কাজলদিঘী (৪০ নং কিস্তি)

“কাজলদীঘি”

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

৪০ নং কিস্তি
—————————

আজকের দলটা অনেক ভাড়ি জমজমাট।

সবাই দেখলাম বেশ পরিষ্কার জমাকাপর পরেছে। বাইক এবং ট্রলির মেলা। অনাদি, বাসু পুরো পরিবার সমেত এসেছে। সঞ্জু বাইক নিয়ে এসেছে। ইসলামভাইও বললো আমি বাইক নিয়ে যাব। আমি আপত্তি করলাম না। আমি অনাদিকে বললাম তুই পাঁচু, পচা ওদের সবাইকে নিয়ে আয়। আমি, বাসু, চিকনা আগে যাচ্ছি।

বড়োমা প্রথমে একটু আপত্তি করেছিল। দেবাও বললো তুই আমাদের সঙ্গে চল না। আমি বললাম, তোরা আয়, আমি হয়তো তোদের পৌঁছবার আগেই চলে আসবো।

মিলি, টিনা, অদিতি তিনজনেই আজ শাড়ি পরেছে। ওদের শাড়ি পরা আবস্থায় আগে দেখিনি। বেশ লাগছিল। তারিয়ে তারিয়ে দেখছিলাম। মিলি কাছে এসে বললো অনিদা চোখ খারাপ হয়ে যাবে এইভাবে দেখলে।

আমি বেরিয়ে এলাম চিকনা আর বাসুকে নিয়ে।

মোরাম রাস্তায় আসতে বাসু বললো, তুই কোথায় যাবি বল।

একটু দাঁড়া। আমি কয়েকটা ফোন করে নিই। একটা সিগারেট দে।

বাসু পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা দিল, আমি একটা বার করে ধরিয়ে ওকে ফিরিয়ে দিলাম। ওদের থেকে একটু দূরে চলে গেলাম। প্রথমে অর্কর সঙ্গে ফোন কথা বললাম, তারপর হিমাংশুকে এখানকার কথা বলে শনিবার সকালের দিকে আসতে বললাম। ও রাজি হলো। আরও কয়েকটা ফোন করলাম।

কাজ শেষ করে আমি ওদের কাছে ফিরে এলাম।

কিরে কার ওপর রাগারাগি করলি?

না। একটা কাজের দায়িত্ব দিলাম একজনকে।

এবার বল কোথায় যাবি?

উনা মাস্টারের বাড়ি।

উনা মাস্টারের বাড়ি!

হ্যাঁ। তোদের যেতে অসুবিধা আছে?

এই সময় উনা মাস্টারের বাড়ি!

একটু দরকার আছে।

তোকে বোঝা মুস্কিল। বাসু হাসলো।

আমিও হাসলাম।

আমি বাসুর পেছনে বসলাম।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম স্যারের বাড়ি।

দেখলাম স্যার বাড়ির বারান্দায় বসে কাগজ পড়ছেন। আমরা বাইক রেখে ভেতরে এলাম। স্যারকে প্রণাম করলাম। স্যার মুখের কাছ থেকে কাগজ সরিয়ে বললেন, কে?

স্যার আমি অনি।

সঙ্গে সঙ্গে স্যার চেঁচামিচি শুরু করে দিলেন। ও বড়বৌ দেখো কে এসেছে। ধুমকেতু দেখবে এসো।

আমি হেসে ফেললাম।

ওরা কারা।

চিকনা আর বাসু।

তুই তো আবার একলা আসতে পারবি না। তোর সাগরেদ দরকার।

চিকনা স্যারের কথায় মাথা চুলকচ্ছে।

বাসু মুখ নীচু করে আছে। ওরা স্যারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো।

কাকীমা, মিনতি বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। আমি কাকীমাকে প্রণাম করলাম। মিনতি আমাকে প্রণাম করলো।

বোস।

না এখন বসবো না।

তাহলে এলি কেন? স্যার বললেন।

মিনতিকে নিতে এলাম। দাদারা সব শিবের মন্দিরে আসছেন। ওকে একটু নিয়ে যাই। ঘণ্টা দুয়েক পর সবাই আসবো।

তারমানে!

হ্যাঁ সবাই আসবো।

তুই কি বলছিস বুঝতে পারছি না!

কলকাতা থেকে আমার কয়েকজন বন্ধুও এসেছে, ওরাও আসবে, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

কেন?

ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।

ওরাও কি তোর মতো সাংবাদিক?

না স্যার, ওরা সব বড় বড় কোম্পানির চিফ। বাসু বললো।

তোর কথা আমার মাথায় ঢুকছেনা।

ঠিক আছে আমি এখন মিনতিকে নিয়ে যাচ্ছি। শিবের মন্দির ঘুরে সকলে মিলে আসছি। বড়োমারা হয়তো এতক্ষণে এসেও পড়েছে।

কিগো বড়বৌ মিনু যাবে?

কেন যাবে না, অনি বড় মুখ করে ওকে নিতে এসেছে।

মিনতির দিকে তাকিয়ে বললাম, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।

মিনতি ছুটে ঘরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হ্যাঁরে অনি।

স্যার।

তোর বাড়িতে নাকি সামন্ত ডাক্তার এসেছে।

এখানেও আসবে।

আমার বাড়িতে!

হ্যাঁ। ওনারা সবাই এসেছেন।

মনা?

কাকাও এসেছেন।

বড়বৌ শুনলে অনির কথা।

শুনছি।

অতিথিরা আসছেন।

আমি কি করবো।

কিছু ব্যবস্থা করো।

কি করবো। সব মান্যি গণ্যি ব্যক্তিরা আসছেন তাদের জন্য খাবার কিছু রেখেছো।

ঋজুকে একটা ফোন করে দাও। বাজার থেকে মিষ্টি কিনে আনুক।

স্যার আমি একটা কথা বলবো।

বল শুনি। তোর গেস্ট। আমারও গেস্ট।

ঢেঁকি ছাঁটা চিড়ে শুকনো লঙ্কা দিয়ে সামান্য তেল দিয়ে ভেজে দিন, তার সঙ্গে ছোলা ভাজা, বাদাম ভাজা আর চা।

গর্ধভ কোথাকার। এখনও তোর সেই মোটা বুদ্ধি গেল না।

আমি মাথা নীচু করলাম।

আমি বলছি স্যার ওরা খুব আনন্দ করে খাবে, দেখবেন।

আবার কথা বলে। কতদিন বেতের বাড়ি খাসনি। মান্যিগণ্যি অতিথিদের আমি চিঁড়েভাজা, শুকনো লঙ্কা ভাজা খাওয়াব। এ কি মনা আসছে।

তাহলে আপনার যা মন চায় তাই করুণ, আমি বলছি খাবার কিন্তু নষ্ট হবে।

তুই যা, তোকে পাকামো করতে হবেনা।

বড়বৌ।

বলো।

তুমি ঋজুকে ফোন করে আমাকে একটু দাও।

মিনতি কাপর পরে বেরিয়ে এলো। বেশ মিষ্টি লাগছে। ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক লাগিয়েছে। কপালে ছোট্ট একটা বিন্দির টিপ।

রেডি।

হ্যাঁ অনিদা।

স্যার আমি আসছি।

কখন আসবি।

মন্দিরটা ঘুরেই আপনার বাড়ি।

ওদেরকে তুই হাঁটিয়ে আনছিস নাকি?

না। অনাদি ট্রলি ঠিক করেছে।

তোর বড়োমার কোমড় ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ।

আমরা বেরিয়ে এলাম।

খামার পেরিয়ে গাড়ির কাছে এলাম। মিনতি আমার পেছনে। চিকনা একটু দূরে এসে আমাকে ঢিপ করে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলো।

কি হলো?

গুরু তুমি কতোবরো খেলোয়াড়!

কেন?

সকালে সঞ্জু আমাকে বলেছিল বলে তুমি মিনতিকে তুলে আনলে।

না না, সবাই আমরা আনন্দ করবো, সঞ্জুর মনটা খারাপ হয়ে যাবে, তাই।

শালা, আমার কেন কেউ নেই বাসু।

চিকনাদা আমি নীপাকে বলে দেব। মিনতি বললো।

তুই তো বহুত নম্বরি হয়েছিস। তোর জন্য এতো কষ্ট করলাম, আর তুই নীপাকে বলে দিবি। আজ সঞ্জুকে আমি খাব।

মিনতি তুই চিকনার পেছনে বোস, আমি বাসুর পেছনে বসে পড়ি। আমি বললাম।

মিনতি চিকনার পেছনে গিয়ে বসলো। আমরা মিনিট পাঁচেকের মধ্যে চলে এলাম।

সঞ্জু দূর থেকে দেখতে পেয়েছে। এগিয়ে এসেছে। মিত্রারাও দেখেছে। সবে মাত্র বিকেল হয়েছে।  মন্দিরের সামনে বিশাল একটা দীঘি। দীঘির জলে কমলা রংয়ের সূর্যের আলো পড়ে চারিদিকে ঠিকরে পড়ছে।

আমরা এসে ওদের সামনে দাঁড়ালাম।

সঞ্জু গম্ভীর। চিকনা চক চকে। মুখে হাসি আর ধরছেনা। নীপা ছুটে এলো।

কিরে তুই!

অনিদা নিয়ে এলো।

নীপা, মিনতিকে জড়িয়ে ধরলো।

বড়োমা বললো, এটা আবার কেরে?

সঞ্জুর দিকে তাকালাম, অনাদির পেছনে মুখ লুকিয়েছে।

সকাল বেলা আমার গামছা ধরে খুব করকিয়ে ছিলি মনে আছে। চিকনা, সঞ্জুর দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ পাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।

সঞ্জু দাঁত কিরমির করছে।

আমি, অনাদি, বাসু হাসছি।

মিত্রা, মিনতিকে জড়িয়ে ধরলো।

ডাক্তারদাদা কাছে এসে বললো, কি অনিবাবু ব্যাপারটা কি?

সুভদ্রা হরণ করতে গেছিলাম।

তোমার কি আর দরকার আছে?

আমার না, অন্যের জন্য।

তিনি কে?

মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো। ওই যে অনাদির পেছনে।

লাইট ম্যান।

সকলে হাসছে।

আমার গামছা ধরে টান মারবি। বাইকে করে নিয়ে এলাম। চিকনা সবার সামনে সঞ্জুকে ক্যারি কেচার করে দেখাচ্ছে।

সেই জন্য তুই শোধ নিলি। বড়োমা বললো।

নেবে না মানে। অনি আমার গুরু। গুরু শিষ্যকে হেল্প করবে না তা হয়।

চিকনার ক্যারিকেচারে সকলের হাসি আর থামে না। মিনতি, মিত্রার থেকে চালান হয়ে চলে গেছে মিলিদের কাছে।

তোমরা মন্দির দেখেছ? বড়োমার দিকে তাকিয়ে বললাম।

না। মন্দির বন্ধ। তোর কাকা ব্রাহ্মণকে ডাকতে গেছে।

অনাদির দিকে তাকালাম। তোরা যেতে পারলি না?

আমাদের যেতে দিলে তো যাব। তবু পাঁচুকে সঙ্গে পাঠিয়েছি। তাতেই কতো গজ গজ।

বড়োমাদের ঘুরে দেখিয়েছিস?

দেখাতে পারতাম কিন্তু তোর মতো গল্প বলতে পারবো না।

তাই দেখাস নি?

অনাদি হাসছে।

কি নেতা হয়েছিস?

ঠিক কথা। ডাক্তারদাদা বললো।

কিগো তুমি চুপচাপ কেন। ছোটোমার গলা জড়িয়ে ধরলাম।

তুই এই কারণে আগে আগে বেড়িয়েছিলি?

হ্যাঁ। স্যারের কাছে গেলাম। বলে এলাম একটু পরে আমরা সবাই আসছি।

ভালো করেছিস, তোর উনা মাস্টারের বাড়িটাও এই ফাঁকে দেখা হয়ে যাবে। মনে মনে ইচ্ছে ছিল ভয়ে তোকে বলিনি। বড়োমা বললো।

ছোটোমা মুচকি হাসলো।

স্যার আজকেও অনিকে বলেছে, কতোদিন বেত পরেনি পিঠে। বাসু বললো।

দাঁড়া তোর উনা মাস্টারকে গিয়ে দেখাচ্ছি। বড়োমা বললো।

আমি বড়োমাকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘোষে বললাম, ওটা স্নেহের মার।

বড়োমা আমার দিকে তাকিয়ে।

তুমি, ছোটোমা যে কান ধরো।

বড়োমা আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে।

চলো বেলা পড়ে আসছে। এই ঝিলটা দেখেছো। কতো পদ্মফুল ফুটে আছে বলো।

ওই দেখ মেয়েগুলো জলে নেমেছে। ছোটোমা বললো।

নামতে দাও। প্রাণভরে আনন্দ করুক।

আবার জোঁকে ধরবে। বড়োমা বললো।

ধরুকনা ক্ষতি কি।

দূরে তাকিয়ে দেখলাম দাদা, নিরঞ্জনদা, মল্লিকদা, ইসলামভাই, ডাক্তারদাদা, হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের ওপারে চলে যাচ্ছে। মিত্রারা একটা গ্রুপে সবাই। আমার কাছে একমাত্র বাসু আর অনাদি।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে দীঘির ধারে চলে এলাম।

জানো বড়োমা, এই পুকুরটার নাম দুধ পুকুর। বছরে দুটো সময় এই মন্দিরকে ঘিরে এই অঞ্চলটা জনারণ্যে পরিণত হয়। এখানে একটা ছোটো মেলা বসে। সেখানে তুমি সব পাবে। হাটের জিনিস যেমন পাবে, আবার মাটির হাঁড়ি, খাবরি থেকে সংসারের যাবতীয় জিনিষ। কত দূর দূর গ্রাম থেকে মানুষ পায়ে হেঁটে শিবের কাছে নিজের মনস্কামনা জানাতে আসে। শিবরাত্রির উৎসবটা সেরকম একটা হয় না। তবে গাজন উৎসবটা বেশ জমাকালো হয়।

চৈত্র মাসে এখানে গাজন হয়। সন্ন্যাসীরা একমাসের উপবাস ভাঙে নীলষষ্ঠীর দিন। যারা সন্ন্যাস নেয় তারা ওই দিন এই মন্দিরে পূজো দিয়ে তাদের একমাসের সন্ন্যাস জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটায়। সেদিন সবচেয়ে ভিআইপি মানুষ সেই সব সন্ন্যাসীরা। গ্রামের মনুষরা সন্ন্যাসীদের ভক্তা বলে। এই সন্ন্যাসীরা সবাই দুধ পুকুরে স্নান করে শিবের মন্দিরে এসে পূজো দেয়। তখন মন্দিরে জাত ধর্মের কোনও ভেদাভেদ থাকে না।

যারা সন্ন্যাস নেয় তারা কিন্তু সবাই যে ব্রাহ্মণ তা নয়। নীচু জাতের লোকই সবচেয়ে বেশি করে সন্ন্যাস নেয়। ধর্মের অনুশাসন এখানে এখনও আছে। কিন্তু ওই কয়দিনের জন্য কোনও অনুশাসন নেই। আমাদের গ্রামেও দু-একজন সন্ন্যাস নিত।

ভারি অবাক লাগে ওই সময়টা। যাদের আমরা সারাটা বছর নীচু জাত বলে ঘৃণা করি, নাক সিঁটকই, তারাই তখন সকলের প্রণাম নেওয়ার যোগ্য ব্যক্তি। সেই নীচুজাতের লোকেদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার জন্য হুটোপুটি লেগে যায়। কারণ তারা সন্ন্যাসী। ওই কয়েকটা দিন তাদের কঠোর কৃচ্ছ সাধনায় সবাই মনে করে তারা শিবের অংশে পরিণত হয়েছে।

কি অদ্ভুত না আমাদের এই ধর্মের অনুশাসন।

বড়োমা, ছোটোমা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।

তুমি কোনওদিন অমরনাথে গেছ?

না।

শুনেছি কালীপূজোর পর ওখানে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যাধিক ঠাণ্ডা পরে যায়। তারপর আবার শ্রাবণী পূর্ণিমায় যাওয়ার রাস্তা খোলে। ওই দিনটা শিবের জন্মদিন। কিন্তু মন্দিরের দরজা খোলার পর যিনি প্রথম পূজা দেন তিনি নাকি একজন মুসলমান।

গল্পটা যখন প্রথম শুনলাম বেশ অবাক লেগেছিল।

জানার চেষ্টা করলাম কেন এই অনুশাসন। দু-একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। তারা কিন্তু বেশ পণ্ডিত মানুষ। কেউ কিন্তু আমার মনমতো উত্তর দিতে পারলো না। সব কেমন ভাষা ভাষা। কমবেশি সবাই বললেন একজন মুসলমান ব্যাক্তি নাকি প্রথম অমরনাথের শিবলিঙ্গ দর্শন করেছিলেন। বলতে পারো তিনিই অমরনাথের আবিষ্কর্তা। যেহেতু ঈশ্বর তাঁকে প্রথম দেখা দিয়েছেন। তাই তার হাত দিয়েই প্রথম ঈশ্বরকে খেতে দেওয়া হবে। তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন এই রীতি ছিল।

তারপর থেকে সেটা প্রচলিত রীতির রূপ ধারণ করলো। তিনি এখন বেঁচে নেই হয়তো তাদের পরিবারের কেউ প্রথম পূজোটা দেয়।

মাঝে মাঝে আমার মাথায় কেমন যেন ঘুরঘুরে পোকা নড়ে ওঠে। একবার যেটা মাথায় ঢোকে তার সমাধান না করা পর্যন্ত মনে মনে শান্তি পাই না।

এই বিষয়টা নিয়ে লেগে পরলাম। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। মহাভারত পূরান যেখানেই যাও এদের তুমি পাবেই। আমাদের দেবতাদের মধ্যে তিন ক্ষমতাবান মক্কেল। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের অধিষ্ঠাতা দেবতা। তিনজনেই নমস্য ব্যক্তি।

তুমি একটু ভালোকরে লক্ষ্য করবে। মহেশ্বর মানে শিবকে তুমি ঘরে ঘরে পাবে। সে ছোটোজাত, বড়োজাত, মধ্যজাত, নীচুজাত যতো রকমের জাত আছে। তার আকার হয়তো ভিন্ন।

বিষ্ণুকে তুমি শিবের মতো সবার ঘরে ঘরে পাবে না। যাদের একটু পয়সাগড়ি আছে বলতে পারো অবস্থাপন্ন গেরস্থ তাদের ঘরে পাবে। শিব যেমন মাঠে ঘাটে গড়া গড়ি খায়, বিষ্ণু তেমনি সোকেশে বন্দি। নারায়ণ বলে কথা।

আর ব্রহ্মা। এনার পূজো আদৌ হয় কিনা আমার জানা নেই। তবে শুনেছি রাজস্থানের আজমীরে পুষ্কর বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে নাকি ব্রহ্মার একটা মন্দির আছে।

শিবের মন্দিরে দেখবে কোনও জাতিভেদ নেই। কিন্তু বিষ্ণুমন্দিরে যাও দেখবে সেখানে অনেক আইন-কানুন, অনেক বাধ্যবাধকতা। ধর্মীয় অনুশাসনের বহর সবচেয়ে বেশি। দক্ষিণ ভারতে গেলে তুমি এটা সবচেয়ে বেশি অনুভব করতে পারবে।

আমার ব্যক্তিগতভাবে কি মনে হয় জানো বড়োমা, দেবতাদের মধ্যেও শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক আছে। আমার মতে শিব হচ্ছে কম্যুনিস্ট, আর বিষ্ণু হচ্ছে ক্যাপিটেলিস্ট।

বড়োমা, ছোটোমা আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। আমি হেসে ফেললাম।

ওরকম ভাবে হাঁ করে তাকিয়ে আছো কেন! ওরকম হাঁ করে তাকিয়ে থেকো না। আশেপাশে প্রচুর মাছি আছে ঢুকে যাবে।

বড়োমা, ছোটোমা দুজনেই হেসে ফেললো। আমাকে দু-দিক থেকে দু-জনে জড়িয়ে ধরলো।

এটা সম্পূর্ণভাবে আমার ব্যাক্তিগত মতামত। আমার মনগড়া, কে মানল কে মানল না কিছু যায় আসে না। আমি আমার মতো ব্যাখ্যা করলাম।

তা বলে তুই কোথায় শুরু করলি আর কোথায় চলেএলি! ছোটোমা ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে।

মনটা খচ খচ করছে?

না।

তাহলে?

তোর মতো করে কখনও ভাবিনি।

ভাবো বেশ মজা পাবে।

পায়ে পায়ে দীঘির দিকে একটু এগিয়ে গেলাম।

জানো গাজনের সময় এখানে দশদিন ধরে মেলা চলে। যাত্রা হয়, কবিগান হয়, জলসা হয় আরও অনেক কিছু হয়। কিন্তু ভক্তাদের আগুনঝাঁপ, কাঁটাঝাঁপ দেখার জন্য এতো ভিড় হয় তুমি কল্পনা করতে পারবে না। এখানকার কমিটির লোকেরা ভিড় সামলাতে হিমসিম খেয়ে যায়।

কাকাকে, উনামাস্টারকে ছোটো সময় দেখেছি খুব হম্বিতম্বি করতে।

সেই সময় সবাই মজা করে ভক্তাদের কাঁটাঝাঁপ, আগুনঝাঁপ দেখে। তখন সেই সব সন্ন্যাসীদের এক একজনকে মনে হয় সবে মাত্র স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। এক একজন টপ ক্লাসের ম্যাজিশিয়ান। তারা যেন সব ভিন গ্রহের বাসিন্দা। ভোজবাজিতে ওস্তাদ।

এই দুধপুকুরে সকলে স্নানকরে শুদ্ধ হয়। তারপর তাদের দোলায় করে কাঁধে চাপিয়ে মন্দিরের সামনে নিয়ে আসা হয়। সেই দোলায় কাঁধ দেবার জন্য হুড়োহুরি পড়ে যায়। সন্ন্যাসীদের কাঁধে চাপাতে পারলে পুণ্যার্জন হবে। কি অদ্ভূত বিধি ব্যবস্থা।

তুমি কখনো এরকম দেখেছো?

বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম। বুঝলাম একটা ঘোড়ের মধ্যে আছে। আমার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনছে। ছোটোমারও একই অবস্থা।

আমার দিকে কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো।

তুই কখনও দেখেছিস?

হ্যাঁ, এখানে যখন থাকতাম প্রত্যেক বছর। কাকীর হাত ধরে চলে আসতাম। কাকা এখানকার মাতব্বর। একটু বড়ো হতে বন্ধুদের সঙ্গে। শেষ এখানে দেখতে এসেছি, যখন টেনে পড়ি। তারপর আমি কলকাতায়, আর আসা হয়নি।

আমি কখনও দেখিনি। শুনেছি। আর আজ এই জায়গাটায় এসে তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

এই দীঘির চারপাশে কতো পানা হয়ে আছে দেখছো।

বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল।

এগুলো কখনও পরিষ্কার হয়না। বছরে একবার পরিষ্কার হয়।

তাই!

হ্যাঁ।

কেন?

গাজনের সময় কাজে লাগে।

ছোটো সময় এইসব ভোজবাজি ব্যাপারটা অতো বুঝতাম না। তখন ওদের দেখে মনে হতো আমিও বড়ো হয়ে সন্ন্যাস নেব, আগুনঝাঁপ, কাঁটাঝাঁপ দেব। একবার কাকাকে বলেওছিলাম, কাকা এমন দাবড়ানি দিল, আমার প্যান্ট পুরো ভিঁজে গেল। একটু বড়ো হতেই মাথার মধ্যে ঘুরঘুরে পোকা নরতো।

দুজনেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।

সন্ন্যাস যখন নিতেই পারলাম না, তখন মনের প্রশ্নগুলো এটা কেন? সেটা কেন? খোঁজার চেষ্টা করলাম। উত্তর খোঁজার জন্য গুণীন কাকার পেছন ধরতাম। বুড়ো বড়ো তেঁয়েটে। কিছু বলতো, বাকিটা কিছুতেই বলতো না। হ্যাট হ্যাট করে গরুখেদানর মতো খেদিয়ে দিত। তখন নিজের মতো করে উত্তর খুঁজে নিতাম।

যেখানে আগুনঝাঁপ হয়। তার চারপাশে মোটা করে এই পুকুরের পানা ফেলে রাখা হয়। আগুন ঝাঁপের জায়গাটা পনেরো-কুড়ি ফুট লম্বা হয়। চওড়া ধরে নাও পাঁচ ফুট। কাঠ কয়লা জ্বালানো হয়। তাও আবার যে সে কাঠ নয়, বেল কাঠ। আগুনটা গণগণে করা হয় কুলোর হাওয়া দিয়ে। তিন-চারজন মিলে কুলোর হাওয়া দেয়। তারপর প্রচণ্ড জোরে ঢাক বেজে ওঠে। ঘণ্টা বাজে, কাঁসর বাজে, শিবের নাম করে জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে সকলে। ভক্তরা তখন ওই গণগণে আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে এপার থেক ওপারে যায়। ওপার থেকে এপারে আসে। সেই সময় পুকুর থেকে ঘড়া ঘড়া জল নিয়ে এসে এই পানার ওপর ঢেলে পানাকে ভিঁজে সপ সপে করে রাখা হয়। ভক্তারা আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে এসে ভিঁজে পানার ওপরে দাঁড়িয়ে পড়ে।

পায়ে ফোস্কা পড়ে যায়না! ছোটোমা বললো।

না। কেন বলো তো?

কেন!

এটাও একটা সাইন্স।

যাঃ।

হ্যাঁগো। আচ্ছা তুমি নিজে একটু পরীক্ষা করে দেখো। তুমি যদি তোমার পায়ের তলায় আগুনের ছেঁকা মারো দেখবে তোমার সেই উত্তাপ লাগতে বেশ কিছুক্ষণ সময় নেবে। গোড়ালির চামড়াটা এমনিতেই মোটা। তাছাড়া আমাদের এখানে যারা সন্ন্যাস নেয় তারা সারাজীবনে জুতো পড়েছে কিনা সন্দেহ। তার ওপর তারা মাঠে ঘাটে কাজ করে হাত পা কড়া পরে আরও মোটা হয়ে গেছে। সেই ছোটো বয়েসে দেখেছি। এখনও সেই ছবিটা মগজের মধ্যে খোদাই করে রেখেছি। এখন তাকে বাস্তবে আনার চেষ্টা করেছি।

কি রকম!

ওই কুড়িফুট রাস্তাটা ওরা হাঁটতে সময় নিত পাঁচ থেকে সাত সেকেন্ড। এক একটা পা ওই আগুন স্পর্শ করতো চার থেকে পাঁচবার, খুব বেশি হলে ছবার।

গিয়েই ওই জলে ভেঁজা পানার ওপর দাঁড়িয়ে যেত। বেশ কিছুক্ষণ পর আবার ওরা একই ভাবে ফিরে এসে এপাশের ভেঁজা পানার ওপর দাঁড়াত। অতএব হাঁটার সময় পায়ের তলাটা যতটা গরম হতো, চপচপে জলে ভেঁজা পানায় এসে দাঁড়াতেই তা ঠাণ্ডা হয়ে যেত। তা বলে তুমি কখনও মনে করোনা আমি তাদের কৃচ্ছসাধনাকে ছোটো করে দেখছি। ওই ভাবে একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে আগুণের ওপর দিয়ে হাঁটা সম্ভব নয়।

তখন তোমার মনের মধ্যে যতো বড়ো ঐশ্বরিক শক্তির উপলব্ধি আসুকনা কেন। তুমি কিছুনা কিছু ইনজিওরড হবেই। ওরা কিন্তু বহাল তবিয়েতে থাকে।

অনেককে দেখেছি এখানকার উৎসবের পরের দিন আমাদের বাড়িতে গিয়ে ওই টানা বারান্দার বেঞ্চে বসে কাকার সঙ্গে চা খেতে খেতে জমিয়ে গল্প করছে। যদি অসুবিধে হবে তাহলে এতটা পথ হেঁটে আমাদের বাড়িতে গিয়ে চা খেল কি করে?

বড়োমা কাকে যেন ইশারা করলো। চোখে চোখ পড়ে গেল।

হঠাৎ আনমনা হয়ে পরলাম। পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম আমার পেছনে সকলে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই আমার কথা শুনছে। দাদারাও একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জা পেয়ে গেলাম।

কিরে বল, বেশ বলছিলি।

আমি মাথা নীচু করে হাসছি।

দিলে সব মাটি করে। বড়োমা ঝাঁঝিয়ে উঠলো।

যাচ্চলে আমি কোথায় মাটি করলুম। টুঁ শব্দটি করিনি। কখন থেকে এসে সব শুনছি। ও টের পেয়েছে। তোমায় এদিকে তাকাতে কে বলেছে?

যত্তো সব। বড়োমা গজ গজ করতে শুরু করলো।

চলো ওই পাশে যাই।

আমরা সবাই মন্দিরের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলাম।

আমার পেছনে, পাশে সবাই। এমন কি কাকা, সেই ব্রাহ্মণ মশাই পর্যন্ত। সকলেই যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনছিল, বুঝতে পারিনি।

জানো বড়োমা আমাদের স্কুল থেকে একটু দূরে গেলে দত্তদের জমিদার বাড়ি। এই গোটা অঞ্চলটা জমিদার বাবুদের। এই মন্দির তারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওই পুকুরটা তারা খনন করেছিলেন। শোনা কথা, এই পুকুরের মাঝখানে নাকি অনেক কুয়ো আছে। কেন বলো তো?

কেন?

আমি যা বলছি তুমি আমাদের লোকগাথার মধ্যে এই গল্পগুলো পাবে।

ছোটোমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

গ্রামের ঘরের ঘুমপাড়ানি গান শুনেছো? বাচ্চাদের ঘুম পারাবার সময় মায়েরা গায়।

ঘুমপাড়ানি গান!

হ্যাঁ।

ভুলে গেছি।

আয় ঘুম যায় ঘুম বর্গী এলো দেশে/বর্গীদের ছেলেগুলো পথে বসে কাঁদে/আর কেঁদো না আর কেঁদো না ছোলা ভাজা দেবো/এবার যদি কাঁদো তুমি তুলে আছাড় দেব। এইরকম আর কি, আমি ঠিক বলতে পারলাম না। আরও অসংখ্য আছে।

বড়োমা হেসে ফেললো।

তুই জানলি কি করে?

পদি পিসির কাছ থেকে।

সেটা আবার কে!

ফণি জ্যেঠুর খুড়ী। মরে গেছে। যেটা বলছিলাম।

বর্গীরা এক সময় বাংলা আক্রমণ করেছিল। তখন দুই বাংলা এক ছিল। কিছু মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থে আমাদের দুই বাংলা ভাগ করলো। সে আর এক ইতিহাস।

তখনকার দিনের জমিদারদের পয়সা-গড়ি খুব একটা কম ছিল না। বেশ ভালো ছিল। তখন তো আর ব্যাঙ্ক ছিল না। লকারও ছিল না।

এই বর্গীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য, এইসব জমিদাররা প্রচুর মন্দির তৈরি করেছিল। মন্দিরের সামনে এক একটা পুকুর। আর পুকুরের মধ্যে যে সব কুয়োর গল্প শুনি বা দেখি, সেখানে তাদের সোনাদানা এক একটা ঘড়ায় ভড়ে মুখ বন্ধ করে লুকিয়ে রাখত। বর্গীরা আক্রমণ করলে। ঘর লুঠ করবে। মন্দির লুঠ করবে না। জানতেও পারবে না এই রকম একটা পুকুরের মধ্যে তাদের ধন সম্পদ লোকান আছে। তারপর ইতিহাস একটু বদলালো। কয়েকটা মানুষের জন্য বর্গীরা জানতে পারলো রাজরাজারা মন্দিরেও তাদের ধন দৌলত লুকিয়ে রাখে। তখন বর্গীরা মন্দির আক্রমন করলো। লুঠ করলো ধনদৌলত।

মাঝে মাঝে গুপ্তধনের গল্প পড়ো, এই কনসেপ্ট থেকে তৈরি।

বড়োমা আমার সামনে দাঁড়াল। আমার মুখে হাত বুলোতে বুলোতে বললো। তুই এত পড়ার সময় পাশ কখন?

ওই জন্য অফিসে যেতে দেরি হতো। তোমায় ফোন করে বলতাম দাদাকে বলে দাও।

ছোটোমা হেসে ফেললো।

ওরা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে।

ফণিজ্যেঠুর বাবা ওই জমিদার বাড়ির লেঠেল ছিলেন। আমি তখন ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে পড়ি। একদিন কি কথায় কথায় ফণিজ্যেঠু আমাকে বলেছিল, ওই বাড়িতে যে মন্দির আছে, তার তলায় একটা অন্ধকার ঘর আছে, জমিদারবাবু নাকি যারা দুষ্টুমি করে তাদের ওখানে আটকে রেখে দেয়। আমি দুষ্টুমি করলে আমাকেও ওখানে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে দেবে।

ছোটো ছিলাম। ফণি জ্যেঠুর দশাসই চেহারা দেখে সত্যি বেশ ভয় পেতাম। কালো কষ্ঠি পাথরের মতো গায়ের রং। মাথায় একটা গামছা পাগড়ির মতো বেঁধে রাখতো। ঝাঁটার মতো ইয়া গোঁফ। যখন বড়ো হলাম দেখলাম তার আগেই জমিদারদের জমিদারিত্ব চলেগেল। জমিদারবাবুরা এখান থেকে টাউনে চলে গেলেন। বাস্তু রয়ে গেল, মন্দির রয়ে গেল। আমি প্রায়ই জমিদার বাড়িতে যেতাম। কাকা, বাবার দৌলতে আমারও একটু পরিচিতি ছিল।

ওই বাড়ির একটা কাজের মেয়েকে পটিয়ে, আমি একদিন সেই অন্ধ কুঠরির খোঁজ পেলাম। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে তার ইতিহাস জানলাম। ফণিজ্যেঠুকে এসে ধরলাম। জ্যেঠু আমার কথা শুনে প্রথমে অবাক হয়ে বললো, তুই জানলি কি করে! আমি বললাম তুমি হ্যাঁ অথবা না বলবে। জ্যেঠু আমার কথায় শায় দিয়েছিল।

সেই দেবদাসী? মিত্রা বললো।

হ্যাঁ।

দেখলাম কাকা অনেকটা এগিয়ে গেছে আমাদের থেকে।

ডাক্তারদাদা আমার সামনে এসে দাঁড়াল।

তুই এগুলো সব খুঁজে খুঁজে বার করেছিস?

হ্যাঁ।

তখন তুই কোন ক্লাসে পরতিস?

ক্লাস টেন।

একা একা?

হ্যাঁ।

জানো ডাক্তারদাদা সেই দেবদাসী আর দামিণীমাসির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। শুধু পরিবেশ বদলে গেছে। পরিস্থিতির অদল বদল ঘটেছে এই যা। শেষ বারে এসে সেই দিদাকে অনেক খোঁজ করেছি। পাইনি। ও পাড়ার লোকগুলো বললো তিনি মারা গেছেন।

এই জন্য তুই ফ্রয়েড পরিস।

আমি মাথা নীচু করলাম।

জানো ডাক্তারদাদা মানুষের মনটা আকাশের মতো। তুমি চেষ্টা করলেও ছুঁতে পারবে না। তুমি উঁকি মেরে দেখতে পার। উপলব্ধি করতে পার। এর বেশি কিছু নয়।

ঠিক বলেছিস।

তারপর আমার কাঁধটা ঝাঁকিয়ে বললো, এই জন্য তুই এতো কষ্ট পাস।

হয়তো সত্যি, হয়তো বা নয়।

জানো বড়োমা, এমনি এই মন্দিরটা দেখলে তোমার কোনও কিছু মনে দাগ কাটবে না।

আর পাঁচটা মন্দিরের মতো।

দেবতাও সেরকম। সব এক রূপ। কিন্তু তুমি যখনই তার ইতিহাসটা জানতে পারবে, তখনই তোমার মনে সেই জায়গাটা দাগ কাটবে।

ঠিক বলেছিস। যেমন তোর পীরবাবার থান।

হ্যাঁ। শুধু আমি না। অনেকেই কিন্তু নিয়ম করে ওখানে দাঁড়িয়ে প্রণাম করে।

বাবাঃ তুই কি গল্প ফেঁদেছিস বলতো। সকলে মোহিত হয়ে শুনছে। কাকা বললো।

ও গল্প তুমিও জানোনা মাস্টার। বড়োমা বললো।

তা বলতে পারো। ছোটো থেকে ওর জানার ইচ্ছেটা প্রবল। আমি যাদের জ্যাঠা, কাকা বলতাম তাঁরা ওর বন্ধু ছিল। নাতির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে কে না ভালোবাসে বলো। ও সেই সুযোগটা নিত। একবার আমাদের গুণিনের কাছে মন্ত্র শিখতে গেছিল। মন্ত্রটন্ত্র শিখে বাবু গুণিন হবেন।

তাই বলি তুই এতো লতাপাতার নাম জানিস কি করে এবং তার গুণাগুন। ডাক্তারদাদা বললো।

আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

যাও মন্দিরে যাও।

তুই যাবি না! বড়োমা বললো।

তোমরা যাও, আমি যাচ্ছি।

হ্যাঁরে হাত, পা ধোব কোথায়?

ওই তো টিউবওয়েল আছে।

ওরা সবাই জুতো খুলে হাত পা ধুয়ে মন্দিরে গেল।

আমি মিনতিকে, সঞ্জুকে কাছে ডাকলাম। চিকনা এগিয়ে এলো। বাসু, অনাদি আমার পাশে। আমার মুখের ভাব ভঙ্গিতে ওরা বুঝতে পেরেছে, আমি খুব সিরিয়াস। এতক্ষণ ওরা আমার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার বলা গল্প মন দিয়ে শুনছিল। দু-জনেই মাথা নীচু করে।

সঞ্জু তুই মিনতিকে ভালোবাসিস?

সঞ্জু মাথা নীচু করে রইলো।

আমি তোর মুখ থেকে শুনতে চেয়েছি?

হ্যাঁ।

মিনতি তুই?

হ্যাঁ।

এখন বিয়ে করতে চাস?

না।

কেন?

আমি পড়াশুনো করবো।

সঞ্জু তুই কি বলিস?

আমার কোনও আপত্তি নেই।

যদি স্যার এখুনি মিনতির বিয়ে দিতে চায়?

আমি রাজি।

তারপর ওর পড়ার কোনও ডিস্টার্ব হবে না?

কোনওদিন হবে না। যদি হয় আমি সংসার থেকে আলাদা হয়ে যাব।

সেটা সমস্যার সমাধান হলো?

ওর পড়াশুনায় যাতে কোনও ক্ষতি না হয় তা আমি দেখব।

যদি ক্ষতি হয়?

তুই যা শাস্তি দিবি, আমি মনে নেব।

মনে থাকবে?

হ্যাঁ।

যা দু-জনে একসঙ্গে পূজো দিয়ে আয়।

ওরা দুজনে চলে গেল। চিকনা আমার কাছে এসে দাঁড়াল। আমার মুখটার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

তোর সঙ্গে এখন কথা বলতে ভয় লাগছে।

কেন!

জানিনা।

চল মন্দিরে যাই।

চল।

আমরা মন্দিরের ভেতর এলাম।

প্রচুর ফুল মিষ্টি। সবাই যে যার নিজের হাতে পূজো দিচ্ছে। বড়োমা মনে হয় ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করছে মন্দির সম্বন্ধে, সে কিছু বলতে পারছে না। বড়োমা কাকাকে মনে হয় কিছু বলছে। সবাই বেশ গোল হয়ে বসে। সূর্য একবারে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। একটু পরেই মুখ লুকবে।

বুবুন।

আমি ঘুরে তাকালাম।

আয় একটু।

আমি কাছে এগিয়ে গেলাম।

তিনকড়ি, এই হচ্ছে অনি। কাকা বললেন।

ওকে খুব ছোটো সময় দেখেছি।

হ্যাঁ। এখন ও কলকাতাতেই থাকে। এইটি বউমা।

উনি দুজনের দিকে একবার ভালো করে তাকালেন। বুঝতে পারলাম চোখে অনেক প্রশ্ন। বুঝলাম কাকা তাকে সঙ্গে করে আনার সময় অনেক কথা বলেছেন। আমি প্রণাম করলাম। উনি আমার মাথায় আবিরের টিপ লাগিয়ে দিলেন।

আরও প্রায় আধঘণ্টা পর আমরা সবাই বেরলাম। এখন গোধূলি। মিহি কুয়াশার মতো অন্ধকার, আকাশটাকে ঢেকে ফেলছে। ঝিঁঝিঁর ডাকে চারদিক ম ম করছে। সন্ধ্যাতারা পূব আকাশে জ্বলজ্বল করছে। মন্দিরে শিবমূর্তির সামনে মোমবাতিগুলো জ্বলছে। মোমবাতির শিখা হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। অদিতি, দেবাশিসের হাত ধরে। দু-জনের কপালেই আবিরের ছোঁয়া। টিনা, মিলি, নির্মাল্য, নীপা সবাই একে একে মন্দির থকে বেরিয়ে এলো।

বড়োমা সবার হাতে প্রসাদ দিল আমরা খেলাম।

জানো বড়োমা, তোমরা যেখানে বসে পূজো দিলে। চৈত্রমাসে ওই জায়গাটা এক মানুষ গর্ত হয়ে যায়।

কেন!

বহু মানুষ কোদাল দিয়ে মাটি কেটে নিয়ে চলে যায়।

এ কি কথা!

হ্যাঁগো। মানুষ বিশ্বাস করে এই মাটিটা খুব উপকারী, যে কোনও ব্যাথায় তুমি যদি জলে গুলে লাগাও তোমরা ব্যাথা কমে যাবে।

গর্ত বোঁজানো হয় কি করে!

ওই পুকুর থেকে মাটি কেটে নিয়ে আসা হয়।

খালি গপ্পো।

তুমি ওই ব্রাহ্মণকাকাকে জিজ্ঞাসা করো।

বড়োমা, ছোটোমা আমার কথা শুনে সত্যি সত্যি আবার ব্রাহ্মণের কাছে গেল। ব্রাহ্মণ হাসছে। বড়োমা ওখান থেকেই আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

কি, অনি গপ্পো বলে?

বড়োমা কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘোষলো।

তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো অনি। ইসলামভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললো।

বলো।

তোদের এখানটা দেখলাম তোর গল্প শুনলাম। আমার একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় পড়েছি ঠিক বলতে পারবনা।

কি বলো?

পীরসাহেব এবং মহাদেব এক ব্যাক্তি।

না। পীরসাহেব আর নারায়ণ এক। দেখবে দুজনকেই প্রসাদ হিসেবে আটার সিন্নি দেওয়া হয়। ওটাই দু-জনের মূল প্রসাদ। যেমন মা মনসার দুধ, কলা।

তুমি এ্যান্টনি ফিরিঙ্গীর জীবনবৃতান্ত পড়েছো।

না।

আমার কাছে আছে, পড়ে নিয়ো। সেখানে কবিয়াল ফিরিঙ্গী সাহেব একজন বাঙালী ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। যদিও কবিয়ালের সঙ্গে তার পরিচয় এক নবাবের বাড়িতে। সেখানে সেই ভদ্রমহিলা একজন বাঈজী হিসাবেই প্রসিদ্ধা ছিলেন। তারপর সেই ভদ্রমহিলার দৌলতেই ফিরিঙ্গী সাহেব একদিন একজন নামজাদা কবিয়াল হন।

একদিন ফিরিঙ্গী কবিয়ালের সঙ্গে তখনকার দিনের বিখ্যাত কবিয়াল ভোলাময়রার কবির লড়াই চলছে। ভোলাময়রার একটা প্রশ্নের উত্তরে ফিরিঙ্গী কবিয়াল বলেছিলেন, কিষ্ট আর খিস্টতে প্রভেদ নেইকো ভাই/শুধু নামের ফেরে জগত ফেরে/আরতো কিছুই নয়। এখানে কিষ্ট বলতে কবিয়াল কৃষ্ণকে বুঝিয়েছেন।

ইসলামভাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।

ডাক্তারদাদা ফিক করে হেসে বললো, কি ভায়া হজম হলো না। ও তোমার কথাটা একটু ঘুরিয়ে বলে দিল। উদাহরণ স্বরূপ।

তারপর বড়োমার দিকে তাকিয়ে বললো। কি বান্ধবী তোমার ছেলের দৌড়টা দেখছো।

বড়োমা হাসি হাসি মুখ করে বললো।

আমি ওর দৌড় জানি, তুমি বরং তোমার বন্ধুটিকে একটু বোঝাও।

দেবারা হো হো করে হেসে ফেললো।

দাদা কপট রাগে বললো, আমাকে আবার এর মধ্যে টানলে কেন। আমি তোমার কোন পাকা ধানে মই দিলাম।

বড়োমা কিছু বলতে যাচ্ছিল আমি বড়োমার হাতটা ধরে বললাম,

চলো, আর এখানে দাঁড়ান যাবে না, স্যার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।

ওরা সবাই যে যার মতো ট্রলিতে বসলো। আমি অনাদিকে বললাম, তুই একবার এগিয়ে যা, স্যারকে গিয়ে বল। পারলে একটু সাহায্য কর।

অনাদি হেসে ফেললো।

বাসু বললো, আমি, চিকনা ওর সঙ্গে যাই।

যা।

ওরা সবাই এগিয়ে গেল। আমরা পেছন পেছন গেলাম। নীপাদের ট্রলি থেকে গানের কলি ভেসে আসছে। বুঝলাম ওরা আন্তাকসারি খেলছে। বড়োমারা নীচু স্বরে কথা বলছে। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই পৌঁছে গেলাম।

উনা মাস্টারের বাড়িতে কারেন্ট আছে। লাইট জ্বলছে।

কাকা ট্রলি থেকে নেমেই চেঁচিয়ে উঠলো, কিরে উনা কোথায় গেলিরে।

স্যার বেরিয়ে এসে খামারে দাঁড়ালেন।

একে একে সবাই ট্রলি থেকে নেমে এসেছে।

বড়োমা, ছোটোমার সঙ্গে স্যারের পরিচয় ছিল। কাকা, দাদাদের সঙ্গে পরিচয় করালেন। স্যার সবাইকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। ডাক্তারদাদাকে প্রণাম করে বললেন আপনি আমাকে চিনতে পারবেন না। আমি একবার আপনার শ্যামবাজারের চেম্বারে গেছিলাম।

কেন!

কোমড়ে চোট লেগেছিল।

ব্যাথা কমেছে না বেড়েছে?

কমেছে।

তারপর আর গেছিলেন?

না।

কেন!

আপনি বলেছিলেন যতদিন বাঁচবেন এই ওষুধ খাবেন।

খেয়ে যাচ্ছেন?

খাচ্ছি। সুস্থও আছি।

এবার আমাকে কি খাওয়াবেন। অনেকটা পথ এলাম।

মিত্রার দিকে তাকিয়ে।

কিরে মামনি ঠিক কথা বললাম কিনা?

একবারে ঠিক।

বড়োমা খিঁচিয়ে উঠলো।

খালি খাই খাই। পেটে জায়গা থাকে কি করে?

ও তুমি বুঝবেনা বান্ধবী।

সবাই আবার হাসে।

ওরা সবাই ধীরে ধীরে বাইরের বরান্দার বেঞ্চে চেয়ারে বসলো।

দেবাশিসকে কাছে ডাকলাম। বললাম, কাকাকে বলেছিলি তোদের মনের কথা।

বলেছিলাম।

কাকাকে মনে করিয়ে দে। স্যারকে বলুক।

মিত্রা সকলের সঙ্গে স্যারের পরিচয় করিয়ে দিল। শেষে বললো তুমি বুবুনকে আজ বেত মারবে বলেছো।

সবাই হো হো করে হাসছে। স্যারও মুচকি মুচকি হাসছে।

তোর বুবুন যদি অন্যায় করে কি করবো।

কি করেছে?

বলেছে তোদের লঙ্কাভাজা দিয়ে ঢেঁকি ছাঁটা চিঁড়েভাজা খাওয়াতে।

বাঃ বাঃ তোফা রেসিপি। ডাক্তারদাদা চেঁচিয়ে উঠলো।

কিগো কিছু বুঝলে। মিত্রা বললো।

যেন স্যারকে ধমকাচ্ছে।

আমার অন্যায় হয়েছে মা। তোর কাকীমা অনির কথা মতো চিঁড়ে ভেজেছে, শুকনো লঙ্কা দিয়ে।

ঠিক আছে। চলো বেঞ্চে বসে এবার বুবুনের বন্ধু মানে আমারও বন্ধু ওরা তোমাকে কিছু বলবে তুমি শোন।

উনামাস্টার একবার মিত্রার দিকে আর একবার দেবাদের দিকে তাকাল।

ভেতরে এসে স্যার বসার পর দেবা সবিস্তারে সব বললো।

তোদের অনি মাইক্রস্কোপ দেখিয়েছে!

হ্যাঁ।

জানিস ওই মাইক্রস্কোপটা নিয়ে একটা গল্প আছে।

জানি। বুবুন বলেছে। মিত্রা বললো।

তোদের বলেছে!

হ্যাঁ।

স্যার নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। মিত্রাকে জড়িয়ে ধরে চোখটা ছল ছল করে উঠলো।

জানিস মা। ওই দিনটার কথা এখনও মনে পড়লে নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। ও আমার ছাত্র, ওর কাছে ক্ষমা চাইতে পারিনি। ওর বাবা আমার বন্ধু, শ্মশানে যেখানে দাহ করা হয়েছিল, সেখানে গিয়ে অধীপের কাছে ক্ষমা চেয়ে এসেছিলাম। মনার কাছে গিয়েও বহুবার ক্ষমা চেয়েছি। আজ তোর কাছে ক্ষমা চাইছি।

এমা এ আপনি কি কথা বলছেন ভায়া! ডাক্তারদাদা বললো।

না ডাক্তারবাবু আমি ঠিক কথা বলছি। সেদিন বুঝিনি, আজ আমি অনুভব করি সেদিন আমি কতবরো ভুল করেছিলাম। আজও আমার মাঝে মাঝে আক্ষেপ হয়।

সে ঠিক আছে। ওটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। মাথায় রাখবেন অনি আপনার ছাত্র। ও কিন্তু ওর স্যারের বাড়িতে আমাদের সকলকে নিয়ে এসেছে।

ডাক্তারদার কথায় মেঘ কাটল।

স্যার বেঞ্চিতে বসলেন।

এবার দেবাদের ব্যাপারটা কি ভাবে কি করলে হবে বলুন। মামনি দেখ না চিঁড়েভাজা কতদূর। ডাক্তারদাদা বললো।

ওরা যা দেবে আমি ল্যাবরেটরিতে রাখবো।

আপনার কি কি লাগবে বলুন?

আমি কালকে একটা লিস্টি করে দেব।

দেবাবাবু তোমাদের কাজ হয়ে গেল। এবার কেটে পরো। আচ্ছা বান্ধবী, অনি গেল কোথায়!

আছে কোথাও দেখ, নাহলে আবার কোথাও গল্পের সন্ধানে গেছে।

আমি অন্ধকারে বাইরের খেতটায় ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছি।

মিনতি, মিত্রা, টিনা, মিলি, কাঁচের বাটিতে করে চিঁড়েভাজা সাজিয়ে নিয়ে এলো।

ওঃ গন্ধটা দারুণ বেরিয়েছে নারে মামনি? ডাক্তারদাদা বললো।

আমি তোমার থেকে একমুঠো খেয়ে নিয়েছি। দারুণ।

অ্যাঁ।

হ্যাঁ।

তুমি খাও দারুণ টেস্ট।

বড়োমা ফিক করে হেসে ফেললো। জুড়িদারটা ভাল জুটিয়েছো।

স্যার ডাক্তারের কাণ্ড কারখানায় মুচকি মুচকি হাসছে।

বুবুন কোথায় গেল বড়োমা?

কেন, ভেতরে নেই!

ছিলতো এখুনি, তারপর কোথায় ফুরুত করে হাওয়া হয়ে গেল।

তুই ধরতে পারলি না! ডাক্তার বললো।

আমার সাধ্যি নেই।

সেকিরে!

হ্যাঁগো। তোমরা পারছো?

বুঝেছি।

মিত্রা চলে গেল।

হ্যাঁগো উনা মাস্টার। বড়োমা বললো।

বলুন দিদি।

তোমায় অনি কোনও কথা বলেছিল?

কিসের ব্যাপারে বলুন।

তোমার মেয়ের ব্যাপারে।

বলেছিল।

ও আজকে তোমার মেয়েকে নিয়ে গেছিল।

হ্যাঁ। যাবার সময় বললো। আপনারা সবাই আসবেন।

সেতো বুঝলাম। ছাত্রের মনের হদিস পাওনা তো ছাত্রকে কেমন পড়িয়েছো?

আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।

ওখানে গিয়ে আমাকে বললো, সুভদ্রা হরণ করে নিয়ে এলাম।

হো হো করে স্যার হেসে ফেললেন। বুঝেছি।

এবার মনের কথাটা বলে ফেলো?

ওর জেদের কাছে হার মানছি।

তাহলে আমি অনিকে বলতে পারি।

বলতে পারেন।

লাইট ম্যান। ডাক্তারদাদা চেঁচিয়ে উঠলো।

বড়োমা সামন্তর দিকে তাকিয়ে হাসলো।

অনি বুঝি তোমায় ঘটকালি করার দায়িত্ব দিয়েছে।

আসার সময় ফিস ফিস করে বললো। স্যারের মনের কথাটা একটু জেনে নিও।

স্যার আবার হো হো করে  হেসে ফেললো।

দেখুন ও কতটা সেন্সেটিভ। এর মধ্যেও ওর কোনও প্ল্যান আছে। ডাক্তারদাদা বললো।

তা বলতে পারবো না। সত্যি কথা বলতে কি ডাক্তারবাবু, ওকে পড়িয়েছি ঠিক কিন্তু ওর মনের হদিস এখনও ধরতে পারি না। মনা মাঝে মাঝে গল্পের ছলে বলে। কেমন সিউরে উঠি। মনাকে বলি তুমি একটু শাসন করো, তা মনা বলে ও এখন কি সেই ছোটোটি আছে। বেতের ভয় দেখাব।

সকলে হো হো করে হেসে উঠলো।

আমাকে পূজো দিয়ে বেরবার সময় যখন ট্রলিতে উঠছি, জড়িয়ে ধরে কানে কানে বললো, তুমি একটু স্যারকে কথাটা পারবে। বড়োমা বললো।

ওকে বলে দেবেন আমার মনের কথা।

ওরা ওদের মতো গল্প করতে শুরু করে দিল। আমি ফলোআপ শুরু করলাম। আরও কয়েকটা ফোন করলাম। তারপর পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকলাম। তখন ওখানে হই হই চলছে। সঞ্জু, চিকনা তরজা। সবাই বেশ এনজয় করছে। মিনতিও আছে। আমাকে দেখে দু-জনে চুপ করে গেল।

কিরে তুই কোথায় ছিলি! দেবাশিস বললো।

বল এই তো এখানেই ছিলাম। মিত্রা বললো।

হাসলাম।

আমরটা কোথায়?

পাবিনা। আগে সত্যি কথা বলবি, তারপর পাবি।

আমি মিত্রার পাশে গিয়ে বসলাম।

একবারে আমার বাটিতে হাত দিবিনা।

বাটিটা চাপা দিয়ে কোলের ভেতর তুলে নিল।

মিনতি একটু চা আন তো।

একবারে দিবিনা, তুই বোস।

মিনতি উঠতে পারছে না। একবার আমার দিকে তাকায় একবার মিত্রার দিকে।

দেখছিস কার ক্ষমতা বেশি।

অব ভিয়াসলি তোর।

তাহলে।

আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে। হাত চলে গেছে ওর কোলের ভেতর লুকিয়ে রাখা বাটিতে।

না না না। চেঁচিয়ে উঠলো।

তার আগেই আমার মুঠো ভর্তি হয়ে গেছে। খেলাম।

মনে রাখিস এটা আমার জন্য। রেসিপিটা আমার বুদ্ধিতে।

মিত্রা আমার দিকে হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে।

কিছু বলবি?

মাথা নীচু করলো, তোর কাছে হেরেও আনন্দ।

ঠিক বলেছো মিত্রাদি। মিলি বললো।

ভালো সাকরেদ তৈরি করে নিয়েছিস। জল উঁচু তো উঁচু, জল নীচু তো নীচু।

কখনই না, যা সত্যি, মিলি তাই বললো।

হাসলাম। ওর গালটা ধরে একটু নেড়ে দিলাম। ওর চোখে মুখে খুশির ঝিলিক।

এবার দে।

বাটিটা এগিয়ে দিল। এক মুঠো তুলে নিলাম।

চিঁড়ে ভাজা চিবতে চিবতে মিনতির দিকে তাকিয়ে বললাম। চা।

মিনতি উঠে দাঁড়াল।

দেবা তোর কাজ করেছিস?

ডাক্তারদাদা আজ ফুল ফর্মে ব্যাট করলো। স্যার ডাক্তারদাদার পুরনো পেসেন্ট।

এ গ্রামের সকলেই কি ডাক্তারদাদার পেসেন্ট!

এই ফিল্ডে আর কে আছে বল?

ঠিক। তোরা কি ঠিক করলি?

আগামী সপ্তাহে একবার আসবো।

হবে না। আমার একটা কাজ আছে রবিবার। হয়তো তোদেরও থাকতে হবে।

ধর আমরা সোমবার এলাম সেদিনই ফিরে গেলাম।

এরা কষ্ট পাবে। এট লিস্ট ওয়ান নাইট তোকে স্টে করতে হবে।

দেখা যাবে।

নীপা ছুটে এসে মিত্রার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে কি বললো।

মিত্রা মুচকি হাসলো। উঠে দাঁড়াল। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি একটু আসছি।

যা।

কি টিনা ম্যাডাম, শিব ঠাকুর কি বললো তোমায়। তিনি কবে আসছেন?

প্রার্থনা করলাম যেন না আসেন।

কিরে দেবা! বলে কি? আমি দেবার দিকে তাকালাম।

এই বেশ ভালো আছি অনিদা।

কেন?

একটা ছবি মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে আছে। যদি সেটা নষ্ট হয়ে যায়।

হুঁ। বেশ জটিল। তবে কি জান টিনা। জীবনের সব ছবিই জল ছবি। তুমি নিজে আবার মনের মতো করে এঁকে নিতে পার।

টিনা আমার দিকে তাকাল। কিছু বলতে চায়। পারলো না। মাথা নীচু করলো।

মিলি ম্যাডাম।

আমি কিছু চাইনি। তবে প্রার্থনা করেছি অনিদার মতো যেন হতে পারি।

খুব কষ্ট।

হোকনা, ক্ষতি কি।

দেবা?

অদিতি চেয়েছে, আমি কিছু চাইনি।

তুই আমাকে জিজ্ঞাসা করবি না। চিকনা বললো।

তুই তো সঞ্জুর মতো একটা খুঁজে দিতে বলেছিস।

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।

কিরে আমি যা বললাম সত্যি?

তুই কি করে জানলি। চিকনার মাথা নীচু।

হবে। সবুরে মেওয়া ফেলে। তোর এখন অনেক কাজ। অনেক দায়িত্ব। মাথায় রাখিস। পাশাপাশি বাসু, অনাদি, সঞ্জুরও। এটা ভেবেছিস।

হুঁ।

চাইবিনা কোনও দিন। চাইলেই ফুরিয়ে যাবে। না চাইতেই তুই যদি পাস। ক্ষতি কি?

চিকনা আমার দিকে তাকাল। চোখদুটো চক চক করছে। ফিক করে হেসে ফেললো।

আর কোনওদিন কোনও কিছু চাইব না।

তুই খালি তোর কাজটা মন দিয়ে করে যা। দেখবি ধরে রাখতে পারছিস না।

আমি করবো অনি। তুই যা বলবি তাই করবো।

সোমবার থেকে একেবারে সময় নষ্ট করবি না।

চিকনা মাথা দোলাচ্ছে।

মাথায় রাখিস।

ফোনটা বেজে উঠলো। দেখলাম হিমাংশু। হঠাৎ এই সময়!

হ্যালো।

তুই কোথায়?

কেন!

কাল দুটো কাজ ক্যানসেল হয়েছে। তাই কাল কোনও কাজ নেই, যদি সকালের দিকে বেরোই।

খুব ভালো। কখন আসবি বল?

একবারে ভোর ভোর বেরিয়ে যাব।

চলে আয়।

আমার সঙ্গে আমার এ্যাসিসটেন্ট যাবে?

আমি দেখেছি।

না।

ছেলে না মেয়ে?

হিমাংশু হাসছে।

ছেলে।

আমাকে চেনে?

তোর নাম শুনেছে।

সব কাগজ সঙ্গে নিয়ে আসবি।

ঠিক আছে।

চেকগুলো ক্যাশ হয়েছে?

হয়ে গেছে।

একটা টেনসন মিটলো। চিঠি সার্ভ করেছিস?

আমার কাছে এ্যাকনলেজ ফিরে এসেছে।

গুড।

এবার বল কি ভাবে যাব?

যেভাবে তোকে রুট চার্ট দিয়েছি।

ওখান থেকে?

ওটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।

ঠিক আছে।

আমাকে একটা ফোন করিস?

আচ্ছা।

কেরে, হিমাংশু? দেবাশিস বললো।

হ্যাঁ।

ও আসছে?

হ্যাঁ।

তুই আমাদের কি দায়িত্ব দিবি বললি না?

সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি।

দেবা চুপ করে গেল।

এবার উঠতে হবে। ওখানে দু-জন মাত্র রয়েছে।

সঞ্জু চলে গেছে। অনাদি বললো।

কেন!

লাইটের কি হয়েছে। ওকে ফোন করেছিল।

লতা, রেবা কোথায়?

কাকীর কাছে।

চল দেবা। এবার এগোই, এদের বসিয়ে রাখলে সারারাতে গল্প শেষ হবে না।

আমরা উঠলাম। বাইরে বারান্দায় এলাম। খুব জোর গল্প চলছে। মিত্রা মধ্যমনি হয়ে বড়োমা, ছোটোমার মাঝখানে। আমায় দেখেই ডাক্তারদাদা বলে উঠলো।

কি অনিবাবু যাবার সময় হয়েছে?

হ্যাঁ।

স্যারের কাছে তোর অনেক অজানা কথা জানলাম।

আমি মাথা নীচু করলাম।

সব ভালো, একটুও খারাপ না।

স্যার কখনও ছাত্রের নিন্দা করেন না।

তুই সেই ছাত্র নোস যে তোর নিন্দা করবে। তোর প্ল্যান মতো সব কথা স্যারের কাছ থেকে আদায় করে নেওয়া হয়েছে।

মনে মনে বললাম, আমি সব শুনেছি।

তুই খুশী?

মাথা দোলালাম।

তোর কিন্তু অনেক দায়িত্ব বেড়েগেল।

আমি চুপ করে থাকলাম।

আসর ভাঙলো। সবাই বারান্দা থেকে নেমে এসে সামনের খামারটায় দাঁড়াল। কাকীমা, মিনতি বেরিয়ে এলো। সকলে সকলের কুশল কামনা করে সবাই মিলে একসঙ্গে স্যারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।

স্যার, ডাক্তারদাদা, দাদার হাত ধরে বললেন আবার আসবেন।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/ZTV5wg7
via BanglaChoti

Comments