❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৫৫ নং কিস্তি
—————————–
চলো মিনসে তোমার জন্য মন খারাপ করে বসে আছে। বড়োমা বললো।
কতযুগ পর দেখবো, চিনতে পারবো না।
আন্টি করুণ চোখে বড়োমার দিকে তাকিয়ে।
আমি চিনিয়ে দেব।
মিলিরা দেখলাম সব ভিড় করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।
নীরু, কনিষ্কদের আশেপাশে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। বাগানটা আলো-আঁধারি।
আন্টি এবার আমার হাত ছেড়ে বড়োমা, ছোটোমার হাত ধরেছে।
তুমি বড়োমার সঙ্গে ও ঘরে যাও আমি আসছি।
তুই কোথায় যাবি!
কোথাও যাব না। বাড়িতেই আছি। জামা প্যান্টটা ছাড়ি।
ছাড়তে হবে না।
আমি হাসছি।
তুমি যাও না।
তুই চল।
আমি বলছি কিচ্ছু হবে না। এতক্ষণ গাড়িতে বসে এত তরপালে।
তুই বড়ো বদ।
তোমার অনেক সৈন্য-সামন্ত। কিচ্ছু করতে পারবে না। তারপর আমি রইলাম পাশুপত অস্ত্র।
দেখলাম অনিমেষদা, বিধানদা ঘরের গেটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আমি আমার ঘরে চলে এলাম। দেখলাম নেপলা, ভজুকে নিয়ে মিষ্টির প্যাকেট নামাচ্ছে।
ঘরে ঢুকলাম। ওই ঘরে বেশ হই হই হচ্ছে। অনিসা, অনিকার গলা সবচেয়ে বেশি পাচ্ছি।
জামাপ্যান্ট খুলে টাওয়েলটা কাঁধে চাপিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। সাওয়ারটা খুলে নিচে দাঁড়ালাম।
বার বার মিত্রার লেখা লাইনটা মনে পড়ে যাচ্ছে।
জানিস মামনি যাকে ভালবাসতাম সে যদি আমাকে একটা সন্তান উপহার দিত আজ তার বয়স অনির মতো হতো।….আমি কোনও কিছুর বিনিময়ে কখনই ওকে হারাতে চাই না।
অনেক ভেবে দেখেছি। ডাক্তারদাদার আপনজন বলতে আমরা ছাড়া কেউ নেই। কোনওদিন সাহস করে জিজ্ঞাসাও করতে পারিনি। তোমার আসল শেকড়টা বলো।
ডাক্তারদাদার ঘনিষ্ট বন্ধু বলতে ডা. আর.এল. দাস আর রথীন চ্যাটার্জী। আর.এল. দাস মারা গেছেন। রথীন চ্যাটার্জী বেঁচে আছেন।
দাদাকে একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম। দাদা শুধু বললো। এই বাড়িটা সামন্ত কিনেছে মিত্তিরদের কাছ থেকে। তাও আমি এখানে আসার বছর দশেক পর।
বড়ো ডাক্তার, কলকাতায় বেশ নাম ডাক। পাড়া প্রতিবেশী হলেন। সেই সূত্রে আলাপ। দায়ে অদায়ে সামন্তর কাছে যাই। এর বেশি কিছু নয়।
তখন তুমি কোনও আত্মীয় স্বজন দেখনি?
শুনেছি ওর ভাই বোনেরা আছে। তারাও সব বড়ো বড়ো পোস্টে কাজ করে। তারপর যে যার কাজে ব্যস্ত সেই ভাবে কেউ ডাক্তারের খোঁজ খবর নেয় না।
আর এগোইনি। বলতে পারি এগোবার চেষ্টা করিনি। অনেক চেষ্টা করেও কোনওভাবেই সূত্র খুঁজে পাই না। এই হিসাবটা আমাকে মেলাতেই হবে। যে ভাবেই হোক।
তুই বেরবি, না দরজা ভেঙে ঢুকতে হবে। মিত্রা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। বাথরুমের দরজা ধাক্কাচ্ছে। বাধ্য হয়ে বাথরুম থেক বেরিয়ে এলাম। ঘরে মিত্রা-তনু দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে দুষ্টুমির ঝিলিক।
তোর হবে দাঁড়া। মিত্রা বললো।
ওকে এখন থেকে বলে দাও রাতে যেন সব বলার পর ঘুমবার চেষ্টা করে। জানতে হবে ওর উপন্যাসের আরও কতগুলো চ্যাপ্টার লেখা বাকি আছে।
আমি তনুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম।
মিত্রার ছোঁয়া পেয়ে গেছ মনে হচ্ছে।
মিত্রাদির ছোঁয়া অনেক আগেই পেয়েছি। মাটি-জল ঠিক মতো পাইনি বলে বাড়তে পারিনি।
এখন মাটি-জল-আলো-বাতাস সব পেয়েগেছ?
তুমি আমাকে এখন কোনও ভাবেই চমকাতে পারবে না।
এই তো মুখে খই ফুটছে।
যতই বলো, দুই মেয়ে আছে টুক টুক করে লাগাব, সব সমস্যার সমাধান।
বাবাঃ ট্রাম্প কার্ডের সন্ধানও পেয়ে গেছ—
বক বক করছিস কেনরে—মিত্রা তেড়ে এলো।
এই দ্যাখো মুখ থাকতে হাতে কেন।
তনু হাসছে। তাহলে শরীর দিয়ে লড়ে যাই।
হাসাচ্ছি। এমন অন্তর টিপুনি দেব না….।
টেপো না। ভেবেছো কি….।
মিত্রা আমার হাতদুটো শক্ত করে ধরেছে।
তনু ওর টাওয়েল খোল।
তনু এগিয়ে এসেছে।
চেঁচাব।
চেঁচানা, চেঁচা। দেখি তোর কতো গলার জোড় আছে। ও ঘর থেকে এখন কেউ আসবে না।
তনু এসে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। পরক্ষণেই মিত্রা তনুর অনুকরণ করলো।
দুটোকেই খুব খুশী খুশী মনে হচ্ছে।
ভীষণ।
দু-জনেই জড়িয়ে ধরেছে।
ও ঘরে সবার সঙ্গে যুদ্ধ লেগে গেছে।
তনুর দিকে তাকালাম।
কেন!
তোমাকে নিয়ে।
তাই তুমি, মিত্রাদি পালিয়ে এলে তোমাদের সম্পত্তি রক্ষা করতে।
হ্যাঁরে বুবুন, বড়োমার সঙ্গে ডাক্তারদার একচোট হলো। তারপর ডাক্তারদা রেগে আন্টিকে বলে, তুমি উড়ে এসে জুড়ে বসতে চাইলে হবে।
আমি তনু কি হাসছি।
অনিমেষদা বলে ডাক্তারবাবু, আমি সুতপা কোথায় যাব?
বলে, ভাগ পাবে।
অনুপদা, রূপায়ণদা খুব মজা করছে আন্টিকে নিয়ে।
নীরুর কথা বলো। তনু বললো।
নীরু তো আন্টির কাছে পেসেন্ট পাঠায়। ও, কনিষ্ক, বটা খাবার আনতে গেছিল, আন্টিকে দেখে ওদের চোখ কপালে। আমাকে বললো, অনি ম্যাডামকে কোথা থেকে ধরে আনলো!
উনি নাকি আগে লন্ডনে ছিলেন কয়েক বছর হলো কলকাতা এসেছেন, পেড্রিয়াটিকের বেশ নাম করা ডাক্তার।
একটা পাজামা পাঞ্জাবী অন্তত দে, টাওয়েল পরে কতক্ষণ থাকি, সারারাত পরে আছে।
শোন না।
আমি কার দিকে তাকাব।
দু-জনের দিকে।
তাহলে ট্যারা হতে হয়।
বাবা দিদাই তোমাকে দেখতে না পেয়ে এবার পাগল হয়ে যাবে।
মিত্রা, তনু দুজনেই আমাকে ছেড়ে মুখ ঢেকেছে।
মিত্রা ফিস ফিস করে বললো, তুই আগে বাথরুমে ঢোক, না হলে সব গড়বড় হয়ে যাবে।
তনু আমাকে ঠেলে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিল।
আমি শাওয়ার খুলে দিয়ে আবার দাঁড়িয়েছি।
মিত্রারা মনেহয় দরজা খুললো। মেয়ের গলা পেলাম।
মা, বাবা এখনও বাথরুম থেকে বেরোয়নি!
দেখনা, মার ওপর তো খুব চোটপাট করিস। এবার নিজের চোখে দেখ।
সত্যি ছোটোমা তুমি মা দুজনে বাবাকে ঠিক ট্যাকেল করতে পারলে না।
বাবা। মেয়ে তারস্বরে চিৎকার করে উঠলো।
তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছো?
চোখ বুঁজিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি মিত্রা-তনু মুখ লুকিয়ে হাসাহাসি করছে।
আমি বাথরুম থেকেই চেঁচিয়ে বললাম দাঁড়া দরজা ঘট ঘট করিস না। বেরচ্ছি।
তবু অনিসা দরজা ধাক্কা দিয়েই চলেছে।
বাধ্য হয়ে আমি গা না মুছে টাওয়েলটা কোনও প্রকারে জড়িয়ে বেরিয়ে এলাম।
তনু মিত্রা আমাকে দেখে চোখ পাকাচ্ছে।
মেয়ে বাথরুমের গেটের মুখে দাঁড়িয়ে।
সত্যি তুমি না একটা ঢপের…।
সারাদিনের ময়লা ধুতে একটু সময় লাগবে না।
তা বলে এতো সময়।
তুই না এলে মিনিট দশেক সময় বেশি নিতাম।
মা ডাকে নি।
জিজ্ঞাসা কর। দু-জনে এসে কি করছিল কে জানে।
মা বাবাকে একটা টাওয়েল দাও।
মেয়ে আমার দিকে ডাগর চোখে তাকিয়ে।
দিদি কোথায়?
দিদি আন্টিদিদার হাঁটুতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ লাগাচ্ছে।
ঠিক আছে তুই গিয়ে দিদাইকে সামলা আমি যাচ্ছি।
জাস্ট ফাইভ মিনিট।
ফাইভ মিনিট এক্সট্রা টাইম।
মেয়ে গট গট করে বেরিয়ে গেল।
মিত্রা কোনওপ্রকারে দরজা বন্ধ করে ছুটে এলো, শয়তান ডাকিনি তাই না।
দিদি দিদি আস্তে অনিসা যদি দাঁড়িয়ে থাকে একবারে গিও। তনু বললো।
তুই ওর পাজামা পাঞ্জাবী বার কর।
এখনও বার করিসনি!
তোকে বার করাচ্ছি। মেয়ের কাছে সাউকিরি, তোর মা দরজা ধাক্কায়নি।
জাপ্টে ধরেছিলি কেন।
তনু আলমাড়ি খুলেছে।
একটা টাওয়েল দে।
এটা খুলে মোছ।
চোখ বন্ধ কর।
মিত্রা তেড়ে এলো, আমি আবার বাথরুমে ঢুকে গা মুছে বেরলাম।
দু-জনে খাটে বসে।
আমি পাজামা পাঞ্জাবী গলালাম। দু-জনেই আমাকে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছে।
আমি মুচকি মুচকি হাসছি।
আজ রাতে তোকে হাসাব।
ইসিকে সঙ্গে নিয়ে নে, ব্যাপারটা আরও জমবে।
এঃ দুটোকে সামলাতে পারে না। আবার আর একটাকে জোটাচ্ছে। মিত্রা বললো।
আমি হাসছি।
তনু এগিয়ে এসে পাঞ্জাবীর বোতাম লাগাতে শুরু করেছে।
তোরা দু-জনে একটা কাজ করতে পারবি—
দু-জনেই আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে।
আবার বদ বুদ্ধি! তনু বললো।
শুনলেই না, ওমনি বদ বুদ্ধি—
বলো শুনি।
দু-জনে মিলে কালকে একটা পার্টি অর্গানাইজ করতে পারবে। ছোটোমা, বৌদিকে সামনে রাখবে।
মিত্রার চোখ চক চক করে উঠলো।
তুই কি ডাক্তারদার রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা করছিস।
না না। এই বুড়ো বয়সে আর ওসব কিছু হয়। তাছাড়া আন্টির ছেলে-মেয়েরাও সুবিধার নয়।
সেই জন্য তখন তুই বলছিলি, ওই ব্যাপারটা আমাকে ছেড়ে দাও।
আমি মাথা দোলালাম।
তোকে আধঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দিচ্ছি।
মাথায় রাখবি কেউ যেন আমাকে সন্দেহ না করে।
সকালে না রাতে?
সারাদিন।
তোর একটা প্ল্যান আছে।
আছে। তোদের রাতে বলবো।
তিনজনে এ ঘরে এলাম। ডাক্তারদাদা, আন্টিকে দেখতে পেলাম না। অনিমেষদারা সোফায় বসে কথা বলছে, চা খাচ্ছে।
আমায় দেখে অনিমেষদা, বিধানদা হাসলো। আমি গিয়ে দু-জনের মাঝখানে বসলাম।
মিত্রারা প্রথমে রান্নাঘরের দিকে গেল, তারপর ওখানে কিছুক্ষণ কথা বলে বড়োমার ঘরের দিকে।
বৌদি রান্নাঘরের সামনে। বড়োমা, দাদা মনে হয় নিজের ঘরে।
বৌদি একটু চা খাওয়াবে?
ছোটো তোর তেঁদড় ছেলে কি বলছে শোন।
ওর মুখটা গিয়ে শেলাই করে দাও।
অনিমেষদা আমার মাথায় হাত রেখেছে।
চুল এখনও ভিঁজে। তুই কি স্নান করলি?
হ্যাঁ।
চুলটাও ঠিক মতো মুছতে পারিস না?
গামছায় মোছা অভ্যেস, এরা টাওয়েল দেবে। হবে কি করে—
তোকে আমি একটা গামছা কিনে দেব।
কি কিনে দেবে ওকে! বৌদি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
গামছা। অনিমেষদা বললো।
বৌদি মুখ টিপে হাসছে।
দাঁড়া মিত্রার কানে কথাটা তুলছি।
আমি বৌদির দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
ছোটোমা চা নিয়ে এলো।
রূপায়নদারা কোথায় গেল অনিমেষদা?
দোকানে গেছে। এসে পরবে।
আমি চায়ে চুমুক দিলাম। বিধানদার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। অনিমেষদা লক্ষ্য করছে।
ওরকমভাবে হাসছিস কেন? বিধানদা বললো।
ভাবছি।
তোকে আর বেশি ভাবতে হবে না। প্রজেক্টটা নিয়ে ভাব তাহলেই হবে।
এটাও তো একটা প্রজেক্ট।
অনিমেষদা গোল্লা গোল্লা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।
এইবার তোর আমি কান ধরবো।
অনিমেষদা জোড়ে হেসে উঠলো।
বৌদি রান্নাঘরের থেকে এদিকে মুখ ফেরাল।
হেসো না অনিমেষ, ওকে নিয়ে আমার বড়ো ভয়, দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
আপনার এতো ভীত হওয়ার কি আছে?
বৌদি এগিয়ে এসেছে সোফার কাছে।
তুমি ওরকম অট্টোহাসি হাসলে?
অনি বিধানবাবুর সঙ্গে ফিচলেম করছে।
বিধানদার সঙ্গে, অনি!
দেখ না মজাটা।
নাগো সুতপা। বেশি স্নেহ করি কিনা। বিধানদা বললো।
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বিধানদার দিকে টেরিয়ে তাকালাম।
তুই যা ভাবছিস তা নয়। আমিও খোঁজ খবর রাখি।
আমি একটা বৃদ্ধাশ্রম করবো ঠিক করেছি বুঝলে বিধানদা। সেখানে বাইরের কেউ থাকবে না। সব আমার ঘনিষ্ঠজনেরা থাকবে।
আমার জন্য একটা জায়গা রাখিস।
সেখানেও একটা ক্লজ আছে।
কিরকম?
সিঙ্গেল হলে চলবে না।
এই বুড়ো বয়সে দোকা পাবো কোথায়?
ছোটোরে অনির কথা শুনবি আয়। বৌদি হাসতে হাসতে বলে উঠলো।
আবার ছোটোকে ডাকে। বিধানদা ধমকে উঠলো।
দেখো ডাক্তারদাদা কিরকম সুন্দর জোগাড় করে ফেললো।
তোর ফক্করি বার করছি দাঁড়া।
বৌদি হাত-পা ছড়িয়ে হাসতে হাসতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
আমি বিধানদার দিকে তাকিয়ে।
মিত্রা, তনু বড়োমার ঘর থেকে বেরলো। হাসি হাসি মুখ। আমি মিত্রাদের দিকে তাকালাম।
ওদের দিকে তাকাচ্ছিস কেন? বিধানদা বললো।
ঠিক আছে তাকাব না। চোখ বন্ধ করে বসে আছি।
মিত্রা বুঝতে পেরেছে কিছু একটা হয়েছে। পায়ে পায়ে কাছে এগিয়ে এলো।
ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে নিয়ে দু-জনে বসে পড়লো।
ছোটোমা দেখলাম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
তুই নাকি বিধানদার সঙ্গে ফিচলেমি করছিস।
বিধানদা, ছোটোমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
না সেরকম কিছু নয়।
অনিমেষদা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসছে।
আফতাবভাই আসার আগেই এই প্রজেক্টটা কমপ্লিট করতে হবে।
আমি উঠে দাঁড়িয়েছি।
কোথায় যাচ্ছিস? বিধানদা হাত ধরেছে।
লাস্ট আপডেটটা নিই।
সত্যি আমি এবার তোর কান ধরে ছিঁড়ে দেব।
ছোটোমা, বৌদি, তনু, মিত্রা খুব জোড়ে হেসে উঠলো।
দেখলাম বড়োমা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। পেছন পেছন ডাক্তারদাদা, আন্টি, দাদা, জ্যেঠিমনি।
কিরে ছোটো! অনি আবার কি করেছে?
কিছু না। বিধানদার সঙ্গে ফোক্করি করছে।
বিধানবাবুর সঙ্গে! দাঁড়া যাচ্ছি। ওর কান ধরে…।
দেখছো তোমার জন্য আমি শুধু শুধু বড়োমার কাছে ঝাড় খাব।
আমি বিধানদার দিকে তাকালাম।
বিধানবাবু অনি আবার কি বলে। ডাক্তারদাদা বললো।
আমি গিয়ে আন্টির সামনে দাঁড়ালাম।
কিছু মিললো?
বুড়ো হয়ে গেছে।
তুমি কি জোয়ান আছো?
আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
ভালো করে ঝেরেছো।
না।
তাহলে এখন আমি আমের আঁটি—
আন্টি হাসছে।
প্রেসারটা একবার চেক করেছো—
এখন ঠিক আছে।
জ্যেঠিমনি হাসছে।
এবার বাড়ি যাবে তো?
দেখলাম ডাক্তারদাদা একবার ঘুরে তাকাল। হাসলো।
তুই আর মেলা বকিস না।
ওমনি। তখন খুব তর্জন-গর্জন করছিলে। আমি চুপ করে শুনে গেছি।
আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরে হাসছে।
ওদিকে কিছু জানিয়েছ?
তোর যাওয়ার আগেই বলে দিয়েছি। এই কদিন আমি থাকবো না। তোমরা কেউ আদর দেখাতে আসবে না।
বড়োমা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
খাবার দাবার ব্যবস্থা করো।
আসুক। তারপর দিচ্ছি।
বুঝলাম না।
ওরা সবাই আনতে গেছে।
বাড়ি শুদ্ধু সকলের।
হ্যাঁ। তোর অসুবিধে আছে।
একবারে না। তাহলে আমি একটু ঘুমিয়ে নিই, ওরা এলে খেতে ডেকো।
মিত্রা।
তোমার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছি।
বড়োমা পেছন ফিরে তাকাল।
ও যাতে না ঘুমোয় তার ব্যবস্থা কর।
মিত্রা, বড়োমাকে জড়িয়ে ধরেছে।
তুমি কতদিন পর একটা ভাল কথা বললে।
বিধানদার দিকে তাকালাম। আন্টি তখনও আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আলাপ হয়েছে?
তুই তো করিয়ে দিলি না।
অনিমেষদা জোড়ে হেসে উঠলো।
বড়োমা পিট পিট করে একবার আমার মুখের দিকে তাকায় একবার অনিমেষদার দিকে তাকায়।
ব্যাপার কি বিধানবাবু? অনিমেষ এতো হাসছে কেন? বড়োমা বললো।
অনিমেষও আজকাল অনির মতো হয়ে যাচ্ছে।
আমি আন্টির দিকে তাকালাম। তুমি বসো। আমি একটু কাজ সেরে আসি।
তোর ঘরে এখনও যাইনি।
হাঁটুর ব্যাথা বেড়ে যাবে।
ভজু টিপে দেবে বলেছে।
ডাক্তারদাদাকে বলো ওষুধ দেবে।
সে যদি হতো তাহলে ওর প্রেসার বেড়ে যেতো না।
আবার বক বক করে। ডাক্তারদাদা ঝামটে উঠলো।
মিত্রাদের দিকে তাকালাম। আমার চোখের ইশারা ওরা বুঝেছে। আমি এ ঘরে এলাম।
খাওয়াটা বেশ হই হই করে হলো। আমি সাথেও নেই পাঁচেও নেই। সবাই দেখলাম চলে এসেছে। আজ ডাক্তারদাদার বাড়ির অনেকগুলো ঘর দখল করেছে এই বাড়ির লোকজন। আভাসে ইঙ্গিতে যা বুঝছি আন্টি, ডাক্তারদাদা এই বাড়িতেই থাকবে।
আমি ছেলেমেয়েদের গুডনাইট করে ঘরে চলে এলাম।
টেবিলের ওপর রাখা ওষুধের প্যাকেট থেকে ওষুধ বার করে খেলাম।
কপালে আজ দুঃখ আছে। আজ মিত্রা, তনু দুজনে ছিঁড়ে খাবে। পিকুকে এক ঝলক দেখলাম। আমাকে দেখে মাথা নিচু করে নিয়েছে। ধারে কাছে আসেনি।
রূপায়ণদা যাওয়ার সময় বলে গেল, কাল কথাও প্রোগ্রাম রাখবি না। সক্কাল সক্কাল কাজ সেরে চলে আসব। আভাসে ইঙ্গিতে বুঝলাম কালকে খুব জোড় খাওয়া দাওয়া হবে।
বিছানায় এসে টান টান হয়ে শুলাম।
আফতাবভাই, অনিকা-অনিসার জন্য টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওরা তিনদিন পর যাবে। আগামী সপ্তাহে আফতাবভাইয়ের আসার কথা। ইসলামভাইকে বলেছি, বাড়ি-ঘর-দোর একটু ঠিক করে নাও। আমাদের এই বাড়ির ঘরগুলো বেশ বড়ো বড়ো অনেকটা আগেকার দিনের ঘরের মতো। দাদা আর কোনও পরিবর্তন করেনি। করতেই বা যাবে কেন, কার জন্য করবে, কিন্তু এখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। দিনে দিনে লোক বেড়ে চলেছে। একটাই রক্ষে ডাক্তারদাদার পেল্লাই বাড়িটা আছে। নাহলে আবার মিত্রার বাড়িতে গিয়ে রাত কাটাতে হবে। বরং মিত্রার বাড়িটা দাদার এই বাড়ি থেকে বড়ো, ঘরের সংখ্যাও অনেক বেশি।
কিরে নিশ্চই শুয়ে শুয়ে কড়িকাঠ গুনছিস।
মিত্রা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তনু সোজা টেবিলের কাছে চলে গেল।
হ্যাঁ দিদি ওষুধ খাওয়া হয়ে গেছে।
সোজা চলে এলো আলমাড়ির কাছে। পাল্লা খুলে নিজেদের রাতের পোষাক বার করলো।
বুবুন।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
কাল ভীষণ মজা হবে।
ম্যানেজ করেছিস।
ম্যানেজ কিরে, অনিমেষদা, বিধানদা পর্যন্ত ফোর ফন্টে চলে এসেছে।
কথাটা কে বললো তুই না তনু।
তখন এ ঘর থেকে গিয়ে রান্নাঘরে গেলাম না।
মাথা দোলালাম, হ্যাঁ। বৌদি-ছোটোমা ছিল।
ছোটোমাকে বললাম। ছোটোমা শুনে চোখ বড়ো বড়ো করলো, তোর সব সময় খাবার ধান্দা।
তনুও চেপে ধরলো।
বৌদি বললো, দাঁড়া আগে ওর সঙ্গে কথা বলি। তোরা অনিকে বলেছিস।
তনু বললো, এটা আমরা মেয়েরা অর্গানাইজ করবো। বড়োমাকে তনু পটিয়েছে। বড়োমা খুশী।
তনু একটা নাইটি মিত্রার হাতে দিল।
বাথরুমে যাওয়ার আর প্রয়োজন আছে?
মিত্রা হাসছে, ও ঘরে করে এলি তো? আবার পেয়ে গেছে!
জিজ্ঞাসা করছি।
তোদেরকে আর একটা দায়িত্ব দেব এটা একটু টাফ তবে তোরা স্টার্ট করলে বাকিটা আমি সামলে দেব।
এখন দাঁড়াও, মিত্রাদি আগে চেঞ্জ করে নাও। তনু বললো।
দু-জনেই উঠে গেল। সঙ্কোচ, লজ্জা শব্দগুলো এখন এই ঘর থেকে উধাও হয়ে গেছে।
রাতপরীর পোষাকে দু-জনে আমার কাছে এসে দাঁড়াল।
তোর পছন্দ। কাল তনু কিনে নিয়ে এসেছে।
ফিতে-টিতে নেই।
না।
তাহলে অনেক এ্যাডভান্টেজ।
দু-জনেই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পরলো।
শয়তান।
আমি উঃ উঃ করে উঠলাম।
বুড়ো বয়সে এ্যাডভান্টেজ।
বুড়ো কিরে এই বয়সেই তো খুচখুচুনি বাইটা বেশি জাগে।
দু-জনে আমার দু-পাশে গড়িয়ে পড়লো।
বল কি বলবি বলছিলি। মিত্রা ঠোঁট দিয়ে কানটা টেনে ধরলো।
দ্যাখ শোয়া মাত্রই শুরু করে দিয়েছিস। তনু এমন রাম চটকান চটকাব বুঝতে পারবে।
বলো বলো, দু-জনে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরলো।
এই ব্যাপারটা তুই তনু আমার থেকে বেশি জানবি।
কি?
বেশ কয়েকটা ভালো ওয়াইনের বোতল নিয়ে আসতে হবে।
এ্যাঁ।
দু-জনেরি চোখ গোল্লা গোল্লা।
এই বড়িতে ড্রিঙ্কস!
সবাই মিলে খাব।
যাঃ দাদার সামনে মদ খাওয়া যায়।
তুই তো মদ খাচ্ছিস না। সকলে মিলে হই হুল্লোড় করছিস।
এটা আমরা দু-জনের কেউ পারবো না। তুই ম্যানেজ কর। কিরে তনু।
হ্যাঁগো দিদি। দাদা, অনিমেষদা, বিধানদা ওরে বাবা সব এক একটা বাঘ।
তোমরা কি নেশা করবে।
সেদিন কি নেশা করার জন্য খেয়েছিলাম, হয়ে গেল। তনু বললো।
কেন লন্ডনে খাও নি?
ব্র্যান্ডি। মিত্র বললো।
আমি, দিদি, ছোটোমা আলাদা খেয়েছি। ওরা যে যার ঘরে গিয়ে খেয়েছে। দাদা, ডাক্তারদা, বড়োমা আলাদা খেত।
নাঃ তোদের দ্বারা কিছু হবে না। দু-টোই মাল।
একবারে মাল বলবে না। দেবো ঠোঁট ফাটিয়ে। তনু কপট রাগ করে উঠলো।
বুবুন।
মিত্রা আমার থুতনি ধরে ওর দিকে ঘোরালো।
বিধানদার কিছু আছে।
ওঃ। তনু। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
বার বার চু চা করলে হবে। তখন খুব ফট ফট করছিলে। মিত্রাদির কথার উত্তর দাও।
মিত্রা তুইও কিন্তু বিরক্ত করছিস। এবার কিন্তু ঘুমিয়ে পড়বো।
ঘুমিয়ে পরলেই হলো। বিধানদার কেশ, আন্টির পর্দা উন্মোচন, পিকুর সমাপ্তি জানতে হবে না।
তনু মাথার বালিশটা একটু উঁচু করে দাও তো।
আমি মাথা উঁচু করলাম তনু ঠিক করে দিল।
বলো বিধানদার চ্যাপ্টারটা। তনু বললো।
সত্যি, কিছু না।
তুই যখন বলছিলি, তখন বিধানদার মুখটা কেমন লাগছিল। খুব আনইজিফিল করছিলেন। তার ওপর অনিমেষদার ওরকম হাসি।
সামথিংস হ্যাজ, আমি মিট করেছি।
সত্যি!
আগে সিওর হই তারপর বলবো।
আন্টির টা।
তোরা লন্ডন চলে যাবার পর কেমন যেন একা হয়ে গেলাম। অঢেল সময়। কি করি কি করি। মেয়েও প্রথম প্রথম খুব একটা ধারে কাছে ঘেঁসতো না।
আদ্যপান্ত তোর লেখা ডাইরীগুলো পড়ে ফেললাম।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
সত্যি তুই খুব ভাল লিখেছিস। ডেট তারিখ ধরে ধরে।
মিত্রা আমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। দু-জনেই আমার পাঞ্জাবীর তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে।
এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। তবে আমার জ্ঞান ফিরে আসার দিন কিংবা তার দিন দুয়েক পর তুই লিখেছিস। তোকে নিয়ে ডাক্তারদাদা আমার ঘরে গেছে। ইমোসন্যালি বলে বসেছে, জানিস মামনি, আমি যাকে ভালোবাসতাম সে যদি আমাকে একটা সন্তান উপহার দিত তাহলে তার বয়স অনির মতো হতো, আমি কোনও কিছুর বিনিময়ে ওকে হারাতে চাই না।
মিত্রার চোখ দুটো চক চক করে উঠলো।
সেদিন আমি আর একটা জিনিষ রিয়েলাইজ করতে পেরেছিলাম, ডাক্তারদা তোকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসে। হারিয়ে যাওয়া জিনিষ ফিরে পাওয়ার যে আনন্দ সেদিন ডাক্তারদার চোখে মুখে ফুটে বেরচ্ছিল। মিত্রা বললো।
এ্যাচিভমেন্ট।
ইয়েস।
তনুকে ব্রিফ করেছিলি?
জিজ্ঞাসা কর প্রত্যেক দিন নিয়ম করে।
তোর ওই দু-টো লাইন ভীষণ স্ট্রাইক করল মনে।
দু-দিন ধরে শুধু ভাবলাম। তারপর লেগে পরলাম, দেখি না খুঁজে পাওয়া যায় কিনা।
ডাক্তারদাদার সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা নেই, যতটুকু দাদার মুখ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম, সেটা কাজে আসবে না। ডাক্তারদাদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে আর.এল. দাস, রথীন চ্যাটার্জী। একজন মারা গেছেন একজন বেঁচে। দেখি রথীন চ্যাটার্জীকে একটা খোঁচা মেরে কিছু পাওয়া যায় কিনা।
বুজুম ফ্রেন্ডরা এরকম খবর অবশ্যই জানবে।
গিয়ে দেখলি রথীন চ্যাটার্জী ওই বাড়িতে থাকে না। পুরোটাই দিদিভাইয়ের স্কুল হয়ে গেছে।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
তোকে বলবো কখন, তুই আমাকে সময় দিস। তোকে যে কতো কথা বলার আছে আমার আর তনুর, তার ইয়ত্তা নেই। তুই তোর তালে থাকিস।
দুজনকে আরও নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিলাম।
তারপর।
ফিরে এলাম।
দিদিভাইয়ের সঙ্গে দেখা করিস নি?
না। সুমন্তর কাছ থেকে এ্যাড্রেস জোগাড় করলাম। ও প্রায় চেকআপ করাতে যায়।
একদিন রথীন ডাক্তারের সল্টলেকের বাড়িতে গেলাম। আমাকে দেখে বুড়ো খুব খুশ। পর পর তিন চারদিন খেপে খেপে গেলাম। গল্প করি। বুড়োর কলেজ লাইফের গল্প। একদিন ফাঁদ পাতলাম বুড়ো বে-ফাঁস বলে ফেললো। সামন্ত বড়ো ডাক্তার হলে কি হবে ভীষণ ভীতু।
কেন!
ওই জন্যই তো চিরটাকাল কুমার থেকে গেল। আর মেয়েটা রাগে, অভিমানে আর একটাকে বিয়ে করে দেশ ছাড়া হলো।
তাই! উনি এখন ইন্ডিয়াতে থাকেন না?
শুনলাম ফিরে এসেছে।
তোমার সঙ্গে যোগা যোগ নেই?
একবার পেসেন্ট পাঠিয়েছিল তখন জানতে পারলাম।
তারপর।
এখন প্রায়ই পেসেন্ট পাঠায়। যোগাযোগ বলতে এইটুকু।
আমি চ্যাপ্টারটা ওখানেই ক্লোজ করে দিলাম, আর আগে বারলাম না। শুধু নাম এ্যাড্রেসটা মনে মনে মুখস্থ করে নিলাম।
রথীন ডাক্তারের কাছে যাই গল্প করি তবে ডাক্তারদাদার চ্যাপ্টার ক্লোজ।
মিত্রা মুচকি মুচকি হাসছে।
দেখলাম এ্যাড্রেসটা শ্যামবাজার অঞ্চলের।
একদিন গেলাম। খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম ওনার চেম্বারটা মনীন্দ্রনাথ কলেজের গলিতে।
সেখানেও একদিন ঢুঁ মারলাম। দেখলাম নাম লেখা আছে সোনালি সোলাঙ্কি। দূর থেকে একদিন দেখলাম। দেখে তো আমি ভিমরি খেয়ে যাই। এই বয়সে যদি এতো সুন্দরী দেখতে হয় তাহলে ইয়ং বয়সে কি ছিলেন। ডাক্তারদাদা এইরকম একজনকে পটিয়ে শেষে ছেড়ে দিল।
তনু খোঁচা মারলো।
তোমার থেকে দেখতে যথেষ্ট সুন্দর।
আহা আমি যেন সুন্দরী।
তারপর বল। মিত্রা স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।
শ্যামবাজার থেক আমি আমার হস্টেল পাড়ায় এলাম।
প্রথমে ভেঁদোদার সঙ্গে দেখা করলাম। তারপর সর্বেশ্বর জ্যেঠু, শেষে পদুকে ডেকে পাঠালাম।
তারমানে পদু তোর অপারেটর হলো।
হ্যাঁ।
বুঝলি তনু। কার বাপের সাধ্য খুঁজে পাবে। তনু, মিত্রা দু-জনেই হাসছে।
পদু প্রাণঢেলে কাজটা করলো। পাই টু পাই ডিটেলস আমাকে জোগাড় করে দিল। মেডিকেল থেকেও সেই সময়কার ডিটেলস তুললাম।
গেলি কি করে সেটা বল।
তাড়াহুড়ো করলে হবে না।
দুটো বাজে।
ঘুমিয়ে পর।
মহা জ্বালাও তো। তনুর মুখে বিরক্তি।
তাহলে কাঁঠাল খেল পেট ফুললো মরে গেল।
ঠিক আছে বল। মিত্রা বললো।
উনি পেড্রিয়াটিকের ডাক্তার। পদুকে বললাম পেশেন্ট জোগাড় করা শুরু করে দে, ভিজিট ফি আমার। গোটা দশেক পেসেন্ট নিয়ে যাবার পরই মুখ চেনা হয়ে গেল। তখন ভিজট ফি হাফ হয়েছে। আন্টি ডাকতে শুরু করেছি। আমি অনি ব্যানার্জী কাগজের অফিসে কাজ করি। নেশা জনসেবা।
আমি একটা সমাজসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত তাই এই সব কাজ করি।
একদিন ওই এলাকার দাদাদের চাঁদার জুলুম থেকে আন্টিকে রক্ষা করলাম। আরও কাছে পৌঁছে গেলাম। পদুর পেট ফুলে যায়, তুই এতো আদাজল খেয়ে পরে আছিস কেন।
পদুকে ধমক দিলাম, খালি ভ্যাড় ভ্যাড় করে, সময়ে জানাব।
একদিন একা গেছি। পদুর দেওয়া পেসেন্ট নিয়ে। কথায় কথায় আন্টি বলে ফেললো, আমাকে একটা কাজের লোক জোগাড় করে দাও না। আমার সঙ্গে থাকবে।
কেনো বাড়িতে লোকজন নেই?
আমি একা থাকি। যে মেয়েটা ছিল সে দেশে গেল আর এলো না। এই মওকায় আন্টির ফোন নম্বর নিয়ে নিলাম।
প্যাডে লেখা ছিল না? মিত্রা বললো।
ওটা আন্টির যিনি এ্যাপয়েন্টমেন্ট নেন তার।
পদুকে বলে কয়ে ওর মেয়েটাকে ফিট করলাম। ওকেও বললাম মা তুই আমাকে মাস তিনেকের জন্য সাহায্য কর। পদুর মেয়ে আমার কথা শুনে হাসে।
কাকা তুমি ওইভাবে বলো না।
ওকে নিয়ে গেলাম।
ওর নাম কি? তনু বললো।
অজন্তা।
আন্টিকে ফোন করি, পেসেন্টের কথা বলি, খবরা খবর নিই। বাড়িতে যাওয়া আশা শুরু করলাম। অজন্তা আমার মেন টিপার, ওর কাছ থেকে পুরো ফ্যামিলি হিস্ট্রি জোগাড় করে নিলাম। তবে বাচ্চা মেয়ে সবটুকু দিতে পারে নি। মাস দুয়েক হয়ে গেল, তোদের আসার সময় হয়েছে। আমি আপনি থেকে তুমিতে চলে গেছি।
একদিন আন্টিকে নিজেই ফোন করে বললাম তুমি আমাকে একটু সময় দেবে, আমার দরকার আছে। বললো অজন্তা আটটার সময় চলে যাবে, তুই বরং তারপর আয় শোবার আগের সময়টুকু গল্প করা যাবে।
ঠিক সময়ে পৌঁছে গেলাম।
জ্যেঠিমনির কাছে যেদিন সকালে গেলাম সেদিন আমার বিয়ের রিসেপসন ছিল, আজ লবডঙ্কা। কিন্তু মনে মনে ঠিক করে নিলাম আজ আমার বানটা মেরে দিয়ে আসতে হবে। লাগে তাক না লাগে তুক। আজই হয়তো আন্টির সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎকার।
গেলাম। অজন্তা চা খাওয়াল।
আমার একটা এ্যাডভান্টেজ ছিল আন্টি দীর্ঘদিন কলকাতায় না থাকর ফলে সেই সময়কার কয়েকজন ছাড়া সবাইকেই প্রায় ভুলে গেছিল।
ততদিনে তুই পুরো পড়াশুন করে রেডি। মিত্রা বললো।
হ্যাঁ।
তনু হাসছে।
সেদিন প্রথমে আমি নিজের পরিচয় দিলাম। আমি শুধু সাংবাদিক নয় আরও অনেক কিছু। এমনকি তোর নার্সিংহোমগুলোর কথা বলতে চিনতে পারলো। বললো আমি ওই নার্সিংহোমে যাই অপারেশন করার জন্য। নীরুর নাম বললো, বললাম চিনতে পারছি না।
মালিক মানুষ বোঝই তো সব। কথা বলতে বলতে একবারে শেষে এসে ডাক্তারদাদা, রথীন ডাক্তার, আর.এল. দাসের নামটা ছুঁয়ে দিলাম। আর.এল. দাস মারা গেছেন সেটাও জানিয়ে দিলাম। রথীন ডাক্তারের বৃতান্ত বললাম, শেষে ডাক্তারদাদাকে নিয়ে পরলাম। ডাক্তারদাদা আমাদের নার্সিংহোমগুলো দেখা শোনা করে সেটাও জানালাম।
বললো জানি।
সেদিন আর এগোলাম না। বললাম আন্টি আজ উঠি।
আসার সময় বলে এলাম প্রফেশনালি আমার নার্সিং হোম নিয়ে তোমার যদি কোনও সমস্যা থাকে তুমি ডাক্তারদাদার সঙ্গে যোগা যোগ করতে পারো। উনি এখন লন্ডনে আছেন।
ফোন নম্বরটা দিয়ে এলাম।
আসার সময় শুধু মুখটা লক্ষ্য করলি কতোটা পরিবর্তন হলো।
হ্যাঁ।
এটা কবে বলো তো। তনু বললো।
ওইটা বলবি? মিত্রা বললো।
হ্যাঁ। তোমার মনে আছে?
কি বলতো? আমি বললাম।
তুমি আগে বলো কবে।
যতদূর মনে পড়ছে তোরা ফিরে আসবি তার দিন পনেরো কি মাস খানেক এরকম সময় হবে। মাঝে অসুস্থ হলাম। অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে।
খবরটা প্রথম বুঁচকি, তনুকে দেয়। জানো ছোটোমা, ডাক্তারদাদাই প্রেম করে। মিত্রা বললো।
আমি হাসছি।
হ্যাঁগো বুঁচকি কেমন একটু আদো আদো স্বরে কথা বলে। আমি মিত্রাদি হেসে মরি।
তনু হাসতে হাসতে বললো।
তারপর শোন না। প্রায়ই দেখি বুঁচকির সঙ্গে ডাক্তারদাদার লেগে যায়। দাদাই, নাতনির তুমুল চলে। এর মধ্যে ইসলামভাইয়ের ঘটনা ঘটে গেছে। বুঁচকিকে অবিশ্বাস করতে পারি না।
তনুকে বললাম, তুই খেয়াল রাখ। আমি ইন্টারেস্ট দেখালে যদি কিছু ভাবে।
তনু কনফার্ম নিউজ দিল। বেশির ভাগ সময় ডাক্তারদাদা বিকেলের দিকে কথা বলে তারমানে এখানে রাত্রি দশটা এগারটা। ব্যাশ এই পর্যন্ত তারপর আর এগুইনি। বড়োমা একদিন জিজ্ঞাসা করাতে বললো, আমার কলিগ, নার্সিংহোমে একটা সমস্যা হয়েছে সাহায্য চাইল।
আমরা দু-জনে লক্ষ্য রেখেছিলাম। ডাক্তারদাদা কিন্তু পার্টিকুলার একটা টাইমে রেগুলার কথা বলে।
তারপর তুই অসুস্থ হয়ে গেলি। সে নিয়ে একটা টেনশন, উনামাস্টার মারা গেলেন। তোকে যে জিজ্ঞাসা করবো তুই কিছু জানিস কিনা, সব কেমন ওলট পালট হয়ে গেল। আবিদের রিসেপশন, অনিকা কেশ, সব একবারে জট পেকে জঞ্জাল।
তারপর বল।
মাঝে দিনকুড়ি যোগাযোগ ছিল না। আমার অসুস্থতা। সে খবরটাও বুড়ির কাছে পৌঁছে গেছিল অজন্তার সৌজন্যে। তোরা আসার পর আমাকে একদিন ডেকে পাঠাল। আমি জানতাম না এর মধ্যে ডাক্তারদাদার সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু বুড়ির হাবভাবে বুঝতাম আমি আগের থেকে অনেকটা বেশি আপন হয়ে পড়েছি।
তোরা এলি। একদিন এনজিওতে ডাক্তরাদাদা আমাকে সরাসরি ব্যাপারটা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো।
আমি ন্যাকা সাজলাম। ডাক্তারদাদার চোখ, পরে বললাম হ্যাঁ আমি যাই।
তুই খবরটা কোথা থেকে পেলি?
বললাম।
ভেতরের ব্যাপার কেউ জানে কিনা?
বললাম, না।
আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে।
বললাম, তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পার।
তখন নিজে স্যারেন্ডার করলো।
জানিস অনি আমার জীবনটা অনেকটা তোর মতো।
আমিও গ্রামের ছেলে। থাকতাম হিঙ্গলগঞ্জে। অনেক কষ্টে বড়ো হয়েছি। আমার বাবা-মাও একপাল ভাইবোন রেখে মারা গেল। কাকারা প্রথম প্রথম দেখেছে, তারপর আর দেখেনি। ফলে ভাইবোনদের দায়িত্ব আমার ঘারে। তখন বিয়ে করার কথা মাথায় ঢোকাইনি।
সোনালীরা রাজস্থানী ব্রাহ্মণ আমরা নিচু জাত। সেখানেও একটা গণ্ডগোল। ওর পরিবারও ঠিক ঠিক মেনে নিল না। সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল। বিয়েটা আর হলো না।
তবে ওর সঙ্গে দু-তিনবার শারীরিক সম্পর্ক করেছি। এটুকু স্মৃতি নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিলাম। সব ভাই বোনকে দাঁড়-টার করিয়ে দিয়ে যখন বিয়ে করার সময় হলো, তখন দেখলাম বুড়ো হয়ে গেছি। সোনালী সংসারী হয়েছে তিন ছেলে-ময়ের মা। ওর স্বামীও ডাক্তার, রাজস্থানী ব্রাহ্মন। তারপর ওরা লণ্ডন চলে গেছে।
তুমি খোঁজ খবর রাখতে না?
প্রথম প্রথম রাখতাম। তারপর যা হয় আর কি, আউট অফ সাইট আউট অফ মাইণ্ড। একবারে যে ভুলে গেছি সেটা বললে অন্যায় হবে।
ফোনটা পেয়ে তোমার কিছু মনে হয়নি?
ওতো আমাদের নার্সিং হোমের সঙ্গে এ্যাটাচ, তবে সেই ভাবে নয়। অপারেশনের জন্য মাঝে মাঝে ভাড়া নিত। প্রথম যেদিন ফোনে কথা হয় সেদিন সেই ভাবেই বললো। আমিও নীরু, কনিষ্কর কথা বললাম।
তুমি জানতে উনি কলকাতায় ফিরে এসেছেন?
কেন জানবো না। ওর বড়ো ছেলে এখানে বিরাট নার্সিংহোম করেছে। দুই ছেলেই ডাক্তার।
আন্টি জানতো না?
জানতো। তবে কোনওদিন কথা হয়নি। মাঝে মাঝে পেসেন্ট পাঠাত।
রাজস্থান ছেড়ে এখানে ইনভেস্ট করলো?
ওরা রাজস্থানী হলেও, ওদের শেকড়টা কলকাতা। ওদের আত্মীয়-স্বজনও কলকাতায় বেশি। অনেক দিনের বাসিন্দা। ওর বাবার বড়বাজারে বিশাল ব্যবসা ছিল।
তারা কেউ কিছু জানে?
ওই সময় ওদের পরিবারের কেউ কেউ জানতো। ওর বাবা-মাও জানতো। আজ পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল কে মনে রেখেছে বল।
তুমি যে সংসার করোনি আন্টি জানে?
জানতো না। এখানে এসে জেনেছে।
ফোনে কথা বলা ছাড়া একবারও দেখা করেছো?
না। আর ভালো লাগে না। সেই মনটা মরে গেছে।
মিত্রা, তনু দুজনে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
আজ দেড়-দু-মাস তোরা কেউ কিছু জানতে পেরেছিস?
না। মিত্রা বললো।
আমি শুধু ডাক্তারদাদার মুখে ঝাল খাইনি, আন্টির মুখেও ঝাল খেয়েছি।
কিরকম! তনু আমার বুকে উঠে এলো।
খুব ইন্টারেস্ট, না।
হবে না। আমাদের লাইফটা ফিরে পাচ্ছি যেন।
ডাক্তারদাদার মন দেওয়া নেওয়া শুরু সেকেন্ড ইয়ার থেকে। ডা. দাস আর রথীন ডাক্তার ছাড়া বিশেষ কেউ জানত না। তবে ডাক্তারদাদা যখন চাকরি নিয়ে ম্যাড্রাস গেলেন সেই সময় আন্টির সঙ্গে শেষ দেখা। আন্টি ম্যাড্রাস গিয়ে তিনদিন ছিল।
সেই জন্য ডাক্তারদাদা ম্যাড্রাসের চাকরি ছেড়ে চলে এসেছিল।
হ্যাঁ। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ডাক্তারদাদার ওপর তখন সাত-ভাইবোন তার মধ্যে তিনটে বোন। আন্টি বলেছিল আমার বাড়ির ব্যাপারটা আমি বুঝে নেব, তোমাকে বুঝতে হবে না। তাছাড়া দুজনে চাকরি করবো, ঠিক সামলে নিতে পারবো।
কথা বলতে বলতে আন্টি কেঁদে ফেলেছিল।
জানিস অনি, অজুর জন্য তখন আমি পাগল। আমার পরিবার ভালোছেলের সন্ধান পেয়েছে। বাড়িতেও কিছুটা জানতে পেরেছে। কেউ রাজি নয়। আমার ওপর বিয়ে করার চাপ বাড়ছে।
ইন্টারভিউ দেওয়ার নাম করে চলে গেলাম ম্যাড্রাস। ওর সঙ্গে মিট করলাম। ওকে কত করে বোঝালাম। এক কথা আমার ওপর অনেক দায়িত্ব সোনা। আমাকে কিছুটা সময় দাও। তাছাড়া তোমার পরিবার মনে নিচ্ছে না। আমি নিচু জাত। আমার মা-বাবা নেই তোমাকে বিবাহ করে একজন গার্জেন পাব তারও সম্ভাবনা নেই। এক জীবনে যে সব পাব তার কি অর্থ আছে।
তিনদিন ছিলাম। তোকে আজ বলছি, আমার একটুও সঙ্কোচ নেই।
চলবে —————————–
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/KPm1zWf
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment