছুতেই নড়াচড়া করতে পারছি না।

বিধানদার চোখে মুখে হাসির ছটা। মাসীমনির চোখদুটো কেমন ছল-ছলে।

ঘরটা ভরে গেল।

তোর সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিস। ডাক্তারদা ধমকে উঠলো।

আমি ডাক্তারদার দিকে আর মুখ তুলে তাকাতে পারছি না।

বিধানদা হুইল চেয়ারটা নিয়ে এসে একবারে খাটের কাছে দাঁড় করাল।

মাসিমনি আমার মুখো মুখি।

আমি স্থবিরের মতো এগিয়ে গিয়ে মাসিমনির হাতদুটো চেপে ধরলাম। কাঁদতে পারছি না। বুকের মধ্যে নিঃশ্বাস আটকে আছে। ঠিক মতো নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

আমি মাসিমনির মুখের দিকে তাকিয়ে।

কাল যেরকম দেখে এসেছি। আজ যেন তার থেকে অনেক বেশি ঝক ঝকে। সাদা চুলগুলো অনেক বেশি বিন্যস্ত। পরনের সাদা লাইনপার তাঁতের শারীটার মধ্যে ঐতিহ্যের মিশেল। কালকের থেকে মাসিমনিকে অনেক বেশি রাসভারি লাগছে। আমি কোনও কথা বলতে পারছি না। শুধু তাকিয়ে আছি।

শোন আমি, অনিমেষ দুটোর ফ্লাইটে দিল্লী যাচ্ছি। তোর আফতাবভাই এগারটা সাড়ে এগারটায় নামবে। ছটা থেকে মিটিং। কাল সকালের ফ্লাইটে সকলে একসঙ্গে ফিরবো। আমার জিনিষ তোর কাছে গচ্ছিত রেখে গেলাম। যে ভাবে রেখে যাচ্ছি সেই ভাবে এসে ফেরত নেব, মনে রাখবি।

নিস্তব্ধ ঘরে বিধানদার গলাটা গম গম করে উঠলো।

আমি বিধানদার দিকে তাকলাম। হয়তো চোখ দুটো ছল ছল করে উঠেছিল।

না না একবারে নয়। অনি কোনওদিন কাঁদে না।

বিধানদার গলাটা সামান্য ধরে এলো।

আমি স্থবিরের মতো বসে।

বিধানদা এগিয়ে এসে আমার কাঁধদুটো ধরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিল।

আমি মাথা নীচু করে নিলাম।

নিস্তব্ধ ঘর। বড়োমা, ছোটোমা, বৌদিদের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না।

তুই তোর বিধানদার সঙ্গে ফক্করি করতিস। সুতপা কতবার তোকে বকা-ঝকা করেছে। সেটা যে এতো বড়ো সত্যি হয়ে এই শেষ বয়সে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করিনি। বিধানদার গলাটা আবার গমগম করে উঠলো।

আমি হাতের তালু দিয়ে চোখটা মুছলাম।

কইরে মিত্রা। কোথায় গেলি সব। বাবাঃ এ ঘরে দেখি বেশ ভিড়।

গলাটা পরিচিত ঠেকল। ছল ছল চোখে মুখ তুলে তাকালাম।

গেটের মুখে ফাদার, উসমান দাঁড়িয়ে।

ফাদার ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। সারাটা মুখে হাসির ছটা।

বিধানবাবু ও ওইভাবে বসে আছে কেন?

পরিচিত মুখগুলো আজ ওর কাছে ভীষণ অপরিচিত মনে হচ্ছে।

ফাদার হাসছে।

ওঠ এইভাবে তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে না।

আমার হাত ধরে ফাদার দাঁড় করাল।

তুই গৃহী সন্ন্যাসী তাই তুই দাদা। আমি পিওর সন্ন্যাসী তাই আমি ফাদার।

আমি ফাদারের মুখের দিকে তাকিয়ে।

বুঝলি, মিত্রা যখন সাড়ে চারটের সময় ফোন করলো, বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছিল। এক নিমেষে হার্টবিটটা হাজারগুণ বেড়েগেছিল।

ফাদার মিত্রার মুখের দিকে তাকাল।

মিত্রা ইশারা করছে। এই সব কথা বোলো না।

ফাদার হাসলো। আমার মুখের দিকে তাকাল।

ভাবলাম তোর আবার কিছু হল নাকি। সেদিনকার পর থেকে তোকে নিয়ে ভীষণ ভয়ে ভয়ে থাকি। তারপর সব বলার পর বললো, তোমাকে যে করেই হোক একবার আসতে হবে।

ফাদার আমার চোখে চোখ রেখেছে।

কিরে অন্যায় করলাম।

ফাদার হাসছে।

তোর এতো বড়ো মিশনে আমিও অংশীদার। একটা ছোট্ট করে থ্যাঙ্কস দে।

ফাদার আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত রাখল।

মাসীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দে।

ফাদার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

চুপ করে থাকলে চলবে। কিছু বলতে হবে। তুই আর একটু সময় চেয়েছিলি। ওদের তর সইলো না। কি করবি। ফেলে দিতে পারবি না। দুই মেয়ে সকাল বেলা ফোন করে আমাকে কি ধমকানি। তুমি যাবে কিনা বলো। এসে ঠিক করিনি বল?

মিত্রা-তনুর দিকে তাকালাম। চোখে মুখে হাসছে। ভাবটা এরকম কেমন মজা দেখ।

বুকের ভেতরের চিনচিনে ব্যাথাটা এখন অনেকটা কম।

যা ফ্রেশ হয়ে নে। সকলে তোর জন্য অপেক্ষা করছে।

ফাদার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

ওদিকে তো আবার কি সব বাধিয়ে রেখেছিস।

আবার কি বাধাল!

বিধানদা ফাদারের মুখের দিকে তাকাল।

কেন আপনি, অনিমেষবাবু কিছু শোনেননি!

না।

উসমানের কাছে শুনুন। ও কোথথেকে শুনে এসে কাল রাতে আমাকে বললো।

ফাদার বড়োমার মুখের দিকে তাকাল। চলুন আমরা ও ঘরে যাই।

বিধানবাবু।

বিধানদা ফাদারের মুখের দিকে তাকাল।

বড়োমা ফাদারের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল।

অনিমেষবাবু আপানার সঙ্গে একটু বসবো।

আপনার আবার কিসের সমস্যা ফাদার।

এতক্ষণে অনিমেষদার গলা পেলাম।

লোকের ভাল করার দীক্ষা নিয়েছি। সমস্যা হবেই।

তাহলে কি….!

সব জড়িয়ে মরিয়ে আছে বুঝলেন। আপনারা ওকে যতদিন দেখছেন আমিও কম বেশি ততদিন দেখছি। তবে আমার থেকে ফাদার রবার্টস ওকে বেশ ভাল বুঝতেন।

ফাদার আমার মুখের দিকে তাকাল। হাসলো।

কিরে তাই তো?

মাসিমনি ফাদারের মুখের দিকে তাকিয়ে।

মাসি আপনার বনপো কিন্তু ভীষণ সরেশ।

মাসি হাসছে।

এই আঠার বছরে ও যতবার আপনার কাছে গেছে। যাওয়ার আগে, নয় ফেরার পথে আমার সঙ্গে দেখা করেছে। কি কথা আপনার সঙ্গে হয়েছে কিছুটা বলেছে। তাতে যা বুঝেছি, ও আপনাকে মাত্র পনেরো ভাগ বলেছে। এখনও পঁচাশিভাগ বাকি আছে।

মিত্রা, তনু ওর বড়োমা, ছোটোমা, সুতপা হয়তো আপনাকে আরও ষাট ভাগ বলতে পারবে। বাকি পঁচিশ ভাগ আমি যেমন জানি না। এরাও কেউ জানে না।

অনিমেষদা খুব জোড় হেসে উঠলো।

হাসলেন কেন অনিমেষবাবু?

আপনি খুব ভাল প্রেডিকসন করেছেন।

ঠিক বলেছেন, এটা প্রেডিকসন নয়, অনুভব করি। অনেক চেষ্টা করি বোঝার, বুঝেও বুঝে উঠি না। এটুকু বুঝি কষ্টগুলো ও একা শেয়ার করে নিজের সঙ্গে, সুখের সময়টুকু সকলের সঙ্গে ভাগ বাঁটোয়ারা করে।

ডাক্তার, তোমার ওপর ও তরপেছিল, বড়োমার গলার ভয়েসে সকলে হাসল।

সে সুযোগ দিইনি।

কি সোনা তোমায় বেলেছিলাম। ও ডাক্তাররের কাছে ঢিঁট, আমরা থাকলে তুরি মেরে উড়িয়ে দিত। তুমি তখন বিশ্বাস করছিলে না। নিজে চোখে দেখলে।

আন্টি হাসছে, সকলে হাসছে।

ডাক্তারবাবুর সঙ্গে ওর তালমিলটা বেশ সুন্দর। ফাদার বললেন।

বান্ধবী এবার চা হবে। ডাক্তারদাদা বললো।

এই তোমার দোষ, থেকে থেকে খালি চা।

সকলে হাসছে।

ছোটোমা, বৌদি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। দাদা, মল্লিকদাকে দেখতে পাচ্ছি না।

চলো দিদি আমরা ও ঘরে যাই।

ফাদার এগিয়ে গেল।

মাসিমনি আমার হাতটা ধরলো।

ও ঘরে আয়। একসঙ্গে চা খাব।

আমি মাসিমনির দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

তনু এগিয়ে এসে মাসিমনির হুইল চেয়ারে হাত রাখল। আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করল।

তুমি বাথরুমে যাও, আমরা আসছি।

মাথাটা নামিয়ে নিলাম।

সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ডাক্তারদাদা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।

তুই তো আবার ওদের থেকেও বেশিক্ষণ সময় কাটাস। আজ একটু তাড়াতাড়ি করিস। তুই না গেলে বান্ধবী চা দেবে না।

আমি ডাক্তারদাদার মুখের দিকে তাকালাম। হাসছে।

টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলাম। টুথব্রাসে পেস্ট লাগিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম।

ইসি, জ্যেঠিমনিকে তখন দেখিনি। দামিনীমাসিকেও দেখেছি বলে মনে পরছে না।

মিলি, টিনা, সুরোরাও কেউ ছিল না।

তাহলে কি মাম্পি, মিকিকে নিয়ে স্কুলে গেছে?

হবে হয়তো।

বিনয়দা, বৌদি, তিতাস এসেছে?

এলে নিশ্চই এ ঘরে একবার আসতো।

মাসিমনিকে তনু-মিত্রা নিয়ে এসেছে। তার আগে নিশ্চই অনিমেষদা, বৌদিকে ফোন করেছিল।

বৌদিই প্রথমে ধরেছিল মাসিমনি হচ্ছে রুমাদি। গতকাল ওদের নিয়ে যাওয়াটাই আমার সব্বনাশ হয়েছে। কি করে বুঝবো এতদিন পর বৌদি মাসীমনিকে দেখে চিনতে পারবে।

স্বাভাবিক। সে কি আজকের কথা প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই।

ইস মাসিমনি কি ভাবছে।

এতো চেষ্টা করেও গোপন কথাটা গোপনে রাখতে পারলি না।

আচ্ছা পক্কে, ঘণ্টা, অনন্য, সুন্দর গেল কোথায়? শুভকেও দেখতে পেলাম না। ওদের যদিও একটা কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলাম।

ব্যাটা ভজু একবারও উৎসাহের বসে এসে উঁকি মারল না।

তাহলে কি ওরা ও বাড়ি থেকে এখনও ফেরে নি?

ইসলামভাই, ইকবালভাই রতনদের দেখতে পেলাম না। সব….।

কিরে সমাধিস্থ হলি। না আবার নতুন কোনও প্ল্যান ভাঁজছিস।

মিত্রা দরজা ধাক্কাল।

নিজের মনে নিজে হাসলাম।

ওদের আজ খুব আনন্দ। বুবুনের রুটটা তাহলে খুঁজে পাওয়া গেল।

আমার এবার কিন্তু অধৈর্য হয়ে পড়ছি।

বেরচ্ছি দাঁড়া।

নিজের কাজ শেষ করে বেরলাম।

তিন্নী আমাকে দেখে খুব জোড়ে হেসে উঠল।

দেখলাম মিত্রা, তনু, ইসিও রয়েছে।

তিনজনেই মুচকি মুচকি হাসছে।

তাহলে বাবুর বেলুন ফুস। তিন্নী বলে উঠলো।

আমি হাসছি।

তিন্নীকে দেখে আবার বাথরুমে ঢুকলি না? মিত্রা বললো।

লজ্জা, হুঁ। আমাদের বাড়িতে এসে মায়ের সঙ্গে যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতো, তখন কি স্যুট-প্যান্ট-টাই পরতো। ওই তো গেড়ুয়া। তাও গায়ের টা খুলে কোমরে গিট্টু মেরে রাখত।

ইসিরা জোড়ে জোড়ে হেসে উঠলো।

শোনো না মিত্রাদি। তোমরা তখন লণ্ডনে। সেই সময় ঠাকুরপো ঘন ঘন যেত।

কি বললে তিন্নী! তনু বললো।

কই কি বললাম!

তুমি অনিকে কি বলে ডাকলে?

ঠাকুরপো।

ইসি শরীর ভাঁজ করে হেসে উঠলো।

ওকে এই নামে কেউ সম্বোধন করতে পারে আজ প্রথম শুনলাম। মিত্রা মুচকি মুচকি হাসছে।

কেন আমি ভুল বললাম! তিন্নী, মিত্রার দিকে তাকাল।

না। ওকে কেউ অনিদা, কেউ শুধু অনি, কেউবা আবার ছোটোবাবু বলে। তোমার মুখ থেকে ঠাকুরপো নামটা শুনে বেশ নতুন নতুন লাগল।

তিন্নী মুখ টিপে হাসছে।

আমরা যখন লণ্ডনে তখন ও খুব ঘন ঘন যেত তাই না? মিত্রা বললো।

হ্যাঁ। তিন্নী বললো।

তনু আলমাড়ি থেকে আমার পাজামা পাঞ্জাবী বার করলো।

তনু ওটা না। মাসিমনি নিয়ে এসেছে। মিত্রা বললো।

সত্যি তো, ভুলে মেরে দিয়েছিলাম। তুমি মনে করিয়ে দিলে। না হলে এখুনি বড়োমা শিল-নোড়া দিয়ে থেঁতো করে দিত।

তনু দৌড় দিল।

কি বলছিলে তিন্নী। মিত্রা বললো।

ও হ্যাঁ। ওই সময় আমার স্কুলের হেডমস্টারটা খুব পেছনে লেগেছিল। মা অসুস্থ। যাকে রেখেছি সেও একটু দেরি করে আসে। প্রায় দিন স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যায়।

একদিন হেডমাস্টারটা নরমে-গরমে খুব বললো।

মনটা খারাপ হয়ে গেল।

মাকে বাড়ি ফিরে বললাম। স্কুলের চাকরিটা এবার ছেরে দেব।

মা বললো সরকারি চাকরি, ছারবি কেন। আমার জন্য তোদের যতো জ্বালা।

সেদিন মনেহয় বিকেলে বাবু গেছেন। মা মনেহয় সব বলেছে।

আজ ওই ভদ্রলোককে দেখে আমার মনে পরলো। ভদ্রলোককে কোথায় যেন দেখেছি।

কাকে?

ওই যে…. তুমি চাঁদ চাঁদ বলে তখন ভদ্রলোককে ডাকলে।

চাঁদ! চাঁদ আবার কি করলো?

ও তো ওই তল্লাটের খুব নামডাক ওয়ালা লোক।

তোমার স্কুল কি খিদিরপুরে?

হ্যাঁ।

মিত্রা হাসছে।

তোমাকে এখন হেডমাস্টার খুব তেল দিচ্ছে।

তেল কিগো! আমাকে বলেছে আপনাকে আর ফার্স্ট ক্লাস নিতে হবে না। আপনি টিফিনের আগে পর পর দুটো ক্লাস নেবেন আর টিফিনের পর দুটো ক্লাস নিয়ে বাড়ি চলে যাবেন। আপনার শ্বাশুরী সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এইভাবে মেইনটেন করবেন। বাকিটা আমি সামলিয়ে নিচ্ছি।

আমি ভাবলাম হঠাৎ হেডমাস্টার এতটা ভালমানুষ হয়েগেল কি করে?

আজ এখানে এসে তার উত্তর পেলাম।

তুমি মাসিমনিকে কিছু বলোনি। ইসি বললো।

বলেছি। মা বললো তুই ভুল বুঝেছিলি। পৃথিবীতে সব মানুষ সমান নয়।

মিত্রা হাসছে।

ওটা বুবুনের ছয় কিংবা সাত নম্বর চ্যালা। একনম্বরটা কাল সকালে আসবে। সেটা দুবাইতে থাকে। তুমি গিয়ে জিজ্ঞাসা করো আপনি হেডমাস্টারকে কিছু বলেছেন? আকাশ থেকে পরবে।

তিন্নী হাসছে।

মাস্তানি করলে কি হবে ভদ্রলোক আমাদের স্কুলে প্রচুর টাকা ডোনেট করেছেন।

তাই! ইসি বললো।

মিত্রা হাসছে।

আমাদের স্কুলের নতুন যে বিল্ডিংটা তৈরি হচ্ছে উনি তৈরি করে দিচ্ছেন।

তাহলে বুঝছো, শুধু মাস্তানি করে না।

মিত্রাদি মাসীমনি বললো ওটা এখন না বিকেলে পরবে। আমি যেটা বার করেছি ওটা দাও।

তনু বলতে বলতে ঘরে ঢুকলো।

তিন্নী তাকিয়েছে তনুর দিকে।

তাড়াতাড়ি করো। তনু আমার দিকে তাকাল।

কেন? মিত্রা বললো।

ডাক্তারদাদার সঙ্গে বড়োমার ফাটা ফাটি চলছে।

আবার কি হলো!

চা।

সবাই হাসছে।

অনিমেষদারা খেতে বসেছে?

এই বসলো। আমাকে বললো বাবু বাথরুম থেকে না বেরলে ঠেলে বার কর। যাওয়ার আগে একটু মুখটা দেখে যাই। হঠাৎ কেন ডেকে পাঠাল, একটু শুনে যাই।

কিছু বুঝছো তিন্নী?

মিত্রা তিন্নীর দিকে তাকাল। মুচকি হাসছে।

তোরা ও ঘরে যা। আমি যাচ্ছি। আমি বললাম।

লজ্জা করছে। মিত্রা এগিয়ে এসে আমার পেটে খোঁচা মারল।

চারজনেই বেরিয়ে গেল।

আমি দরজাটা ভেজিয়ে পাজামা পাঞ্জাবী গলালাম। এটাও কেউ না কেউ নিয়ে এসেছে।

ওই ঘরে বেশ হই চই হচ্ছে। বুঝেছি মাসিমনিকে নিয়ে আজ এ বাড়ি বেশ সরগম।

মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে কেমন খেই হারিয়ে ফেলি।

এতদিন এই পৃথিবীতে অনির নিজের বলতে কেউ ছিল না। আজ তবু একজনকে পাওয়া গেছে।

এই বাড়ির সকলে তাকে পেয়ে ভীষণ খুশী। তার ওপর সে বিধানদার পরিচিত।

একবারে সোনায় সোহাগা।

সবাই এই মুহূর্তটুকুকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে।

তখন বিধানদা কেমন বলে ফেললো, আমার জিনিষ তোর কাছে গচ্ছিত রেখে যাচ্ছি। ফিরে এসে ফেরত নেব। একটুও সঙ্কোচ নেই। সবাই তখন আমার মুখের দিকে কেমনভাবে যেন তাকাচ্ছিল।

তুই সংগ্রহ করেছিস এ কথা ঠিক। তবে এটা তোর জিনিষ নয় এটা সার্বজনীন। আমাদের সকলের। তুই এদিকে নজর দিবি না।

এখনও মেয়ে অনিকা আসে নি। তাদের কাছে নিশ্চই তার মা খবর পাঠিয়ে দিয়েছে।

মাসিমনিও হয়তো জেনেছে।

আর দেরি করলাম না। চুলটা আঁচড়ে নিয়ে, রেডি হয়ে এ ঘরে এলাম।

বাগানে একটা গাড়িও নেই পুরো শুন শান।

কনিষ্করা নিশ্চই খবর পেয়েছে। হয়তো দেখে-টেখে চলে গেছে।

মিলিরা কি অফিসে?

মাম্পি-মিকিকে দেখতে পাচ্ছি না।

ঘরের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালাম।

অনিমেষদা, বিধানদা টেবিলে পাশাপাশি বসে খাচ্ছে। বড়োমা এগিয়ে দিচ্ছে। দাদা, মল্লিকদা, ডাক্তারদাদা বড়ো সোফায়। ছোটো দুটোয় একটাতে বৌদি, আর একটাতে আন্টি। দামিনীমাসি, ছোটোমাকে রান্নাঘরে গোঁতা-গুঁতি করতে দেখলাম।

মাসিমনি, বিধানদার একপাশে হুইল চেয়ারে। একটু দূরত্ব রেখে।

ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই সকলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

নতুন জামাকাপর তাই একবার সবাইকে কোমর নুঁইয়ে পা ছুঁলাম।

বিধানদাকে প্রণাম করতেই চেঁচিয়ে উঠলো, খাবার পর করলে হতো না।

আমি প্রণাম করেই বিধানদার দিকে তাকিয়ে একটা বিটকেল হাসি হাসলাম।

বিধানদা চেঁচিয়ে উঠলো।

দাঁড়া খেয়ে উঠে তোর কান মুলছি।

বৌদি, ডাক্তারদাদার চোখে পরে গেছে। শরীর কাঁপিয়ে খুব জোড় হেসে উঠলো।

কি হলো বিধানবাবু, তুমি আবার ওরকম চেঁচিয়ে উঠলে কেন।

বড়োমা বিধানদার দিকে তাকিয়ে।

আমি ততক্ষণে বৌদিদের দিকে চলে গেছি।

তোমার ছেলের চোখ আর হাসিটা লক্ষ্য করলে না।

অনিমেষদা মুখ নীচু করে হাসছে মাথা দোলাচ্ছে।

বড়োমা মুখ টিপে হেসে ফেললো।

ডাক্তারদাদা, দাদার দিকে হেলে পরেছে মনে হয় কিছু বলছে।

তোর মতো তেঁয়েটে ছেলে জগতে দুটো নেই। বিধানদা জোড়েই বললো।

মাসিমনি, বড়োমার দিকে তাকিয়েছে।

বুঝতে পারছো না।

মাসিমনি হেসে ফেললো।

আমি ততক্ষণে রান্নাঘরের দিকে গেছি।

ছোটোমা, দামিনীমাসিকে প্রণাম করলাম।

দামিনীমাসির হাতটা ধরে সেফটিপিন খুলতেই, দামিনীমাসি চেঁচিয়ে উঠলো।

মিত্রা।

মিত্রা মাসির দিকে তাকাতেই মাসি ইশারা করলো।

চুপ চুপ তুমি আর চেঁচিয়ো না। এখুনি বড়োমা গলা টিপে দেবে।

ততক্ষণ দেখলাম তনু হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

বৌদি ঘার ঘুরিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। বড়োমাও তাকিয়েছে।

কিগো দামিনী নিশ্চই সেফটিপিন?

ছোটোমা তখন কান ধরার জন্য হাত তুলেছে। আমি হাত ধরে ফেলেছি।

বৌদি, মাসীমনির দিকে তাকিয়েছে।

দেখছো রুমাদি তোমার বোনপর কাণ্ড দেখেছ।

মাসিমনি হাসছে।

তোরা বোতাম লাগিয়ে দিসনি। বয়েই গেছে, সেফটিপিন লাগিয়ে নিচ্ছি। বৌদি বললো।

অনিমেষদা খেতে খেতে সমানে মাথা দুলিয়ে যাচ্ছে। মুচকি মুচকি হাসছে।

বড়োমা একবার মিত্রার দিকে তাকিয়ে স্নেহের হাসি হাসল।

তিন্নি, ইসি পরিবেশের দাসত্ব স্বীকার করে হেসে গড়াগড়ি খায়।

আমি বড়ো সোফাটায় এসে দাদা, ডাক্তারদাদার মাঝে নিজেকে গুঁজে দিলাম।

কেন তোর আর বসার জায়গা ছিল না? বৌদি বললো।

আমি কোনও কথার উত্তর দিলাম না। ডাক্তারদার দিকে তাকিয়ে বললাম।

বান্ধবী চা দিয়েছে।

চা-এর বদলে মুখ ঝামটানি দিয়েছে।

তনু ঘরে ঢুকে সোজা আমার কাছে এসে দাঁড়াল।

এই নাও।

আমি তনুর দিকে তাকালাম।

সোনা না। ইমিটেশন। তনু চেঁচাল।

আবার একচোট হাসি।

মাসি তাড়িয়ে তাড়িয়ে সমস্ত ব্যাপারটা উপভোগ করছে। চোখে মুখে ভেসে উঠেছে তার অভিব্যক্তি।

তনু মাসিমনির দিকে তাকাল।

তুমি দেখ মাসিমনি। ও ঘরে বলতে পারতো। এ ঘরে এসে দামিনীমাসির হাত থেকে সেফটিপিন খুলছে। এ বাড়িতে তুমি দামিনীমাসি ছাড়া কারুর হাতে সেফটিপিন পাবে না।

মাসিমনি হেসেই যাচ্ছে।

তনু রুমাল দিয়েছিস। মিত্রা বললো।

লাগবে না। পাজামায় হাত মুছুক। ছোটোমা, মাসি বুঝে নেবে।

বৌদি আবার একচোট শরীর কাঁপিয়ে হাসলো।

তনু, মাসিমনির দিকেই তাকিয়ে।

তুমি আরও ঘণ্টা দুয়েক থাকো বুঝে যাবে তোমার বোনপো কি চিজ।

দরজা দিয়ে অনুপদা, রূপায়ণদা ঢুকলো। সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখেছে।

অনুপ দেখতে পাচ্ছিস কোথায় সেঁটে আছে?

রূপায়নদা কথাটা বলেই অনিমেষদার দিকে তাকাল।

দাদা কথা হয়েছে?

এই তো সবে এই ঘরে এলো।

বুঁচকির সাথে কথা হলো। ওরা আপনাদের এয়ারপোর্ট থেকে পিকআপ করবে।

ওরা পৌঁছে গেছে?

কেন নেমেই মিত্রাকে ফোন করেছিল।

অনিমেষদা মিত্রার দিকে তাকাল।

খেয়ে উঠলে বলতাম। দেখলে তো ঘরে ঢুকেই কি শুরু করলো।

রূপায়নদা তাকাল মিত্রার দিকে।

মিত্রা, মাসিমনি আর বিধানদার দিকে তাকিয়ে ইসারা করলো।

রূপায়নদা জোড়ে হেসে উঠলো।

নাঃ ওর দম আছে। আমাদের এখনও সাহসে কুললো না।

বাইরে হুটারের আওয়াজ হতেই অনিমেষদার দিকে তাকালাম।

আমার দিকে তাকিয়ে অনিমেষদা হাসছে। আমার চোখের ইশারা বুঝে গেছে।

সকাল থেকে সাক্ষাৎ হয়নি।

অনিমেষ, প্রবীর এই সময়। বিধানদা বললো।

সকাল থেকে দিদিকে দেখে নি।

পাগল সব। বিধানদা মাথা দোলাচ্ছে।

আমাদের কথা বলার ফাঁকেই প্রবীরদা ঘরে ঢুকলো। কারুর সঙ্গে কথা না বলে সোজা মাসিমনির কাছে গিয়ে নীচু হয়ে প্রণাম করলো।

এতদিন আপনার সঙ্গে পার্টির পুরনো মিনিটবুকে সাক্ষাৎ হয়েছে। পরিচয় জানতে পারিনি। শুধু জেনেছি সেই সময় আপনি পার্টির একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।

মাসিমনি, প্রবীরদার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

অনি আপনার বোনপো আমাদের ভাই। অনি যে নামে আপনাকে সম্বোধন করে আমিও সেই নামে আপনাকে সম্বোধন করবো।

খালি বক বক। বিধানদা খেঁকিয়ে উঠলো।

অনুপদা জোড়ে হেসে উঠলো।

আচ্ছা আপনি চেঁচাচ্ছেন কেন। কথা হচ্ছে প্রবীরের সঙ্গে দিদির। বৌদি বলে উঠলো।

তোমাদের জন্যই ও এতটা তেঁয়েটে হেয়েছে।

অনিমেষদা হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই বললো।

দামিনী দুটো মিষ্টি নিয়ে এসো।

প্রবীরদা, মাসিমনির হাত ধরেই বড়োমার মুখের দিকে তাকাল।

ভজু কই।

কেউ বাড়ি নেই। এবার সব ঢোকার সময় হয়েছে।

কি হয়েছে বল না। অনুপদা বলে উঠলো।

মিত্রা যা তো চাঁদকে বল মিষ্টির ট্রেগুলো নামিয়ে আনতে। প্রবীরদা মিত্রার দিকে তাকাল।

কার জন্য নিয়ে এলে প্রবীর? ডাক্তারদাদা বললো।

প্রবীরদা, ডাক্তারদাদার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সবার জন্য।

দামিনীমাসি মিষ্টি নিয়ে এসে অনিমেষদা, বিধানদার পাতে দিল।

আঙ্কেল। তারস্বর চিৎকারে বইরের দরজার দিকে তাকালাম।

সব্বনাশ। বৌদি গেঁঢ়াদুটো ছিল কোথায়! প্রবীরদা বললো।

স্কুলে গেছিল। বৌদি বললো।

দুটোই ছুটতে ছুটতে এসে সকলকে ঠেলে সরিয়ে আমার কোলে এসে ঢুকে পরলো।

সুরো গেটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। হাতে স্কুল ব্যাগ।

মিত্রার দিকে তাকাল।

হট না কুল।

কুল।

মা।

বৌদি সুরোর দিকে তাকাল।

শ্বশুর-শাশুড়ী দুজনেই আসছেন। সবে রওনা হয়েছেন।

বৌদি হাসছে। কে খবর দিল?

অনিদার ব্যাপারে খবর দেওয়ার লোকের অভাব।

তুই চলে যাবার পর অংশু এসেছিল। কচুরী খেয়ে চলে গেছে। বলেগেছে দুপুরে এসে খাবে।

গুণমন্তর পুত্রকে জিজ্ঞাসা করেছ কি কি কাজের ফিরিস্তি পেছনে গুঁজে দিয়েছে?

এই তো সবে উঠলো।

আমি মাম্পি, মিকির সঙ্গে কথা বলছি ঠিক কানটা সুরোর দিকে।

মাম্পি-মিকি দুজনেই চোখ মুখ বেঁকিয়ে-বুঁকিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলে চলেছে। ওদের কথা সবাই শুনতে পাচ্ছে। আমি একবার মাম্পির দিকে তাকাই একবার মিকির মুখের দিকে তাকাই।

মাসিমনি পরিবেশটা ভীষণ উপভোগ করছে।

তোমার শরীর এখন কেমন আছে মাসিমনি। সুরো বললো।

হঠাৎ কেমন ভালো হয়েগেছি বুঝলি। মাসিমনি সুরোর হাতটা ধরেছে।

অনিদা তোমার অক্সিজেন, অনিদা ডাক্তারজ্যেঠুর অক্সিজেন, আজ থেকে বিধানজ্যেঠুর নাম তার সঙ্গে জুড়ে গেল।

বিধানদা জোড়ে হাসলো।

বোনপোকে কিছু বলোনি? সুরো মাসিমনির দিকে তাকিয়ে আছে।

সময় পাইনি। ওর সঙ্গে সময় করে একটু হিসেব-নিকেষ করতে হবে।

তোমাকে আমার বিয়ের দিনের কথা বলেছি। কতকাল হয়ে গেছে। এখনও হিসেব শেষ করতে পারিনি। দেখ তুমি কতদিনে পার।

সুরো আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

ওরা এতো কি কথা বলছে বলতো। প্রবীরদা সুরোর দিকে তাকাল।

আমার নামে নালিশ করছে।

প্রবীরদা হাসছে।

আইস্ক্রীম দিই নি। বাবুলগাম দিই নি। বেলুন কিনে দিই নি।

প্রবীরদা সুরোর দিকে তাকিয়ে।

হ্যাঁগো। আর তো কেউ ওরকম ধৈর্য ধরে শুনবে না।

একটু থামল।

আমি মিলিদি ঠিক করেছি এবার পাকাপাকি ভাবে দুটোকে রেস্ট্রিকরে দেব।

আমি সুরোর দিকে তাকালাম।

আর তাকিও না।

সুরো পা দাপাতে দাপাতে মাসিমনির হাত ছেড়ে বড়োমার ঘরের দিকে চলেগেল।

ছোটোমা আধঘণ্টা হয়ে গেছে। এখনও গরমজল আসে নি। আমি চেঁচালাম।

হক কথার এক কথা বলেছিস। ডাক্তারদা বলে উঠলো।

বড়োমা তাকাল ডাক্তারদার দিকে।

তাকিও না বান্ধবী। কম নয় প্রায় আঠারশো মিনিট।

বড়োমা, আন্টির দিকে তাকিয়েছে।

তুমি এগুলোকে নিয়ে চলতে পারতে। সব এক একটা পদ। আমি চলছি। আর দুটো দেখেছ চুপ চাপ বসে বসে ঠ্যাঙ নাচাচ্ছে। সুযোগ খুঁজছে।

এতক্ষণে দাদা বেশ জোড়ে হাসলো।

বিধানবাবু আমি উঠি। অনিমেষদা টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো।

হ্যাঁ তুমি উঠে হাত ধোও, আমি যাচ্ছি।

অনির সঙ্গে একটু কথা সেরে নিই।

হ্যাঁ। অনুপ ফাইল নিয়ে এসেছ? বিধানদা অনুপদার দিকে তাকাল।

আমার পার্টটা নিয়ে এসেছি। প্রবীরের পার্টটা প্রবীর নিয়ে এসেছে।

তোমরা ওকে নিয়ে বসো আমি যাচ্ছি।

বড়দির ঘরে আয়। অনিমেষদা আমার দিকে তাকাল।

সুতপা ওর চা ছোটোর কাছ থেকে নিয়ে দিদির ঘরে পাঠিয়ে দাও।

মাসিমনি সব দেখেশুনে মুচকি মুচকি হাসছে।

আমি উঠে বড়োমার ঘরের দিকে এগলাম।

ইসিকে জিজ্ঞাসা করলাম, জ্যেঠিমনি কোথায়?

ঠাকুর ঘরে।

পিকুরা এসেছিল?

একবার করে সবাই বুড়ি ছুঁয়ে চলে গেছে।

বড়োমার ঘরে ঢুকলাম।

সুরো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে।

খাটে বসতে গিয়ে ওকে একটু খোঁচা মারলাম।

ধরে না আচ্ছা করে দিতে হয়। সুরো দাঁত মুখ খেঁচাল।

অংশু কোথায়রে?

কোথায় জান না। তখনও গলায় সমান ঝাঁঝ।

জানলে কি তোকে জিজ্ঞাসা করি।

ন্যাকা।

আমি খাটে বসে বসে সুরোর চুল আঁচড়ান দেখছি। শরীরটাকে বাঁদিকে-ডানদিকে ভাঁজ করে বেশ সুন্দরভাবে চুল আঁচড়াচ্ছে।

চিকনাদারা সবাই রওনা হয়েছে। দুপুরের মধ্যে ঢুকে পরবে।

দুপুর হতে আর বাকি আছে।

ওই হলো।

দাদাদের ফ্লাইট কটায়?

দুটো পঁয়তাল্লিশ।

তুই কখন এলি?

গেলাম কোথায় যে এলাম।

ওই বাড়ি থেকে?

সাড়ে পাঁচটা।

ঘুমস নি!

ঘুম হয় নাকি। সকাল বেলা বৌদি যা গরম নিউজ দিল। সবাই তেতে গেল। সত্যি অনিদা।

নারে, তোদের বলতাম।

ভাগ্যিস মা চিনতে পেরেছিল। চেপে না ধরলে বেমালুম অস্বীকার করে যেতে।

তোর কাছে সব কিছু স্বীকার করি।

সেতো সাতকাল গিয়ে এককালে ঠেকলে।

অনিমেষদা ঘরে ঢুকলো।

মা-রে আমার ব্যাগটা গুছিয়েছিস।

বুঁচকি বলেছে কিছু লাগবে না। একসেট জামাকাপর আর রাতে শোয়ার লুঙ্গি-গেঞ্জি দিয়েছি। জ্যেঠুর ধুতি-পাঞ্জাবী এক সঙ্গে দিয়ে দিয়েছি।

অনিমেষদা আমার পাশে এসে বসলো। রূপায়নদা, প্রবীরদা, অনুপদা সোফায় বসলো।

সুরোর চুল বাঁধা শেষ হয়েছে।

মারে সেন্টার টেবিলে সিগারেটের প্যাকেটটা রয়েছে একটু নিয়ে আসবি।

এবার একটু কমাও।

শেষ কাজটুকু তোর দাদার সঙ্গে করে নিই। তারপর আমি, বিধানবাবু রিটায়ার করবো।

অনুপদারা হাসছে।

অনিমেষদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

প্রবীরের সঙ্গে কথা সারলি।

কোথায় কথা বললাম। দেখলে তো।

তোর কথা বলা কেউ দেখতে পায় না। কিন্তু সকলের সামনে ঘুরে বেরাচ্ছিস। যাকে বলিস সে বোঝে, আর তুই বুঝিস।

প্রবীরদা হাসছে।

ওই দেখ প্রবীর হাসছে। আচ্ছা তুই বল। এই স্টেটের চিফ মিনিস্টার প্রবীর, সরকারের রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে প্রবীর সই করবে। আর রিলেটেড দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা সই করবে। তোর আফতাবভাই আমাকে, বিধানবাবুকে ডাকবে কেন।

বিধানদা ঘরে ঢুকলো।

কি বলে ও।

অনিমেষদা, বিধানদার দিকে তাকাল। পেছন পেছন সুরো এসে সিগারেটের প্যাকেট অনিমেষদার হাতে দিল।

এখনও জিজ্ঞাসা করিনি।

প্রবীর ফাইলটা বার করো। বিধানদা বললো।

কিসের ফাইল? আমি বললাম।

তুই যা যা বলেছিলি।

ওটা নিয়ে যেতে হবে না। তোমার এয়ারপোর্টে নামলে অনিকা তোমাদের একটা ফাইল দেবে।

অনিমেষদা, রূপায়ণদা, অনুপদা হাসছে। প্রবীরদা গম্ভীর থাকার চেষ্টা করেও থাকতে পারছে না।

কি বুঝছেন বিধানবাবু।

ও নিশ্চই ওখানে কোনও গণ্ডগোল করে রেখেছে।

অবশ্যই। প্রবীর সেটা সম্পূর্ণ জানে। সেই জন্য সকাল বেলা না এসে বেরবার ঠিক আগের মুহূর্তে এসেছে।

সেরকম কিছু না। প্রবীরদা বললো।

অনির সঙ্গে তোমার যে খুব ভাল সাঁট-গাঁট আছে সেটা বোঝার মতো যথেষ্ট বয়েস আমার, বিধানবাবুর হয়েছে। এটা তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। তা বলে আমি বলতে চাইছি না সেটা নেগেটিভ।

বিধানদা মুচকি মুচকি হাসছে।

বল কি বলছিলি। অনিমেষদা আমার মুখের দিকে তাকাল।

সিনপসিসটা অনিকা গাড়িতে যেতে যেতে বলে দেবে। অনিসা, ঘণ্টা-পক্কেদেরটা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। তোমাদের সর্বভারতীয় সম্পাদক এই মিটিং-এ থাকবেন। আরও দু-একজন থাকলেও থাকতে পারেন। তোমাদের ব্যাপারে তোমরা রিজিড থাকবে। প্রবীরদার ব্যাপারে কোনও কথা উঠলে বলে দেবে, আমরা পার্টিগত দিক থেকে ব্যাপারটা প্রবীরকে বোঝাব। কিন্তু ওটা ওর প্রশাসনিক পার্ট। বাকিটা তোমাদের বোঝাতে হবে না।

অনুজ কি এখনও হাল ছাড়ে নি!

না।

প্রবীর কাল সেরকম কিছু বুঝলাম না। অনিমেষদা, প্রবীরদার দিকে তাকাল।

সকালে অর্ক একটা ফাইল আমাকে বাড়িতে দিয়ে এসেছে।

কি আছে তাতে!

প্রজেক্টটা এখানে না করে কেরলে করা যেতে পারে। ওটাও আমরা কন্ট্রোল করছি।

তুমি দেখেছ?

দেখেছি।

অফিসিয়াল ফাইলটা তোমার কাছে এসেছে?

না।

বিধানবাবু একটা কাজ করলে হয় না।

বলো শুনি। সকালে তোমাকে সব বলেছি।

অনুপকে এই কয়মাসের জন্য যদি শিল্পদফতরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এদিকটা সামলাবে কে?

আমার, আপনার ওপর একটু চাপ বেরে যাবে।

অনিমেষদা, প্রবীরদার দিকে তাকাল।

প্রবীর তোমার মতামত কি?

এই মুহূর্তে অনুপকে সরিয়ে নেওয়া ঠিক হবে না। বরং আমিন সাহেবকে দিন। ফ্রেস ভাবে যখন আসবো তখন অনুপ দায়িত্ব নিক। অরিজিন্যাল প্রজেক্ট শুরু করতে করতে অনি সেই সময়টুকু পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবে।

অনুপ তোমার মতামত।

প্রবীর যুক্তিটা খারাপ দেয়নি। শ্যামেদের ব্যাপারটা আমি, বৌদি কথা দিয়ে এসেছি এক মাসের মধ্যে কিছু একটা সেটেল করে দেব।

অনি অংশুকে, সুরকে কিছু কাজের দায়িত্ব দিয়েছে। প্রবীরদা বললো।

তারমানে!

অনুপদা হাসছে।

অংশু ওর কলেজ থেকে রিজাইন দিয়েছে।

কই আমাকে একবারও বলে নি! সমস্যা কি?

আপনার মত শ্বশুর মশাই থাকলে অনেক এ্যাডভান্টেজ। সুরো তার দাদাকে রিকয়েস্ট করেছিল। অনি রিজাইন দিতে বলেছে।

অনিমেষদা মাথা দোলাচ্ছে।

তুমি কি অনুজের সঙ্গে পার্সোনালি কথা বলবে? বিধানদা বললো।

প্রবীরের কাছ থেকে ফাইলটা দেখি, আপনারা ঘুরে আসুন। যে ইনভেস্ট করবে তার যদি ইচ্ছে না থাকে অনুজ কি করবে। অনুপদা বললো।

নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করবে। আমি বললাম।

মাসিমনিকে নিয়ে তনু এসে গেটের কাছে দাঁড়াল।

আসুন আসুন। অনুপদা উঠে দাঁড়াল।

না। অনিমেষ তোমরা এখুনি বেরবে?

আর মিনিট পনেরো।

আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। সময় লাগবে।

ঠিক আছে। আপনি যান।

তোমরা সাবধানে যেও। মাসিমনি বিধানদার দিকে তাকাল।

অনিমেষদা হাসছে।

খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। পরে তোমাদের কাছ থেকে শুনে নেব।

শুনবেন মানে! আমরা আর একটা ছাতা পেলাম। রূপায়ণদা বললো।

তোমরা থাকবে তো?

বিকেল পর্যন্ত থাকব।

আচ্ছা।

তনু হুইল চেয়ারটা ঘুরিয়ে মাসিমনিকে নিয়ে চলেগেল।

তুই একটু হিন্টস দে। অনিমেষদা আমার দিকে তাকালো।

আবার হিন্টস কিসের যা বলার তা তো বললাম।

অনিমেষদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।

মহা মুস্কিল।

একটা প্রজেক্টও যদি স্লিপ করে তোর পিঠের চামড়া তুলবো।

একটাও স্লিপ করবে না।

রূপায়ণদা, অনুপদা শব্দ করে হেসে উঠলো।

এই তো আপনি যেটা ওর মুখ থেকে শুনতে চাইছিলেন, শুনে নিলেন। অনুপদা বললো।

খেয়ে না আঁচান পর্যন্ত বিশ্বাস নেই।

ঘড়িটার দিকে তাকিয়েছ। বৌদি গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

এই উঠছি।

বেরবার আগেও ওকে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করবে।

সাধে কি করি সুতপা। এই তো একটা নতুন উপসর্গ শুনলাম।

আবার কি হল! বৌদি ভেতরে এল।

অনুজটা আবার গণ্ডগোল পাকিয়েছে।

তাহলে রুমাদি ঠিক বলেছে।

দিদি জানল কি করে?

তনু, মিত্রা।

ওরা কি সব গল্প সেরে দিয়েছে।

আমরা যাবার আগে অতক্ষণ কি করছিল।

দিদি কি বলেছে?

অনুজ এত সহজে ছেড়ে দেবে না। ও ওর বাবার মতো স্বভাবের।

বিধানদা হাসছে।

অনিমেষদা, বিধানদার দিকে তাকাল।

আমি চুপ চাপ বসে।

চলুন বিধানবাবু বেরন যাক। কি হয় আগে দেখি।

সবাই উঠলাম।

মিত্রা চা-এর কাপ নিয়ে এ ঘরে আসছিল। আমাদের দেখে থমকে দাঁড়াল।

টেবিলে রাখ, আমি আসছি।

মাম্পি, মিকিকে সুরো খাওয়াচ্ছে।

অনিমেষদা, বড়োমার দিকে তাকাল।

আসছি।

নেমে একটা ফোন কোরো।

আমাকে করতে হবে না। অনিমেষদা হাসছে।

দেখো আবার কি ঘোঁট পাকিয়েছে। সকাল থেকে অর্ক তিনবার ও ঘরে ঢুকেছে। অনি ঘুমচ্ছে বলে ডাক্তার ভাগিয়ে দিয়েছে।

বিধানদা, অনিমেষদা মুচকি মুচকি হাসছে।

বাইরের বারান্দায় এলাম।

দেখলাম ভজুরাম গেটের দরজা খুলছে। অনন্যরা সব গাড়ি থেকে নামছে। পিল পিল করে সব ভেতরে ঢুকলো। ইকবালভাই, ইসলামভাইও আছে।

দাদাই বেরচ্ছ। সুন্দর এগিয়ে এসে অনিমেষদা, বিধানদাকে প্রণাম করলো।

অনিমেষদা, সুন্দরের দিকে তাকিয়েছে।

যাও দিদিভাই, বোন গ্রীণ সিগন্যল দিয়ে রেখেছে। ড্যাডের হেড বুঝলে।

সুন্দর ইসারা করে মাথা দেখাচ্ছে।

আমি, ঘণ্টা, পক্কে এখন রেগুলার চেজ খেলছি।

অনিমেষদারা হাসছে। সবাই এসে অনিমেষদাদের প্রণাম করে ভেতরে গেল।

ইকবাল কাল সকালে ফিরে তোমার পার্টটা শুনবো। অনিমেষদা বললো।

ইসলামভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

যা চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। অনিমেষদা আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে।

আমি দু-জনকে প্রণাম করে ভেতরে চলে এলাম।

তনুকে দেখতে পেলাম না। বুঝলাম মাসিমনিকে নিয়ে আমার ঘরের বাথরুমে গেছে।

আমি এসে টেবিলের একটা চেয়ারে বসলাম।

মাম্পি, মিকি তখনও খেয়ে চলেছে।

ছোটোমা ভাজা ভুজির গন্ধ পাচ্ছি দুটো দেবে।

ভাগ এখান থেকে তোর সঙ্গে কথা বলবো না।

ছোটোমা রান্নাঘরে ঢুকলো।

দাদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। হাসছে।

ছোটোমা একটা প্লেটে করে কয়েকটা বড়াভাজা নিয়ে এসে টেবিলে রাখল।

দিদি সব ঠিক আছে। ইসলামভাই ছোটোমার মুখের দিকে তাকিয়েছে।

ছোটোমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।

ছোটো ওকে দুটো বরফি দাও।

কোথায়?

ভজু নিয়ে আসে নি!

না। সব তো এসেই যে যার ঘরে ঢুকে পরলো।

দাঁড়াও নিয়ে আসি।

ইকবালভাই বেরিয়ে গেল।

মাম্পি, মিকি সুরসুর করে এগিয়ে এসে দুট বড়া প্লেট থেকে তুলে নিয়েছে।

আমি হাসলাম। সুরো দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তেরে গেলো।

তোদের দেয়নি—

কেউ এতটুকু ভাগ ছাড়বে না বুঝলি সুরো। মিত্রা হাসতে হাসতে বললো।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/mjJiSnq
via BanglaChoti

Comments