জীবন BY (ডিমপুচ) (পর্ব-৬)

জীবন

লেখক – ডিমপুচ
পর্ব-৬
—————————

৩ বছর পর আবার মাসিমার বাড়ি, আবার বীথি বৌদি, বঙ্কিমদা, বাপ্পা আবার জমজমাট। বীথির মেয়েটা বেশ বড় হয়েছে,  জড়িয়ে বলল কাকু । পুকুর মনে হোল কিছু উপহার আনা উচিৎ ছিল। নরেশবাবুর সাথে নিজের ৩০০০ স্কোয়ার ফুটের ফ্লাট দেখে খুব পছন্দ পুকুর। পরের দিনই রেজিসট্রেসন। নরেশ বাবুর সাথে এক রেস্তোরাঁ তে বসে
………পিনাকী বিয়ে করছনা কেন?…..খুলে সব বিশদ ভাবে বলতে
……তুমি আমাকে ফটো দাও , পুলিশে জানাশোনা আছে। বার করে দেব।
,…… স্যার একটা অনুরোধ, আপনি ভাবি কে বলে ফ্লাট টা একটু সাজিয়ে দিন। খরচা আমার, পছন্দ ওনার। তাড়াতাড়ি, আমি ৭ দিনের জন্য এসেছি।…।
……তোমার ভাবি খুশি হবে। কাল থেকেই শুরু।বিরাট এক হোটেলে বাড়িতে রাতের প্রভুত খাবার  ডেলিভারির অর্ডার দিয়ে , মিষ্টি হাতে পুকু মাসিমাকে প্রনাম করলো।পরেরদিন প্রায় ১০ বছর পর সোনারপুর। ভবদাদু বেরতে পারেন না। বয়েস ৮০ পেরিয়েছে। পুকুকে দেখে জড়িয়ে কান্না………”কি ভালো যে লাগছে পুকু তোকে দেখে, কি বলব” । সন্দাদু নেই। গত হয়েছেন ২ বছর হোল । অসিমদার ক্লাব বন্ধ হয়ে এখন ফ্লাট বাড়ি। অসিমদা এখনও পাড়ার সবার পাশে দাড়ায়। ভবদাদুর বাড়িতে পুকু থাকবে, মামার ছেলেরা গর্বিত ,যে তাদের পরিবারের ছেলে পাড়ার ক্লাব কে বাড়ি দান করবে।
দু দিন পর রেজিস্ট্রি অফিসে সব কাজ সেরে পুকু, অসিমদা, আর পাড়ার দুই ভদ্রলোক, একজন উকিল একজন ডাক্তার, সাক্ষী হিসাবে দান পত্রে সই করেছেন, পাড়ার মোরে ট্যাক্সি থেকে নেমে হেটে ষাচ্ছে।বাকি দুজন রিকশা  নিয়ে এগিয়ে গেছেন
………অসিমদা, হেটে চলো অনেকদিন এই রাস্তায়  হাঁটিনি
………চল, হেঁটেই চল………ছেলেবেলার বাড়ি গুলো নেই বেশির ভাগ। ফ্লাট হয়েছে বুবু, পুকুর ছটোবেলার বন্ধু, বক্সিং পার্টনার, এক সাথে সরস্বতী পুজ করা, প্রথম লুকিয়ে সিগারেট খাওয়্‌ এখন ছোট খাটো প্রমোটার, এই সব ফ্লাটের দু একটার অংশীদার। বদলে যাওয়া রাস্তার দুই পাস দেখতে দেখতে হাঁটছে। একটি মেয়ে খুব ধ্রুত ওদের পাস দিয়ে হেটে এগিয়ে গেল, বোরখা পরা ,
………এরা কি নতুন, আগে দেখিনি তো বোরখা পরা মেয়ে এই পাড়ায়
………হ্যাঁ। বছর দেড় এসেছে। আর বলিস না, এক বৃদ্ধা একদিন সন্ধ্যাবেলা এসে হাজির, “ অসিম বাবু কে, অসিম বাবু কোন বাড়িতে থাকেন” এই বলে সেই বড় রাস্তার আগের থেকে জিজ্ঞাসা করতে করতে, প্রায় ৯ টা এসে হাজির।  কি ব্যাপার, গড়িয়ার মহামায়াতলার কে এক বাপ্পা, চিনি না  নাম শুনিনি কোনদিন পাঠিয়েছে বাড়ির জন্য। আরে আমি কি বাড়ির দালাল নাকি?
……… আমি খুব বিপদে পড়েছি, আমার দুই নাতনি ,থাকার জায়গা নেই, পয়সাও নেই, গড়িয়ার যেখানে থাকি, ভালো জায়গা নয়। নাতনি দুটোকে খুব জ্বালায় । তাই বাপ্পা আমাকে বলল, আপনি অসিমদা, সোনার পুরের এই জায়গায় থাকেন, খুব পরোপকারী, তাকে বলে ওনার কাছাকাছি কোথাও ভাড়া নিন।উনি থাকলে কেউ কিছু করতে সাহস করবে না। কি করবো বল, বুড়ি মানুষ, এদিকে বুকুর জ্যাঠামশাই মারা গেছেন। ব্যাচিলর ছিলেন, তাই ওনার ঘর টা বুকুর বাবাকে বলে ব্যাবস্থা করে দিলাম
………বুকু মানে আমার বক্সিং পার্টনার?
……হ্যাঁ, লুকিয়ে সিগারেট খেয়েছিলি, হাহা হা
পুকুর মনে দ্বন্দ্ব খেলা করছে। বৃদ্ধা, দুই নাতনি
………ইসলাম ধর্ম ?
……তাই তো দেখছি। মেয়ে দুটো বাইরে বোরখা পড়ে বেরোয় । মহিলা বেরন না। তবে খুব অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন। নাতনি দুটো সব বিক্রি করেছে চিকিৎসার জন্য। সেখানেও  অসিমদা , “একটু দেখুন যাতে দাম পাওয়া যায়”। ইংরাজি টুইসন করে চালায় দুই বোন। ………পুকু দাঁড়িয়ে পড়ল, মস্তিষ্কে দামামা বাজছে
………তোমার কাছে কে পাঠিয়েছিল, কি নাম নিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা
………বাপ্পা বলে কেউ একজন , চিনিও না। তুই দাঁড়িয়ে পরলি কেন? পুকু কি হয়েছে তোর চল? স্থির পুকু। ইংরাজির টুইসন, বাপ্পা, মাসিমার ছেলের নাম। “ * মহিলার লুকিয়ে থাকতে চাইলে বোরখা ব্যাবহার করবে”।হাসি ফুটে উঠছে পুকুর  ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত মুখে
………অসিমদা, উ আর বিউটিফুল…দু হাতে জড়িয়ে গালে চুমু দিয়ে পিছন দিকে দৌড়
………পুকু পুকু কোথায় যাচ্ছিস , কি হয়েছে তোর? 

সোজা  বুকুদের বাড়ির পাশের দরজা দিয়ে দোতলার দরজায়…ঠক ঠক ঠক ঠক যতো জোরে পারে, নক করছে পুকু। ভিতর থেকে “ কে , কে ,আসছি উফফ,  আসছি রে বাবা”। দরজা খুলে বোরখা পড়ে এক মহিলা। কয়েক মুহূর্ত ’ “উহ” শব্দ করে হাতে মুখ চিপে পিছিয়ে গেল ৩ পা। পুকু ঘরে ঢুকে হাত দিয়ে দরজা ভেজিয়ে
………বোরখা এইবার ছুড়ে ফেল টাপুর। এসে গেছি আমি ………বোরখা খুলে দু চোখে বন্যা নামিয়ে মুখ চেপে বসে পড়ল টাপুর। পুকু এসে পাশে বসে
………কেন টাপুর, কেন? আমি কি খুব খারাপ?
“পুকু দা”, অন্তরের  গভীর থেকে উঠে আসা এক কান্না, আনন্দ আর বিস্ময় মাখা চিৎকার। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে টুপুর।পুকুর চোখেও জল, বা হাত বাড়িয়ে টুপুর কে কাছে ডাকতেই  ঢেউ এর মতো এসে ভেঙে পড়ল পুকুর বুকে । দুই বোন দুই হাতে পুকুর। কেঁদেই চলেছে।কান্না থামতে।
………কেন আমায় কষ্ট দিলে তোমরা? কি করেছি?
………কি করবো পুকুদা কি করবো। আমরা এখন পথের ভিখারি, দেখ শোবার খাট পর্যন্ত নেই। বাবার মৃত্যু, জমানো টাকার অধিকাংশই শেষ হয় চিকিৎসায়। কোন আয় নেই। জমানো টাকায়, বছরের পর বছর খাওয়া, শেষে বাড়িওয়ালা ভাড়া বাকির জন্য প্রায় প্রতিদিন দিদু কে অপমান করত কিন্তু একদিন তার বড় ছেলে  আমার দ্বিগুণ বয়েস, মদ খেয়ে টাকা ছুরে গায়ে হাত দিল। মুদির দোকানে ধার থাকায় জিনিষ দেওয়া অনেকদিন বন্ধ সাথে অপমান। কি অপমান বল। ষার স্বামী  ওত বড় ব্যারিস্টার ছিলেন শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া, রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখা, তাকে ঘাড় ধাক্কা দেবার মতন করে বাড়ি ছাড়া করলো। গড়িয়ার ওখানে একটা এক কামরার ঘর নিয়ে ছিলাম, খুবই বাজে জায়গা, আমাদের দু জন রাস্তায় বেরোলেই কি কুৎসিত টিটকিরি। তখন আমি দিদুকে বলি অসিমদার কথা। তোমার মুখে শুনেছিলাম পরোপকারী, আর সেই ভাবে এখানে আসা।এখানেই শেষ নয়,  দিদুর ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়। বড় হাসপাতালে ৩১দিন রেখে জীবন বাচিয়েছে কিন্তু একটা কুচো পর্যন্ত  নেই। দেখ, সমস্ত বাড়িতে কিচ্ছু নেই। রিকশা চালক পর্যন্ত এর থেকে ভালো থাকে। বাবা আর দিদু, দুজনের অসুখ আমাদের সম্পন্ন অবস্থা থেকে গরীবের এরও নীচে নামিয়েছে। সাহায্য চাইতে পারিনা কাউর কাছে সম্মানে লাগে। ভীষণ অপমান হয়। আর কে আছে, যে চাইব
………আমাকে জানালে না কেন?
……কি করে জানাব,? তুমি বিদেশ যাবার আগে একবার অন্তত আসতে পারতে। তোমাকে লিখেছিলাম একবার দেখা করবে না? মনে নেই? দিদু বলত না মুখে কিন্তু   কারো কাছে হাত পাততে কি লজ্জা না ? পুকুদা আমরা এখন গরিব শুধু নয় তার অনেক নীচে। মাসে ৪০০০ টাকা মতো আয়। সপ্তাহে একদিন একটা ডিম দুই বোন ভাগ করে খাই। সকালে পান্তা আর রাতে ভাত, আলু, কুমড়ো, কচু সেদ্ধ। বিশ্বাস করতে পারছ না, না?টুপুর দিদুর জন্যও সব ত্যাগ করেছে, ও যে কি করেছে বলতে পারব না। ভুলে যাও আমাকে পুকুদা,  ভুলে যাও
………শেষ  নিশ্বাস অবধি তোমাদের ভুলবো না। দোষ স্বীকার করছি।রোজগারের নেশায় ভুল করেছি। ক্ষমা চাইছি  প্লিস, টাপুর প্লিস। তোমাকে খুঁজে বার করার জন্য এজেন্সি লাগিয়েছি দুবার। তারা পায় নি।আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো সারা জীবন। এই দ্যাখো… মানিব্যাগ বার করে দেখাল টাপুরের ছবি প্রথমেই। আমি শুধু তোমার টাপুর,প্লিস, প্লিস। আমি তোমার চিঠি না পেয়ে চাকরি ছেড়ে লন্ডন থেকে সোজা এই কলকাতায় এসেছিলাম শুধু তোমার জন্য।বিশ্বাস করতে পারছনা আমায়?
……পুকুদা  তুমি দায়ী নয়, কিন্তু তোমায় পেলে আমরা মনে সাহস পেতাম……টুপুর এই মুখ খুলল
……টাপুর, টুপুর, এই জায়গা আমার মায়ের  জন্মস্থান, আবার মৃত্যু স্থান, আমার কাছে এই সোনারপুর পুণ্যভূমি। আমি মায়ের নামে বলছি এক বর্ণ মিথ্যা বলিনি। বিশ্বাস করো………বুজে এল পুকুর স্বর। নিঃশব্দ ঘরে শুধু নিশ্বাসের শব্দ
……দিদি উই সুড বিলিভ হিম……টুপুর এসে গলা জড়িয়ে পুকুর গালে চুমু।
এতক্ষন পর টাপুর একটু হাসল
……চেহারাতে বেশ জেল্লা এসেছে তোমার আর আমরা ঘাটের মড়া, কিন্তু কি করে খোঁজ পেলে আমাদের?
…………হা হা হা। ভালো ফন্দী এঁটেছিলে। ৩ টি সুত্র, এক, দুই বোন আর দিদিমা সাথে বোরখা  দুই, ইংরাজি টিউশন আর বাপ্পার  নাম।কিন্তু দিদু এখন কোথায়?
…… এই কাছের এক সরকারি হাসপাতালে কাল ভর্তি করেছি। কোন উপায় আর নেই, আর কিচ্ছু নেই। দিদুর ওষুধের দাম আমার এক বন্ধু দেয়। না নিতে পারলে ভালো হতো কিন্তু উপায় নেই, টুপুর উত্তর দিল
………আমার নিজের মায়ের জন্য কিছু করতে পারিনি, বুচির জন্যও না, একবার চান্স দাও দিদুর জন্য কিছু করি।
দরজায় ধাক্কা আর অসিমদার গলা
……পুকু, পুকু তুই কোথায়?… ‘ভিতরে এস অসিমদা’… অসিম ভিতরে ঢুকে ওই দৃশ্য দেখে হতবাক
………অসিমদা, এই টাপুর, আর এ টুপুর। অসিমদা, বিয়ের ব্যাবস্থা করো, কাল বাদে পরশু, টাপুর আর আমার বিয়ে……টাপুর পুকুর কথা শুনে মুখ তুলতে,  এই প্রথম পূর্ণ দৃষ্টিতে পুকু দেখল তার টাপুর কে। চেহারা অনেক খারাপ হয়ে গেছে,সেই জৌলুষ, উজ্জলতা নেই। টুপুর ও তাই। বিয়ের কথা শুনে টাপুর
………এ হয়না পুকুদা, এ হয়না। …বিষণ্ণ হাসি দিয়ে” সিঁদুর, শাঁখা কেনার পয়সাও নাই, এ হয়না”
………হয়, আর হবে, টুপুর, হবে? না হবে না? , বল, তোর ওপর বিচারের ভার……পুকুর গলায় লঘু সুর। টুপুর হেঁসে, পুকুর গলা জড়িয়ে
……পুকুদা, তোমাকে কি শাস্তি দেওয়া উচিৎ বল তো?
……সব মেনে নেব, বস,  শুধু বিয়েটা তুই একটু এগিয়ে দে
ঘরে ছড়িয়ে পড়ল প্রান খোলা হাসি বহুদিন পর
………পুকু তুই কি বলছিস , আমি কিছুই বুঝি না রে? এদের তুই কি ভাবে চিনিস?.অসিম অবাক …প্রথম দেখা থেকে বলল পুকু, সব শুনে
………তোমরা এই অবস্থায় আছ, আমাকে বলতে পারতে। কিছু একটা করতাম । তারপর কান এঁটো করা হাসি হেঁসে
……… পুকু তুই আজ একটা ভালো কাজ করলি ক্লাবকে বাড়ি দিয়ে আর সাথে সাথে তোর  ভালো হোল, কি অদ্ভুত মিল বল। যাই ভব জ্যাঠাকে জানাই।
……হ্যাঁ অসিমদা।একটু চা আর বিস্কিট ব্যাবস্থা কর  অসিমদা। এখন অনেক কাজ। দাড়াও প্রথমে ফোন নরেশ বাবুকে। টুপুর তুই  দিদুকে এখন ডিসচার্জ  করাতে পারবি তো?
……পারব। ……”চল”। টাপুর সব গুছিয়ে নাও, এক্ষুনি
……কোথায় যাব?
………সবথেকে সেফ জায়গায়। নরেশ বাবুর জিম্মায়। তোমাদের পুরানো বাড়ির উল্টো দিকে জমিদারের বাড়ি ভেঙে ফ্লাট বাড়ি হয়েছে। তার তিন তলাটা ৩০০০ স্কোয়ার ফুট, কিনেছি। কোন আপত্তি আছে তোমার?
……… উফফ, ভারি ফুটানি মারছে রে দিদি , বিয়ে করা উচিৎ হবে? পরে কথা শোনাবে রে………টুপুর  এইবার একটু সহজ,
………টুপুর, টুপুর, বোন আমার বাগড়া দিস না রে। সারা জীবন কিছু পাইনি,
………ও পুকুদা,তুমি কত বড়লোক গো, ওই যায়গায় ৩০০০ স্কোয়ার ফিট, ওরে বাবা ভাবতে পারছি না টুপুর, মাথা ঘুরছে রে।পুকুদা আমরা কিন্তু নিঃস্ব, ভেবে দেখ
………গত ৫বছর ধরে তোমাকেই শুধু ভেবেছি, আমি তোমার  থেকেও নিঃস্ব, টাপুর। প্লিস, আমায় বিয়ে করো, প্লিস………নারীর ভূষণ মেখে মাথা নিচু করে নিল টাপুর মিষ্টি হাসি মেখে মুখে।
অসিমদা চা আর বিস্কিট পাঠিয়েছে তাই, নিয়ে ৩ জন মুখো মুখি। ধীরে ধীরে পুকু বলল গত ৫ বছরের তার জীবনের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা। মনীষার কথা বলতেই দুই বোন
………মুখে আনবে না, একদম চুপ। ওই নাম এখানে উচ্চারন করবে না। আমরা জানি উনি এখন কলকাতায় আর কোথায় থাকেন, তা সত্তেও এই অভাব, অপমান কিন্তু ওনার  কাছে যাবার কথা  চিন্তাতেও  আসেনি। একদম ওনার কথা বলবে না।
অসিমের মুখে শুনে মোটা মুটি পুকুর সব শুভাকাঙ্ক্ষীরা উপস্থিত। তাদের ভিতর এক  বৌদি
……পুকু, মেয়েটার মাথায় বুদ্ধি আছে রে, ঠিক বুঝেছে, যে বিপদে পড়ে নিজের পরিচয় জানালে পাশে দাড়াবার লোক পাবে। কিন্তু এই রুপ নিয়ে এরা এখানে এই গোয়ালে, ইসস
ভবদাদুর পুত্রবধু মানে পুকুর মায়িমা নিয়ে গেলেন টাপুরকে, তার বাড়িতে আজকের দিন খাবে থাকবে। পুকু নরেশ বাবুর সাথে যোগাযোগ করে দিদুকে ছাড়িয়ে, কলকাতার  সব থেকে দামি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে, টুপুর কে নিয়ে মাসিমার বাড়ি। সেই বাড়ির সবার চিৎকারে পাড়ার লোক বেরিয়ে এসেছিলো। ওই বাড়িতে ফুলশয্যা হবে কেননা ওই বাড়িতে প্রথম আলাপ।  রিসেপ্সন পুকুর নতুন ফ্লাটে, আর বিয়ে নরেশ বাবুর বাড়িতে। বর আসবে সোনারপুর থেকে। পুকু এক গাদা টাকা  বীথি আর মাসিমার হাতে দিল বিয়ের সব খরচার জন্য। সবার জন্য গহনা, শাড়ি ইত্যাদি কেনার খরচা বাবদ।
রাতে, অসিমদার বাড়ির ছাদ থেকে ফোন
………হ্যালো, শ্রী, পরশু তোকে ভোর বেলায় আমার বন্ধু সঞ্জয় পিক আপ করবে। সঞ্জয় কে চিনিস তো? শোন আমার সই করা ৮ টা চেক আছে। একটা ভাঙ্গাবি। তোর মনের মতন,  খুব ভালো, সব থেকে দামি শাড়ি কিনবি কাল। আর যা যা লাগে সব কিনবি। দামি জামা,  কামিজ, জিন্স যা যা খুশি কিনবি আর সব নিয়ে সঞ্জয়ের সাথে আসবি। টাকা তুলতে কিপটেমি করলে কান মলা দেব।। কিপটেমি করবিনা।
তুই? শ্রীর চোখে জল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছে ওই সম্বোধনে
………কি ব্যাপার দাদা, তোমার বিয়ে?
……হ্যাঁ, সেই মেয়েটার খোঁজ পেয়েছি। তুই আসবি সঞ্জয়ের সাথে। একে একে মল্লিকাকে, সুপ্রিয় কে ফোন আর কলকাতার হোটেলে ঘর বুক করা। প্লেনের টিকেট কিনে ডেলিভারি দেওয়া কাল সকালের ভিতর, এই সব কাজ করতে আধ ঘণ্টাও  লাগল না। পয়সা থাকলে সময়ও কেনা যায়। টাপুরকে সম্প্রদান করবে বঙ্কিমদা।

ভবদাদুর বাড়িতে টাপুর অনেকদিন পর এক বালতি  বরাদ্দ জল ছেড়ে  তেল মেখে সাবান দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চান করে খুব খুশি। মনের খুশি ধরা পড়ে মানুষের  মুখে। মায়িমা একটি নতুন শাড়ি দিয়েছেন। খাবার টেবিলে সবাই চুপ করে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে নতুন শাড়ি পড়ে খোলা চুলে টাপুরকে। সেই মুগ্ধতা গায়ে মেখে লজ্বিত টাপুর মুখ তুলে হাসতে গিয়ে আরও ব্রীড়ানত । বাড়ির মেয়েরা নিজেদের মধ্যে
………অসাধারণ রূপসী, আমাদের পাড়ায় এতোদিন কিন্তু আমরা দেখিনি। পুকুর দিদিমা,
………কাল বাদে পরশু বিয়ে, গলা খালি রাখতে নেই মা…… একটি সোনার চেন পরিয়ে দিলেন। টাপুরের চোখ ছল ছল করছে
……… রাজ রাজেন্দ্রাণী হবে তুমি। আমার পুকু খুব দুঃখী ছেলে, ওর দুঃখ এইবার ঘুচবে

টাপুরের আজ বিয়ে। গায়ে হলুদ নিয়ে এসেছে, বুকু আর পুকুর মামাতো ভাই টুকাই ।হলুদ শাড়ীতে টাপুর, হলুদ মাখিএছে ভাবি, বীথি, শ্রী এমনকি টুপুর পর্যন্ত। টুপুর কেও হলুদ মাখিয়ে দিয়েছে বীথি। সবাই একটি ছোট পীতলের ঘটি থেকে জল ঢালছে টাপুরের মাথায়, টুপুরের সজল চোখ বলে উঠলো “ দিদি তুই খুব সুন্দর রে, খুব সুন্দর”।

নরেশ বাবুর বাড়ির চান ঘরে  একা দাঁড়িয়ে নগ্ন টাপুর। ঝরে পড়ছে শাওয়ার থেকে বৃষ্টির মতো জল ধারা। হঠাৎ ভেসে এল কোন সুদুর অতিত থেকে এক টুকরো ছবি সেই ধারার মাঝে। ছোট্ট টাপুরকে কোলে নিয়ে ডিমের কুসুম অল্প করে চামচেতে খাইয়ে দিচ্ছে বাবা, ভিতরের ঘর থেকে ভেসে আসছে  দিদুর গলা “ মনি, এইটা রাগ ভৈরব, আরও খাদে নেমে স্বর তোল“
কেঁপে উঠলো টাপুর, দু হাতে কান্না চেপে চানঘরের সুন্দর মেঝেতে দুই হাঁটুর ওপর চিবুক রেখে হু হু করে কেঁদে চলেছে।  বুকের অনেক অনেক গভীরে বার বার উথলে উঠছে অবিরাম অশ্রু স্রোত, ওপর থেকে ঝরে পড়া অজস্র জলবিন্দুর ভিতর উপুর হয়ে শুয়ে ক্রন্দনরত টাপুর শুনছে তার মা মনীষা গাইছে উদাত্ত কণ্ঠে
……………………… ধ্বনিল আহ্বান, মধুর গম্ভীর, প্রভাত অম্বর মাঝে,
……………………দিকে দিগন্তরে ভুবন মন্দিরে শান্তি সঙ্গীত বাজে
………………… ধ্বনিলরে   ধ্বনিলরে
খুব আস্তে, শুধু টাপুর শুনতে পেল নিজের  অস্ফুট ডাক ‘মা’।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/3m4UZoJ
via BanglaChoti

Comments