কাজলদিঘী (১৮৮ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৮৮ নং কিস্তি
—————————–

রতনদা সামনের দিকে তাকাও। সুরো সামনের সিট থেকে বলে উঠলো।

দেখে কি করবো। সুকান্তদা পুরো টিম নিয়ে দাঁড়িয়ে। এতক্ষণে দেখো টিভিতে কতবার সুকান্তদার মুখ দেখিয়েছে কে জানে। কালকে আবর কাগজে সুকান্তদার ছবি ছাপা হবে।

আমি রতনের মাথায় একটা চাঁটা মারলাম।

আমাদের গাড়িটা সুকান্তদের গাড়িটাকে একটু ছাড়িয়ে এসে রাস্তার বাঁদিক ঘেঁষে দাঁড়াল।

আমাদের দেখা দেখি পর পর পেছন পেছন গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে।

বড়োমার গাড়িটা একবারে সুকান্তদের গাড়ির সামনে।

সূর্য একবারে পশ্চিমদিকে হেলে পড়েছে। আর দেখা যাচ্ছে না। তবে তার আলোর রেশ আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন আকাশটার রং একবারে কমলা।

পাশ দিয়ে হুস হুস করে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ঠিক অপরজিটে ঝুপড়ি মতো একটা চায়ের দোকান। বেশ কয়েকজন সেখানে বসে আছে। একটু দূরেই রাধামনি।

গাড়ি থামতেই মিত্রারা নেমে পড়েছে। মিলিরাও পেছনের দরজা খুলে নেমেছে। সুকান্ত বড়োমার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। শুভরা দেখলাম গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে ঝুপড়ির দিকে গেল।

মাম্পি, মিকি সিট টপকে আমার কোলে চলে এলো।

তোমাকে আবার দুষ্টুরা ধরতে এসেছে।

মাথা দোলালাম। না।

মিকি দরজাটা বন্ধ করে দে।

আমি মাম্পির কথা শুনে হাসছি।

তখন কটা মোয়া খেলি।

একটা।

আমাকে দিলি না।

আছে, বাড়ি চলো দিম্মা দেবে।

তোদের দেব না।

মিত্রারা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। খোলার চেষ্টা করলো খুলতে পারলো না।

মাম্পিরা ভেতর থেকে লক করে দিয়েছে।

কিরে খোল, মনি এসেছে।

না।

ওরা ধরে নিয়ে যাবে না। তুই খোল।

মিত্রারা ওখান থেকেই মাম্পি, মিকির মাথা ভাঙছে। হাসাহাসি করছে।

বড়োমারাও সবাই গাড়ি থেকে নেমে এসেছে।

আমি লকটা খুলে দিলাম, মিত্রা দরজা খুললো।

সুকান্ত হাসছে।

তুমি নামবে না।

নেমে কি করবো।

বাঃ এতো বড়ো একটা কাজ করলাম। একটা থ্যাঙ্কস দাও কমসে কম।।

হাঁস ডিম পারলো, খেলো দারগা। আমার ফয়দা কি বল?

উদয় দাদার কথা শুনছো। বড়োমা, ছোটোমাকে দেখলে। এবার দাদাকে দেখ। আজ আমাকে যে জায়গায় দেখছো সব দাদার জন্য। দাদা না থাকেলে, যেখানে ছিলাম সেখানেই পচে মরতাম।

উদয় এগিয়ে এসে পায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করলো।

আরে থাক থাক আমি নামছি দাঁড়াও।

না। মাম্পি গম্ভীর।

কেন।

ওরা দুষ্টু।

সুকান্ত হাসছে।

কনিষ্কদার মেয়েটা তো বড়ো কটকটি।

কটকটি কি গো তোমরা ওর আঙ্কেলকে ধরতে এসেছো না। মিত্রা বললো।

সুকান্ত, উদয় দুজনেই হাসছে।

বুবুনের আসল বডিগার্ড। তোমরা কেউ ধোপে টিকবে না।

আমি হাসছি।

মাম্পি, মিকির দিকে তাকালাম।

চল নিচে যাই।

ওরা ধরবে না।

না।

উদয় হাসছে।

আমি ছেলেটির দিকে তাকালাম। বেশ দেখতে। এক ঝটকায় যে কোনও মেয়ে প্রেমে পড়ে যেতে পারে। ফিগারটাও তেমনি। বেশ লম্বা চওড়া। পুলিসে চাকরি করতে হলে এমন ফিগার দরকার।

উদয় তোমাকে মাপা শেষ। সুকান্ত হাসতে হাসতে বললো।

উদয় মুচকি মুচকি হাসছে।

চিনতে পারলাম না। সুকান্তর দিকে তাকালাম।

তোমার ওখানকার থানার ওসি। অনাদিদা সুন্দরবোনে পাঠিয়ছিল, তুলে নিয়ে এসেছি।

তাই!

হ্যাঁ তাই। তোমার কাছে যেন কোনও খবর নেই।

মিলিরা হাসছে।

আমি এবার বাইরে বেরিয়ে এলাম।

সুবীরদা দাদার আত্মীয় একবারও বলেনি। উদয় বললো।

বললে তোমার কাছ থেকে এ্যাডভান্টেজ নেওয়া হয়ে যাবে তাই বলেনি।

ইসলামভাই-এর সঙ্গে কতবার দেখা হয়েছে একবারও কিছু বলেনি।

আরও কিছুদিন যাক বুঝতে পারবে। তুমি দাদার বাড়ির ভেতরে ঢুকেছো।

কোনটা?

সুবীরদা যে বাড়িতে থাকে তার পাশেরটাই দাদার বাড়ি।

ঢোকা হয়নি। আমি সামনের যে ছোটো মাঠটা আছে ওই পর্যন্ত গেছি। আর এই বাড়ির দালানে যে বেঞ্চটা আছে, সেখানে বসেছি।

চিকনাদাকে দেখেছো?

চিকনাদাকে দেখবো না। আরি বাবা।

আমি হাসলাম।

চিকনাদা দাদার শুধু বন্ধু নয় আরও অনেক কিছু। যা কাণ্ড সকাল থেকে দেখলে সব চিকনাদাকে গুলি করার জন্য। না হলে আরও কিছু দিন ধামা চাপা পরে থাকতো।

সুকান্ত, শ্রীবাস্তবরা কোথায়?

তোমার কথা মতো ওখানে ঝাঁপি ফেলেছে।

এদিকে আয় তোর সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।

সুকান্তর সঙ্গে সঙ্গে মিত্রারাও হেসে ফেললো। আমি সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।

সুকান্ত আমার পেছন পেছন এগিয়ে এলো।

উদয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে।

ওদের সঙ্গে একটু তফাৎ রেখে দাঁড়ালাম।

মনীশকুমারের খবর কি?

উনডেড।

কোথায় রেখেছিস?

আমার পরিচিত একটা নার্সিংহোমে।

এ্যারেস্ট করেছিস?

না।

কেন?

প্রবীরদা না বললো।

প্রবীরদাকে সব ব্যাপারটা জানিয়েছিস।

অফিসিয়াল জানাইনি। এমনি সমস্ত ঘটনা বলেছি।

কি বলছে?

বললো একটু ভাবতে দে তারপর তোকে বলছি।

মনীশ কি বলছে?

কি বলবে। ধরা খেয়ে গেছে।

মরেছে কারা?

দিবাকরদা যাদের নিয়ে এসেছিল।

তুই কাদের দিয়ে অপারেসন করিয়েছিস?

কলকাতার টিম। শ্রীবাস্তব, সেন, মহান্তি ছিল।

দিবাকর কোথায়?

রিক্স নিই নি, কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছি।

সবকটাকে।

হ্যাঁ তিনজনকেই পাঠিয়ে দিয়েছি।

অনাদি, সাগরের খবর কি?

শুনলাম দুটো বাচ্চা ছেলে নাকি গুলি করেছে। এখনও আঠারো বছর হয়নি। জুভেনাইল কেশ।

বাঁচবে না মরবে?

সুকান্ত আমার চোখে চোখ রেখেছে। ইনজিওর্ড হয়েছে, বাকিটা খবর নিইনি।

অনিমেষদাকে কিছু বলেছিস?

দাদার সঙ্গে কথা বলার মতো সাহস আমার নেই।

আলতাফরা ওখানে রয়েছে।

কেন! তুমি নিয়ে চলে আসতে পারতে।

মন চাইল না।

আমি রাতে শ্যামদার সঙ্গে কথা বলে নেব। আমাদের এখানে ওদের কোনও রেকর্ড নেই।

যেটা ভাল বুঝবি করবি। আমি আগামী সপ্তাহে এখানে আসব।

হ্যাঁ বিরাট প্রোগ্রাম। প্রবীরদা বলেছে।

কালকে এদের কোর্টে তুলবি?

কালকে এখানকার কোর্টে তুলবো। তারপর কলকাতার টিম ওদের হেপাজতে নিয়ে নেবে। এরপর মুম্বাইয়ের টিম আসবে।

ফাইলটা ভাল করে গুছবি, যেন ফাঁক না থাকে, পারলে অনুপকে ফোন করে নিবি।

সকালে একবার কথা বলেছি।

আমি হাসলাম। দেরি করবো না। গিয়ে লিখতে বসতে হবে।

যাও।

এরিমধ্যে সেই ঝুপড়ির দোকান থেকে চা এসেছে। সুকান্তর সঙ্গে যারা এসেছিল তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম। এরই ফাঁকে উদয়কে বললাম নীপাদের ঠিক ঠাক পৌঁছে দিও।

উদয় হাসলো।

আপনি না বললেও এই দায়িত্বটা আমার।

সেদিনকে এই তল্লাটে যে সব ঘটনা ঘটেছিল তার ফাইল রেডি করেছো?

ওটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সুকান্ত বললো।

পাওয়রাটা এখন আমার হাতে, তাছাড়া সুকান্ত এখন কাজলদীঘির ওসি নয়। এই ডিস্ট্রিক্টের এসপি। মনে করলে সে অনেক কিছু করতে পারে।

তুই তো আমার সব জানিষ আমাকে এ্যারেস্ট কর।

খেপেছো। তারপর সুখে থাকতে ভূতে খাবে।

সুকান্ত হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরলো।

কলকাতায় এরমধ্যে আসবি?

বলত পারছি না। ডেকে পাঠালে আসবো। তুমি আরও প্রেসার তৈরি করে দিলে।

নিতে পারবি বলে তৈরি করেছি।

সে তো অবশ্যই। আমি কখনও না করেছি। কাল রাতেও তুমি যখন দোনোমনো করেছো, আমি বলেছি, সুকান্তকে একবার চান্স দিয়ে দেখো না সে পারে কিনা। আশা রাখি তোমার বিশ্বাস ভাজন হতে পেরেছি। বাই দা বাই তোমাকে একটা কথা গোপন করেছিলাম। কাজ শেষ এবার বলেফেলি।

সুকান্তর মুখের দিকে তাকালাম।

তোমার কাছ থেকে কাজটা নেওয়ার পর একমাত্র তিন্নীকে বলেছিলাম।

কেন মরে যাবার ভয় ছিল?

সুকান্ত আমার মুখের দিকে তাকাল।

আমি কিন্তু সাইড লাইনে বহু খেলোয়াড়ক বসিয়ে রেখেছিলাম।

সুকান্ত মুখ তুলে হাসছে।

আমি তোমার ভাই। তোমার ভাইকে মরে দিয়ে কেউ চলে যাবে এটা হয় নাকি।

যাইরে, না হলে ফিরতে রাত হয়ে যাবে।

তিন্নী একবার তোমার কাছে যেতে চায়।

নিয়ে আসিস।

আবার যাত্রা শুরু। যে যেরকম ভাবে এসেছিলাম সেই ভাবেই বসলাম। শুধু গাড়িতে ওঠার সময় বড়োমাকে বললাম, আমি ফেরার পথে অফিসে নামবো। কাজ সেরে বাড়ি ফিরবো।

বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো, কিছু বললো না।

আমি এসে নিজের জায়গায় বসলাম।

সেকেন্ড হুগলি ব্রিজে ওঠার সময় সুরো বললো, আমি তাহলে এদের নিয়ে বড়োমার গাড়িতে উঠে যাই।

কেন?

তুমি তো অফিসে যাবে।

আমি নেমে গিয়ে বরং একটা ট্যাক্সি ধরে নেব, তোরা বাড়ি চলে যাবি।

তনু ফিক করে হেসে উঠলো।

আবার কিছু নিশ্চই প্ল্যান ভেঁজে রেখেছো।

তনুর দিকে তাকালাম।

আমি, মিত্রাদি একটু অফিসে যাব।

কি করতে।

কাজ আছে।

কোনও কাজ নেই, থাকলে কাল এসে করবে।

শেখার কি আর শেষ আছে। তনু বললো।

যা শিখেছো তাইই ইমপ্লিমেন্ট করত পারছ না। আবার শেখা।

বেশি ঝামেলা করিস না। মিত্রা গম্ভীর হয়ে বললো।

ভিউং গ্লাস দিয়ে দেখলাম রতন মুচকি মুচকি হাসছে।

চল তোদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আমি বেরব।

মাথায় রাখবি অফিসের মালকিন আমি। তুই আমার অধস্তন কর্মচারী।

ঘেঁচু। খাতাকলমে দেখাতে পারবি।

আমার সাইন করা প্রেসকার্ড তোর পকেটে আছে। মিলি, টিনা, অদিতি তার স্বাক্ষী।

কেন আমি নেই। তনু বললো।

বড়োমা ফুসমন্তর দিয়েছে, ওর পাশে দু-জনে এঁটুলে পোকার মতো সেঁটে থাকবি।

মিত্রা হেসে ফেললো।

দু-জনে মিলে ঘাড়টা একবারে মুটকে ভেঙে দেব বুঝলি।

মিত্রা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এলো। তনু হাতদুটো ধরে ফেলেছে। মাম্পি-মিকি পেছন দিকে তাকিয়ে হি হি করে হাসছে।

দেখ ওরাও তোকে চিনে গেছে।

না চেনার কি আছে, আমি কি….।

আবার কথা।

রতন গাড়িটা ব্রিজ থেকে নামিয়ে রেসকোর্সের মেনগেটে দাঁড় করালো।

নিজের দিকের দরজা খুলে রতন নেমে এসে সুরোর দিকে দরজাটা খুললো।

তুমি কি করে ওদের নিয়ে বসো বলোতো। সুরো আমার দিকে তাকাল।

কেন।

পা ধরে গেল।

তোদের পা রয়েছে, আমার পা নেই সব বেশো কাঠ।

দেখলে, দেখলে বৌদি ট্যাঁঙ্গস ট্যাঁঙ্গস কথা শুনলে।

কেন বললো বুঝলি না।

সুরো মিত্রার দিকে তাকিয়ে থাকলো।

ওই যে ওর সঙ্গে অফিসে যাব, সহ্য হচ্ছে না। তাই তকে একটু ছুঁয়ে দিল।

মিলিরা জোড়ে হেসে উঠলো।

কি হলো বসে রইলে, নেমে ও গাড়িতে চলে যাও। মিলিদের দিকে তাকালাম।

আমরাও যাব, মিলি বললো।

তোমরা কি করতে যাবে।

আমাদেরও কাজ আছে। অদিতি বললো।

দেবা বিধবা হয়ে যাবে।

হয়ে যাক, পারলে আর একটা বিয়ে করুক কিছু যায় আসে না।

আঙ্কেল তুমি যাবে না। মাম্পি চেঁচিয়ে উঠলো।

আমি এখুনি ফিরে আসছি, ঘুমবি না।

ইসলামভাই গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

মামনি রাতে আর রান্না করে লাভ নেই খাবর কিনে নিয়ে যাই।

বড়োমা কি বললো।

দিদি বললো মিত্রাকে জিজ্ঞাসা কর।

জ্যাঠিমনি থাকবে না চলে যাবে।

দিদি থাকবে ইসিরা চলে যাবে।

বলো আজকে গিয়ে কাজ নেই কাল যাবে।

তোরা তাহলে বেরিয়ে যা।

আমি ইসলামভাই-এর দিকে তাকালাম।

পারলে একবার আবিদের ছেলেটার খোঁজ নেবে।

তুই মনে রেখেছিস! আমি তো ভাবলাম তুই ভুলেই গেছিস।

হাসলাম।

রতন চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ছোটোমারা কেউ গাড়ি থেকে নামেনি। আমরা রেড রোড ধরলাম। ওরা সোজা।

ফোনটা বার করে অর্ককে একটা ফোন লাগালাম।

বলো।

রেডরোড পেরচ্ছি।

খবর চলে এসেছে।

বাবা তোরা তো সব বড়ো খেলোয়াড়।

ছোট খেলোয়াড় হলে তোমার সঙ্গে টিঁকতে পারবো?

হাসলাম।

বলো।

লাইব্রেরী থেকে….।

ওই প্রিয়েডের কাগজ বার করে রাখতে হবে এই তো।

হ্যাঁ।

অরিত্র সব গুছিয়ে রখেছে। তোমার পেন-পেন্সিল, খাতা-কলম, জলের গ্লাস সব।

আমি হাসছি।

একটা রগড় হয়েছে জানো অনিদা।

কি বলতো।

সন্দীপদা আজ সবচেয়ে ব্যস্ত মানুষ।

কেন!

সকাল থেকে আমাদের দেখা পায়নি। সব এসে দুপুরের পর ঢুকেছি। তারপর এই সব ঘটনা ঘটেছে। খেপে লাল। আসতেই ঝাঁজিয়ে উঠলো কোথায় ছিলি সব, সকাল থেকে এতো নিউজ হয়ে গেল, আমি কি রাতে কলা চুষবো।

সায়ন্তন গম্ভীর হয়ে বললো, এখন কলার সিজিন, মর্তমান এখন দু-টাকা করে জোড়া চলছে, একডজন নিয়ে আসি চুষবে কেন, বসে বসে খাও ছাড়িয়ে দিচ্ছি।

খেপে লাল।

অনির জন্য সব কটা বড্ড বার বেরেছিস।

তারপর সুমন্ত এসে গম্ভীর হয়ে বললো, আমার কাছে যা লেটেস্ট নিউজ আছে তাতে অনিদা সন্ধ্যের দিকে অফিসে ঢুকছে। আজকের লিড স্টোরিটা নামাবে।

তোমায় কি বলবো অনিদা মুহূর্তের মধ্যে চেঞ্জ।

তুই সত্যি বলছিস!

সুমন্ত কোনও দিন যা তা নিউজ সাপ্লাই করেছে।

আমার আর অরিত্রর সঙ্গে আর কথাই বলেনি।

কিছুক্ষণ আগে মনে হয় সুমন্তকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে কি হলোরে। তারপর মনেহয় সুমন্ত বলেছে। তাড়াতাড়ি এসে তোমার চেয়ার টেবিল সব ঠিক ঠাক করে একটা নিউজপ্রিন্টের প্যাড, পেন, জলের গ্লাস সব রেডি করে রেখেছে।

বৃষ্টিকে ডেকে বলেছে তোকে দায়িত্ব দিলাম ঘরে ঢুকেই যেন মাথা গরম না করে তাহলে সব গুবলেট হয়ে যাবে। তুই পাশে পাশে থাকবি।

এখন কোথায়?

বাইরের লবিতে পায়চারি করছে।

আমি ঢুকছি।

এসো।

গেটের কাছে গাড়ি আসতেই মিত্রা নেমে দাঁড়াল।

মিলি আমার ব্যাগটা নামাস। তনু বললো।

তোমার আবার কিসের ব্যাগ। তনুর দিকে তাকালাম।

তোমার সব তাতে এতো ইন্টারেস্ট কিসের।

আমি নামলাম। দেখলাম সুবল গেটের মুখে দাঁড়িয়ে।

দরজা খুলে এগিয়ে এলো। মিলির হাত থেকে ব্যাগটা নিলো।

রতন কাছে এসে দাঁড়াল।

ম্যাডাম মোটামুটি ঘণ্টা তিনেক সময় পেতে পারি?

মিত্রা নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকাল।

কাছা কাছি।

কেন, তুই কোথায় যাবি! আমি বললাম।

একটা কাজ সেরে আসি।

তাড়াতাড়ি চলে আসবি।

আমরা ভেতরে ঢুকলাম। এই সময়টা ফাঁকাই থাকে। একসঙ্গে ওপরে উঠে এলাম।

মিত্রার ঘরের সামনে লাইট জ্বলছে। হরিদার ছেলে বসে আছে।

কিরে তুই বাড়ি যাস নি?

ম্যাডাম আজকের দিনটা একটু থাকতে বলেছেন।

দাদার ঘরের সামনে লাইট জ্বলছে কেন?

মিত্রা তাকাল হরিদার ছেলের দিকে।

নিভিয়ে দিচ্ছি।

তোর কি ভূতের ভয় আছে নাকি?

হরিদার ছেলে মাথা নিচু করে রইলো।

আমি নিউজ রুমে ঢুকতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। সন্দীপ বেরচ্ছিল।

কিরে কোথায় যাচ্ছিস?

তুই এসেছিস, তাই তোকে রিসিভ করতে যাচ্ছিলাম।

একবার ওর মুখের দিকে তাকালাম।

সন্দীপ হাসছে।

খিস্তী দিস না। চা খাবি?

আজকে যে কভার স্টোরিটা নামাব কত দিবি?

তুই অফিস বিল্ডিংটাই নিয়ে নে।

তোর মালকিন দেবে না।

শুধু আমার নয় তোরও মালকিন মাথায় রাখিস।

হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলাম। সন্দীপ আমার পেছনে।

নিউজরুমটা বেশ জমজমাট। অরিত্ররা দেখে হাসছে।

পুরো সেঁটে গেছে। অর্ক চেঁচাল।

কেন তুমি অনির নানা। সন্দীপ চেঁচাল।

এই তো অনুসরের জায়গায় ন’আকার বসিয়ে দিলে।

সন্দীপ হেসে ফললো।

দেখেছিস ছেলেগুলোর অবস্থা। মানতেই চায় না।

তোকে অসম্মান করে?

মিথ্যে বলবো না। যথেষ্ট সম্মান করে।

তাহলে?

সন্দীপ হাসছে।

লাইব্রেরী থেকে সব নিয়ে এসে রেখেছিস?

হ্যাঁ।

ছিদামকে একটু ঝপ করে চা আনতে বল।

তুই তোর টেবিলে বোস আনিয়ে দিচ্ছি।

সন্দীপের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।

তাড়াহুড়ো করবি না। তুই যা লাগবে বলিস, আমি তোকে সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছি।

দ্বীপায়ণকে একটু ডাক।

সুমন্ত হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।

বহুত বড়ো গেম খেললে। এবারও চান্স পেলাম না।

সুকান্ত ফোন করেছিল?

করবে না আবার। অপারেশন শেষ, ফোন লাগাল। ব্যাটা কেঁদে ফেলেছিল।

আয় চা খেতে খেতে কথা বলি।

ছিদামদাকে বলি।

সন্দীপ বলে দিয়েছে।

আমি টেবিলে এসে বসলাম। কাগজের ফাইলগুলো ডাঁই করে রয়েছে।

অরিত্রর দিকে তাকালাম।

একুশ বছর আগে নিজের লেখাটা দেখেছিস?

দেখেছি।

ঠিক পর পরই দিবাকরের ওপর একটা আর্টিকেল লিখেছিলাম না।

হ্যাঁ।

একটু বার কর।

ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ছিদাম চা নিয়ে এলো।

কিরে সব ঠিক ঠাক আছে?

খারাপ থাকবে কেন।

বাবাঃ তোরা সব আজকে ট্যারা ট্যারা কথা বলছিস কেন বলতো?

কোথায় ট্যারা ট্যারা কথা বললাম। খারাপ থাকলে তো বলবো।

চা খেতে খেতেই ওদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম।

ডিম টোস্ট নিয়ে আসবো?

ছিদামের দিকে তাকালাম।

করা করে ভাজবি। ঘুগনি আছে?

একটু দেরি হবে।

বানিয়ে আনবি?

হ্যাঁ।

যা। আমার জন্য একা আনিস না।

কোনওদিন একা খেয়ে দেখেছো, কেমন লাগে?

যা পালা, বুঝেছি আজ তুই পিকআপে আছিস।

অরিত্র, অর্ককে ওদের পার্ট বোঝালাম। লিখতে বসে যা। সায়ন্তনকে ছবি রেডি করতে বল।

আমি পুরনো কাগজগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। তারপর ডুব দিলাম লেখার মধ্যে। প্রায় দেড় ঘণ্টা আর পেছন ফিরে তাকাই নি। কি হচ্ছে, না হচ্ছে জানার কোনও প্রয়োজনই বোধ করিনি। ধীরে ধীরে একুশ বছর আগের ফেলে আসা জীবনের কাহিনী লিখলাম।

যেখানে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে দিবাকর, অনাদি, চিকনা, বাসু, অনি সকলে। ঠিক আমি নয়, আমার হয়ে যেন মিত্রা লিখছে।

মিত্রা তার চোখ দিয়ে দেখছে সেই সময়।

আজ আমি হারিয়ে গেছি। মিত্রার চোখ দিয়ে একুশ বছর আগের ঘটনার বর্ণনা করে যাচ্ছি। একে একে যেন প্রতিটি গ্রন্থির উন্মোচন হচ্ছে। আর আজকে সেই দিবাকর বাচ্চে সিং। কেন? কেন অনাদির এই পদস্খলন? এখন তার পরিবারের কি হাল? তার বাবা-মা কেমন আছে সব।

একের পর এক তার বর্ণনা।

এমন কি দুদিন আগে চিকনার গুলি খাওয়ার ঘটনাটাও বেশ সুন্দর করে ঢুকিয় দিলাম।

প্রায় দেড় ঘণ্টা মাথা গুঁজে লিখে গেলাম। মাথা তোলার ফুরসৎই পেলাম না।

লেখা শেষ হতে কলমটা প্যাডের ওপর রেখে আঙুলের মধ্যে আঙুল চালান করে মট মট করে আঙুল গুলো ফাটালাম চোখ বন্ধ করে ঝেড়ে একটা আলিস্যি ঝাড়লাম।

চোখ খুলতে দেখলাম তনু হাত পেতে সামনে দাঁড়িয় আছে।

হেসে ফেললাম।

শেষ স্লিপটা দাও?

তনুর চোখ দুটো অদ্ভূত লাগছে। যেন একুশ বছর আগের ঝিলিক তনুর চোখে মুখে।

এখনও শেষ হয়নি।

তুমি নিচে দাগ টেনে দিয়েছো।

নিজে নিয়ে নাও।

তুমি নিজে হাতে দেবে।

আমি প্যাড থেকে পাতাটা ছিঁড়ে তনুর হাতে দিলাম।

চেয়ার থেকে সামান্য ঘুরতেই চোখ পড়েগেল মল্লিকদার টেবিলের দিকে। মল্লিকদা আরাম করে হেলান দিয়ে বসে। টেবিলের আর একপাশে মিলি, অদিতি, টিনা, মিত্রা। অর্ক, অরিত্র, সন্দীপ, সুমন্ত আর একটা টেবিলে। দ্বীপায়ণ, সায়ন্তন, শুভ আর একটা টেবিলে ল্যাপটপ নিয়ে লড়ে যাচ্ছে।

ঠিক যেন একুশ বছর আগের একটা দিন মনে পড়ে যাচ্ছে। সেদিন পজিশনটা যেন আরও টাফ ছিল। কুশীলবেদের বয়স ছিল অল্প। ছিল চরম উত্তেজনা। বার বার মল্লিকদা বলেছে, দিদিকে একটা ফোন কর, তোর ছোটোমাকে একটা ফোন কর, মিত্রাকে একটা ফোন কর।

ফোন করিনি। উল্টে মুখ করেছি।

নিজের মনে নিজেই হেসে ফেললাম।

তনু ততক্ষণে মল্লিকদার টেবিলে চলে গেছে।

আমাকে দিয়ে আর লাভ কি। চোখ তো বোলালি এডিট করার দরকার আছে।

তনু মাথা দোলাল। না।

যা সন্দীপকে দে কম্পোজে পাঠিয়ে দিক।

দ্বীপায়ণ নিজের টেবিল থেকে চেঁচিয়ে উঠলো তনুদি তোমার সব ছবি রেডি। একবার দেখে নাও।

তনু আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো, তারপর দ্বীপায়নদের টেবিলের দিকে গেল।

আমি পায়ে পায়ে মল্লিকদার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালাম।

মল্লিকদার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললাম।

তুমি এসেছো!

তুই লিখবি, না এসে পারি। সকাল থেকে যা চলছে। এখানে আসার পর তবু একটু রিলিফ পেলাম।

কেন, আবার কি হলো?

কি হয়নি বলতো।

বড়ো সাহেবকে একটা ফোন লাগাও। একটু কথা বলে নিই।

মিলিরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

মল্লিকদা হাসছে।

হাসছো কেন?

এতো বুঝিস এটুকু বুঝিস না।

কি বলো?

লক্ষণ এলে রাম আসবে না।

দাদা অফিসে এসেছে! এত রাতে!

তোর আসার অনেক আগে থেকে এসেছে।

তাই তখন দাদার ঘরের সামনে লাইট জ্বলছিল?

আমি ভেতরে ছিলাম।

মিত্রার দিকে তাকালাম। ডাগর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

এই প্রথম নিউজরুমে ঢুকলি?

দ্বিতীয়বার।

প্রথম কবে ঢুকেছিলি?

সেই ঝামেলা হওয়ার সময়। তবে বাইরে থেকে বহুবার দেখেছি, ভেতরে আসা হয়নি।

সন্দীপ, চা কইরে। চেঁচিয়ে উঠলাম।

থামো তো অফিসে আসা তক খালি বক বক।              

অর্ক, অরিত্র, সুমন্ত টেবিল থেকে মাথা তুললো।

মল্লিকদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

ভেবেছে আমি বলেছি। তোর লেখার মধ্যে ডুবে আছে।

অরিত্র মনে হয় চাপা স্বরে কিছু বললো। এখান থেকে বুঝলাম না।

সে কিরে! এই বললি, যা চাই খালি হুকুম করলেই চলে আসবে। আমি বললাম।

সন্দীপ এবার পেছন ঘুরে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল।

কিরে চিনতে পারছিস না?

সন্দীপ হেসে ফেললো।

সরি সরি, একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। যা নামিয়েছিস না, সাতদিন ধরে খাব।

মিলিরা জোড়ে হেসে উঠলো।

সন্দীপ উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো।

তখনও ওর চোখে মুখে অন্যমনস্কতার ছাপ স্পষ্ট।

বুঝলেন ম্যাডাম, এই কাগজে আমার একটাই বন্ধু। অনি।

সবাই আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে। সন্দীপ মিত্রার দিকে তাকাল।

জানেন ম্যাডাম, এই মুহূর্তে আমার একটা কথা ভীষণভাবে মন পড়ে যাচ্ছে। চাকরি পাওয়ার পর নতুন বিয়ে করেছি। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে আমার অফিসের স্টাফ মাত্র একজন। অনি। নতুন সংসার। কতো স্বপ্ন। খরকুটোর মতো সব ভেসে যেতে বসলো।

অফিসে গণ্ডগোল, চাকরি যায় যায়। যেন মহামারী লেগেছে।

ও তখন বাইরে। ফিরে এলো। সব বললাম। খুব ক্যাজুয়েলি বললো, একটা গেলে আর একটা পেয়ে যাবি। আমি এডিটর হবো। তোকে ঠিক একটা কাজ জোগাড় করে দেব। ভাবিস না।

নিজের অস্তিত্ব তখন লোপ পেতে বসেছে। অফিসের টালমাটাল পরিস্থিতি।

ওকে তখন কাছ থেকে দেখেছিলাম। সবাই ভয়ে তটস্থ, ওর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।

বেশ মনে পড়ে। দু-জনে বসে ঠিক ওই টেবিলটায় কথা বলছিলাম। আপনি ডেকে পাঠিয়েছেন। সেই ছেলেটিকে বলে দিল নিচে রিসেপসনে অপেক্ষা করতে বলো, যাচ্ছি।

আমি তো শুনে অবাক।

তবু ছেলেটি দাঁড়িয়ে রইলো। আমি ওকে ব্যাপারটা বললাম।

তখন ঝাঁজিয়ে উঠলো, ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছে নাকি।

এই নিউজরুম তখন টইটুম্বুর। এক ঘর ভর্তি লোক সবই ওর দিকে তাকিয়ে।

তারপর তো সব ইতিহাস। ঠিক চব্বিশ বছর আগেকার ঘটনা।

অনি আমার চাকরি বাঁচিয়েছে। একটু একটু করে স্বপ্ন দেখিয়েছে, তোকে এডিটর হতে হবে। তোকে তৈরি হতে হবে। একসময় স্বপ্ন দেখতাম, আজ সেই স্বপ্ন সার্থক।

অর্ক, অরিত্র, সায়ন্তনের কথা ভাবুন। তখন ওদের বয়স একুশ বাইশ। তিনজনেই ফ্রিল্যান্সার। রাতে প্রয়োজনে থেকে যায়। তখনও চাকরি পায়নি।

তখন তো ওদের মতো আরও কতো ছেলে এই হাউসে ছিল।

জহুরীর চোখ। আমাকে ডেকে বললো, ওদের দুটোকে নার্সিং কর। ভালোজাতের গাছ। আজ ওরা এই হাউসে কোথায় অবস্থান করছে একবার ভাবুন। এই হাউসে অনির পর আর যাদের ইনফ্লুয়েন্স বলুন, কানেকসন বলুন, সবচেয়ে বেশি সেটা হলো অরিত্র, অর্ক, এরপরই সায়ন্তন, সুমন্তকে ওরাই তৈরি করেছে। আমার একটাই খারাপ লাগে অনি আমাকে দু-হাত ভরে দিয়েছে। আমি অনিকে এখনও পর্যন্ত কিছুই দিতে পারলাম না।

বহুত বাতেলা দিলি, একটু চা খাওয়া, তাহলেই শোধ-বোধ। আমি বললাম।

সন্দীপ আমাকে জড়িয়ে ধরেই হেসে ফেললো।

দেখ, এই এক কাপ চা তোকে ঠিক সময়ে দিতে পারিনি।

মিত্রা আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।

অতো আদর দেখাতে হবে না। এবার নোটটা দে।

সন্দীপ হেসেই যাচ্ছে। মিলিরা, মল্লিকদাও হাসছে।

সুমন্ত টেবিল থেকে উঠে এলো।

কিসের নোট, তুমি লিখেছো নাকি?

তারমানে!

ম্যাডাম লিখেছে। এবার ম্যাডাম যদি বলেন রাইটার্স রেমুনারেসন নেবেন, আমরা এখুনি দিয়ে দেব।

ছাপতে হবে না। লেখাটা দিয়ে দে।

অর্কদা অনিদার লেখা অনিদাকে ফেরত দিয়ে দে। দেখি কোন হাউস এই লেখা ছাপে। আমাদের হাউস ছাড়া এই লেখা কেউ ছাপবে না।

সন্দীপদার খেয়ে হজম হয়ে গেছে। অরিত্র চেঁচিয়ে উঠলো।

সন্দীপ অরিত্রর দিকে তাকাল।

লাস্টলিপটা।

ওটা আর দেখতে লাগবে?

বানান-টানান ভুল হলে দাদা খেপে যাবে।

মাথায় রাখবে অনিদার লেখা। তোমার আমার নয়।

তাহলে দাদার কাছে দিয়ে আয়।

দেখলাম নিউজরুমের দরজা ঠেলে দাদা ঢুকলো। পাশে তনু।

সন্দীপ আমাকে ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে জিভ বার করেছে। দাদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। আমি এগিয়ে গেলাম।

সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

দাদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। হাসছে না, আবার হাসছে। চোখেমুখে ছড়িয়ে পরেছে অস্বাভাবিক একটা পরিতৃপ্তির অনুভূতি। যেন মন বলছে, আমার হাতে তৈরি তরোবাড়িটা যথার্থই শানিত, যে কোনও মুহূর্তে যাকে তাকে যখন তখন ফালা ফালা করে দিতে পারে।

তুমি এতো রাতে এলে কেন?

তুই তো টেনে আনলি।

হাসি তখনও ঠোঁটে লেগে আছে।

তুই না লিখলে আসতাম না।

আমি দাদার দিকে তাকিয়ে হাসছি।

অনেকদিন পর আজ মনটা বেশ হাল্কা হাল্কা লাগছে বুঝলি অনি।

আমি দাদার থেকে চোখ সরিয়ে নিইনি।

সকাল থেকে তোর বড়োমার সঙ্গে ক্ষেপে ক্ষপে অনেকবার কথা হলো। কখনও আমার ওপর রাগ করলে, কখনও আমার ওপর অভিমান করলে। শেষ বেলায় যখন বললে ও এখান থেকে সোজা অফিসে যাবে, তারপর বাড়ি ফিরবে। তখনই মল্লিককে বললাম, আমি অফিসে যাব।

মল্লিক একটু গাঁইগুঁই করছিল। আমি বললাম, না যাব।

ডাক্তার বললো, কেন তুমি অফিসে যেতে চাইছ?

তা বললুম, আমার মনে হচ্ছে ও একটা ইতিহাসের যবনিকা টানতে চাইছে। শুরুর সাক্ষী আমি ছিলাম। মরে গেলে কি হতো বলতে পারি না। বেঁচে যখন আছি, শেষের সাক্ষীটা থাকতে চাই।

ডাক্তার শুনে-টুনে বললো, যাও। তোমাকে আজ বাধা দেব না।

বল, ভালো কথা বলিনি ডাক্তারকে?

আমি মাথা নিচু করে আছি।

বড়ো ভালো লিখেছিস।

শুরু করলি নিজেকে দিয়ে, শেষ করলি মিত্রাকে দিয়ে। এখুনি তোর বড়োমাকে সেটা ফোনে জানিয়ে এলাম। আজকে মরন-টরন কিছু বলেনি।

হাসলাম।

তুই এখনও আমাদের কাছে অধরা। হাতের কাছে পেয়েও তোর স্পর্শ পাই না।

একুশ/বাইশ বছর আগের ঘটনা সকলে ভুলে তালগোল পাকিয়ে দেয়, আর তুই যেন তোর কলম দিয়ে সেই একুশ বছর আগের দিনটাকে জীবন্ত করে তুললি।

তাও নিজে নয় মিত্রার চোখ দিয়ে।

বড়ো শক্ত কাজ, তুই কতো সহজ সরলভাবে লিখে দিলি। একে মুন্সীয়ানা বলে ছোটো করবো না, এটা এক ধরণের শিল্প, আমাকে যদি এর পরিভাষা বলতে বলিস তাহলে বলবো মার্গোসঙ্গীত, শব্দের মূর্চ্ছনায় সকলে মহিত হবে। আর যারা বোঝে না তারা মহিত হয়ে শুনবে।

আমি দাদার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছি।

সেই শব্দের মূর্চ্ছনা বড্ডবেশি হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এদেরকে বার বার বলি, তোরা অনির লেখা পড়িস, কিন্তু প্রত্যেকটা লেখার মধ্যে দিয়ে ও যে কিছু বলতে চায়, সেটা তোরা কিছুতেই বুঝতে চাস না। ওটা যদি বুঝতে পারিস, তোরাও ভাল লেখা লিখতে পারবি।

কে কার কথা শোনে, বলে বলে আমার মুখ ব্যাথা হয়ে গেছে, কাকস্য পরিবেদনা।

বুঝলি, সুমন্তর মধ্যে সেরকম একটা সম্ভাবনা দেখেছিলাম। তারপর সব গড্ডালিকা প্রবাহ। ওটাও দরকোচা মেরে গেছে।

ডেডিকেসনটা সবচেয়ে বড়ো জিনিষ, ওটা না থাকলে হাত থেকে এই লেখা বেরতে পারে না। একশোভাগ তোমাকে নিবেদিত প্রাণ হতে হবে। তবে তুমি লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে।

তনু ঘরে গিয়ে বলছিল, দাদা ও লিখছে না যেন সাধনা করছে।

আমি ওর মুখ থেকে ঠিক এই কথাটা শুনতে চাইছিলাম।

তনুকে বলেছিলাম, এইটা হচ্ছে অনির ডেডিকেসন, নিবেদিত প্রাণ। তোমাদের এতদিন গল্প বলেছি, আজ নিজের চোখে দেখলে।

অন্ততঃ এই টুকু বিশ্বাস নিয়ে মরতে পারবো, কাগজটা খুব তাড়াতাড়ি উঠে যাবে না।

একটা রিদিম, ছন্দ আমি অনেক চেষ্টা করেছি পারিনি। ও করে দেখিয়ে দিয়েছে।

সবাইকে এক সুতোয় গেঁথে একটা মালা তৈরি করেছে। কিন্তু দেখ মালার প্রত্যেকটা ফুল তাদের নিজের অস্তিত্ব নিয়ে বহাল তবিয়েতে আছে।

সম্বিত ফিরে পেতে দেখলাম মিত্রাদের সঙ্গে নিউজরুমের প্রায় সকলে আমাদের দুজনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়ছে। দাদা যেন শিক্ষক ওরা যেন সকলে ছাত্র।

কিরে মা, কাজতো শেষ এবার ফিরবি।

মিত্রা দাদার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।

কি ভাবছিস, দাদা তোর বুবুনকে অন্ধ স্নেহ করে।

মিত্রা মুখ নীচু করে নিল।

তোর বড়োমাকে ফোন করেছিস?

মিত্রা মাথা দোলাল। করেছে।

তুই এবার যাবি তো। দাদা আমার দিকে তাকাল।

আর একটু কাজ বাকি আছে। তুমি এককাপ চা খাও, তার মধ্যে সেরে নিচ্ছি।

দাদা হেসে ফেললো।

মিত্রা হরির ছেলেটাকে এবার ছেরে দে। মল্লিকদা বললো।

ও যায় নি! ওকে তখনই বললাম তুমি চলে যাও।

আমি ছিলাম বলে হয়তো যায়নি। দাদা বললো।

মিলি যা ওকে বল বাড়ি চলে যেতে। নিচে বলে দে, গাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে।

দাদা মল্লিকদার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।

আমি দ্বীপায়ণের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। তনু বসে ল্যাপটপে কাজ করছে।

কি করছো?

তনু আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো।

হাসলে যে।

তোমায় দখে লোভ সামলাতে পারলাম না। কালকে ওদের উৎসব নিয়ে একটা ফিচার লিখে ফেললাম। সুমন্তকে বললাম একটু কারেকসন করে দে। তারপর মল্লিকদাকে দেব।

মিলি নিউজরুমের দরজা খুলে একপাশে দাঁড়াল, দেখলাম ছিদাম বিশাল একটা ডেচকি নিয়ে ঢুকছে। পেছনে আরও একটা ছেলে।

মিত্রা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে।

তোর জন্য বেচারা তিনবার ফিরে গেছে। ঘুগনি বানিয়েছে। কাউকে দেয়নি। বলেছে দাদাকে দিয়ে আগে বৌনি করবো, তারপর তোমরা খেও। চা নিয়ে এসেছিল আমরা ভাগ করে খেয়েছি।

ছিদাম তার কাজে লেগে পরেছে।

আমি তনুর তোলা ছবিগুলো দ্বীপায়নের ল্যাপটপে দেখছিলাম। বেশ তুলেছে তনু। একেই বলে ক্যামেরার চোখ। খালি চোখে যা সুন্দর নয় লেন্সের তলায় সেইই অপরূপ সুন্দরী।

দ্বীপায়ন পাতা ছেড়ে দিয়েছো?

কখন। কাগজ ছাপা শেষ হয়ে এলো।

আমার লেখা….।

পুরো গেছে নাকি। কয়েকদিন সেলটা খেতে হবে না। মিনিমাম চারদিন ধরো।

মিত্রা-তনু দুজনেই হাসছে।

ছিদাম একটা স্টিলের বাটিতে করে ঘুগনি নিয়ে এসেছে। আর কড়া করে শেঁকা পাঁউরুটি।

ছিদাম আমাদের দিতে হবে না। তুমি বরং এক্সট্রা দুটো চামচ নিয়ে এসো।

মিত্রা হাসতে হাসতে বললো।

ছিদাম মিত্রার দিকে তাকিয়ে।

কেন আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি।

তোমার দাদার থেকে খেলে ভাগে কম পরে যাবে।

না না ঠিক আছে, আর একটু দিয়ে যাচ্ছি।

ছিদাম আমার দিকে তাকাল।

বলছে যখন নিয়ে আয়। রাত হয়েছে বাড়িতে গিয়ে আবার খেতে হবে।

ডিমটা নিয়ে আসি।

নিয়ে আয়।

ছিদাম চলে গেল।

আপনারা আছেন বলে ছিদামদা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না।

দ্বীপায়ণ মিত্রার দিকে তাকাল।

যা বলার বলে চলে গেছে। যে বোঝার সে ঠিক বুঝে গেছে।

তোদের সব কিছুতে বিটকেল বুদ্ধি। আমি বললাম।

আমি একটা পাঁউরুটির পিস মুখে তুললাম।

মিত্রা-তনুর দিকে তাকালাম। নাও।

মল্লিকদার টেবিল থেকে একটা হই হই শব্দ হলো। পেছন ফিরে দেখলাম দাদা বেশ জমিয়ে বসেছে। সবাই মনোযোগ দিয়ে দাদার কথা শুনছে। আর হাসাহাসি করছে।

ওখানেও চা পাঁউরুটি ঘুগনি পৌঁছে গেছে।

তনুর ছবি দেখতে দেখতেই নিউজরুমে কাগজ এলো। আবার একচোট হই হই।

সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে দেখার জন্য সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।

একটা সময় ভীষণ উৎসাহ ছিল। এখন সেটা কেমন যেন মরে এসেছে। কিন্তু নতুন কাগজের গন্ধটা এখনও নাকে লেগে আছে। কেমন যেন নেশা ধরায়।

চা খেয়ে আমরা সবাই বরিয়ে এলাম।

লিফ্টে নামার সময় মিলি বললো, কাগজের অফিসে কাজ করছি, নতুন কাগজ বেরবার আনন্দটা কিরকম এতদিন জানতাম না। আজ পরতে পরতে অনুভব করলাম। সত্যি অনিদা, কয়েকদিন নাইটে এই ভাবে থাকলে নেশা লেগে যাবে।

আমি মিলির দিকে তাকালাম, চোখে নতুন কিছু পাওয়ার কাজল।

দ্বীপায়নদা কিরকম আনমনা হয়ে ঘোরাঘুরি করছিল, যেই ফার্স্ট পেজটা মেকিং করতে শুরু করলো একবারে অন্যমনুষ। সন্দীপদা কথা বলছিল বলে কিরকম বিরক্ত হচ্ছিল। টিনা বললো।

ওটা বল। অদিতি বললো।

কোনটা! মিলি বলো।

আমরা সায়ন্তনের পেছনে কত লাগি। ছবি ফিনিসের সময় সুমন্ত বললো বলে কিরকম ঝাঁজিয়ে উঠলো, তোকে কথা বলতে বলেছি। প্রিন্ট আউট দেব পছন্দ না হলে কথা বলবি। দেখ সুমন্ত কিন্তু একটুও রাগ করলো না। কিংবা গম্ভীর হয়ে থাকল না। অদিতি বললো।

ওই সময়াটা হচ্ছে কাগজের পিক টাইম। মুহূর্তে সময় নষ্ট করা যাবে না। কেউ কাউকে পাত্তা দেয় না। যাকে তোমরা বলতে পারো ডেট লাইন। যাই হোক না কেন তোমাকে বারোটা কুড়ির মধ্যে কাগজ ছাড়তেই হবে। নাহলে কাগজ ছেপে দেড়টার মধ্যে বেরবে না। ট্রেনও ধরান যাবে না।

আরও নিট করে বলতে গেলে বলা যেতে পারে, ভূমিষ্ঠ হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্ত।

তুমি তখন মাথা গুঁজে লিখে যাচ্ছ। কি হচ্ছে কি না হচ্ছে তোমার কানে কিছুই যায়নি।

মিলি কথা বলতে বলতে আমার মুখের দিকে তাকাল।

ও চিরোটা কাল এইরকম। পরীক্ষার সময় কতবার খোঁচা মারলে তবে একবার তাকাত।

আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।

লিফ্ট থেকে বেরিয়ে বাইরে আসতেই উদয়, শেখর আর সার্কুলেসনের ছেলেটা এগিয়ে এলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে তিনজনেই হাসছে।

কিরে হাসছিস কেন?

আগে বলো ঝাড় দেবে না।

কেন ঝাড়ের মতো কাজ করেছিস?

দাদা যা প্রিন্ট অর্ডার দিয়েছিল তার থেকে একলাখ বেশি ছেপে দিয়েছি। আন সোল্ড থাকলে আমাদের মাইনে থেকে কেটে নিও।

আর বিক্রী হলে ফিফটি পার্সেন তোদের ফান্ডে যাবে এই তো।

আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছি।

টিনাদি দাদা পার্মিসন গ্র্যান্ট করে দিয়েছে। কাল নট ঝাড়।

টিনা ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

দেখছিস কে এসেছে।

মিত্রার কথায় গেটের দিকে তাকালাম। দেখলাম আবিদ গেট খুলে ভেতরে আসছে। পেছন পেছন চাঁদ আর রতন।

ভেতরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/Va5mhgX
via BanglaChoti

Comments