কাজলদিঘী (১৯১ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯১ নং কিস্তি
—————————–

আমার পেছন পেছন সবাই ঘরে এসেছে। বিনয়দা আমার পাশে।

গৃহস্থ বাড়িতে রুগীর ঘর দেখতে যেমন হয় সেরকমই লাগছে।

ছোট্ট একটা কাঠের মিনিয়েচার করা টেবিলে ওষুধের শিশি, একমগ জল, একটা গ্লাস।

পাঁচমাস আগে যা দেখেছিলাম, তার থেকে খুব একটা ইমপ্রুভ হয়েছে বুঝতে পারলাম না। সব একইরকম আছে।

গায়ের রংটা আরও বেশি যেন ফ্যাটফেটে লাগছে। পাকা গমর মতো রং-এ সাদাটে রং ধরেছে।

মাথার চুলগুলো যে দু-একটা কালো তারের মতো দেখে গেছিলাম সেগুলো এখন পাটের রং।

মাসিমার কাছে যে মেয়েটি থাকতো সে আসেনি?

বিনয়দার দিকে তাকালাম।

এসেছিল। ওর আবার বাচ্চাটার শরীর খারাপ। তাই চলেগেছে। বিকেলে আসবে বলেছে।

এই মাসে চেকআপ করার ডেট?

তুই তো জানাবি বললি।

এই দেখো একবারে খেয়াল নেই। আমাকে একবার ফোন করবে তো।

বিনয়দা হাসছে। মেয়েটি কম-বেশি রেগুলার ফোন করে। নিজে থেকেই খোঁজ-খবর নেয়।

সেই বলো। মাসিমা ঘুমচ্ছে।

সব সময় কেমন একটা ঘোরে থাকে।

আমরা দুজনে খুব চাপা স্বরে কথা বলছিলাম।

একবার পেছন দিকে তাকালাম। বড়োমাদের চোখ-মুখ যেন ভূত দেখছে।

সবারই নজর বিছানার ওপর মাসিমার শরীরটা।

অনি আবার এই ভদ্রমহিলাকে পেল কোথায়! বৌদিও স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।

হয়তো সকাল বেলা বলা কথাটার উত্তর খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে।

মাসিমা পাশ ফিরে শুয়ে আছে, গায়ে একটা পাতলা চাদর।

আমি খাটের কাছে গিয়ে মাসিমার কপালে আস্তে করে হাত রাখলাম।

আমার হাতের ছোঁয়ায় মাসিমা চোখ মেলে তাকাল।

আমি অনি।

আমার গলার আওয়াজ শুনে অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

ঠোঁটের কোনে প্রতিপদের চাঁদ। চোখে মুখে ফুটে উঠলো যন্ত্রণার বলি রেখা। কিছু বলতে চাইল।

ঠোঁট দুটো থিরি থিরি কেঁপে উঠলো। আমি মুখটা মাসিমার মুখের কাছে নামিয়ে আনলাম। চোখের ইশারা করলাম।

কেমন আছিস?

ভালো।

আস্তে করে বললো, ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে?

একবার পেছনদিকে তাকালাম। কথাটা কেউ শুনতে পেল নাকি।

সবাই যেন কানটা জুম করে আমার কথা শুনতে চাইছে।

আমি মুখে কিছু না বলে ইশারায় বোঝালাম, দেখা হয়েছে, ভাল আছে।

মাসিমা ঘরের চারদিক ফ্যাকাশে চোখে জুল জুল করে তাকিয়ে দেখছে।

এরা কারা?

হাসলাম।

তুমি আমার পরিবারকে দেখতে চেয়েছিলে। আজ সুযোগ পেলাম তাই নিয়ে এলাম।

মাসিমা এবার হাসলো। এই হাসির মধ্যে প্রাণ ফিরে পেলাম।

তনু, মিত্রা এসেছে?

এসেছে।

একটু দেখা।

বেশি কথা বলতে পারবে না। কষ্ট হবে।

হবে না।

মাসিমা চোখ বন্ধ করে সম্মতি জানাল।

আমি তনু-মিত্রাকে কাছে ডাকলাম।

ওদের দু-জনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর মাসিমা অনেকক্ষণ ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। শীর্ণ হাত দুটো সামন্য কেঁপে উঠলো। ওদের ছুঁতে চায়।

ওরা বুঝতে পেরে নিজেরেই মাসিমার হাত ধরলো।

দুজনে আমার দিকে তাকাল। ইশারায় বললো প্রণাম করবে।

মাসিমা আমার মুখের দিকে তাকাল। একটু ধর।

তোমায় উঠতে হবে না।

সকাল থেকে একবারও উঠিনি।

তোমার কষ্ট হবে।

হোক, অতিথি এসেছে।

আমি মসিমাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে ধীরে ধীরে উঠে বসালাম।

নিজেই বুকের কাপরটা ঠিক ঠাক করে দিলাম।

মাসিমা হাসছে।

কি খেয়েছো?

ছানা।

ফলের রস?

বিনয় দিয়েছে।

মাসিমা বড়োমাদের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার দিকে তাকাল।

ওরা কারা।

বড়োমা, ছোটোমা, বৌদি, জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি।

সবাই এসেছে!

হ্যাঁ।

এদিকে কোথায় এসেছিলি?

মনসা মন্দিরে।

ছোটোমা পূজো দিল?

হ্যাঁ।

মাসিমা আমার মুখে হাত বোলাচ্ছে।

তুমি বেশিক্ষণ বোসো না। কষ্ট হবে।

বালিশগুলো একটু পিঠে দিয়ে দে।

তনু খাটের পাশ থেকে বালিশগুলো এগিয়ে দিল। আমি সাজিয়ে দিলাম।

বড়োমারা খাটের কাছে এগিয়ে এসেছে।

মাসিমা আমার মুখের দিকে তাকাল।

সুতপা কোনটা।

বৌদি এগিয়ে এসে বিছানায় জড়ো হয়ে থাকা কাপর-চোপরের মধ্যে মাসিমার পা খুঁজতে শুরু করেছে।

মাসিমা হাসছে। থাক থাক।

একে একে বড়োমা, ছোটোমা, দামিনীমাসি, জ্যেঠিমনির সঙ্গে মাসিমার পরিচয় করালাম।

মাসিমা ছোটোমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।

আপনার পরিচয়টা অনি এখনও আমাদের দেয়নি। বৌদি বললো।

তোমরা চা খেয়েছো?

মাসিমা আবার সামনের দিকে তাকাল।

বিনয়।

হ্যাঁ মা। টুনি বানাচ্ছে।

একটু মিষ্টি জল এনে দে।

টুনি আনছে।

বৌমা ফোন করেছিল?

ওকে জানিয়েছি।

তিতাসকে বলেছিস, অনি এসেছে।

হ্যাঁ।

মাসিমা আবার আমার মুখের দিকে তাকাল।

এখান থেকে কোথায় যাবি?

শ্যামবাজারের বাড়িতে। ছোটোমার বিবাহ বার্ষিকী।

মাসিমা হাসলো।

বৌদি আবার রিপিড করলো, আপনার পরিচয়টা অনি এখনও আমাদের দেয়নি।

মাসিমা বৌদির দিকে তাকাল।

দেবে।

মাসিমা বড়োমার দিকে তাকাল।

তোমায় অনি খুব ভালোবাসে।

বড়োমা এগিয়ে এসে মাসিমার হাতদুটো শক্ত করে ধরলো।

দু-জনেই দু-জনের চোখে চোখ রেখেছে।

ওমা তোমরা সকলে এখনও দাঁড়িয়ে আছ। দাদাটা কি গো ও ঘর থেকে কয়েকটা চেয়ার আনতে পারেনি। জ্যেঠু তুমি ট্রে-টা ধরো আমি চেয়ার নিয়ে আসছি।

টুনি বিনয়দার হাতে ট্রে-টা ধরিয়ে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

তনু, মিত্রা এগিয়ে গেছে।

দিন আমরা নিয়ে নিচ্ছি।

মাসিমা ওদের দিকে তাকিয়েছে।

নাও তোমরা একটু মিষ্টি খেয়ে জল খাও। আজ প্রথম এলে।

আমি খাটের কাছ থেকে এগিয়ে এলাম। একটা চায়ের কাপ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

বুকের ভেতরটা কেমন যন্ত্রণা করছে।

ঝিমলির কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে মাসিমার আয়ু আর বেশি দিন নেই।

এই একটা রোগ কটি কটি টাকা খরচ করেও মানুষের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবে না।

সাত-পাঁচ নানা কথা মনের মধ্যে ভিড় করতে শুরু করেছে।

মাঝে মাঝে মনে হয়, যে হাত দুটো কোনও কাজাই লাগবে না সেই হাত দুটো রেখে লাভ কি। তার থেকে বরং দুমড়ে মুচড়ে তাকে ভেঙে ফেল। ল্যাটা চুকে গেল।

বিনয়দা হয়তো জানে, আবার জানে না, জানলেও কি করবে। তারও হাত-পা বাঁধা।

আকাশ-পাতাল কতো কথা পিঁপড়ের চাকের মতো মাথায় কামড়াচ্ছে।

কিরে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস।

এমনি। এবার চল দেরি হয়ে যাবে।

মাসিমা তোকে ডাকছেন।

কথা বললি।

মিত্রা মাথা দোলাল।

তনু কোথায়।

মাসিমাকে শোয়াচ্ছে।

আমি ভেতরে এলাম। তনু মাসিমার মাথার শিয়রে বসে। আমি কাছে গেলাম।

কপালে হাত রাখলাম। মাসিমা আমার হাতটা ধরলো।

আবার কবে আসবি।

দেখি। খুব ঝামেলায় পড়ে গেছি।

তিতাস সকালে কাগজ পড়ে শোনায়। তখন তোর কথা জানতে পারি।

আমি চুপ করে রইলাম।

অনেক ওপরে উঠেছিস, জীবনে যে প্রতিজ্ঞাগুলো করেছিলি সব তো শেষ করলি, আর নয়।

আমি মাসিমার মুখের দিকে তাকালাম।

মেয়েটাকে ছেলেটাকে একটু দেখা।

দেখাব।

তুই বৃথা কষ্ট পাচ্ছিস, আমি ঠিক আছি। আগের থেকে অনেক ভালো আছি।

আমি কষ্ট পাই না।

মাসিমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

একটা জিনিষ রেখেছি তোর জন্য, নিয়ে যা।

তুমি আমার থেকে কিছু নাও নি।

নতুন বৌ-এর মুখ দেখলাম, তুই না নিস, ওদের দিস।

ওরা বুড়ী হয়ে গেছে।

তুই তো বুড়ী বয়সে দেখালি।

সময় পাইনি।

মিত্রারা মুচকি মুচকি হাসছে।

অনেকক্ষণ কথা বলেছো এখন আর কথা বলবে না। ঘুমোবার চেষ্টা করো।

কবে আসবি?

আগামী সপ্তাহে, না পারলে তার পরের সপ্তাহে আসবো।

ঘরের তালা তো খুললি।

চুপ করে রইলাম। কোনও কথা বললাম না।

ঠিক আছে যা, তুই এখন আর কোনও কথা বলবি না।

আমি মাসিমার মুখের দিকে আর তাকালাম না। হন হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা বাগান পেড়িয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম।

ভ্যান রিক্সর ছেলেটা এগিয়ে এলো। একটাকে দেখছি আর একটা গেল কোথায়?

দাদা এখন যাবেন।

হ্যাঁ। তুমি ভাই একটা কাজ করবে।

বলুন।

আমি এগিয়ে যাচ্ছি। তুমি বরং ওদের নিয়ে এসো।

কোথায় যাব বলুন।

মাছিডাঙার নতুনপল্লীর রাস্তায়। দেখবে ওখানে একটা গাড়ি দাঁড় করানো আছে।

আচ্ছা।

কি জানি কি হলো আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো না। ইঁটের রাস্তা ধরে সোজা হাঁটতে শুরু করলাম।

ঠিক শহর নয়। শহর ধীরে ধীরে গ্রাস করছে গ্রাম্য নির্জনতাকে।

সূর্যের আলো গায়ে লাগছে না। গাছের পাতার আড়ালে সে ঢাকা পড়ে গেছে।

এই তল্লাটে প্রচুর লিচু, পেয়ারা, জাম, জামরুল, আতা, কলাগাছ আছে।

একটা বাড়িও দেখা যাবে না, যেখানে এই গাছ নেই। ইঁট বিছানো সরু এই পথটা এঁকে বেঁকে বড়ো রাস্তায় গিয়ে মিশেছে।

ওই পথে আর যেতে ইচ্ছে করলো না। আমি অন্য পথে চলে এলাম একেবারে ভেঁড়ির ধারে।

নাক বরাবর সোজা হাঁটলে নতুনপল্লীর মোড়।

বিকাশদের পাড়াটার নাম নতুনপল্লী।

প্রথম যখন এখানে এসেছিলাম তখন এই তল্লাটের অবস্থা যা দেখেছিলাম এখন তার থেকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

ফি-বছর বিদ্যেধরী দু-কুল ছাপিয়ে চারদিক ভাসিয়ে দিত। ডাঙা বলতে ওই মন্দিরের চত্বর টুকু।

মাসিমাদের বাড়ি ডুবতো না। তল্লাটের সবাই এসে উঠতো ওই মন্দির চত্বরে আর মাসিমাদের বাড়ি। ঈশ্বরদাদুর সামনের জায়গাটুকুতে তখন সব অস্থায়ী ত্রিপল টাঙান হতো।

জল নেমে গেলে আবার যেই কে সেই।

এখন বিদ্যেধরীর শরীরে পলি পড়েছে। সেই জলোচ্ছ্বাস আর নেই। তবে বর্ষায় খানা-খন্দর, ডোবা সব ভরে যায়। এখনও এই মজা খালেও জোয়ার ভাটা খেলে। জোয়ারের সামান্য নোনাজল খেত খামারে ঢুকিয়ে গলদা, বাগদা চাষ হয়।

চারদিকে বিশাল জলরাশি। মাঝখানে মডেলদের শরীরের মতো মেদহীন সরু রাস্তা। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে আমাকে জলে ফেলে দেবার তাল করছে।

মাথাটা একমনি বস্তার মতো ভাড়ি ভাড়ি লাগছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। সাত আটমাস আগেও মাসিমাকে যেমন দেখেছিলাম, তার থেকেও অবস্থা এখন অনেকটা খারাপের দিকে।

ঝিমলি কথায় কথায় বলেছিল, অনিদা তুমি যতই চেষ্টা করো, এসব রুগী বছর পাঁচেকের বেশি বাঁচে না। হঠাৎ হঠাৎ কি হয়ে যাবে বলা খুব মুস্কিল। ওষুধের ওপর রাখতে হবে।

কথায় কথায় এও বলছিল, বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে পারলে একবার চেষ্টা চরিত্র করে দেখা যেতে পারতো।

তিতাস, বিনয়দা দুজনেরই টেস্ট হয়েছে। মেলেনি। বৌদিরটাও শেষমেষ টেস্ট করিয়ে দেখা হয়েছিল। কারুর সঙ্গে ম্যাচ করেনি।

আমারটা এখনও টেস্ট করা হয়নি। ভয় করে, যদি না মেলে, তাহলে? দেখি ঝিমলির সঙ্গে একবার বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে হবে। যদি আমার সঙ্গে মেলে, তাহলে একবার শেষ চেষ্টা করা যাবে।

একরাশ চিন্তা নিয়ে আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে কখন গাড়ির কাছে এসে পড়েছি খেয়াল করিনি। সম্বিত ফিরতে দেখলাম বড়োমারা সকলে আমার আগে পৌঁছে গেছে।

মিত্রা কাছে এগিয়ে এলো। আমার দিকে তাকিয়ে কেমন থম মেরে গেল।

কিরে! ওইভাবে একা একা চলে এলি।

ওর মুখের দিকে তাকালাম।

সত্যি ওরা যে কি, আমি একটু স্বাধীনভাবে চলাফেরা পর্যন্ত করতে পারব না। পান থেকে চুন খসলেই প্রশ্নবানে জর্জরিত করে তুলবে। কি করে যে বোঝাই আমি ওদের মতো স্বাভাবিক নয়।

এমনি, চল এবার ফিরতে হবে, অনেক দেরি হয়ে গেল।

এগিয়ে এলাম। সকলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখের ভাষাই এখানে মুখের ভাষা।

গাড়ির আশেপাশে রতন ছাড়াও আরও চার-পাঁচজন ছেলে দাঁড়িয়ে।

চিনতে পারলাম না। তখন বিকাশ বলছিল গাড়ি পাহাড়া দেওয়ার জন্য লোক পৌঁছে যাবে।

রতন, বিকাশ এসেছিল?

না।

ছেলেগুলোর দিকে তাকালাম।

ভাই তোমদের কেউ একটু বিকাশকে ডেকে আনবে।

বিকাশদা বেচাদাকে বলেছে, আপনি বেচাদার কাছ থেকে শুনে নেবেন। একজন বললো।

আমি আর কথা বারালাম না। সামনের দরজা খুলে গাড়িতে উঠতে গেলাম।

তুই মাঝখানে বোস। বৌদির গুরু গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

কেন!

এমনি। আপত্তি আছে?

না। তোমরা কোথায় বসবে?

আমরা ঠিক বসে যাব।

দেখলাম সামনের সিটে দামিনীমাসি, জ্যেঠিমনি উঠে বসলো। মিত্রা তনু পেছনের দরজা খুলে উঠে বসলো। আমরা চারজনে গাদা-গাদি করে মাঝখানের সিটে বসলাম।

আমি জানলার ধারে। পাশে বৌদি বসেছে।

রতন গাড়ি স্টার্টদিল। কারুর মুখে কোনও কথা নেই। আমি জানলার ধারে বসে রাস্তা দেখছি। রাজারহাট বিডিও অফিস পেড়িয়ে আসার পর বড়োমাকে বললাম, আমাকে একটু জলের বোতলটা দাও।

সকাল থেকে কিছু খেলি না, এবার পিত্তি পড়বে। একটা মিষ্টি খেয়ে একটু জল খা।

জীবনে অনেক পিত্তি পড়েছে বুঝলে বড়োমা, এইটুকুতে এখন আর কিছু হবে না।

তবু বড়োমা একটা মিষ্টি হাতে দিল। খেয়ে জল খেলাম।

রতন তার মতো গাড়ি চালিয়ে চলেছে।

অনিদা।

বল।

যশোর রোড ধরি।

তাই ধর।

বৌদি মাঝে মাঝে আমার মুখের দিকে তাকায়। বুঝতে পারছি কিছু বলতে চাইছে।

সত্যিতো এতক্ষণ যা ঘটেছে তা অস্বাভাবিকতার চূড়ান্ত।

মনের মধ্যে লক্ষ লক্ষ প্রশ্নের অবতারণা হতেই পারে।

আমার হলেও তাই হতো। বৌদি খোঁচা মারলো। মুখের দিকে তাকালাম।

কিছু বলবে?

তুই রমাদিকে কবে থেকে চিনিস।

আমি বৌদির মুখর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার সামনের দিকে তাকালাম।

এই প্রশ্নের সম্মুখীন আমাকে একদিন হতেই হতো এটা আমি জানতাম।

একটু বড়ো হয়ে যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকে নিজের শেকড়ের খোঁজ করেছি। পাইনি।

কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। বুঝেও না বোঝার ভান করলাম।

কে রমাদি!

যার কাছে তুই আমাদের নিয়ে গেলি।

মাসিমার নাম রমাদি! জানতাম না।

জ্যেঠিমনি ঘার ঘুরিয়ে একবার পেছন দিকে তাকাল।

রমাদির রোগটা কি? সরি রমাদি না তোর মাসীমা।

বুঝতে পারছি পরিত্রাণ পাওয়ার কোনও উপায় নেই। শাঁড়াসি আক্রমণ চলবে যতক্ষণ না মনের মতো উত্তর দিতে পারব। মনে মনে যুদ্ধের রণকৌশল তৈরি করে নিলাম। না এতো তাড়াতাড়ি এদের বলা যাবে না। হিতে বিপরীত হতে পারে।

আমার সবচেয়ে অনুভূতি প্রবণ জায়গা।

কিরে চুপ করে রইলি।

শুনে কি করবে।

শুনি না।

ব্লাড ক্যানসার।

সবাই আমার দিকে কেমন চোখে যেন তাকাল।

বৌদির মুখের দিকে তাকালাম। আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

ছোটোমা, বড়োমাও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

সামন্তদার সঙ্গে আলোচনা করেছিলি? বৌদি বললো।

না।

কেন! বড়োমা বলে উঠলো।

এমনি।

তারমানে! বৌদি বলে উঠলো।

সকলের চোখে মুখে অবিশ্বাসের ছোঁয়া। তনু-মিত্রার মুখটা মাঝে মাঝে সামনের আয়নাতে ভেসে উঠছে। চোখ দিয়ে যেন এই টুকরো টুকরো কথা গিলছে।

মাসিমাকে ডাক্তারদাদা দেখেছে।

পরিচয় গোপন করে। বৌদি বললো।

তোর রেফারেন্স। ছোটোমা বললো।

হাসলাম।

হাসবি না। হেসে সব কিছু জয় করা যায় না। ছোটোমা বললো।

মাসিমা তোমাদের কিছু বলেছে।

সে কথা তোকে বলতে যাব কেন শুনি, বড়োমা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।

ডাক্তারদাকে আমার রেফারেন্সে দেখান হয়নি।

কেন?

সব কেনর উত্তর হয়।

সঠিক উত্তরটা কি, শুনতে চাইছি।

বৌদি ঝাঁজিয়ে উঠলো।

হুট করে বলা নেই কওয়া নেই এখানে আসার প্ল্যান ভাঁজলি। বুঝলাম ছোটোর একটা ইতিহাস তুই খুঁজে বার করেছিস। সেটার একটা রিজিন আছে। তোর এই কিওরিওসিটি চিরটা কালের। তোর দাদা আমার প্রেমের কাহিনী জোগাড় করেছিস। কলেজ লাইফে কোথায় কোথায় আড্ডা মারতে যেতাম। পুলিসের তাড়া খেয়ে কোন বাড়িতে কার কাছে মাসের পর মাস আত্মগোপন করেছিলাম সব তুই জোগাড় করেছিস। এ সব খবর আমার কাছে আছে। সকালে তুই কথায় কথায় বলে ফেলেছিলি, একজন রোগ শয্যায় শুয়ে আছে, তাকে তুই দেখতে আসতে পারছিস না। রমাদি কি সেই….।

এই মুহূর্তে নিজেকে বড়ো পলকা মনে হলো।

হ্যাঁ।

এতদিন রমাদির কথা জানতে পারিনি কেন?

তখন থেকে তুমি রমাদি রমাদি করে যাচ্ছ। মাসিমার নাম রমাদি, তুমি রমাদিকে চেন, মানে মাসিমাকেও তুমি চেন, কিভাবে চিনলে শুনি।

এ্যাটাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স। এই তত্ত্ব এবার খাটাবার চেষ্টা করলাম।

কেন তোকে বলতে যাব। তুই নিজেই বলিস, কিছু কথা গোপন রাখতে হয় বুঝলে বৌদি, নাহলে সংসারে দাম পাওয়া যায় না।

হাসলাম। তুমি যেভাবে রমাদিকে চেন, আমিও সেইভাবে মাসিমাকে চিনি।

এর বাইরেও আরও অনেক কিছু আছে।

আছে হয়তো।

হয়তো কেন?

বাবাঃ তুমি তো উকিলের জেরা শুরু করে দিলে।

হেসে বৌদির গলাটা জড়িয়ে ধরালাম।

এখন ছাড়, কথা শেষ হোক তারপর আদর দেখাবি।

কথা শেষ হবে না, চ্যালতেই রহেগা।

বৌদি, ফাঁদ পেতে কেটে পরার ধান্দা। মিত্রা পেছন থেকে ফুট কাটল।

আমি পেছন দিক ফিরে তাকালাম।

তখন মাসিমা ওকে একটা কি জিজ্ঞাসা করতে ও পেছন দিক ফিরে আমাদের দিকে কেমন করে তাকাল দেখেছিলে। তারপর মুখে কোনও উত্তর দেয়নি। মাসিমা কিন্তু হেসেছিল। মিত্রা বললো।

মনে থাকবে না আবার।

তোর চোখটা কি আতস কাঁচ। আমি বললাম।

মিত্রা মুখ টিপে হাসছে।

আমি সামনের দিকে তাকালাম। রতন কোথায় এলাম রে?

আর.জি.কর ছাড়লাম আর মিনিট তিনেক।

যাক।

বৌদি জাল ছিঁড়ে পালিয়ে গেল। তনু বললো।

যাবে কোথায় পুকুরের বাইরে তো আর যেতে পারবে না।

আমি সমুদ্রের।

খাওয়া-দাওয়াটা বেশ ভালো হলো, হৈ-হুল্লোড় যেমন হওয়ার তেমনই হলো কিন্তু তার মধ্যেই কেমন যেন একটা তাল কেটে যাওয়া ভাব। কেন জানিনা আজ আমি ঠিক ততটা স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারলাম না। আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলাম তালে তাল মেলাবার। ধরা যে পরি নি তা নয়, ধরা পড়েছি, আবার সামলেও নিয়েছি। একটাই রক্ষে আমরা আসার আগে অনিমেষদা, বিধানদা খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে গেছে কি একটা জরুরী মিটিং আছে তাই। কনিষ্করাও বেরিয়ে গেছে। মিলিরা অফিসে গেছে, কি সব জরুরী কাজ আছে।

ফিরে আসতে মল্লিকদা একটু মন খারাপ করেছিল, বুঝলাম ছোটোমা সব ব্যাপারটা বলেছে।

খেয়ে উঠে বড়োমাকে বললাম, তোমরা কি আজ ফিরছো?

না।

আমি একটু অফিসে যাব, অফিস থেকে ও বাড়িতে ফিরবো।

অফিসে যেতে পারিস কিন্তু এ বাড়িতে ফিরে আসবি।

কথাটা কানে বাজলো। বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম।

তাকিয়ে লাভ নেই।

কেন তোমরা আজ এ বাড়িতে থাকো, আমি ও বাড়ি পাহাড়া দিই।

ও বাড়ি পাহাড়া দেওয়ার লোক আছে।

বুঝলাম বেশি গেঁইগুই এখানে খাটবে না।

ঠিক আছে ফিরে আসবো, একটু রাত হলে মনে কিছু করো না।

রাত হবে কেন? যা কাজ ছিল কাল সেরে এসেছিস, তোর সঙ্গে রবীন যাচ্ছে, ওর সঙ্গে ফিরে আসবি।

বড়োমার মুখের দিকে তাকিয়ে আর কথা বলতে পারলাম না।

আজ বড়োমার চোখে মুখে কোথায় যেন একটা প্রবল অধিকার বোধের ছাপ অনুভব করছি। পুত্রের প্রতি মায়ের অধিকার।

বাইরে বেরিয়ে এলাম। সকলে বাগানে চেয়ার পেতে গোল হয়ে বসেছে। জোড় আড্ডা চলছে, মিত্রাকে দেখতে পেলাম না।

বাচ্চাগুলো মনের সুখে হুটো-পুটিতে ব্যস্ত।

ডাক্তারদাদা, দাদা, মল্লিকদা, আন্টি, নয়না একজায়গায় বসে কথা বলছে।

আমাকে বেরিয়ে আসতে দেখে, তনু চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো।

ইসি চেয়ারে বসেই চেঁচাল, বেরচ্ছিস নাকি?

ওর দিকে তাকিয়ে মাথা দোলালাম।

তনু কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

কোথায় যাবে?

একটু অফিসে যাব।

আজকে না গেলে নয়।

একটু ঘুরে আসি। তোমার মিত্রাদি কোথায়?

ওই তো কথা বলছে।

আমি পেছনে ঘুরে তাকালাম।

মিত্রা চলতে ফিরতে কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে।

মিত্রাদি। তনু চেঁচাল।

মিত্রা ঘুরে তাকিয়েই হাত দেখাল, তারপর ফোনটা কোনওপ্রকারে অফ করে হন্তদন্ত হয়ে কাছে ছুটে এলো।

কোথায় যাচ্ছিস!

একটু অফিসে যাব।

না। যাওয়া হবে না।

কেন!

তোকে নিয়ে আমি একটু বেরবো।

অফিসে কাজ আছে।

অরিত্ররা ঠিক সামলে নেবে। তোকে অতো কাগজ নিয়ে ভাবতে হবে না। তুই না গেলেও কাল ঠিক ঠাক কাগজ বেরবে।

মিত্রা, তনুর দিকে তাকাল।

তনু একটু দাঁড়া, আমি ওপর থেকে ঝপ করে ঘুরে আসছি।

যা পরে আছি তাই পরে গেলেই হবে, না চেঞ্জ করতে হবে। তনু বললো।

খারপটা কি পরে আছিস।

মিত্রা দাঁড়াল না। হন হন করে চলে গেল। তনুর মুখের দিকে তাকালাম।

কোথায় যাবে?

কি করে জানবো।

তনু ছুটকি দৌড়লো কেন রে? ইসি আবার চেঁচাল।

কি জানি, বললো কোথায় বেরবে।

তুমি একটা দাঁড়াও, আমি কয়েকটা ফোন করে আসি।

এখানে দাঁড়িয়ে করলে হবে না। আমি শুনবো না।

আমি তনুর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে বাগানের এ প্রান্তে চলে এলাম।

মিনিট পনেরো সময় নিলাম। সবাইকে ফোন করে লাস্ট আপডেট নিলাম।

ফিরে এলাম।

মিত্রা চলে এসেছে। হাতে একটা ফাইল।

এটা কিরে?

দেখতে পাচ্ছিস তো একটা ফাইল।

সে তো দেখতে পাচ্ছি।

চল।

কোথায় যাবি বল।

চোখ চলে গেল পোর্টিকোর দিকে।

দেখলাম বড়োমা, বৌদি, ছোটোমা, জ্যেঠিমনি আমদের দিকে তাকিয়ে আছে।

রবীন যে গাড়িটা চালায় সেটা সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। মিত্রার ইশারায় রবীন চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো।

তনু তুই সামনে বোস।

তনু মাথা দোলাল।

আমি মিত্রা পেছনে উঠে বসলাম।

এটা মিত্রার ব্যক্তিগত গাড়ি।

এই গাড়ি সচরাচর ও ছাড়া একমাত্র মল্লিকদা, দাদা চড়ে।

বড়োমারা সবাই ইসলামভাই-এর গাড়ি চড়ে।

ফিরে আসার পর ইসলামভাই-এর সঙ্গে দেখা হলেও খুব একটা কথা হয়নি।

রবীন গেটের বাইরে গাড়ি নিয়ে এলো।

ম্যাডাম কোথায় যাব?

সকালে আবিদকে তুমি যেখানে ছেড়ে এসেছো সেখানে নিয়ে চলো।

মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।

কাল রাতে তুই যে বললি….।

আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, কোনও কথা বললাম না।

আবিদ এখানে এসেছিল। আমরা ফিরে আসার কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে।

কেন যে আজ মরতে ওখানে গেলাম।

গেলি বলে তো অনক কিছু জানলাম।

আবার মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।

তাকাস না, তোকে দেখলে এখন গা-পিত্তি জ্বলে।

তনু সামনের সিট থেকে ফিক করে হেসে উঠলো।

তনু।

বলো।

ডলসহাউস থেকে দুটো পুতুল কিনে নে।

আমি পেছনে হেলান দিয় জনলার দিকে তাকিয়ে বসে আছি।

সবাই চুপ চাপ। রবীন ডলসহাউসের সামনে এসে দাঁড়ালো।

তনু নেমে গেল। মিত্রা মানি পার্টস থেক রবীনকে টাকা দিল মিষ্টি আনার জন্য।

আমরা দুজনে গাড়িতে বসে রইলাম।

মিত্রা ঘার ঘুড়িয়ে আমার দিকে কট কট করে তাকাল।

সব কিছু নিজের ভেতর রেখে দিয়ে গুমড়ে মরিস কেন। বললে তো কিছুটা হাল্কা হওয়া যায়। না সেখানেও ভাগ দিতে গিয়ে কিপ্টেমি করতে হবে। ওটা আমার, তোদের নয়।

আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।

সব কিছুতে তোকে ভীষণ তেল দিতে হয়। তেল দিতে দিতে আমার তেল সব শেষ।

আমি আবার জানলার দিকে মুখ ফেরালাম।

অনাদি, সাগরকে এ্যারেস্ট করা হয়েছে।

চকিতে মিত্রার দিকে তাকালাম।

কি বলতে চাইছে ও। এখন ও অনেক পাকা হয়েছে। আগের মতো সেই মিত্রা আর নেই। বুঝে শুনে প্রতিটা স্টেপ ফেলে।

কেয়েকটা ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছি, দারুণ সব স্টেপ নিয়েছে।

তখন ভেতরে গেলাম, বৌদি বললো, প্রবীরদা ফাইলে সই করেছে। অনিমেষদা, বিধানদা সেই জন্য তাড়াতাড়ি খেয়ে বেরিয়ে গেছিল। পার্টি মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।

আমি একটা কথারও প্রতি উত্তর দিলাম না।

এছাড়া আর অন্য কোনও গতি ছিল না। পার্টির অন্য মহল থেকে অনিমেষদা, বিধানদার ওপর খুব প্রেসার আসছিল।

তোর ফোন থেকে অনিমেষদাকে একটু ধরে দে।

আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না।

তনু দরজা খুলে ভেতরে এলো।

কিরে তুই এলি! রবীন কোথায়?

মিত্রা কথা বলছে ফোনের বোতাম টিপছে।

ওই মুখে গেছে মিষ্টি কিনতে।

আশে পাশে কোথাও মিষ্টির দোকান নেই?

কি জানি, বললো সামনের মিষ্টির দোকানটা বেশ ভালো।

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকাল।

এনগেজ টোন পাচ্ছি।

দেখি তনু কি আনলি।

তনু প্যাকেটটা মিত্রার হাতে দিল।

এর থেকে আর ছোটো পেলাম না। সঙ্গে একটা টেডিবিয়ার নিয়েছি।

তনু একটা ছোট্ট প্লাসটিকের প্যাকেট থেকে একটা মুখ থেবড়া কুকুরের বাচ্চা বার করলো।

কি কিউটরে তনু। আমারই তো চটকাতে ইচ্ছে করছে।

চোখদুটো দেখ কি প্রমিনেন্ট।

ভাল করেছিস। ছেলে আবার পুতুল খেলবে কি।

মিত্রা প্যাকেটটা খুলে ফেললো।

কি মিষ্টি দেখতে।

একটাই ছিল। ভদ্রলোক বললেন, এই কোয়ালিটির জিনিষ বড়ো একটা বিক্রি হয় না এই তল্লাটে, তাই রাখি না।

মিত্রা প্যাকেটটা মুড়ে তনুর হাতে দিল।

রবীন এসে পরেছে আবার গাড়ি চলতে শুরু করলো।

ম্যাডাম আবিদদাকে ফোন করে দিয়েছি। রবীন বললো।

ভালো করেছো।

রবীন কোন দিক দিয়ে যাবি?

তুমি বলো।

ওর ফ্ল্যাটটা কোথায়?

তুমি যাও নি!

গেলে তোকে জিজ্ঞাসা করতাম।

মমিনপুর ব্রিজে উঠতে বাঁদিকে।

পার্কস্ট্রিট ক্রসিং ছাড়িয়ে মিনিট পাঁচেকের জন্য গাড়িটা একটু রাখতে পারবি।

নো পার্কিং জোন।

তাহলে মির্জাগালিব স্ট্রীট হয়ে কিড স্ট্রীটে গাড়িটা ঢোকা। মিনিট পাঁচেকের জন্য গাড়িটা একটু পার্ক করবি আমি একটা কাজ সেরে নেব।

কোথায় যাবি! মিত্রা খ্যাঁক করে উঠলো।

আর্ট কলেজের সামনের ফুটপাথে যাব।

কেন?

তোরা বাচ্চাটার জন্য জিনিষ কিনলি, আমি একটা কিছু কিনি।

ফুটপাথে বিকোয় বুঝি।

আমার পছন্দের জিনিষ ফুটপাথে বিকোয়।

ঢং করিস না। কাকে দাঁড়াতে বলেছিস।

তুই নেমে আমার সঙ্গে যেতে পারিস।

গেলে কি লাভ হবে?

মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।

এই অভিজ্ঞতা আছে।

কথা বারালাম না। মাঝে মাঝে সত্যি কথা বললেও এরা বিশ্বাস করে না।

এমএলএ হোস্টেলটা ছাড়িয়ে এসে রবীন গাড়ি পার্ক করলো।

আমি দরজা খুলে নামলাম।

দেরি করিস না। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।

আমি একবার হেসে পেছন ফিরে তাকালাম, তারপর রাস্তা পার হয়ে ফুটপাথে উঠলাম।

এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম। না এপাশে ওপাশে কোনও চেনামুখ দেখতে পাচ্ছি না।

আর্ট কলেজের সামনে সেই ছেলেটি বসে।

কাগজের ফুলের ওপর কেন জানি না আমার চিরটাকালের দুর্বলতা। কাঠিদুটোকে মুড়িয়ে বলের মতো ফুলিয়ে যদি চোখের সামনে ঝুলিয়ে রাখা যায়, বাচ্চারা বেশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। মা-বাবার আলমাড়ি ঘাঁটতে গিয়ে চোরা কুঠরিতে এই রকম একটা ফুল পেয়েছিলাম।

কতদিন আগের কে জানে। হয়তো আমার বয়স তখন মাস দেড়েক অথবা ছয়েক।

হয়তো মা আমার চোখের সামনে সুতো দিয়ে ওই রঙীন কাগজের বলটা ঝুলিয়ে রাখতো। বড়ো হয়ে ভেবেছিলাম কোনও দিন আমার সন্তান হলে আমিও তার চোখের সামনে তার বাবার দেখা এই কাগজের ফুলের মতো বলটা ঝুলিয়ে রাখবো। এ জীবনে সে সাধ আর মিটল না। আমার সব কিছু কেমন যেন দুধের সাধ ঘোলে মেটান।

দোকানের সামনে এসে দাঁড়াত ছেলেটি মুখের দিকে তাকাল।

এতো আকিব নয়। আকিব গেল কোথায়! কথা বারালাম না।

ভাই কাগজের ফুল দাও তো।

ছেলেটি আমার মুখের দিকে তাকাল। ভাবছে ঢালাও এই খেলনার দোকনে কাগজের ফুল!

ওর মনের কথা বুঝতে পারলাম। আকিব কোথায়?

এবার ছেলেটি আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল।

আকিব কোথায়?

বাথরুমে গেছে, একটু দাঁড়ান।

জিএসআই-এর ভেতরে?

ছেলেটি কোনও কথা বললো না।

বাধ্য হয়ে কি করি সামনের একটা দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে ধরালাম।

অনবরতো কতো লোক হেঁটে চলে যাচ্ছে। কে বুঝবে এর মধ্যেই আইবি, এসবি-র কতো লোক ঘুরে বেরাচ্ছে। একটু চোখ মেলে তাকালে পরিষ্কার বোঝা যায়। এটাই ওদের পেশা। ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে খবরটা বার করে নিয়ে চলে আসো।

কিগো তুমি কখন এলে?

ফিরে তাকালাম, আকিব।

এই মিনিট পাঁচেক হবে।

খবর কি বলো?

ভালো। এই ছেলেটি কে?

কেন!

আমার সেই কাগজের ফুল চাইলাম, আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকায়ি থাকলো।

আকিব হাসালো।

আমার শালা, মিউজিয়ামের সামনে জল বিক্রী করে, এই সময়টা কেউ আর জল খায় না, তাই আমার দোকানে এসে বসে।

দে আমার ফুল দে।

কাকে দেবে?

এক জায়গায় যাব।

একটু অপেক্ষা করতে হবে।

কেন। কাছে নেই?

নিয়ে আসতে হবে।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করলে তোর বৌদিরা আবার খেপে যাবে।

বৌদিরা! কোথায়?

ক্রিক রোতে গাড়ি রেখে দাঁড় করিয়ে এসেছি।

তুমি যাও আমি যাচ্ছি।

তাড়াতাড়ি আয়।

যাও তুমি, মিনিট দশেকের মধ্যে যাচ্ছি।

আমি হাঁটা লাগালাম। আকিব জিএসআই এর ভেতরে চলে গেল। গাড়ির কাছে আসতে মিত্রা বললো, কিরে তোর জিনিষ কোথায়?

কাছে ছিল না আনতে গেল।

মিত্রা মুচকি হাসলো।

আবার যাবি।

না। দিয়ে যাবে বললো।

তনু কিছু বুঝছিস।

বুঝে কাজ নেই।

তোকে এশিয়াটিক সোসাইটির গল্পটা বলেছিলাম। তারপরেই প্রবীরদার কেশ।

তনু হাসছে।

দেখ আবার কপালে কি লেখা আছে।

খালি বক বক। একটু চুপ করে থাকতে পারিস না।

সারাজীবন চুপ করিয়ে রাখলি। বুড়ী বয়সে একটু নাই বকবক করলাম।

চুপ করে গেলাম। এদের সঙ্গে বকা মানে মাথা খারাপ হওয়া।

আইসক্রীম খাওয়াবি?

আমার পয়সা নেই।

রবীন খুব জোড় হেসে উঠলো। তনু, মিত্রাও হাসছে।

কবে ছিলো বলতে পারিস?

বাধ্য হয়ে পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বার করে রবীনকে বললাম, যা নিয়ে আয়।

রবীন নিজের সিটেই বসে ছিল। বেরিয়ে এলো।

ম্যাডাম কাপ নেব না বার নেব?

যা পারো নিয়ে এসো।

আমি গাড়িতে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়েছি। মিত্রা খোঁচা মারলো।

কি হলো।

ভেতরে এসে বোস।

না। জলের বোতলটা দে।

মিত্রা জলের বোতলটা দিল। ছিপি খুলে গলায় ঢাললাম।

মিনিট দশেক হয়ে গেল আকিব ব্যাটা এখনও এলো না। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। রাস্তার নিওন আলো জ্বলে গেছে। সামনের রাস্তাটা দিয়ে তীব্র হর্ণের শব্দ করে গাড়িগুলো হুস হুস করে বেরিয়ে যাচ্ছে।

কলকাতার অফিস পাড়া ছুটি হয়েছে। পার্কস্ট্রীটের অফিস পাড়া একটু পস এলাকা। ময়েগুলোও কম বয়সী। বেশ চকচকে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলে সময়টা বেশ কেটে যায়। বাড়ি থেকে অফিসে আসার সময় যেভাবে সাজুগুজু করে আসে ফেরার সময়ও তার ব্যতিক্রম হয় না। এতো মেইনটেইন করে কখন? কাজ কর্ম নেই!

মিলির ঘরে গেলে প্রায়ই দেখতাম ছোট্ট আয়নাটা সামনে রেখে টিসু পেপার দিয়ে গাল ঘসছে।

একদিনতো বলেই ফেললাম, ঠান্ডা ঘরে বসে তোমরা কি ঘেমে যাও ?

না।

তাহলে!

স্কিনটা পরিষ্কার রাখা দরকার তাহলে চট করে বুড়িয়ে যাব না।

এই নাও তোমার কাগজের ফুল। তোমার ডিমান্ড ফুল ফিল করা সত্যি টাফ।

ফিরে তাকালাম। আকিবের হাতে একটা খাম।

কেন এখন পাওয়া যায় না?

পাওয়া যাবে না কেন, কেনে কজন বলো। এগুলো বছর পাঁচেক আগে কিনেছিলাম। এখনও গোটা কুড়ি পরে রয়েছে।

কালকে আসবো সবকটা আমাকে দিস।

হবে না।

কেন!

আবার আমাকে সব নামাতে হবে।

সময় করে বার করে রাখিস এসে নিয়ে যাব।

আবার তোমার পরিচিত কারুর বাচ্চা হলে আসবে, এই তো।

আমাদের কথায় মিত্রা, তনু মুচকি মুচকি হাসছে।

এই যে তোর দুই বৌদি।

আকিব খামটা আমার হাতে দিয়ে হাত জোড় করলো।

ভাল করে দেখে নে, এই তল্লাটে প্রায়ই আসে।

আকিব হাসছে।

মিত্রাদের দিকে তাকালাম।

ফাইন আর্টসের সামনের ফুটপাথে ওর খেলনার দোকান। যাকে যেরকম পারে বধ করে। তিরিশ টাকার মাল তিনশো টাকা দাম চায়। তারপর নিগোসিয়েসন।

যাঃ তুমি না কি। এখন কি আর সেই দিন আছে। পাবলিক ভীষণ সির হয়ে গেছে।

কত পয়সা দেব?

তোমার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে আবার থানায় জমা পরবো নাকি?

পাগলামো করিস না।

কুড়িটাকা কেনা দাম, তুমি যা দেবে।

আমি পকেট থেকে একটা পঞ্চাশটাকার নোট বার করে আকিবের হাতে দিলাম।

ও পকেট থেকে একটা দশটাকার নোট আমার হাতে দিতে গেল।

এটা থাক তোর কাছে, আমাকে বাকি ফুলগুলো যখন দিবি, তখন এ্যাডজাস্ট করবি।

আমাদের কথা বলার মধ্যেই রবীন আইসক্রীমের কাপ নিয়ে এসে হাজির।

কটা নিয়ে এসেছিস রবীন?

চারটে।

একটা আকিবকে দে।

রবীন প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে হাত ঢোকাল।

তোমার ভাগেরটা নেব না।

আমি তোর বৌদিদের কাছ থেকে একটু একটু করে নিয়ে নেব।

আকিব আইসক্রীমের কাপ হাতে নিল।

যা এবার দোকানে যা।

আকিব আমার মুখের দিকে তাকাল।

আমার ফোন নম্বর তোর কাছে আছে।

যেট ছিল সেটা চলে না।

ওটাতেই করবি। না পেলে ম্যাসেজ করবি।

আচ্ছা।

নিজের নামটা লিখতে ভুলবি না।

আকিব হাসছে।

আমি গাড়ির দরজা খুললাম। আকিব রাস্তা পার হয়ে ফুটপাথে উঠলো।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/SJYOKqE
via BanglaChoti

Comments