নিজেরে হারায়ে খুঁজি [অধ্যায়-১ (পর্ব-৪)]

❝নিজেরে হারায়ে খুঁজি❞
BY- Nandana Das

অধ্যায় -১

পর্ব চার
—————————–

সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখলাম আমি আর ক্যারোল সামান্য একটা তিন ফুটের ছোট্ট কাপড়ের উপরে শুয়ে আছি একে অপরের সাথে লেপ্টে। ক্যারোল আমাকে একেবারে পা আর হাতের বন্ধনে নিজের বুকে নিয়ে নাক ডাকছে বিশ্রী ভাবে। জানিনা গত দুই মাসে মনে হয় আমি এই প্রথমবার এমন বোধহীন শান্তি তে ঘুমোলাম। কোনরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দেখি মালিয়া আর মা উঠে পরেছে। ইশ কি লজ্জা। মালিয়া কোনদিন ও দেখেনি এমন ভাবে ওর বাবা আর আমাকে শুতে। আমি উঠতেই বলল,
–       খিদে পেয়েছে মা।

আমি হেসে লেগে পরলাম আমার সন্তানদের খাবারের ব্যবস্থা করতে।

যাই হোক ক্যারোলের খবরে কোন ভুল ছিল না। একদিন পরেই রেডিও তে এনাউন্স করল খবর টা। মন দিয়ে শুনলাম সবাই। সাধারণত এমন খবর আমরা সবাই মন দিয়ে শুনি। একজন কোন ইনফর্মেশন মিস করলেও যাতে সমস্যা না হয়। ওরা বলল,

–       সকাল থেকে সব মিলিয়ে চারটে ট্রেইন আসবে ট্রিভিয়া থেকে। সব কটা ট্রেন আসবে দুপুর একটা থেকে দুটোর মধ্যে উত্তর ইকারা স্টেশন এ। তার মধ্যেই সকল তে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে আটলান্টার রিফিউজি শেল্টার এ। সকল কে অনুরোধ করা হচ্ছে, ষ্টীলের পাত সাথে রাখবেন সর্বদা। গান যেন থাকে সাথে। জলের বোতল। আর ফাঁপা ষ্টীলের রড, শব্দ উৎপন্ন করার জন্য। বেশী লাগেজ যেন না থাকে। লোক জনের জায়গা না হলে লাগেজ ওখানেই ছেড়ে যেতে হবে। মনে রাখবেন মানুষের জীবনের মূল্য লাগেজের থেকে অনেক বেশী। শুধু বাচ্চার খাবার দাবার জনিত কোন লাগেজ নেওয়া যেতে পারে।

শেষ ও হলো না খবর টা অনেক দূর দূর থেকে খান দশেক বন্দুকের আওয়াজ পেলাম আমরা সবাই। আসলে সবাই নিজেদের বাঁচার আশা টা সেলিব্রেট করল। ক্যারোল ও ডবল ব্যারেল বন্দুক টা নিয়ে বাইরে দুই রাউন্ড ফায়ার করে এল। আমি বুঝলাম বেশী লোক আর বেঁচে নেই এই ইকারা তে। আর যারা আছে তারা আমাদের মতই না মরে বেঁচে আছে কোন রকমে। নিজেদের মধ্যে ছোট ছোট খুশী গুলো কেই বড়ো করে নিচ্ছে নিজেদের মধ্যেই। আর আমার কাছে ব্যাপার টা দুদিকেই। গতকাল ক্যারোলের সাথে অল্পক্ষণের জন্যেও মিলিত হয়ে নিজেকে খুঁজে পেয়েছি সামান্য। আর ইভানের ব্যাপার টা আমাকে বলতে গেলে ভিতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে অল্প অল্প করে। আমি চোখে জল নিয়ে একটা স্কার্ট কে ব্যাগের মতন বানিয়ে, দরকারী জিনিস পত্র ভরে নিতে লাগলাম। সেই রাতে বন্দুকের আওয়াজের পরে আবার সারা রাত জুড়ে আমাদের শেল্টার এ আক্রমণ হলো বেশ কিছুক্ষণ ধরে। মনে হলো আজকে রাতে আর ও কিছু ইকারা বাসীর প্রাণ যাবে। দরকার ছিল না এই বন্দুকবাজীর, আটলান্টা তে পৌছনোর আগে।  

সকাল এলো যেন কোন নতুন আশা নিয়ে আমাদের কাছে। সবাই মিলে ভালো করে স্নান করলাম। আট টা বাজতে না বাজতেই রোদ উঠলো কড়া। মনে হলো আজকের দিন টা ভালো কিছু হবেই। ততক্ষণে ক্যারোল একটা ঘুরে বেড়ানো একটা বেশ বড় মুরগী কোথা থেকে ধরে নিয়ে এসেছে। তাকে ছাড়িয়ে ধুয়ে পুড়িয়ে খেতে খেতেই আমাদের দশ টা বেজে গেল। আমাদের সবার হাতে মানে আমার হাতে মায়ের হাতে আর মালিয়ার হাতে একটা করে ছোট ছোট পুঁটুলি। তাতে অল্প মাংশ আছে প্লাস্টিকে ভরা আর জামাকাপড় আছে সবার। পিন্টো রইল আমার কোলে। মালিয়া ওর বাবার কাঁধে। আর কীট আমার হাত ধরে আছে।  তিল তিল করে গড়ে তোলা এই সংসার এই জায়গা ছেড়ে আমরা রওনা দিলাম উত্তর ইকারা স্টেশন এ। ক্যারোলের হাতে আছে শক্তিশালী ডবল ব্যারেল গান টা। আমার স্কার্টে গোঁজা আছে একটা পিস্তল। লোডেড। কীট আর কীটের বাবার হাতে দুটো ষ্টীলের ফাঁপা রড। আর সবার কাছেই আছে লম্বা আর শক্ত ষ্টীলের ব্লেড। বের হবার আগে আমাদের ক্যারোল বলে দিল,

–       শোন সবাই কে বলে দিচ্ছি, লিরা, তুমি পিন্টো কে কোল থেকে নামাবে না। আমরা জলার রাস্তা নেব স্টেশন পৌঁছতে। প্রায় সাড়ে চার কিমি। তার কারণ হলো জলে ওরা ভয় পায়। যদি রাস্তায় আক্রমণ হয়, বিনা দ্বিধায় জলে ঝাঁপ দেবে বুঝেছ? কারোর জন্য অপেক্ষা করবে না।

তারপরে বিশেষ করে মালিয়া আর কীট কে বুঝিয়ে দিল ভালো করে। মা কে আলাদা করে বলল ক্যারোল এক ই কথা। আমরা সবাই থর থর করে ভয়ে কাঁপছি। এতো দিন কিছু বুঝলেই আমরা শেল্টার এ ঢুকে পরতাম। কিন্তু এখন আমাদের প্রায় পাঁচ কিমি হাঁটতে হবে। মাঝে কিছু হলে আর কোন উপায় নেই। তারপরে মনে পরল আমার ছেলে টা না জানি কি পরিমাণ কষ্ট সহ্য করেছে। ও যদি ওমনি করে সাহস দেখাতে পারে সেই দিনে আমি কেন পারব না। মনে মনে একটা সাহস জেগে উঠল আমার মধ্যে। আমার এখনো তিন সন্তান আমার কাছেই আছে। পারতে আমাকে হবেই। আর পিছনে নয় সামনের দিকে তাকালাম আমি পিন্টো কে কোলে নিয়ে।

আমি বেশ কিছুদিন বাইরে বের হই নি এর আগে। বেরোলেই শুধু পচা গন্ধ বাতাসে। রক্তের ছাপ চারিদিকে। দেওয়ালে, রাস্তায় বা দোকানের সামনের দাওয়ায়। ছোট ছোট গুল্মের পাতায় রক্তের বিন্দু। রাস্তায় পুরু হয়ে জমা রক্ত এখন কালো হয়ে গেছে। ঈশ্বর মনে হয় একেই নরক বলেছেন। আমি তাই বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজকে বের হতেই হলো। ঠিক আমাদের বাড়ির রাস্তা যেখানে বড় রাস্তা মানে হাই ওয়ে তে গিয়ে মিশেছে সেখানেই একটা কিশোর ছেলের মাথা পরে আছে। ইভানের মতই হলুদ চুল এক মাথা। গা গুলিয়ে উঠল আমার। মনে মধ্যে একটা অদ্ভুত বিষাদ। ইভানের কথা মনে পরল আবার। ওখান থেকে ছুটে পালাতে পালাতেই কেঁদে ফেললাম আমি। জানি আশে পাশে কেউ আর বেঁচে নেই। না জানি কোথা থেকে ওরা এই মাথা টা নিয়ে এসে এখানে ফেলেছে। ওরা জানে, কোথায় কোথায় জীবিত মানুষ আছে। সেখানেই ওরা বেছে বেছে আসে।

ক্যারোল ও ছুটে এসে আমাকে ধরে ফেলল এবারে। প্রায় জড়িয়ে ধরে পুরো পরিবার টা কে গার্ড করে আমার স্বামী আমাদের কে নিয়ে যেতে লাগল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। দেখলাম অনেকেই বড় জলার মধ্যে দিয়ে ষ্টেশন যাবার এই রাস্তা টা নিয়েছে। কিছু না হলেও প্রায় সত্তর জনের একটা বিশাল মিছিলের মতন করে আমরা যাচ্ছি। দুই দিকেই অগভীর জলা। আর জলার দুই পারে সবুজ চাষের জমি। এই দুই মাসেই আমার ইকারা কেমন প্রাগ ঐতিহাসিক যুগের মতন হয়ে গেছে। আগে কত সুন্দর ছিল এই জলার রাস্তা টা। এখন রাস্তা জুড়ে গাছের ঢল নেমেছে যেন। রাস্তার আশে পাশের ছোট ছোট গাছ গুলো কে মিউনিসিপ্যালিটী থেকে কেটে সুন্দর শেপ করে রাখা থাকত। তারাই এখন বপু বাড়িয়ে রাস্তা অধিকার করে নিয়েছে। রাস্তা ময় গাছের শুকনো পাতা। জলার শুরুর আগে কিছু বাড়ি ছিল। সব বাড়ি গুলো এখন ফাঁকা। ভয়ে যেন চারিদিক নিস্তব্ধ। প্রাণ হাতে নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি স্টেশনের দিকে।

স্টেশনে পৌঁছে একটু শান্তি পেলাম। এখনো দেরী আছে ঘন্টা খানেক। আকাশে ঝলমল করছে রোদ। ততক্ষণে আমি খাইয়ে দিয়েছি কীট আর মালিয়া কে পেট ভরে। কিছু মাংশ আছে আর ও। ক্যারোল কে খাইয়ে আমি আর মা খাব। তার আগে পিন্টো কে দুধ খাইয়ে দিলাম অনেক টা। আহা বেচারী পিন্টো, কত দুষ্টুমি করে দাদা আর দিদির সাথে এই দুপুরে ঘুমানোর আগে। আজকে একেবারে চুপ হয়ে আছে। ওর শিশু মন কিছু বুঝতে না পারলেও , পরিস্থিতি ওর শিশু মন কেও একেবারে স্তব্ধ করে দিয়েছে। খিদে পেয়েছিল বেশ ওর। কিন্তু বলতে পারছিল না । আমি বোঁটা টা মুখে দিতেই একেবারে দশ মিনিটেই দুটো মাই ই একেবারে শূন্য করে দিল ছেলে আমার।

অনেক লোক জমা হয়েছে। নয় নয় করেও এই ছোট্ট স্টেশনে লোক সংখ্যা প্রায় আড়াইশো তো হবেই। এদিকের ট্রেন গুলো বিশেষ বড়ো না। ছোট ছোট চার কামরার ট্রেন। ট্রিভিয়া থেকে প্রতি দুই ঘন্টায় চলে আটলান্টা অব্দি। ট্রিভিয়া আমাদের রাজধানী। কি জানি হয়তো ট্রেন আসছে তার ও আগে থেকে। এই আইল্যান্ড খুব বড়ো না। সাকুল্যে আড়াইশো কিমি বাই সত্তর কিমি হবে। লোক সংখ্যা প্রায় সারে চার লক্ষ। কিন্তু এখন হয়ত দশ হাজার ও বেঁচে আছে কিনা সন্দেহ। ওরা অপেক্ষা করছিল। বহু বার এনাউন্স করল প্রথম ট্রেন টা আসার আগে। কিন্তু প্রথম ট্রেনের ভিড় দেখে ভয় পেয়ে গেলাম আমি। ট্রেন টাই দেখা যাচ্ছিল না। শুধুই লোক, ঠিক শুঁয়োপোকার মতন ট্রেনের গায়েও যেন লেগে আছে। আমাকে ক্যারোল বলল,

–       প্রথম ট্রেন তাই এতো ভিড়। চিন্তা কোর না। পরের ট্রেন এ নিশ্চয়ই ওঠা যাবে।

আমি ভাবছি এ কেমন বিচার। এমন নরকে মাত্র চারটে ট্রেন? আরো ট্রেন দেওয়া কি উচিৎ ছিল না? ক্যারোল হয়ত আমার কথা বুঝতে পারল। বলল,
–       ট্রেন চালানোর লোক নেই হয়ত আর। চিন্তা কোর না। আমি বরং একবার স্টেশন মাস্টারের সাথে কথা বলে আসি।

ক্যারোল চলে গেল। আমি মা আর বাচ্চাদের নিয়ে বসে রইলাম। পিন্টো ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছে পেট পুজোর পরে। ক্যারোল ফিরে এসে বলল চিন্তা নেই। পরের ট্রেন টা আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডিজেল টানা একটা ইঞ্জিনে এলো আরেক টা ট্রেন। এই ট্রেন টাও ওই রকম ভাবেই এঁটুলি লাগা ভিড়। আমরা পাত্তাই পেলাম না। ক্যারোল পারলেও সে আমাদের ছেড়ে উঠলো না।

হুইসেল দিয়ে এই ট্রেন টাও বেড়িয়ে গেল। এদিকে প্রায় তিনটে বেজে গেছে। সূর্য্য হেলে পরছে ধীরে ধীরে আটলান্টিসের উলটো দিকে। স্টেশনের বিশাল ছাউনি টার ছায়া লম্বা হয়ে চাষের জমি তে গিয়ে পরেছে। কেমন একটা হাওয়া দিচ্ছে। রক্তের মেটে গন্ধ টা একেবারে ঢুকে যাচ্ছে ফুস্ফুসে। আমি চেষ্টা করছি , না নিতে সেই গন্ধ টা। এবারে কেমন একটা ভয় যেন আমাকে চেপে ধরল। মনে হতে লাগল যদি ট্রেনে জায়গাই না পাই আমরা? এই ট্রেন টা তে অনেকেই মারামারি করে উঠে পরল। যারা একা আর পুরুষ মানুষ ওরা চলে গেল। তাও স্টেশনে গিজগিজ করছে লোক। এর পরেই দূরে ধোঁয়া উড়িয়ে এলো তিন নম্বর ট্রেন। আমাকে ক্যারোল বলল,

–       তুমি কিন্তু পিন্টো আর কীট কে ছাড়বে না।
–       না ছাড়ব না। তুমি মালিয়া কে ধরে থেক। ও যেন ছেড়ে না যায়।

তারপরে মা কে বললাম,
–       মা তুমি আমাকে ছাড়বে না। ধরে থাকবে আমাকে।

মা ও খুব ভয় পেয়ে আছে। কোন রকমে আমার হাত টা ধরে আমাকে বলল,
–       ঠিক আছে

ক্যারোল বলল,
–       সবাই কে একসাথে উঠতে হবে এমন কিছু নেই। যে কামরা তে পারবে উঠে যাবে বুঝলে। ওখানে নেমে খুঁজে নেব। ভরসা রেখ , আমি ঠিক খুঁজে নেব তোমাদের।

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম আমি ক্যারোল কে।হাসলাম আমি ক্যারোলের দিকে তাকিয়ে। বোঝালাম ওকেই আমি ভরসা করি। এদিকে  তিন নম্বর ট্রেন টা এলো। চারিদিকে হাউমাউ করে কান্না কাটি মারামারি শুরু হয়ে গেল। আমি পিন্টো কে কোলে নিয়ে আছি। কীট এর হাত টা মনে হচ্ছে ছেড়ে যাবে এবারে। মা তো কখন আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে। আমি যতবার কীট কে টেনে নিয়ে উঠতে যাচ্ছি কেউ না কেউ আমাকে ঠেলে আবার পিছনে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কেঁদে ফেললাম আমি। ট্রেন ছেড়ে দিল মনে হলো এবারে। যাক কীট কে তুলে দিতে পেরেছি আমি। এবারে আমি উঠলেই ব্যস। পিন্টো কে কোলে নিয়ে কোন রকমে পা দানিতে পা দিয়েছি ভিতর থেকে কেউ একজন আমাকে ধাক্কা দিতেই আমি পড়ে গেলাম। ট্রেন ততক্ষণে স্পিড নিয়ে নিয়েছে। আমি বেকুবের মতন তাকিয়ে রইলাম চলে যাওয়া ট্রেন টার দিকে। আর অতো ভিড়ের মাঝেও মনে হলো দেখলাম কীটের ছোট্ট হাত টা আমাকেই খুঁজছে।

হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি। এই ট্রেন টা তে ষ্টেশন অনেক টাই ফাঁকা হয়ে গেল। দেখলাম ক্যারোল নেই ষ্টেশন এ। তার মানে ও উঠে পরেছে। যাক বাবা ও তার মানে কীট কে ঠিক খুঁজে নেবে। আর চিন্তা নেই। ছেলেটা আমার একা থাকবে না ওখানে। অনেকটা শান্তি এল মনে। এবারে মা কে খুঁজতে হবে। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলাম মা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আর কাঁদছে। আমি পিন্টো কে কোলে নিয়ে মায়ের কাছে ছুটে গেলাম। মা ভয় পেয়ে গেছিল। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরল আমাকে। বলল,
–       আমার জন্যেই তোদের যাওয়া হলো না তাই না রে?

আমি মা কে জড়িয়ে ধরলাম। ভাবলাম মা এমনি ই হয়। বললাম,
–       মা তুমি সেই সব কথা একদম ভাববে না বুঝলে? ক্যারোল মালিয়া আর কীট আগের ট্রেনে বেরিয়ে গেছে। এবারে আমরা যাব। তুমি চিন্তা কোর না। এবারে আমাকে একেবারে শক্ত করে ধরে থাকবে বুঝলে?

মা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। হাসল মিষ্টি করে। আমার মুখ টা নিজের দুই হাতে নিয়ে বলল,

–       আমি তো ভাবিনি আমার আধ পাগল মেয়েটা এতো সাহসী হবে কোন দিন। এতো সুন্দর করে সংসার করবে। এতো ভালবাসবে সবাই কে।

আমি বুঝলাম আমার মা আমাকে ভরসা করতে শুরু করেছে। সত্যি ই, ক্যারোল কে প্রেম করার আগে আমার আরো প্রেম হয়েছিল। তাদের কেও বিয়ের জন্য পাগল ছিলাম আমি। কম বকুনি খাই নি মায়ের কাছে। ক্যারোলের সাথে প্রেম টা আসলে মা বিশ্বাস করতেই পারে নি। তাই বিয়ের আগেই যখন ইভান পেটে এসেছিল তখন মা ভয় পেয়ে গেছিল। আমাকে খুব বকেছিল সেদিন রাতে। কিন্তু তখন আমার বাবা আমাকে বাঁচিয়েছিল। সিনিয়র ব্রুনো কে ডেকে পাঠিয়েছিল আমার বাবা। 

এদিকে চার নম্বর ট্রেন আর আসে না। আমি পিন্টো কে কোলে নিয়েই গেলাম ষ্টেশন মাস্টারের কাছে। দেখলাম আমার মতই অনেকেই ওখানে ভিড় করেছে। যা শুনলাম আর বুঝলাম তাতে আমার ভয় বেড়ে গেল। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা তার পরেই নেমে আসবে অন্ধকার। আমার তালুর উপরে এখনি কিলবিল করে উঠলো পোকার আওয়াজ। শুনলাম কোন যান্ত্রিক গোলযোগে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ কিমি দূরে ইকারা থেকে। ইঞ্জিন ঠিক করা চলছে। ভরসা পেলাম না লোকের কথায়। তাই জিজ্ঞাসা করলাম ষ্টেশন মাষ্টার কে।

–       স্যার তাও কতক্ষণে আসবে বলে আপনার মনে হচ্ছে।

ষ্টেশন মাষ্টার ছেলেটা অল্প বয়সী। আমাকে বলল,
–       জানিনা ম্যাম। আধ ঘণ্টার মধ্যে না এলে আমি চলে যাব। তবে বেশীক্ষণ আমিও থাকব না।
–       ওকে থ্যাঙ্কস।

মা কে এসে বললাম কথা টা। দুজনাই মারাত্মক ভয় পেয়ে আছি আর সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছি। একবার মনে হচ্ছে ফিরে যাই আমাদের শেল্টার এ আর একবার মনে হচ্ছে, আধ খানা পরিবার তো চলেই গেছে। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে থাকলে হয়ত আমরাও পৌঁছে যাব। মা অনবরত কাঁদছে। কারণ মা এসে থেকে ইকারা ষ্টেশন এ আমার বাবা আর ভাই দের খুঁজেছে। কাউকেই পায় নি। আমিও খুঁজি নি এমন না। কিন্তু মেয়েদের সন্তান হয়ে গেলে ওরাই তো আগে থাকে মেয়েদের জীবনে। চোখে জল এলো আমার ও। কিন্তু মা এর কষ্ট আমি বুঝতে পারছি। কারণ আমার ইভান কেও আমি হারিয়ে ফেলেছি। মা বলল,

–       কেউ বেঁচে নেই ওরা আর, তাই না রে লিরা?

মা কে জড়িয়ে ধরলাম আমি। বললাম,
–       মা তুমি আর ভেব না। ওখানে থাকলে, তোমাকেও আর আমি পেতাম না মা।

মা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল আমাকে জড়িয়ে ধরে। বলল,
–       কেমন করে সবাই কে আমারা হারিয়ে ফেললাম। দাদু ভাই আর তোর বাবা, তোর ভাই। উফ!!!
–       চিন্তা কোর না মা আমরা তো বেঁচে আছি। সবাই আবার একসাথে থাকব।

ধীরে ধীরে নেমে আসছে অন্ধকার। ষ্টেশনে উপস্থিত অনেকেই স্বজন হারানোর বেদনায় কাঁদছে। অন্ধকার নেমে গেলে আর হয়ত কেউ কাঁদতেও পারবে না। চারিদিকে একটা আতঙ্ক একেবারে চেপে বসছে উপস্থিত সবার মধ্যে। মা কে বললাম,
–       মা এবারে চল ফিরে যাই আমরা। দিন থাকতে থাকতে হয়ত আমাদের শেল্টার এ পৌঁছে যাব আমরা সবাই। তারপরে দেখা যাবে পরের সপ্তাহে।
–       হুম তাই চল। ফিরে যাই। সাথে পিন্টো দাদু ও আছে। আর থাকা যাবে না।

মায়ের কথা শেষ ও হলো না। আমরা সবাই শুনতে পেলাম ট্রেনের হুইসেল। বেশ কিছু টা দূরে এখনো ট্রেন টা। কালো ধোঁয়া বের করে আসছে । উপস্থিত সবাই উল্লাসে হই হই করে উঠল। আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। পিন্টো কে বেঁধে নিলাম কোলের সাথে। আর মায়ের হাত টা ধরলাম শক্ত করে। ট্রেন টা এসে দাঁড়ালো সামনে। ফাঁকা একেবারে। আমার আগে যে ছিল, সে উঠতে গিয়েই জোরে “ মা গো!!” বলে পিছিয়ে এলো।

পিছিয়ে এলো বললাম বটে, কিন্তু সে পিছিয়ে আসতে পারল না। সহসা দেখলাম একটা কালো কিছু লোক টার বুক টা চিরে পিঠের দিকে বেড়িয়ে এলো আর দলা রক্ত এসে লাগল আমার গায়ে বুকে মুখে। আর সেটা শরীর টা কে সামনে সামনি ভেদ করে দেবার পরে আড়াআড়ি ভাবেও কেটে ফেলল এক লহমা তেই। কোমরের উপরের আধখানা মাটিতে পরতেই, ভয়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম। চারিদিক থেকে এই রকমই আওয়াজ আসতে থাকল। পাশেই তাকিয়ে দেখলাম একজন পরে গেছিল ষ্টেশনে ভিড়ে। তার মাথা টা ফেটে গিয়ে একেবারে মিশে গেল যখন একটা কালো কিছু এসে ওর মাথায় সজোরে আঘাত করল। উফ!!! চোখের সামনেই এই নারকীয়তা দেখে কেমন ভ্যোম হয়ে গেলাম আমি ওখানে। আমার মাথায় ভোমরার মতন আওয়াজ না জানি কোথা থেকে জুড়ে বসল। পোকা কিলবিল করার আওয়াজ টা চারিদিক থেকে আসতে লাগল। আমি কেমন স্থানু হয়ে গেছিলাম। হয়ত তখন ই আমার শেষ সময় চলে এসেছিল। যদি না পিন্টো কেঁদে উঠত আমার ওখানেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত। পিন্টো জোরে কেঁদে উঠতেই আমার যেন চমক ভাঙল।

মনে হলো কোলের ছেলেটা কে বাঁচাতেই হবে আমাকে। আমি মায়ের হাত ধরে উলটো দিকে দৌড়োতে শুরু করলাম। তখন আমি বুঝে গেছি, এই ট্রেন এর লোক গুলো কে অনেক আগেই এই শয়তান গুলো শেষ করে দিয়েছে। চারিদিকে প্রচন্ড আতঙ্কের চিৎকার। আর আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল এই জন্য যে, পিছনে মেরে ফেলবার জন্য অনেকেই ছিল। আর আমরা এক ছুটে চলে এসেছি ষ্টেশনের বাইরে। জলার রাস্তার দিকে প্রাণপনে দৌড়তে শুরু করলাম আমরা। পিন্টো ভয়ানক কাঁদছে। থামাতে পারছি না কিছু তেই। কিন্তু ভাবতে পারিনি জীবন আর মৃত্যুর মাঝের এই সময়ে আমি সব থেকে অনাকাঙ্খিত উপহার টা পাব। আমরা সবার আগে বের হয়ে এসেছিলাম ষ্টেশন চত্বর থেকে। বাইরে বের হয়েই, জলার শুরুতেই সামনেই দেখলাম, একটা হলুদ চুলের ছেলে দাঁড়িয়ে, হাতে একটা বন্দুক নিয়ে।

ইভান!!!!!!!!!

কিন্তু এ কি হলো ইভান আমাকে চিনতে পারছে না? ইশ কি অবস্থা হয়েছে ওর। চুল লতিয়ে গেছে ঘাড়ের নীচে। গায়ের রঙ কালো হয়ে গেছে। লম্বা লাগছে বেশী, কিন্তু রোগা হয়ে গেছে। আমি ডাকলাম

–        ইভান!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!

আমার মা ও ইভান কে চিনতে পেরেছে আর তাতেই আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরল। পিন্টো কোলের মধ্যেই দুবার চাগাড় দিয়ে উঠল দাদা কে দেখে। ভুলে গেছিলাম সবাই যে আমরা পালাচ্ছিলাম মৃত্যুর থেকে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই। ইভান কে পেয়ে আমাদের মধ্যে আনন্দের শেষ রইল না। আমি পিন্টো কে কোলে নিয়েই ছুটে যাচ্ছিলাম ইভান কে নিজের বুকে নেব বলে। কিন্তু ইভানের মুখ টা কেমন কঠিন। আমাদের দেখে ও ওর মনে কোন খুশী নেই। বন্দুক টা তাগ করে আমার দিকে দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল ইভান। মুখে একটা কঠিন পাশবিক নৃশংসতা।আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,
–       ইভান! এই ইভান! কি করছিস। আমি তোর মা!

কিন্তু কে শোনে কার কথা! দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল আমাদের দিকে। ঠিক দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে তখন ইভান, গুলি করল ও। এক হাতে পিন্টো ছিল আমার। ভয়ে পিন্টো কে জড়িয়ে ধরেই আমি নীচু হলাম। তারপরে দেখলাম ঠিক আমার পাশেই একটা ম্যানকুশের লাশ পরে। আমি ইভানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তারপরেও ও তীব্র বেগে ছুটে আসছে আমার দিকে। ঠিক আমার আগে এসেই ও লাফালো। আর দুই হাতে কঠিন ভাবে ধরা একটা দু ফুটের শক্ত ষ্টীলের ব্লেড। প্রায় উড়ে এলো আমার দিকে, কিন্তু সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। আমি আবার চোখ বুঝে ফেলেছিলাম ভয়ে। একটা আওয়াজে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ইভান লাফ দিয়ে নিজের হাতে থাকা একটা ষ্টীলের ছুরি বসিয়ে দিয়েছে আরেকটা ম্যানকুশের ঠিক মাথার মাঝে। সময় নষ্ট করল না ও । এক ঝটকায় তুলে নিলো ব্লেড টা শয়তান টার মাথা থেকে। সাথে সাথেই লাফ দিয়ে উঠল। আমাকে বলল,

–       সময় নেই মা আর। চল। ওই দেখ পিছনে!!!!

তাকিয়ে দেখলাম, অগুন্তি ম্যানকুশ ষ্টেশনে মরনযজ্ঞ চালাচ্ছে। আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে ওরা বেশী সময় নেবে না। আর ঠিক তাই হলো, দুটো শয়তান আমাদের দিকে তাকিয়েই তীব্র বেগে এগিয়ে আস্তে শুরু করল। ইভান আমার হাত টা ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল জলার দিকে। আমি পিন্টো কে জাপ্টে ধরে দৌড়চ্ছি আর ঈশ্বর কে ডাকছি। প্রায় শয়তান দুটো আমাদের ছুঁয়ে ফেলবে তখন ইভান আমাকে আর মাকে ঠেলে দিলো এক দিকে আর নিজে অন্য দিকে ঝাঁপ দিলো জলার। আর ও একজনের ঝাঁপ দেবার আওয়াজ আমি পেলাম আমাদের সাথেই আমাদের দিকে।
কোলে পিন্টো আছে আমার। আমি আর মা ঝাঁপ দিয়েই বুঝলাম এখানে জল কম। কোমর জল কিন্তু পিন্টো বেচারী খানিক জল খেয়ে ফেলল। আমি পিঠে থাপ্পড় দিয়ে হালকা হালকা করে ওর কাশী বন্ধ করলাম। চেঁচিয়ে উঠলাম আমি,
–       ইভান !! ইভান!!

আওয়াজ এলো ওই দিক থেকে।

–       আমি আছি মা! চিন্তা কোর না। একটু গভীরে চলে যাও তোমরা। খেয়াল রাখবে ওদিকে চাষের জমি থেকেও যেন ১৪ ১৫ ফুট দুরত্ব থাকে।
আমি দেখে নিলাম। এখানে গভীরতা বেশী নেই। আমার বুক অব্দি। আমি পিন্টো কে কোলে নিয়ে, মায়ের হাত ধরে জলার জলে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপ করে। আরেক টা আওয়াজ পেয়েছিলাম, দেখলাম একটা বিশাল মোটা লোক আর খুব লম্বা লোক এসে আমাদের দিকেই ঝাঁপ দিয়েছে। তার হাতে একটা তলোয়ার। লোকটা বিশাল দেহী বুঝলাম কারণ, চেহারা তো অন্ধকার হলেও বুঝতে পারছি, আর যেখানে আমি বুক জলে সেখানে লোকটার কোমর জল। আমার একটু ভরসা হলো। লোকটা সরে এলো আমাদের দিকে। মনে হলো সবাই মিলে একসাথে থাকাই ভালো। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম ইভান কে,

–       কি রে তুই ও সরে গেছিস তো উলটো দিকে?

উত্তর এলো,
–       হ্যাঁ মা। আমি তো এই করেই বেঁচে আছি গত দু মাস।
–       ঈশ্বরের অশেষ করুনা সোনা।

উলটো দিকে থেকে কোন আওয়াজ এলো না। পাশের সেই বিশাল দেহী লোক টা আমাকে জিজ্ঞাসা করল,
–       কে ও? ছেলে?
–       হ্যাঁ।
–       খুব সাহসী ছেলে। আমি দেখলাম কেমন ভাবে ম্যানকুশ দুটো কে মারল। আর ইনি কে ?
–       মা।
–       যাওয়া হলো না তাহলে আটলান্টায়?
–       নাহ কই আর হলো? তবে আমার স্বামী , মেয়ে আর মেজ ছেলে চলে গেছে।
–       হুম। আমার আর কেউ বেঁচে নেই।
–       ওহ সরি।
–       না না সরি বলার কি আছে? এ অবস্থা তো সবার। বরং আপনাদের দেখে ভালো লাগছে বেশী।

লোকটার কথার মাঝেই মনে হলো আবার তেমন ভোমরার ডাক শুনতে পেলাম। দেখলাম লোকটা ও সাবধান হয়ে গেল। তার মানে সবার কানেই এই আওয়াজ আসে। পোকা কিলবিলের আওয়াজ পেলাম আমি। উলটো দিক থেকে ইভান বলল,
–       মা আর কথা বোল না তোমরা। চুপ করে যাও। ভয় পাবে না একদম। কিচ্ছু হবে না। আমার কাছে গান আছে। ব্যস কথা বোল না তোমরা। আমি ঠিক আছি। আমাকে ডেক ও না কেমন?

ছেলের কথা শেষ ও হলো না। ঝাঁকে ঝাঁকে শয়তানের দল ছুটে এল জলার ধারে। সার দিয়ে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত রকম আওয়াজ বের করতে থাকল ওরা। কেমন ঘ্যানঘ্যানানির মতন আওয়াজ টা। আমার মাথা ধরে গেল। পিন্টো হয়ত কাঁদতে যাচ্ছিল আমি পিন্টোর মুখ টা চেপে ধরলাম। উফ মাথা ঘুরছে আমার এবারে। এক হাতে পিন্টো কে কোলে নিয়ে চেষ্টা করছি যাতে ওই আওয়াজ কানে না নিতে হয়। জানিনা কতক্ষণ চলেছিল সেই আওয়াজ। অনেক পরে, আসতে আসতে কমে গেল সেই আওয়াজ। আমরা দেখলাম, জলার ধার ওরা খালি করে দিল। দুই দিকে ভাগ হয়ে চলে গেল ওরা। আমি কোন আওয়াজ করছি না, কারণ ইভান মানা করেছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে ইভানের গলা এলো ওপার থেকে। একটু চাপা। বলল,

–       ওরা চলে গেছে মা। কিন্তু কি বলত আমাদের থাকতে হবে এখানে এখনো অনেকক্ষণ। ভোরের দিকে মিনিট তিরিশ সময় পাওয়া যাবে। সেই সময়ে কিন্তু আমাদের দৌড়োতে হবে চার কিমি। পারবে তো?

আমি মায়ের দিকে তাকালাম। তারপরে বললাম,
–       আমি তো পারব। কিন্তু তোর দিদা?
–       সব হয়ে যাবে। আমি ভাই কে নিয়ে নেব কোলে। বেশী জোরে ছুটতে হবে না। একটু  তাড়াতাড়ি হাঁটতে হবে। দিদা পারবে ঠিক।

মা বলল আমার কিছু বলার আগেই।
–       হ্যাঁ পারব।

আমি বললাম,
–       তুই এদিকে চলে আয় না ইভান। একবার তোকে জড়িয়ে ধরি সোনা।
–       আচ্ছা দাঁড়াও আসছি।
বাস কিছু পরেই দেখলাম ইভান উঠে এদিকে চলে এল। আমার যেন তর সইছিল না আর। ও কাছে আসতেই পিন্টো কে মায়ের কোলে দিয়ে ইভান কে জড়িয়ে ধরলাম আমি পাগলের মতন। চুমু খেতে লাগলাম ওকে সারা গায়ে হাতে গালে কপালে ঠোঁটে। উফ যেন আমি সাত রাজার ধন বুকে পেলাম। জানিনা কেন আমার মন বলছিল ছেলে আমার ঠিক আছে। বাস শুধু আসতে পারছে না আমাদের কাছে। জলের মধ্যে দাঁড়িয়েই সেই বিশাল দেহী লোকটা দেখছিল আমি কেমন করে ছেলেকে আদর করছি। বলে বোঝাতে পারব না আমি আমার যে কি রকম আনন্দ হচ্ছে। আমার স্বামী, কীট আর মালিয়ার বিচ্ছেদ আমাকে ইভান ভুলিয়ে দিল। মনে হচ্ছিল কবে সামনের শুক্রবার আসবে আর আমরা সবাই মিলে চলে যাব যেখানে আমার বাকী পরিবার আছে। ইভান চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল হাতে একটা বড় বন্দুক নিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ আদর করার পরে ওকে আমি ছাড়লাম। তারপরে পিন্টো কে কোলে নিলাম আমি আর মা খানিক আদর করল ইভান কে। তখনো বিশাল দেহী লোকটা হাঁ করে দেখছিল আমাদের কে। ইভান কে জিজ্ঞাসা করলাম

–       হ্যাঁ রে জকি কোথায়?

ইভান বলল,
–       সে আছে মা আশে পাশেই কোথাও। আমি তার আওয়াজ পাচ্ছি অনবরত। ও লুকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে আমাকে জানান দেয় ও আছে। আর বিপদ আসলে চলে আসে আমার কাছে। দেখবে?

এই বলে অবিকল কুকুরের আওয়াজ বের করল ইভান মুখ থেকে,
–       ভুক!!
ঠিক সেকেন্ড দুই তিন পরে ষ্টেশনের সামনেই একটা জলা থেকে আওয়াজ এলো
–       ভুক!!
ইভান আমার দিকে তাকিয়ে হাসল ওই আওয়াজ টা আসার পরেই। তারপরে হাসি মুখেই বলল,
–       আমি ভেবেছিলাম, যদি তোমরা বেঁচে থাক, তোমাদের দেখা পাবই এখানে।

কিন্তু বলতে বলতে গলা ভিজে এলো ইভানের। আমারো চোখে জল এসে গেল আবার। ওকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। ভাবলাম, ইশ ছেলেটা কি ভাবেই না কাটিয়েছে এই দুটো মাস। আমকে জড়িয়ে ধরে রইল ও। আর পিন্টো কে চুমু খেলো অনেক গুলো। বলল,

–       জান মা আমি সব থেকে বেশী চিন্তায় ছিলাম তোমার। ভাবছিলাম কি জানি, তুমি যেমন সবাই কে বাঁচাতে দৌড়বে, তার পরে তোমার কি হবে। সিনিয়র ব্রুনো সেদিনে যা ঘাবড়ে গেছিল আমি তো ভাবিনি তোমাদের আর পাব মা।

আমি বললাম,
–       আরেকটু আগে আসতে পারতিস? তাহলে হয়ত আগের ট্রেনেই আমরা চলে যেতে পারতাম।
–       হুম। কিন্তু আমার কাছে রেডিও নেই তো। আমি জানতাম না। আমি থাকি জলার ঐ দিকে একটা মাড আইল্যান্ড আছে সেখানে। প্রায় পনেরো কিমি দূরে এই মেইন আইল্যান্ড থেকে।
–       তুই বাড়ি আসিস নি কেন, শুক্রবারে তো ম্যানকুশ বের হয় না।
–       সেটাও আমি জানতাম না মা। আমি অনেক বার রাতে এদিকে এসেছি। মানে আমাদের বাড়ির দিকে। কিন্তু জল থেকেই দেখতাম রাতে অনেক গুলো ম্যানকুশ আমাদের বাড়িতেই ঘোরা ফেরা করছে। আমি ফিরে যেতাম আবাঁর সাঁতরে।
–       তাহলে আজকে কি ভাবে এলি?
–       আজকে আমি ঠিক করেই ছিলাম যে আসব। দিনে এসেছি ওই জন্যে। আজকে হালকা মেঘ ছিল। এসে দেখলাম কোথাও কিছু নেই। ততক্ষণে দুপুর পেরিয়ে প্রায় বিকাল। তারপরে রাস্তার এপারে এসে জলার রাস্তা ধরলাম। ভেবেছিলাম, যদি ম্যানকুশ সামনে চলে আসে তবে জলায় ঝাঁপ দেব। এসে দেখি এখানে মানুষের মেলা। তখন ই জানলাম ট্রেন নিয়ে যাচ্ছে আমাদের আটলানায়। আমার সুবিধা আছে এই যে জকি বুঝতে পারে বহু দূর থেকে ম্যানকুশের উপস্থিতি। তাই আমি জলা থেকে উঠতে সাহস পেয়েছি আজকে।

আমি ওর সাথে কথা বলছি আর ওর গাল, হাত, শরীর থেকে কাদা গুলো কে ধুয়ে দিচ্ছি। ওকে বললাম,

–       তোর বাবা তোকে দেখলে কি যে খুশী হত।  আহা মানুষ টা রোজ একলা কাঁদত ছেলের জন্য।

ইভান আমাকে জড়িয়ে ধরল একেবারে জাপটে। আমিও জড়িয়ে ধরলাম, পিন্টো কে কোলে নিয়েই। ও আমাকে বলল,
–       এর পরের সপ্তাহ তেই নিশ্চই অন্য ট্রেন দেবে। আমরা চলে যাব মা ওখানে। কত দিন বাদে তোমাকে পেলাম মা।

ইভানের সাথে কথোপকথনে যা বুঝলাম, আমাদের পুরো রাত্রি টাই এই ভাবে জলার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কালকে সকালের মধ্যে যদি আমরা পৌঁছতে না পারি আমাদের শেল্টার এ তবে জানিনা কি হবে। জীবন যেন প্রতি মুহুর্তে পরীক্ষা নিচ্ছে। আর যেমন তেমন পরীক্ষা নয়, একেবারে জীবন মৃত্যুর পরীক্ষা। ঠিক সেই সময়ে পিন্টো কেঁদে উঠল। বুঝলাম ওর খিদে পেয়েছে। পিন্টোর কান্নার সাথে সাথে আবার জকির আওয়াজ পেলাম পুকুর থেকে। বাড়িতেও ঘরে পিন্টো কাঁদলে আর আমি বাইরে থাকলে জকি এই ভাবেই আমাকে আওয়াজ দিতো। যেন আমি শুনতে পাই নি ওর কান্না। আজকেও তার অন্যথা হলো না। ইভান আবার অবিকল কুকুরের গলায় ডাক দিলো,

–       ভুক ভুক।

দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই জকি এদিকের জলার জলে ঝাঁপ দিল। একেবারে আমার কাছে এসে আমার গায়ে মাথা টা ঠেকিয়ে নাড়াতে লাগল। আমি এক হাতে ওর মাথায় গলায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতে লাগলাম। ভাবলাম ইশ সবাই মিলে যদি ট্রেন টা ধরে ফেলতে পারতাম তবে আজকে আমার পুরো পরিবার একসাথে থাকত। এই সময়ে পিন্টো আবার কেঁদে উঠল। এবারে ওকে দুধ দিতে হবে। সমস্যা হলো দুপুরে ওকে কোলে নিয়ে দুধ দিয়েছি। এখন দাঁড়িয়ে আছি তাও বুক জলে। এই ভাবে দাঁড়িয়ে ছেলেকে দুধ খাওয়াতে হবে কোন দিন ভাবিনি। যদিও ইভানের কোমর জল। জলে ভিজে আমার টপ টা সেঁটে গেছে পিঠের সাথে। নিজে হাত বাড়িয়ে ব্রা র হুক আমি খুলতে পারব না। সমস্যা হলো ওই লোকটা। ওর সামনেই কি ভাবে খুলি আমার ব্রা টা। বা মা কেই বা কি ভাবে বলি খুলে দাও। আর পিন্টো কেঁদেই চলেছে। ইভান বলল,

–       মা ওকে চুপ করাও না হলে আওয়াজে আবার এসে উৎপাত করবে। খুব বিপজ্জনক ওরা।

আমি আর অপেক্ষা করলাম না। মা কে বললাম ব্রা টার পিছন থেকে খুলে দিতে। এদিকে তাপমান নেমে আসছে নীচে খুব দ্রুত গতি তে। এমন শীতলতায় এক বুক জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে পরিবার কে নিয়ে থাকতে আমি জীবনে ভাবিনি। পিন্টো টার জামা প্যান্ট ও ভিজে গেছে। ওর জামা যে পুঁটুলি তে নিয়ে ছিলাম, সেটাও ভিজে গেছে জলে ঝাঁপ দেবার সময়ে। আমি পিন্টো কে নিয়ে ভাবছি আর মা আমার টপ টা পিছনে তুলে ব্রা এর হুক টা খুলে দিল। ভিজে গেছিল আমার ব্রা টা পুরোই। আমি পিন্টো কে ইভানের কোলে দিয়ে হাত দিয়ে গলিয়ে নিয়ে ব্রা টা বের করে নিলাম।

এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম সেই লোকটা হাঁ করে দেখছে আমার ব্রা বের করে নেওয়া টপের ভিতর থেকে।তারপরে টপ টা বুকের উপরে তুলতেই আমার বড় মাই টা বের হয়ে এলো।আর সেটা দেখেই ইভানের কোল থেকেই পিন্টো ঝাপিয়ে পরল আমার বুকে। বাঁ দিকের মাই টা দুই হাতে ধরে, ইভানের কোল থেকেই ঝুঁকে প্রাণপনে টানতে লাগল আমার বোঁটা। যখন টানছিল বোঁটা একটা চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছিল আমার বোঁটায়। বুঝলাম খিদে পেয়েছিল ওর খুব। হয়ত ভাবছে ছেলে আমার,  জোরে টানলেই বুঝি বেশী বেশী করে দুধ যাবে ওর মুখে। আসলে আজকে সকাল থেকে ও আমার দুধ খাচ্ছে। বাড়িতে থাকলে অন্যান্য খাবার ও খায় ও। কিন্তু আজকে সারাদিনেই, তরল দুধ ওর পেটে যাচ্ছে কাজেই ওর খিদে পেয়ে যাচ্ছে বারবার। আমি পিন্টো র মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। অদ্ভুত একটা শান্তি চারিদিকে। লোকে খেই হারিয়ে ফেলবে এই শান্তি তে।কত মরণ আর্তনাদ, দুখন্ড হয়ে যাওয়া শরীর রাস্তায় পরে আছে অজানা অচেনা হয়ে এই শান্তির পিছনে সেটা এই মুহুর্তে কেউ আন্দাজ করতে পারবে না।

কিন্তু আকাশে চাঁদের আলোয়, কোন সুদুর থেকে ভেসে আসা রক্তের গন্ধ মাখা হাওয়ার ঘ্রাণ আমাকে কেমন চঞ্চল করে দিল। মনে হলো এই শান্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে মৃত্যুর করাল ছায়া। আমি দেখছিলাম চারিদিকে। ততক্ষণে পিন্টো বাঁ দিকের মাই টা ছেড়ে ডান দিকের টা ধরেছে। ইভান ধরে আছে ভাই কে। আর সেই লোক টা বিশ্রী ভাবে তাকিয়ে আছে আমার মাই দুটোর দিকে। মুখে একটা বেকুব নোংরা হাসি। হয়ত এই পরিস্থিতি তে না থাকলে বেকুব হাসি টা দিত না। নোংরামো টাই থাকত। কিন্তু এই রকম মৃত্যুর দোর গোঁড়ায় দাঁড়িয়েও একজন মায়ের দুধ খাওয়ানো দেখছে তার ছেলেকে বাধ্য হয়ে, হয়ত এটাই ওকে বেকুব বানিয়ে দিয়েছে। আর কোন আওয়াজ নেই চারিপাশে, শুধু আমাদের গায়ে জলের ধাক্কা লাগার ছিপছিপে শব্দ, মাঝে মাঝে হাওয়ার গাছের পাতায় লেগে শনশন শব্দ আর নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে পিন্টোর দুধ খাবার শব্দ।

–       চক চক চক চক চক চক।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/XNsKDAV
via BanglaChoti

Comments