❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৮৩ নং কিস্তি
—————————–
আমি হেসে ফেললাম। ছোটোমা, বড়োমা আন্টির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।
খুব জানার ইচ্ছে করছে?
বল না।
সংক্ষেপে বলা যাবে না। তোলা থাক, আর একদিন বলবো।
বল না, সোনা যখন বলছে।
জ্যেঠিমনির দিকে তাকালাম। জ্যেঠিমনি হাসছে, দামিনীমাসি বৌদিও বাদ নেই।
কেন তোমাকে তোমার অজু কিছু বলে নি। আন্টির দিকে তাকালাম।
জানলে তো বলবে।
তা ঠিক, রসিয়ে রসিয়ে বলে নি। কাঁঠাল খেল পেট ফুললো মরে গেল, তাই পছন্দ হয় নি।
আন্টি হাসছে।
আর একদিন বলবো। চলো এবার আর কষ্ট হবে না। আমরা নিচের দিকে নামবো।
এই তো একটুখানি। জ্যেঠিমনি বললো।
তাও তোমাদের মিনিট দশেক লাগবে।
সবাই নিচের দিকে নামা শুরু করলো।
জ্যেঠিমনি।
বল।
তোমার কখনও মনে হয়েছে, আমাদের দেশে এরকম একটা অজ গ্রাম আছে।
প্রথমে ঠিক বিশ্বাস হয় নি। তোর জ্যেঠুর সঙ্গে একবার কেদার-বদ্রী গেছিলাম সেখানে ঠাকুরকে পূজো দিয়েছিলাম শুকনো প্রসাদ কিনে।
ওই প্রথা এখনও আছে। কেননা অতো উঁচুতে ওসব ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। আমরা কিন্তু কলকাতা থেকে মাত্র দুশো কিলোমিটার দূরে আছি।
তা মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে আরও দূরে আছি। একবারে পৃথিবীরে শেষ প্রান্তে।
জ্যেঠিমনির কথা শুনে হাসলাম।
ধীরে ধীরে আমরা নেমে আসছি। যত নামছি মেলার হই হই শব্দটা যেন তত পরিষ্কার হচ্ছে। ইতি উতি আলো উঁকি ঝুঁকি মারছে। শ্যামের বাড়ির কাছে আসতেই দেখলাম, খাটিয়াতে ইসলামভাইরা বসে জিলিপি আলুর চপ খাচ্ছে। সঙ্গে মুড়ি।
আমাদের দেখে ইসলামভাই উঠে এলো।
এতক্ষণ কোথায় ছিলে? বড়োমার দিকে তাকাল।
সুখলালের বাড়ি থেকে আসছি। এতোটা পথ আসতে হবে তো।
ওরা উঠে দাঁড়িয়ে জায়গা করে দিয়েছে। বড়োমারা সকলে বসলো।
ভজু এসে তিনবার ঘুরে গেছে। অনুপদা বললো।
কেনো? ছোটোমা বললো।
বড়দির কাছ থেকে মনে হয় টাকা নিয়েছে জিলিপি খাওয়ার জন্য, কিছুতেই কিনতে পারছে না। তোমরা আসো নি বলে।
বড়োমা হাসলো।
সামিয়ানার তলায় নাচ চলছে।
মিত্রারা মনে হয় এই আলো আঁধারি অন্ধকারেও আমাদের দেখে ফেলেছে। উঠে এলো।
বাবাঃ ছেলেকে পেয়ে সব একবারে গিলে খেয়ে নিলে।
বড়োমা মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
তোরা সব মন্দিরের দিকে দৌড়লি তাই ওর সঙ্গে একটু গল্প করতে করতে এলাম।
মিত্র ছোটমার দিকে তাকিয়ে বললো, ভাগ দেবে।
ছোটোমা হাসছে।
চল পাঁপড়, জিলিপি খাওয়াবি চল। মিত্রা আমার দিকে তাকাল।
তোরা খাস নি!
তোর জন্য অপেক্ষা করছি।
তনু ছবি তোলা শেষ?
এক রাউন্ড হয়েছে। বাকিটা কাল সকাল থেকে শুরু করবো।
কামাই কিছু হবে।
হলেও ভাগ পাবে না।
অনুপদারা হেসে উঠলো।
ছেলেদের খোঁজ খবর রেখেছিস? মিত্রার দিকে তাকালাম।
মাঝে মাঝে হাই হ্যালো করছে তারপর আবার ফুরুত। কোথায় যাচ্ছে কি করছে জানি না।
কনিষ্করা কোথায়?
সব এইটুকু জায়গার মধ্যেই আছে।
খাওয়া দাওয়া করেছিস?
এক রাউন্ড করেছি।
চায়ের দোকান দেখলি?
কয়েকটা বসেছে। তাতে লোক জন নেই।
সবাই হাঁড়িয়া আর পচাই খাচ্ছে।
মিত্রা কল কল করে হেসে উঠলো।
ইসলামভাই।
এখানে তোর সঙ্গে কোনও কথা বলবো না। কলকাতায় ফিরি তখন কথা বলবো।
মেয়ের সঙ্গে কথা বললে?
সকালে একবার বলেছিলাম।
নাতনির সঙ্গে?
বললো তোমার বুদ্ধি-শুদ্ধি সব ঝামা হয়ে গেছে।
কি রোয়াব দেখছো।
সব তোর জন্য।
আরে ধরো ধরো একবারে কড়া থেকে তুলে আনলাম।
ঘুরে তাকালাম।
ভজুর হাতে একটা বিশাল শালপাতার ঠোঙা। বড়োমার সামনে তুলে ধরেছে।
প্রায় তিরিশ চল্লিশটা জিলিপি হবে।
বড়োমা একটা তুলে নিলো।
ভজু এবার সবার কাছে গিয়ে ঠোঙা এগিয়ে দিচ্ছে। সবাই তুলে নিলো।
আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
একটা তুলে নিলাম।
তুই খেয়েছিস?
দশ টাকার নিলাম। দুটো ফাউ দিল, ওইটা খেলাম।
দামিনীমাসি মুখ ঘুরিয়ে হাসছে।
তুই সবচেয়ে বেশি পয়সার জিলিপি কিনলি।
না আর একজন কিনেছে।
কে।
ঘণ্টা। আমার মতো দুই ঠোঙা। মাঠে বসে জিলিপি মুড়ি খাচ্ছে।
তুই ভাগ নিস নি?
আমাকে বললো ভজুমামা একটু নিয়ে যা। দুমুঠো খেলাম।
চায়ের দোকান দেখলি?
বলে আসবো, বললেই এসে দিয়ে যাবে।
তাই!
চা বিক্রি হচ্ছে না।
কেন।
হাঁড়িয়া, পচাই, মহুয়া বিক্রি করছে।
হাসলাম। নাম জেনে ফেলেছিস?
ভজু মাথা দোলাচ্ছে।
চেখেছিস নাকি?
তুমি বারন করেছো।
যা বলে আয়।
দাঁড়াও হাতটা চেটে নিই, রস লেগে আছে। বড়োমার কাছে ঠোঙাটা নিয়ে ছুটে গেল।
আর একটা নাও।
বড়োমারা হাসছে। ওরা মনে হয় একটা করে জিলিপি নিলো।
ভজু ঠোঙাটা নিয়ে, হাত চাটতে চাটতে চলে গেল।
তোর সঙ্গে তো ও বেশ ভালো কথা বলে। আমরা দশটা কথা বললে, একটা কথার উত্তর দেয়। আর তুই টুক টুক করে বলছিস, আর ও ধরে ফেলছে। অনুপদা বলে উঠলো।
হবে না কন, ও যে ওর জন্য হাসপাতালে ওর পাশের বিছানায় শুয়ে দিনের পর দিন রাত জেগেছে।
হতচকিত সবাই দামিনীমাসির মুখের দিকে তাকাল। মাসি মাথা নিচু করে নিলো।
তখন ওর ম্যারেনজাইটিস হয়েছিল। গলাটা ভার ভার।
মরেই যেত। ওর জন্য বেঁচে গেল। তারপর থেকেই মাথাটা কেমন হয়েগেল। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। সামন্তদাকেও তখন একবার দেখিয়েছিলাম। বলেছিল সারাজীবন ওষুধ খেতে হবে।
এই আবার শুরু করে দিলে। মাসির মুখের দিকে তাকালাম।
মাসি আমার মুখের দিকে তাকাল। চোখটা ছল ছল করছে।
তখন কনিষ্করা ছিল না? বড়োমা বললো।
ছিল হয়তো, আমাকে তো কোনও দিন কিছু বলে নি। আরজিকর-এ ভর্তি করেছিলাম।
না-গো সব গল্প। অনুপদার দিকে তাকালাম। কথা ঘোরালাম।
শ্যামের সঙ্গে কথা বললে।
অনুপদা হেসে ফেললো।
সেরকম কিছু নয়, একটুখানি বসেছিলাম।
মিত্রা-তনু দু-জনেই ছোটোমার ঘারে নিঃশ্বাস ফেলছে।
তোমাদের খিদে লাগছে না।
এইতো মুরি, আলুরচপ, জিলিপি খেলাম, তার আগে রতন কোথা থেকে ডিম সেদ্ধ নিয়ে এলো।
অনুপদা মুচকি মুচকি হাসে আর বলে। ইকবালভাই, ইসলামভাই-এর চোখ আমার মুখের ওপর।
বাড়ির ভেতর থেকে ময়না এসে সামনে দাঁড়ালো।
চা খাবে?
ভজুকে আনতে পাঠিয়েছি।
কেনে, আমান্যে করতি পারতিনি?
হাসলাম। একটু মেলা থেকে কিনে খেতে ইচ্ছে করছে। রাতে কি করছিস।
উ তুর নাম কইরে বলি চড়্যায়ছিল সেউ রান্না করতিছি, মেলা নু ডিম কিনছে ….।
বুঝে গেছি।
ময়না হাসছে।
দারু কোথায়?
সে পাশে কান্যে আসছে কথা কইছে।
তোর ছেলে দুটোকে দেখালি না।
কদবার তুর পাশ নু চইলালো তুই দেখিস লাই!
তুই চিনিয়ে দিয়েছিস?
কাল দেখাইবো।
ওখানে চলে গেছে।
ময়না খিল খিল করে হসে উঠলো।
চূড়া কই?
রান্না করেঠে।
যা তাড়াতাড়ি কর বড়োমাদের খাইয়ে শুইয়ে দে। সকাল থেকে অনেক ধকল গেছে।
হঠাৎ চম্পা আর তিন-চারটে মেয়ে দৌড়ে এসে তনু-মিত্রাকে জড়িয়ে ধরল। টানতে টানতে একটু দূরে নিয়ে গেল। কি বলছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে খুব জেদা-জিদি করছে। ময়না এগিয়ে গেল। কি কথা বললো কি জানি সবাই হাসছে।
ভজু সেই চায়ের ছেলেটাকে ধরে এনেছে। হাতে একটা মগ।
ভজুর হাতে অনেকগুলো মাটির ভাঁড়।
বড়োমা গরম গরম চা। এখানে কাপ নেই মাটির ভাঁড়।
বড়োমা ভুজর দিকে তাকিয়ে।
ভজু সকলকে মাটির ভাঁড় ধরিয়ে দিল, তারপর নিজেই ছেলেটার হাত থেকে চায়ের মগটা নিয়ে প্রত্যেককে ঢেলে দিল।
মিত্রা কাকে ফোন করছে।
ভজু গিয়ে মিত্রাদের হাতেও একটা করে মাটির ভাঁড় ধরিয়ে দিয়ে চা দিল।
পরিবেশটা এখনও গুমোট, কোথায় যেন একটু তাল কেটে গেছে। ভজু স্বাভাবিক।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দেখলাম মিলিরা, কনিষ্করা, শুভরা সকলে হই হই করে চলে এলো।
আমাদের হাতে চায়ের ভাঁড় দেখেই নীরু চেঁচিয়ে উঠলো, ভজু আমাদের।
শেষ হয়ে গেছে দাঁড়াও বানিয়ে আনি।
নীরু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো এই ব্যাটা তোর দোকান কোথায়?
সেউ পাশে।
যা এখানে তুলে নিয়ে আয়। আমরা যতক্ষণ থাকবো চা বানিয়ে যাবি। আর কি আছে?
বিস্কুট আছে, লাড়ু আছে।
নিমেষের মধ্যে পরিবেশটা একবারে ওলট-পালট হয়ে গেল।
সবে মাত্র ভাঁড়ে একটা চুমুক মেরেছিলাম। নীরু এসে হাত থেকে ভাঁড়টা নিয়ে নিলো।
বটা পাশে দাঁড়িয়ে।
চুমুক মারবি, ভাঁড় সমেত মুখে ঢুকিয়ে দেব।
বড়োমা এই অত্যাচার সেই কলকাতা থেকে শুরু হয়েছে। এর একটা বিহিত করো।
বড়োমা মুচকি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নীরু আমার দিকে তাকাল।
তোর জন্য ও ভাল করে বানাবে, তখন খাস।
বটার দিকে তাকাল।
দু-চুমুক, তারপর তোকে ভাগ দেব। অনির কথা, দিয়ে খা একা খাস নি।
ইসলামভাই হাসতে গিয়ে বিষম খেল।
বড়োমা চেঁচিয়ে উঠলো। আ মলো যা।
কে কার কথা শোনে।
তনু দেখলাম দৌড়ে শ্যামেদের বাড়ির ভেতর চলে গেল।
চম্পা চম্পার বন্ধুরা নাচতে শুরু করে দিল। একটা হই হই।
তনু ভেতর থেকে ক্যামেরার ব্যাগ নিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল।
এটা কি হবে!
নাচবো।
নাচবো মানে!
আমরা নাচবো।
ম্যাডাম তোমার কোমর ধরে আমি, শ্রীপর্ণার কোমর ধরে অনি।
নীরুর কথায় অনুপদা খুব জোর হেসে উঠলো।
অনি বলেছে ভাগ করে খেতে, তাই নারে নীরু। বটা বললো।
তনু মুচকি মুচকি হাসছে।
একটা ছেলে দেখলাম সামিয়ানার তলা থেক একটা হ্যাচাক খুলে নিয়ে চলে এসে একটা বাঁশের সঙ্গে বেঁধে দিল। আধা-অন্ধকার জায়গাটা বেশ খানিকটা আলো হয়ে গেল।
চায়ের ছেলেটা তার বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে চলে এসেছে। একটা স্টোভও আছে দেখলাম।
নীরু ওদিকে ছুটলো।
আমি ছোটোমা, বড়োমার মাঝখানে গিয়ে নিজের শরীরটাকে গুঁজে দিলাম।
ওরা হাসছে।
তুই নাচবি না। কনিষ্ক বললো।
মাথা দোলালাম, না।
ছোটোমার মুখের দিকে তাকালাম। আস্তে করে শরীরটাকে হেলিয়ে বললাম।
খাবে নাকি?
কি?
মহুয়া।
ছোটোমা মুখ টিপে হাসলো। চোখ দিয়ে ইশারা করে বললো, দিদিকে বল।
আমার কীর্তিটা মিত্রা দেখে ফেলেছে।
আমি বড়োমার দিকে আস্তে করে হেলে বললাম, মহুয়া খাবে নাকি?
বড়োমা হেসে ফেললো।
সবাই খাচ্ছে, খুব ইচ্ছে করছে।
খেলে নাচতে হবে।
নাচবো।
ভাঁড়ে করে খেতে হবে।
তাই খাব।
জ্যেঠিমনি পাশে বসেছিল শুনতে পেয়ে গেছে, হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
বুবুন খুব খারাপ হয়ে যাবে তুই কিছু একটা ফন্দি আঁটছিস। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।
পায়ে পায়ে কাছে এগিয়ে এলো।
আমি উঠে দাঁড়ালাম, দাঁড়াও আমি আসছি।
মিত্রা এগিয়ে এসে আমার গেঞ্জি টেনে ধরেছে। চোখে অনেক প্রশ্ন।
কোথায় যাবি?
এখুনি আসছি।
ছোটোমা ওখান থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো, তুই ভাগ পাবি।
এইবার জ্যেঠিমনি বেশ জোরেই হাসলো।
চায়ের ছেলেটাকে নীরুরা এমন ব্যতিব্যস্ত করতে শুরু করেছে সে বেচারা ভড়কে গেছে।
অনুপদা, ইসলামভাই উঠে গেল।
ভেতরে এসে দেখলাম বিরাট একটা কড়াইতে শ্যাম মাংস রান্না করতে বসিয়েছে। নিজেই বানাচ্ছে। আমাকে দেখে হেসে ফেললো।
চূড়া, দারু পাশেই আছে।
তুই এঠি কি করতে আইলু।
কেন আসতে নেই?
আমি সেউ কথা কইছি।
তাহলে।
ময়না আইসা কইলো চা-র জন্য লোক ডাইকে লিয়ে আসছু।
আমি নিয়ে আসি নি। নীরুরা নিয়ে এসেছে।
আমি কাছে গিয়ে শ্যামকে সব বললাম।
শ্যাম খুন্তি ছেড়ে হাসতে শুরু করলো। দারুও হাসে। চূড়াও হাসে।
শিবু কোথায়?
সে মেলা সামলায়তিছে।
জোগাড় কর।
এতো জনকার হবেক লাই। ঘরে যে টুক আছে মোনকার হয়ে যাবেক।
শ্যাম দারুর দিকে তাকাল।
মোর ঘরেরটা বড় কড়া।
মিশিয়ে দে।
খারাপ হয়াবে।
তাহলে কড়াটা ইসলামভাইরা, রতনরা খাবে। নরমটা বড়োমারা খাবে।
লেসা হয়াবে।
বিছানা করে রাখ মহুয়া খেয়ে নাচন-কোদন করে খেয়েদেয়ে শুয়ে পরবে।
ভাত অখনো বাসায় লাই তাইলে রুটি বনাই।
কেন, মেলায় কিনতে পাওয়া যাবে না?
ভাল হবে নি।
বলে আয় আমাদের জন্য ভাল করে বানিয়ে দেবে। যতো নষ্টের গোরা তোর মেয়ে। মিত্রাকে নাচাল ওরা নেচে উঠলো। ময়না তালে তাল দিল।
দারু তুই শিবুকে একবার ডাইক। শ্যাম বললো।
দারু হেসেই যায়, বড়োমা লাচবে কইছে।
সবাই নাচবে।
তুই যা, মাংসটা টুকু বাকি আছে সাইরে লিয়ে যাইঠি। শ্যাম হাসি না থামিয়েই বললো।
দেরি করিস না।
আমি বাইরে চলে এলাম। দেখলাম রতনরা চলে এসেছে।
আমাকে দেখেই রতন ছুটে এসে কোলে তুলে নিলো।
এই দ্যাখ দ্যাখ পড়ে যাবো।
দারুণ লাগছে বুঝলে অনিদা। চাঁদ, চিনা চলে এসেছে।
রতন আমাকে নিচে নামাল।
আবিদ এখুনি ফোন করেছিল। ছেলে হয়েছে। সিজার। ঝিমলিদি অপারেশন করেছে।
তাই! খুব ভাল খবর দিলি। ও যাওয়ার আগে হয়েছে না পরে।
বিকেলের দিকে হঠাৎ শরীরটা গণ্ডগোল করে, আবিদ সোজা নার্সিং হোমে নিয়ে চলে এসেছিল। নীরুদা ঝমলিদিকে সব বলে এসেছিল, ঝিমলিদি আর রিক্স নেয় নি।
কিরে ব্যাটা আগে আগে হলো নাকি।
এখনও তিন সপ্তাহ মতো বাকি ছিল।
তাহলে ঠিক আছে। আয়েষা বাচ্চা দু-জনে ঠিক আছে?
হ্যাঁ দু-জনেই ঠিক আছে। আবিদ দেখেছে।
নীরু কথা বলেছে?
হ্যাঁ।
ইসলামভাই কোথায়?
বাচ্চাটার জন্য বাঘ নখ না কি কিনতে গেল।
আমি হাসলাম।
চাঁদ কি বলছে শোনো।
চাঁদ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আজ একটু পার্মিসন দাও। কোনও দিন এসব খাইনি। লোভ হচ্ছে।
শ্যাম মাংস বানাচ্ছে, শেষ হয়ে এসেছে। তারপর নিয়ে আসছে। খেয়ে উল্লু বনতে পারবি না।
চাঁদ হই হই করে চেঁচিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরলো।
তুমি বিশ্বাস করো একটু টেস্ট করবো।
আমি জানি তোদের টেস্ট। ছাড়, আদরের ঠেলায় আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা।
চারদিকটা ঘুরে দেখলি।
দারুণ লাগছে, যেদিকে তাকাই সেদিকটাই ভালো লাগছে। তুমি তখন কি সুন্দর নাচলে।
হাসলাম।
ওদিকে ঘণ্টা-পক্কে মাদল কাঁধে তুলে বাজাবার চেষ্টা করছে। সুন্দররাও লেগে পড়েছে। মাদল ধামসার ভৌত-বিজ্ঞান, জীবন-বিজ্ঞান উদ্ধার করতে শুরু করে দিয়েছে।
আমি বড়োমাদের কাছে এলাম। জমিয়ে সবাই গল্পে মত্ত।
কিরে কখন শুরু করবি? ছোটোমা বললো।
মাংসটা শেষ হয়ে এসেছে। রুটি দিয়ে মাংস আর মহুয়া। রাতে আর খাবার দরকার নেই, শুধু জামাকাপড় খুলে শুয়ে পরলেই হলো।
একটু জিলপির কথা বল।
দাঁড়াও ভজুকে বলি ওই ব্যাটাকে ধরে আনতে।
দামিনীমাসি, আন্টি হেসে গড়িয়ে পরে।
আর কাউকে জানিয়েছ নাকি? বড়োমার দিকে তাকালাম।
মিত্রাটা মহা নম্বরি। তোর পেছন পেছন ভেতরে গেল। এসে সকলকে বললো। বড়োমা বললো।
দাদার পার্মিসন নিয়েছ?
আজ খেয়ে নিই, কাল বলবো। নাহলে এখুনি ছেঁচকিয়ে উঠবে, ফুর্তি হচ্ছে ওখানে, ফুর্তি।
ছোটোমা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসছে।
আমি ওইখানে দাঁড়িয়েই ভজু বলে চেঁচিয়ে উঠলাম।
ভজু নাচের ওখানে ছিল কাছে এগিয়ে এলো।
বলো।
জিলিপি কোথা থেকে কিনলি।
ধরে নিয়ে আসবো।
বড়োমারা সকলে জোড়ে হেসে উঠলো।
যা ধরে নিয়ে আয়।
ভজু ছুট মারলো।
চোখ চলেগেল সামিয়ানার তলায়। সুন্দর মাদলের তালে শরীর দুলিয়ে নাচছে। আদৌ সাঁওতালী নাচ নাচছে, না অন্য কিছু বোঝা মুস্কিল। সবাই কিছু একটা করছে।
নীরুরা এবার আমাকে দেখতে পেয়ে গেছে।
তেড়ে-ফুঁড়ে কাছে এসে বললো। কিরে তুই যে কি সব খাবার এ্যারেঞ্জমেন্ট করতে গেছিলি কি হলো।
কেন মাঠে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমরা একটু চেখেছি।
ছোটোমা হাসছে।
তখন আমার চা-টা খেয়ে নিলি। একটু নিয়ে আয়।
একটা ডিম সেদ্ধ?
ওটা আবার কোথায় পেলি!
আমরা নিজেরা এখানে মেলা বসিয়ে নিয়েছি।
তার মানে!
দোকান শুদ্ধু কিনে নিয়েছি।
আমি এবার না হেসে থকতে পারলাম না।
দাঁড়া চা আনছি। নীরু চলে গেল।
মিলিরা দেখলাম চম্পার কোমর ধরে নাচের মহড়া দিচ্ছে। সুন্দররা মনে হয় পেছনে লাগছে।
শ্যাম ভেতর থেকে বাইরে এসে বড়োমার পায়ের কাছে বসলো। শুধু হেসে যায়।
সত্যি তুমি খাব?
কেন।
বড্ড কড়া তাকে নরম করা যাবে নি।
কম করে খাব।
মাংস বনাইছি লেই আসি।
নিয়ে আয়।
কিরে শ্যাম শুধু মাংস। অনুপদা পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো।
রুটি বনাইছি।
দেরি করিস না।
শুরু হয়ে গেল আর এক উৎসব। কাঁচা শালপাতার বাটিতে মাংস-রুটি, ভাঁড়ে করে মহুয়া। কেউ তখন আর খাটিয়াতে নেই সব যে যার মাটিতে বসে পড়েছে।
অনিদা এর সঙ্গে গরম জিলিপি হলে ভাল হতো না। ভজু চেঁচিয়ে উঠলো।
এই শিবু জিলাপি ওলাকে ধরে নিয়ে আয়। নীরু চেঁচিয়ে উঠলো।
তুমি পয়সা দেবে। ভজু নীরুর দিকে তাকাল।
কেন তোমার অনিদা দেবে। নীরু ভেঙচি কেটে উঠলো।
ইসলামভাই আর হাসি চাপতে পারল না।
ব্যাটা ভজুও আজকাল বুঝে গেছে তুই কি মাল। কনিষ্ক বলে উঠলো।
গুরুটা কে দেখবি তো।
পেছন দিকটা একবার দেখ। বটা বললো।
নীরু পেছন দিকে তাকিয়ে দেখলো, জিলিপি ওলা বসে বসে জিলিপি ভাজছে।
ওটা কখন এলো!
ভজুই নিয়ে এসেছে।
ওরে ব্যাটা তুইও দেখছি আজকাল রংফাটসে ডায়লগ দিচ্ছিস।
কেউ আর গম্ভীর নেই।
তবে যাই বলো নীরু, মাংস দিয়ে এই সোমরস কিন্তু দারুণ লাগছে। বরুণদা বলে উঠলো।
সে যাই হোক বেশি নয়, তাহলে ক্যামেরা চলতে শুরু করবে।
তনু, নীরুর দিকে তাকাল।
তোমাকে বলি নি।
কচকচানি চলছে।
আমি প্রথমে এক ফোঁটাও ছুঁইনি। একটা রুটি আর দু-টুকরো মাংস খেয়েছি।
দারু মাংসটা বেশ ঝাল ঝাল করেছে। মহুয়ার সঙ্গে খাওয়ার জন্য বেশ ভাল। এরপর জিলিপি, ডিম, পাঁপড়, চা।
খাটিয়া থেকে উঠে পায়ে পায়ে মিত্রা-তনুর কাছে গেলাম। পাশে বসে আস্তে করে কানে কানে বললাম। বেশি খাসনি। রাতে একটা জায়গায় যাব।
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকাল। তনু, মিত্রাকে ইশারা করছে। মিত্রা বললো, পরে বলছি।
আমি দু-জনের পাত থেকেই একটু রুটি ছিঁড়ে খেলাম।
এক রাউন্ড খাওয়ার পরেই নাচ শুরু হয়ে গেল।
কেউ বাদ গেল না।
হাসা-হাসি, ঢলা-ঢলি মাদল ধামসার শব্দে চারদিক ম ম করে উঠলো।
মনের খুশিতে যে যার নাচে।
তনু খুশি মতো ছবি তুললো।
মরে আসা মেলার সামান্য যে টুকু ভিড় অবশিষ্ট ছিল, এবার আমাদের দিকে ঢলে পড়েছে।
আমি একবার গিয়ে মিত্রা-তনুর কোমর ধরে নেচে এসেছি।
শ্যামেরাও নাচলো, চূড়া, ময়নার কোমর ধরে।
খাওয়া-দাওয়া নাচ।
আসন পেতে পরিপাটি করে আর খাওয়া হলো না। সবাই ওখানে খোলা আকাশের তলায় বন ভোজনের মেজাজে খেলো আর নাচলো। প্রায় দু-ঘণ্টা।
শেষে আমি বললাম, এবার থামা আর না।
কে কার কথা শোনে।
বড়োমা এসে খাটিয়াতে আমার পাশে বসলো। চোখ চক চক করছে।
আমি বড়োমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। তখনও ছোটোমা, বৌদি, মিত্রার কোমর জড়িয়ে ধরে শরীর দুলিয়ে চলেছে, উচ্চারণ করতে পারুক আর না পারুক উঁ উঁ করে সুর ভাঁজছে।
অনি আমি এখানে খোলা আকাশের তলায় খাটিয়াতে শোবো। বরুণদা চেঁচিয়ে উঠলো।
তালে তাল মেলালো নীরু, অনিকেত।
কনিষ্কর দিকে তাকালাম।
আমার নেশা হয় নি।
হেসে ফেললাম।
শ্যামের দিকে তাকালাম।
হাসছে।
উ দিকে তাকা।
পেছন ফিরে দেখলাম ইসলামভাই একটা খাটে টান টান হয়ে শুয়ে পড়েছে। অনুপদার অবস্থাও একইরকম। রতনরা সবাই মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছে।
বুঝতে পারলাম এদের এখান থেকে আর নড়ানো যাবে না।
তুকে ত্যাখন কইলি। শ্যাম বললো।
বড়োমার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
কি-গো শরীর খারাপ লাগছে?
হাসলো।
মাথাটা বেশ ঝিম ঝিম করছে।
কেমন মনে হচ্ছে।
এখন ঐ পাহাড়টাতে একা একা উঠতে পারবো।
এই বুবুন আয় নাচি। গলার স্বরটা অপরিচিত ঠেকলো, চমকে তাকালাম।
দেখলাম মিলি কোমর দুলিয়ে নাচতে নাচতে আমাকে ডাকছে।
ওর অবস্থা দেখে হেসে ফেললাম।
মিত্রা, তনু হেসে নিজেদের গায়ে ঢলে পরে।
শ্যামের দিকে তাকালাম। হাসছে।
মিলিদির লাগিইছে।
ভেতরে বিছানা করে ফেলেছিস।
সব সাইরে এউঠি আসছি।
খাবার-দাবার।
কিছু লাই।
সব শেষ!
ওন্যে কি হুসে খাছে।
তোরা খেয়েছিস?
হ।
সবাই, না কেউ বাকি আছে?
তুই বাকি আছু।
আমি দুটো রুটি খেয়েছি। চূড়া কই?
তার লেশা লাগিইছে।
এ্যাঁ।
হ।
ময়না?
ঘরকে গেছে, কইলো শরীলটা আনচান করেঠে।
শ্যাম আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কিছু বলবি।
বড়োমা এউঠি বইসুক তুই ইদিকে আয়।
আমি উঠে সামনেই দাঁড়ালাম।
তোর জন্যি আজ আনন্দ করলি।
কেন আগে করতিস না।
ছেলে-মেয়ে হওয়ানু সব বন্ধ করি দিছিলি, ময়না, চূড়া তুর সইঙ্গে লাচার পর ঘরকে গিয়ে কাঁদতিছিল। কইলো অনিদা অখনো সেউ রকম আইছে। মনকাকে দেইখে জইরে ধরলো।
বউমনিরা মনকাকে দেখতিছিল। মন্যে তো আগে দেখি লাই। কি সন্দোর।
শিবুর বউ ছেলেকে সকাল থেকে দেখলাম না। কথা ঘোরালাম।
শ্যাম মাথা নিচু করে নিলো।
তুকে তো সব কথা কই লাই। ঘর সুংসারের কথা কি কইবো।
কেন!
শিবুর বউটা ছেলে বিয়াইতে গিয়ে মরি ইছে।
এ্যাঁ! কবে!
সে তুই য্যাখন মরিইছিলু।
তোরা আমাক এতদিন খবরটা দিস নি! তারপর নিশ্চই আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
কি কইবো তুকে, শিবুর বউ মরিইছে।
ছেলেটা?
চম্পার থেইকে কয় মাসের বড়ো। চূড়া-ময়নার কাছে মানুষ হছে।
শিবুকে বিয়ে দিসনি কেন?
কইরতে চায় নি।
সুখলালা কাকা?
বহুবার কইছে মানে লাই।
চুপ করে গেলাম।
তুর একটা অনমতি চাই।
কি!
চূড়া, চম্পার সঙ্গি শিবুর ছেলেটার বে দিবে ঠিক করছে।
খুব ভালো কথা। চম্পাকে জিজ্ঞাসা করেছিস ওর পছন্দ কিনা। তোদের মধ্যে তো এসব ব্যাপার আছে। দু-জনের পছন্দ হওয়া চাই। ঘাটুলে যেতে হবে। তারপর সুখলাল কাকার অনুমতি।
সবারে মানাইছি, কাকারে মানাইতে পারতিছিনি।
কেন তোদের সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনও সমস্যা।
হ।
গোত্র এক হয়ে গেছে।
হ।
চম্পা কই।
সটকি ইছে।
ওখানে গেছে।
শ্যাম হাসছে।
ঠিক আছে আগে এগুলোকে ব্যবস্থা করি, তারপর দেখছি।
তুই লিয়ে আয়, আমি ভিতরকার ঘরে সব ব্যবস্থা করছি।
দারু কোথায়?
তোর ছেইলে গুলাকে সামলায়ঠে।
বেশি খেয়ে ফেলেছে?
একটু খাইছে।
বড়োমার কাছে এসে দাঁড়ালাম। পেছনে হাত দুটো দিয়ে ঢলে পরেছে। চোখ ঢুলু ঢুলু।
জ্যেঠিমনি, আন্টি, দামিনীমাসি খাটে বসে। একই অবস্থা।
সবাইকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শোয়ালাম। তনু, মিত্রা সাহায্য করলো।
মিলি-সুরো-টিনা-অদিতিরা প্রথমে একটু চেল্লাচিল্লি শুরু করেছিল, ধমক লাগাতে দেখলাম কেমন থমকে গেল।
শুর শুর করে চলে এলো।
বেশ টলছে। সেবারের থেকে বেশিই খেয়েছে। না হলে শ্যামের কথাই ঠিক। বড্ড কড়া।
অংশু-সুবীরকে দেখতে পাচ্ছি না।
কনিষ্কদের খাটিয়া থেকে ওঠার আর শক্তি নেই।
যাওয়া আসার ফাঁকেই তনুকে বললাম, ঠিক আছো তো?
এক ফোঁটা খাইনি শুধু ঠোঁটে ছুঁইয়েছি।
একটু চেখে দেখতে পারতে?
সেটুকু করেছি।
টেস্ট কেমন?
মিষ্টি। কেমন একটা ঝাঁজ।
বাকিটা ফেলে দিলে!
না। আমি, দিদি হাফ হাফ। দিদি ইসিদিকে বাকিটা দিয়েছে।
ইসি খুব খেয়েছে?
হ্যাঁ। তনু হাসছে।
শুধু দুটো বড়ো টর্চ সঙ্গে নেবে।
তনু আমার মুখের দিকে তাকাল।
এই কাপর পরে যাব।
এখানে আর কে দেখবে। যাও দিদিকে ডেকে আনো।
শালোয়ার পড়ি।
আচ্ছা পরে এসো।
তনু ভেতরে চলে গেলো।
সব যে যার খাটিয়াতে শরীর ছেড়ে দিয়েছে।
রতনরা মাটিতে হাত পা ছড়িয়ে রয়েছে। ডাকলাম। কোনও সারা শব্দ নেই।
শিবুকে বললাম কিরে এদের কি করবি?
নিচে শুলি ঠাণ্ডা লাগি যাবে।
যা খাটিয়া নিয়ে আয়। ঠ্যাং ধরে তিনজনকে তুলে দিই।
বেদম খাইছে।
দিয়েছিস কেন?
মন্যে কি দিব। হাঁড়ি নু গড়ায়ে লিয়ে লিছে। কনিষ্কদারাও খাইছে।
বেশ করেছে। দুটো মেশিন রেডি কর।
কেনি!
ঘাঁটুলে যাব।
শিবু শরীর দুলিয়ে হাসলো।
তাই তুই সবগাকে খাওয়ায়ে বেহুঁস করছু।
না। তোর বৌমনি দেখতে চেয়েছে। আর কোনও দিন আসতে পারবে কিনা কে জানে।
তাইলে শ্যাম, দারু যাউক।
এখানে থাকবে কে?
শিবু ভেতরে গেল। খাটের ব্যবস্থা করলো। আমাকে আর ধরতে হলো না। ওরা তিনজনেই ওদের এক এক করে ধরে খাটে তুলে দিল।
ছেলেরা শুয়েছে।
সব বেহুঁস। শ্যাম বললো।
অংশু, সুবীর কোথায় বলতো?
তান্যে অনিক আগে ঘরকে গিয়ে শুয়ে পড়ছে।
তোর বউমনিরা কোথায়?
আসতিছে। তুই বরং শিবু, দারুকে লিয়ে যা, আমি এউঠি রই।
ওই পথে একবার দিবাকরের সঙ্গে দেখা করবো।
আইজ থাউক মুই ব্যবস্থা করিঠি কাইল যাস।
কোনও অসুবিধে?
তুকে নতন করে কইতে হবে।
ঠিক আছে।
মেলার দিকে তাকালাম। তখনও কয়েকটা লম্ফ জ্বলছে। বেশির ভাগই মাঠে-ঘাটে শুয়ে আছে। গোটা পঞ্চাশেক মেয়ে-পুরুষ তখনও ঘোরাঘুরি করছে। কেউ স্বাভাবিক নয়। সবাই শরীরে শরীর মিশিয়ে দিতে চায়। হাসা হাসি ঢলা ঢলি চলছে।
তোরা যদি না যাস কিছু অসুবিধে আছে?
তুই কুন পাশ নু যাবি।
মারাংবুরুর থানের পাশ দিয়ে।
তাইলে ঠিক আইছে। এ পাশনু যাইস নি ভালু থাকতি পারে।
নদীর ধারের ওই খাঁড়িটাতেই সবাই আছে তো?
হ।
একটা মেশিন দে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ফিরে আসবো।
শিবু হাসছে।
শ্যাম আমার হাতে মেশিনটা দিল।
চালাইতে পারবি তো?
লক করেছিস না আনলক আছে।
লক করা আছে।
ম্যাগাজিন ভর্তি না কিছুটা খালি রেখেছিস।
ভর্তি।
আমি মেশিনটা হাতে নিয়ে একবার দেখলাম। দেখেই মন হচ্ছে খুব বেশি ব্যবহার হয়নি।
কাঁধে ঝুলিয়ে নিলাম।
তনুরা ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। দু-জনেই জিনসের প্যান্ট আর পাঞ্জাবী লাগিয়েছে।
শ্যামেরা দেখে হেসে ফেললো।
বউমনিরা বেশ সন্দর পোশাক পরছে পাহাড় চড়তি আর অসুবিধা হবেক লাই।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। দু-জনেই কাছে এলো।
রাতে কেউ দেখবে না কি বলো শ্যাম। তনু বললো।
দেখলি কেউ চিনতি পারবেক লাই।
মিত্রার কাঁধে একটা ছোট্ট ব্যাগ।
ওটা আবার নিলি কেন।
একটা জলের বোতল নিলাম।
টর্চ।
ব্যাগের ভেতর আছে।
চল। কটা বাজে?
পৌনে একটা।
মন্যে দশ-পনরো মিনিট বাদ বাদ ফোন দিব। শিবু বললো।
আমারটায় নয় তোর বউমনিরটায় বা তনুদিদির ফোনে, প্রয়োজন পরলে আমি ফোন করবো।
আইচ্ছা।
আমরা তিনজনে সামনের দিকে একটু এগিয়ে পাহাড়ি রাস্তা ধরলাম।
সেই আলো আঁধারি পথ। মিত্রা-তনু সামনে, আমি পেছনে।
বাবাঃ কি খাঁড়াই রে বুবুন।
মাঝে মাঝে এরকম পাবি। না হলে এমনি ভালো রাস্তা।
আর কোনও পথ ছিল না।
ঘুরতে হতো।
একটু খানি ওপরের দিকে উঠেই দাঁড়িয়ে পড়লো।
কিরে!
দাঁড়া একটু জল খাই।
তিনজনেই এক ঢোক করে জল খেলাম।
বুবুন তোর পেছনে ওটা কিরে?
মেশিন।
কি হবে!
রাত বিড়েতে তোদের নিয়ে বেরিয়েছি কে কি অবস্থায় থাকে কিছু বলা যায়।
তা বলে এটা নিয়ে বেরতে হবে?
তোরা না থাকলে নিতাম না।
তনু মুচকি হাসলো।
তুমি চালাতে পারো।
পরিস্থিতি তার বিচার করবে।
তোকে বলেছিলাম, সেই প্রথম দিন মার আলমারিতে দেখে ভয় পেয়েছিলাম। তারপর ও বললো ওটা ইসলামভাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।
চলতে চলতেই কথা হচ্ছে। এবার রাস্তাটা একটু চওড়া। দু-জনে আমার দুটো হাত ধরেছে।
জানিস বুবুন আজ সেই দিনটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
কোন দিনটা বলতো?
তুই আমি যেদিন প্রথম রাতের অন্ধকারে তোর গ্রাম দেখতে বেরিয়েছিলাম।
আমার গ্রামের সঙ্গে এখানকার অনেক পার্থক্য।
তা হোক সেদিনও রাতে বেরিয়েছিলাম। এই রকম চাঁদনি রাত ছিল। দ্বিতীয়বার মিলিদের সঙ্গে করে তুই যখন নিয়ে গেলি। বাড়ির পেছন পাশ দিয়ে বাঁশ বাগানের ভেতর দিয়ে।
এখানে শাল বনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিস। সচরাচর বাঁশ বাগান পাবি না।
টিলাটার মথায় এসে দাঁড়ালাম। মিত্রারা সামান্য হাঁপিয়ে গেছে।
খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে চারিদিকটা চেয়ে চেয়ে দেখছি।
চাঁদ এখন মাথার ঠিক ওপরে। যত রাত হয় চাঁদের আলোটা যেন তত উজ্জ্বল হয়। এখান থেকে ভাঙা মেলাটা দেখা যাচ্ছে। সুনসান মাঠ। এখনও গুটি কয়েক লোকের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। কোনও আলো নেই যে দু-চারটে চালা দেখা যাচ্ছে তাও অন্ধকার।
ওইখানে মেলা বসেছিল? তনু বললো।
হ্যাঁ।
তুমি মনে হয় বড়োমাদের নিয়ে এই পথ দিয়ে নিচে নেমেছিলে?
কেন তোমরা নামো নি!
আমরা ওই পাশ দিয়ে একটা মোরাম ফেলা রাস্তা দিয়ে নিচে নেমেছিলাম।
বুঝেছি।
কি!
ওটা রাজপথ। এটা গলি ঘুঁজি।
তনু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। মিত্রা তখনও মেলার দিকে তাকিয়ে।
তনু সামনের পাহাড়টাকে দেখ। তখন বড়োমা বলছিল, মনে আছে।
তনু তাকিয়েই চেঁচিয়ে উঠলো।
হাউ নাইস। দিদি ব্যাগটা দাও, একটা ছবি তুলি।
আসে কিনা দেখ।
চেষ্টা করি একবার।
তুমি ক্যামেরা নিয়ে এসেছো!
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
বারে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তাইই জানি না। সেরকম সুন্দর কিছু দেখলে আক্ষেপ থেকে যাবে।
আমি তনুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম।
তনু জুম করে তোলার চেষ্টা করলো। আধুনিক ক্যামেরা, অনেকটাই ধরে রাখতে পারলো।
মেঘটা তখনও পাহাড়ের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।
বল-না আমরা কোথায় যাচ্ছি। মিত্রা হাতটা ধরে ঝাঁকুনি দিল।
ঘোটুল।
ঘোটুল!
হ্যাঁ।
সেটা আবার কি।
তখন খেতে বসে বলছিলে…। তনু বললো।
ফ্রি-সেক্স, নিজের মনের মানুষকে পছন্দ করার জায়গা।
এখানে! কি বলছিস তুই!
হ্যাঁরে, তাই তো তোদের দেখাতে নিয়ে এসেছি।
আমার মাথায় ঢুকছে না।
নিজের চোখে দেখবি চল।
কোথায় এটা?
মারাংবুরুর থানের পাশ দিয়ে একটু গেলে, সুবর্ণরেখার একটা খাঁড়ি পড়বে। চারিদিক পাহাড় ঘেরা একটা জায়গা। চাঁদের আলো বালির ওপর পরে আলো করে রেখেছে।
তনু আর দাঁড়াব না, যত কষ্ট হোক একবারে ওখানে গিয়ে দাঁড়াব।
চলো চলো।
তনু ক্যামেরা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো।
দিদি টর্চটা বার করে নিই।
লাগবে। মিত্রা আমার দিকে তাকাল।
আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। তোদের অসুবিধে হলে হাতে রাখ।
তনু ব্যাগে ঢুকিয়ে দে।
এবার নিচের দিকে কিছুটা নামলেই ডান হাতে সুখলাল কাকার বাড়ি। সেই এক চেনা পরিচিত রাস্তা। যতবার এখানে এসেছি, ততবার এই রাস্তা দিয়ে বার কয়েক হাঁটতে হয়েছে। নয় সুখলাল কাকার বাড়ি নয়তো মারাংবুরুর থান।
নামতে বেশি কষ্ট নেই বেশ তড়তড় করেই তিনজনে নেমে এলাম।
গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে হেঁটে চলেছি। সেই ঝিঁ ঝিঁ পোকার তারস্বর ডাক। এ যেন কখনও পুরনো হয় না। যতবার শুনবে ততবার নতুন মনে হবে। গাছের ফাঁক দিয়ে যেটুকু আলো এসে পরেছে তাতেই রাস্তাটা যথেষ্ট আলোকিত। আঁকা বাঁকা পথ। চোরা গোপ্তা হঠাৎ হঠাৎ মিলিয়ে যাচ্ছে।
সুখলাল কাকার বাড়ির সামনেটা অন্ধকার। বারান্দায় দুটো মশারি টাঙানো। একটু এগিয়ে আসতেই মারাংবুরুর থানের টিলাটা দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় সব কিছু পরিষ্কার। মনে হচ্ছে যেন হাত বাড়ালেই ধরতে পেরে যাব।
দু-জনে আমার দু-হাত শক্ত করে ধরেছে।
বুবুন।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
ভয় করছে?
না।
আমি দু-জনের হাতটা ছেড়ে দিয়ে কোমর পেঁচিয়ে ধরলাম। ওরাও দুজনে আমার কোমর ধরলো।
মেয়ে ফোন করেছিল। বাবার ওপর তার বেজায় অভিমান হয়েছে।
ও কিছু নয়, এলে দেখবি ঠিক হয়ে যাবে। এখানে যে আসবো ঠিক ছিল নাকি।
সেদিনের মিটিং-এর পর বুঝলাম শ্যামেদের সঙ্গে একটা নিগোসিয়েসন না করলে নয়।
তারপর গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া সাগর, অনাদি। সব জালিয়ে পুরিয়ে মারলো।
তুই যখন নাচছিলি ওরা তখন সবাই ভেতরে খেতে বসেছিল। বৌদি ভীষণ খুশি।
বড়োমা বললো, বৌদি অনিমেষদাকে ফোন করে বলেছে, এইরকম সহজ সরল মানুষ গুলোকে তোমরা এতদিন ডিপ্রাইভ করেছো। এখানে যে দায়িত্বে আছে তাকে পাঠাও, আমি তার সঙ্গে কথা বলবো। সে এতদিন কি কাজ করেছে, আমি জানতে চাইবো।
অনুপদা বার বার ছোটোমাকে বলছে আমাদের এতদিন ভুল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে ছোটদি। কি করবো বলো। সেবার এসেছিলাম। এতো ভেতরে ঢুকি নি। স্টেশন চত্বরে একটা হোটেলে বসে কথা বলেছিলাম।
ইসলামভাই সব দেখে শুনে কি বলে জানিস।
মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।
অনির আরও কত কিছু দেখার বাকি আছে কে জানে।
আজ দিদিভাই আমাদের দুজনকে একটা খুব দামি কথা বলেছে জানিস।
একটু অবাক হয়ে বললাম, কি!
তোরা দু-জনে অনেক পুণ্য কাজ করেছিস তাই অনির মতো একটা ছেলেকে পেয়েছিস।
সেই শুনে তনু কি বলে জানিস, কেন তুমিও তো পেয়েছো।
তনুর মাথায় মাথা দিয়ে ঠোক্কর দিলাম।
তনু হাসলো।
ছোট্ট বাঁকটায় এসে দাঁড়ালাম। বাম দিকের রাস্তাটা মারাংবুরুর থানের দিকে চলে গেছে। আর ডানদিকের রাস্তাটা নদীর দিকে। খিল খিল করে মেয়েলি হাঁসির শব্দে থমকে দাঁড়ালাম।
চলবে —————————–
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/5K2uAXW
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment