❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৮২ নং কিস্তি
—————————–
ছোট্ট পাহাড় ঘেরা সমতল জায়গাটায় দিনের শেষ আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পরছে। আমি আকাশের দিকে আনমনে তাকিয়ে ছিলাম। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের শরীরে হালকা কমলা রং-এর স্পর্শ। মাঝে মাঝে দ্রিম দ্রিম করে মাদলের আওয়াজ ভেসে আসছে। একটু পরেই কমলা রংয়ের সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঝুপ করে মুখ লুকিয়ে নেবে।
কিরে যাবি না।
ধ্যান-ভ্রষ্ট হলাম।
মিত্রা, তনু, ইসি তিনজনেই বেশ মিষ্টি করে সেজেছে। কাপর পরেছে।
আর সবাই।
ওরা চলে গেছে। তোকে নাকি খুঁজে পায়নি।
হাসলাম।
টর্চটা সঙ্গে নিয়ে নে।
তনু, মিত্রা, ইসি তিনজনেই বাড়ির ভেতরে ছুটল।
আমাদের পরিচিত কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না।
মাদল বাজাতে বাজাতে ওরা এগিয়ে গেছে সুখলাল কাকার বাড়ির দিকে।
একটা দুটো করে দোকান বসতে শুরু করেছে।
শ্যামকে ডেকে বললাম। সবাই কি তোদের এখানকার?
না। ফুলঝোড়া, দাহিজুড়ি, মুসাবনি আরও সে পাশ থেকে লোক আসতিছে।
কতো লোক হবে?
হাজার খানেক।
এই যে মেলায় দোকানপাট বসছে তারা কি এখানকার?
না সব বাইরে নু আসতিছে।
কিছু যদি হয়?
হবে নি। লোক আছে, তান্যে সব দেখি দেখি ছাড়তিছে।
মিত্রারা ফিরে এলো। তনুর কাঁধে দেখলাম একটা লম্বা ধরণের ব্যাগ।
আমি একটু অবাক হয়ে তনুর দিকে তাকালাম। ওটা কি!
মেয়েদের মতো সব দিকে এতো নজর কেন। তনু ঝামটে উঠলো।
আচ্ছা আর বলবো না।
শ্যাম তুমি যাবে না। মিত্রা বললো।
তুমান্যে যাও, পরে যাইঠি।
আমরা সকলে সুখলাল কাকার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। একটু এগোতেই দেখলাম আধা-অন্ধকার বনোপথে কনিষ্করা দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে মুচকি হাসলো। তারপর আমাদের সঙ্গেই পায়ে পা মেলালো। এই বনো পথে আমরা কজন। যে পথে একটু আগে এসেছিলাম। দিনের আলো পরে এসেছে। একটু একটু করে অন্ধকারটা দিনের আলোকে গ্রাস করে নিচ্ছে। যে টুকু এখনও অবশিষ্ট আছে। সেটুকুও একটু পরে হয়তো নিঃশেষ হয়ে যাবে। পরে রইবে নিবিড় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।
জোনাকিরা সাঁঝ বাতির আলো জ্বালিয়ে ইতি-উতি উড়তে শুরু করে দিয়েছে। ঝিঁঝিঁ পোকারা দলবদ্ধ হয়ে ডাকতে শুরু করেছে। যতো অন্ধকার ঘনো হয়ে আসবে ঝিঁঝিঁর ডাকের শব্দ তত তীব্র হবে।
নীরু শ্রীপর্ণা কোথায়?
কি করে বলি বলতো। এটুকু জানি হারাবে না।
হেসে ফেললাম।
হ্যাঁরে, এখানে আসার পর পাত্তাই পাচ্ছি না। এতদিন গল্প বলতাম। বলতো ফিল্টার করে খেতে শেখ। এবার ফিরে গিয়ে বলবো ফিল্টার করা জলের ভাগটা দাও।
কনিষ্করাও নীরুর কথা শুনে হাসছে।
সত্যি তো বটা, নীরু ঠিক কথা বলেছে। কনিষ্ক বললো।
বটা হাসছে।
সেই খাবার আগে একবার দেখা পেলাম, তারপর থেকে পুরো গাইপ। কোথায় ফুরুত ফুরুত করে উড়ে বেড়াচ্ছে কে জানে।
সুখলাল কাকার বাড়ির কাছা কাছি আসতেই মাদলের নেশা ধরানো শব্দ ভেসে আসছে। বুঝলাম অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলে এলাম।
হ্যাচাক জালানো হয়েছে। এখানে দে লাইট নিয়ে আসা হয়নি। বইবার সুবিধে। গোটা পাঁচেক হ্যাজাক দড়ি দিয়ে চার পাশে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
মাঝে মাঝে নামিয়ে পাম্প দিয়ে দিচ্ছে।
সেই পবিত্র ঢিপিকে সামনে রেখে সুখলাল কাকার খামারে নাচ-গান চলছে।
সন্ধ্যে এখনও পুরো হয়নি। তবে হতে আর বাকি নেই। যে টুকু আলো আকাশের বুকে এখনও লেপটে রয়েছে তা কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার গ্রাস করে নেবে।
চম্পাকে দেখলাম বেশ সুন্দর একটা রঙিন শাড়ি পরেছে। এই দঙ্গলের মধ্যে ওকে একবারে আলাদা রকমের দেখতে লাগছে। গায়ে একটা ব্লাউজও চড়িয়েছে। মাথার খোঁপায় ময়ূর পুচ্ছ। ওদের বয়সী মেয়েদের সঙ্গে কোমর জড়িয়ে শরীর দুলিয়ে নাচছে।
ছেলেরা মাদল আর ধামসা বাজিয়ে সঙ্গত দিচ্ছে।
বড়োমাদের দেখলাম একটা দড়ির খাটিয়াতে বেশ গুছিয়ে বসে আছে।
ছেলেরাও হয়তো আশেপাশে কোথাও আছে চোখে পড়ছে না।
এক একবার এক একটা দল নাচছে।
দিদি এটা একটু ধরো তো। তনুর গলা পেয়ে পেছন ফিরে তাকালাম।
দেখলাম তনু ক্যামেরা স্ট্যান্ড বার করে ক্যামেরাটাকে সেট করছে। সঙ্গে লেন্স।
হেসে ফেললাম।
একবারে হাসবে না। বহুদিন পর মনের মতো একটা সাবজেক্ট পেয়েছি।
টুকরো টুকরো কথা বলার ফাঁকেই তনুর ক্যামেরার সাটারের আওয়াজ পেলাম।
ছোটোমা ছবি তুলছো।
শুভর গলার আওয়াজে আবার পেছন ফিরে তাকালাম। বোচনরা সকলে তনুকে ঘিরে ধরেছে। নম্রতাকেও দেখলাম। আমাকে দেখে হাসলো।
ঘণ্টা-পক্কে তনুর পিঠের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
তোমার ছবি তোলার দফা-রফা হয়ে গেল। আমি বললাম।
ওই জন্য স্ট্যান্ডটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।
একটা নরম হাতের স্পর্শে চমকে উঠলাম। মিত্রারা খিল খিল করে হেসে উঠলো।
আকা মোদের সঙ্গে লাচবে চলো।
তাকিয়ে দেখি চম্পা আমার হাতটা চেপে ধরেছে।
ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম।
খুব সুন্দর করে সেজেছে। কপালে শিশির বিন্দুর মতো ঘামের আভাস। চম্পা আজ যেন চোখে মুখে কথা বলছে। আয়তো চোখ দুটোয় হাসির কাজল।
চলো না।
আমি হাসছি। মোড়ল বকবে।
না বকবোনি।
আজ তোরা নাচ, আমি দেখি।
না তুমি চলো মনকার সঙ্গে লাচবে।
দেখলাম চম্পার সঙ্গে আরও তিন চারটে মেয়ে এসে জড়িয়ে ধরেছে।
মিত্রাদের দিকে তাকাতেই ওরা ইশারা করছে, যা না, ওরা যখন বলছে।
ও মা দেখি কোথা থেকে ময়না-চূড়াও এসে হাজির।
যা মেয়ে যখন কইতিছে লাচকে যা। ত্যাখন তার মার সঙ্গে লাচছু অখন মেয়ের সঙ্গি লাচ।
আমি ইশারায় বললাম তোর মেয়েকে নিয়ে ভেগে পরবো।
চূড়া বাঁকা চোখের দৃষ্টি হানলো। মুই তোর শাশড় হবো।
মূল বেদীর সামনে সকলে কোমড় ধরাধরি করে দাঁড়ালাম। চম্পা আমার কোমর জড়িয়ে ধরে রয়েছে। আর একপাশে ওরই মতো আর একটা মেয়ে। চম্পার মতোই খুব সুন্দর করে সেজেছে। দ্রিম দ্রিম শব্দে মাদল ধামসা বেজে উঠলো। আমার শরীরটা আবার কেমন দুলে উঠলো।
গান ধরলাম।
ঝিমিত ঝিমিত জুনি জ্বলে / মুড় দেজর দেবা তলে / ইয়ান আমার দেজ, ইয়ান তোমার দেজ, ইয়ান বেগর দেজ।
আমার সুরে ওরা সুর মেলাল।
ওদের কোমর জড়িয়ে ধরে মাদলের তালে তালে প্রায় মিনিট দশেক নাচলাম।
নাচতে নাচতেই চম্পার মুখের দিকে তাকাই। খুশিতে চক চক করছে চোখ মুখ। নাকের ঝুটা পাথরের নোলক থেকে ঠিকরে বেরচ্ছে আলো। ধামসা মাদলের তালে তালে সারাটা শরীর সাপের ফণার মতো দুলছে। অফুরন্ত প্রাণ শক্তি ওদের।
রীতি অনুযায়ী ঢিপির চারিদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে হচ্ছে। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে।
ওদের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আর কারুর মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না। একটু ভুল হলেই হোঁচট খেয়ে পরে যাব।
গানটা শেষ হতেই আমি দাঁড়িয়ে পরলাম।
হই হই করে ওরা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
বুকটা কামার শালের হাপরের মতো ওঠানামা করছে। হাঁপিয়ে পরেছি।
চম্পারা জড়িয়ে ধরে আছে। ওদের আনন্দের শেষ নেই।
দেখলাম সুখলাল কাকা লাঠি হাতে টলতে টলতে আমার কাছে উঠে এলো।
চোখ দুটো ছল ছলে। আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
তুই বাঁইচা থা, দীর্ঘজীবী হ। অখনও তুই এউ গানটা মনে রাখছু।
হেসে ফেললাম।
কতদিন বাইদ শুনলি, মোনকার সুময়কার গান।
চম্পারা সুখলাল কাকার মুখের দিকে তাকিয়ে।
এন্যে শুনছে, কুনওদিন গায় লাই।
এবার দেখবে গাইবে। আমি বললাম।
যা এবার মারাংবুরুর থানে যা।
তুমি যাবে না।
কাল ভোরনু উইঠে জীব।
হই হই করে ভিড়টা এবার সুখলাল কাকার বাড়ির খামার খালি করে দিয়ে থানের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। একটুখানি চড়াই-এ উঠলেই মরাংবুরুর থান।
গুহা গাত্রে একটা কালো পাথর। অকুণ্ঠ বিশ্বাসে সে আজ জাগ্রত।
একটা হ্যাজাক সুখলাল কাকার বাড়ির বারান্দায় রেখে বাকিগুলো ওরা নিয়ে চলে গেল।
বড়োমারা সব খাটিয়া থেকে উঠে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
ছোটোমা, দামিনীমাসি জড়িয়ে ধরেছে।
তোরা দুজন একলা আদর করলে হবে। আমাদের একটু ভাগ দে। বৌদি বললো।
বুকটায় একটু কান দাও কেমন ধরাস ধরাস করছে। ছোটোমা বললো।
অভ্যেস নেই, হাঁপিয়ে পরেছে।
ছোটোমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক।
লাইভ টেলিকাস্ট করলে নাকি?
ছোটোমা আমার পেটে খোঁচা মারলো। বৌদি হাসছে।
আন্টি কেমন লাগছে?
কি বলি বল, বার বার মনে হচ্ছে, এই শেষ বয়সে অজুর সঙ্গে দেখা না হলে তোকে ভীষণভাবে মিশ করতাম।
ভুলেগেলে চলবে না। তুমি কিন্তু প্রথমে আমার দেখা পেয়েছো, তারপর অজু।
বড়োমা, জ্যেঠিমনি হাসছে।
মাসি ভজু কোথায়?
মাসি হাসছে।
সেই যে নদীর ঘাটে দেখলাম তারপর থেকে ব্যাটা ফুরুত।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোর নাচ দেখলো, নিজেও কিছুটা কোমড় ধরে নেচে নিলো, তারপর বড়দির কাছ থেকে দশটাকা নিয়ে বললো, জিলিপি খেতে যাই।
ধারে কাছে মিত্রা, তনু কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। বুঝলাম ওরা ওখানে গেছে।
চূড়া চা নিয়ে এলো, মাটির ভাঁড়ে। ছোটোমা এগিয়ে গেল।
তুই কি ভাল মেয়ে রে?
চূড়া হাসছে।
বোড়োমা তুমি পূজা দিতে যাবেক লাই?
দাঁড়া তুই, হাঁটুর ব্যাথায় মরছি।
তুমার মিষ্টি যে পঠাই দিলাম।
ভাল করেছিস। কাল সকালে স্নান করে পূজো দিয়ে আসবো।
দিদি চায়ে চুমুক দিয়েছো। ছোটোমা বলে উঠলো।
না।
একবার দাও।
কেনো?
দাও না।
আঃ কি সুন্দর গন্ধ রে ছোটো। বৌদি বললো।
তেজপাতার গন্ধ পাচ্ছ না।
বৌদি মাথা দোলালো
আমি হাসছি।
এই মেয়ে, আর একটু কর। ছোটোমা তাকাল চূড়ার দিকে।
আছে, লেইসব।
লিয়ে আয়।
জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি হেসে উঠলো।
তুইও তো ওদের মতো শুরু করলি। জ্যেঠিমনি বললো।
ইসলামভাইরা কোথায় ছোটোমা?
তুই এইসময় সবার খোঁজ করলে পাবি। যে যার ইচ্ছে মতো ঘুরছে।
চায়ে চুমুক দিলাম।
মারাংবুরুর থানে পূজো বেশ জমে উঠেছে। এখান থেকে তার শব্দ পাচ্ছি।
বড়োমার দিকে তাকালাম।
এখন এখানে থাকবে না মেলায় যাবে?
মেলায় যাব।
এই যে বললে হাঁটু ব্যাথা করছে।
করুক, আর কখনও আসা হবে কিনা কে জানে। একবার দেখে নিই।
তখন তুই যে গানটা গাইলি তার শব্দগুলো একটু বলতো। বৌদি আমার মুখের দিকে তাকাল।
কেনো!
বিশ্বাস কর শব্দগুলো একটুও বুঝতে পারিনি। তুই এমনভাবে সুর করে টানছিলি।
ঝিমিত ঝিমিত জুনি জ্বলে / মুড় দেজর দেবা তলে / ইয়ান আমার দেজ, ইয়ান তমার দেজ, ইয়ান বেগর দেজ। আমি কেটে কেটে খুব ধীর স্থির ভাবে বললাম।
বৌদির চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারলাম মনে মনে শব্দগুলো সাজিয়ে মুখস্থ করে ফেললো।
মুখস্থ করলে?
বৌদি হাসলো।
এবার অর্থটা বল।
হাসলাম।
যে পাহাড়ের আকাশ তলে / মিটি মিটি জোনাক ( জোনাকি) জ্বলে / এটি আমার দেশ, এটি তোমার দেশ, এটি সবার দেশ।
বৌদি আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো।
এতো গভীর অর্থ!
গভীর কিনা বলতে পারবো না। তবে সুখলাল কাকাদের মুখে মুখে এক সময় এই গানটা ঘুরতো, এর কোনও লিপি তুমি খুঁজে পাবে না। অনেকটা লোকয়াত, কে লিখেছে কবে লিখেছে তার কোনও হদিস নেই। ট্র্যাডিসন্যালি মুখেমুখে, শুনেশুনে চলে আসছে।
শুধু এই গানটা বললে ভুল হবে এদের বেশির ভাগ গানই এরকম।
খুব ভালো করে লক্ষ্য করে দেখ এদের সংস্কৃতি, সাজ-পোশাক, ধর্ম বিশ্বাস সব কিছুর মধ্যেই এই জঙ্গল এই পাহাড় এই প্রকৃতির একটা প্রভাব আছে।
এদের চাহিদা ভীষণ সীমিত। তুমি এদের শহুরে শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা করলেও এরা জঙ্গল চায়। জঙ্গলেই এদের শান্তি। দু-একজনের কথা বাদ দাও।
রবীন্দ্রনাথকে দেখিনি, জানিনা। তিনি কোন মানসিক পরিস্থিতিতে এই লেখাটা লিখেছিলেন তাও জানি না। তবে অনুভব করার চেষ্টা করে চলেছি প্রতি নিয়ত।
কোনটা বলতো!
দাও ফিরে সে অরণ্য লহ এ নগর।
বড়োমা, বৌদি দুজনেই আমার দিকে কেমন ভাবে যেন তাকাল।
বড়োমা কাছে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখলো।
হ্যাঁগো বড়োমা, তুমি শিক্ষিত হতে পারো তুমি জ্ঞানের পাহাড় হতে পারো, কিন্তু প্রকৃতিকে তুমি তোমার শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে বেঁধে রাখতে পারবে না। সে তার নিজের মতো আপন খেয়ালে চলবে। ইকো-সিস্টেমটা ভারি অদ্ভূত তত্ত্ব।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
খাদ্য খাদকে বাদ্য বাদকে প্রকৃতির ঐশ্বর্য / ষড় রিপু ছলে ষড় রিপু খেলে প্রাণ হতে মাৎসর্য।
বড়ো দামী কথা। বৌদি বললো।
ক্লাস এইটের বাংলা পরীক্ষায় ভাব-সম্প্রসারণ লিখে উনা মাস্টারের কাছে দশে আট পেয়েছিলাম।
ওই যে তোমাকে একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম, বিবেকানন্দ কাতর স্বরে সকলের কাছে আবেদন করেছিলেন, ওরে তোরা গীতাটাকে ঠাকুরের সিংহাসনে রেখে প্রতিদিন ফুল চন্দন দিয়ে পূজো না করে, ওটা ভালো করে পর, দেখবি তাতেই পূজো করা হবে।
অর্থটার কেউ মানে বোঝে না, বুঝলে বড়োমা। অল আর বোগাস। ওটা যে ধর্ম পুস্তক নয় কাকে বোঝাবে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখলাম। সকলের মুখ থমথমে।
চলো এবার, দেরি হয়ে যাচ্ছে। ওরা ওপাশের রাস্তা দিয়ে নিচে নেমে যাবে। এপাশে আর আসবে না।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল।
তোমার অনুভবের কেন্দ্র বিন্দুতে আমার ভাষা পৌঁছবে না। তবে এটুকু বুঝতে পারছি এই মুহূর্তে তুমি তোমার মধ্যে নেই। মাঝে মাঝে এইভাবে নিজেকে একটু নারা দেবে, দেখবে বেশ রিল্যাক্স লাগবে। আবার নতুন করে কাজের উদ্যম ফিরে পাবে। মনে হবে যেন আরও কিছুদিন বেঁচে থাকি। না হলে সব একঘেয়েমি লাগবে।
খামার থেকে বারান্দার কাছে এলাম। পিসী ঘুমিয়ে পরেছে।
বেচারা। এতটা রাস্তা আসার ধকল শরীরটা সমলাতে পারেনি।
চূড়ার মতো বেশ কয়েকজন এখানে রয়েছে। চূড়া মনে হয় ভেতরে কিছু করছে।
সুখলাল কাকার কাছ গিয়ে দাঁড়ালাম।
তুমি একবারটি ওখানে যাবে না।
সকালে গেছলি। অখন আর যাবোক লাই। ওন্যে টুকু আনন্দ করতিছে করুক।
বড়োমাদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।
অন্ধকার রাস্তা দেইখে লিয়ে যাইস।
সুখলাল কাকার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম।
বড়োমারা খুব ধীরে সুস্থে হাঁটছে। মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে পরছে।
ঝিঁ ঝিঁ পোকার তারস্বর চিৎকারে কোন এক ঘেয়েমি লাগছে না। প্রতিটা মুহূর্ত যেন মনে হচ্ছে নতুন।
আজ চাঁদ উঠেছে। এ চাঁদ উপোসী নয় একবারে ঝকঝকে। থালা ভরা মিঠাই দেখলে যেমন চোখ মুখ চক চক করে ওঠে এও যেন সেই রকম।
আলো আঁধারি পথ। লম্বা লম্বা শালগাছের ফাঁক দিয়ে যে টুকু আলো পথের ওপর লুটো-পুটি খাচ্ছে তাতেই পথটা যথেষ্ট আলোকিত। দমকা নয়, ঝিরঝিরে বাতাসে গাছের পাতায় কাঁপন লেগেছে। শব্দটা মাঝে মাঝে বাড়ছে আবার কিছুক্ষণ পর স্তিমিত হয়ে আসছে। আমরা কটা প্রাণ নিস্তব্ধে চলেছি।
অনি।
থমকে দাঁড়ালাম। ছোটোমা আমার ঠিক পেছনে। কয়েক হাত দূরে।
গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলোর দু-এক টুকরো ছোটোমার মুখ মণ্ডলের ওপর পড়ে থিরি থিরি কাঁপছে। মায়াবী মুখটায় অনেক না বলা কথা।
বলো।
তুই এখানে প্রথম কবে আসিস?
স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মাঝে তিনমাসের ছুটি। আমার তো কোনও আত্মীয় স্বজন নেই। কোথায় যাই বলো। সেই সময় মৌসুমি মাসিদেরও ধান কাটার মরসুম শেষ। কম বেশি সকলেই ফিরে গেছে। আবার মাস দুয়েক পর আসবে। কাকীকে বললাম কাকাকে বলো না, একবার মাসিদের ওখান থেকে ঘুরে আসি।
কাকী কাকাকে বললো, কাকা শুনেই খ্যাঁক করে উঠলো, ব্রাহ্মণের ছেলে সেখানে ইঁদুর পোরা দিয়ে পান্তা খেতে যাবে।
বিল পাস হলো না।
শেষে মাসিকে বললাম, মাসি তুমি যদি একবারটি কাকাকে বলো।
মাসি বলতেও সেই এক কথা।
অনেক ঘ্যানর ঘ্যানর করার পর, বললো যেতে পারে নিজেকে ভাত ফুটিয়ে খেতে হবে। তোরা কেউ রান্না করে খাওয়াতে পারবি না।
সেই প্রথম মাসির হাত ধরে এখানে আসা।
মাস খানেক ছিলাম। তারপর মাসির হাত ধরেই আবার ফেরত যাওয়া। তখন মাসি আমার গার্জেন। এখানে তখন এতো লোক ছিল না। সাকুল্যে দশ-পনেরোটা পরিবার। পঞ্চাশ-ষাট জন লোক। তাও আবার এই ধরণের বাড়ি নয়। সব শালাপাতার ছাউনি।
কয়েকটা সেরকম বাড়ি দেখলাম।
ছোটোমার মুখের দিকে তাকালাম।
রেজাল্ট বেরলো, কলকাতায় চলে এলাম। মাঝে মধ্যে বাড়িতে গেলে, প্রয়োজন হলে কাকা আমাকে এখান পাঠাত, লোকজন নিয়ে যাওয়ার জন্য। তবে কালী মেসো সাপকাঠি হয়ে মারা যাবার পর মাসি আর এখানে আসেনি। আমাদের ওখানেই থেকে যায়।
সেটা কে?
কেন, মৌসুমি মাসির বড়!
মৌসুমিদির কোনও ছেলে পুলে নেই?
না। শুনেছি বাবা মারা যাবার মাস দেড়েক পর মেসো সাপকাঠি হয়ে মরে গেছিল। আমি ঠিক মনে করতে পারি না। তবে ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
মৌসুমিদি কি তোর জম্মের আগে থেকে ওখানে যায়?
শুনেছি আমি জম্মাবার সময় আঁতুড় ঘরে আমার দাইমাকে মাসি সাহায্য করেছিল।
তোর দাইমাটা কে?
অশ্বিনী খুড়োর বউ পদি খুড়ী।
সেই গুনীন!
হ্যাঁ।
বেঁচে আছে?
না মরে গেছে।
তার কোনও ছেলেপুলে নেই?
না। সে আঁটকুড়ো।
অশ্বিনী খুড়ো?
এখনও ধিকি ধিকি করে প্রাণটা রয়েছে।
তুই দেখা করিস?
এবারে গিয়ে আর দেখা করে উঠতে পারিনি। আগের বার গিয়ে দেখা করেছিলাম। বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে। মনে হয় আর বেশিদিন বাঁচবে না। চিকনাকে বলেছি একটু দেখে শুনে রাখ। আমার বাবার সময়কার মানুষ।
চুপ করে রইলাম।
চলো। আবার পথ চলা শুরু।
চারদিক নিস্তব্ধ।
কারুর মুখে একটা শব্দ নেই। নিজেদের পায়ের শব্দ নিজেরা শুনতে পাচ্ছি।
আমি সবার সামনে।
পাথর বিছানো শরু রাস্তা লাইন দিয়ে ওপরের দিকে উঠছি। বুঝতে পারছি সকলেরই এই সামান্য খাঁড়াই পথ টুকু উঠতে কষ্ট হচ্ছে।
দ্রিম দ্রিম শব্দে মাদলের মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে। কান পেতে শুনলে সামান্য একটু হই হই-এর শব্দও পাওয়া যাবে। সামনের টিলাটার ওপরে দাঁড়ালেই এখান থেকে মেলাটা দেখা যাবে।
অনি।
ছোটোমার ডাকে আবার থমকে দাঁড়ালাম।
দেখলাম একটু দূরত্ব রেখে সবাই লাইন দিয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠে আসছে। বৌদি, বড়োমার হাত ধরেছে। দামিনীমাসি, আন্টির হাত ধরেছে। ছোটোমা, জ্যেঠিমনির হাত ধরেছে।
বুঝতে পারছি আন্টির এই সামান্য বাল্কি চেহারায় হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।
তোর বাবা-মাকে তোর মনে পড়ে?
সবাই কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি ছোটোমার মুখের দিকে তাকালাম।
দুটো ছবি চোখের সামনে ভেসে আছে। তাও সেটা আবঝা। অতোটা পরিষ্কার নয়।
ওরা সকলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
প্রথম যেদিন আমাদের গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে বাবার হাত ধরে ভর্তি হতে গেছিলাম। কিভাবে গেছিলাম মনে করতে পারি না। পরের টুকু মনে আছে।
পোকা মাস্টার স্কুলের দালানে একটা মাদুর পেতে বসে। খালি গা কাঁধে গামছা। গলায় মোটা সুতোর পৈতে। হাতে তাল পাখা। আমি যেতে আমাকে মাদুরে ওনার পাশে বসিয়ে সহজ পাঠের প্রথম ভাগের অ আ ই ঈ পড়তে বলেছিল, সেটা পড়েছিলাম। তার সঙ্গে যে কবিতা ছিল সেটা বানান করে পড়তে বলেছিল সেটা পড়েছিলাম। পোকা মাস্টারের মুখ আর ওই যে পড়ছি সেটা মনে আছে, বাবার মুখটা মনে পরে না।
বাড়ি ফিরে আসতে মা কোলে তুলে নিয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কি গো ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করতে পারলে। বাবা বলেছিল ও তো সব গড় গড় করে বলে দিল। ভর্তি নেবে না মানে। মায়ের কোলে চড়ছি এটা মনে আছে, মায়ের মুখটা ভাষা ভাষা মনে পড়ে। বাবার গলার শব্দ, চোখ বুজে কিছুক্ষণ কনসেনট্রেট করলে এখনও শুনতে পাই।
দ্বিতীয় যে ছবিটা এখনও চোখের সামনে ভেসে আছে। সেটা হলো মনাকাকার কোলে করে শ্মশানে যাচ্ছি। আরও অনেকে আছে। কিভাবে কোন পথ দিয়ে গেলাম মনে করতে পারি না। সারাক্ষণ মনাকাকার কোলে আছি এটা মনে করতে পারি। শ্মশানে গিয়ে মনে হয় উনা মাস্টারের কোলে ট্রান্সফার হয়েছিলাম। মনাকাকা অঝোরে কাঁদছে। কয়েকটা পাটকাঠি আমার হাতে জ্বলছে। মনাকাকা আমার হাতটা ধরে আছে। মা-বাবা দু-জনে পাশা পাশি শুয়ে আছে। সাদা কাপরে শরীরটা ঢাকা। মায়ের মাথায় লাল সিঁদুর। দুজনের পায়ে লাল রং। আমি জ্বলন্ত পাট কাঠিটা কাকার হাত ধরে দু-জনের ঠোঁটে স্পর্শ করলাম। সবাই কাঁদছে বুঝেছো, কিন্তু কেন কাঁদছে ঠিক সেই মুহূর্তে অনুভব করতে পারিনি।
এই টুকু আমার স্মৃতিতে ধরা আছে, আর সব ব্ল্যাক আউট।
এতক্ষণ চোখ বুঁজে মাথা নিচু করে কথা বলছিলাম।
চোখ খুললাম। ছোটোমার মুখের দিকে তাকালাম। চোখের কোলে চিক চিক করছে শিশির দানা। সবাই অপলক নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে। আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। ছোটোমার মুখ থম থমে।
কেন তুই বার বার ওকে জিজ্ঞাসা করিস। বড়োমার গলাটা বুঁজে এলো।
ছোটোমা কাঁদছে না।
কাছে টনে নিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলাম।
তুমি কিছু খুঁজে পেতে চাইছ। আমিও খুঁজছি ছোটোমা। সময় পেলেই খুঁজি। একবারে পাইনি বললে মিথ্যে বলা হবে। যেটা পাচ্ছি সেখানে বিশ্বাস যোগ্যতার মাপকাঠিতে এখনও মেপে উঠতে পারিনি। যে দিন নিজের মন থেকে বিশ্বাস করতে পারবো আমি সত্যি, আমার সত্যিটুকু সামলাবার ক্ষমতা এদের আছে, অবশ্যই তোমাকে বলবো।
ছোটোমা আমার বুকে মুখ গুঁজে দিলো।
জানো ছোটোমা শৈশবে শিশুদের অনেক মান-অভিমান থাকে। এটা মা ছাড়া কেউ বোঝে না। এখন সেটা আরও বেশি অনুভব করি। তুমি, বড়োমা আমার মান-অভিমান অনেকটা পূরণ করেছো। কাকা-কাকীমা আমার কোনও অযত্ন সেইভাবে কোনও দিন করেননি। মিথ্যে বলবো না। তবে একটা ব্যাপার অনুভব করতাম, আমার সঙ্গে তাদের কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই। বলতে পারো কিছু কিছু ব্যবহারে এটা আমি অনুভব করতাম।
টুয়েলভে ওঠার পর থেকে এটা আমি বেশ ভালোভাবে বুঝতে শিখলাম। কাকার কাছে ফর্ম ফিলাপের টাকা আনতে গিয়ে কথায় কথায় শুনতে হলো, এবার তুমি যথেষ্ট বড়ো হয়েছো নিজের ভালো-মন্দ নিজে বুঝতে শেখ। ফর্ম ফিলাপ করলাম। আর বাড়ি যাইনি। চুটিয়ে পড়াশুনো করে পরীক্ষা দিলাম।
টাউন হল স্কুলে সিট পরেছিল।
দেখতাম মাঝে এক ঘণ্টার ব্রেকে সবার বাড়ির গার্জেন এসেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মা কিংবা বাবা। এমনকী আমার যে সব বন্ধুরা আমার সঙ্গে হস্টেলে থাকতো তাদেরও মা নয়তো বাবা কেউ না কেউ এসেছে। আমার কেউ নেই। টিফিন খাবার কথা ছেড়েই দাও। প্রথম দিন ব্রেক টাইমে বাইরে বেরিয়ে এইসব দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। তারপর থেকে আর বেরোইনি। পরীক্ষা শেষ হলে ক্লাসেই থাকতাম। নোটসের খাতায় চোখ বুলতাম।
শেষ দিন ইকনমিক্স পরীক্ষা। আমি আমার মতো ক্লাসরুমে বসে নোট দেখছি।
ড. রায়ের মনে হয় সেদিন তাড়াতাড়ি কলেজে ক্লাস শেষ হয়েগেছিল। আমাদের সঙ্গে পরীক্ষার হলে দেখা করতে এসেছিলেন। কাউকে হয়তো আমার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তারা বলেছে অনি ক্লাসে আছে। উনি এসেছিলেন আমার ঘরে। সেদিন উনি আমার কথা সব জানলেন। যাওয়ার সময় বললেন অনি ছোটবেলায় আমিও মা-বাবাকে হারিয়েছি। মামার বাড়িতে মানুষ। একদম মন খারাপ করবে না। স্যার আমাকে ক্লাস থেকে নিচে নিয়ে এলেন। সামনে সুতানুটি সংসদ আছে। তার পাশে একটা মিষ্টির দোকান থেকে আমাকে কয়েকটা রসগোল্লা আর দই খাওয়ালেন। নিজেও খেলেন। কেন জানিনা সেদিন থেকে আমি স্যারের চোখে পড়ে গেলাম।
তিনমাস ছুটি বাড়ি ফিরে গেলাম।
ফিরে যাওয়ার সময় স্যারের বাড়িতে গিয়ে স্যারকে প্রণাম করে গেলাম।
তারপর মনে হয় স্যার শুভঙ্করবাবুর সাথে কথা বলে আমার সম্বন্ধে জেনেছিলেন।
রেজাল্ট বেরলো। তখন বুকলেট বেরতো। সাইকেলে করে স্টেশন রোডে এসে রেজাল্ট দেখলাম। আমি, চিকনা, বাসু। রেজাল্ট যে দেখে দিল সে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। ভাবলো আমি হয়তো আমার রোল নম্বরটা ভুল বলছি। বললাম, কি হয়েছে বলুন। তা বললো, এতক্ষণ যা রেজাল্ট দেখলাম সব ফেল, নয়তো কোনও প্রকারে পাশ করেছে। তুই সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিস। থাকিস কোথায়?
কাজলদীঘি।
পড়তিস কোথায়?
কলকাতায়।
কোন স্কুলে?
স্কুলে না কলেজে।
কোন কলেজে?
স্কটিশ চার্চ।
উনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
চল ব্যাটা তোকে পয়সা দিতে হবে না। আমি তোকে মিষ্টি খাওয়াবো। আমি, বাসু, চিকনা তিনজনেই প্রথমে একটু ভরকে গেছিলাম। সেই দাদা কিন্তু মিষ্টির দোকানে বসে আমাদের তিনজনকে মিষ্টি খাওয়ালেন। আর যে আসে তাকেই বলে ও এতো নম্বর পেয়েছে। সে এক ভারি মজার ব্যাপার। আমার রেজাল্টে তার বুক ফুলে বটগাছ।
বাড়ি ফিরে এলাম।
কি করে জানিনা আমি আসার আগেই আমার রেজাল্টের খবর গ্রামে পৌঁছে গেছিল। উনা মাস্টার, মনাকাকা, পোকা মাস্টার, অনাধি মাস্টার সব দালানেই বসে ছিল। আমি সবাইকে প্রণাম করলাম। উনা মাস্টার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, তুই শুধু আমাদের গ্রামের নয় তোর কলেজেরও মুখ উজ্জ্বল করেছিস। মাথায় রাখবি, যত কষ্টই হোক এখানে থেমে গেলে চলবে না। আরও বড়ো হতে হবে।
সবাই আনন্দ করছে।
আমি এই বাড়িতে আমার ঘরে এসে আলমাড়ি থেক মায়ের ফটোটা বুকে চেপে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। আর যেদিন স্কুলে প্রথম ভর্তি হয়ে বাড়ি ফিরে এসে মায়ের কোলে চরেছিলাম, সেই অনুভূতিটা পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি জানো ছোটোমা।
চারিদিক নিস্তব্ধ, কারুর মুখে কোনও কথা নেই। আমরা সাতটা নিথর প্রাণ খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে ফিস ফিস করে মনে মনে কথা বলছি। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, হাওয়ার দোলায় গাছের পাতার ঝিরিঝিরি শব্দ চারদিকে ম ম করছে।
ছোটোমা এবার চলো। না হলে ওরা এবার আমাদের খুঁজতে বেড়িয়ে পরবে।
সকলেই চমকে আমার মুখের দিকে তাকাল। স্খলিত পায়ে আবার পথচলা শুরু।
টিলাটার মাথায় চড়েই নিচের সমতলে মেলাটাকে পরিষ্কার দেখতে পেলাম। আকাশের চাঁদ মেলার বুকে নেমে এসেছে। আধুনিকতার কোনও স্পর্শ নেই এই মেলায়। অরণ্যের আপন নিজস্বতা চারিদিকে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অনেকটা অংশ জুড়ে মেলা।
সামর্থ্য অনুযায়ী আলো। কেউ লম্ফ জ্বেলেছে, কেউ কার্বাইডের গ্যাস ল্যাম্প, কেউ হ্যারিকেন জ্বেলেছে কেউ হ্যাজাক। কেউ কেউ খোলা আকাশের তলায় চাঁদের আলোয় পশরা সাজিয়ে বিকি কিনির হাট বসিয়েছে। আলো আঁধারি থাকলেও চাঁদের মায়াবী আলোয় সব পরিষ্কার। এখান থেকে কাছের পাহাড়টাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ওর মনে হয় শীত করছে। একটা সাদা মেঘের চাদর গায়ে জড়িয়ে চুপটি করে বসে আছে।
এই মেলায় কোনও মাইক নেই। কেউ লাউড স্পিকারে চেঁচিয়ে বলছে না, আপনারা সাবধানে চলাফেরা করুন, আপনাদের বাচ্চাদের হাত শক্ত করে ধরে রাখবেন, তাদের চোখ চোখে রাখবেন, না হলে মেলার এই ভিড়ে হারিয়ে যেতে পারে।
এ যেন প্রাণের মেলা। নিজের খেয়াল খুশি মতো হাত-পা ছড়িয়ে ঘুরে বেরাও।
খুব বেশি আলো সামিয়ানার তলায়। সেখানে কয়েকটা বড়ো হ্যাজাক জ্বালানো হয়েছে। এদের পরিভাষায় যাকে বলে ডে-লাইট। টুকরো টুকরো দ্বীপের মতো দোকানপাট।
চাঁদের আলোয় মেলাটাকে ভারি অদ্ভূত দেখতে লাগছে। সামিয়ানার তলায় মাদল ধামসা বাজিয়ে নাচ চলছে। মাঝে মাঝে হই হই করে উঠছে সকলে।
ছোটোমারা সকলে অবাক হয়ে মেলার পানে তাকিয়ে।
অনি এটা মেলা! বৌদি বললো।
হ্যাঁ। এ তো তোমার শহরের মেলা নয়। জঙ্গলের মেলা। এদের অনুশাসন আচার-আচরণ, ঋীতি-নীতি একবারে নিজস্ব ঘরানায় তৈরি। এখানে তোমার শহুরে মূল্যবোধ ধোপে টিকবে না। এখানকার মেলার সবচেয়ে বড়ো মূল্যবোধ, প্রাণভরে আকণ্ঠ হাঁড়িয়া আর পচাই খাও, প্রাণ খুলে মন খুলে নাচা-গানা করো আর অবাধ শারীরিক মিলন।
শারীরিক মিলন! বৌদি আমার মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ। এটা ওদের সমাজের অনুশাসন। এই ঋীতি চলে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকে। শুধু আজ রাতটুকুর জন্য। রাতটুকু পেরলেই তোমাকে আবার একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে। এ নিয়মের লঙ্ঘন হলে মোড়লের বিচার সভা বসবে, অরণ্যের আইনে। সে আইন বড়ো কঠিন। সেখানে তোমার মৃত্যু দণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। আর সেই মৃত্যু তুমি নিজের চোখে দেখবে, অনুভব করবে, তুমি মরছো।
অনি!
হ্যাঁগো ছোটোমা, আমি মিথ্যে বলছি না। আমি নিজেও যে তার সাক্ষী।
ছোটোমা আমার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে।
এই সুখলাল কাকাকে তুমি এতো ভালোমানুষ দেখছো। কিন্তু যখন বিচার সভায় বসবে তখন ওই পাহাড়টার মতো মাথা উঁচু করে বসে থাকবে। তুমি দেখবে এতো কাছে। হাত বাড়ালেই যেন ছুঁয়ে ফেলতে পারছি। না অনেক দূর, কয়েক ক্রোশ পথ। তোমার পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে নেমে আসবে। অন্ধকারে তুমি পথ হারিয়ে ফেলবে। সে পথের দিশা তুমি আর খুঁজে পাবে না।
ওরা সবাই আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
অনি।
আন্টির মুখের দিকে তাকালাম।
তুই এই মেলা দেখতে আগে এসেছিস?
দুবার।
তখন কি এরকম ছিল?
ঠিক এরকম নয়। তখন লোকজন এতো ছিল না। মেলা বলতে নিজেদের মধ্যে উৎসব।
সকাল-বিকেল মারাংবুরুর থানে পূজো দেওয়া। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হলেই শুকনো পাতা, ডালপালা জড়ো করে আগুন জ্বালানো হতো। সেই আলোকে সামনে রেখেই মাদল, ধামসা বেজে উঠতো, আগুনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে সকলে নাচতো, হাঁড়িয়া-মৌল খাওয়া হতো। সকালে শুয়োর শিকার করে নিয়ে আসতো। সেই আগুনে ঝলসে উঠতো শুয়োরের মাংস। হাঁড়িয়া মৌলের সঙ্গে সেটাই সেই রাতের খাদ্য। সে এক অদ্ভূত রোমাঞ্চকর বন্য পরিবেশ।
আস্তে আস্তে লোকসংখ্যা বেড়েছে। বাইরের থেকেও লোক জন আসতে শুরু করেছে। এখন এখানে যে লোক দেখছো বেশিরভাগ বাইরের। সবাই আজকের দিনে এই মেলায় একটু আনন্দ করতে আসে। এদেরও ঘরের তৈরি হাঁড়িয়া, মৌল একটু বেশি বিক্রি হয়। দুটো পয়সা আসে। সবটাই পেটর জন্য বুঝলে।
ছোটোমা আমার মুখের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে।
অনি।
আন্টির দিকে তাকালাম।
পার্থক্য।
ওই যে বললাম সেই বুনো গন্ধটা আর নেই। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
তারমানে এরা আধুনিক হচ্ছে।
ঠিক আধুনিক নয়। আমরা উচ্চ শিক্ষিত, পরিশীলিত মনস্ক, জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা ওদের অরণ্যের অধিকারে থাবা বসিয়েছি।
কেন!
সে অনেক কথা। তবে তোমায় একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। এখানে অনেক ছেলে মেয়ে আছে, যাদের কোনও পিতৃ-পরিচয় নেই।
আন্টি আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।
বন-বাবুরা এখানে কাঠ কাটতে আসে। তারা তো আর শহর থেকে লোক-লস্কর নিয়ে আসে না। এদের দিয়েই কাজ করায়। সংসার রেখে আসে শহরে। পেটের দায়ে চাকরি করত এসেছে বনে। তাদের কাছে এরা কুলি-কামিন। একটু আধটু ফুর্তি করে। এরাও দুটো ভাত বেশি পায়। ফল স্বরূপ একটা সন্তান উপহার দেয়। বাবুরা শহরে চলে যায়। এরা কিন্তু সেই সন্তানকে ফেলে দেয় না। তাকে মানুষ করে।
এই ঘটনা জানার পর নীরুকে বললাম একটা কিছু ব্যবস্থা কর।
তুই কি পাগল হয়েছিস, তারপর কিছু হলে এখানে আসাই বন্ধ হয়ে যাবে।
তারপর কি ভেবে বললো, তুই একবার শ্যামকে বল।
শ্যামকেও বললাম। শ্যাম বললো, অনিদা তুই কিছু করতে পারবি না। তুই এদের কতো দিবি। দিয়ে শেষ করতে পারবি না। আগে তবু না খেতে পেয়ে অনেকে মরে যেত, এখন তবু তুই কিছু দিস বলে অতোটা মরে না।
শ্যামকে বললাম নীরুকে বলি পিল দিয়ে যেতে। ওরা যেন খায়।
শ্যাম আমার কথা শুনে হেসেছিল।
তবে ময়না-চূড়া আমার কথাটা বুঝেছিল। ওরা এই দায়িত্বটা নিয়েছিল। তুমি মানুষের এই আদিমতা বন্ধ করতে পারবে না। পরে নীরুর কাছ থেকে খবর নিয়েছিলাম কিছুটা কাজ হয়েছে।
এবার তোকে আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো।
বলো।
মনে কিছু করবি না।
কেনো, তুমি কি সেরকম কিছু কথা জিজ্ঞাসা করবে নাকি?
ঠিক তা নয়, ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে।
বলো।
তুই দিদির বাড়িতে কবে এসেছিলি?
চলবে —————————–
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/qlAWUmr
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment