❝কাজলদীঘি❞
BY-: জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯২ নং কিস্তি
—————————–
রবীন আবার গাড়ি স্টার্ট করলো।
এসি চলছে।
মিত্রা আইস্ক্রীমের কাপ বার করে তনুকে একটা রবীনকে একটা দিয়ে, নিজের কাপ থেকে চামচে দিয়ে একটু কেটে আমার মুখের সামন তুলে ধরলো।
তুই খেয়ে নিয়ে আমাকে দে।
আমারটা নেবে না। তনু পেছন ফিরলো।
খেয়ে নিয়ে দাও।
ওরা খেতে শুরু করলো। আমি জনলা দিয়ে বাইরে তাকালাম।
ছোট থেকে এই আমার একটা বদ অভ্যাস। গাড়িতে বসলোই অটোমটিক চোখটা জানলা দিয়ে বাইরে চলে যাবে। এক রাস্তা, হয় তো সহস্রবার দেখেছি, তবু যেন আমার কাছে সব নতুন লাগে।
বুবুন।
মিত্রার দিকে ফিরে তাকালাম।
খেয়ে নিয়ে তোর ফুলগুলো দেখবো।
দেখিস।
একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো।
বল।
আকিবের ফুটপাথে দোকান।
মিত্রা চামচে দিয়ে আইস্ক্রীম তুলছে আর মুখে দিচ্ছে।
তুই ন-মাসে, ছ-মাসে একবার আসিস। মাঝে অনেকদিন কলকাতায় ছিলি না। তোর সঙ্গে….।
মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
ছেলেটাকে দেখে ফুটপাথের দোকানদার মনে হয় না। তনু পেছন ঘুরে তাকাল।
তোমার সঙ্গে যতক্ষণ কথা বললো, বেশ ভদ্র, বিনয়ী।
আকিবের সম্বন্ধে খুব জানতে ইচ্ছে করছে। মিত্রা বললো।
কি হবে জেনে, আমার সঙ্গে এরকম হাজার একটা লোকের পরিচয় আছে। কজনের কথা তোদের বলেছি। কিংবা বলতে পারবো।
সেই জন্য জানতে চাইছি। এই যেমন মাসীমকে আজ প্রথম দেখলাম। বিকাশকে দেখলাম। সর্বপরি আকিব। সবার সঙ্গেই তোর একটা মধুর সম্পর্ক।
বেশি জানতে গেলে মথা খারাপ হয়ে যাবে।
এই তেল খেতে শুরু করলি। তখনই তোকে বলেছি, বয়স হয়েছে তেলে এখন টান পরে গেছে।
যখন তেল স্টক করবি তখন জানতে চাস, বলবো।
বল না।
রেওভাট।
মিত্রা জোড়ে হেসে উঠলো।
আইস্ক্রীমটা পুরোটা গিললি।
সরি সরি।
মিত্রা আইস্ক্রীমের কাপটা আমার দিকে এগিয়ে দিল।
যা বেরো, তলানিটুকু খাব না।
আমার থেকে নাও হাফ আছে। তনু এগিয়ে দিল।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
ওই তো দিচ্ছে, নে।
না।
অনিদা আমারটা নিতে পার। এখনও হাত লাগাইনি।
তুই খা।
এক চামচ। তনু কাপটা এগিয়ে দিল।
আমি একটু নিয়ে মুখে দিলাম।
কনকনে ঠাণ্ডা। দাঁত সির সির করে উঠলো। মাথার ব্রহ্মতালু পর্যন্ত ঝনঝন করে উঠলো।
তোমরা এতো ঠাণ্ডা খাচ্ছ কি করে।
মিত্রা জানলার কাঁচটা সামান্য নামিয়ে কাপটা বাইরে ফেলে দিল। একঝলক গরম হাওয়া চোখে মুখে এসে ঝাঁপিয়ে পরলো।
মিত্রা রুমালে হাতটা মুছতে মুছতে বললো, এবার বলে ফেল।
কি!
প্রথমে আকিব। পরে ধীরে সুস্থে মাসীমা, বিকাশ।
ফুলটা দেখলি না।
পাশ কাটাবার ধান্দা করিস না। দেখছি।
মিত্রা খামটা হাতে তুলে নিল।
একটা ফুল তুলে দুটো কাঠি দু-হাতে ধরে ঘুরিয়ে খুলতেই চোখ বড়ো বড়ো করে বলে উঠলো, তনু দেখ, ছেলেবেলায় এগুলো নিয়ে আমরা খেলতাম না।
তারপরেই আমার মুখের দিকে স্থির চোখে তাকাল। কি যেন খুঁজে বেরাচ্ছে।
চোখ নামিয়ে নিল।
হঠাৎ তুই এগুলো কিনলি?
কি জানি। হয় তো এই ফুলগুলোর প্রতি আমি ভীষণ দুর্বল। তাছাড়া আবিদের ছেলেকে অনেকে অনেক কিছু দেবে দশটাকা দামের এই কাগজের ফুল কেউ দেবে না। এতো কমদামী জিনিষ কেউ দেয় নাকি?
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
কি ভাবছিস, তোর বুবুন মানসিক রুগী।
না।
তাহলে?
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল।
কি?
সময় হোক বলবো।
রবীন মমিনপুর ব্রিজের বাঁদিক দিয়ে গাড়ি ঢোকালো।
এদিকে কোথায় যাচ্ছিস?
আবিদের ফ্ল্যাটে।
এদিক দিয়ে নিউআলিপুর যাওয়া যায় না?
হ্যাঁ।
রবীন একটু এগিয়ে একটা পেল্লাই এ্যাপার্টমেন্টের গেটে গাড়িটা দাঁড় করাল।
দারোয়ানটা গেটের মুখে আমাদের দেখে দরজাটা হাট করে খুলে দিল।
রবীন বোঁ করে গাড়িটা ভেতরে ঢুকিয়ে নিল।
রবীন গাড়িটা থামাতেই আমি দরজা খুলে নামলাম।
দেখলাম চাঁদ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
সকাল বেলা তোমায় দেখতে না পেয়ে আবিদ খুব মন খারাপ করছিল।
আবিদ কোথায়?
বাবাগিরি ফলাচ্ছে।
যাক কাজের বাইরে তবু একটা কাজ পেয়েছে। এই এ্যাপার্টমেন্টটা কার রে?
চাঁদ হাসছে।
হাসছিস কেন?
সেই আনোয়ার কেস। তারপর অনাদিদার ইনভলভমেন্ট।
যাক ভালই দাঁ মেরেছিস বল।
খুব একটা হয়নি। ঝামেলা ঝঞ্ঝাটে সব বেরিয়ে গেছে।
আবিদ ফ্রি, না কিনেছে?
কস্টিং-এর ওপর টেন পার্সেন্ট দিয়েছে।
তোরটা কোথায়?
তারাতলায়।
একবার যেতে হবে।
তোমার সময় হবে?
করে নিতে হবে। দিন দিন বড্ড অসামাজিক হয়ে পড়ছি।
তনু, মিত্রা হাসছে।
আমরা চাঁদের পেছন পেছন লিফ্টের সামনে এলাম।
চাঁদ পাঁচ নম্বর বটম টিপলো। সাঁই করে ওপরে চলে এলাম।
লিফ্টের দরজা খুলতে দেখলাম আবিদ দাঁড়িয়ে আছে।
আমাকে দেখেই চোখটা ছল ছল করে উঠলো।
কিরে ব্যাটা, আবার কান্নাকাটি কিসের?
তুমি এখনও আমার আয়েষার ওপর রাগ করে আছো।
মিত্রা চল, ঘরে ঢুকে আর লাভ নেই। যা নিয়ে এসেছিস ওর হাত দিয়ে দে।
আবিদ হাতটা চেপে ধরলো। আমার মুখের দিকে ছল ছল চোখে তাকিয়ে।
তোদের মতো আমারও অনেক সমস্যা। তোরা তবু তোদের সমস্যার কথা শোনাবার লোক পেয়েছিস, আমি এখনও পাইনি। আমার সমস্যা আমাকে সামলাতে হয়।
একটু থামলাম।
আমি এর জন্য কাউকে দোষ দিই না।
আমার সমস্যাগুলো এতো অদ্ভূত সচরাচর কাউকে বলতেও পারি না। লোকে আমাকে ভুল ভাবে। কি করবো, এটা কপালের দোষ।
এখানে দাঁড়িয়ে সব বলবি না ভেতরে যাবি। মিত্রা বললো।
হাত দশেক দূরে আবিদের ফ্ল্যাটের দরজা হাট হয়ে খোলা। ভেতরে এলাম।
বেশ সাজানো গোছান ফ্ল্যাট। আবিদ বেশ রুচি সম্মত ভাবে সাজিয়েছে ফ্ল্যাটটা। প্রায় হাজার স্কয়ারফিটের ওপর। আমি একবার চারদিকটা চোখ বুলিয়ে নিলাম।
আয়েষা কোথায়?
ভেতরের ঘরে।
আমরা সকলে আবিদের পেছন পেছন এলাম।
আয়েষা খাটে বসে ছিল, আমায় দেখে উঠে এলো। নীচু হতে যাচ্ছিল। হাতটা চেপে ধরলাম।
আজ থাক, পেটে শেলাই আছে, নিচু হতে গেলে হিতে বিপরীত হলে মুস্কিল।
পাশের ছোট্ট একটা কটে বাচ্চাটা শুয়ে আছে। তনু মিত্রা ওখানে চলে গেছে।
বুবুন দেখবি আয় কেমন ঘুমচ্ছে।
আমি এগিয়ে গেলাম। ঘরে দুটো মেয়ে আছে। আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
বাচ্চা বৌ-এর দেখভাল করার জন্য আবিদ রেখেছে।
আমি ছোট্ট কটটার কাছে গেলাম।
কিরে একবারে পোঁটলা বানিয়ে দিয়েছিস। আয়েষার দিকে তাকালাম।
আয়েষা হাসছে।
দাদার কোলে দাও। আবিদ বললো।
না এখন থাক, ব্যাটা চোখ বন্ধ করে ঘুমচ্ছে।
মিত্রা নিজেই কট থেকে ওকে তুলে নিলো।
টাওয়েল দিয়ে আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়েছে। খালি পায়ের পাতাটুকু আর মুখ টুকু খোলা।
মিত্রা নিয়ে এসে আমার কোলে দিল।
ধর।
দাঁড়া, তুই কাছে থাক, ম্যানেজ করতে না পারলে নিয়ে নিবি।
ব্যাটা তখনও চোখ বুঁজিয়ে আছে।
কখন ঘুমিয়েছে? আয়েষার দিকে তাকালাম।
দূর সব সময় চোখ বন্ধ করে থাকে। পাশ থেকে চাঁদ বললো।
আমি বাচ্চাটার গালে গাল ছুঁইয়ে একটা ফুঁ মারতেই কেঁপে উঠলো। যেন মনে হলো একটু নড়ে চড়ে উঠলো। বিরক্তি চোখে আমার দিকে তাকাল। কুত কুতে চোখ।
ও মা, দেখ কিরকম পিট পিট করছে। মিত্রা বললো।
আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
মিত্রাদি।
তনুর ডাকে মিত্রা তাকাল।
নিয়ে আয় নিয়ে আয় দেখি পুঁচকের চোখের সামনে ধরতে কি করে।
তনু আমার নিয়ে আসা একটা কাগজের ফুল নিয়ে এসে মিত্রার হাতে দিল।
মিত্রা মুখে বিভিন্নরকম শব্দ করে ওর দিকে ফুলটা তুলে ধরলো।
ব্যাটা এবার বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়েছে।
কিরে চোখ মুখটা কেমন করছে মুতবে না তো। আয়েষার দিকে তাকালাম।
করলে করবে, তোমার জামাকাপর নষ্ট হবে না। আয়েষা বললো।
কিছুক্ষণ ওদের ওখানে থাকলাম। আবিদের ফ্ল্যাটটা ভাল করে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। প্রায় দেড় হাজার স্কয়ারফুটের ফ্ল্যাট। আবিদ অনেক মিষ্টি খাওয়াতে চেয়েছিল একটা খেয়ে একটু জল খেলাম।
তারপর বেরিয়ে এলাম।
সকাল থেকে বুকের ওপর যে পাথরটা চাপা দেওয়া ছিল এখন কেমন যেন বেশ হাল্কা হাল্কা লাগছে। বাচ্চাটাকে কার মতো দেখতে হয়েছে, আবিদের মতো না আয়েষার মতো। এখন বোঝা যাবে না। সবে মাত্র বাহাত্তর ঘণ্টা বয়স হয়েছে।
আয়েষা লিফ্টের দোরগোড়া পর্যন্ত এলো।
আবার কবে আসবে?
এই তুমি গণ্ডগোল করলে। আবিদ বলে উঠলো।
তোকে এরাও চিনেগেছে বুঝলি। মিত্রা বললো।
আমি আয়েষার দিকে তাকালাম।
হাসলাম।
এর মধ্যে একদিন ঠিক চলে আসবো দেখিস।
আগামীকাল নাসরিনরা ফিরে আসছে।
তোর সঙ্গে কথা হয়েছে।
হ্যাঁ। এই তো কিছুক্ষণ আগে ফোনে কথা হলো।
এইবার ওটার বিয়ে দিতে হবে। তাহলে ল্যাটা চুকে যাবে।
তুমি বললেই ও বিয়ে করে ফেলবে, তাই না।
কেন করবে না। তোর এবং নাসরিন দুজনেরি আমি লিগ্যাল গার্জেন।
আয়েষা মুখ নিচু করে নিল।
আমাদেরও ইচ্ছে অনিচ্ছা আছে।
আমি তোদের কোনও দিন বাধা দিইনি। তোদের ভালো কাজ আমি সব সময় মেনে নিয়েছি। ফাদার বিরোধিতা করলেও আমি সাপোর্ট করেছি। অন্যায় দেখলে একটু আধটু বকাঝকা করেছি। সেটা তোদের ভালোর জন্য।
আয়েষা মুখ তুললো।
ওর মাথায় হাত রাখলাম। এবার ঘরে যা। এই সময়টা একটু সাবধানে থাকিস।
নিচে নেমে এলাম। দেখলাম রবীন গাড়ির সামনের কাঁচ মুছছে।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
তোকে তখন অনিমষদাকে ফোন করতে বলেছিলাম।
দেখলি তো তোর সামনেই ডায়াল করেছিলাম। এনগেজ ছিল।
তোকে রিং ব্যাক করেনি?
করলে তোকে নিশ্চই বলতাম।
আমি গাড়ির দরজা খুললাম।
আসিরে।
আবিদ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি সিটে বসে দরজা বন্ধ করলাম।
ওই ভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছিস কেন?
চাঁদ হাসছে।
হাসছিস কেন?
ম্যাডামের কাছ থেকে আকিবের কথা শুনলাম। তাই ভাবি ওই তল্লাটের খবর তুমি পাই-টু-পাই পাও কোথা থেকে। পান থেকে চুন খসলেই ঝাড়।
ও তোর দাদা, ঝামেলা করতে যাস না। ধরা খেয়ে যাবি।
ঝামেলা করবো কেন, বন্ধুত্ব করবো।
না তোমাকে আর বন্ধুগিরি ফলাতে হবে না।
চাঁদ, আবিদ দুজনেই হাসছে।
মিত্রারা গাড়িতে উঠে এল। রবীন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এলো। মমিনপুরের মুখে আসতে রবীন জিজ্ঞাসা করলো।
ম্যাডাম এবার কোথায় যাব।
বাড়িতে।
শ্যামবাজার।
না। এই বাড়িতে।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
তুই তো এই বাড়িতে রাতে থাকবি বলেছিস। বড়োমা বললো।
আমি কোনও কথা বললাম না।
তনু গড়িয়াহাট থেকে খাবার নিয়ে নিস। রবীন তুমি তো দোকান চেন।
হ্যাঁ ম্যাডাম।
রবীন আলিপুর রোড ধরলো। বুঝলাম হাজরা হয়ে গড়িয়াহাট যাবে।
আমি জানলার দিকে মুখ করে রাস্তা দেখছি। গাড়ির ভেতরটা নিস্তব্ধ।
বুবুন।
মিত্রার ডাকে ফিরে তাকালাম।
তুই রাগ করেছিস?
কিসের জন্য বল।
আকিবের কথা চাঁদকে বলেছি।
না।
ওরা কেউ আকিবকে চেনে না?
মিত্রার দিকে তাকালাম।
হ্যাঁরে। ভেবেছিলাম ওরা হয়তো চেনে। শুনে বললো, ম্যাডাম আমরাও খানিকটা তোমার মতো। অনিদার সঙ্গে লতায়-পাতায় কতজনের সম্পর্ক আছে আমরা কিছুই জানি না। তবে এখন বুঝতে পারছি। অনিদা ওই তল্লাটের খবর এতো ডিটেলসে রাখে কি করে।
তুই এতো সুন্দর নিটওয়ার্ক তৈরি করলি কি করে বলতো?
মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
বোঝার চেষ্টা করলাম। মিত্রা এখন অনেক বুদ্ধিমতী।
সে তো বলতে পারবো না। তবে আমার জীবনে রাস্তা-ঘাটে কারণে-অকারণে এরকম অনেক লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে।
কোনও পরিচয় দুর্ঘটনা থেকে। আবার কোনও পরিচয় হয়েছে স্বাভাবিক নিয়ম মেনে। কেউ টিকে গেছে কেউ টেকেনি। আফটার অল সকলে মানুষ।
আকিবকে তুই চিনলি কি করে দুর্ঘটনা না স্বাভাবিক নিয়ম মেনে।
দেখলাম তনু আমাদের দিকে ঘুরে বসলো।
আকিবের সঙ্গে আমার পরিচয় একটা দুর্ঘটনা।
কি রকম?
তখন তোর অফিসের আমি ফ্রি-ল্যান্সার। নিজের পেট চালানর জন্য টাকার দরকার। মাঝে মাঝে সুজিতদার কাছে আসি কপিরাইটের কাজ জোগাড় করতে।
যেদিন পেলাম ভাল নাহলে সুজিতদার সঙ্গে সুজিতদার পয়সায় পার্কস্ট্রীটের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছেঁড়া পরটা ঘুগনি জিলিপি খেয়ে এক কাপ চা তারপর মাসির ঠেক।
তখন সুজিতদার অবস্থা ভালো ছিল না। আমার মতো ভিক্ষারী।
দু-চারটে ক্লায়েন্ট ছিল। তাও সব দুর্বল মার্কা। যে টুকু পেত তাতে কোনও প্রকারে চলে যেত। তখন গুবলু হয়নি। সুজিতদা সবে বিয়ে করেছে।
বৌদিও অফিসে আসতো সেই সময়। একটা স্টাফের মাইনে বাঁচতো।
সেদিন দাদা সকালের দিকে দেখা করতে বলেছে।
দামিনীমাসির ওখান থেকে বেরিয়ে অফিসে গেছি। কি করনে খুব ঝাড় খেলাম। ওখানে বসেই লেখাটা রি-রাইট করে দিতে হলো।
জমা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। পকেট গড়ের মাঠ। দশ বারোটাকা পরে রয়েছে। বাসে ওঠার নাম মনে হলেই গায়ে জড় এসে যায়। হন্টন বাবুর গাড়ি।
মিউজিয়ামের কাছে আসতেই দেখলাম বেশ ভিড়। দাঁড়িয়ে গেলাম। একটা লোক খেলা দেখাচ্ছে। তার সঙ্গে একটা বাচ্চা দুটো লোক। ছেলেটার স্পিকিং পাওয়ার দুর্দান্ত। খুব ভালভাল কথা বলছিল। দাঁড়িয়ে গেলাম।
কথাবার্তা শুনে বুঝলাম ব্যাটা খেলা দেখাবে। কাজ নেই তাই দাঁড়িয়ে গেলাম।
বেশ ভাল লাগছিল ওর কথাবার্তা।
তারপর একটা বাক্সে বার করলো ওপরটা খোলা। বাচ্চাটাকে ওর মধ্যে ঢুকিয়ে কালো কাপর চাপা দিল। কি সব বলে গেল এখন ঠিক মনে করতে পারছি না।
তবে এটুকু মনে আছে। সবাইকে জায়গা ছেড়ে নড়তে চড়তে বারন করলো।
তখন আমি পুরো হিপনোটাইজ। আমি বললে ভুল হবে যারা দাঁড়িয়ে ছিল সবাই।
একটা ল্যাংরা মতো লোক মুখে যা-তা বলতে বলতে ভিড়ে থেকে বাইরে যেতে চাইছিল দেখলাম ব্যাটা ছিটকে পরে গিয়ে ছটফট করতে শুরু করে দিল। তার লাঠি একদিকে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সে এদিকে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
ওই দেখে আমার কেমন যেন ভয় ভয় করতে শুরু করলো।
লোকটা আবার তার বক্তব্য রাখছে। দেখছেন হাতে হাতে ফল।
ওদের মধ্যে আর একজন গিয়ে ল্যাংড়া লোকটাকে তুলে ধরলো। সবাই আবার দাঁড়িয়ে পরলো। ল্যাংড়া লোকটাও।
আমিও বেশো কাঠের মতো দাঁড়িয়ে পরলাম।
আবার লোকটা বলতে শুরু করলো।
ছেলেটা সেই বাক্সে কাপর ঢাকা অবস্থায়। তারপর দেখলাম ছেলটাকে কি সব বলে গেল।
মোদ্দাকথা ওই বাচ্চাটার ওপর প্রেতাত্মা ভড় করেছে।
সেই লোকটা ঝোলা থেকে একটা চক চকে ছুঁড়ি বার করলো।
তারপর কাপরটা একটু ফাঁক করে মনে হয় ছেলেটার কোথাও ঢুকিয়ে দিল। একটা ছটফটানি। গোঁ গোঁয়ানি শব্দ। তারপর দেখলাম সব কেমন নিশ্চুপ। সামনে রাস্তা দিয়ে খালি গাড়ির শব্দ।
কয়েক মিনিট পর কালো কাপরটা তুলতেই দেখলাম ছেলেটার গলায় এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে ছুঁড়ি বিঁধে আছে। গল গল করে রক্ত বেরচ্ছে।
ভেতরে ভেতরে কেমন যেন নার্ভাস ফিল করলাম।
ব্যাটা তখন বলছে, আমার কাছে একটা ওষুধ আছে। এই মুহূর্তে ওইটা আপনারা কিনে নিন, নাহলে আপনাদের ক্ষতি হবে। কারণ প্রেতাত্মা এই মুহূর্তে সকলের ওপর ভড় করে আছে। এই রকম কি সব বলে গেল।
দাম বললো পনেরো টাকা।
একপ্রকার বলতে পারিস আমার পকেট থেকে বারো টাকা ছিনিয়ে নিল।
তারপর আবার ছেলেটাকে বাক্সের মধ্যে চালান করে দিয়ে কালো কাপর ঢাকা দিল।
কিছুক্ষণ পর খেলা শেষ। ভিড় ফাঁকা হয়ে গেছে। দেখলাম দিব্যি ছেলাটা গলাটা মুছতে মুছতে জল খেল। কথা বললো। আমি আর দাঁড়ালাম না। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
সাকুল্যে বারোটা টাকা পকেটে ছিল, আমার সামান্য দুর্বলতায় পকেট মার হয়ে গেল।
এশিয়াটিক সোসাইটির তলায় অনেকক্ষণ বসে বসে ভাবলাম।
সেই পুরিয়াটা খুলে দেখলাম কয়েকটা হাড়ের টুকরো একটা শেকড়।
আমি বেশ্যা পট্টির ছেলে, পুরো টুপি খেয়ে গেলাম। সুজিতদার কাছে এলাম। কাজ জুটলো না। দশটাকা ধার করে ফিরলাম।
সপ্তাহ-দুয়েক পর আবার তোর কাগজের অফিসের কাজ সেরে হাঁটা পথে পার্কস্ট্রীটে সুজিতদার অফিস। মিউজিয়ামের সামনে সেই ভিড়। উঁকি মারতেই দেখলাম, একই খেলা। কুশীলব সব এক। সই বক বক। আড় চোখে দেখলাম আগের দিনের সেই ল্যাংড়াও আছে।
দাঁড়িয়ে গেলাম।
একবারে টাইম ধরে ধরে সেই ডায়লগ, যেন মুখস্থ বলে যাচ্ছে। যে একটু নড়বেন তার ক্ষতি হবে।
তারপরেই সেই মহেন্দ্রক্ষণ ল্যাংড়া চলে যেতে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে পরে গেল।
আমার বারোটাকার শোক আর ভুলতে পারলাম না।
ল্যাংড়ার সেই লাঠি নিয়ে ওই ভিড়ের মধ্যে ডায়লাগ মারা সেই লোকটাকে বেধড়কে পিটতে শুরু করলাম। তখন আমি দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য। রাগে গা রি রি করছে।
হই হই রই রই অবস্থা।
আমার মাথায় আগুন জ্বলছে। আমার ওরকম এলোপাথাড়ি মার দেখে সেই চেলাগুলো যে যার হাওয়া। ল্যাংড়া হামাগুড়ি দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে। দিলাম তাকেও দু-ঘা।
সে এক রক্তা রক্তি অবস্থা। কোথা থেকে পুলিশ এসে হাজির সোজা পার্কস্ট্রীট থানায় চালান।
আমি আছি ল্যাংড়া আছে সেই লোকটা।
থানায় ঢুকেই পুলিসের হম্বি-তম্বি বেরে গেল।
এই সব ক্ষেত্রে যা হয় আর কি।
আমি চুপ চাপ। ডাইরী লেখা হবে।
নাম-ধাম জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলো।
আমি ঘোষদার নাম করলাম।
অফিসার আমার মুখের দিকে একবার তাকাল।
ভালই রেফারেন্স জোগাড় করেছিস। পোঁদে যখন দু-চার ঘা ডাণ্ডার বাড়ি দেব রেফারেন্স বেরিয়ে যাবে।
কথা শুনে মাথা গরম হয়েগেল। টেবিল চাপরে বললাম, আমি সাংবাদিক। কালকেই এটা নিয়ে লিখব। দেখি আপনার চাকরি কে বাঁচায়।
আমার ওই অবস্থা দেখে ঘরের সবাই আমার মুখের দিকে তাকায়।
লোকটা কি বুঝল কি জানি। চেয়ার ছেড়ে উঠে ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললো, যান ভেতরে যান, ঘোষ সাহেব ডাকছেন।
আমি ভেতরে গেলাম।
ঘোষদা হেসে বললো, ও তুই, বাইরে নাকি খুব চেঁচামিচি করছিলি।
ঘোষদাকে সব বললাম, ঘোষদা হেসে কুটি কুটি। কবি তোর দ্বারা সাংবাদিকতা হবে না।
ঘোষদা তখন আমাকে কবি বলে ডাকতো। আমার থেকে বছর দশেকের সিনিয়ার।
আগে বৌবাজারে ছিল সেই সময় পার্কস্ট্রীটে এসেছে।
তারপর ঘোষদা সেই অফিসারকে ডাকলো। বললো সবাইকে ছেড়ে দিন।
ভদ্রলোক প্রথমটায় একটু অবাক হলেন, তারপর সিনিয়ার অফিসার তায় ওসি, কিছু বললেন না।
ঘণ্টা খানেক কাটিয়ে থানা থেকে বেরিয়েছি। দেখি চার মক্কেল ফুটপাথে বসে।
সেই ল্যাংড়াও আছে।
ভাবলাম পিটবে নাকি। পেটে পিটুক আমিও অনেক পিটিয়েছি তখন।
ওমা দেখি সেই ভদ্রলোক যে বক বক করছিল আমার সামনে হাতজোড় করে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমাকে মাফ করে দিন। ভুল হয়ে গেছে।
ভাবলাম ব্যাটা হয়তো বারো টাকা ফেরত দেবে।
মিত্রা-তনু হাসছে।
কচু। আকিব ওই দলে ছিল। তখন ওর বছর কুড়ি বয়স।
তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে বুঝলি।
চার নম্বর পোলের তলায় ওদের ঝুপড়িতে গেছি। নিজে চোখে দেখেছি কিভাবে ওরা বেঁচে আছে।
তারপর জড়িয়ে গেলাম।
এই যে এতদিন আমি ছিলাম না। কলকাতায় এলে ওদের ওখানেও কয়েকবার ছিলাম।
রবীন ঠিক জায়গায় গাড়ি পার্ক করে খাবার আনতে নামলো।
আমি বললাম, একটু চা খাওয়াবি।
না এখন খেতে হবে না। বাড়ি গিয়ে খাবি। মিত্রা বললো।
তনু গাড়ি থেকে নেমে গেল।
আমি মিত্রা একা।
জানিস মিত্রা মাঝে মাঝে মন হয় আমার দেখা চরিত্রগুলো এখনও আমার আশেপাশে ঘোরাফেরা করে।
হয়তো করে। দিন বদলালেও মানুষের এই পেশা বদলায় নি। মিত্রা বললো।
এখনও তুই যদি মনুমেন্টের তলায় একটু খোলা চোখে ঘোরা ঘুরি করিস এদের দেখা পাবি।
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
তখন তুই চূড়ান্ত বহেমিয়ান।
তা বলতে পারিস। চালচূল হীন মানুষ। একটা ঠেলা ওয়ালা রিক্সা ওয়ালার থেকেও অনিশ্চিত জীবন। কোনওদিন খেতে পাই, কোনওদিন পাই না। কাকে বলবো।
কাকার সঙ্গে এক অদ্ভূত অভিমানের পালা চলছে।
দু-একবার টাকা চায়নি তা নয়। মুখের ওপর বলে দিয়েছে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াও।
কপাল খারাপ টিউশনির বাজার ধরতে পারিনি।
ভালো করে যে বেশ্যার দালালি করবো তাও পারতাম না। সম্মান বোধ।
এক অদ্ভূত দম বন্ধ করা পরিস্থিতি।
আচ্ছা এই রিলেশনগুলো তুই কবে ক্যাশ করতে শুরু করলি?
হাসলাম।
হয়তো এই জীবনে ক্যাশ করা হতো না। মাথা নীচু করে নিলাম।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা তুললাম।
এর জন্য আমি তোর কাছে ঋণী। তুই আমাকে ক্ষমতা দিলি। কাগজের মালিক বানালি। আমি ধীরে ধীরে তা ব্যবহার করেছি। কিন্তু কখনও কোনও অন্যায় কাজে আমার ক্ষমতা ব্যবহার করিনি।
তোর সঙ্গে যদি আমার দেখা না হতো, তুই যদি আমাকে আশ্রয় না দিতিস, আমি আর দশজনের মতো বেঁচে থাকতাম। সুনীতদা আমাকে তোর কাগজ থেকে ভাগিয়ে নিয়ে গিয়ে নিজের কাগজে নিয়ে যেতো। আমি সেই কাগজে কাজ করতাম।
সুনীতদার কাজের লোকের দরকার ছিল আমার টাকার।
দাদাদের হয়তো চাকরি জুটতো না। আমিই টানতাম।
হয়তো জীবনটা অন্যভাবে লেখা হতো।
আমার কথাটা অন্যভাবে নিস না। জীবনে বড়ো হতে গেলে একটা খুঁটির ভীষণ দরকার বুঝলি। তারপর তোর বুদ্ধি তোর ইনটেলেক্ট তোর কানেকসন দিয়ে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাও।
আজতো অস্বীকার করার উপায় নেই, তুই আমার সেই সবচেয়ে বড়ো খুঁটি।
এটা তুই বহুবার আমাকে শুনিয়েছিস।
নিজে যাতে ভুলে না যাই তাই।
আজ আমার যা কিছু তার মূল কেন্দ্রে তুই। তুই অনেক একরোখা হতে পারতিস। আমার সঙ্গে দিনরাত যুদ্ধ করতে পারতিস। আমাকে তোর হাতের পুতুল বানাতে পারতিস।
কিন্তু তুই তা করিসনি। তুই আমার সব কিছু মেনে নিয়েছিস।
আমি তোকে যতোটা ভালোবাসি তার থেকেও তুই আমাকে বেশি ভালোবাসিস।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি তোর সেই ভালোবাসার কলঙ্ক।
কেন?
একটা কথা আমি সব সময় মনে করতাম এই যা কিছু আমার তা আমার নয়। তোর। তুই বার বার এই কথার বিরোধিতা করেছিস। মন থেকে মনে নিতে পারিনি।
আমার বেড়ে ওঠা এক অদ্ভূত পরিবেশে। ফলে নিজেকে নিয়ে যখন ভাবি তখন কেমন পাগল পাগল মন হয়। আমার আচার আচরণ, নিজের কাছেই কেমন অস্বাভাবিক বলে মনে হয়।
কিন্তু একটু ভেবে দেখ, আমার চলার পথে যারা নিজের স্বার্থ চরিতার্থতার জন্য কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে, আমি তাদের ক্ষতি করেছি। এও তোকে বলছি মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত করবো।
তোকে কথা দিলাম দিবাকরের ইতিহাস লেখা শেষ করেছি ও আর বেশি দিন নেই।
নেক্সট অনাদি, সাগর। তারপর আমি থামবো। এর মধ্যে নতুন করে যদি কেউ জুটে যায়, খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দেব। জীবনটাকে নিয়ে সারাজীবন ছিনি মিনি খেলেছি। বাকিটুকু নয় খেলেই যাব।
বুবুন!
হ্যাঁ মিত্রা। দিবাকর আমাকে প্রথম এই জগত দেখার, এই জগতে মেশার সুযোগ দিয়ছে। একে একে আমি জড়িয়ে পরেছি আণ্ডার ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে। ইসলামভাই-এর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। কিন্তু সেটা কাজের স্বার্থে, কাজের বাইরে ইসলামভাইকে আমি কোনওদিন পুঁছতাম না।
বেশ্যা পট্টিতে রাতের পর রাত কাটিয়েছি। নিজেকে অনেক সংযত রেখেছি।
কিন্তু দিবাকর আমার সমস্ত সংযম ভেঙে দিয়েছে।
বেড়ালের একুশ দিনে চোখ ফোটে।
আমারও চোখ ফোটার পর ভাবতাম ইসলামভাই শেষ কথা নয়। এরপর আরও আছে। আমাকে শেষ দেখতে হবে।
আজ কুড়ি বছর ধরে তার সন্ধান করেছি। শেষে আফতাবভাই-এর কাছে এসে থেমেছি।
অনেক কিছু শিখেছি জানিস আফতাবভাই-এর কাছে।
বিশেষ করে সাপুরে যেমন বিষধর সাপের সঙ্গে খেলে। ওটাও একটা শেখার বিষয়। আমিও শিখেছি। এখন রপ্ত হয়ে গেছি।
সাপুরে সাপের কামড়ে মরে। মিত্রা বললো।
না। তুই অসতর্ক হলে তোকে সাপের কামড় খেতে হবে।
কিন্তু তুমি যদি সাপের বিষদাঁত ভেঙে সাপকে নিয়ে খেলা করো সে ফোঁস করবে কিন্তু কিছু করতে পারবে না। আমর কাছে কয়েকটা বিষধর সাপ আছে। যাদের বিষদাঁত আছে। বাকি সব জাতসাপ, তবে বিষদাঁত ভাঙা। যেগুলোর বিষদাঁত আছে, সেগুলোকে ঝোলা থেকে খুব কম বার করি। ওদের এক ছোবলে তোর ভবলীলা সাঙ্গ।
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
কি ভাবছিস?
রবীন, তনু হাতে একগাদা প্যাকেট নিয়ে ফিরে এলো।
আমরা আর ফিরছি নাতো? তনু বললো।
কেন বলতো? মিত্রা বললো।
রাতের খাবার নিয়ে নিয়েছি।
এখনকার খাবার জন্য কিছু নিয়েছিস?
ফিস কাটলেট নিয়েছি।
চল আর দেরি করে লাভ নেই।
গড়িয়াহাট থেকে দাদার বাড়ি আসতে বেশি সময় লাগল না। একটু খানি পথ। মিনিট সাতেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম।
ছগনলাল গেটের মুখে বসেছিল ওর দেশোয়ালী ভাইদের সঙ্গে। গেট খুলে দিল।
রবীন গাড়ি রেখে চাবি আনল।
আমার ঘর আর বড়োমার ঘর খোলা হলো।
তনু ঘর খুলতেই আমি বাথরুমে গেলাম। চোখে মুখে ভাল করে জল দিলাম। সেই সকালে এই পাজামা পাঞ্জাবী পরেছি এখন আর শরীরে রাখতে ইচ্ছে করছে না।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম তনু ছোট্ট টেবিলটাতে খাবার গোছাচ্ছে। তিনটে প্লেট।
তনু আমাকে একটা পাজামা পাঞ্জাবী দাও এটা আর পরে থাকতে ভাল লাগছে না।
তনু আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
আলনায় আছে একটু নিয়ে নাও।
আমি নিজে হাতে আমার মতো বার করে নিলাম। শরীর থেকে টেনে হিঁচড়ে খুলে ফেললাম সকাল থেকে পরে থাকা জামাকাপর। চেঞ্জ করে নিলাম।
একটা বালিশ টেনে নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসলাম।
তোমরা জামকাপর ছাড়বে না।
পরে ছাড়ছি।
নাও তুমি খেতে শুরু করো। আমি চা নিয়ে আসি।
মিত্রা কোথায়?
খাবারগুলো গুছিয়ে রাখছে।
রবীন চলে গেছে।
না। ওঘরে বসে টিভি দেখছে।
ওকে ছেড়ে দাও।
এখন থাক। নাও তুমি খেতে শুরু করো আমরা আসছি।
তোমরা এসো।
ঠান্ডা হয়ে যাবে।
হোক।
তনু বেরিয়ে গেল।
অনাদি, সাগরকে এ্যারেস্ট করলো। অনিমেষদার কানে নিশ্চই খবর পৌঁছে গেছে। ওরা বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। আমাকে ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না।
ওরা রাজনীতি করে। আমি রাজনীতি করি না।
কাল রাতে অনিমেষদার সঙ্গে কোনও কথা বলা হয়নি। আজও সারাদিন দেখা হলো না।
ঘুটিগুলো ওলট-পালট হয়ে গেলে গণ্ডগোল।
কিরে এখনও শুরু করিসনি। মিত্রা বলতে বলতে ঘরে ঢুকলো।
তনুর হাতে চায়ের ফ্লাক্স।
তনু সোফায় বসলো। মিত্রা আমার শরীর ছুঁয়ে বসলো। সেন্টার টেবিলটা কাছে টেনে নিল।
অনিমেষদা ফোন করেছিল। মিত্রা বললো।
আমাকে একটু দিলি না।
রাতে সবাই ফিরে আসবে। তুই এখানে থাকবি। ওরা কেউ থাকতে চাইছে না।
আর কখন আসবে, এখনই তো সাড়ে সাতটা পৌনে আটটা বাজে।
আসবে।
তিনজনে খাওয়া শুরু করলাম।
জানিস বুবুন….।
মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।
দিবাকরের কথাটা মনে পরলে খারাপ লাগে।
কেন!
মনে হয় এই তো কয়েকদিন আগে মেলার মাঠে দুজনে পাশাপাশি বসে গল্প করছি, নীপারা স্টেজে চন্ডালিকা করছে। ছেলেটা কেন যে এমন….।
লোভ।
তোরও লোভ আছে, নেই? আমারও আছে, তনুরও আছে।
সেটা ক্ষতি কারক নয়।
আচ্ছা এমন কিছু লোভ আছে কি, যেটা মানুষকে পাগল করে দেয়?
হ্যাঁ।
তনু ফ্লাক্স থেকে কাপে চা ঢালছে।
মিত্রা খাট থেকে উঠে দাঁড়াল।
দাঁড়া তোকে একটা জিনিষ দেখাই।
মিত্রা সোজা টেবিলের কাছে চলে গেল। ড্রয়ার থেকে চাবি বার করে আলমাড়ি খুললো, তারপর শরীরটা ভেতরে ঢুকিয়ে একবারে আলমাড়ির শেষপ্রান্ত থেকে একটা চাবি বার করে লকারটা খুললো।
ব্রাউন কালারের একটা বড়ো খাম বার করে আনলো।
আলমাড়ির পাল্লাটা ভেজিয়ে খাটে এসে বসলো।
আমি চায়ে চুমুক দিয়েছি।
আমরও কিছু কিছু লোভ আছে। তার নিদর্শন তোকে দেখাচ্ছি। তোকে দেখে বলতে হবে সেটা খারাপ না ভাল।
আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
মিত্রা খামের ভেতর থেকে একটা খাম বার করে পাশে রাখলো। তারপর একটা কাগজের ফুল বার করে এনে আমার চোখের সামনে খুলে মেলে ধরলো।
চিনতে পারিস।
আমি ফুলটার দিকে তাকিয়ে আছি। বুকটা চিন চিন করে উঠলো।
মায়ের আলমাড়ি থেকে চুরি করেছি। তখন তুই নিরুদ্দেশ।
একদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য ও বাড়িতে গেছিলাম।
ফেরার পথে এই দুটো নিজে হাতে ক্যানিং স্ট্রীট থেকে কিনে এনেছিলাম।
মিত্রা আর একটা খাম থেকে আরও দুটো ফুল বার করলো।
এইটা তোর ছেলের, এইটা তোর ময়ের। তারপর একদিন যত্ন করে খামে ভরে আমার লকারে ঢুকিয়ে রেখেছি। কতদিন পর বার করলাম ঠিক মনে নেই। তবে খুব মন খারাপ হলে বার কয়েক তোর ফুলটা বার করে দেখেছি।
মনে হতো এই ফুলটায় তোর আঙুলের স্পর্শ আছে, মায়ের হাতের স্পর্শ আছে।
আমার বুকর চিন চিন ব্যাথাটা ক্রমশঃ বারছে।
আজ আকিব যখন খামটা দিয়ে গেল, ফুলটা যখন দেখলাম, তখন বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। যেন মন হলো দম বন্ধ হয়ে আসছে।
নিজেকে খুব জোড় সামলে নিয়েছিলাম।
তোর জীবনের অপরিপূর্ণতা আমি তনু কোনওদিন পূরণ করতে পারবো না। তবে সুখ-দুঃখে তোর পাশে থাকর একটু সুযোগ দে না। কেন দূরে সরিয়ে রাখিস।
মিত্রার গলাটা ভাড়ি হয়ে এলো।
যেদিন পীরবাবার থানে আমরা দু-জন গেলাম। মায়ের চেনটা বার করতে গিয়ে প্রথম ফুলটা চোখে পরেছিল। তোকে জিজ্ঞাসা করবো করবো করে আর করা হয়নি।
তোর ছেলে-মেয়ের ছয় ষষ্ঠীর দিন উনা মস্টার দুটো কাগজের ফুল কিনে এনেছিল। সাদা রং-এর তা তোর ছেলে মেয়ে দুদিনে তাকে টেনে ছিঁড়ে দিল।
তারপর আমি একদিনের জন্য জোড় করে একবার গেলাম। সেদিনই ফিরে এলাম।
সঙ্গে ফুলটা নিয়ে এসেছিলাম। আর দুটো জিনিষ নিতে গেছিলাম, দেখলাম যে জায়গায় সেই দুটো দেখেছি, সেই জায়গায় নেই।
তবে তার আগে তোর অজান্তে আমি জেরক্স করে রেখেছিলাম।
আজ পর্যন্ত আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তি দেখেনি।
একমাত্র তোর জিনিষ তুই দেখেছিস।
বুঝতে পারলাম আমার চোখে মুখে তুমুল পরিবর্তন হচ্ছে। চোখ দুটো জ্বালা করছে।
আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাতে আমি তোকে আমার কথা বলেছিলাম। তুই জ্যেঠিমনিকে আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিলি। ভাঙ্গা ঘর জোড়া লাগিয়েছিলি। এখনও তারা তোকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। তুই যদি বলিস জল উঁচু তাহলে জল উঁচু। যদি বলিস জল নীচু তাহলে জল নীচু। একটুও ভাবে না। অনি সত্যি বলছে না মিথ্যে বলছে।
জ্ঞাণ হওয়া থেকে তুই তোর শেকড়ের খোঁজ করছিস। বহুবার আমাকে বলেছিস, আমি অনাথ। তাই লোকে আমাকে চট করে ভালোবেসে ফেলে। এটা তোর মুখের কথা। মনের কথা নয়। মা-বাবা কলেরায় মারা যায়নি। মা-বাবা আত্মহত্যা করেছিল।
মিত্রা চোখ-মুখ লাল করে আমার মুখের দিকে তাকাল।
কেন? একমাত্র তুই জানিস।
মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরে ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো।
তনু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ছল ছল করছে।
কেন তুই একা সারাটা জীবন এই কষ্ট বয়ে বেরাবি। আমরা দু-জনে যদি তোর সঙ্গে সমান ভাবে ভাগ করে নিই ক্ষতি কি।
অশ্বিনী জ্যেঠু মরার আগে তোকে সত্যি কথাটা বলে গেছে। একমাত্র সে আর কাকা ছাড়া পৃথিবীর তৃতীয় ব্যক্তি কেউ জানতো না।
আমার বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আমি বাকরহিত। ফ্যাল ফ্যাল করে মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখ দুটা ভীষণ জ্বালা জ্বালা করছে।
আজ তুই মাসীমার কাছে গেছিস। বড়োমার থেকেও তাকে তুই অনেক উঁচু আসনে বসিয়েছিস।
কে এই মাসীমা?
চলবে —————————–
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/jGBhLn3
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment