কাজলদিঘী (অষ্ট বিংশ কিস্তি)

“কাজলদীঘি”

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

অষ্ট বিংশ কিস্তি
—————————

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম মিত্রা ঘাটের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। ওর কাঁধে টাওয়েল। গাছের উঁচু মগডালের দিকে তাকিয়ে। চারিদিক নিস্তব্ধ। এ বাড়ির সব আজ ও বাড়িতে। আমি পা টিপে টিপে ওর পেছনে এসে দাঁড়ালাম। ওর মতো মাথা তুলে ওপরের দিকে তাকালাম। দেখলাম একটা টিয়াপাখি আর একটা টিয়াপাখির ঠোঁটে ঠোঁট রেখে টানাটানি করছে।

মাঝে মাঝে একটা ট্যাঁও ট্যাঁও করে উঠছে। মিত্রা একদৃষ্টে ওইদিকে তাকিয়ে আছে। আমিও ওর পেছনে। পাখিদুটো হঠাৎ উড়ে গেল। মিত্রা আপন মনে বলে উঠলো। যাঃ। ঘুরতে গিয়ে আমার গায়ে আছাড় খেয়ে পড়লো। আমাকে জাপ্টে ধরলো। ফিক করে হেসে বুকে মুখ রাখলো।

দিলি তো ছুঁয়ে।

কেন!

আমি পটি করে এসেছি। চল স্নান করবি আমার সঙ্গে।

এখন?

হ্যাঁ।

চল।

আমি হাসছি।

দাঁড়া আসছি।

মিত্রা ছুটে চলে গেল। নীপাকে ডেকে জামাকাপর আনতে বললো। আমি ততক্ষণে জলে নেমে গেছি। নীপা জামাকাপর দিয়ে গেল। বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো। যতো দুষ্টু বুদ্ধি, দাঁড়াও বড়োমাকে ডাকছি। নীপা চলে গেল। মিত্রা নেমে এলো।

কাপরটা কোমড়ে ভাল করে বেঁধে নে, না হলে পায়ে জড়িয়ে যাবে।

তুই বেঁধে দিয়ে যা।
আমি উঠে এসে ভালকরে পেঁচিয়ে বেঁধে দিলাম।

দু’জনে নেমে গেলাম জলে। সাঁতার কাটছি।

জানিস বুবুন, জলটা বেশ ভারি। আমাদের ক্লাবের সুইমিং পুলের জলটা এর থেকে হাল্কা।

ওটা পিউরিফায়েড ওয়াটার। এটা বাঁশবাগানের পাতা পড়া জল।

অনেকদিন পর সাঁতার কাটছি। নীপাটা কিছুতেই জলে নামতে দেয় না।

তোকে ভয় পায়।

কেন!

নীপাকে জিজ্ঞাসা করিস।

চল ওপারে যাই।

দম আছে।

তুই আছিস তো। এক্সপার্ট।

হাসলাম।

হাসিসনা।

ওপারে কিন্তু দাঁড়ান যাবে না। প্রচুর পাঁক।

ঠিক আছে।

দু-জনে ওপারে সাঁতরে চলে গেলাম। ফিরে তাকাতেই দেখি, ছোটোমা, বড়োমা, নীপা, ইসলামভাই দাঁড়িয়ে হাসছে।

ওরে ফিরে আয়, ঠাণ্ডা লাগবে।

মিত্রা বড়োমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো।

কিরে ফিরে যেতে পারবি। না পিঠে উঠবি।

চল যতটা যাওয়া যায়। তারপর তোর পিঠে উঠে যাব।

আবার সাঁতরাতে আরম্ভ করলাম। মাঝ পথে এসে সত্যি মিত্রা হাঁপিয়ে পরলো।

বুবুনরে এখানটা কি গভীর, টানতে পারছি না।

আমার গলাটা জড়িয়ে ধরে ভেসে থাক।

ও তাই করলো। দুজনে পাড়ে উঠলাম। বড়োমা হাসছে।

তুই সাঁতার কাটতে জানিস? মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললো।

বুবুন ছিল, তাই নামলাম। নীপাটা নামতে দেয় না।

ঠিক আছে কালকে তুই নামিস। আমি থাকবো।

আমি মিত্রার কোমরের দিকে তাকালাম। চকচক করছে কোমড়টা। আমি হাত দিতেই ও সরে দাঁড়াল।

দাঁড়া দাঁড়া একটা জিনিস দেখাচ্ছি।

নীপা দৌড়ে নিচে নেমে এসেছে ও বুঝতে পেরেছে।

তুমি নেবে না, আমি নেবো।

মিত্রা বুঝতে পারেনি। ও চেঁচিয়ে উঠলো কি বলবি তো!

দেখ না।

নীপা মিত্রার কোমড়ে জড়ানো কাপরটা থেকে একটা চারাপোনা বার করলো।

মাছ! মিত্রার চোখ চকচক করে উঠলো।

তুই সাঁতার কাটলি, আবার কোঁচরে করে মাছও ধরে আনলি।

এবার নীপা মিত্রা দুজনে লেগে পরলো। আমি উঠে এলাম। বড়োমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলাম।

দুজনকে বলেছো ব্যাপারটা।

বড়োমা ইশারায় জানালো, হ্যাঁ।

ছোটোমা মুচকি হাসছে।

হেসোনা হেসোনা, মেঘ গর্জন করে, আবার বর্ষায়।

বুবুন এই দেখ।

মিত্রা মাছটা ধরে রয়েছে। মাছটা ওর হাতের মধ্যে ছটফট করছে।

ছেড়েদে।

উঁ। ভেজে খাব।

ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

আজকে অনেকে এসেছে। বাঁশবাগানে জোর খাওয়া চলছে। চিকনারা অনেককে বসিয়ে দিয়েছে। আমি ওখানে একবার গেলাম। চিকনা এগিয়ে এলো।

গুরু সব ঠিক আছে?

বিরাট আয়োজন মনে হচ্ছে।

মুন্নাভাই বলেছে টাকার জন্য কার্পণ্য করবে না। যা লাগবে নিয়ে এসো। সবাইকে পেট পুরে খাওয়াও।

মেনু কে ঠিক করেছে।

মুন্নাভাই দুটো আইটেম বলেছে। বাকি অনাদি, বাসু। তোর জিলিপি আছে, ভাজা হচ্ছে। পইড়্যা ঘরের বুড়ো এসেছে।

যাই একবার দেখে আসি।

আমি রান্নাঘরে এলাম। এবাড়ির রান্নাঘরটা মনে হয় অনেক দিন পর ব্যাবহার হলো। বাসু-অনাদি পইড়্যা ঘরের বুড়োকে ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছে সাইজ কতো বড়ো হবে।

আমি যেতে হেসে ফেললো।

তোর এতক্ষণে সময় হলো।

আমার জন্য কি কিছু আটকে আছে?

অনাদি হেসে ফেললো।

সিগারেট খাবি।

খিদে লেগেছে, খেয়ে নিই।

বুড়ো হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জিলিপি ভাজছে।

একটা কাজ করবি অনাদি।

বল।

আমি পইড়্যা ঘরের বুড়োর কাছে গিয়ে বসলাম।

কাকা।

বল।

তোমার তাবার মতো সাইজের পাঁচটা জিলিপি ভাজতে পারবে।

তুই বললি ভাইজে দিব।

তুমি ভাজো।

অনাদি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাসু হাসছে।

বুঝেছি তুই কি করবি।

পাঁচটা কেন গোটা দশেক ভেজে নিই।

আবার মাখতে হবে।

দূর ও নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।

সঞ্জুকে দেখতে পাচ্ছি না।

ও জেনারেটরটা একবার দেখতে গেছে।

মেলা লোক দেখছি। পরিবেশন করবে কে। গামছাটা কোমড়ে বাঁধি।

তুই আর জালাস না, বড়োমা আস্ত রাখবে না।

হাসলাম।

ম্যাডামকে একবার ডাক কি করে জিলিপি ভাজে দেখে যাক। বাসু বললো।

না। এসে ঝামেলা করবে। অনাদি বললো।

বুবুন তুই এখানে!

বাসু হাসছে। অনাদি মুখ ভ্যাটকাল। চিকনা মিত্রার পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছে।

একটা দে।

অনাদি এই ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বে। ওকে বল।

ও দেবে না। সকাল থেকে আমার ওপর গরম।

মিত্রার কথা বলার ঢঙে অনাদি হেসে ফললো।

কাকা দুটো দাও তো। দিই। নাহলে মাথার পোকা বার করে দেবে।

মিত্রা হাসছে। অনাদি দুটে জিলিপি রসে ভেজান তাবা থেকে তুলে ওর হাতে দিল।

হেবি মাঞ্জা দিয়েছিস।

মিত্রার দিকে তাকালাম।

ছোটোমার কাপর। আমি ভাঙলাম।

জিলিপি কামরেই বললো। মাত্র দুটো।

বেশি খেলে খেতে পারবি না।

ঠিক আছে। হিসেব করে খেতে হবে।

বাসু হাসছে। অনাদি ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে হাসছে।

তাড়াতাড়ি সার। বিকেলে নিরঞ্জনদা প্রোগ্রাম করেছে। আমি বললাম।

কোথায়রে? অনাদি বললো।

চল দেখবি।

উনামাস্টার তোকে একবার ডাকছে। চিকনা বললো।

অনাদি বললো, কোথায়?

ও বাড়িতে। তিন মাস্টারে বসেছে।

কে কে?

উনা, মনা, পোকা।

আরি ব্যাস। চল চল স্যারকে একবার পেন্নাম ঠুকে আসি।

বাসু, অনাদি, আমি, মিত্রা, চিকনা এ বাড়িতে এলাম। কাকা চেয়ারে। বেঞ্চিতে উনা মাস্টার আর পোকা মাস্টার। আর সবাই বারান্দায় সারিবদ্ধভাবে বসে। বড়োমা উনামাস্টারের পাশে বসে জমিয়ে গল্প করছে। আমাকে দেখেই বললো।

আয়। তোর উনামাস্টারের সঙ্গে গল্প করছি। তোর গুণের কথা বলছে।

আমি মাথা নীচু করলাম। সবাইকে একধারসে পেন্নাম ঠুকতে আরম্ভ করলাম। আমার পেছনে লাইন দিয়ে ওরা সবাই।

উনামাস্টার পোকা মাস্টার আমার মিত্রার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। মিত্রা এতদিন আমার মুখে গল্প শুনেছে। দেখেনি। ও অবাক হয়ে দেখছিল। তারপর উনামাস্টারের দিকে তাকিয়ে বললো।

তুমি বুবুনকে মারতে কেন?

দালান শুদ্ধ সব লোক ওর কথা বলার ঢঙে হেসে ফেললো।

উনামাস্টার মিত্রাকে কাছে ডেকে নিয়ে ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বৃদ্ধের হাত থর থর করে কাঁপছে।

ওকে যদি না মারতাম মা তুমি পেতে কেমন করে। ও যে বয়ে যেত।

মিত্রা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে।

তোমায় কথা দিচ্ছি, ওকে আর কোনওদিন মারবো না।

মিত্রা ফিক করে হেসে ফেললো।

তুমি মারবে কি করে, ও এখন বড়ো হয়ে গেছে।

ঠিক বলেছো। এবার আমার হয়ে তুমি ওকে মারবে।

দেখছিস বুবুন, স্যার পার্মিশন দিয়েছে। কথাটা মনে রাখিস।

বড়োমা, নিরঞ্জনদা, ইসলামভাই, ছোটোমা সবাই হাসছে।

যাও বেলা হলো, খেয়ে নাও।

তোমরা খাবে না?

আমরা এ বাড়িতে তোমরা ও বাড়িতে।

আমি স্যারের কাছ গেলাম। আস্তে করে বললাম আপনি খেয়ে নিন কিছু কথা আছে।

আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত আছি। এক ফাঁকে বলিস।

সবাই হই হই করে খেতে বসলাম। আজ মিত্রা আমার পাশে, বড়োমা আর এক পাশে, তার পাশে ছোটোমা। সবাই সারিবদ্ধভাবে বসেছি। কাঞ্চন, লতা, চিকনা পরিবেশন করছে। ওরা আগে খেয়ে নিয়েছে। সঙ্গে নীপার তিন-চারজন বন্ধু আছে। বুঝলাম সবার চোখ আজ মিত্রার দিকে। সবাই টেরিয়ে টেরিয়ে মিত্রাকে দেখছে। ওকে আজ বেশ মিষ্টি দেখতে লাগছে।

প্রথমে ফ্রাইড রাইস পরলো তারপর মাছের চপ তারপর মাংস চলে এলো। এইবার মিত্রার খেলা শুরু হয়ে গেল।

মাঝে মাঝেই আমার দিকে টেরিয়ে দেখে। তারপর বললো। কিরে তুই কম কম নিচ্ছিস।

ওর দিকে তাকালাম। মুচকি হাসলাম।

বড়োমা, কিছু ফন্দি এঁটেছে তাই না?

তুই তো ছিলি ওর সঙ্গে সারাক্ষণ, তোকে কিছু বলে নি।

আমাকে কখনও বলে।

তাহলে।

আমিও কম কম নিই।

ঠকে যাবি। আমি বললাম।

ঠকলে ঠকবো। তুই কম খাবি, আমিও কম খাব।

রাতে পাবি না।

হুঁ চিকনাকে বলবো রেখে দিতে, বাকিটা রাতে খাব।

রাতে অন্য মেনু।

ইসলামভাই হাসছে। হসতে হাসতেই বললো।

না-রে। অনি মিথ্যে বলছে। তুই খা। বিরিয়ানিটা কেমন হয়েছে বল?

দারুণ। বুবুন নেয়নি দেখেছো। শুধু ছুঁয়েছে।

ও খানেওয়ালা লোক নয়। তুই খেতে পারিস। তোর জন্যই বানালাম।

শেষে দই মিষ্টি এলো।

ওদের সবাইকে মিষ্টি দই দিল। আমাকে চিকনা একটা টক দই-এর হাঁড়ি বসিয়ে দিল।

মিত্রার চোখ গোল গোল।

তাই বলি, তুই কম কম খাচ্ছিস কেন। আমাকে পেট পুরে খাইয়ে দিয়ে তুই এখন দই-এর হাঁড়িতে চুমুক দিবি। তোকে খেতে দেব না। ওটা রাতের জন্য থাকবে। সবাই খাব।

ঠিক আছে, চিকনা। দই খাব না। জিলিপিটা নিয়ে আয়।

চিকনা জিলিপি নিয়ে এলো। কড়ার সাইজের এক একটা জিলিপি। বড়োমা দেখে চোখ কপালে তুলেছে। নিরঞ্জনদা, ইসলামভাই হেসেই চলেছে।

ও বড়োমা তুমি কিছু বলতে পারছো না, সব একদিনে খাইয়ে দিলে হবে কি করে।

বড়োমা হাসবে না কাঁদবে এমন ভাবে মুখ করে রয়েছে।

নিরঞ্জনকে বল।

ও নিরঞ্জনদা তুমি কিছু বলতে পারছো না।

নিরঞ্জনদা পাতের দিকে মুখ করে ফিক ফিক করে  হাসছে।

দশটা জিলিপি আছে। নিরঞ্জনদার একটা বড়োমা-ছোটোমার একটা করে মুন্নাভাই-ভজুর একটা করে। বাকি সব তোর।

বড়োমা বললো, আমি পুরোটা খেতে পারবো না।

ছোটোমাও একই কথা বললো।

ছোটোমা-বড়োমার ভাগ আমার। বল এবার দই না জিলিপি। মিত্রার দিকে তাকালাম।

দুটোই খাব। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো। চিকনা জিলিপিগুলো রেখেদাও রাতে খাব। ছোটোমার হাফ আমার, বড়োমার হাফ তোর।

রাখা যাবে না। উঠে দাঁড়িয়ে একটু নেচে নে।

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।

তুমি কিছু বলতে পারছো না। বড়োমার দিকে তাকিয়ে মিত্রা চেঁচাল।

বড়োমা আমার কান ধরে বললো, তুই এতো বদমাশ কেন। ওর পেছনে না লাগলে তোর ভাত হজম হয় না।

সবাই হেসে গড়াগড়ি খায়।

মনে রাখিস তোলা রইলো। এর শোধ আমি নেব। সবার সামনে কান ধরিয়েছিস।

সে তুই নিস, আগে দই-এর হাঁড়িটা দে।

হাসি থেমে নেই।

চুমুক দিয়ে খেতে হবে।

খাব।

বাধ্য হয়ে চিকনাকে বললাম যা গ্লাস নিয়ে আয়।

চিকনা দে ছুট। মিত্রা হাসছে।

কিরকম দিলাম বল।

আমি একটু হেলে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম, দেওয়াচ্ছি দাঁড়া।

বড়োমা শুনতে পেয়েগেছে। মুচকি মুচকি হাসছে।

ছোটোমা আমারা কান ধরে সোজা করলো।

বড়োমা চেঁচিয়ে উঠলো ও ছোটো ছার ছার আমি একবার ধরেছি।

চিকনা গ্লাস নিয়ে এলো। আমি ওকে বললাম। সবাইকে দে। বাকিটা মিত্রাকে দে ও খাবে।

ওমনি তোর রাগ হয়ে গেল। খাব না যা।

তোকে নিয়ে বড় বিপদ। তুই খা না, যতটা পারবি খা, তারপর আমি খাব।

তুই খা, তোরপর আমি খাব।

পাবিনা।

দেখছো বড়োমা কেমন করে।

ছোটোমা হাসছে, মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি দই-এর হাঁড়ি তুলে চুমুক দিলাম।

মিত্রার দিকে তাকাচ্ছি। ও আমাকে একদৃষ্টে দেখছে। ওর তাকানোতে হাসি পেয়ে গেল। আমি কোনওপ্রকারে ঢোক গিলে হাঁড়ি নামিয়ে রেখে। জোড়ে হেসে উঠলাম।

তুই ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকলে খাব কি করে?

তুই আর একবার খা।

না তুই খা।

আমি ওই ভাবে পারব না।

ডাব খাস না।

ওতো স্ট্র দিয়ে খাই।

এখানে স্ট্র পাবি কোথায়। পেঁপে ডাল নিয়ে আসি।

দে চুমুক দিই।

মিত্রা হাঁড়ি মুখে তুললো। বেশি খেতে পারলো না। নামিয়ে রেখে বললো।

পেট আঁই ঢাই করছে। তুই খা। মুখটা কেমন করলো।

জিলিপি।

রাতে খাবো।

মিষ্টি।

রাতে খাবো।

মিত্রার সঙ্গে কথা বলছি ঠিক কিন্তু মিত্রার মুখটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। আমার চোখের ভাষা মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল।

কিরে শরীর গণ্ডগোল করছে!

না।

উঠে পর।

ও আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।

আমি ওকে ধরে তুললাম। ছোটোমা, বড়োমার মুখ শুকিয়ে গেছে। বুঝেছে কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে। আমি ওকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে এলাম।

বমি করবি?

না।

কি মনে হচ্ছে?

দইটা এতো টক গাটা গুলিয়ে উঠলো।

খেতে গেলি কেন?

ওইভাবে খেতে কেমন লাগে দেখছিলাম।

মিত্রাকে মুখ ধুইয়ে ওপরের ঘরে আমার খাটে নিয়ে এসে শোয়ালাম। মিত্রা আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে।

তুই সব সময় টেনসন করিস।

বক বক করিস না। পেটের কাপরটা ঢিলে করে টান টান হয়ে শো।

মিত্রা কাপরটা ঢিলে করে দিল।

ভেতরে কিছু পরা আছে।

ও ফিক করে হেসে মাথা দোলাল।

তোকে এখানে কে দেখবে রে। খোল।

চেঁচাচ্ছিস কেন।

মিত্রা খুলে দিল। আমি আলনায় আমার পাঞ্জাবীর তলায় রাখলাম।

এবার শুয়ে পর।

মিত্রা মাথার বালিসটা টেনে নিল।

কুত্তামুড়া হয়ে শুবি না।

কি বললি?

কিছু না। সায়ার দড়িটা ঢিলে কর।

দাঁড়া বড়োমা আসুক বলবো।

বক বক করতে বারন করেছি।

এবার বল, ব্লাউজের হুক খোল।

এখুনি সবাই চলে আসবে।

আমার কিছু হয়নি।

তখন মুখ ভেটকাচ্ছিলি কেন।

বমি পাচ্ছিল।

লোভী।

তুই ওরকম বলবি না।

তুই ওকে লোভী বলছিস কেন?

পেছন ফিরে তাকালাম।

ছোটোমা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ভেতরে এলো। পেছন পেছন সবাই। ঘর ভরে গেল। বড়োমা গিয়ে মিত্রার মাথার শিয়রে বসলো। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

কি হয়েছিল হঠাৎ। বড়োমা মিত্রার দিকে তাকিয়ে।

গা গোলাচ্ছিল।

আমি ছোটোমার দিকে তাকালাম।

কার্মোজাইম আছে?

আছে।

নীপা ছুট লাগালো।

সকাল থেকে শুধু খেয়ে যাচ্ছে। আমি গজগজ করছি।

তুই রাগ করছিস কেন। না খেলে মানুষ বাঁচে। মিত্রা বললো।

বড়োমা আর ঠিক থাকতে পারলো না। এই গুরুগম্ভীর পরিবেশেও হেসে ফেললো। নিরঞ্জনদা, ইসলামভাইও হাসছে।

এখুনি আমাকে কি বললো জানো ছোটোমা।

কি?

কুত্তামুড়া হয়ে শুবি না।

সেটা আবার কিরে?

নিরঞ্জনদা হাসতে হাসতে বললো, তুই থাম ছোটো।

বাপের জম্মে এমন কথা শুনিনি। বড়োমা বললো।

গ্রামের ভাষা তুমি শুনবে কি করে?

এর অর্থ কিরে নিরঞ্জন।

কুকুরে মতো গুটি সুঁটি মেরে শুবি না।

তুই আমাকে কুকুর বললি।

রাতে খাওয়া বন্ধ। আমি বললাম।

তোর কথায়, ও বড়োমা, ওকে বলো না।

ঠিক আছে একটু শো। এখন বমিভাবটা কমেছে।

একটু আছে।

দইটা খেতে গেলি কেন। আমি বললাম।

তুই খেলি কেন।

আমার পেট আর তোর পেট।

বল কুত্তার পেটে ঘি সয়না।

এদিকে তো টনটনে জ্ঞান আছে।

সবাই আমাদের তরজা শুনে হাসছে।

তুই চুপ কর। ছোটোমা বললো।

আমি কাল সকালে কলকাতা যাব। এখানে ঠিক করে থাকবি। আমায় যদি কাজ ফেলে আসতে হয়। দেখবি মজা।

আর খাবই না।

সবাই মুখ টিপে হাসছে।

নিরঞ্জনদা বললো, যাওয়ার ব্যাপারটা তাহলে কি করবি?

চলো যাব। ও শুয়ে থাকবে। শরীর খারাপ। পরে পরে ঘুমবে।

মিত্রা তড়াক করে উঠে বসলো।

না না আমি ঠিক হেয় গেছি, যেতে পারবো।

আমি ওর দিকে কট কট করে তাকালাম।

আমি তোর সঙ্গে যাব না। বড়োমার সঙ্গে যাব।

বড়োমা মুখ টিপে হাসছে।

নীপা ওষুধ নিয়ে এলো। ছোটোমা দিল। মিত্রা খেলো। আবার শুয়ে পরলো।

ঘণ্টা খানেক বাদে আমরা দুটো গাড়ি করে সবাই রওনা হলাম।

আমরা ছাড়া আমাদের সঙ্গে এল বাসু, চিকনা, অনাদি, সঞ্জু।

আমি এর মধ্যে সঞ্জুর ব্যাপারটা নিয়ে উনা মাস্টারের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেছি। উনি আমাকে না বলেননি। বলেছেন তোর কাকীমার সঙ্গে কথা বলে তোকে জানাব।

কাকা বরং বলেছে অনি যখন আছে তুমি নিশ্চিন্ত হতে পার। ও বেগড়বাই করবে না। খবরটা চিকনার কান হয়ে সঞ্জুর কাছে পৌঁছে গেছে। অনাদি, বাসু দুজনেই খুশি।

জায়গাটা দেখলাম। জায়গা দেখে সবারই পছন্দ হয়েছে। সবাই বেশ খুশী। আমি নিরঞ্জনদাকে বললাম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা করো। আমি দাদাকে বুধবার নিয়ে আসছি। এখানে তিনদিন রাখবো। তুমি কাল চলে যাও, বুধবার একবারে রেস্ট্রি অফিসের সামনে আসবে। ওখান থেকে বাড়ি।

মিত্রা এসে আমার হাতটা ধরলো। আমার মুখের দিকে তাকাল। সূর্য সবে অস্ত যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশের রং একবারে গাড় কমলা। তার ছোঁয়া মিত্রার মুখে।

কিরে মিষ্টি মুখ করাবি না। এতবড়ো একটা কাজ করবি।

আমি ওর দিকে তাকালাম। না পারছি হাসতে, না পারছি কিছু বলতে।

বড়োমা আমার পাশে এসে দাঁড়াল।

তুই ওর কথায় হ্যাঁ বল না। আব্দার করে চাইছে।

এই ফাঁকা মাঠে আমি কি ভেজে খাওয়াব।

হুর-রে বলে চিকনা গাড়ির দিকে ছুট মারলো। মিত্রা পেছন পেছন দৌড়চ্ছে।

নিরঞ্জনদা, বড়োমার দিকে তাকিয়ে বললো। পাগলিটা দৌড়লো কেন!

ওই বা কি নিয়ে থাকে বল। একটু আনন্দ করতে চাইছে করুক।

নিরঞ্জনদা হেসে ফেললো। তুমি ছোটো এদের দুটোকে নিয়ে বেশ আছো।

মিত্রা ছুটতে ছুটতে এলো। দুপুরের ভাজা সেই বড়ো বড়ো জিলিপি নিয়ে। রসগোল্লার হাঁড়ি।

আমি বললাম, এগুলো কোথায় ছিল!

বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি। চিকনা বললো।

সব হজম হয়ে গেছে বিশ্বাস কর। খিদে পেয়ে গেছে। আর বমি হবে না। মিত্রা তরবর করে বলে গেল।

নীপা আমার দিকে তাকিয়ে বললো।

ওরকম করো কেন অনিদা। মিত্রাদি আনন্দ করে বলছে।

সব দেখছি মিত্রার দলে। নিরঞ্জনদা বললো।

ইসলামভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললো, বউনি কর। নাহলে আমরা পাব না।

সবাই হো হো করে হাসছে।

বেশ কিছুক্ষণ সবাই ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে হৈ হুল্লোড় করলাম।

ফেরার পথে নিরঞ্জনদা আমাকে নিজের গাড়িতে তুলে নিল। ওরা সবাই এক গাড়িতে। বুঝলাম নিরঞ্জনদা আমার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে চায়। যতই হোক রাজনীতি করে। আলাদা ভাবে আমাকে বুঝে নিতে চায়। বড়োমা একবার আপত্তি করেছিল। তারপর নিরঞ্জনদার চোখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিল।

গাড়ি চলছে তার মতো। আমি চুপচাপ জানলার দিকে তাকিয়ে বসে আছি। বেশ কিছুক্ষণ পর নিরঞ্জনদা কথা বলা শুরু করলো।

অনি।

বলো।

আজকে তোর আর্টিকেলটা পড়লাম। বেশ ভালো লিখেছিস।

আমি নিরঞ্জনদার দিকে তাকালাম।

শেয়ানে শেয়ানে কোলাকুলি শুরু হলো। নিরঞ্জনদা আমার চোখ দেখে বুঝতে পারলো। এতক্ষণ দেখা অনির সঙ্গে এই অনির অনেক পার্থক্য।

ঝেড়ে কাশো। ভনিতা কোরও না।

আমি জানতাম। তুই এই কথাটা বলবি।

বলো কি বলতে চাও।

তোর আর্টিকেলটা নিয়ে ওখানে অনেক সমস্যা তৈরি হয়েছে।

কোথায়?

কলকাতায়।

তোমাদের পার্টিতে, না আমার অফিসে।

দু-জায়গাতেই।

আমার অফিসে হলে, আমার বুঝে নেবার ক্ষমতা আছে। তোমাদের পার্টিতে হলে। তার দায়িত্ব তোমাদের।

তোকে যদি হ্যারাস করে।

তাহলে বুঝবে তোমাদের অনেক মন্ত্রীর স্বরূপ আমি প্রকাশ করে দেব। বলতে পারো নাঙ্গা করে ছেড়ে দেব। তাতে তোমাদের সরকারে অনেক সমস্য তৈরি হবে। সেটা চাও।

তুই কি বলতে চাস!

তোমরা কেউ ধোয়া তুলসীপাতা নও। এটা মানো?

মানি।

আমার কাছে মলের মতো তোমাদের অনেক মন্ত্রীর উইথ ডকুমেন্টস মেটেরিয়াল রেডি করে পরে আছে। যদি ছেপে দিই তোমাদের সরকারের ভিঁত আমি একাই কাঁপিয়ে দেব।

এর একটা উল্টো রি-এ্যাকসন আছে।

ইসলামভাই-এর সম্বন্ধে তোমাকে নতুন করে বলতে হবে না।

তুই কি বলতে চাইছিস!

তোমার কথার পৃষ্ঠে কথা বলছি। তুমি বুঝে নাও। দীর্ঘদিন রাজনীতি করছো।

আমি জানি তোর শেকড়টা অনেক দূর পর্যন্ত।

জানই যদি, আমাকে বাজাচ্ছ কেন?

আমি জানতে চাইছি।

তুমি অনেক কিছু জানো। প্রকাশ করছো না। তোমার জানা উচিত ছিল তোমাদের হাইকমান্ডের সঙ্গে আমার খাতিরটা খুব একটা কম নয়। আমাকে তাদের প্রয়োজন আছে। মলকে নিয়ে তারা ভাবে না। কয়েকটা আমলার কথায় তারা উঠবে বসবে না।

অনি! তুই কি বলছিস ভেবে বলছিস?

তুমি যদি বড়োমা, অমিতাভদার সম্পর্কে ভাই না হতে তোমার ভিঁতটাও ঝোড়ো হাওয়ার মতো নড়িয়ে দিতাম। তুমি অস্বীকার করতে পারবে।

নিরঞ্জনদা মাথা নীচু করলো।

আমি ঠিক তোকে গেজ করতে পারিনি।

এতদিন রাজনীতি করছো। তুমি কি ভাবলে আমি পুতুলখেলা করতে বসেছি।

না আমি ঠিক ততটা তোকে আণ্ডার এস্টিমেট করিনি।

তোমাকে তোমার হাইকমান্ডের কে আমাকে মনিটরিং করতে বলেছে। নামটা বলো।

নিরঞ্জনদার গালে কেউ যেন একটা থাপ্পর মারলো। আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল।

তুই বিশ্বাস কর, কেউ বলেনি।

তুমি যদি ভেবে থাকো আমাকে কিছু পাইয়ে দিয়ে কাজ হাসিল করবে, তাহলে মনে রাখবে বড়োমা, অমিতাভদা আমাকে আটকে রাখতে পারবে না।

বৃথা তুই রাগ করছিস আমার ওপর।

আমি রাগ করিনি, আমার প্রেডিকশন গুলো অব্যর্থ ভাবে মিলে যাচ্ছে।

তুই বিশ্বাস কর, আমাকে কেউ কিছু বলেনি।

তোমার এটা জানা উচিত ছিল ইসলামভাই-এর মতো লোক আমার একটা কথায় আমার সঙ্গে এখানে চলে এলো। তোমাদের পার্টির সঙ্গে ইসলামভাই-এর রিলেশনটা তোমায় নতুন করে বলে দিতে হবে না।

না, সেটা আমি জানি।

তুমি ইসলামভাই-এর নাম শুনেছো। আগে দেখোনি?

এটা সত্যি।

আজ তুমি জানলে ইসলামভাই ছোটোমার ভাই?

হ্যাঁ। একটু অবাক হয়েছি।

আমি ইসলামভাই-এর সঙ্গে দশ বছর ঘুরছি, আমিও জানতে পারিনি।

এটা কাকাতালীয়।

ঠিক। যাক তুমি তোমার কথা বলো। ট্র্যাক থেকে বেরিয়ে যেও না।

না তুই আমাকে একবার বোঝার চেষ্টা কর।

তুমি সত্যি বলছো না মিথ্যে বলছো আমি এখুনি একটা ফোন করলেই ধরে ফেলব। তুমি প্রমাণ চাও।

না আমি প্রমাণ চাইনা। আমি জানি তোর নেটওয়ার্ক স্ট্রং।

এবার ঝেড়ে কাশো। আমি কাল সকালে কলকাতা যাব।

আমি তোর সঙ্গে যাব।

যেতে পারো। কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে যাব না, আমি সোজা অফিসে যাব।

নিরঞ্জনদা আমার হাতটা ধরে ফেললো। কাকুতি মিনতি করে উঠলো।

তুই আমার ছোটো ভাই-এর মতো। জানিস তো সব। তোকে নতুন করে কি বলবো। পার্টির ভেতরের ব্যাপার। আমাকে কিছু কিছু হুইপ মানতে হয়।

ওটা তোমার ব্যাপার।

তুই আমার এই রিকোয়েস্টটা রাখ। তাহলে আমার কিছুটা সম্মান বাঁচে।

বলো। শুনি।

কালকে একবার সেক্রেটারিয়েটে যাব। তুই আমার সঙ্গে যাবি।

কার কাছে যাবে?

একজন সক্রেটারির কাছে, সিএমের হুকুম।

ওটা তার হুকুম। উনি তোমাকে হুইপ করতে পারেন। আমাকে নয়।

আমি জানি।

ঠিক আছে। তুমি ঘরের লোক বলে তোমার সঙ্গে যাব। কিন্তু নখরামি করলে তার উত্তর আমি কলম দিয়ে দেব।

না না আমি তোকে কথা দিচ্ছি।

আমি কি পাব?

তোকে ছশো একর জায়গাটা ব্যবস্থা করে দেব।

আর।

শুধু তোকে লেখাটা স্টপ করতে হবে।

আমি যাব না। তুমি ফোন করে বলে দাও। ওদের দম থাকলে কিছু করে দেখাক।

তুই এরকম করলে চলে কি করে?

লেখা তিনটে ইনস্টলমেন্টে আছে। আগামীকাল একটা বেরবে পর্শুদিন একটা বেরবে। বাকিটা বেরবে না। এতে যদি রাজি হয় যাব। নাহলে যাব না।

ঠিক, তিনটের বেশি তুই আর লিখবি না।

কথা দিচ্ছি।

এটা নিয়ে তুই আর বেশি জল ঘোলা করবি না।

আমার স্বার্থে আঘাত লাগলেই করবো, নচেত নয়।

ঠিক আছে। আমি কথা বলে নিচ্ছি।

বলো।

নিরঞ্জনদা ফোন করলো। অপর প্রান্ত বুঝলাম ফোনটা রিসিভ করেছে। কথা হচ্ছে। নিরঞ্জনদা আমার কথা ওনাকে বলছেন। মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছে। নিরঞ্জনদা বুঝতে পারছে আমি সব ব্যাপারটা বুঝতে পারছি।

প্রথমে সেই ভদ্রলোক কিছুতেই মানছেন না। নিরঞ্জনদাও অনেক ভাবে কথা বলে ওনাকে বোঝাতে চাইছেন। উনি কিছুতেই বুঝবেন না। শেষ পর্যন্ত নিরঞ্জনদা বললেন, তাহলে আমার হাত থেকে গেমটা বেরিয়ে যাবে।

এই ইনস্টলমেন্ট শেষ হলে আরও বেরবে। আপনি পারলে আটকান।

নিরঞ্জনদার পরবর্তী কথা শুনে মনেহলো ভদ্রলোক একটু ব্যাকফুটে চলে গেলেন।

আমি চুপচাপ বসে আছি। নিরঞ্জনদা কথা বলে চলেছে। শেষে ঠিক আছে। ধন্যবাদ।

নিরঞ্জনদা আমার দিকে তাকাল। মুখে তৃপ্তির হাঁসি।

তুই আমাকে বাঁচালি।

আমি বাঁচাবার কে।

তুই জানিসনা অনি। পার্টি করছি। লতায় পাতায় সকলের সঙ্গে ভাব রাখতে হয়।

এই ব্যাপারটা আমার নেই। আমি ব্যাবসা করতে বসেছি। নোট ফেলবো, ব্যবসা করবো। পারলে তোমাদের নিয়ে দু-চারটে লিখে টাকা ইনকাম করবো। কেউ ধোয়া তুলসীপাতা নয়।

তুই যে বললি হাইকমান্ডের সঙ্গে বসবি।

প্রয়োজন পরলে বসবো। তুমি অতদূর এখনও পৌঁছতে পারোনি।

তুই এইভাবে বলিস না।

যা সত্যি তাই বললাম।

ঠিক কথা, তবু আমারও কিছু ক্ষমতা আছে।

ক্ষমতা থাকলে তোমাকে একটা সচিব বলবে তুমি শুনবে। কাল চলো ওর প্যান্ট আমি খুলবো।

তুই এরকম করিস না।

ছাড়ো তুমি। বলো তো মালটা কে?

তুই এভাবে বলিস না।

ওই যে বললাম, তুমি নিরঞ্জনদা, না হলে আরও রাফ ভাবে বলতাম।

আবাসন সচিব।

আবাসন সচিব! ওটার সঙ্গে তোমার কি সাঁট গাঁট?

কেন তুই চিনিস নাকি!

তোমার সঙ্গে ওই দপ্তরের মন্ত্রীর কি রিলেশন সত্যি করে বলো।

কেন!

ওর ওপর একটা লেখা লিখছি। যখন পাতি পঞ্চায়েত ছিল তখন বহুত বড়ো বড়ো বাতেলা ঝেড়েছিল। এমনকী কৃষকদের নিয়ে মিটিং মিছিল করে বেশ নাম কামিয়েছিল। এখন আবাসন মন্ত্রী বনে গেছে। মন্ত্রী হওয়ার পর এখন সেই কৃষিজমিতে প্রমোটিংয়ের ব্যবসা করতে অনেক বড়োবড়ো ব্যবসায়ীকে সাহায্য করছে। শালা বহুত মাল কামিয়েছে। সব ডকুমেন্টস আমার কাছে আছে।

নিরঞ্জনদা আমার হাত ধরে ফেললো।

কি হলো আবার!

ওর জন্যই তোকে নিয়ে যাচ্ছি।

তুমি খেপেছো। শালা পার্টিটাকে একেবারে শেষ করে দিচ্ছে।

আমি জানি। কিন্তু ওর দোষ নয়। পার্টিকে মাসে মাসে আমাদের ডোনেশন দিতে হয়।

তা বোলে মলকে সরকারি সম্পত্তি ঝেড়ে দেবে। তুমি আমাকে গল্প দিচ্ছ।

আরে ওর ওপর এখন প্রচুর প্রেসার।

থাকবেই, দু-নম্বরি করবে, মাল কামাবে, আর প্রেসার ভোগ করবে না।

মুখ্যসচিব, চিফ মিনিস্টার ফাইল চেয়ে পাঠিয়েছে। তুই সব ফাইলের নম্বর উল্লেখ করে করে লিখেছিস।

হ্যাঁ আমার কাছে সব ডকুমেন্টস আছে।

পেলি কোথায়?

গোয়েন্দা গিরি করছো। পারবে না।

না না বিশ্বাস কর।

সরষের মধ্যে ভূত। তুমি ভূত তাড়াতে পারবে না। বরং বেশি ভূতের জন্ম হবে।

নিরঞ্জনদা হেসে ফেললো।

তোমায় একটা কথা বলবো নিরঞ্জনদা মনে কিছু করবে না।

বল।

তোমাদের অনেক মন্ত্রী-সন্ত্রী, আমলাদের একটা বউ-এ পোষায় না। ওদের অনেক বউ-এর দরকার। আর জানো তো এটা সাপ্লাই আসে কোথা থেকে। আমি আমার জীবনের আঠারো মাস ওখানে কাটিয়েছি।

নিরঞ্জনদা চুপ করে গেল। আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।

কি ভাবছো। অনি বহুত বড়ো বিষ মাল।

না। তোর ইনটেলেক্ট দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি।

বটগাছ, অশ্বত্থ গাছ দেখেছো। ওদের লালান পালন করার কেউ নেই। কিন্তু ওরা মাটি ফুঁরে ওঠে। বেদম ঝড়ে কোনওদিন কোনও বটগাছ কিংবা অশ্বত্থ গাছকে উপরে পড়ে যেতে দেখেছো?

না।

আমার আদর্শ এই দুটো গাছ, আমি ওদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছি। তোমরা আমার কি রি-এ্যাকশন নেবে।

না আমি সেই ভাবে বলতে চাইনি।

তুমি হ করলে হাওড়া বোঝার ক্ষমতা আমার আছে। আমার জায়গায় মিত্রা হলে অন্য কথা ছিল।

আমি জানি, যা ডিসিশন তুই নিবি, মিত্রা নেবে না। তাই তোর সঙ্গে আলোচনা করছি।

এবার আসলি কথায় এসো।

বল।

এই ড্রিলে তোমার কি লাভ?

তুই এইভাবে বলিস না।

শোনো আমি অমিতাভদা, বড়োমা নই। এটা মাথায় রাখো।

নিরঞ্জনদা হো হো করে হেসে উঠলো।

আমি একটা জেলাসভাধিপতি, তুই আমাকে পাত্তাই দিচ্ছিস না।

তোমার মতো জেলাসভাধিপতি এই পশ্চিমবাংলায় ১৭টা আছে।

জানি।

তুমি আমার পাশে বসে যেতে পারছো। তারা স্বপ্নদেখে। এটা মানো?

তুই এটা বাড়িয়ে বলছিস।

তোমার পাশের জেলার সভাধিপতিকে একটা ফোন করো। যে আমি এই হাউসের মালিকের সঙ্গে একই গাড়িতে কথা বলতে বলতে যাচ্ছি। সে কি বলে দেখো। আমি তোমার পেছনে বলছি না।

তা বলে তুই আমাকে একেবারে এলেবেলে পর্যায়ে নামিয়ে আনছিস।

তোমায় একটা সত্যি কথা বলছি শুনে রাখ নিরঞ্জনদা। আমার লেখাটা তোমার হাইকমান্ডের অন্ততঃ একজন বড়োমাথা প্রকাশ হওয়ার আগেই পড়ে ফেলেছে। আর সে পড়া মানেই অন্ততঃ সাতজন মাথা জানে অনি এইটা একদিন নয় একদিন প্রকাশ করবে। তাতে তাদের কিছুটা উপকার হবে। সেখানেও কিছু নিয়ম নীতি আছে। আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছো।

নিরঞ্জনদা আমার দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে।

আমি মুচকি হাসলাম। হাঁ করে কি দেখছো?

দাঁড়া দাঁড়া আমার হজম করতে একটু অসুবিধে হচ্ছে।

হবে। কেননা তুমি একটা পরিবারের ছোটোভাই। খাও দাও ফুর্তি করো। কি ভাবে সংসারটা চলছে তার খোঁজ খবর রাখো না। তোমারটা পেলেই তুমি খুশি। তাই তোমাকে যতটুকু দেওয়ার, ততটুকু দেওয়া হয়েছে। তাতেই তুমি তিড়িং-বিড়িং করছো।

অনি!

আর তোমার হাইকমান্ড পার্টিটা চালাচ্ছে। একটা নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে। তুমি দোষ করলেও পার্টির চোখে তুমি দোষী নও। যতক্ষণ না প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আমি মলের কেশটায় এরকম দু-চারজনের প্রমাণ পার্টির হাইকমান্ডের হাতে তুলে দিলাম। ছিঁচকে গুলো তিড়িং-বিড়িং করবে, পার্টির হাইকমান্ড নয়।

অনি! তুই কি বলছিস!

অনি বলে কোনও লাভ নেই। আমি যা করার করে দিয়েছি। ওদের তুমি বাঁচাতে পারবে না। ওরা আজ না হোক কাল সাসপেন হবে। হয়তো পার্টি থেকে চিরবিদায় নিতে হবে। তুমি যদি তোমার রাজনৈতিক কেরিয়ার স্ট্রং করতে চাও, তাহলে যা বলবো এখন থেকে পঙ্খানুপুঙ্খভাবে শুনে যাও। আখেরে তোমার উপকার হবে। তোমার গদিটা আর তিনবছর। তারপর কি করবে, কিছু ভেবে রেখেছো?

তুই কি বলছিস, আমার মাথায় ঢুকছে না।

একটু ভাবো। দীর্ঘদিন পার্টি করছো। তোমাকে আমি বোঝাব, এই ধৃষ্টতা আমার নেই।

না মনে হচ্ছে তোর সঙ্গে আমাকে রেগুলার যোগাযোগ রাখতে হবে। তুই আমাকে দিন সাতেক সময় দে।

দিন সাতেক নয় তুমি আরও বেশি সময় নিতে পারো।

নিরঞ্জনদা হেসেফেললো।

আমার সম্বন্ধে ভালো করে হোমওয়ার্ক করে নাও।

তুই টিজ করছিস আমাকে।

তুমি দাদার সম-সাময়িক তোমায় টিজ করবো। এবার আমার কাজের কথায় আসি। অনেক হ্যাজালাম।

বল।

রেস্ট্রি বুধবার করবো। সব রেডি করেছো?

না।

তাহলে?

দলিল তুই লিখবি।

যা বাবা! তুমি বললে সব রেডি করে রাখবে।

চল লোকটাকে ডেকে পাঠাই। দলিলটা নিয়ে আসুক। তুই বানিয়ে নে।

সেটা আগে করনি কেন?

সময় পেলাম কোথায়। তুই যে ভাবে পরপর কাজ করে যাচ্ছিস। তারপর কালকে একটা আনন্দের দিন গেল, ভালোলাগলো না।

ঠিক আছে, গিয়ে দলিলটা আমাকে আনিয়ে দাও। আমি বিনিয়ে নিচ্ছি। কাল কলকাতায় থাকবে। পর্শু আমার সঙ্গে আসবে। এটা মাথায় রেখো।

না আমি চলে আসবো।

থাকলে ভালো করতে, তোমার উপকার হতো।

আবার এখানেও আমাকে ঝোলাবি।

তোমার কি কাজ আছে বলো?

তুই জানিস না।

আমার জেনে লাভ নেই। কাল একজনকে দাদার বাড়িতে আনবো। থাকলে তোমার উপকার হতো।

কাকে!

তোমার জেনে লাভ?

তুই ভীষণ তেঁয়েটে।

হাসলাম।

গাড়ি এসে বাজারে থামলো। আমি নামলাম। নিরঞ্জনদাও নামলো। আমি বড়োমার গাড়ির কাছে গেলাম। রবিন দরজা খুলছে। বড়োমা আমায় দেখে মুখটা গম্ভীর করলো।

বাবাঃ গালটা ফুলেগেছে মনে হচ্ছে।

একবারে কথা বলবি না।

পারবে অনির সঙ্গে কথা না বলে থাকতে।

ওই জন্যই….।

আমি বড়োমাকে জাপ্টে ধরলাম। চা খাবে?

কোথায়?

তোমাকে ভাবতে হবেনা। বাসু।

বাসু পেছনেই ছিল। কাছে এলো।

আমার বাড়িতে চল। বড়োমা আর এদিকে আসবে কিনা সন্দেহ।

কিগো যাবে?

কতোক্ষণ লাগবে।

এই দু-মিনিট।

তোর দু-মিনিট মানে আধঘণ্টা।

ওঃ বড়োমা, এতক্ষণ বাদে তুমি একটা সলিড কথা বললে। মন ভরে গেল।

আমি মিত্রার দিকে তাকালাম, তোকে যেতে হবে না। তুই বাসুর দোকানে বোস। আমি বড়োমা….।

তোকেই বাদ দিয়ে দেব।

তাহলে তো খুব ভালো। চল অনাদি, আমরা বাসুর দোকানে বসি।

বড়োমা হাসছে। তোদের কি বয়স হবে না?

তোমার, দাদারও বয়স হয়েছে।

তোর সঙ্গে পারবো না।

নিরঞ্জনদাকে বললাম, এখানে থাকতে থাকতে আমার কাজ সেরে নাও। চা খাওয়ার মধ্যে যেন চলে আসে। তুমি ব্যবস্থা করে এসো।

নিরঞ্জনদা জিভ বার করে ফেললো। সত্যি অনি ভুলে গেছিলাম।

বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল।

চলো আমরা এগোই।

কথা বলতে বলতে আমরা বাসুর বাড়িতে এলাম। এই প্রথম বাসুর বাড়িতে আসছি। সত্যিই মিনিট দুয়েকের পথ।

গেটের মুখে লতা দাঁড়িয়ে ছিল। এগিয়ে এলো।

বাসুর বাড়িটা বেশ সাজানো গোছান। লাইট আছে। শহুরে একটা বাড়ির ক্ষেত্রে যা যা থাকা দরকার তার সব সুযোগসুবিধাই আছে। লতা এগিয়ে এসে বড়োমা, ছোটোমা, মিত্রা এমনকি ইসলামভাইকেও প্রণাম করতে গেল, বাধা পেলো। আমি হাসলাম।

বাড়িতে ঢুকেই মিত্রা লতাকে নিয়ে সটকে গেল। বুঝলাম বাথরুমে গেল। আমি বড়োমার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। বড়োমা ইশারায় বললো যাবে। আমি বললাম যাও। বড়োমা, ছোটোমাও গেল। আমি বাসুর বাড়িটা ঘুরে ফিরে দেখলাম। চিকনা বাইক নিয়ে এসে দাঁড়াল।

গুরু চারিদিক মেপে নিচ্ছ।

হ্যাঁ। তুই কোথায় গেছিলি?

বিস্কুট নিয়ে এলাম।

অনাদি কোথায়?

নিরঞ্জনদা কোথায় পাঠাল।

আসবে না?

নিরঞ্জনদার সঙ্গে আসছে। নিরঞ্জনদার চেলুয়ারা এসেছে।

তারা আবার কোথায় ছিল?

তোর বাড়িতে বসেছিল। তারপর শুনলো এখানে এসেছে। চলে এলো।

কোথায় বসেছে?

বাসুর দোকানে।

ওদের চা দিতে হবে।

রাখ তুই, সব ধর্মাবতার।

হাসলাম।

চিকনা ভেতরে গেল। আবার বেরিয়ে এলো। চল একটু অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাই।

ভালো লাগছে না।

তাহলে থাক।

চিকনা, পর্শুদিন সকালে রেস্ট্রি অফিসে যাবি নীপাকে সঙ্গে নিয়ে। ওই দিন কোনও কাজ রাখবি না।

চিকনা মাথা নীচু করে আছে।

সত্যি তুই যা বলছিস তাই হবে?

আমি কি মিথ্যে বলছি। তোর কি মনে হচ্ছে?

ঈশ্বর আমার দিকে এমন ভাবে মুখ তুলে তাকাবে, ভাবিনি।

চিকনার গলাটা ভারি হয়ে এলো।

কেন অনির ওপর বিশ্বাস নেই?

তুই এভাবে বলিস না।

চিকনা চোখ মুছছে। আমি চিকনার দুই কাঁধে হাত রাখলাম।

চিকনা এটা একটা নতুন জীবন। অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা আসবে। তাকে ওভারকাম করতে হবে। লক্ষ্য স্থির রাখবি। তুই আমার কাছে চেয়েছিলি। আমি সময় নিয়েছিলাম।

তুই পাশে থাকলে আমি লড়ে যাব। তুই শুধু বলে দিবি এই ভাবে এই ভাবে কাজ কর। দেখবি একবারে ফেল হবে না।

আমি তোর পাশে আছি।

কোথায়? তুই ম্যাডামকে আর নীপাকে রেখেছিস।

না এটায় আমি আছি।

সত্যি।

হ্যাঁ।

অনাদি বললো, আমি, নীপা আর ম্যাডাম।

অনাদি জানেনা। এবার মেশিনের ব্যবস্থা কর। কাল আমি কলকাতা যাচ্ছি।

কবে আসবি?

পর্শুদিন আসবো। সঞ্জুকে বলে এদিককার ব্যবস্থা পাকা কর।

ঠিক আছে।

যার যা পাওনা মিটিয়ে দিয়েছিস?

হ্যাঁ।

কতো আছে?

নীপা জানে। নীপার কাছে আছে।

লিখিয়ে নিয়েছিস?

হ্যাঁ। নীপা খাতায় লিখিয়ে নিয়েছে।

এবার জোড় কদমে লেগে পর।

কালকেই একশোমোন ধান উঠবে।

রাখার ব্যবস্থা করছিস।

তোর বাড়িতে যতটা পারি রাখছি। তারপর স্যারকে বলেছি। স্যার অনুমতি দিয়েছে।

দু-টো বড় হামার ঘর তৈরির ব্যবস্থা কর।

পাঁচুকে বলেছি। ও সব ব্যবস্থা করছে। তোর হামার ঘরটা নষ্ট হয়ে গেছে। ওটাকে একটু সারিয়ে নিয়েছি। একটা কথা বলবো।

বল।

অনাদি পার্টির কয়েকটা ছেলেকে নিতে বলছে।

অনাদি আমাকে বললো না কেন?

লজ্জা পাচ্ছে। তুই যদি কিছু মনে করিস।

তোর দরকার পরলে নে।

আমার লাগবে। এবার রাতে শোয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে।

সে তুই ভাববি।

অনি। বড়োমার গলা।

যাচ্ছি।

দেখলাম মিত্রা গেটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি এগিয়ে গেলাম।

তুই অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছিলি!

তোকে দেখছিলাম।

চল, বড়োমা তোকে আচ্ছা করে দেবে।

আমি ওর কাছে এসে মুচকি হাসলাম।

ওমা, দেখছি সাগরেদও আছে!

সাগরেদ নয় তোর বিজনেস পার্টনার।

খালি বক বক। দিলো আমার কোমরে চিমটি।

বড়োমা আমাকে মারলে তুই খুব আনন্দ পাস। তাই না?

মিত্রা মাথা দুলিয়ে বললো, ভীষন।

মিত্রার মুখটা দেখলাম। এখন অনেকটা ফ্রেশ।

ভেতরে এলাম। বড়োমার পাশে বসলাম। ছোটোমা, ইসলামভাই, নীপা খাটে, ভজু নিচে বড়োমার পাশে। চিকনা খাটে বসলো। বাসু খাটের এককোনে।

তুই খাটে যা।

কেন?

তুই সবসময় বড়োমার পাশে বসবি কেন?

ঠিক আছে আজ থেকে ছোটোমা আমার তোকে বড়োমাকে দিয়ে দিলাম।

ইঃ কতো খায়। একটাও তোর নয়।

আমি ছোটোমার পাশে গিয়ে বসলাম। বড়োমার দিকে তাকিয়ে বললাম। সব খবর নেওয়া হলো।

কার।

বাসুর।

তুই কি করে জানলি?

জানলাম।

বিজ্ঞের মতো কথা বলিস না। মিত্রা তোকে কুচুর কুচুর করে বলেছে।

নাগো বড়োমা আমি বলিনি, ও মিথ্যে কথা বলছে।

আমি হাসছি। চা হলো।

হয়ে গেছে। বাসু বললো।

লতা ঘরে ঢুকলো।

একবারে শহুরে ঢঙে লতা সব নিয়ে এলো। চা চায়ের সঙ্গে পাঁপর ভাজা। বেশ ভালো লাগলো। পেছনে একটা কাজের মেয়ে। হয়তো পাশেই থাকে।

চা নিলাম।

বাইরে বাইকের আওয়াজ পেলাম। অনাদির গলা পেলাম। বুঝলাম নিরঞ্জনদা এলো। দুজনে ঘরে ঢুকলো। বাসু উঠে দাঁড়াল। পাশের ঘর থেকে একটা চেয়ার নিরঞ্জনদার জন্য এনে দিল।

নিরঞ্জনদা ঘরে ঢুকেই আমার হাতে দলিলটা দিয়ে বললো।

এই নে তোর কাজ করে দিলাম। এবার আমার বৈতরণীটা উতরে দে। এরই মধ্যে দু-বার ফোন হয়ে গেল।

হাসলাম। চায়ে চুমুক দিলাম।

বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ছোটোমা, ইসলামভাই-এর একই অবস্থা। ওরা ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেনি। নিরঞ্জনদা হঠাৎ এই ভাবে কথা বলার কারন কি?

খোঁজ নেওয়া হয়ে গেছে মনে হয়? আমি নিরঞ্জনদার দিকে তাকালাম।

কি করে জানলি!

তোমার কথার ভাঁজে।

সত্যি অনি তুই একটা ছেলে বটে। তুই কি আমার ফোনেও আড়ি পেতেছিস।

ইসলামভাই হাসতে গিয়ে গায়ে চা ফেললো।

ছোটোমা হাঁই হাঁই করে উঠলো। তোকে ওরকম ভাবে হাসতে কে বলেছে?

আমি গম্ভীর।

মিত্রা তুই গিয়ে একটু খাটে বোস। ওকে এখানে পাঠা। বড়োমা বেশ গম্ভীর হয়ে বললো।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে শুর শুর করে চলে গিয়ে বড়োমার পাশে বসলাম। বড়োমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছি না। চা খেয়ে যাচ্ছি। বুঝছি বড়োমা এবার আমাকে জিজ্ঞাসা করবে। না জানতে পারলে, পেট ফুলে যাচ্ছে।

কিরে, নিরঞ্জন কি কথা বলে? বড়োমা ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকাল।

জিজ্ঞাসা করো?

ওতো বললো। তুই চুপ করে আছিস কেন। ওর পেছনে আবার লেগেছিস নাকি?

ছ্যাঃ তোমার ভাই বলে কথা। নিরঞ্জনদার সামনে বলছি। জিজ্ঞাসা করো?

কিরে নিরঞ্জন কি হয়েছে?

না কিছু হয়নি। একটা সমস্যা হয়েছে। অনি সমাধান করতে পারবে, তাই তেল দিচ্ছি।

এই বার ছোটোমা হেসে ফললো। তুমিও অনিকে তেল লাগাচ্ছ।

আর বলিস না। হাতি যখন কাদায়….।

উঁহুঁ তুমি হাতি নও। আমি চামচিকে নই। তুমি একথা বলতে পারো না। তোমাকে তখনও বলেছি। এখনও বলছি। বড়োমা, দাদা যদি না থাকতো আমি কি করতাম, তাও তোমায় বলেছি।

কি হয়েছেরে নিরঞ্জন, তুই আমাকে বল, দিই ওর কানটা ছিঁড়ে।

তুমি মুখে বলছো কেন, তোমার হাত নেই। মিত্রা চেঁচালো।

বড়োমা আমার পিঠে হাত রাখলো।

কানটা ধরো।

আমি হাসছি।

কি হয়েছেরে, দু-জনে গাড়িতে একসঙ্গে এলি। তুই হাসতে হাসতে নামলি। নিরঞ্জনের মুখটা কেমন যেন থম থমে দেখলাম।

বাবা তোমার চোখ আছে। অন্ধকারেও তুমি নিরঞ্জনদার মুখটা দেখতে পেলে!

কথা ঘোরাস না, সত্যি কথা বল।

নিরঞ্জনদা তোমায় সব বলবে, আমি বলবো না।

ঠিক আছে।

আমি কাল সকাল বেলা কলকাতা যাব। পর্শুদিন দাদাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসবো।

কি মজা। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।

থাম তুই। মজা দেখছিস। ও কি পাকিয়ে রেখেছে দেখ। বড়োমা বলে উঠলো।

নিরঞ্জনদা আমার দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন চায়ে চুমুক দিয়ে চলেছে। ইসলামভাই ভালোকরে মাপছে দুজনকে। ও ধরতে পেরেছে, কিছু একটা হয়েছে।

চলো এবার উঠি, কালকে আবার ভোর ভোর বেরতে হবে। দাদার সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে?

বড়োমার দিকে তাকালাম।

কেন তোর সঙ্গে হয়নি?

সকালের পর হয়নি।

আমাকে যে বললো।

পকেট থেকে ফোনটা বার করতেই বড়োমা ফিক করে হেসে ফেললো।

নিরঞ্জনদা, কাল তোমার গাড়িতে যাব। অসুবিধে নেই তো?

নিরঞ্জনদা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে।

আরে বাবা, আমি যাব বললাম তো।

নিরঞ্জনদা ঠায় আমার দিকে তাকিয়ে।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। নিরঞ্জনদার কাছে এগিয়ে গেলাম।

চলো। আমি যাব। তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?

তুই দাদার হলে যে ভাবে ইনিসিয়েটিভ নিস, আমার জন্য নিচ্ছিস না।

তোমার থেকে দাদাকে বেশি ভালোবাসি, তাই। তুমি চাপ নিয়ো না।

সবাই একসঙ্গে বেরিয়ে এলাম। ট্রলিতে আমি আলাদা বসতে চাইছিলাম। বড়োমা বললো, তুই আমার ট্রলিতে আয়। তাই করলাম। অনেক ভাবে আমার কাছে জানতে চাইল। আমি চুপচাপ। বললাম তুমি নিরঞ্জনদার কাছ থেকে জেনে নেবে।

শেষে ছোটোমা বললো দিদি তুমি থামো। কলকাতা থেকে ফিরে এসে তোমায় সব বলবে। ও আগে ওর কাজ সারুক।

তাই হলো। ট্রলিতে যেতে যেতে আর বিশেষ কথা হলো না। সবাই চলে এলাম।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/CBgKlUi
via BanglaChoti

Comments