কাজলদিঘী
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
দ্বিতীয় কিস্তি
—————————
সত্যি আমার দ্বারা যে এরকম কিছু হবার নয় তা আমি জানি।
শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামের পাঠশালা আর স্কুলে। এরপর কলকাতায় চলে আসি। কলেজ লাইফ আর ইউনিভার্সিটি লাইফ কেটেছে কলকাতায়। তারপর চাকরি জীবন। অনেকটা ভাসা মানিকের মতো। আমি এখনও ভাসছি। ভেসে বেড়াচ্ছি।
গ্রামে উনামাস্টারের কাছে টিউশন পড়তে যেতাম।
আমাদের গ্রামের থেকে সেটা প্রায় দুই মাইল দূরে। প্রত্যেক দিন হেঁটে যাওয়া আসা করতে হতো। আমাদের গ্রাম থেকে আমরা দু-জন যেতাম। আমি আর ভানু।
ভানু চারবার ফেল করে এখন আমার সঙ্গে একসঙ্গে মাধ্যমিক দেবে। স্বভাবতই ও আমার বস। আমার থেকে অনেক কিছু ও বেশি জানে। তাছাড়া বিড়ি খায়। বাবার বিড়ির বাণ্ডিল থেকে প্রত্যেক দিন ও দু-তিনটে করে বিড়ি গেঁড়াবেই গেঁড়াবে।
আর আমাদের বন্ধুদের সামনে এমন হাবভাব করে বিড়ি খাবে আর কথা বলবে যে আমরাও ওর কথাবার্তায় মহিত হয়ে যেতাম। ও আমাদের দলের পালের গোদা।
আমি মাঝে মাঝে ওর ফাই ফরমাস খাটতাম।
মনামাস্টার আমার গার্জেন। মনাকাকা।
মাঝে মাঝে আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলতো, ভানুর সঙ্গে বেশি মিশিস না। ছেলেটা ভালো নয়। আমি মাথা নিচু করে থাকতাম।
সেদিন উনামাস্টারের কাছে পড়তে যাওয়ার কথা। সকাল ৬ টার সময়। আমি রেডি হয়ে ভানুর বাড়িতে গেছি। ভানুর মা বললো, ভানু চলে গেছে। অগত্যা আমি একা একাই গেলাম উনামাস্টারের কাছে।
গিয়ে দেখি সকলেই এসেছে। কিন্তু ভানু নেই। কেমন যেন লাগল।
সৌমিলি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে পূর্ণিমাকে বললো, পুনি দেখ বাবু আজ একা একা, জুরিদার নেই।
আমি এমনিতে খুব কম কথা বলি। মেয়েদের সঙ্গে তো কথাই বলতাম না। ওদের দিকে তাকালাম। ওরা এমন ভাবে আমাকে চোখ মারলো যে আমার বুকটা কেঁপে উঠলো।
উনামাস্টার আমার দিকে তাকাল।
আর একটা হনুমান গেল কোথায় অনি?
আমি মাথা নিচু করে বললাম, জানিনা।
মিথ্যা কথা বলছিস।
সত্যি বলছি স্যার। কাকী বললো ও আমার আগে চলে এসেছে।
দেখ গিয়ে কার ঘরের আঁখ বাড়ি ধ্বংস করছে।
গুডবয় বলে আমার একটা সুনাম ছিল। তাই মাঝে মাঝে পাল্লায় পরে একটু-আধটু দোষ করলেও সাতখুন মাপ। অনি এটা করতেই পারে না।
পড়তে পড়তে অনেক দেরি হয়ে গেল। বইখাতা গুছিয়ে বেরতেই দেখি স্যারের বাড়ির বাঁশঝাড়ের কাছে পুকুর পাড়ে সৌমি আর পুনি দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতেই সৌমি বললো, কোন দিক দিয়ে যাবি অনি?
দীঘাআড়ি দিয়ে যাব।
দীঘাআড়ি!
আমাদের দুটো গ্রামের মাঝে একটা বিরাট ঝিল।
মাঝে মাঝে আমি একা একা ওখানে গিয়ে বসি। কতো পাখি আসে ওই ঝিলে। আমি বসে বসে দেখি। চারিদিকে গাছ আর গাছ। ঘনো জঙ্গলে ভর্তি। উনামাস্টারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে পরবে বীরকটার শিবমাড়ো। একটু এগোলেই পুরীকুন্ডী শ্মশান। শ্মশানকে বাঁহাতে রেখে এগিয়ে গেলে কামার ঘর। তারপর বড়বিল, রামপুরার বাঁধে উঠে বাঁধ বরাবর দীঘাআড়ি।
লোকে ভয়ে ওই পাশে যায় না। বলে ওখানে নাকি ভূতেরা নাচানাচি করে। আমি বহু দিন একা একা ওইখানে গিয়ে বসেছি। কিন্তু ভূত দেখতে পাইনি। তাই আমাকে অনেকে ডাক সাইটে সাহসী বলেও ডাকে। বাড়ির সকলে জানে কোথাও না পেলেও অনিকে দীঘাআড়িতে পাওয়া যাবেই। আমাদের গ্রামে যারা মারা যান। তাদের ওই শ্মশানে পোড়ান হয়। আমার মা-বাবাকেও ওখানে পোড়ান হয়েছিল।
বোঁচকুল খাবি? পুনি বললো।
না।
আমাদের সঙ্গে আজ বাঁধে বাঁধে চল না।
অনেক ঘোরা হবে।
তাতে কি হয়েছে? একসঙ্গে গল্প করতে করতে যাব।
ওরা থাকে আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাশে ধামসাই বলে একটা গ্রামে। ওই গ্রামের সকলেই বেশ পয়সা ওয়ালা লোক, গ্রামের লোকেরা বলে মাহেশ্ব পাড়া, সকলেই প্রায় চাষ আবাদ করে, আর গ্রামে সপ্তাহান্তে যে হাট বসে তাতে দোকান দেয়। সৌমি আগে আমি মাঝখানে পুনি পেছনে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছিল।
তুই একটা গবেট গোবিন্দ বুঝলি আনি।
কেন!
তুই মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে জানিস না।
আমি চুপ করে থাকলাম।
ভানুকে দেখেছিস, আজকে একটা মেয়েকে পটাচ্ছে। আবার কালকে আর একটা মেয়েকে পটাচ্ছে। আর তুই ওর সঙ্গে থেকে কি শিখলি?
ভানু ভালোছেলে।
এঃ । ভানুর কলাটা দেখেছিস?
ভানু কি কলাগাছ, যে ওর কলা থাকবে।
হি-হি, হি-হি তুই সত্যি একটা গাধা।
যা তোদের সঙ্গে আমি যাব না। আমি ফিরে দাঁড়ালাম।
পুনি, সৌমি দু-জনে আমার দু-হাত ধরলো।
আচ্ছা আচ্ছা তোকে গাধা বলবো না। কিন্তু গাধী বললে রাগ করবি না?
আমি সৌমির দিকে তাকালাম। ওর চোখের ভাষা সেই দিন সেই বয়সে বুঝতে পারিনি। কিন্তু ছবির মতো আমার চোখে আজও ভেসে আছে। এখন এই ভরা যৌবনে আমি চোখ বন্ধ করে একমনে চিনতা করলেই সেই চোখ দেখতে পাই। ভাষাও বুঝতে পারি।
তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে গ্রামের শেষ প্রান্তে এলাম।
সামনের বড়ো মাঠটাকে কাশিঘরের ডাঙা বলে। এখন ওটা সবুজ। সবে মাত্র ধান রোয়া শেষ হয়ে গাছগুলো সামান্য বেড়ে উঠেছে। ওটা পেরলেই সৌমিদের বাড়ি। আর আমাকে ডানদিক দিয়ে আবার ছিনার বাঁধে বাঁধে কিছুটা হেঁটে নদী পেরিয়ে আসতে হবে।
সামনে বিশাল বাঁশ বন। এই দিনের বেলাতেও সেখানে শেয়ালের আনাগোনা।
এই পুনি তুই বলনা অনিকে।
আমি! না না তুই বল।
কেন আমি কি শুধু একা ভাগ নেব? তুই নিবি না?
আমি তো ওকে রাজি করিয়ে নিয়ে এলাম এপাশ দিয়ে আসার জন্য, তুই এবার বল।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কি বলছে ঠিক মাথায় ঢুকছে না। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমরা এখন বাঁশ বনের ভেতরে। চারিদিকে লম্বা লম্বা বাঁশ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কোনটা হেলে পড়েছে। কোনটা একে অপরের শরীরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁশ গাছ ছাড়াও অনেক গাছ আছে। তাল, তমাল, শিরিষ, সেগুন, বট, অশ্বত্থ আরও কত কি।
ওই কোনের ঢেকটাতে একটা বড় জামরুল গাছ আছে। আমরা দঙ্গল বেঁধে স্কুল থেকে ফেরার পথে জামরুল খেতে আসি। হাওয়ার ধাক্কায় বাঁশ গাছগুলো একপাশ থেকে আর এক পাশে হেলে যাচ্ছে। গায়ে গায়ে ঘসা লেগে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ হচ্ছে। আমি প্রায়ই একা থাকলে এরকম নির্জনে চলে আসি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একলা বসে থাকি। ভীষণ ভালো লাগে।
এই আওয়াজ শুনতে শুনতে মনে হয় বাঁশ গাছগুলো যেন একে অপরের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে কথা বলছে। আমরা কেউই ওদের শব্দ-স্পর্শ-গন্ধ বুঝি না। কিন্তু ওরা ওদের ভাষা বোঝে। আমি ওপরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
একফালি সূর্যের আলো বাঁশ গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে নিচে আসার জন্য অবিরাম ছটফট করছে। কিন্তু আর একটা গাছ তাকে কিছুতেই নিচে আসতে দেবে না। এ যেন আলো ছায়ার খেলা। আমি নিজের মধ্যে নিজে যেন হারিয়ে গেলাম।
অনি।
সৌমিলির গলা শুনে চোখ নামাতেই দেখি দুজনের কেউই আমার পাশে নেই। একটু ভয় পেয়ে গেলাম।
অনি।
এদিক ওদিক তাকালাম। না কেউ কোথাও নেই।
অনি।
এবার বুঝতে পারলাম। ওই বাঁশ ঝারটার পেছন থেকে আওয়াজ আসছে।
কি হলো, তোরা ওখানে কি করছিস? যাবি না? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। মনাকাকা বকবে।
একবার এদিকে আয়, একটা জিনিস দেখাব।
আমি একটা হেলে পড়া বাঁশের তলা দিয়ে মাথাটা নিচু করে ওপাশে গেলাম।
কোথায়?
এই তো এখানে, আয়।
কাছে যেতেই অবাক হলাম। একটু ভয়ও পেলাম। পুনি, সৌমি দুজনেই উলঙ্গ অবস্থায় একটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে।
করবি।
আমি ভয় পেয়ে দৌড় লাগালাম। সেই যে ওখান থেকে দৌড় শুরু করলাম সোজা চলে এলাম দীঘাআড়ি।
দীঘির পাড়ে বইখাতা রেখে ঝিলের জলে চোখ-মুখ ধুলাম। পেট ভর্তি করে জল খেলাম। তারপর আমার পরিচিত সেই ঝোপটার কাছে গিয়ে বসলাম। সরাল, শামুকখোলা একবার দীঘির জলে মুখ ডোবাচ্ছ আবার ভেসে উঠছে। সামনেই কোথাও একটা ঘু ঘু পাখি ডাকছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ঝিঁ ঝিঁ শব্দ। কাঠবিড়ালীগুলো আশপাশ দিয়ে ছোটাছুটি করছে। কেউ আবার সামনের দুইপায়ে খাবার নিয়ে পেছনের দুইপায়ে ভড় দিয়ে দাঁড়িয়ে কুট কুট করে খাবার খাচ্ছে। আমি আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম।
মা-বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো আমার জীবনটা একটু অন্য ভাবে লেখা হতো, কি করা যাবে। সবার ভাগ্যে সব কিছু জোটে না, আমারও তাই।
হঠাৎ একটা মেয়ের খিল খিল শব্দে চমকে উঠলাম। এদিক ওদিক তাকালাম। না কেউ কোথাও নেই। তারপর ভানুর গলার শব্দ।
আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। ঝোপের আড়ালে ভানু আর কালীচরনের ঝি।
কালীচরন আমাদের বাড়ির খামারের ওপাশে একটা টং করে রয়েছে। এই সময় ওরা আসে মাঠে কাজ করার জন্য। আবার মাঠের কাজ শেষ হলে চলে যায়।
কালীচরন সাঁওতাল। ওর মেয়ের নাম ময়না। ময়না ভানুর কাছ ঘেঁসে বসে আছে। উদম গায়ে একটা বারো হাত কাপর কোনও প্রকারে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে জড়িয়ে আছে। কতো বয়স হবে আমাদেরই মতো। সতেরো আঠারো, শরীরটা যেন পাথরে কুঁদে তৈরি। যেমনি মিশ কালো, তেমনি চকচকে।
আমার যে ময়নাকে ভালো লাগত না তা নয়। তবে ভালো লাগলেও বা করবো কি? আমি চেষ্টা করেও কখনও ভানুর মতো হতে পারব না। তাছাড়া আমার মনামাস্টার আছে। আমার গার্জেন। আমি বাপ-মা মরা ছেলে। গ্রমে আমাকে শাসন করার প্রচুর লোক। পান থেকে চুন খসলে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। আমার অনেক প্রতিবন্ধকতা। তাই সব ইচ্ছেগুলো বুকের মধ্যে গলা টিপে মেরে ফেলতাম।
মনে পড়ে গেল সৌমি আর পুনির ব্যাপারটা। ওরা ওই ভাবে নেংটো হয়ে আমার সামনে এলো? আর আমি দৌড়ে চলে এলাম!
তুই এতো জোরে চাপিস কেন?
ভালো লাগে।
আবার ওদের দিকে চোখ পড়ে গেল।
ভানুর শরীরে শরীর ঠেকিয়ে ময়না বসে আছে। বুক থেকে কাপরটা খসে পড়েছে।
ময়না বলে উঠল, বুদতি পালিছি বুদতি পালিছি…..।
ভানু হাসল, তুই বুঝতি পারছু?
হ।
তাইলে কাপরটা….?
না।
কেন?
কি দিবি।
বিকেলে হাটে তোকে ছোলার পাটালি কিনে দেব। আর মনিহারির দোকান থেকে একটা লাল ফিতে কিনে দেবো।
দিবি তো।
হ্যাঁ।
আগের বার দিলি নি।
এবার তোকে ঠিক দেব।
মোকে তাড়াতাড়ি যাইতে হবে। পান্ত লিয়ে মাঠে আসতি হবে।
ভানু ময়নার কানের লতিতে জিভ দিল। ময়না নড়ে চড়ে উঠল।
কেউ যদি এউঠি এইসে পড়ে?
কে আসবে এখন!
তুর ওই বন্ধুটা।
অনি?
হ।
ও তো পড়তে গেছে।
তুই যাস লাই?
না।
কেনি?
তোকে আজ খুব আদর করতে ইচ্ছে করছিল। তাই ওইখানে গিয়ে বসেছিলাম। জানি তুই আসবি।
তুর খালি নষ্টামি। এসব করা ভালো লয়।
কে বললো তোকে?
মা বইলছে।
তোকে আমার ভালো লাগে?
ভানু ময়নার গালে একটা চুমু খেল। তারপর….
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। প্রায় আধঘণ্টা ধরে সব দেখলাম। শেষে দুজনেরই শরীর কেমন ভাবে যেন কেঁপে কেঁপে উঠল। এটাই তবে সেক্স!
বন্ধুরা অনেক গল্প করতো। আমি ঠিক আমল দিতাম না। মাঝে মাঝে অন্ধকার ঘরে উলঙ্গ হয়ে ছোটো আয়নাটা নিয়ে নিজেই নিজেকে দেখতাম। ভালো লাগত।
আমি বহু দিন ওদের দীঘাআড়ির এই জায়গাটায় দেখেছি। কিন্তু কোনও দিন ওরা আমাকে দেখতে পায়নি। তারপর একদিন ভানুকে ব্ল্যাকমেল করলাম।
ভানু আমার হাতে-পায়ে ধরে। আমি শুধু ওকে বলেছিলাম, আমি যা বলবো তোকে তাই করতে হবে। ও রাজি হয়ে গেল। তারপর থেকে ভানু দাদা। আমি ওর দাদা।
দেখতে দেখতে ১৫টা দিন যে কোথা দিয় কেটে গেল ঠিক বুঝতে পারলাম না। বড়োমা এর মধ্যে দু-তিনবার ফোন করেছিল। ছোটোমাও।
অমিতাভদা প্রতিদিন সকালে আর বিকেলে ফোন করতো। মল্লিকদাও। তনু মাঝে কয়েকবার ফোন করেছিল ঠিক, তবে ওর কথাবার্তা শুনে কেমন যেন একটু খটকা লাগল। বললাম ঠিক আছে, কলকাতায় গিয়ে সব শুনবো।
আসার সময় আমাকে প্লেনের টিকিট ধরানো হলো। কলকাতর অফিসে আমাকে জরুরি দরকার আছে তাই। কলকাতা এয়ারপোর্টে নামার পর দেখলাম বড়োমার মিস কল। প্লেনে থাকাকালীন হয়তো করেছিল। বড়োমাকে ফোন করলাম। কন্ঠে উৎকন্ঠা। আমাকে বললো।
তুই এখন কোথায়?
এই সবে নামলাম, এখনও লাউঞ্জে রয়েছি বেরোত পারিনি।
ঠিক আছে। প্রথমে একবার এ বাড়িতে আসিস।
একটু ভয় পেয় গেলাম—কেন!
আয়-না, এলে জানতে পারবি।
তুমি আগে বলো, দাদার কিছু হয়েছে!
না-রে না।
তাহলে!
তোর জন্য আমি ছোটো সকাল থেকে রান্না চাপিয়েছি। তুই এলে একসঙ্গে খাওয়া হবে।
সত্যিকথা বলো, তাহলে যাব। নাহলে যাব না। যেমন বিকেল বেলা যাই তেমন যাব।
না তুই এখুনি আসবি।
ঠিক আছে।
বুঝলাম গুরুতর একটা কিছু হয়েছে। যার জন্য বড়োমার তলব।
এয়ারপোর্টে নেমে অনেক পরিচিত মুখের দেখা পেলাম। কাজের তাগিদে এখানে প্রায় আসতে হয়। তাছাড়া সাংবাদিক মানুষ, তাই একটু আধটু খাতির আছেই, কলকাতা মার্কেটে আমার পরিচিতি খুব একটা খারাপ নয়।
সমীরণদা কলকাতারই একটা অন্য কাগজের এয়ারপোর্ট সংবাদদাতা। আমাকে দেখে বললো, কোথায় ছিলে বাপ, ক-দিন দেখা সাক্ষাত নেই। একবারে ফুরুত।
বললাম, কোথায় গেছিলাম।
একটু অবাক হয়ে বললো, করেছিস কি, সম্পূর্ণটা তুই একলা করেছিস!
হ্যাঁ।
চল একটু ক্যান্টিনে যাই কফি খাব। তোর কোনও তড়াহুরো নেই তো?
এই তো সবে কলকাতায় নামলাম।
সমীরণদা হাসল। আমি তোর সমস্ত নিউজগুলো পড়েছি। দারুন লিখেছিস। তোর স্পেকুলেসন সব মিলে গেছে।
হ্যাঁ, আজকে রেজাল্ট। আমি তো সকালের ফ্লাইটে বেরিয়েছিলাম, দিল্লী হয়ে আসছি। সকাল থেকে কাগজটা দেখা হয়নি।
তাই!
সমীরণদা ব্যাগ থেকে ওদের হাউসের কাগজ আর আমাদের হাউসের কাগজটা বার করলো। আমি ওপর ওপর একবার চোখ বোলালাম। কফি আর চিকেন পকোরা এলো। সকাল থেকে কিছু পেটে পড়েনি। খিদেও লেগেছিল। কয়েকটা চিকেন পাকোরা গলধোকরণ করে, কফি মুখে দিলাম। অমৃতের মতো লাগলো। সমীরণদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
কলকাতার হাল হকিকত বলো।
যেমন ছিল তেমনি আছে।
তাপস এলো হাঁপাতে হাঁপাতে।
তুমি এখানে? তাপস আমাদের হাউসের একজন গাড়ির ড্রাইভার।
হ্যাঁ।
তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেলাম।
কেনো! তুই আসবি আমাকে কেউ বলে নি।
আমার কি আসার ঠিক ছিল। এই তো ঘণ্টা খানেক আগে বললো।
ও। কেন কি হয়েছে?
তোমাকে অফিসে ফেলেই, আবার রাইটার্সে দৌড়তে হবে।
আমি এখন অফিসে যাব না।
যা বাবা! সুনিতদা বললো তোমাকে নিয়ে অফিসে যেতে।
দাদা কোথায়?
দাদা তো কয়েকদিন হলো অফিসে আসছেন না।
মল্লিকদা।
মল্লিকদাও আসছেন না।
আমি তাপসের দিকে তাকালাম। সমীরণদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।
ঠিক আছে, তুমি কফি খাবে?
না।
গাড়ি কোথায় রেখেছো?
পার্কিংয়ে।
তুমি যাও আমি আসছি। বুঝলাম কিছু একটা গড়বর হয়েছে। নাহলে কাগজের দুই স্তম্ভ নেই। কাগজ বেড়িয়ে যাচ্ছে। আমার একটু অবাক লাগল।
ঘরের কথা বাইরে প্রকাশ করতে নেই।
সমীরণদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ওর নিজের হাউসে একটা ভালো জায়গা হোল্ড করে আছে।
কিরে কি ভাবছিস?
কিছু না। পনেরো দিন ছিলাম না….।
তোদের হাউসে বেশ গণ্ডগোল চলছে।
তাই! সে তো আমাদের হাউসে লবিবাজি আছেই। আজ এই লবি স্ট্রং তো কাল ওই লবি।
সমীরণদা মুচকি হাসলো।
ঠিক আছে দাদা, আজ আসি, কাল দেখা হবে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।
সমীরণদার কাছে বিদায় নিয়ে লাউঞ্জ পেরিয়ে গেটের বাইরে এলাম। তাপস আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
কি ঠিক করলে।
অফিস গাড়ি পাঠিয়ছে। আগে অফিসে যাই, তারপর দেখা যাবে।
মনে হচ্ছে ঝড়ের একটা পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছি। তাপস আমাকে অফিসে লিফট করেই ওর কাজে চলে গেল। রিসেপসনিস্ট ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেলাম না। একজন ছেলে কোট-টাই পরে বসে আছে।
আমাকে দেখে বললো, কাকে চান?
আমার ব্যাগটা এখানে রাখবো।
কার সঙ্গে দেখা করবেন?
কি বলি ছেলেটাকে। খুব আস্তে করে বললাম আমি এই অফিসের স্টাফ।
ছেলেটি আমার কার্ড দেখতে চাইল।
দেখালাম।
আমি আমার লাগেজটা রিসেপশন কাউন্টারের পেছনে রেখে লিফ্টের কাছে চলে এলাম।
সবাই কেমন ইতি উতি তাকাচ্ছে। ভারি অবাক লাগল।
কোনও দিকে তাকালাম না। ওপরে এসে সোজা নিউজরুমে চলে গেলাম।
এই সাত সকালে নিউজরুমে যেন হাট বসে গেছে। গিজ গিজ করছে।
প্রচুর নতুন মুখ।
সন্দীপের সঙ্গে দেখা হলো। কাছে এগিয়ে এল।
কখন এলি?
এই তো এই মাত্র।
শুনেছিস কিছু?
কি বলতো!
অফিসের হাল চাল।
না।
কথা বলতে বলতে নিজের টেবিলে এলাম। মল্লিকদার চেয়ারটা ফাঁকা পড়ে আছে। অপরজিটের চেয়ারে কয়েকজন নতুন ছেলেমেয়েকে দেখলাম। দু-একটা ভালো চামকিও চোখে পরলো। আমি আমার টেবিলে গিয়ে বসলাম। সন্দীপ আমার পাশে বসলো।
সবাই আমাকে কম বেশি লক্ষ্য করছে।
টেবিলের ওপর রাশিকৃত চিঠি। সন্দীপ আমার দিকে তাকিয়ে বসেছিল। আমি চিঠিগুলো একবার দেখলাম। কয়েকটা চিঠি পরিচিত জনের। বাকি আমার লেখার ওপর। এগুলো চিঠিপত্র বিভাগে পাঠিয়ে দিতে হবে। আমি সন্দীপের দিকে তাকালাম। সন্দীপ বললো, চল একটু ক্যাণ্টিনে যাই।
চল।
আমি আর সন্দীপ ক্যাণ্টিনে এলাম।
বটাদাকে ডেকে ডিমটোস্ট আর চায়ের কথা বললাম। সন্দীপের দিকে তাকিয়ে বললাম, বল কি বলছিলি?
আমার চাকরিটা মনে হয় গেল।
কেন!
তুই কিছু জানিস না?
না।
দাদা তোকে কিছু বলে নি!
না।
তুই কলকাতায় কবে এসেছিস?
কতবার বলবো। ঘণ্টাখানেক হবে। তাপস আনতে গেছিল, সুনিতদা নাকি গাড়ি পাঠিয়েছিল আমাকে তুলে আনার জন্য। প্রথমে অফিসে আসতে বলেছে। তারপর বাড়ি।
ও।
কেন-রে?
গিয়ে দেখা কর, সব জানতে পারবি।
কি হয়েছে বল না?
ফোনটা বেজে উঠলো। বড়োমার ফোন।
হ্যালো বলতেই অমিতাভদার গলা পেলাম।
মাথা ঠাণ্ডা রাখিস।
তুমি! বড়োমা কোথায়?
রান্নাঘরে।
তোমার ফোন কোথায়?
ব্যবহার করছি না।
ও। তা হঠাৎ মাথা ঠাণ্ডা রাখব কেন?
সন্দীপ আছে, শুনে নে।
অফিসে আসনি কেন?
সে অনেক কথা।
আমি এখানে, এটা কে বললো?
খবর এলো।
বাবাঃ নেট-ওয়ার্ক তো বেশ স্ট্রং, তাহলে এই অবস্থা কেন?
কপাল।
সাংবাদিকতা করতে করতে চুল পাকিয়ে ফেললে। এখন এই কথা বললে হবে।
সে তুই যা বলিস।
মল্লিকদা কোথায়?
বাড়িতে। তুই কখন আসছিস?
দেখি। কাজ শেষ হলেই চলে যাব।
বটাদা ডিম, পাঁউরুটি আর চা দিয়ে গেল। আমার দিকে একবার কট কট করে তাকাল।
ফোনটা পকেটে রাখলাম। সন্দীপের দিকে তাকালাম। হ্যাঁ কি বলছিলি?
আমার চাকরিটা মনে হয় যাবে।
কেন?
সুনিতদা এখন পাওয়ারে।
তাতে কি হয়েছে!
তুই সত্যি একটা গাণ্ডু।
হেসে ফেললাম।
হাসিস না। তোর ওই হাসিটা দেখলে গা জ্বলে যায়।
আচ্ছা আচ্ছা হাসব না।
তোর চাকরিটা থাকবে।
যাক তাহলে রক্ষে।
অমিতাভদা এবং মল্লিকদাকে এখন ছুটিতে যেতে বলা হয়েছে।
তাই! এককেবারে ছুটি।
ন্যাকামো করিস না। অমিতাভদার ঘরে এখন সুনিতদা বসছে।
ও তাহলে এডিটর, কি বল।
ওই রকমই বলতে পারিস। এখনও খাতা কলমে নয়। তবে বকলমে কাজ চালাচ্ছে।
ও।
সব নতুন নতুন ছেলেমেয়ে আমদানি করেছে।
বেশ ভালো।
সন্দীপ কট কট করে আমার দিকে তাকাল।
একজন উর্দিপরা ভদ্রোলোক এসে বললেন, আপনাকে সুনিতবাবু ডাকছেন।
ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালাম। উনি চলে গেলেন। সন্দীপের দিকে তাকালাম।
এখন অনেক সিকুরিটি গার্ড এসেছে। এরাই এখন অফিসের দেখভাল করে।
হরিদা কোথায় গেল?
অমিতাভদা যেদিন থেকে আসা বন্ধ করেছেন, হরিদাকে প্রেসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওখানে কি করছে!
কাগজ বইছে।
ওই বয়স্ক মানুষটা কাগজ বইছে!
হ্যাঁ। না হলে কাজ থেকে ছুটি নিতে বলা হয়েছে।
বেচারা।
আমি অবাক হয়ে সন্দীপের কথা শুনছি। বাকিটা নিজে নিজেই আঁচ করে নিচ্ছি।
এই অফিসের মালকিন আমার পূর্ব পরিচিতা এটা এখানকার কেউ জানে না। একমাত্র অমিতাভদা, মল্লিকদা ছাড়া। তবে মল্লিকদার স্ত্রীই যে আমার ছোটোমা আর অমিতাভদার স্ত্রী আমার বড়োমা এটা সংঘমিত্রা জানে না।
তারমানে অনেক জল এই পনেরো দিনে গড়িয়ে গেছে। এই বয়সে এত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্যকরেও দাদা-মল্লিকদা কেউ কোনও কথা বলেনি। শুধু আমার ফিরে আসার অপেক্ষা করেছে। এই বয়সে এটা ওদের প্রাপ্য ছিল না। আমি নিজে খুব ভালোকরে জানি এই কাগজটাকে আজ কলকাতায় শীর্ষে তোলার জন্য ওরা দুজনে কি না করেছে।
কি ভাবছিস?
না কিছু না। চল ওঠা যাক। নতুন সাহেবের সঙ্গে কোথায় দেখা করবো।
অমিতাভদার ঘরে।
ক্যান্টিন থেকে সোজা নীচে চলে এলাম। সন্দীপ নিউজরুমে গেল আমি এডিটর রুমের দিকে পা বাড়ালাম। ঢোকার মুখে দেখলাম একজন সিকুরিটি গার্ডের মতোন লোক দাঁড়িয়ে আছে। ঢুকতে যেতেই আমাকে বাধা দিল। কি প্রয়োজন জিজ্ঞাসা করলো। তারপর বললো, ওই খানে গিয়ে স্লিপ নিয়ে আসতে।
জায়গাটা নতুন তৈরি হয়েছে মনে হচ্ছে।
দেখলাম, নিচে যে রিসেপসনিস্ট ভদ্রমহিলা বসতেন তিনি বসে আছেন। কাদের সঙ্গে যেন কথা বলছেন। আমি বাধ্য ছেলের মতোন হাজির হলাম, আমাকে দেখেই ভদ্র মহিলা মুচকি হেসে বলে উঠলেন, আরে অনিবাবু যে, কি দরকার?
এডিটর সাহেবের সঙ্গে দেখা করবো।
ওঃ এই সিকুরিটিটাকে নিয়ে পারা যাবে না। সবাইকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
কি আর করা যাবে, ও তো আর আমাকে চেনে না।
চিনবে না কেন। আপনি এই হাউসের স্টাফ।
আজ আমাকে প্রথম দেখছে।
ঠিক আছে চলুন, আমি বলে দিচ্ছি।
আপনি একটা স্লিপ লিখে পাঠিয়ে দিন।
না না, এটা হয় না।
কেন হয় না, যেটা অফিসের ডেকরাম সেটা তো মানতে হবেই।
ভদ্রমহিলা আমার মুখের দিকে তাকালেন। কি যেন ভাবলেন। হয় তো শেষের কয়টা কথা বেশ কঠিন হয়েগেছিল। খুব খলবলি ভদ্রমহিলা। আমি খুব একটা পাত্তা দিই না। তবে অফিসের অনেকেই ওকে পাত্তা দেয়। দেখতে শুনতেও খারাপ নয়। ভেতরে গিয়ে ইন্টারকমে ফোন করতেই আমার যাবার ডাক এলো।
এডিটর রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। দেখলাম সুনিতদা তার দলবল নিয়ে বসে আছে। আমাকে ঢুকতে দেখেই বললো, আয় আয়।
ওদের ওইভাবে বসে থাকতে দেখে মাথাটা গরম হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দাদার কথাটা মনে পড়েগেল, মাথা ঠাণ্ডা রাখিস।
আমি পার্মিশনের তোয়াক্কা না করে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।
ঘরের সবাই কেমন ভাবে যেন আমাকে টেরিয়ে দেখলো।
কেমন আছিস?
ভালো।
চা খাবি?
না। ক্যান্টিন থেকে সবেমাত্র আসছি।
আমার কাট কাট উত্তরে সবাই আমার দিকে বিস্ময়ে তাকাচ্ছে।
তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথা ছিল।
বলো।
তুই আজ সবে মাত্র ফিরলি।
তাতে কি হয়েছে। এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠালে আমাকে ধরে আনার জন্য….।
না মানে। তোকে আমি চেন্নাইয়ের ব্যুরো চিফ করেছি।
কার অনুমতি নিয়ে?
আমিই ঠিক করেছি। তবে ম্যানেজমেন্ট সেটায় সায় দিয়েছে।
আজকাল কি তুমি এসব ঠিক করছো নাকি?
না ম্যানেজমেন্ট গত সপ্তাহে আমাকে দায়িত্ব তুলে দিয়েছে।
আমাকে কেউ এখনও জানায়নি।
এই তো, আমি জানাচ্ছি।
সুনিতদা জানে আমার মতো খারুয়া ছেলে এই হাউসে একটাও নেই। মাঝে মাঝে অমিতাভদা পর্যন্ত ফেল মেরে যেত। কিন্তু আমি বেঁচে যাই শুধুমাত্র আমার লেখার জন্য।
সুনিতদার দিকে তাকিয়ে বললাম, ম্যানেজমেন্টকে বলো আমার সঙ্গে কথা বলতে।
সেটা কি করে হয়!
কেন! যাবে কে, তুমি না আমি?
তুই।
তাহলে আমার সঙ্গে একবার আলোচনা করা উচিত ছিল।
সেটা ঠিক, তবে আমি জানি তুই….।
সরি। আমি যেতে পারছি না। তাছাড়া আমি এতো বেশি অভিজ্ঞ নই যে একটা অফিস চালাব। তার চেয়ে বরং তুমি চলে যাও। তা না হলে আমার থেকেও অনেক সিনিয়ার জার্নালিস্ট এই হাউসে আছে। তাদের পাঠাবার ব্যবস্থা করো।
তাহলে তুই যাচ্ছিস না?
না।
সবাই আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। একটু যেন অবাক হয়েছে। ওদের চোখে মুখেই তার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট। ঘরটা নিস্তব্ধ। সুনিতদা আমার মুখের দিকে তাকাল। কিছু হয়তো বলবে ঠিক করেছিল তার আগেই আমি উঠে দাঁড়ালাম।
আর কিছু বলার আছে?
তুই একবার ভেবে দেখতে পারিস।
সরি।
তাহলে আমার কিছু করার নেই।
হাসলাম। তোমার ম্যানেজমেন্ট আমারও ম্যানেজমেন্ট তাদের সঙ্গে আমি বসবো। তাতে তোমার আপত্তি কোথায়? তোমার ব্যাক্তিগত আপত্তি থাকলে আলাদা কথা।
না, তুই হয় তো সব জানিস না।
সে তো হতেই পারে। পনেরো দিন পরে ফিরলাম। ঘণ্টা খানেক হলো অফিসে ঢুকেছি। আমার সমস্ত ব্যাপার না জানারই কথা।
ঠিক আছে তুই যা।
আমি বেরিয়ে এলাম। এটুকু জানি আমাকে এই হাউস থেকে সরান খুব মুস্কিল। তাহলে অনেক ঝড় উঠবে। সেটা সুনিতদা ভালোকরে জানে। চম্পকদা আঁচ করে, তাছাড়া মিত্রা এসব কি করলো! কার কথায় ও উঠছে বসছে! সুনিতদার কথায়! মুখে থেকে একটা খিস্তি বেরিয়ে এলো, কালকা জোগী গাঁড় মে বোলতা হ্যায় জটা।
নিউজরুমে চলে এলাম।
নিজের টেবিলে এসে বসলাম।
সন্দীপ এলো। কিরে কি বললো?
শালা চেন্নাইয়ের ব্যুরো চিফ বানিয়েছে।
আমি জানি ডি এইচ এ এম এন এ নিশ্চই একটা প্ল্যান ভেঁজেছ।
সেটা আবার কিরে!
বউ বলেছে কাউকে গালাগালি দিতে হলে বানান করে দেবে।
আমি মনে মনে উচ্চারণ করে হেসে ফেললাম।
শালা অমিতাভদার সবকটা হ্যান্ডসকে এক সপ্তাহের মধ্যে এখানে ওখানে সরিয়ে দিয়েছে। তুই কি বললি?
যাবনা বলে দিয়েছি।
ব্যাস হয়ে গেল। তোর চাকরি নট।
তো।
এরপর কি করবি?
কোনও কাগজের এডিটর হবো।
তোর দম আছে।
হাসলাম।
অনি আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করিস।
সন্দীপ আমার হাতটা ধরে ফেললো।
কেন? তোর চাকরি চলে গেছে?
যায় নি, তবে চলে যাবে।
কি করে বুঝলি?
খবর নিয়েছি কাগজপত্র তৈরি।
পিটিআই, ইউএনআই কে সামলাবে?
লোক এসে গেছে। আমি সাতদিন ধরে আসছি আর চলে যাচ্ছি।
হাজিরা খাতায় সই মারছিস?
হ্যাঁ।
কোনও নিউজ করিসনি?
না।
কেন?
দেয় নি।
ও।
অনিববু কে আছেন। একজন সিকুরিটি এসে সামনে দাঁড়াল। আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম, ভালোকরে মাপলাম, ভদ্রলোক নয় একটা বাচ্চা ছেলে। সন্দীপ আমাকে দেখিয়ে বললো, উনি।
আপনাকে একবার মেমসাহেব ডাকছেন।
কে।
খিঁচিয় উঠলাম। বলাটা একটু জোড়ে হয়েগেছিল। নিউজরুমের সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছে।
মেমসাহেব।
সে আবার কে!
ছেলেটি আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।
ঠিক আছে, নিচে ভিজিটারস রুমে বসতে বলো।
আপনাকে এখুনি ডাকছেন।
সন্দীপের মুখের দিকে তাকালাম। সন্দীপ ইশারায় বললো মালকিন।
তোমার মেমসাহেবকে গিয়ে বলো, আমি একটু পড়ে যাচ্ছি।
জরুরি দরকার আছে।
আরি বাবা, আচ্ছাই তো, এ তো ঘোরায় জিন দিয়ে এসেছে।
চেঁচিয়ে উঠলাম, নিউজরুমের সবাই আমার দিকে হাঁ করে দেখছে।
আমি উঠে পরলাম। গট গট করে ওর পেছন পেছন নিউজরুমের বাইরে বেরিয়ে এলাম। এই চেম্বারটাও আগে ছিল না নতুন হয়েছে। এই পনেরো দিনে অফিসের হাল-হকিকত একেবারে বদলে গেছে। দোষ আমার। কেননা আমি অফিসে খুব বেশিক্ষণ থাকতাম না। বেশির ভাগটাই বাইরে বাইরে কাটাতাম। তাছাড়া মাথার ওপর ভাববার লোক ছিল। তাই নিজের লেখালিখি নিয়েই থাকতাম।
দোতলায় মালকিনের ঘরের সামনে আসতে দেখলাম বেশ ভিড়। আমাকে দেখে ভিড়টার মধ্যে সামান্য গুঞ্জন। কট কট করে একবার সকলের দিকে তাকালাম।
আসতে পারি, বলে দরজাটা খুলতেই অবাক হয়ে গেলাম, যারা কয়েকদিন আগেও অমিতাভদাকে তেল দিত, তারা এখন ম্যানেজমেন্টের কাছের লোক। ঘর ভর্তি। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
মিত্রা একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে ও একটু অবাক হলো। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিল না। আমার পায়ের নোখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ভালোকরে মাপলো। দেখলাম সুনিতদা ম্যাডামের পাশেই একটা চেয়ারে বসে আছে। আমাকে দেখেই মুখে একটা পরিতৃপ্তির হাসি। ব্যাপারটা এরকম কেমন মজা দেখ।
আসুন। মিত্রা আস্তে করে বললো।
ভেতরে এসে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।
সুনিতদা আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল, ম্যাডাম এই হচ্ছে অনি।
আমি মিত্রার চোখে চোখ রেখেই বুকের সামনে হাত তুললাম।
চম্পকদা বললেন আরে অনিবাবু, ভাইজ্যাক কেমন কাটালে।
রাগে তখন আমার শরীর জ্বলছে। খাড়ুয়ার মতো উত্তর দিলাম।
ভালো।
তোমার আর্টিকেলগুলো কিন্তু এবার খুব একটা জমে নি।
আমি চম্পকদার দিকে একবার তাকালাম। সামান্য হেসে বললাম, চম্পকদা আমি জানতাম আপনি এ্যাডের লোক, সাংবাদ নিয়ে কবে থেকে মাথা ঘামাতে শুরু করলেন।
আমার কথায় ঘরটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না আমি চম্পকদার মতো একজন সিনিয়ার মোস্ট লোককে এইভাবে কথাটা বলবো।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলো। বললো না। হেলান দিয়ে চুপচাপ বসেছিল। আর একদৃষ্টে আমাকে দেখে যাচ্ছিল।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম, হ্যাঁ ম্যাডাম বলুন আমাকে কেন ডেকেছিলেন?
সুনিতদা আমার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো, ওই ব্যাপারটা।
আমি বেশ গম্ভীর হয়ে বললাম, তোমাকে আমার ডিসিশন জানিয়ে দিয়েছি। লেবু কচলালে তেতো হয়ে যায়। নতুন কিছু থাকলে বলতে পারো।
সেটা আমরা মানতে পারছি না।
সুনিতদা, তুমি বর্তমানে এই হাউসের কোন পজিশনে আছ আমি জানি না। তবে বাইরে যাওয়ার আগে আমার যিনি রিসেন্ট বস কাম এডিটর ছিলেন, তাঁকে আমি এই হাউসে যখন ঢুকি, তখন বলেই ঢুকেছিলাম, আমার একটা পা হাউসের বাইরে থাকবে সব সময়। প্রয়োজন পরলে, যে পা-টা ভেতরে আছে, সেটাও বাইরে বার করে নেব।
তুই কি বলতে চাইছিস।
তুমি একজন চিফ রিপোর্টার ছিলে, গোদা বাংলাটাও ঠিক মতো বুঝতে পারছো না। আবার বাংলা কাগজে সর্বোচ্চ পদে কাজ করতে চলেছো।
হেয়ালী রাখ।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। বুকের কাছে হাতজোড় করে বললাম, ম্যাডাম আমি আসছি।
মিত্রা আমার দিকে তাকাল। ওর চোখে অনেক না বলা কথা। কিন্তু বুঝতে পারছি এদের সামনে কিছুতেই বলতে পারছে না।
আমাকে চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বসুন।
সুনিতবাবু আপনারা এখন যান। আমি ওনার সঙ্গে পার্শোনালি কথা বলে নিচ্ছি।
এক ঘর ভর্তি লোক সবাই এই কথায় কেমন যেন অবাক হয়ে গেল। একে অপরের মুখের দিকে তাকাল।
আমি বসলাম।
একে একে সবাই ঘরের বাইরে চলে গেল। মিত্রা বেলবাজাতেই সেই ছেলেটিকে দেখলাম। যে আমায় ডাকতে গিয়েছিল। চোখ দু-টো ভীষন জ্বালা জ্বালা করছে।
কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে। বেল বাজালে একমাত্র তুমি আসবে।
ঠিক আছে ম্যাডাম। ছেলেটি বেড়িয়ে গেল।
আমি মাথা নিচু করে বসেছিলাম। অনেক দিন পর কারুর সঙ্গে এইরকম রাফ ব্যবহার করলাম। নিজেরই খুব খারাপ লাগছিল। এসির হাওয়াটা ভীষণ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। সহ্য হচ্ছিল না।
কিরে আমার সঙ্গে কথা বলবি না?
মাথা নিচু করে বললাম, বলুন।
বাবাঃ, এখনও রাগ পড়েনি।
রাগের কি আছে, চাকরি করতে এসেছি, তা বলে নিজের ব্যক্তিসত্ত্বাকে বিসর্জন দিতে আসি নি।
মিত্রা নিজের চেয়ার ছেরে উঠে এলো। আমিও ওর চোখে চোখ রেখে উঠে দাঁড়ালাম। মিত্রা এসে সটাং আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো।
তুই রাগ করলে আমি যাব কোথায়, আমি এখন বড়ো একা।
মিত্রার গলাটা ভাড়ি হয়ে এলো।
আমি ওর দিকে তাকালাম, ওর চোখ দু-টো ছল ছল করছে।
তুই আমার পাশে থাকবি না?
ওর চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করলাম। না আমার কলেজ লাইফের মিত্রাই। ওর চোখের মধ্যে কোনও দৈত সত্ত্বা নেই। এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
তুই এসব কি করলি!
আমি করিনি। আমাকে দিয়ে করানো হয়েছে। আমাকে ছেড়ে, মিত্রা মাথা নিচু করলো।
তার মানে! ব্যবসা করতে বসেছিস, মালকিন হয়েছিস।
সে অনেক কথা। আর ভালো লাগছে না। তোর সঙ্গে আটমাস আগে দেখা হয়েছিল। সেই যে তোকে ধরে নিয়েগেলাম, তারপর অনেক করে যেতে বলেছিলাম। তুই যাসনি।
চুপ করে থাকলাম।
বোস।
চেয়ারে বসলাম।
আমার থুতনিতে হাত দিয়ে মাথাটা ঘুরিয়ে বললো, বল কেন যাস নি?
আমার চোখ দুটো ভাড়ি হয়ে এসেছিল। নিজেকে সামলে নিলাম।
ও আমার পাশে একটা চেয়ার নিয়ে মুখোমুখি বসলো।
কখন ফিরলি?
ঘণ্টা খেনেক হলো।
বাড়ি গেছিলি?
না।
একটু কফি খা।
না।
ফোনটা বেজে উঠলো, বড়োমার ফোন। ফোন ধরতেই বড়োমার গলায় অভিমানের সুর।
কিরে কখন আসবি, আমরা না খেয়ে বসে আছি।
একটু পড়ে যাচ্ছি।
বড়োমা আমার গলার স্বরে বুঝতে পারলো, কিছু একটা হয়েছে।
তোর কি হয়েছে?
কিছু হয়নি, তুমি এখন রাখো। আমি ঘণ্টা খানেকের মধ্যে চলে যাচ্ছি।
আচ্ছা। বড়োমা ফোনটা রেখে দিল।
মিত্রা আমার দিকে তাকাল।
কার ফোন!
বড়োমা।
মিত্রার চোখে বিস্ময়ের কাজল।
অমিতাভদার স্ত্রী।
মিত্রার মুখটা হঠাৎ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে নিল। কি ভাবলো কে জানে, দুজনেই চুপচাপ বসে আছি। ওর হাত আমার ডান হাতটা ধরে আছে। আমাকে একটা কথা দে?
মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।
কি!
আজ রাতে আমার বাড়ি আসবি। তোকে আজ থাকতে হবে। থাকবি?
বলতে পারছি না।
না তোকে কথা দিতে হবে।
আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে আছি। ওর চোখে বিস্ময়।
বললাম, ঠিক আছে।
তুই আমার গাড়ি নিয়ে যা।
না, তা হয় না।
কেন!
এরা কি ভাববে।
ব্যাবসাটা আমার।
এরা কেউ জানেনা তুই আমার পূর্ব পরিচিত।
জানি। সেই জন্য আমি অনেক ভুল কাজ করে ফেলেছি। আমায় তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তুই আমায় সাহায্য কর। তোর প্রমিসের কথা মাথায় আছে?
আমি মিত্রার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম। কিছুতেই মাথায় কিছু ঢুকছে না। কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছিলাম।
অবাক হয়ে বললাম, কি?
না জেনে তোর ফাইলটাও প্রায় সই করে ফেলেছিলাম।
ভালোই তো।
মিত্রা আমার মাথার চুলটা ধরে ঘেঁটে দিল। অনেক দিন পর আজ আমার বুবুনের সেই রাফ এ্যান্ড টাফ রূপটা দেখতে পেলাম।
ওর দিকে তাকালাম।
মিত্রা হেসে ফেললো। চোখ চক চক করছে।
তাকাস নি। চোখ গেলে দেব। দাঁতে দাঁত চিপলো।
আমি এখন যাব।
রাতের কথা মনে রাখিস।
আমি আফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। নিউজরুমে আর গেলাম না। নীচে এসে আমার ব্যাগটা নিয়ে বড় রাস্তায় এলাম। একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা অমিতাভদার বাড়ি চলে এলাম।
খাওয়া দাওয়ার পর সবাই এক সঙ্গে বড়ো সোফায় বসে কথা বলছিলাম। আমি, বড়োমা, ছোটোমা লম্বা সোফায়। মল্লিকদা, দাদা মুখো মুখি দুটো চেয়ারে। মিত্রার সঙ্গে কি হয়েছে না হয়েছে তার একটি কথাও বলিনি। ওখানকার গল্পই করছিলাম। আর অফিসে এতদিন কি হয়েছে, তার গল্প দাদার কাছে শুনছিলাম।
বাইরে থেকে ছগনলাল চেঁচিয়ে উঠলো মাইজি কৌন আয়া। মল্লিকদা বললো, দাঁড়া আমি যাচ্ছি।
ছোটোমা বললো, তুমি কথা বলো আমি গিয়ে দেখছি।
কিছুক্ষণ পর ছোটোমা ফিরে এলো, হাতে একটা চিঠি। মুখটা কেমন শুকনো শুকনো।
আমি হেসে বললাম কি হলো আবার।
আমার হাতে চিঠি দিয়ে বললো, তোর চিঠি।
খামটা হাতে নিলাম। সকলে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কেমন যেন ভয় ভয়।
আমি চিঠিটা খুললাম।
মিত্রার চিঠি।
গাড়ি পাঠালাম, চলে আয়। অমিতাভদা, মল্লিকদা, বড়োমা, ছোটোমাকে আমার প্রণাম দিস। দেরি করিসনা। মিত্রা।
চিঠিটা পড়ে সকলের মুখের দিকে তাকালাম। সবাই উৎসুক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বড়োমার হাতে চিঠিটা দিলাম। বড়োমা পড়ে ছোটোমাকে দিল, ছোটোমা অমিতাভদার হাতে, অমিতাভদা চিঠিটা পড়ার পর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।
মল্লিকদা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, চোখে মুখে দুষ্টুমি। ছোটোমার দিকে তাকিয়ে বললো, কেশটা বেশ জটিল।
বড়োমা খেঁকিয়ে উঠলো। আর বকিস না। কাগজের এডিটর হয়েছে। দুই মক্কেল বসে বসে বিরাট কাজ করেছেন। সবাই মিলে তোদের তাড়িয়ে দিলে, আর তোরা বসে বসে খাবি খাচ্ছিস।
না না তুমি শোন। অমিতাভদা বলে উঠলো।
আর শুনে কাজ নেই অনেক হয়েছে। বড়োমা বললো।
বুঝলাম এখন যুদ্ধ চলবে। আমি উঠে বাথরুমে গেলাম। বেরিয়ে এসে বড়োমাকে বললাম, আমাকে একটা পাজামা, পাঞ্জাবী বার করে দাও।
পাজামা, পাঞ্জাবী পরতে হবে না, প্যান্ট-গেঞ্জি পরে যা। ছোটোমা বললো।
এই যথেষ্ট।
ছোটোমা বুঝলো একে বলে কিছু হবে না, বাধ্য হয়ে ঘর থেকে একটা পাজামা-পাঞ্জাবী বার করে আনল। আজ আমায় কেউ বাধা দিল না। কেউ কোনও প্রশ্ন করল না। আজ সবাই জানলো মিত্রা শুধু আমার পরিচিতই নয় খুব ঘনিষ্ঠ।
আমি আমার ঘর থেকে রেডি হয়ে বাইরে এলাম।
ওরা সবাই সোফায় বসে গল্প করছিল। আমি বড়োমাকে প্রণাম করলাম। তারপর ছোটোমাকে। তারপর অমিতাভদাকে। অমিতাভদা আমার মাথায় হাত রেখে বুকে জড়িয়ে ধরলো। চোখদুটো ছলছল করছে, মুখে করুণ আর্তি।
তোর ওপর আজ সব কিছু নির্ভর করছে।
আমি মাথা নিচু করলাম।
তুমি একথা বলছো কেন! সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি আমার সঙ্গে যাবে?
না।
কেন?
তুই যা, তুই যা ডিসিশন নিবি তাই হবে।
মল্লিকদাকে প্রণাম করতে যেতেই বললো, থাক থাক আমার চেয়ারের একটা বন্দোবস্ত কর। না হলে বেকার হয়ে যাব। এই বুড়ো বয়সে আর ভালো লাগছে না।
কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, মল্লিকদা আমার মুখটা চেপে ধরলো। আজ নয়, সুখবর এনে বলিস।
মিত্রার বাড়িতে এসে যখন পৌঁছলাম তখন রাত আটটা বেজে গেছে। গাড়ি একেবারে পর্টিকোর ভেতরে এসে দাঁড়াল। আমি গাড়ি থেকে নামতেই একজন ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন। চেনাচেনা মনে হলো। মিত্রার ওই বাড়িতে দেখেছি মনে হচ্ছে। বুড়ীমাসি?
আমাকে বললেন, মেমসাহেব ওপরের ঘরে আছেন, আপনাকে চলে যেতে বলেছেন।
আমি আটমাস আগে এই বাড়িতে এসেছিলাম। আজ আবার আটমাস পরে এলাম।
অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সব কিছু লক্ষ্য করলাম। ওপরে উঠে এলাম। মিত্রা সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ওকে দেখে থমকে দাঁড়ালাম।
মিত্রা একটা বাসন্তী কালারের সালোয়ার কামিজ পরেছে। দারুন লাগছে দেখতে, কলেজ লাইফের মিত্রা আর আমার বস মিত্রার মধ্যে অনেক পার্থক্য। তবু কোথায় যেন এক থেকে গেছে মিত্রা।
আয়।
আমি ওপরে উঠে এলাম। ওর পেছন পেছন গেলাম। একটা ঘরে আমাকে নিয়ে ঢুকলো। দেখলাম তিনজন ওখানে বসে আছেন। এদের মধ্যে মাত্র একজনকেই চিনতে পারলাম। আমাদের অফিসের এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার মিঃ সনাতন ঘরুই।
উনি আমাকে দেখে একটু অবাক হলেন। মুখে কিছু বললেন না। মিত্রা সকলের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল।
মিঃ ঘরুই বললেন, আমি ওনাকে চিনি, তবে বেশি কথা হয়নি কোনও দিন। তবে উনি যে আপনার এতোটা ক্লোজ জানতাম না।
মিত্রা বেশ গম্ভীর গলায় বললো, এর বেশি আর জানার চেষ্টা করবেন না।
মিত্রা বললো, বুবুন (আমার ডাক নাম, এই পৃথিবীতে এই নামে একমাত্র মিত্রাই ডাকে সেই কলেজ লাইফ থেকে, আর আমার মা ডাকতেন) ইনি মিঃ অরিন্দম চ্যাটার্জী, আর উনি মিঃ কিংশুক ব্যানার্জী।
সকলেই মিত্রার মুখে আমার নামটা শুনে একটু অবাক চোখে তাকাল। বিশেষ করে সনাতনবাবু। ওনার চোখ মুখ দেখে বুঝে ফেললাম উনি কিছু গেইজ করার চেষ্টা করছেন।
আমি বুকের ওপর হাত তুলে নমস্কার করলাম।
ওরাও প্রীতি নমস্কার জানালো।
আমি আজ এনাদের এ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলাম। তোকে সব বলছি, তুই সব শুনে নে, তারপর একটা ডিসিশন দে। তোর ডিসিশন আমার অনেক কাজে লাগবে।
সবাই আমার আর মিত্রার দিকে তাকাল।
মিত্রা একে একে অফিসের সমস্ত ঘটনা আমাকে বললো। আমি এতটা জানতাম না। কিছু কিছু জানতাম।
সব শোনার পর বুঝলাম, ও অনেককেই তারাবার বন্দোবস্ত করেছে। এমনকি তাদের চিঠিও সই সাবুদ হয়ে গেছে। বিশেষ করে যাদের সঙ্গে আজ দুপুর বেলায় আমার কথা কাটাকাটি হয়েছে তাদেরকেও। অমিতাভদা, মল্লিকদা যে জায়গায় ছিল সেই জায়গাতেই আছেন। মনে হচ্ছে আমার সঙ্গে কথা বলার পর তুরন্ত ডিসিশন চেঞ্জ করেছে।
আমি সব শুনে বললাম, এটা তুই নিজে থেকে ডিসিশন নিয়েছিস, না অন্য কারুর মতামত নিয়ে করেছিস?
মিত্রা বললো, অন্যের মতামত নিয়ে এতদিন কাজ করেছিলাম, এখন আমি আমার ডিসিশনে চলছি।
আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম, তুই যা আগে করে ফেলেছিলি, এখন সেইরকম রাখ।
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকাল!
চেঞ্জ করিস না।
কেন বলছিস বল?
অনেক সমস্যা তৈরি হবে।
মিত্রার চোখে মুখে হাসির রেখা। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
বরং দুটো নতুন পদ ক্রিয়েট কর।
বল।
অমিতাভদার জায়গায় তুই সম্পাদক হয়ে যা।
আমি!
হ্যাঁ।
তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকাল।
খাতা কলমে।
অমিতাভদাকে প্রধান সম্পাদক কর, মল্লিকদাকে মুখ্য সম্পাদক বানিয়ে দে। আর বাকি সবাইকে যুগ্ম সম্পাদক বানিয়ে দে। তোর নামটা চেঞ্জ করে নে সম্পাদকের জায়গায়।
যাঃ তা হয় না।
না হবার কি আছে, তুই মালিক।
এই কাগজের একটা ঐতিহ্য আছে।
ওই কথাটা মাথায় রেখেই তোকে বলছি।
সম্ভব নয়।
এটা যদি করতে পারিস, তাহলে আর কারুর কিছু বলার থাকবে না। তবে তোর খরচ বারবে, দুটো নতুন ঘর তোকে বানাতে হবে।
সেটা এমন কোনও ব্যাপার নয়।
ঘরুইবাবুকে বলে দে কাল থেকে কাজ শুরু করে দিক।
ঘর কার কার জন্য।
সুনিতদা এখন যে ঘরে আছে সেই ঘরেই থাকুক।
একটা অমিতাভদার জন্য আর একটা মল্লিকদার জন্য। তবে ঘর দুটো তোকে নিউজ রুমের মধ্যে করতে হবে। আলাদা জায়গায় করলে হবে না।
কেন!
নিউজের ছেলেগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন কথা না বললে ওদের ভাত হজম হবে না। ওরা নিউজ খায়, নিউজ দিয়ে স্নান করে, ওদের জগৎটা সব কিছুই নিউজ ময়।
সবাই আমার কথায় হাসলো।
ঘরুইবাবু আমার কথা শুনে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, অনি ঠিক কথা বলেছে ম্যাডাম।
তাহলে আপনি এতদিন কি করছিলেন?
ওদের যা চাপ, তারপর সবাই আপনাকে ঘিরে থাকে সব সময়। বলবো কখন।
আমি ঘরুইবাবুর দিকে তাকালাম, মনে মনে বললাম, ঘরুই তুমি বহুত ঘোরেল মাল।
দিল্লী ব্যুরোকে জানিয়ে দে, তোর নামটা কাল পর্শুর মধ্যে চেঞ্জ করে পাঠিয়ে দিতে, কি ঘরুইবাবু হবে না?
নিশ্চই হবে।
আর এই কয়দিন যেমন চলছে তেমন চলুক। এরমধ্যে ঘরুইবাবু সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলুক।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
তুই কয়েকদিন অফিসে যাস না। মাথায় রাখিস, যে ঝড়টা উঠেছে সহজে থামবে না।
ঠিক আছে।
নিউজরুমের বুড়ো গুলোকে সামলাবার দায়িত্ব আমি নেব, ওটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।
আবার সবাই হাসলো।
আপনি ভালো কথা বলেছেন। যত সমস্যা ওই এডিটর পদটাকে নিয়ে। অরিন্দমবাবু বললেন।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল।
আমি ঘরুইবাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম, ঘরুইবাবু অফিসে আপনার সঙ্গে আমার বিশেষ একটা কথা হয় না। কিন্তু আপনি আমার সম্বন্ধে অনেক খোঁজ খবর রাখেন।
ঘরুইবাবু আমার মুখের দিকে বিষ্ময় চোখে তাকালেন।
আপনার স্বভাব চরিত্র সম্বন্ধে মিত্রা যতটা না জানে, তার থেকে আমি অনেক বেশি জানি। শুধু এইটুকু ব্যাপার আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম।
ঘরুইবাবুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। উনি ভাবতে পারেন নি এই ঘরে মিত্রার সামনে ওনাকে আমি এই ধরনের কথা বলতে পারি।
এ আপনি কি বলছেন অনিবাবু!
আপনি নিশ্চই জানেন, আমি কতোদূর দৌড়তে পারি।
হ্যাঁ হ্যাঁ তা কি বলতে।
দুপুরে একঘর ভর্তি লোকের সামনে আমি মিত্রাকে কি বলেছিলাম সেটা নিশ্চই শুনেছিলেন। ওটা এমনি এমনি বলা যায় না। কলজের দম থাকতে হয়।
ঘরুইবাবু আমার মুখের দিকে ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে আছেন।
ওনাদের আমি চিনি না, (সামনে বসা দুজন নতুন ব্যক্তিকে দেখিয়ে) তাই এই মুহূর্তে কিছু বলছি না। (হাতজোড় করে) তবে আপনাদেরও জানাই মিত্রা আমার কলজের বন্ধু, শুধু বন্ধু নয় বিয়ের আগে ওদের বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। ওর বাবা-মা সকলেই আমার বিশেষ পরিচিত। এর বেশি কিছু বলতে চাই না। মিত্রার কোনও ক্ষতি হবে এটা আমি মেনে নেব না। ও আপনাদের যে দায়িত্ব দিচ্ছে। তা ঠিক ঠিক ভাবে পালন করবেন। আর এই মুহূর্তে যা বললাম তা যেন পাঁচকান না হয়।
মিত্রা চুপচাপ বসেছিল। ওরা আমার কথা শোনার পর কেউ আর কোনও কথা বললো না।
মিত্রা যখন আপনাদের এখানে ডেকে এনেছেন, সঙ্গে আমাকে, তখন আমি বুঝে নেব আপনারা ব্যবসায়িক দিক থেকে মিত্রার খুব কাছের লোকই হবেন।
সকলেই আমার মুখের দিকে তাকাল।
মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললাম, ওনাদের পার্পাশটা আমাকে একটু বলবি?
চম্পকবাবুকে আমি রাখব না ভেবেছিলাম।
কেন?
ওনার চালচলন আমার ভালো লাগছে না। ওনার জায়গায় অরিন্দমবাবুকে নিয়ে এলাম।
এ ভুলটা করিস না। চম্পকদা থাকুক। চম্পকদার ওপরে ওনাকে বসা।
অরিন্দমবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার একটু অসুবিধে হবে কাজ করতে।
কি কারনে বলছেন?
সাবতাজ হতে পারে।
আপনি যখন এতটাই জানেন, তখন এই টুকু নিশ্চই বুঝতে পারছেন। কেন বলছি।
অরিন্দমবাবু চুপচাপ।
অরিন্দমবাবু আপনি আগে কোথায় ছিলেন?
একটা সর্বভারতীয় ইংরাজী দৈনিকের কথা বললেন।
মিত্রার সঙ্গে আপনার পরিচয়?
মিত্রা বললো, আমার ক্লাবের মিঃ রায় ওনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ছেন।
আপনাদের ওখানে মৈনাক আছে না।
অরিন্দমবাবুর মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
মিত্রা বললো, কে মৈনাক?
আমাদের সঙ্গে ইংরাজী ডিপার্টমেন্টে পড়তো।
ফর্সামতো ছেলেটা। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা।
হ্যাঁ।
তোর সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে!
ভাইজ্যাক যাওয়ার দু-চারদিন আগে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
অরিন্দমবাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম, চম্পকদাকে এখন সরানো যাবে না। আপনি নিজে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবুন।
অরিন্দমবাবু চুপচাপ বসে রইলেন।
মিত্রার দিকে তকিয়ে বললাম, কিংশুকবাবু।
ওনাকে আমি ম্যানেজমেন্ট দেখার জন্য অনুরোধ করেছি।
ভালো।
তবে তুই একটা কাজ কর, দায়িত্বটা সকলকে ভাগা ভাগি করে দে।
তোর মতামতটা বল।
আজ হবে না। দাদা কি এখানে আছেন?
সবাই আমার মুখের দিকে তাকাল।
না। মুম্বাই গেছে।
কবে আসবেন?
দু-একদিন দেরি হবে।
দাদাকে আসতে দে। দাদার সঙ্গে একবার আলোচনা করার দরকার আছে।
ঠিক আছে।
মিত্রা ওদের দিকে তাকিয়ে বললো যে ভাবে বুবুন বললো, ওই ভাবে কাল থেকে কাজ শুরু করে দিন। কিংশুকবাবু আর অরিন্দমবাবুর দিকে তাকিয়ে বললো, আপনাদের ঘরটা রেডি হোক তারপর অফিসে আসবেন। আপনারা আপনাদের মতো কাজ শুরু করে দিন। ঘরুইবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, যা যা ডিসিশন হলো সেই মতো কাজ শুরু করুণ। আগামী সপ্তাহের মধ্যে কাজ শেষ করে ফেলার চেষ্টা করুণ।
ঘরুইবাবু একটু আমতা আমতা করে বললেন, আর কয়েকটা দিন আমাকে সময় দিন।
ঠিক আছে তাই হোক।
সুনিতবাবু যদি কিছু বলেন?
সুনিতবাবু কিছু বললে পাত্তা দেবার দরকার নেই। বাকিটা কি করে কি করতে হয়, আপনাক নিশ্চই বুঝিয়ে বলার দরকার নেই?
ঘরুইবাবু মাথা নিচু করে বললেন, না ম্যাডাম আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব।
সবাই বিদায় নিল।
মিত্রা ওদের নিচে ছেড়ে দিয়ে এসে বললো, কি খাবি?
বেলা করে বড়োমা অনেক খাইয়েছে, আর খেতে ভালোলাগছে না।
তাহলে আমিও খাব না।
সেকিরে! ঠিক আছে খাব, অল্প করে।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
দুজনে নিচে এলাম। বুড়ীমাসিকে দেখতে পেলাম না। বরং আর একটি মেয়েকে দেখলাম। ডাইনিং টেবিলে সব সাজান। মিত্রা আমি দুজনে বসলাম। খেতেখেতে কলেজ লাইফের ছেঁড়াছেঁড়া কিছু কথা ছাড়া শুধু জিজ্ঞাসা করলাম মাসিমা-মেসোমশাই কেমন আছেন।
মিত্রা একটু গম্ভীর হয়ে গেল, আস্তে করে বললো, দু-জনেই গত। তারপর থেকে সব হরির লুটের মতো চলছে।
একটু থেমে অভিমানভরা কণ্ঠে বলে উঠলো, তুই তো আমার কোনও খোঁজ খবর রাখিস না। তোকে বলেই বা আর কি হবে।
আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। কোনও কথা বললাম না। মিত্রা মিত্রার মতো কিছুক্ষণ বকে গেল। খাওয়া শেষ করে দুজনেই ওপরে উঠে এলাম।
মিত্রাদের বাড়িটা বিরাট জায়গা নিয়ে। সামনে বিশাল বাগান। গেটের ঠিক মুখে এই বাড়ির কাজের লোকেদের থাকার জায়গা। এই মুহূর্তে তাদের ঘরের লাইট নিভে গেছে। বাগানের রাস্তাটায় তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি বারান্দার রেলিংয়ে কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে একটু ঝুঁকে দাঁড়ালাম।
কলকাতা শহরের মতো জায়গায় এই রাতেও ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ভারি ভালোলাগছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। বাগান পেরিয়ে বড় রাস্তা। নিওন আলোয় চকচক করছে রাস্তাটা। কিছুক্ষণ আগে একজন কাজের মেয়ে এসে আমার ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে গেছে। বিছানাপত্র সব ঠিক ঠাক করে দিয়ে গেছে।
ঘুম আসছে না। সকাল থেকে ভীষণ ধকল গেল। মিত্রা মাঝে একবার নিজে থেকে অমিতাভদাকে ফোন করে সব জানিয়েছে। অমিতাভদা রাজি হয়েছে। বড়োমার সঙ্গে আমার ফোনে সামান্য কথা হয়েছে। বলেছি কাল গিয়ে সব বলবো।
হঠাৎ নরম হাতের স্পর্শে চমকে পেছন ফিরে তাকালাম, মিত্রা কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে জানি না। ওকে এই মুহূর্তে রাত পরির মতো লাগছে। পরনে ফিন ফিনে একটা সাদা নাইট গাউন। ভেতর থেকে অন্তর্বাস পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম।
কিরে আমার দিকে তাকাতে লজ্জা করছে।
কিছু বললাম না। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
আমি সামনের আধা-অন্ধকার বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মিত্রা আমাকে পেছন থেকে সাপের মতো আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। বুঝতে পারছি ওর নরম ঠোঁট আমার পিঠে আঁকি বুকি কাটছে। ওর ঘন নিঃশ্বাস আমার পিঠ ময় ছড়িয়ে পড়ছে।
সামনের গাছটা জুঁই ফুলের গাছ। সাদা থোকা থোকা ফুল ফুটে আছে। চারিদিকে তার গন্ধে ম ম করছে। ওর সুডৌল বুকের স্পর্শ আমার শরীরে কাঁপন ধরাল, ঠোঁটটা আমার পিঠে ঘষতে ঘষতে বললো।
কথা বলবি না—
আমি সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। মিত্রার নিবিড় হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে মুখ মুখি হলাম। একটা সুন্দর পারফিউমের গন্ধ নাকে এসে লাগল। গন্ধটায় নেশা হয়। এই আলো আঁধারি ছায়া ঘেরা বারান্দায় ওর চোখে চোখ রাখলাম। মিত্রা সাজেনি। না সাজলে ওকে সত্যি খুব সুন্দর লাগে। প্লাক করা ভ্রু। টানা টানা দীঘল চোখ। পান পাতার মতো ওর মুখমণ্ডল। অনেক দিন পর মিত্রাকে এত কাছ থেকে দেখছি। আমি ওর প্রসারিত দু-কাঁধে হাত রাখলাম। ও আমার কোমরে হাত রাখলো।
অনেকক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চোখের পলক পড়ছে না। মিত্রাও আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। পারফিউমের গন্ধের আড়ালে ওর শরীরের পরিচিত গন্ধটা আমাকে ধীরে ধীরে মাতাল করে তুলছে।
একদিন মিত্রা আমার ছিল। আজ ও অন্য কারুর। কথাটা মনে পড়তেই, বুকের ভেতরটা কেমন চিন চিন করে উঠলো। অনি এ তুই কি করছিস?
যা ঘরে যা, কেউ দেখে ফেললে, কি ভাববে।
কে দেখবে! ধারে কাছে কেউ নেই। আমি এখানে একা।
আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম! কথাটা কানের মধ্যে দিয়ে ঠিক অন্তরে প্রবেশ করলো না। ঠোঁট দুটো নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠল। মিত্রা একা থাকে!
চল ঘরে যাই।
মিত্রা আমার বাম হাতটা চেপে ধরলো। পায়ে পায়ে ওর শোবার ঘরে এলাম।
আমার নির্দিষ্ট করা ঘরের থেকে দুটো ঘর পরে। হাল্কা আলোয় ওর ঘরটা স্বপ্নপুরীর মতো লাগছে।
একদিকে বিশাল সোফা। সেন্টার টেবিল। আর একদিকে ওর শোবার পালঙ্ক। সমস্ত আসবাব পত্রের মধ্যে একটা রুচির ছাপ। কয়েকটা মনে হচ্ছে মিত্রার শ্যামবাজারের পুরনো বাড়িতেও দেখেছি। সেই পুরনো আসবাবপত্র পালিশ করে নতুন রূপ পেয়েছে। বিশেষ করে সোফার কাছে কাঠের মিনিয়েচার করা সেন্টার টেবিলটা।
বোস, ড্রিংক করিস?
না।
তুই ভালো ছেলে। আমি খারাপ মেয়ে।
আমি ওকে লক্ষ্য করছিলাম, ও ওয়ার্ডোবের সামনে গিয়ে ওয়ার্ডোবটা খুললো।
আমার চোখ চলেগেল। বিদেশী মদের বোতলে ঠাসা। সঙ্গে সব উপকরণ।
তুই তো কোনও দিন এসব খেতিস না!
খেতাম না। এখন খাই।
কেন?
স্ট্যাটস শিম্বল।
না খেলে কি স্ট্যাটাস মেইনটেইন করা যায় না?
তুই এখনও সেই এঁদো গলিতেই রয়ে গেলি।
মনে মনে বললাম, ঠিক। মুখে কিছু বললাম না।
মিত্রা আমার দিকে তাকাল। চোখে শ্লেষের হাসি।
আজ আমার সঙ্গে একটু শেয়ার কর।
না।
কেন?
তুই প্রত্যেক দিন খাস?
যার স্বামী মাসের পর মাস বাড়ির বাইরে থাকে। তাকে কিছু একটা নিয়ে বাঁচতে হয় বুঝলি বুবুন।
সে তো কাজের জন্য বাইরে আছে। অতো বড় একজন ডাক্তার….।
মিত্রা আমার দিকে ফিরে তাকাল। ওর চোখ দুটো গনগনে আগুনের কয়লার টুকরোর মতো। ঠোঁটের গোড়ায় সেই শ্লেষের হাসি।
ঝটতি আমার চোখে চোখ রেখে সরিয়ে নিল।
পুরুষরা ভীষণ স্বার্থপর।
একটু থামলো।
তুইও।
আমিও!
মিত্রা আমার দিকে তাকাল। মাথাটা নিচু করলো।
ওয়ার্ডোব থেকে একটা স্কচের বোতল বার করলো। দুটো গ্লাস একটা সোডার বোতল নিয়ে এলো। আর একটা কাজুর প্যাকেট। সেন্টার টেবিলে রেখে আমার পাশে এসে বসলো।
মিত্রা নিজেই পরিপাটি করে সব সাজিয়ে নিল।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো, একটু নে।
না।
তাহলে আমি একা একা খাই।
আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে আছি।
মিত্রা ঠোঁটে গ্লাস ছোঁয়াল।
সত্যি তুই খাবি!
নিমেষের মধ্যে গ্লাসটা শূন্য করে টেবিলে রাখলো।
বুঝলি বুবুন, না খেলে ঠিক থাকি না।
কি বলছিস!
হ্যাঁরে, ঠিক বলছি।
তোর হাজবেণ্ড জানে?
মিত্রা আবার একটা গ্লাস নিঃশেষ করলো।
আমি ওকে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি।
ওর কাছ থেকেই এ সবের দীক্ষা নিয়েছি। পতি পরম গুরু।
শেষের শব্দগুলো তীব্র শ্লেষে পরিপূর্ণ।
আমি ওর দিকে অবাক চোখে তাকালাম। ওর চোখ মুখটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে।
তোকে সব বলবো। সঅঅঅব।
মিত্রা টেবিল থেকে বোতলটা নিয়ে গ্লাসে ঢাললো। তারপর বোতলটা আবার টেবিলে রাখলো। চোখের কোনা দিয়ে আমাকে একবার দেখে নিল। আমি স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। আমার দেখা কলেজ লাইফের মিত্রার সঙ্গে এই মুহূর্তের দেখা মিত্রার কোনও মিল খুঁজে পাচ্ছি না।
মিত্রা ঠোঁট থেকে শূন্য গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখলো।
তুই আমার জীবনে প্রথম পুরুষ। প্রথম ভালোবেসেছিলাম তোকে।
মিত্রার চোখে চোখ রাখলাম।
আমার শরীরের স্পর্শ তোকে প্রথম দিয়েছিলাম। সেই দিনটার কথা তোর মনে আছে?
মিত্রা কি আমার সঙ্গে অভিনয় করছে? তাহলে পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে যাচ্ছে কেন? আমাকে দিয়ে কোনও কাজ বাগাবার ধান্দা। নিশ্চই আমার সমস্ত খোঁজ খবর ও রাখে। কাজের কাজ হয়ে গেল তারপর আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
মিত্রা আবার বোতলটায় হাত দিতে গেল আমি বোতলটার দিকে তাকালাম।
আচ্ছা বাবা এখন খাবো না, সাজিয়ে রাখি, একটু পরে খাব। রাগ করিস কেন।
মিত্রা আবার নিজের মতো করে গ্লাসে ঢালতে শুরু করেছে।
আচ্ছা তাই যদি হয়, আজ দুপুরে আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর মিত্রা সব ডিসিশন চেঞ্জ করল কেন? ধ্যুস, আমার কাছে পাস্ট ইজ পাস্ট? আমি পেছন ফিরে তাকাই না। তবে মাঝে মাঝে নিজের আয়নায় নিজেকে দেখার চেষ্টা করি।
পূর্ণ গ্লাসটা টেবিলে রেখে, মিত্রা সরাসরি আমার দিকে তাকাল।
তোর সেই ব্যামোটা এখনও যায়নি দেখছি।
কি?
কিছু বললেই উদাস চোখে ভাবিস।
হ্যাঁ।
কি হ্যাঁ!
তুই যা বললি।
কোথায় বল তো তোর শরীরটা প্রথম ছুঁয়ে ছিলাম?
বীনা সিনেমা।
তুই এখনও মনে রেখেছিস!
হ্যাঁ।
আমাকে দেখে তোর ঘেন্না হয় না?
কেন!
একটা মেয়ে তোকে না জানিয়ে….।
আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল।
তুই চুপ করবি। একটু জোরে বলে ফেললাম।
চলবে —————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/D05um7L
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment