প্রতিশোধঃ দ্যা রিভেঞ্জ (পর্ব-২১)

একবিংশ পর্ব
—————————–

বীরেন ভট্টাচার্যের হেড অফিসে আগুন, কিন্তু কেন? কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে অভয়কে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নটা করে আমির ,মাহমুদ আর উসমানকে ওদের বিশ্বাসঘাতকতার চরম শাস্তি দিয়েছে এরপর রকির দেহ যাতে ওর পরিবারের হাতে পৌঁছে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করে ফিরে এসে দুই বন্ধু বাগানে বসে নিজেদের পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করছে তখনই অভয় বলে কথাটা যে সে এখন বীরেন ভট্টাচার্যের অফিসে অর্থাৎ যেখান থেকে উনি নিজের সব কাজ কারবার কন্ট্রোল করেন সেখানে আগুন লাগাতে চায়, তার‌ই উত্তরে আমির প্রশ্নটা করে।
দরকার আছে আমির আর আমিও তোমাদের সাথে যাবো।
সে নাহয় আগুন লাগানো গেল কিন্তু হটাৎ ওখানে কেন? মানে কোনো বিশেষ কারণ কি?
হ্যাঁ।
ওহ্ ঠিক আছে কখন করতে হবে?
আজ রাতেই।
ঠিক আছে। আমির উঠতে যায় কিন্তু অভয় বসতে বলে, আমির আবার বসে পড়ে, একটু চুপ করে থেকে অভয় বলতে থাকে: তুমি হয়তো ভাবছো আমি কি পাগলামি শুরু করেছি, কিন্তু ওখানে আগুন লাগাতে চাওয়ার একটা উদ্দেশ্য আছে।
আমির চুপ করে শুনতে থাকে অভয় বলতে থাকে: তুমি হয়তো ভুলে গেছো যে জমিটায় বীরেন ভট্টাচার্য নিজের সমস্ত পাপের কন্ট্রোল রুম বানিয়েছেন সেটা একসময় আমাদের ছিল, আমার বাবা খুব কষ্ট করে ওইটুকু জমি কিনে একটা ছোটো বাড়ি বানিয়েছিলেন, আমাদের কাছে সাক্ষাৎ স্বর্গ ছিল ওটা কিন্তু একরাতে বীরেন ভট্টাচার্য আমাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে আমাদের স্বর্গকে নরকে পরিণত করেছেন, আমার বাবার স্মৃতিধন্য জমি ওটা আমার কাছে পরম পবিত্র কিন্তু বীরেন ভট্টাচার্য ওখানে বসে অজস্র পাপ করেছেন ফলে ওটা অপবিত্র হয়ে গেছে তাই ওটাকে আবার পবিত্র করতে হবে, আগুন দিয়েই ওই জমিকে অপবিত্র করার সূচনা করেছিলেন বীরেন ভট্টাচার্য আর আমি আগুন লাগিয়েই আমি আবার ওই জমিকে পবিত্র করবো।
তুমি চিন্তা কোরো না হয়ে যাবে। অভয়ের কথা শেষ হতেই বলে ওঠে আমির।
আরেকটা কাজ করতে হবে।
কি?
শিউলী দেবীর দেওয়া ব্রহ্মাস্ত্রটা প্রয়োগ করার সময় এসে গেছে।
আমিরের মুখে হাসি দেখা দেয় বলে: তাহলে তো ওনার খেল খতম।
হ্যাঁ, এবার সময় হয়েছে শেষ আঘাতটা করার, রকির মৃত্যুর পর উনি আর চুপ করে থাকবেন না, এখন উনি আমাকে শেষ করার জন্য যা করা সম্ভব তাই করবেন আমার পরিচিত কাছের মানুষদের মারার চেষ্টা করবেন সাথে ক্ষমতা অর্জনের জন্য ভোটে জিতে সিএমের গদিতে বসতে চাইবেন কিন্তু ওনার ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে যাবে, আমি পূরণ হতে দেবো না।
দুই বন্ধু আলোচনা করছে এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে তাথৈ এসে দাঁড়ায় ওকে দেখে দুজনেই একটু অবাক হয় অভয় জিজ্ঞেস করে: কিছু বলবে?
হ্যাঁ, মানে।
কি হয়েছে? কিছু দরকার?
একটা কথা ছিল, কিন্তু বুঝতে পারছি না কিভাবে বলবো?
তুমি কবে থেকে আমাকে কিছু বলার আগে ভাবতে শুরু করলে?
একটু ভেবে তাথৈ বলেই ফেলে “এক্ষুনি বৃষ্টির ফোন এসেছিল”
ও, তা কি বললো?। অভয়ের গলা নিস্পৃহ।
কিসব উল্টোপাল্টা বকছিল, বললো কারা জ্যেঠিমাকে মেরেছে এখন ওকে মারতে চায়।
তো তুমি কি চাও আমি ওর খোঁজ করি?
হ্যাঁ, আমি জানি ও তোমাকে অপমান করেছিল কিন্তু আজ ওর কথাবার্তা কেমন শোনাচ্ছিল তুমি যদি একবার..
এটা তুমি কি বলছো তাথৈ? পিছন থেকে কখন যেন বিদিশা এসে দাঁড়িয়েছে, কথাটাও সেই বললো।
বৌদি বিশ্বাস করো আজ বৃষ্টির আওয়াজ নরমাল ছিল না।
হতে পারে আবার এটাও হতে পারে এটা বীরেন ভট্টাচার্যের নতুন প্ল্যান।
মানে? কথাটা তাথৈকে বেশ অবাক করে বোঝা যায়।
বীরেন ভট্টাচার্য খুব ভালো করেই জানেন যে তোমাদের দুই বোনের পরস্পরের মধ্যে খুব মিল, তাই একজনের বিপদের কথা শুনে অপরজন ঠিক থাকতে পারবে না যেখানেই থাকুক সে আসবেই।
তাতে কি হলো?
তুমি এখনো বুঝতে পারছো না, বীরেন বাবু এখন যেনতেনভাবে রয়কে মারতে চাইবেন আর উনি এটা ভালো করেই জানেন যে রয়কে মারা তো দূর এখন ওর অবধি পৌঁছানো ওনার পক্ষে ইমপসিবল, কিন্তু যদি কোনোভাবে রয়ের কোনো দুর্বলতা হাতে পান তাহলে সহজেই রয়কে পেয়ে যাবেন ঠিক যেমন আগের বার আমিরকে ব্যবহার করেছিলেন।
তাথৈ বুঝলো ব্যাপারটা সে বলে:কিন্তু কেন জানিনা আজ বৃষ্টির গলা অন্যরকম শোনালো, এখন ওর ফোনটাও বন্ধ, বারবার বলছিল ওকে বাঁচাতে। বলে অভয়ের দিকে তাকালো, কভয় বুঝলো তাথৈ কি বলতে চাইছে কিন্তু বিদিশা যেটা বলছে সেটাও যুক্তিযুক্ত আবার যদি সত্যিই বৃষ্টির কোনো বিপদ হয় তাহলে অভয়ের উচিত ওকে বাঁচানো, বিপন্নকে বাঁচানোর শিক্ষাই সে পেয়েছে তার বাবা এবং গুরুর কাছ থেকে।
আমার মনে হয় বিদিশা ঠিক বলছে এটা প্ল্যান হতে পারে। বলে আমির‌। অভয় উত্তর দেওয়ার আগেই ওর মোবাইলটা বাজতে শুরু করে, ফোনটা রিসিভ করে সে “বল”
ভাই, আই নিড ইওর হেল্প। ফোনের ওপাশ থেকে অমিয়র গলা শোনা যায়।
তোর আবার কি হয়েছে?
বীরেন ভট্টাচার্যের লোকজন বৃষ্টিকে তাড়া করছে, আর আমি ওকে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করছি কিন্তু জানিনা কতক্ষণ পারবো?
তোরা কোথায়?
বাইকে করে পালাচ্ছি, কিন্তু যেখানেই যাচ্ছি যেদিকেই যাচ্ছি ওরা ঠিক খোঁজ পেয়ে যাচ্ছে।
গাঁড়ল কোথাকার, আমার বাড়ির দিকে আয়, আমিও বেরোচ্ছি।
থ্যাংকস ভাই।
তুমি যাবে? ফোন রেখে অভয় বেরোনোর উদ্যোগ করতেই জিজ্ঞেস করে আমির।
হ্যাঁ, যেতেই হবে, সত্যি মিথ্যা যাই হোক অমিয় এখন বৃষ্টির সাথে আছে আর দুজনের পিছনেই লোক তাড়া করছে।
ঠিক আছে আমিও যাবো তোমার সাথে।
আমিও যাবো। তাথৈ বলে ওঠে।
না, তুমি এখানে থাকবে।
অভয় আমি যাবো, প্লিজ আমাকে নিয়ে চলো।
তাথৈ আমার উপরে ভরসা রাখো।
তাথৈ আর কিছু না বলে চুপ করে যায়।
দুই বন্ধু বেরিয়ে আসে গাড়িতে উঠতে উঠতে অভয় আমিরকে বলে আমির নিকুঞ্জকে ফোন করো।
একটু ফাঁকা রাস্তা পেয়ে অমিয় বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছে পিছনে বৃষ্টি দুহাতে ওকে আঁকড়ে ধরে আছে হটাৎ একটা কানফাটানো আওয়াজ আর ওদের মাথার পাশ থেকে কি যেন বেরিয়ে গেল বুঝতে অসুবিধা হলো না যে পিছনে যারা তাড়া করছে এতক্ষণ অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল আসছিল এখন তারা এখন গুলি চালাচ্ছে, পরপর আরও কয়েকটা গুলি চললো কিন্তু বাইরের স্পিডের জন্যই হোক বা সৌভাগ্যের জন্য গুলিগুলো ওদের লাগেনি নাহলে… সামনে একটা সিগন্যাল অমিয় লক্ষ্য করে হলুদ হয়ে আছে এক্ষুনি লাল বাতি জ্বলবে কিন্তু এখন থামলে অবধারিত মৃত্যু সে বাইকের স্পিড আরো কিছুটা বাড়িয়ে দেয়।
বেশ কিছুদূর পর্যন্ত পিছনে কাউকে ওদের তাড়া করতে না দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হয় অমিয় এবং বৃষ্টি দুজনেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। “তুমি তো আমাকে পছন্দ করো না তাহলে আমাকে বাঁচাতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিলে কেন? বৃষ্টি জিজ্ঞেস করে।
তুমি আমাকে না কোনোদিন বুঝেছো না বুঝবে।
তাহলে বুঝিয়ে দাও।
তুমিও তো আমাকে পছন্দ করো না তাহলে আমার কাছে এলে কেন?
ভেবেছিলাম তুমি জানো তাথৈ কোথায় আছে।
ওহ।
বৃষ্টি আরও জোরে আঁকড়ে ধরে অমিয়কে, বলে: জানিনা কেন যখন ওরা আমাকে তাড়া করছিল তখন যে দুজনের কথা মনে পড়েছে তাদের একজন তাথৈ আর অপরজন তুমি, আমার মা আমাকে বাঁচাতে নিজে….. আমি শেষবারের মতো দেখতেও পেলাম না।
আয়্যাম সরি।
বৃষ্টি অমিয়র পিঠে মাথা রাখে, অমিয় বোঝে বৃষ্টি কাঁদছে সে বাঁধা দেয় না সে একমনে বাইক চালাতে থাকে কিন্তু আর কতদূর, ইসস যদি শুরুতেই অভয়ের বাড়ির দিকে আসার কথাটা মনে পড়তো তাহলে হয়তো এতক্ষণে ওর সাথে দেখাও হয়ে যেত তাড়াহুড়োয় সে বৃষ্টিকে নিয়ে উল্টো দিকে চলে গিয়েছিল তারপর অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে আসছে, অভয়‌ও আসছে বললো কিন্তু ও খুঁজে পাবে ওদের? অমিয়র মনে একটু শঙ্কা দেখা দিতেই নিজেই সেটা উড়িয়ে দিল, অভয় যখন বলেছে ও আপছে তখন ও ঠিক খুঁজে নেবে ও ছোটো থেকেই নিজের কথা রাখে।
বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই হটাৎ একটা ক্রসিং পার হবার সময় সাইড থেকে একটা মারুতি এসে ওদের প্রায় ধাক্কা মারছিল কিন্তু অল্পের জন্য অমিয়রা বেঁচে যায়, বাইকটা একটু থামিয়ে পিছনে ঘুরে কিছু বলতে যাচ্ছিল সে কিন্তু পিছন ঘুরতেই তার হৃৎকম্প শুরু হয়ে গেল, যারা তাদের তাড়া করছিল তারা যেভাবেই হোক ওরা ঠিক অমিয়দের খুঁজে পেয়েছে, অমিয় তাড়াতাড়ি সামনে ঘুরে আবার বাইকে স্পিড তোলে সঙ্গে সঙ্গে পিছনের গাড়িটাও ওদের ধাওয়া করে, অমিয়র বাইকের খুব কাছেই চলে এসেছে গাড়িটা ওটার উদ্দেশ্যে বাইকটাকে ধাক্কা মারা, মেরেই দিচ্ছিল কিন্তু মোক্ষম সময়ে একটা গুলির আওয়াজ আর তারসাথে টায়ার ফাটার কানফাটানো আওয়াজ এবং গাড়িটা একদিকে কেদরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো, কৌতূহলবশত ব্যাপারটা কি দেখার জন্য অমিয় বাইক থামিয়ে পিছনে ঘুরে তাকায় দেখে ওদের পিছনে যারা তাড়া করছিল সেটার পিছনে আরেকটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, অমিয় দেখলো পিছনের গাড়িটা থেকে নেমে এলো অভয় আর আমির এবং যারা ওকে আর বৃষ্টিকে তাড়া করছিল তারা মোট পাঁচজন  টায়ার ফাটা গাড়ি ছেড়ে অশ্রাব্য অশ্লীল গালাগালি দিতে দিতে বেরিয়ে আসতেই অভয় আর আমির ওদের দিকে গুলি চালাতে থাকে প্রত্যুত্তরে এরাও গুলি চালাতে থাকে, অমিয় বৃষ্টিকে নিয়ে বাইক ছেড়ে রাস্তার পাশে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে।
দুতরফ থেকেই অনবরত গুলি চলতে থাকে একদিকে আমির আর অভয় গাড়ির দরজার আড়াল থেকে চালাচ্ছে অপরদিকে এই পাঁচজন‌ও তাই, একসময় হটাৎ অভয় নিজের জায়গা ছেড়ে এগিয়ে এলো পিছন থেকে আমির ওকে কভার করছে, আসতে আসতে অভয় দুজনকে আর আমির দুজনকে স্পট ডেড করে দিল বাকি একজন ওর বিরুদ্ধে দুজন পিস্তলধারীকে দেখে নিজের পিস্তল ফেলে মাথার উপর দুটো হাত তুলে স্যারেণ্ডার করলো সাহস পেয়ে অমিয় আর বৃষ্টি বেরিয়ে এল। অভয় জিজ্ঞেস করলো: তোরা ঠিক আছিস?
হ্যাঁ।
অভয়.. তুই মানে আপনি। বৃষ্টি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে তবে সেটা অভয়কে জীবিত দেখে না আগে রেস্টুরেন্টের ঘটনা মনে করে বোঝা যায় না। অভয় এবার স্যারেণ্ডার করা লোকটাকে বলে: তোরা ওদেরতাড়া করছিলি ধরতে পারলে মেরে দিতি এখন তোর সাথে কি করবো? লোকটা চুপ করে থাকে সে বোঝে তাকে জ্যান্ত ছেড়ে দেবে না, অভয় পিস্তল লোকটার কপাল লক্ষ্য করে চালিয়ে দেয়।
বৃষ্টি এবং অমিয়র নিয়ে অভয় আর আমির বাড়ির বদলে একটা হাসপাতালে এসে মর্গের সামনে দাঁড়াতেই বৃষ্টি অবাক হয়ে যায়, অভয় নামতেই সে জিজ্ঞেস করে: এখানে?
আসো। অভয় শান্ত স্বরে উত্তর দেয়, মর্গের ভিতরে ঢোকে সবাই সেখানে একজন কর্মী ৎঅভয়কে দেখেই এগিয়ে আসে বলে “এদিকে আসুন স্যার” বলে ওদের একটা ডেডবডির কাছে নিয়ে যায় তারপর বডির মুখের ঢাকাটা খুলে দেয়, বৃষ্টি প্রথমে চমকে ওঠে তারপর নিজের মায়ের মৃতদেহের উপরে কান্নায় ভেঙে পড়ে, অমিয় কিছু বুঝতে না পেরে অভয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আমির কথা বলে: বীরেন বাবু ওনাকে শ্মশানে গুলি করে ফেলে চলে যান, ওখানের কয়েকজন লোক ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন কিন্তু বাঁচাতে পারেন নি। তারপর যে কর্মীটা ওদের নিয়ে এসেছে তাকে দেখিয়ে বলে ইনি আমাদের পরিচিত উনি চিনতে পেরেছিলেন এটা কে তখনই উনি আমাদের জানান আমরা শেফালী দেবীর বডি রেখে দিতে বলি যাতে বৃষ্টি ম্যাডামকে নিয়ে আসতে পারি।
আমাদের কিভাবে খুঁজলে?
উপায় আছে, অভয় বলে, তোকে তো ফোন‌ও করেছিলাম তুই ধরিসনি তোর ভাগ্য ভালো ওই ক্রসিংটায় আসতে আসতে তোদের দেখতে পেয়েছিলাম যাইহোক আপাতত ওর কাছে যা, ওকে সামলা। বলে অমিয়কে বৃষ্টির কাছে যেতে ইঙ্গিত করে।
সকালে শ্মশানে নিজের মায়ের অন্তিম সংস্কার করে বৃষ্টি সোজা একটু দূরে দাঁড়ানো অভয়ের সামনে এসে দাঁড়ায় ওর মুখে এখন কান্নার বদলে একটা কাঠিন্য এসেছে, এসে সটান বলে: অভয় তুমি আমার একটা কাজ করবে?
কি?
বীরেন ভট্টাচার্যকে মারতে হবে?
ওর কথা শুনে অভয় তো বটেই এমনকি পাশে দাঁড়ানো অমিয় থেকে শুরু করে তাথৈ এবং সরমাদেবী পর্যন্ত অবাক হয়ে যায়।
বৃষ্টি আপাতত একথা থাক।
না অভয়, তুমি হেজিটেট কোরো না, ওই লোকটা আমাকে মারার জন্য লোক পাঠিয়েছিল তার থেকেও বড়ো আমার মাকে মেরেছে এর প্রতিশোধ তো আমি নেবোই, তুমি ওনাকে না মারলে আমি মারবো।
বৃষ্টি আমার কথা শোনো, এখন বাড়ি চলো, এসব কথা পরে ভাবা যাবে তবে তোমাকে এতটা আশ্বস্ত করছি যে উনি ওনার কাজের উপযুক্ত শাস্তি পাবেন আর সেটা খুব তাড়াতাড়ি।
আমি এখন‌ই ওনাকে মারতে চাই। বলে বৃষ্টি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই অমিয় আর তাথৈ এসে ওকে ধরে, বৃষ্টি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে: ছাড়ো আমাকে আমি..
বৃষ্টি বৃষ্টি আমার কথা শোনো। অমিয় বৃষ্টিকে নিজের কাছে টেনে ধরে বলে, আপাতত শান্ত হয়ে যাও পরে যদি অভয় কিছু না করে তখন তুমি যা করার কোরো আমি যাবো তোমার সাথে। বৃষ্টি অমিয়র দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে অমিয় ওকে নিজের বুকে টেনে নেয়। গাড়িতে ওঠার সময় অভয় আমিরকে বলে: আমির তুমি ওদের সবাইকে নিয়ে বাড়িতে যাও আমি একটু পরে আসছি
তুমি এখন কোথায় যাচ্ছো। আমির অবাক হয়।
কাজ আছে এসে বলবো।
একা যাবে?
হ্যাঁ, চিন্তা কোরো না আমার কিছু হবে না আর অমিয় তোকেও এখন তোর বাড়ি ফিরতে হবে না তুই বৃষ্টির সাথে থাক।
কিন্তু অভয়।
তোর কোম্পানির এমডিকে আমি ফোন করে দেবো, চিন্তা নেই তোর চাকরী যাবে না, দরকার হলে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করবি।
সাবধানে যাও আর তাড়াতাড়ি ফিরো। তাথৈ বলে অভয়কে, উত্তরে অভয় সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে। আমির ওদের নিয়ে চলে যেতেই অভয় একটা ক্যাব বুক করে তাতে উঠে পড়ে ওর গন্তব্য শহরের পুলিশের হেড কোয়ার্টার, সেখানে পুলিশ কমিশনারের অফিস।
ফাঁকা বাড়িতে এখন মাঝে মাঝে সত্যি সত্যিই বীরেন ভট্টাচার্যের ভয় করে, বাড়িটা যেন এক কালান্তক রাক্ষসের মতো তাকে গিলে নিচ্ছে, পুরো বাড়িটায় এখন তিনি একা অবশ্য শুধু বাড়িতেই তার জীবন‌ও এখন একা সবসময়ের ছায়াসঙ্গী যে দুজন ছিল তার ভাই আর জগা তারা গেছে, দিদি গেছে, ভাগ্নে গেছে, স্ত্রী গেছে একটু আগে লোক খবর দিল যারা তাদের র মেয়েকে তাড়া করছিল রাস্তায় তাদের কয়েকজনের লাশ পাওয়া গেছে কিন্তু তার মেয়ের কোনো পাত্তা নেই মেয়েও তাকে ছেড়ে চলে গেছে, আরেকজন খবর দিল তার নিজের অফিস আগুনে পুড়ে গেছে কিছু অবশিষ্ট নেই বেঁচে থেকে কি করবেন তিনি, নিজের পিস্তলটা মাথায় ঠেকিয়েও নামিয়ে নেন তিনি, না এখন মরলে চলবে না তিনি বীরেন ভট্টাচার্য একসময় তার নামে পুরো শহরের লোক ভয়ে কাঁপতো তিনি তার কোনো শত্রুকেই পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখেন নি তাই শেষ শত্রুকেও না মেরে তিনি মরবেন না ,অভয়.. হ্যাঁ অভয় রায় চৌধুরী ওই রুদ্রের ছেলে ওকে না মেরে তিনি মরবেন না যেভাবেই হোক ওকে তিনি মারবেন‌ই ওর জন্যই তার সব গেছে কি কুক্ষণেই যে ওকে হাতে পেয়েও সঙ্গে সঙ্গে না মেরে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন নিজের গালেই চড় মারতে থাকেন বীরেন বাবু, সেই তার থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে এমনকি তার অফিসে আগুন যে এই অভয় লাগিয়েছে এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত, তিনি ঠিক করেন যেভাবেই হোক তিনি অভয়কে শেষ করবেন।
এইসব ভাবছেন এমন সময় তার ফোনটা বেজে উঠলো নাম্বারটা দেখে বুঝলেন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের একজন ফোন করেছে
হ্যালো, বীরেন বাবু?
বলছি।
একটা খারাপ খবর আছে স্যার।
বীরেন বাবু ভাবেন তার জীবনে আর কি খারাপ খবর বাকি থাকতে পারে? জিজ্ঞেস করেন: কি খবর?
আপনার নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে, আপনাকে অ্যারেস্ট করার জন্য পুলিশ আপনার বাড়ির উদ্দেশ্যে র‌ওনা দিয়ে দিয়েছে।
হোয়াট?
হ্যাঁ, স্যার।
কিন্তু কেন?
আপনি খবর দেখছেন না?
খবর?
হ্যাঁ, দেখুন।
বীরেন বাবু ড্রয়িংরুমে টিভিটা অন করে একটা নিউজ চ্যানেল চালান এবং যেটা দেখলেন সেটা দেখার পর তার মুখে প্রথমে ভয় তারপর রাগের অভিব্যক্তি প্রকাশ পেলো এবং অবশেষে ঘৃণা, তিনি অনুচ্চস্বরে প্রথমে শিউলী দেবী ও পরে অভয়ের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য গালি দেন।
স্যার আপনি কোথাও গা ঢাকা দিন। ফোনের ওপাশের আওয়াজে চমক ভাঙে।
ফোনটা রাখার পরেও বীরেন বাবুর রাগ কমে না, তিনি পরপর অনেকগুলো নিউজ চ্যানেল ঘুরিয়ে দেখেন প্রতিটা চ্যানেলেই এক‌ই দৃশ্য।
বেশ কয়েকবছর আগে তখন তিনি সদ্য ইলেকশনে দাঁড়িয়েছেন সেইসময় প্রোমোটিংএর জন্য একটা জমি পছন্দ হয় সেই জমিতে একটা পরিবার বাস করতো স্বামী-স্ত্রী, বৃদ্ধ বাবা, বৃদ্ধা মা আর ১২-১৩ বছরের একটা কিশোর, তাদের কাছে জমিটা চেয়েছিলেন কিন্তু তারা অস্বীকার করে পরে তাদের ভয় দেখালে হুমকি দিলে তারা পুলিশের কাছে গিয়ে ডায়রী করে আসে এদিকে সেইসময় তার নামে কোনো খারাপ কিছু রটলে তার পলিটিক্যাল কেরিয়ার ওখানেই ইতি হয়ে যেত তাই তিনি ওই পরিবারের সবাইকে নিজের হাতে খুন করেন কিন্তু বুঝতে পারেন নি সেইখানে উপস্থিত তার দলের একজন লুকোনো ক্যামেরায় পুরো ঘটনাটা রেকর্ড করে যেটার সাহায্যে সে পরে বীরেন বাবুকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে ফলে তাকেও সরিয়ে দেন তিনি কিন্তু ভিডিওটা উদ্ধার করতে পারেন না, পরে কিভাবে যেন সেটা শিউলীর হাতে আসে যেটা দিয়ে সেও তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে শিউলীকেও শেষ করে দিতেন কিন্তু শিউলীর কাছে ভিডিও কিভাবে এলো এটা খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারেন যে লোকটা প্রথম ভিডিওটা রেকর্ড করেছিল সে তার এক বন্ধুর কাছে ভিডিওটা রেখেছিল সেই বন্ধু আবার শিউলীর পরিচিত ছিল ভিডিওটা সেই শিউলীকে দেয়,  বীরেন বাবু অনেক চেষ্টা করেও সেই বন্ধুটির খোঁজ পাননি এদিকে শিউলীকে মারলে সে যদি ভিডিওটা ছড়িয়ে দেয়, সেই ভয়ে শিউলীকে মারতে পারেননি উল্টে তাকে এবং তার ভরনপোষণের দায়িত্ব নিতে হয়। সেই ভিডিওটাই এখন ভাইরাল হয়েছে এবং তিনি নিশ্চিত এর পিছনেও অভয়ের হাত, অভয়‌ই যে শিউলীকে তার কবল থেকে মুক্ত করে নিয়ে গিয়েছিল এটা তিনি জানেন এবং শিউলীই যে অভয়কে ভিডিওটা দিয়ে গিয়েছে এব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ নেই যেটা অভয় এখন সুযোগ বুঝে প্রকাশ করেছে, টিভি বন্ধ করে বীরেন বাবু ফোনটা হাতে তুলে নেন তিনি একটা নাম্বার ডায়াল করেন একটু পরেই ওপার থেকে আওয়াজ আসে “হ্যালো”
হ্যালো চ্যাটার্জী?
বলুন। মিস্টার চ্যাটার্জির কণ্ঠে তাচ্ছিল্য এবং ব্যাঙ্গ।
আমি কেন ফোন করেছি সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
আপনি কি চান?
আপনার সাহায্য বিনিময়ে আমি আপনাকে..
শুনুন বীরেন ভট্টাচার্য বীরেন বাবুকে থামিয়ে মাঝপথে বলে ওঠেন মিস্টার চ্যাটার্জী, আপনি এখন কাউকে কিছু দেবার অবস্থায় নেই, পুলিশ আপনার পিছনে, এআরসি আপনার পিছনে এখন তো পুরো শহরের লোক আপনার পিছনে পড়বে, আমি আপনাকে সাহায্য করে নিজের জন্য বিপদ ঢেকে আনতে পারবো না আর তাছাড়া হবু সিএমের পক্ষে একজন ক্রিমিনালকে সাহায্য করাটা উচিত হবে না।

হ্যালো, চ্যাটার্জী, হ্যালো.. বীরেন বাবু কিছু বলতে পারেন না তার আগেই মিস্টার চ্যাটার্জী ফোন কেটে দিয়েছেন। বীরেন বাবু বুঝতে পারছেন এখনি তাকে পালাতে হবে নাহলে তিনি বাঁচতে পারবেন না, ধরা পড়ে যাবেন তখনই ড্রাইভারকে ডেকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলেন, যখন তার গাড়িটা ভট্টাচার্য ম্যানসনের গেট ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন বীরেন বাবু খেয়াল করলেন উল্টোদিক থেকে একটা পুলিশের জিপ তার বাড়ির দিকেই আসছে তিনি ড্রাইভারকে দ্রুত গাড়ি চালাতে হুকুম দেন, ড্রাইভার তৎক্ষণাৎ সে হুকুম তামিল করে, এদিকে বীরেন বাবুকে অ্যারেস্ট করতে আসা পুলিশরাও খেয়াল করেছে বীরেন বাবুর গাড়িটা দ্রুত চলে যাচ্ছে তারাও স্পিড বাড়িয়ে পিছনে ধাওয়া করতে থাকে, একজন পুলিশ ওয়াকিটকিতে খবর পাঠিয়ে দেন যে বীরেন ভট্টাচার্য পালানোর চেষ্টা করছেন।
বীরেন বাবু অবশ্য বেশীদূর পালাতে পারেন না একটু পরেই তিনি যেদিকে যাচ্ছেন সেদিক থেকে একটা পুলিশের জিপ এসে তার পথ আটকে দাঁড়ায়, নিজের গাড়িটাকে পিছনে নিতে বলে দেখেন পিছন থেকেও আরেকটা পুলিশের গাড়ি এসে পড়েছে, এবার একটা গাবি থেকে একজন পুলিশ মাইকে বীরেন বাবুকে উদ্দেশ্য করে বলেন স্যারেণ্ডার করতে, কিন্তু বীরেন ভট্টাচার্য যে সহজে স্যারেণ্ডার করবেন না সেটা বুঝতে তাদের একটু দেরি হয়, মাইকের আওয়াজের উত্তরে বীরেন বাবুর গাড়ি থেকে সামনে পুলিশের গাড়ি এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চলতে থাকে, ফলে কয়েকজন পুলিশ গুরুতর আহত হন ,এবং বাকিরা নিজেদের আড়াল করেন এইটুকু সময়ে বীরেন বাবুর ড্রাইভার সামনের পুলিশের গাড়িটাকে কোনোমতে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় কিন্তু পিছনের গাড়িটা পিছনে ধাওয়া করতে থাকে এবার বীরেন বাবু পিছনের গাড়িটার উদ্দেশ্যে গুলি চালাতে থাকেন, প্রত্যুত্তরে সেখান থেকেও গুলি চলতে থাকে, বীরেন বাবু হয়তো পালাতে সক্ষম হতেন কিন্তু পারলেন না কারণ ঠিক এইসময় একটা গুলি তার গাড়ির টায়ারে লেগে টায়ার ফেটে যায়, ড্রাইভার কোনোমতে গাড়িটা উল্টে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়, বীরেন বাবু বোঝেন আর উপায় নেই কারণ তার পিস্তলেও গুলি নেই যে তিনি পুলিশের উপরে চালাবেন তিনি গাড়ি থেকে নেমে দুহাত উপরে তুলে স্যারেণ্ডার করেন।
থমথমে মুখ নিয়ে কোর্টে ঢুকলেন বীরেন বাবু তিনি ভালো করেই জানেন তার বিরুদ্ধে যা প্রমাণ আছে তাতে হয়তো আজ‌ই কোর্ট তার রায় দিয়ে দিতে পারে। পার্টি তাকে বরখাস্ত করেছে, পুরো শহরের লোক তার কুশপুত্তলিকা পোড়াচ্ছে, তাকে গালাগালি দিচ্ছে ,শাপশাপান্ত করছে এতদিন যারা তার সামনে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পেতো না তারা এখন তার সামনে গলা তুলে কথা বলার সাহস পাচ্ছে, কোর্ট চত্ত্বরে অজস্র লোকের ভিড় সবাই তার ফাঁসির দাবি জানাচ্ছে, বেশ কয়েকজন তো জুতো ছুঁড়ে মারছে তার উদ্দেশ্যে, এছাড়া টমেটো, পচা ডিম তো আছেই। পাবলিকের এত রোষের কারণ প্রায় তার সব কুকীর্তি ফাঁস হয়ে গেছে শুধু যে ওই একটা পরিবারকে খুন তাই নয়, আরও অনেকেই যারা এতদিন তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পেতো, তার থেকে পালিয়ে লুকিয়ে আত্মগোপন করে ছিল তারাও এখন গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে, মিডিয়ায় লোক‌ও কিভাবে যেন তাদের খোঁজ পেয়ে গেছে, অবশ্য বীরেন বাবু খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন এসবের পিছনে কে, শুধু একবার এখান থেকে বেরোতে পারলেই হলো অভয়কে তিনি শেষ করবেন‌ই দাঁতে দাঁত চেপে নিজের মনেই প্রতিজ্ঞা করেন তিনি, তিনি চারিদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাতে থাকেন যেন ভিড়ের মধ্যে কাউকে খুঁজছেন, হটাৎ  একজন কনস্টেবলের সাথে চোখাচোখি হয় তার, কনস্টেবলটি ঘাড় ঘুরিয়ে ইশারা করে একদিকে তাকায় বীরেন বাবু সেদিকে তাকিয়ে একজনকে দেখতে পান তারপর পরপর আরো কয়েকজনকে তার ঠোঁটের কোণে একটা মুচকি হাসি দেখা যায় ত র মানে সব ব্যবস্থা কমপ্লিট এখন সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষা।
গ্ৰেপ্তারের পরে প্রথমে পুলিশ তাকে ১৪ দিনের হেফাজতে রাখে যদিও তার উপরে কোনোরকম শারীরিক বা মানসিক টর্চার করা হয়নি, তাকে কোনোকিছু জিজ্ঞাসাবাদ‌ও করা হয়নি যেন সবকিছুই আগে থেকে সাজানো ছিল ,একটা নাটকের উপস্থাপনার জন্য শুরুতে যেমন একটু সময় লাগে সেই সময়টাই হলো ওই ১৪ দিন, জেলে খুব সাধারণভাবেই দিন কাটছিল তার শুধু খাওয়া দাওয়ায় একটু অসুবিধা হচ্ছিল, যদিও এর আগে কয়েকদিন জেলের খাবার খেতে হয়েছিল কিন্তু সেটা বহুবছর আগে তারপর আর তাকে জেলে ঢোকানো তো দূরের কথা তার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস হয়নি কারো। তবুও তিনি চুপচাপ সব সহ্য করে দিন কাটাচ্ছিলেন আর একটাই কথা বারবার জপে যাচ্ছিলেন মনে মনে “অভয় তোকে আমি ছাড়বো না”। গার্ড থেকে শুরু করে অন্যান্য কয়েদিরা সবাই তাকে একপ্রকার পাগল বলেই ধরে নিয়েছে,  তিনদিন আগে প্রতিদিনের থালায় জেলের খাবারের বদলে একটা টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার এলো একজন কনস্টেবল আর তার সাথে একটা গ্ৰাম্য মহিলা এল খাবারটা নিয়ে, নিজের সেলে তখন একাই ছিলেন তিনি প্রথমে অবাকই হয়েছিলেন বীরেন বাবু কারণ তিনি এটা আশা করেননি খেতে সংকোচ করছিলেন তিনি যদি বিষ মেশানো থাকে, কিন্তু মহিলার “খেয়ে লিন বাবু, আমি অনেক কষ্ট করে বানিয়ে এনেছি” শুনে টিফিন ক্যারিয়ার খুলতে থাকেন, জিজ্ঞেস করেন “তুই কে?আমার জন্য খাবার এনেছিস যে, তোকে তো চিনতে পারছি না?”
আমাকে আপনি চেনেন না বাবু, কিন্তু আমার মরদকে চেনেন হয়তো আপনি ওর অনেক উপকার করেছেন।
কি নাম তোর মরদের?
বাপ্পা বাবু?
বাপ্পা? এই নামে তো কাউকে চিনি না।
মুখ দেখলে হয়তো চিনতে পারবেন বাবু।
তা সে আসেনি কেন?
সে জোগাড় করতে ব্যাস্ত।
জোগাড়? কিসের জোগাড়?
আপনাকে বার করে নিয়ে যাওয়ার। শেষের কথাটা অবশ্য বলেন কনস্টেবল আর সেটা গলার আওয়াজ অনেকটা নামিয়ে। চমকে ওঠেন বীরেন বাবু সোজা তাকান কনস্টেবলের দিকে, কনস্টেবল একবার চারিদিকে তাকিয়ে কেউ লক্ষ্য করছে কি না দেখে গলাটা আরও নামিয়ে বলে “স্যার একদম ভিতরের খবর পেয়েছি আপনার বিরুদ্ধে সব প্রমাণ তৈরি, সেইজন্যই কেউ আপনাকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করছে না নেহাত ফর্মালিটির জন্য জেল হেফাজতে রেখেছে, একজন উঁচু পজিশনের প্রচণ্ড ক্ষমতাধর  কেউ একজন সব প্রমাণ তুলে দিয়েছে, সেই নাকি কমিশনারের সাথে মিটিং করে  সব ব্যবস্থা করেছে”।
বীরেন বাবুর বুঝতে বাকি র‌ইলো না সে কে, এটা অভয় ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না, তিনি কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করেন: কিন্তু আমাকে কিভাবে বার করবেন?
এখন নয় স্যার আপনাকে ঠিক সময়ে জানাবো এখন আপনি খেয়ে নিন। বীরেন বাবু আর দ্বিরুক্তি না করে খাবারটা খেয়ে নেন, পরের দিন আবার খাবার এলো পরের দিন আবার তবে এবার খাবারের সাথে একটা ছোটো চিরকুট পেলেন তিনি তাতে লেখা “সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, আগামীকাল কোর্টের রায় যাই হোক বেরোনোর পরে কাজটা করা হবে, তৈরী থাকবেন”। বীরেন বাবু পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও তিনি তৈরী থাকেন দেখাই যাক না যদি সত্যিই পালানোর সুযোগ আসে তাহলে ক্ষতি কোথায়? এখন তার একটাই লক্ষ্য যেভাবেই হোক অভয়কে শেষ করা।
কোর্টে ঢুকে শান্তভাবে আসামীর কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ান বীরেন ভট্টাচার্য বাইরে তখনও ক্ষিপ্ত জনতা তার ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার। বীরেন বাবু চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে থাকেন, একবারে প্রথমেই চোখে পড়ে বৃষ্টিকে, একেবারে প্রথম সারিতে বসে আছে সে সোজা বীরেন বাবুর দিকে তাকিয়ে চোখেমুখে অসম্ভব ঘৃণা,তার এক পাশে একটা ছেলেকে দেখেন সে বৃষ্টির একটা হাত চেপে ধরে আছে অপর পাশেই বসে থাকতে দেখেন সরমাদেবীকে এবং তার পাশে বসে ওটা কে? বীরেন বাবু অবাক হয়ে দেখেন বিদিশা বসে তার পাশে তাথৈ, তার পরিবারের যারা আছে তারা সবাই আছে এবং তারা প্রত্যেকেই ঘৃণাভরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার কোর্টরুমের দরজার দিকে চোখ পড়তেই তিনি হতবাক হয়ে যান এ কাকে দেখছেন তিনি ও কে দাঁড়িয়ে আছে? এত বছর পরে দেখেও ঠিক চিনতে পেরেছেন তিনি, ষোলো বছর আগের সেইরাতে তিনি শেষ দেখেছিলেন যে রাতে তিনি রুদ্র আর তার পরিবারকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু সেইরাতে তার চোখে মুখে ছিল আতঙ্ক বেঁচে থাকার নিজের ছেলে আর স্বামীকে বাঁচানোর আকুতি আর আজ তার চোখেও ঘৃণা, অমৃতা.. অমৃতা রায় চৌধুরী ,রুদ্রের স্ত্রী অভয়ের মা, অমৃতা যে বেঁচে আছে বা বেঁচে থাকতে পারে এটা তার একমুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি এমনকি অভয় বেঁচে আছে এটা জানার পরেও নয়।
অমৃতাদেবী এগিয়ে এসে তাথৈএর পাশে বসেন তখন‌ও তার দৃষ্টি সোজা বীরেন বাবুর দিকে, বীরেন বাবু মনে মনে খুশীই হন অভয় তার থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে এবার তার পালা প্রথমে অভয়ের চোখের সামনে ওর মাকে মারবেন তারপর ওকে আজ‌ই অমৃতাদেবীকে শেষ করবেন তিনি। এবার দরজা দিয়ে যাকে ঢুকতে দেখেন বীরেন বাবু তাকে দেখে তার হাত নিশপিশ করতে থাকে, অভয় ঢুকছে বহুকাল হয়ে গেল নিজের হাতে কাউকে মারেননি তিনি তার হয়ে জগা এবং অন্যান্য লোকেরাই কাজটা করে দিত কিন্তু আজ তার সেই কাজটাই নিজের হাতে করতে ইচ্ছে করছে, ইচ্ছা করছে এখনই গিয়ে অভয়ের গলা টিপে ধরেন অতিকষ্টে নিজেকে সংবরণ করেন তিনি, না আগে ওর সামনে ওর মাকে শেষ করবেন তারপর ওকে, অভয় ঢুকতে ঢুকতে চোখ থেকে চশমাটা খুললে তিনি দেখেন সেও তা দিকে তাকিয়ে আছে, তার ঠোঁটের কোণে একটা মুচকি হাসি সেও এসে অমৃতাদেবীর পাশে বসলো তার দৃষ্টিও সোজা বীরেন বাবুর দিকে।
বিচার শুরু হলে একে একে প্রায় সব সাক্ষ্য‌ই তার বিরুদ্ধে আসতে থাকে বলাইবাহুল্য  তার পক্ষে শহরের কোনো উকিল‌ই না দাঁড়াতে চাওয়ায় নিয়মমাফিক সরকারের তরফ থেকে একজনকে ঠিক করা হয় কিন্তু তিনি টিকতেই পারছেন না, আর সবশেষে যখন বহুবছর আগে করা খুনের ভিডিওটা আর তার সত্যতার প্রমাণ দেওয়া হলো তখন অবশ্য আর কিছু করার ছিল‌ও না, স্বভাবতই বিচারক তার মৃত্যুদণ্ডের রায় দিলেন তার এত ক্রাইম এবং এত প্রমাণ যে এটাই হ‌ওয়ার ছিল।
কোর্ট থেকে বেরোতেই জনতার উল্লাস দেখতে পান বীরেন বাবু, একটু দূরে অভয়, অমৃতা আর বাকীদের দেখেন তিনি। তাকে দেখে অভয় তার কাছে এগিয়ে আসে বলে “বলেছিলাম না আপনাকে বাঁচতে দেবো না, আমি সবসময় আমার কথা রাখি”। কোর্টের ভিতরে তাকে বেশি কথা বলতে হয়নি, বলেন‌ওনি তিনি, চুপ করেই দাঁড়িয়েছিলেন বলা যায় কিন্তু এবার তিনি মুখ খোলেন “আজ আমিও তোকে বলছি ঠিক যেমনভাবে তোর বাপকে মেরেছিলাম ঠিক সেভাবেই তোকে মারবো তবে তার আগে….”
তাহলে দেখাই যাক।
বেশ, দেখাই যাক।
অভয় পিছনে ফিরে গেল পুলিশ আবার  বীরেন বাবুকে নিয়ে পুলিশ ভ্যানের দিকে এগোতে থাকে যখন তারা পুলিশ ভ্যানটার প্রায় কাছেই চলে এসেছেন জাস্ট একটু দূরে তখনই আচমকা ঘটে গেল ব্যাপারটা একটা ছোটো বিস্ফোরণের শব্দে পুলিশ ভ্যানটা মাটি থেকে ছিটকে উপরে উঠে তারপর আবার নীচে আছড়ে পড়লো এবং তাতে আগুন লেগে গেল ঘটনায় আকস্মিকতায় বীরেন বাবু এবং তার সঙ্গের পাঁচজন পুলিশ‌ও ছিটকে কয়েকপা পিছনে পড়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে পরপর আরো কয়েকটা গাড়িতে বিস্ফোরণ এবং এক‌ইভাবে গাড়িগুলোতে আগুন লেগে গেল সঙ্গে সঙ্গে কোর্ট চত্ত্বরে হুড়োহুড়ি লেগে গেল যারা এতক্ষণ বীরেন ভট্টাচার্যের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার ছিল এবং রায় ঘোষণার পরে উল্লাসে ফেটে পড়েছিল তারাই এখন প্রাণভয়ে পালানোর জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে শুরু করে দিল, এর‌ইমধ্যে বীরেন দুজন লোক মুখ ঢেকে দৌড়ে বীরেন বাবুর কাছে গিয়ে তাকে ধরে তুললো পুলিশগুলো তাকে ধরার জন্য রিভলবার বার করলে লোকগুলো লাথি মেরে বীরেন বাবুকে ছাড়িয়ে নেয়, কিন্তু বীরেন বাবুর দুহাতে তখনও হাতকড়া তবুও তিনি একটা রিভলবার তুলে নেন তারপর সঙ্গের পুলিশগুলোর উদ্দেশ্যে চালিয়ে দেন, পুলিশগুলোকে মেরে বীরেন বাবু লোকদুটোর সাথে দৌড়াতে থাকেন।
বীরেন বাবুর সাথে কথা বলে অভয় ফিরে এসেছে, অমৃতাদেবী জিজ্ঞেস করলেন “তুই ওনার কাছে গিয়েছিলি কেন?”
এমনি চলো। সবাই গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় পরপর বিস্ফোরণ অমৃতাদেবী, সরমা দেবী সহ তাথৈ এবং বৃষ্টিও হতবাক হয়ে যায়, এরপর হঠাৎই পরপর গুলির শব্দ, কোর্ট চত্ত্বরে সবাই হুড়োহুড়ি করছে অভয় তাড়াতাড়ি সবাইকে গাড়িতে উঠতে বলে। একটা গাড়ির আওয়াজ পেয়ে অভয় দেখে একটা গাড়ি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে কোর্ট চত্ত্বর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, হটাৎ গাড়িটার একটা জানালার কাঁচ নীচে নেমে যায় এবং সেটা থেকে একটা রিভলভার ধরা হাত বার হয় সাথে বীরেন বাবুর মুখ, অভয় সভয়ে দেখে বীরেন বাবু গুলি চালাতে উদ্যত তবে তার লক্ষ্য সে নয় তার লক্ষ্য তার মা সঙ্গে ঈ সে বা হাত দিয়ে মাকে ঠেলে সরিয়ে দেয় কিন্তু গুলিটা তার বা হাতের বাহুতে লাগে রক্ত বেরোতে থাকে, অমৃতাদেবী সহ বাকিরা ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করে ওঠেন “অভয়”। অভয় মাটিতে পড়ে যায় সে ডানহাতে বাহু চেপে বীরেন বাবুর দিকে তাকায় দেখে গাড়িটা বেরিয়ে যাচ্ছে বীরেন বাবু আরও কয়েকবার ট্রিগার চাপলেন কিন্তু গুলি বেরোচ্ছে না দেখে রিভলভার ফেলে দিলেন গাড়িটাও তাকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
অমৃতাদেবী তাড়াতাড়ি ছেলের কাছে এসে কাঁদতে শুরু করেন অভয় কোনোমতে বলে “মা, তুমি ঠিক আছো?”
হ্যাঁ, বাবু, তোর কিচ্ছু হবে না।
আমি ঠিক আছি মা। এটুকু বলেই অভয় জ্ঞান হারায়।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/NEkCf4z
via BanglaChoti

Comments