কাজলদিঘী (৫৪ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

৫৪ নং কিস্তি
—————————

আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।

মিত্রা ফাইল খুললো, অনেকগুলো দলিল। তার মধ্যে থেকে একটা খাম বের করে নিয়ে এলো। একটা ছবি আমার হাতে দিল। ফটোটা লাল হয়ে গেছে। আমি কাছে নিয়ে এসে ভালো করে দেখলাম। বছর বাইশ তেইশ বয়স হবে মেয়েটার। ছবিটা উল্টে দেখলাম স্টুডিওতে তোলা। বড়োমার মুখশ্রীর সঙ্গে কিছুটা মিল আছে।

আমি অনেকক্ষণ ফটোটা লক্ষ্য করলাম। মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

চিনতে পারছিস?

মনে হচ্ছে বড়োমাকে যদি এই বয়সে নিয়ে যাই, তাহলে ছবিটার সঙ্গে বড়োমার মুখশ্রী মিলে যাবে।

মিত্রা আমাকে জাপ্টে ধরে ঠোঁটে চুমু খেলো।

দ্যাটস রাইট বুবুন, তুই একেবারে ঠিক কথা বলেছিস।

তাই!

মিত্রা চোখের ভাষায় আর ঘাড় দুলিয়ে, হ্যাঁ বললো।

তুই পেলি কোথায়?

প্রশ্ন করবি না। শুধু দেখে যা। আমি তোর মতো হতে পারছি কিনা বল।

এবার এই ছবিটা দেখ।

বিবাহ বাসরে তোলা ছবি। সবে বিয়ে হয়েছে। একজন মিত্রার বাবা আর একজন সেই ভদ্রমহিলা মানে বড়োমা। তারমানে বড়োমার সঙ্গে মিত্রার বাবার বিয়ে হয়েছিল! আমি মিত্রার দিকে তাকালাম। মিত্রা আমার চোখের দিকে জুল জুল করে চেয়ে আছে। আমি কি বলি।

তোর বাবার সঙ্গে বড়োমার বিয়ে হয়েছিল!

ইয়েস ইয়েস বুবুন তুই একেবারে ঠিক।

মিত্রার চোখ দুটো চক চক করে উঠলো।

তুই প্রমাণ পেলি কি করে!

মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরলো, তোকে সব বলবো বুবুন, তুই যে আমার সব, তোকে বলতে না পারলে আমি শান্তিতে মরতেও পারবো না।

এই দেখ একটা পোস্ট কার্ড।

হাতে নিয়ে পড়লাম। ফর্মাল চিঠি, কন্যাদায় গ্রস্ত পিতা আর একজনের পুত্রের সঙ্গে তার মেয়ের বিবাহ দিতে চান। নিচে বসিরহাটের ঠিকানা। আর মিত্রাদের বাড়ির ঠিকানা।

পড়লি।

আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।

জানিস বাবা এরপর বড়োমাকে দেখতে যান, পছন্দ হয়, বিবাহ হয়। বাবা তার দিনলিপিতে এটা লিখে গেছে। তোকে পড়াব। তারপরের ঘটনা তুই জানিস। বড়োমা পীরসাহেবের থানে নিজে মুখে সব স্বীকার করেছে। তোকে নতুন করে কি বলবো। বাবা আর কোনওদিন বিবাহ করেননি।

আমি চমকে মিত্রার দিকে তাকালাম।

ভাবছিস আমি পৃথিবীর আলো দেখলাম কি করে?

আমি এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।

আমি তোকে ফাঁকি দিতে চাইনি বুবুন, তুই বিশ্বাস কর। আমি ভীষণ লোভী।

মিত্রা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো।

আমি মিত্রাকে কাছে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।

মিত্রা আমার বুকে মাথা রেখেছে। চোখ বন্ধ। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আমি মিত্রার গালে আসতে করে থাপ্পর মারলাম। মিত্রা চোখ খুললো।

কিরে, শরীর খারাপ লাগছে।

মিত্রা অস্ফুট কিছু বলতে চাইল, বলতে পারল না।

আমি জলের বোতলটা কাছে টেনে নিয়ে মিত্রার চোখে জল দিলাম। আমার পরনের কাপরটা দিয়ে মুছিয়ে দিলাম।

কষ্ট হচ্ছে।

মিত্রা আমর দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

যে কথা ছ-বছর ধরে নিজের বুকের মধ্যে বয়ে বেরিয়েছি, আজ তোকে বললাম। তুই ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তি জানে না।

একটুক্ষণ থেমে।

বুকের ভেতরটা ভীষণ ব্যাথা করছে, জানিস বুবুন।

ব্লাউজের হুকটা একটু খোল আমি হাত বুলিয়ে দিই।

না থাক, একটু সহ্য করতে শিখি। তুই আমার থেকে আরও কষ্ট পেয়েছিস।

আমি মিত্রার মুখটা বুকে জড়িয়ে ধরলাম।

নারে বুবুন সত্যি। এখন তুই আছিস, আমার আর ভয় নেই। আমার আর কিছু হবে না, তুই দেখিস।

আমার নিজেরও খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কি করবো, প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু কষ্ট আছে। যা সম্পূর্ণ ভাবে তার নিজস্ব। সেটা ভাগ করে নেওয়া যায় না। হয়তো অনুভব করা যায়। তার কষ্টের সমব্যাথী হওয়া যায়। কিন্তু শেয়ার করা যায় না।

জানিস বুবুন, বড়োমা যে দাদার সঙ্গে থাকেন, বাবা সেটা জানতেন।

উনি জানতেন! তা সত্ত্বেও….

বাবার দিনলিপি তার প্রমাণ।

জানিস, বাবা মারা যাবার আগে আমার আর মার মধ্যে প্রপার্টি ভাগ করে দিলেন।

মিত্রা আমার ডানহাতটা ওর হাতে তুলে নিল।

তখনই আমার একটা খটকা লেগেছিল। কিন্তু কাউকে বলিনি। বাবা আমার বয়ফ্রেন্ড। বাবার কাছে আমি কখনও কোনও কথা কোনওদিন গোপন করিনি। সিনেমা হলে তোর হাত নিয়ে যেদিন বুকে রেখেছিলাম বাবাকে এসে অকপটে সব স্বীকার করেছি।

বাবা হেসে বলেছিলেন ছেলেটাকে তুমি একবার আমাকে দেখাতে পার। আমি মাথা দুলিয়ে বলেছিলাম, পারবো। উনি বলেছিলেন কবে? আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম, ও ভীষণ মুডি, আমার ইচ্ছের ওপর আসবে না। বাবা হেসেছিলেন। একটু মনে করে দেখ তারপর তোকে প্রথম আমাদের বাড়িতে নিয়ে গেছিলাম।

স্বরস্বতী পূজোর দিন।

এই তো তোর মনে আছে।

সেই দিন বাবার আচার আচরণে তুই কিছু বুঝতে পেরেছিলি।

কাঁচা মন, তখন এতো সব ঘোর-প্যাঁচ বুঝতাম না। সত্যি কথা বলতে কি তখন আমার চোখে সব রঙিন। গ্রাম থেকে একটা ছেলে শহরে এসেছে। কেরিয়ার তৈরি করতে হবে। কলেজে দাদা হতে হবে, একটা হামবড়াক্কি ভাব। মাঝে মাঝে সেই দিনের কথা মনে পড়লে নিজের মনে নিজে হাসি।

বাবা তোকে দেখার পর, তোর সঙ্গে কথা বলার পর বলেছিলেন আমার অমত নেই।

মিত্রা আমার দিকে তাকাল।

তুই একটু ভেবে দেখ, তখন আমাদের থার্ড ইয়ার চলছে। তুই পার্ট ওয়ানে ফার্স্টক্লাস পেয়েছিস।

হ্যাঁ।

আমাদের ঘনিষ্ঠতা এরপর আরও বেড়েছে। তুই আমাদের বাড়ি এসেছিস কম, কিন্তু আমি তোর হোস্টেলে প্রায় গেছি।

ঠিক।

জানিস বুবুন, বাবা মারা যাবার পর আমি নিজেকে নিজে নতুন ভাবে আবিষ্কার করলাম, আমি কে?

কলেজে পড়ার সময় আমি জানতাম না কে আমার মা? ছোট থেকে জানতাম আমার মা আমার জন্মের পর আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। আমি জ্যেঠিমনির কাছেই মানুষ। জ্যেঠিমনি আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন।

মিত্রা!

হ্যাঁ বুবুন তুই বিশ্বাস কর। আমি তোকে….

মিত্রার চোখ দুটো জলে টল টল করছে। আমি ঠোঁট দিয়ে তা মুছে দিলাম।

তুই আমার মা বলে যাকে আজ সকালে প্রণাম করলি, সে আমার মা নয়।

আমি মিত্রার চোখের দিকে স্থির চোখে তাকালাম। কি বলতে চায় মিত্রা?

আমি বাবার ঔরস জাত জ্যেঠিমনির সন্তান। বাবার সঙ্গে জ্যেঠিমণির অবৈধ সম্পর্ক ছিল।

আমি মিত্রার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি।

একমাত্র বাবা আর জ্যেঠিমনি ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ জানত না। আমি হওয়ার পর বাবা আইনত জ্যেঠিমনির কাছ থেকে আমাকে দত্তক নিয়েছিল।

মিত্রা থামলো।

তুই বিশ্বাস কর আমি এতোসব জেনেছি বাবার দিনলিপি পড়ে। বাবা ডে টু ডে ডিটেলসে সব লিখেছে। এমনকি জ্যেঠিমণির সঙ্গে কবে কবে সেক্স করেছে তাও।

জ্যেঠু।

জ্যেঠু আমার হওয়ার মাস তিনেক আগে মারা গেছেন। সেটা সুইসাইড ছিল।

কেন?

তুই বুঝে নে।

তোর যে আর এক বোন ছিল।

ওটা জ্যেঠুর।

তাহলে তোর মা বলে যাকে দেখেছি?

উনি আমার বাবার সেক্স পার্টনার। বলতে পারিস ক্যাশ বাক্স। আমি যেমন ছিলাম শয়তানটার। বাবার সঙ্গে ওনার বয়সের ডিফারেন্স প্রায় কুড়ি পঁচিশ বছরের। ওনার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সূত্রেই বাবার আলাপ। পয়সাওয়ালা ঘরের মেয়ে। বাবা কোনওদিন ওনাকে বিয়ে করেননি। এই বাড়িটা কিনে উনি এখানে ওনাকে রেখেছিলেন।

কিন্তু আমি তো ওনাকে ও বাড়িতে দেখেছি।

দাদু খুব স্ট্রিক্ট প্রিন্সিপালের মানুষ ছিলেন। দাদু যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন ওনার প্রবেশাধিকার ছিল না। দাদু মারা যাবার পর উনি ওই বাড়িতে প্রবেশাধিকার পান।

তারপর!

এনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর জ্যেঠিমনির সঙ্গে বাবার দূরত্ব বেড়েছে। জ্যেঠিমনি প্রথমে আমাকে দিতে চাননি। পরে দাদুর চাপে আর বাবার ব্ল্যাকমেলিংয়ে আমাকে দিতে বাধ্য হন। হাঁড়ি আলাদা হয়েছে। তুই ওপর থেকে কিছু বুঝতে পারিসনি।

তুই কাকে মা বলতিস?

জ্যেঠিমনিকে। ওনার কাছেই তো ছোট থেকে মানুষ।

তাহলে এই মা।

কলেজ লাইফে এসে পেলাম।

তখন তুই কিছু বলিসনি?

একথা কাউকে বলা যায়। আমার বাবা বিয়ে করেছেন।

তাহলে তুই তোর বাবাকে ভালো লোক বলিস কি করে?

শোন আমার কথা।

আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।

বড়োমার সঙ্গে ওই ব্যাপারটা ঘটে যাবার পর। বাবা মেন্টালি ডিসব্যালেন্সড হয়ে যান। অসুস্থ হয়ে পরেন। তারপর জ্যেঠিমনির সেবা শুশ্রুষায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। বলতে পারিস এই প্রিয়েডটাতেই জ্যেঠিমনি বাবা ক্লোজ হয়ে পরেন।

জ্যেঠু কি করতো?

পারিবারিক ব্যবসা, কাগজ। তখন শেয়ার অত্যন্ত কম ছিলো। পাঁচ পার্সেন্ট।

তোর বাবা কি করতেন?

কাগজ দেখতেন। আর শেয়ারের কারবার। বলতে পারিস ব্রোকার। আমার তথাকথিত মার পরিবারেরও শেয়ারের ব্যবসা। বাবার প্রচুর উচ্চাকাঙ্খা ছিল। বাবা, মার বাড়ির সম্পত্তি পায়। কাগজের ভাগটাও কিছুটা সেই পরিবারের।

মানে!

আমার মার পরিবার দামানি। ওরা অবাঙালি।

তারপর?

বাবা মার কাছ থেকে তার সম্পত্তি জোড় করে লিখিয়ে নেন। মানে কাগজের ভাগ। তারপর কাগজটাকে আসতে আসতে নিজের কুক্ষিগত করেন। আমাদের পরিবারের ফাইভ পার্সেন্ট শেয়ারও নিয়ে নেন। বাড়িটা জ্যেঠিমনিকে ছেড়ে দেন।

টোটাল প্রপার্টি!

হ্যাঁ ফাইভ পার্সেন্টের যা মূল্য।

বাবা জানতেন বড়োমা অমিতাভদার স্ত্রী হিসাবে অমিতাভদার কাছে থাকেন। দাদা দামানিদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। মিঃ দামানি আর আমার দাদু দুজনে বন্ধু মানুষ। মিঃ দামানি দাদুকে শেয়ারটা কিনিয়ে দিয়েছিলেন। ওদের হাতেই সিংহভাগ শেয়ার ছিল। বাকিটা আর তিন চারজনের কাছে।

তারপর।

বাবা অমিতাভদাকে কব্জা করার জন্য ছলে বলে কৌশলে সব শেয়ার কিনে নিলেন। বলতে পারিস ঘুরিয়ে বড়োমাকে শাস্তি দান। কিন্তু মা-র বাবা আমার মামাদাদু খুব ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন তা করতে দেননি। বাবা মারা যাবার বছর খানেক আগে মামাদাদু মারা যান। বাবা দামানিদের পুরো শেয়ারটা নিয়ে নেয়।

তখন বাবার অনেক পয়সা। দারুণ প্রতিপত্তি। কাগজটা বাবা পুরোপুরি কব্জা করে ফেলেছেন। কিন্তু আমার তথাকথিত মার সঙ্গে বাবার দূরত্ব বেড়ে যায়। মা আমাকে একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। বাবার সঙ্গে প্রায় ঝগড়া করতেন। সেই সময় বাবার ক্যানসার ধরা পরলো। মার নতুন বন্ধু ডাক্তারের প্রবেশ। মার সঙ্গে রেগুলার ঝগড়া। বাবার অসহায় মুখটা মনে পড়ে যায়।

জ্যেঠিমনির কাছে যাই। দু-একদিন এসেছিলেন। মা, বাবার অমতে জোর করে সেই শয়তানটার সঙ্গে আমার ম্যারেজ রেজিস্ট্রি করায়, তলারও খাবে গাছেরও কুরবে। এটা বলতে পারিস বাবার প্রতি মার রিভেঞ্জ। আমি তখন দিশেহারা। এক কথায় বলতে পারিস বলির পাঁঠা। আমি না পারছি ও বাড়িতে ফিরে যেতে, না পারছি এ বাড়িতে থাকতে। তখন আমার মনের কি পরিস্থিতি তোকে বোঝাতে পারবো না।

তারপর!

বাবা মারা গেলেন।

ব্যাশ আমি, মা শয়তানটার হাতের পুতুল। কাগজের সম্পত্তি আর কিছু প্রপার্টি আমার নামে ছিল। মিঃ দামানি মানে আমার দাদুও আমাকে কিছু প্রপার্টি লিখে দিয়ে যান। শেষে মা শয়তানটার চাল বুঝতে পারলেন। তাই আমার নামে নিজের প্রপার্টির কিছুটা লিখে দিয়ে যান।

তোর মায়ের কোনও ভাই ছিল না?

না। মা দাদুর এক মাত্র মেয়ে।

দাদুর অবর্তমানে বাড়িটার কি হাল হোল?

রি মডেলিং করে নার্সিংহোম হয়েছে।

তারপর?

এরপর পুরনো বাড়ির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রইলো না। বাবা থাকতে যেটুকু ছিল বাবা মারা যাবার পর তা একদম তলানিতে ঠেকে গেল। তারপর সব শেষ। আমি তখন গা ভাসিয়ে দিয়েছি। শয়তানটা মার শরীর খারাপের বাহানায় স্লো-পয়জন করে মেরে দিল।

মরার আগে মার নামে যেটুকু প্রপার্টি ছিল নিজের নামে সই করিয়ে নিল। আমি তখন ওর হাতের পুতুল। ওর ভাগ্না সুনীত কাগজ দেখে। আমি শুধু সই করি। কাগজে একটু একটু যেতে শুরু করেছি। বাবার ডাইরী পড়ে সব জেনেছি। নিজের মনকে শক্ত করেছি।

একদিন কাগজের একটা অনুষ্ঠানে বড়োমাকে দেখলাম। সেদিন বড়োমা আমাকে দেখেনি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম এই ভদ্রমহিলা আমার বাবার জীবনটা নষ্ট করেছে। আমার বাবা এতো খারাপ লোক ছিলেন না। আমি ওনাকে সঠিক শাস্তি দেব। বলতে পারিস আমিও প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠলাম।

যে ভাবেই হোক আমাকে এই গাছটা কেটে ফেলতে হবে। ফার্স্ট টার্গেট মল্লিকদা, অমিতাভদা। সেই ভাবে প্ল্যান প্রোগ্রাম তৈরি করতে শুরু করলাম। দেখলাম সুনীতদা সম্পাদক হওয়ার জন্য উঠে পরে লাগলো। আমি সুযোগটাকে কাজে লাগালাম।

এই সময় ধুমকেতুর মতো তোর সঙ্গে একদিন ক্লাবে দেখা। তুই আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইলি। বাবার কথাটা মনে পড়ে গেল। অনি এলে ওকে কখনও ফিরিয়ে দিবি না।

তোর বাবা জানতেন না আমি ওই কাগজে আছি।

জানলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। তুই জানতিস, বাবা ওই কাগজের মালিক?

না।

বাবা বেঁচে থাকাকালীন মা যখন চাপ সৃষ্টি করছে শয়তানটার সঙ্গে রেজিস্ট্রীর জন্য, তখন তোর খোঁজ বার বার করেছি। শুভঙ্করবাবুর কাছে গেছি। কার কাছে যাইনি তোর খোঁজ নিতে। লজ্জার মাথা খেয়ে শেষমেষ ড. রায়ের কাছেও একবার গেছি।

প্রতিটা জায়গা থেকে হতাশ হয়ে ফিরেছি। তারপর নিজের মনকে বুঝিয়ে সব মেনে নিয়েছি। তখন তোর মিত্রা বাজারের দেহপসারিণীর থেকে খুব একটা কম যায় না। বলতে পারিস সফিসটিকেটেড বাজারী মেয়ে।

আমি মিত্রার মুখটা চেপে ধরলাম। মিত্রা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমার বুকে মুখ গুঁজলো। বেশ কিছুক্ষণ কাঁদার পর ও থামল।

আজ বিগত দশ মাসে আমার জীবনটা তিনশো ষাট ডিগ্রী ঘুরে গেছে।

জানিস বুবুন তখন রেগুলার ড্রিঙ্ক করতাম। বেলেলাপণার চূড়ান্ত। যে কোনও পুরুষকে জড়িয়ে বলরুমে ড্যান্স করতাম। ভাবতাম এ ভাবেই আমার জীবনটা শেষ করে দিতে হবে। কাগজের ব্যাপার তখন কিছু বুঝতাম না। বুঝেও বা লাভ কি। তখন আমার পার-ডে হাত খরচ পাঁচ হাজার টাকা। বাকি সব বাদ দে।

তোর খোঁজ খবর নিতে শুরু করলাম। দু-তিনবার দাদাকে ডেকে পাঠালাম। জানলাম দাদা, শুভঙ্করবাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শুভঙ্করবাবুর থ্রু দিয়ে তুই কাগজে এসেছিস। কিন্তু তুই তখন চরম বহেমিয়ান জীবনযাপন করছিস। তোকে কিছুতেই ধরতে পারছি না।

প্রতিজ্ঞা করলাম তোকেও কাগজ থেকে সরিয়ে দেব। সুনীতদা বারণ করলো। বললো, অনির নিজস্ব একটা পাঠক আছে। ওকে সরালে আমাদের কাগজের ক্ষতি। তাছাড়া তোকে নেওয়ার জন্য অন্যান্য কাগজ মুখিয়ে আছে। তার চেয়ে বরং ওকে প্রসার করা হোক।

তবু আমি রিজিড থাকলাম। খোঁজ খবর নিলাম। তুই তখন ভাইজ্যাক গেছিস। ওই পনেরো দিন তোর লেখা আর্টিকেলগুলো আমি রেগুলার পড়েছি। তোর ধার আর ভারের কাছে আমি মাথা নত করেছি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম। আমাদের কাগজে তোর মতো সোর্স কারুর নেই।

তুই এখনও সেরকম একরোখা। স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড। একমাত্র অমিতাভদা ছাড়া তুই কাউকে অফিসে পাত্তা দিস না। যেরকম তোকে কলেজে দেখেছি। ড. রায় ছাড়া কাউকে পাত্তা দিতিস না সেইরকম। বুবুন এখনও ডেয়ার ডেভিল। বুবুনের যে গুণটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল।

তোর ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকলাম। তখন বাবার ছবির কাছে বসে প্রতিদিন ড্রিঙ্ক করতাম, আর বলতাম বাবা আমাকে পথ দেখাও, বুবুনকে আমার জীবনে ফিরিয়ে নেব কিনা। বাবা কোনওদিন না বলেনি।

তুই ফিরে এলি। প্রথম রিটার্ন পেলাম তোর কাছ থেকে। তুই আমার ডাকে সারা দিলি না। তুই সুনীতদাকে এক কথায় উড়িয়ে দিলি। সবাই মেনে নিল, তুই শুধু বললি তুই ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বসবি। বুঝলাম সব ঠিক আছে। লোহা লোহাকে কাটতে পারবে।

মনকে শায় দিলাম অন্ততঃ একটা লোক আমার পাশে দাঁড়াতে পারে। তোকে জড়িয়ে ধরলাম। সেখানেও শয়তানটা সব বুঝতে পারলো। তখন দুটো পথ বেছে নিলাম যে কোনও মূল্যে তোকে আমায় ফেরত পেতে হবে। তাতে যা হয় হোক।

ওকে বললাম বুবুনকে আমার চাই। ওকে আমি কাগজের শেয়ার হোল্ডার করবো। তখন শয়তানটা বারাসতের একটা বিশাল প্রপার্টি আমার কাছ থেকে লিখিয়ে নিল। ওটা দামানিদের প্রপার্টি ছিল। দাদু আমাকে দিয়েছিলেন।

দুই তোমাকে ডিভোর্স দিতে হবে। দ্বিতীয়টা ও মেনে নিল না। বরং কাগজের নামে লোন নিয়ে, ও আর মল সব টাকা আত্মসাৎ করে নিল। ইসলামভাইকে সেই সময় আমি প্রথম দেখি। ইসলামভাই তখন ওদের অপারেটর।

টোডি?

ওদের একটা গ্রুপ আছে। টোডিও বড় ব্যবসায়ী। আমাকে ওরা টোপ হিসাবে ব্যাবহার করলো। প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি। পরে যখন বুঝলাম, তখন সব হাতের বাইরে। দেহটার আর কিছু নেই বুঝলি।

মিত্রা থামলো।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে।

তোর মনটা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার কথা শুনতে শুনতে।

একটুও না।

তুই তো আজ একটুও রেগে যাচ্ছিস না। তোর চোখের রং একটুও বদলে যাচ্ছে না।

তুই বল, আমি শুনছি।

আর কি শুনবি, সবই তুই জানিস।

বড়োমা, আজকের বিয়ে।

মিত্রা আমার কোল থেকে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

আমার জেদ বুবুন।

তোর জেদ!

হ্যাঁ।

তোর ডাকে যেদিন প্রথম শয়তানটাকে নিয়ে দাদার বাড়িতে গেলাম সেদিন বড়োমাকে দেখে জ্যেঠিমনির কথা মনে পড়ে গেল। যিনি আমাকে ন-মাস দশদিন গর্ভে ধারন করেছিলেন। একজন স্নেহময়ী মা। বিশ্বাস কর সেদিন থেকে প্রতিহিংসা পরায়ণ মনোভাবটা মন থেকে আসতে আসতে উবে গেল।

আমি তোর আত্মশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। ধীরে ধীরে নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়তে শুরু করলাম। নতুন জীবন দেখালি তুই। তুই কিরকম মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে আকাশে উড়িস। তোর ওখানে গিয়ে তোর প্রতি সকলের ভালোবাসা আমাকে পাগল করে দিল। আমার প্রতি তোর ভালোবাসা যে তখনও অটুট, সেটা বুঝতে পেরে নিজে পাগল হয়ে গেলাম। তোর সমস্ত কথা মেনে নিতে শুরু করলাম।

মিত্রা একটু থামল।

বার বার তোর খোঁজ নিয়েছি। তুই সেই শয়তানটার মতো মুখোশ ধারী কিনা। প্রত্যেক বার তোর কাছে হেরে গেছি। তুই কাকার অপারেশনের পর দেশ থেকে ফিরে এসে পাগলের মতো হয়ে গেলি। আমি সেই সময় শয়তানটার কাছে বার বার গেছি। সুনীতদাকে বলেছি তোমরা এটা কি করছো। ওরা তোকে মারবার জন্য উঠে পরে লেগেছে।

তারপর যখন শুনল তুই ওদের থেকেও ইসলামভাই-এর খুব কাছের লোক, তখন ওরা গুটিয়ে গেল। সেই সময় আমি স্বার্থপরের মতো একটা চাল চাললাম। বললাম আমি বুবুনকে সামলাতে পারি, যদি তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও। গিভ এন্ড টেক পলিসি।

এক কথায় রাজি হয়ে গেল। সময় নষ্ট করিনি। নিজের পরিচিত উকিল ঠিক করে ফার্স্টক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স নিলাম। কাগজ ওর হাতে দিলাম না। আমার কাছে রাখলাম। আমি তখন মুক্ত বিহঙ্গ। তোকে গ্রহণ করা শুধু সময়ের অপেক্ষা।

নিজের আনন্দটুকু তোর সঙ্গে শেয়ার করবো তার কোনও উপায় নেই। তোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বার বার বড়োমার কাছে ছুটেগেছি, কোনও দিশা পাইনি। ভেবেছি বড়োমা তোকে তার নিজের বাড়িতে রেখেছে।

বিশ্বাস কর সেই সময় ওই ঠিকানা ধরে বড়োমার বসিরহাটের বাড়িতেও একদিন গেছি। যদি তুই ওখানে থাকিস। ব্যার্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এসেছি।

মিত্রা হাঁফাচ্ছে।

তখন জানতাম না। তুই বড়োমার সম্বন্ধে কিছুই জানিস না। হঠাৎ একদিন অফিসে আবিষ্কার করলাম, যাদের ভয়ে আমি সিঁটিয়ে থাকতাম, তার সব কেঁদো বাঘ হয়ে গেছে। দিনরাত আমাকে তেল দিচ্ছে। আমি কোনও কাজে অনড় থাকলে ভয় দেখাচ্ছে তোকে নিয়ে।

তখন আমার মনের পরিস্থিতি কি তোকে বোঝাতে পারবো না। যাকে আমি খড়কুটোর মতো ধরে বাঁচতে চাইলাম সেও আমাকে বুঝলো না। তোর ওপর তখন আমার ভীষণ রাগ। তারপর সেইদিন এলো। একদিনে তুই সব ওলটপালট করে দিলি। কি আনন্দ হচ্ছিল। সেই আনন্দটুকু তোর সঙ্গে শেয়ার করবো ভেবেছিলাম। তুই কারুর ডাকে সারা দিলি না। চলে গেলি।

সেইদিন দুপুরে ও ডেকে পাঠাল। ও আর মল চূড়ান্ত অপমান করলো।

এক কথায় বলতে গেলে আমাকে শকুন দিয়ে ঠুকরে খাইয়ে দেবে।

মনকে বোঝালাম, ওরা ভয় পেয়েছে। তাই এই সব কথা বলছে। নরমে গরমে আমার কাছ থেকে ব্ল্যাঙ্ক স্টাম্প পেপারে সই করাতে চাইল হোটেলে বসে। আমি করলাম না। তখন আর জীবনের মায়া করি না। বেশি কি করতে পারে মেরে দেবে। সে ওরা পারবে না। বুবুন এখন আমার পাশে আছে। তবু মনে ভয়। চলে গেলাম ক্লাবে, বেহেড মাতাল হলাম।

হেসে ফেললাম।

হাসলি যে।

তারপরই তো থাপ্পর।

মিত্রা ঝট করে উঠে বসে আমার গালে চুমু খেল।

তুই বিশ্বাস কর, তখন যে আমার কি হয়েছিল।

আমি ওর দিকে তাকালাম। ও মাথা নীচু করে নিল।

এরপর তোকে ছেড়ে আর থাকতে ভালো লাগেনি। ওই চার সপ্তাহ বড়োমা, ছোটোমা আমার জীবনটাকে নতুন রং-এ রাঙিয়ে দিল। সঙ্গে তুই। তোর দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমার বাবা তোকে কতটা চিনেছিলেন।

মনে মনে ঠিক করলাম বাবার সঙ্গে বড়োমার বিয়ে হলে বড়োমা আমার মা হতো। আমার কাছে বড়োমা মা। বহুবার বড়োমা তোর কাছে কনফেস করতে চেয়েছে, তুই পাত্তা দিসনি। তুই যেন নতুন পৃথিবী গড়তে এসেছিস। দুরদার করে এগিয়ে যাচ্ছিস। আমি, বড়োমা, ছোটোমা ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম। তোর মন বুঝে কথা বলতাম।

কখনও বড়োমা আমাকে পাঠাত তোর কাছে তোর মন বুঝতে, কখনও ছোটোমাকে পাঠাত, শেষে নিজে আসত। আসতে আসতে দেখলাম প্রত্যেকেই তোকে কেন্দ্র করে আশ্রয় পেতে চাইছে। আমি শুধু একা নয়। ভারি মজা লাগল।

অফিসে খোঁজ খবর নিলেই দেখি সকলে ওরে বাবা বলে দশহাত পিছিয়ে যাচ্ছে। যারা একসময় ছেঁড়া নেকড়ার মতো আমাকে একটা ডাস্টবিনে ফেলে রাখত তারা মর্যাদা দিচ্ছে।

বুঝলাম আমার বুবুন সফল। ও অন্যায় কাজ করছে না।

মিত্রা থামল।

আমি সম্মোহনের মতো ওর কথা শুনে যাচ্ছি। ও আপন মনে সব বমি করছে।

কিরে, কি ভাবছিস? তোর মিত্রা কবিতার মতো নষ্ট মেয়ে?

আমি মিত্রার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলাম। ও চোখ বন্ধ করে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে কোন সেক্সের গন্ধ নেই, সেখানে রয়েছে ভালোবাসার চরমতম স্পর্শ। আমি ঠোঁট থেকে ঠোঁট তুললাম। মিত্রা তাকাল।

আমাকে একটু জলের বোতলটা দিবি।

হাত বাড়িয়ে ওকে জলের বোতল দিলাম। ও ঢক ঢক করে কিছুটা জল খেল। তারপর আবার আমার কোলে মাথা রাখল।

জানিস বুবুন তোর কোলে শুয়ে আছি, কি শান্তি।

আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম। ও আমার ডান হাতটা জাপ্টে ধরে বুকের কাছে টেনে নিল।

পীরবাবার থানের মাটি তুই যেদিন আমার মাথায় লাগালি, সেদিন আমি দুটো জিনিস চেয়েছিলাম পীরবাবার কাছে। একটা তোর সন্তান আমি গর্ভে ধারণ করে মা হব। দুই বড়োমার মাথার সিঁদুর ঘটা করে অনুষ্ঠান করে আমার সিঁথি রাঙাবো।

ওই সিঁদুর আমার বাবার হাতে দেওয়া। আজ বাবা নেই বড়োমা আছেন।

বড়োমা সেই অর্থে আমার মা। বাবার সঙ্গে বড়োমা থাকলে আমি বড়োমার গর্ভেই আশ্রয় পেতাম।

মিত্রা উঠে বসে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো।

আমি জানতাম তুই একদিন না একদিন আমাকে রেস্ট্রী করবি। না হলে এতো বড়ো প্রপার্টি তুই ঠিক ভাবে সামলাতে পারবি না। তবে সেটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটবে বুঝতে পারিনি। প্রথমে ভেবেছিলাম তুই বুঝতে পেরেছিস আমি মা হতে যাচ্ছি। তাই বিয়ে করা জরুরি। একটা সামাজিক স্বীকৃতি আমাকে দেওয়া দরকার। তারপর তোর মনের কথা বুঝতে পারলাম। জেদ করে আমি এই অনুষ্ঠান করলাম। তাও আমার বাড়িতে। কেন জানিষ? আমার বাবা-মা দুজনেই আজ এখানে উপস্থিত। আমার মা তোকে বরণ করে গাড়ি থেকে নামিয়েছেন। আমার মা আমাকে ধরে নিয়ে এসে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছেন। মা তার বিয়ের সিঁদুর কৌটো থেকে সিঁদুর নিয়ে কুনকেতে লাগিয়ে দিয়েছেন, যেটা তুই আমার সিঁথিতে দিয়েছিস। বাবা ওপর থেকে সব দেখেছেন। তার বিয়ে করা স্ত্রী তার মেয়ের বিয়ে দিয়েছে।

মিত্রার গলাটা ধরে এলো। কথা বন্ধ হয়ে গেল। আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। বেশ বুঝতে পারছি ওর বুকের লাব ডুব শব্দটা ঘন হয়ে এক তালে বেজে চলেছে।

এরপরও তুই বলবি ম্যান ইজ মেকার অফ হিজ ওউন ফেট। মিত্রার গলাটা বুঁজে গেল, কথা বলতে পারলো না।

মিত্রা কিছুক্ষণ চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকল। আমি ওর মাথায় হাত বোলাচ্ছি।

জানিস বুবুন, আমি যে বেনারসীটা পরে আছি এই বেনারসীটা পরে বড়োমা বাড়ি ছেড়ে বিয়ের রাতে চলে এসেছিল। আজ আমার শরীরে যা দেখছিস সব বড়োমার। ব্লাউজের হাতাগুলো বড়োমা নিজের হাতে শেলাই করে দিয়েছে।

আমার ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মুখ মণ্ডলে তার প্রতিক্রিয়া হয় তো কিছুটা পড়েছে, তবু যতোটা সম্ভব ভেতরে ভেতরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে চলেছি।

আজ আমি যা চেয়েছি, যেমন ভাবে চেয়েছি, তাই পেয়েছি। আমার জীবনের চরমতম সুখের দিন। যেদিন প্রথম আমার শরীরটা তোর হাতে তুলে দিয়েছিলাম সেদিনের থেকেও। আজকের দিনটার সঙ্গে শুধুমাত্র একটা দিনের মিল আমি খুঁজে পাই।

কোন দিনটা। আমার গলার স্বর অস্পষ্ট।

যেদিন পীরবাবার থান থেকে ফিরে এসে সেই চাঁদনী রাতে তুই আমাকে তোর জীবনটা দিলি।

আমি আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। কাঁদলাম না। তবে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো।

এমা, মিত্রার কষ্টে তুই কেঁদে ফেললি, দেখ আমি একটুও কাঁদছি না। আমি তোর মতো শক্ত হওয়ার চেষ্টা করছি।

মিত্রা ডানহাতটা দিয়ে আমার চোখের জল মুছিয়ে দিল। আমার ঠোঁট স্পর্শ করলো।

কাঁদিসনা বুবুন। তোর মিত্রাকে কেউ আর তোর কাছ থেকে কোনওদিন ছিনিয়ে নিতে পারবে না। তোর মিত্রা তোরই থাকবে। যে আসছে দেখিস সে তোর থেকে কোনও অংশে কম যাবে না। জ্যোতিষদাদা বলেছে। তোর বুবুন যেখানে থামবে, সেখান থেকে সে শুরু করবে। আমি যে নদী বুবুন। কতো নোংরা আমার শরীরে। কিন্তু দেখ আমি কতো পবিত্র জিনিষ গর্ভে ধারণ করেছি। কজনের ভাগ্যে এটা জোটে। তোর কোলে মাথা রেখে আমি নিজেকে নিজে উজার করে দিচ্ছি। এটাও আমার একটা পাওয়া। বলতে পারিস বড়ো পাওয়া।

মিত্রা থামলো।

আমার কোলে মাথা রেখে ও শুয়ে আছে।

জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। সকালের আলো ফুটে উঠেছে। সারারাত ঘুম হলো না। দুজনে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছি। মিত্রার সব কথা শুনলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু মেলাতে পারছি না। সব কেমন জট পেকে যাচ্ছে। কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম ফাঁক থেকে যাচ্ছে। নয় মিত্রা সব গুছিয়ে বলতে পারলো না। নয় ও ইচ্ছে করে কিছু একটা গোপন করে গেল। তবে এই মুহূর্তে ও নিজে কিছু গোপন করেনি বলেই মনে হচ্ছে। ও ঠিক গুছিয়ে বলতে পারলো না। আমাকে ওর বাবার দিনলিপিটা পড়তে হবে। আরও কিছু উদ্ধার করা যাবে তার থেকে।

কিরে আবার কোথায় ডুব মারিল।

অ্যাঁ, না কোথাও না।

দেখছি তো। আমি যে তোর কোলে শুয়ে আছি সেটাই ভুলে গেছিস।

হাসলাম।

ভাবছিস মিত্রা কতোটা স্বার্থপর।

না।

বুবুন আমার ওপর তোর একটুও রাগ হচ্ছে না।

একটুও না।

তুই এখান থেকে বলছিস। মিত্রা আমার বুকে হাত দিল।

হ্যাঁ।

তুই আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলি না।

কি বিষয়ে বল।

তোকে এতো কথা বললাম, তুই কিছু বললি না।

এখনও সময় আসেনি। হ্যাঁরে বড়োমা জানে?

কি ব্যাপারে বল!

তোর বাবার সঙ্গে বড়োমার বিয়ে হয়েছিল।

না।

ওই ঘরে যে ফটোটা আছে বড়োমা দেখেনি?

না। ওই ঘরের চাবি আমার কাছে আছে। একমাত্র তুইই ঢুকেছিলি।

কেউ দেখতে চায়নি!

চেয়েছে, অন্য ফটো দেখিয়েছি।

সেটা কার?

দাদুর কম বয়সের একটা ছবি।

হাসলাম।

হাসলি কেন?

কতোদিন গোপন করবি।

আমি বড়োমাকে মুখ ফুটে কোনওদিন বলতে পারবো না।

তোর তো মা। মায়ের কাছে লজ্জা কিসের?

যদি কিছু মনে করে।

করলে করবে। তোর বাবা কিছু কিছু অন্যায় করেছে। এটা তুই স্বীকার করিস?

করি।

তা সত্ত্বেও তুই তোর বাবাকে ফ্রেন্ড-ফিলোজাফার-গাইড বলছিস।

হ্যাঁ।

বড়োমা অন্যায় করেছে, তবু তাকে তুই মা বলে স্বীকার করেছিস?

হ্যাঁ।

তাহলে তাকে জানাতে অসুবিধা কোথায়। কিছুটা তার মন সংশোধন হবে।

এরকম ভাবে কখনও ভাবিনি বুবুন!

মিত্রা আমাকে জাপ্টে ধরে উম উম উম করে আমার কপালে গালে গোটা পাঁচেক চুমু খেলো। সত্যি তুই কি সহজভাবে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলি। এই জন্য তুই আমার বুবুন।

তা বলে এই নয় যে আজকেই তুই গিয়ে বলে দিবি।

না তা বলবো না। তবে কি জানিষ বড়োমা মনে হয় কিছু একটা আঁচ করেছে।

কি করে বুঝলি।

এই বেনারসীটা আমি জোর করে বড়োমার কাছে দেখতে চেয়েছি, বলেছি তোমার ছেলেকে বিয়ে করলে এই বেনারসী পরেই বিয়ে করবো, না হলে করবো না। নিজে পছন্দ করে আমার জন্য বেনারসী কিনেছে, আমি সঙ্গে ছিলাম, তবু আমি বলেছি আজ পরবো না।

ওটা আমি রবিবার পরবো। তোর সমস্ত কাপর জামা বড়োমাকে পছন্দ করতে বলেছি। যেগুলো তুই আজ পরেছিস। আর রবিবারেরটা ছোটোমা পছন্দ করেছে। একটাও আমি পছন্দ করিনি। সমস্ত ব্যাপারটা আমি ছেড়ে দিয়েছি দুজনের ওপর।

দামিনীমাসি, ইসলামভাই তোর জন্য পছন্দ করে জিনিষ কিনেছে। সকাল থেকে তুই যে দুটো পাজামা পাঞ্জাবী পরেছিস। একটা দামিনীমাসির একটা ইসলামভাই-এর। তাতেই যেন মনে হলো বড়োমা কিছু একটা আঁচ করেছে।

আচ্ছা ডাক্তারদাদা তোকে সম্প্রদান করলো কেন?

বড়োমার ইচ্ছে অনুযায়ী।

কিরকম!

ডাক্তারদাদা আমার জীবন দিয়েছে। তাই।

ডাক্তারদাদা আপত্তি করেনি?

একটুও না। বরং বলেছে, বুঝলে বান্ধবী আমরা সব ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

হাসলাম।

তুই বুঝতে পেরেছিস?

মাথা দোলালাম। হ্যাঁ।

জানিস বুবুন আমি কথাটা শুনে মনে রেখেছি, একটুও বুঝতে পারিনি।

কেন!

ওয়েস্ট ইন্ডিজতো একটা দেশের নাম।

না। পৃথিবীর একটা পোর্সান। ওখানে অনেকগুলো ছোট ছোট দ্বীপ আছে। অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে দেশটা। প্রত্যেকটা দ্বীপের আলাদা আলাদা নাম।

ডাক্তারদাদা, ইসলামভাই, দামিনীমাসি, বড়োমা, ছোটোমা, দাদা, মল্লিকদা, এক একটা দ্বীপ আমরা দুজনে সকলকে একত্রিত করেছি।

কি দারুণ কথা বলেছে ডাক্তারদাদা।

ডাক্তারদাদার জীবনবোধটা ভীষণ গভীর। আমার সঙ্গে কিছুটা মেলে।

ঠিক বলেছিস।

কেন।

সেদিন বাড়ি ফিরে দেখলাম তোর ঘরের লাইট জ্বালা।

কি ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল তোকে বলে বোঝাতে পারবো না। আজ বুবুন আমার কথা রেখেছে। গাড়ি থেকে নেমে সবার আগে ছুটে আমি ওপরে চলে এলাম। তোকে সারপ্রাইজ দেব। পা টিপে টিপে বারান্দা পার হয়ে তোর ঘরের সামনে এলাম। তুই একমনে ছবি আঁকছিস। আমি স্ট্যান্ট হয়ে গেলাম। তুই ছবি আঁকতে পারিস! আমি জানতামই না।

পা টিপে টিপে তোর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তোর কোনও খেয়াল নেই। এক মনে ছবি আঁকছিস। আমি যে তোর পেছনে দাঁড়িয়ে আছি তুই বুঝতেও পারলি না। আবার সেই ভাবে নিচে নেমে এলাম। সবাইকে বললাম। ডাক্তারদাদা বললো ও সাধনা করছে, তোমরা ওকে বিরক্ত করো না।

আমি বললাম তোমরা দেখবে না। কি দারুন সব পেন্টিং করছে বুবুন।

ওরা সবাই এলো, নিস্তব্ধে দেখল চলে গেল। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ। ধৈর্য ধরতে পারলাম না। তোর সামনে গেলাম। তোর চোখদুটো তখন কি ভালো লাগছিল। তুই আমাকে দেখছিস, তবু যেন দেখছিস না।

হেসে ফেললাম।

মিত্রা আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল।

জানিস বুবুন আমি ঈশ্বরের কাছে মনে প্রাণে প্রার্থনা করছি, যে আসছে সে যেইই হোক আমার গুণ যেন সে একটুও না পায়, তোর সব গুণ সে যেন পায়।

তাই?

হুঁ।

কেন তুই খারাপ?

ভালো বলি কি করে বল।

মন খারাপ করিস না। জীবনটা সব সময় এক খাতে বইবে সেটা হয় কি করে।

আমি ওর দিকে তাকালাম।

তোর বুবুন ত্রুটিহীন মানুষ নয়।

আমার থেকে অনেক গুণে ভালো।

তোর বুবুনেরও অনেক বেড পার্টনার থাকতে পারে। যদি কখনও জানতে পারিস কি করবি।

আমার বুবুনকে আমার কাছ থেকে কেউ কখনও ছিনিয়ে নিতে পারবে না।

কে বলেছে, তোর জ্যোতিষদাদা।

হুঁ।

ঘেঁচু।

তোর বুবুন কৃষ্ণ তার শতো গোপিণী।

তা থাক, তবু সে রাধার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।

ওরে বাবা সার বুঝেছিস দেখছি।

আরও অনেক কিছু বুঝেছি তোকে এখন বলবো না।

আর একটা কি দেখাবি বললি, আমার ক্লু।

আজ থাক। আমার কথা শুনে তুই ক্লান্ত হয়ে পরেছিস। আর একদিন তোকে বলবো।

আমি ক্লান্ত হইনি, তুই বল।

জানিস আজ অবতার আর সাগির কনিষ্কর পা ধরে কি কান্না।

তোকে আমার ক্লু টা বলতে বললাম।

আজ ভালো লাগছে না। যেটা বলছি সেটা শোন না।

ঠিক আছে বল।

আমরা সবাই গেলাম।

ইসলামভাই প্রথমে একটু ভড়কে গেছিল। কনিষ্কর পা ধরে অবতার, সাগির কাঁদবে কেন! নেপলা, রতন, আবিদও একটু থতমতো খেয়েগেছে।

কি বলছিল ওরা।

তুই ছট্টুকে এনকাউন্টার করিয়েছিস ওদেরকেও ছারবি না। কনিষ্ককে দেখলে তখন তুই হাসবি না কাঁদবি।

কেন!

গম্ভীর হয়ে বললো। তোদের এখনও অনি বাঁচিয়ে রেখেছে! অনির জায়গায় আমি থাকলে অনেক আগে মেরে দিতাম।

কনিষ্কর পা ধরে সে কি কান্না। ঢেউ তুলে তুলে কাঁদছে। রতন, আবিদ, নেপলা হেসে গড়িয়ে পরে।

তারপর কনিষ্ক, দামিনীমাসির দিকে তাকিয়ে বললো। তুমি জাননা মাসি, অনি এদের জন্য কি না করেছে। গুলি খেয়ে রাস্তায় পরে থেকেছে। খবর পেয়ে তুলে এনেছে।

রাতে হাসপাতালে এ্যাডমিসন না করে অপারেসন থিয়েটরে নিয়ে গিয়ে ওদের হাত থেকে পা থেকে গুলি বার করেছি আমি, বটা। ওরা অনির বিরুদ্ধে স্কিম করে! ওদের জন্ম দিল অনি। আর ওরা যদি গাদ্দারি করে, বেঁচে থাকবে। আমি, বটা সাক্ষী আছি। আর কে কি বললো বুঝতে যাব না।

ছার পা ছার। আজ অনির বিয়ে মাথায় রাখিস।

তখন ইসলামভাই বললো অনি সেই জন্য ওদের আনতে বলেছে।

দেখ অনি তোদের নেমন্তন্ন করেছে, নিশ্চই কথায় কথায় একদিন বলেছিল আমার বিয়েতে তোদের নেমন্তন্ন করবো, আর তোরা স্কিম কর, অনিকে মারার জন্য।

সবাই হাঁ করে কনিষ্কর কথা শুনছে।

বটা দাঁড়িয়ে ছিল। দুটোর হাত ধরে টেনে তুলে বললো যা ভেতরে চলে যা। রবিবার এসে অনির সঙ্গে দেখা করবি। না হলে এবার টেবিলে তুলে মেরে দেব। অনি জানতেও পারবে না। তারপর মর্গে পচে যাবি।

আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে আছি।

আচ্ছা বুবুন তুই এইসব করার সময় পেতিস কি করে?

সেই জন্য তুই খুঁজে পাসনি।

এক থাপ্পর। আমার কথাটা আমাকে ঘুরিয়ে দিলি।

আমি হাসছি।

তোর সঙ্গে অর্ক ঝগড়া করবে।

কেন।

রবিবার আসুক বুঝতে পারবি।

তুই তো জানিস বল।

এখন বলবো না।

দরজায় কড়ানাড়ার শব্দ পেলাম।

ধ্যুস কি সুন্দর গল্প করছিলাম।

কটা বাজে খেয়াল আছে।

সত্যিতো। তোর কোলে শুয়ে আছি। কিছুই বুঝতে পারিনি। বুবুন আমরা ঘুমলাম না!

আমি হাসছি।

তুই কি রে, ভাবলাম তোর কাছে একটু আদর খাব।

এতো খেয়েও মন ভরলো না।

ভরে, তুই বল।

যা দরজা খোল।

মিত্রা উঠে গিয়ে দরজা খুললো।

ছোটোমা।

আমি তাড়াতাড়ি ফাইলটা গুছিয়ে রাখলাম। বুঝতে পারছি ছোটোমা, মিত্রার দিকে তাকিয়ে কালকে কতটা আদর করেছি তার সন্ধান পেতে চাইছে। তাহলে খুনসুটি করবে।

কিরে! ও ওখানে বসে কি করছে! তোরা সারারাত ঘুমোস নি?

মিত্রা সোজা সাপ্টা জবাব দিল, না।

কি করছিলি ড্যাবা, ডেবীতে!

গল্প করছিলাম।

গল্প করতে করতে রাত কাবার!

হ্যাঁ।

কই দেখি চল।

ছোটোমা ভেতরে এলো। চারিদিক অনুসন্ধিৎসু চোখে দেখলো।

আলমাড়ি খোলা! সামনে ফাইল!

আমা হাসছি।

তুই মাটিতে থেবরে বসে আছিস, তোদের ব্যাপার স্যাপার কি বলতো?

চা এনেছো।

আনা হচ্ছে।

ওটার এখন ভীষণ দরকার। বড়োমা ফোন করেছিল?

করেছিল।

কখন যেতে বলেছে।

কেন।

ওখানে গিয়ে বাথরুমে যাব।

কেন এখানকার বাথরুম মনে ধরছে না। আগে তো অনেকবার ঢুকেছো।

দুজনে ঢোকা যাবে না।

মিত্রা খিল খিল করে হেসে উঠলো।

দাঁড়া তোর কানটা….।

ছোটোমা তেরে এলো কান ধরতে।

যতো বড়ো মুখ নয় ততবড়ো কথা।

ও ছোটো করিস কি এই সাত সকালে।

বৌদি চায়ের পট কাপ-ডিশ ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকলো।

দ্যাখো দিদি দ্যাখো, সারারাত না ঘুমিয়ে দুটোতে ফাইল পত্র দেখেছে। আবার বলে কিনা ও বাড়িতে গিয়ে বাথরুমে ঢুকবে।

বৌদি চায়ের ট্রে সেন্টার টেবিলে রাখল। মিত্রার দিকে তাকাল। ভালো করে দেখে বললো।

কিরে সত্যি তোরা ঘুমোসনি!

মিত্রার মুখ দেখে বুঝতে পারছো না।

আমি হাসছি।

বৌদি ছোটোমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, সত্যি ছোটো তুই পারিসও বটে।

তুমি কখন এলে? আমি বললাম।

আমি গেলাম কখন যে আসব।

কেন!

বৌ নিয়ে ঘরে ঢুকলি বৌদির খোঁজ রেখেছিস।

আচ্ছা বাবা অন্যায় হয়েছে। সুরো কই?

ও বাড়িতে, তিনবার ফোন হয়ে গেছে। অনিদা কখন যাবে।

আমার খোঁজ খবর নেওয়ার ওই একটাই লোক আছে বুঝলে।

দেবোনা এক থাপ্পর, দাঁড়া দিদিকে খবরটা দিচ্ছি। ছোটোমা বললো।

বৌদি, সকাল বেলা এত অত্যাচার ঠিক হচ্ছে না।

সত্যি তোরা ঘুমোস নি!

চায়ে চুমুক দিলাম।

আঃ।

আর আয়েশ করতে হবে না। বৌটাকে দাও। শুধু নিজে খেলে হবে।

নিয়ে নিক।

দেখেছ ছেলের কথা। ছোটোমা বললো।

জানো বৌদি একটা কাজ করছিলাম, দেখলাম সাতটা বেজে গেছে।

বৌদি আমার দিকে তাকিয়ে।

তোমরা আরও সকালে ডাকতে পারতে।

হাসছি। মিত্রাও হাসছে।

ছোটোমা।

বলুন।

হাসলাম।

কিছু খাবার জুটবে।

তোকে দেখলে গা পিত্তি জলে যাচ্ছে। নিজেও ঘুমোসনি, মেয়েটাকেও ঘুমোতে দিসনি। দাঁতে দাঁত চিপে বললো।

দেখলি মিত্রা, কে দোষ করলো, কার ঘারে দোষ পরলো।

ছোটোমা ঘর থেকে গট গট করে বেরিয়ে গেল। বৌদি সোফায় বসলো, কাপে চা ঢেলে নিল।

মিত্রার দিকে তাকিয়ে।

আয়। এখানে বোস।

মিত্রা গিয়ে বৌদির পাশে বসলো।

ঘুমসনি কেন?

আমি হাসছি। মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তারপর বৌদির দিকে তাকাল।

ও ঘুমোতে দেয়নি। বললো চল গল্প করি।

সারারাত!

বিশ্বাস করো, বুঝতে পারিনি।

নিশ্চই কোনও জরুরি বিষয় নিয়ে গল্প হচ্ছিল বল।

কতদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়নি বলো। অনেক জমে ছিল।

আজ সব শেষ করে দিলি।

কিছুটা, এখনও বাকি আছে।

ছোটোমা কানে ফোন গুঁজে কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকলো। বুঝলাম খবর হয়ে গেল।

আমি হেসে বললাম প্রমপ্ট এ্যাকসন।

তা বলবে না।

ফোনটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল।

বলো।

কিরে তুই নাকি ঘুমোসনি! বড়োমার গলা।

তুমি চলে এসো, দেখে যাও।

ছোটো বললো।

চা চেয়েছি, তাই।

ছোটোমা আমার কান ধরে মুলে দিল, আমি উ করে উঠলাম।

কি হলো রে।

ছোটোমা কান মুলে দিল।

বেশ করেছে।

কখন বাড়ি যাব বলো?

কেন থাকতে ভালো লাগছে না।

বল না বল, ওখানে গিয়ে বাথরুমে ঢুকবো। ছোটোমা বললো।

আমি হাসছি।

তুমি ছোটোমার সঙ্গে কথা বলো।

দে।

আমি ছোটোমার হাতে ফোনটা চালান করে দিলাম।

বৌদি টিনারা কোথায়?

সব ও বাড়িতে চলে গেছে।

ওরা যে থাকবে বলেছিল।

বৌদি হাসলো।

কিরে, তুই যাবি, না আমি সেরে নেব। মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।

তুই যা।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। মিত্রা ফাইলটা আলমাড়িতে তুলে রেখে আলমাড়ি বন্ধ করলো। পাঞ্জাবীটা খুলে বিছানায় ছুঁরে ফেলে দিলাম। বাথরুমের দিকে এগোলাম।

কিরে তুই কাপর পরে যাবি? মিত্রা বললো।

কেন কি হয়েছে?

দাঁড়া আমি তোকে টাওয়েল দিচ্ছি।

দেখছো বৌদি, কাণ্ড দেখ। আমি বললাম।

কাণ্ড দেখবে কি রে গর্ধভ কোথাকার। ছোটোমা বললো।

তখন থেকে যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছ। দাঁড়াও ওখানে গিয়ে মল্লিকদাকে রিপোর্ট করছি।

ছোটোমা হেসে ফেললো।

বাড়িতে যখন পৌঁছলাম সাড়ে দশটা বাজে। ছগনলাল ঢুকতে দেখেই হাসলো।

দেখলাম বাড়ি ভর্তি লোক। সবাই হাজির এই সময়। আমি মিত্রা গাড়িতে, সবাই নেমে এলো। বড়োমা বরণ করলো। দুজনকে আমার ঘরে নিয়ে গেল। হই হই রই রই বেশ মজা লাগছিল। উপকরণের কোনও অভাব নেই। যেন মোচ্ছব বসে গেছে। কাজ কর্ম শেষে খাওয়া দাওয়া হলো। আর এক চোট হই হই। মিত্রা বললো আমি বড়োমার ঘরে একটু নাক ডেকে ঘুমবো।

আমি ওপরে চলে এলাম।

দেবাকে বললাম আয় তোদের সঙ্গে কিছু কথা সেরে নেই। বড়োমা বললো তুই একটু ঘুমিয়ে নে। আমি বললাম না। পরে ঘুমচ্ছি।

ওপরে উঠে এলাম। চারিদিকে একটা বিয়ে বিয়ে গন্ধ। ঘুম নেই কিন্তু শরীরে ক্লান্তিও সেই ভাবে নেই। আমি এসে জানলার সামনে দাঁড়ালাম। একটা সিগারেট ধরালাম। ছোট ছোট চকমকি লাইট দিয়ে বাড়ি সাজান চলছে। ইসলামভাই-এর পাগলাম। মনে মনে হাসলাম। মিত্রার সব কথা হুড়মুড় করে মনের মধ্যে এসে ভিড় করছে।

মানুষের মন। সত্যি কি থেকে কি হয়ে গেল। ভাবতেই পারছি না। মিত্রার লাইফটা বারে বারে ঘুরে ফিরে আমার চোখের সামনে ভেসে আসছে। সত্যি কি ও এক সময়ে বহু পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী ছিল? ও নিজে মুখে স্বীকার করেছে।

কেমন যেন লাগছে। আমার মিত্রা। যাকে আমি মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছি কই আমার মধ্যে কোনও ফাঁকি ছিল না।

তাহলে মিত্রা?

ও একটা মেয়ে। মেয়েদের অনেক বাধ্যবাধকতা থাকে। ও স্বীকার করে নিয়েছে। ওই সময় গা ভাসিয়ে দেওয়া ছাড়া ওর কোনও উপায় ছিল না। তাহলে আমি ওকে ভুল ভাববার চেষ্টা করছি কেন? আমি যদি ওর জায়গায় থাকতাম?

তাহলে আমিও হয়তো এর থেকে কিছু কম যেতাম না। যতই হোক আমি একটা ছেলে। আমি এই পৃথিবীতে যেভাবে লড়াই করতে পারবো, একটা মেয়ের পক্ষে সে ভাবে লড়াই করা সম্ভব নয়। নিজের মনকে বোঝালাম, মিত্রাকে ভুল ভাবা আমার কখনওই উচিত নয়।

আমার একটা ব্যাপারে ওর কাছে সব সময় ঋণী থাকা উচিত। ও আমাকে নতুন দিশা দিয়েছে। আমাকে নতুন ভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে।

কিরে কি করছিস ওখানে দাঁড়িয়ে।

ফিরে দাঁড়ালাম।

আয়।

দেবারা পাঁচজন।

টিনা এগিয়ে এলো। ভ্রু নাচিয়ে বললো, অনিদা কাল রাতটা কেমন কাটালে।

টিনার মুখের দিকে তাকালাম। খুব একটা ভালো নয়।

কেন!

টিনার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

তোমরা চলে এলে। মনটা খারাপ হয়ে গেল।

টিনা ফিক করে হেসে ফেললো।

এই জন্য।

হ্যাঁ।

বিশ্বাস করো কালকে একটু নিজেদের ফ্ল্যাটে গেছিলাম আমি আর মিলি। এক সপ্তাহ হলো এখানে পরে আছি। তাই একবার দেখতে গেলাম।

ভালো করেছো।

আমি খাটে এসে বসলাম। কিরে দেবা কাল কেমন মজা করলি।

দারুণ।

আনিদার বিয়েটা স্মরণীয় হয়ে থাকল আমাদের কাছে।

কেন অদিতী?

তোমার না বলা অনেক কথা কাল শুনলাম। তোমার নতুন জগৎ, নতুন দিক।

অনিদাটা খুব খারাপ না।

এই তুমি শুরু করতে চাইছ। মিলি বললো।

হেসে ফেললাম। জানো অদিতী একটা সময় আমার সেরকম কোনও কাজ ছিল না। বদ সঙ্গ, বদ নেশা করতে পারিনি। তাই কি করবো, নেই কাজ তো খই ভাজ।

ওরা হাসছে।

আচ্ছা মৈনাক তোকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করাল কনিষ্কদের সঙ্গে। তুই ওদের আপন হয়ে গেলি, আর মৈনাক ফুটে গেল, ব্যাপারটা কি বলতো?

কি করে বলবো। ওদের সঙ্গটা আমার ভালো লাগতো, তাই ওদের কাছে যেতাম। তারপর দেখলাম আমি ওদের মতো না হলেও, ওরা আমাকে বন্ধু হিসাবে গুরুত্ব দিচ্ছে, তাই হয়তো টিঁকেগেলাম।

অনিদা আমাদের একবার ভালোপাহাড়ে নিয়ে যাবে। টিনা বললো।

কনিষ্কদার মুখ থেকে ভালোপাহাড়ের কথা শুনে মনে হচ্ছিল এখুনি ওখানে চলে যাই। মিলি বললো।

তোমরা যেতে পারবে না।

কেন।

অনেকটা হাঁটতে হয়, চড়াই উতরাই।

তুমি প্রোগ্রাম করো, যাব। টিনা বললো।

কনিষ্করা কম বেশি রেগুলার যায়। ওদের বলে দিচ্ছি ঘুরে এসো।

তুমি না গেলে মজা নেই।

কেন, কনিষ্ক খুব ভালো ছেলে।

পাগল! কি গলা। গম গম করছে যেন। কি পার্সোনালিটি! মিত্রাদিকে কাল অনেক কথা বলেছে তোমার সম্বন্ধে। শেষে বলেছে ওকে কখনও ভুল বুঝবেন না ম্যাডাম। ঠকে যাবেন। মিলি বললো।

ও আমাকে একটু বেশি ভালোবাসে, তাই সব সময় বারিয়ে বারিয়ে বলে।

আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কনিষ্কদা অনিদা আপনাদের কিরকম বন্ধু।

হাসলাম।

হেসো না, বলে কিনা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেমন বন্ধুত্ব থাকে তেমন।

তোমাদের মিত্রাদি বলে নি, গে কিনা।

সেটা মিলি জিজ্ঞাসা করেছে। টিনা বললো।

তাতে কি উত্তর দিলো কনিষ্ক।

বললো, আপনার উত্তরটা সরাসরি না দিয়ে একটা গল্পের মাধ্যমে দিই।

বলুন শুনি।

অনি না থাকলে সে বছর আমরা ডাক্তার হতে পারতাম না, পরের বছর লেগে যেত।

হাসলাম।

আচ্ছা ডোমেদের সঙ্গেও তোমার বন্ধুত্ব আছে।

ওরা আমার নিউজ সোর্স। হাসপাতালের খবর ওদের থেকে বেশি কেউ রাখে না।

মিত্রা নাচতে নাচতে ঘরে এসে ঢুকলো।

দেবাশিসরা সবাই ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল।

কিরে তুই ঘুমলি না! অমি বললাম।

ঘুম আসে। তুই জমিয়ে গল্প করছিস।

ওর পেছন পেছন বড়োমা, ছোটোমা, বৌদি সবাই এসে হাজির।

তোমরা আবার কি করতে এলে।

তোকে দেখতে এলাম।

এসো এসো বসো অনিদার গল্প শোনো। টিনা বললো।

সবাই খাট জুড়ে বসলো। মিত্রা আমার ঘারে উঠে এলো। আর একপাশে সুরো ঘারে উঠেছে।

কোনটা বলছে রে। মিত্রা বললো।

কালকে কনিষ্কদা বললো না অনি না থাকলে ওই বছর ডাক্তার হতে পারতাম না।

কিরে আমাদের বাদ দিয়ে ঝেড়ে দিচ্ছিলি। মিত্রা আমার কোমরে খোঁচা মারলো।

দে না পিঠে একটা গুম করে। ছোটোমা বললো।

বড়োমা, ছোটোমা সকাল থেকে….

ছোটোমা তেরে এলো।

বৌদি সাক্ষী আছে।

মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে।

আমি হাসছি।

কি বুঝছো বড়োমা। তোমাদের দুটো বললাম এটা থার্ড, কনিষ্ক একটু ছুঁয়ে গেছে। মিত্রা বললো।

বড়োমা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়েছে। পান চিবচ্ছে পুচুর পুচুর।

কিগো নিজে একটা বেশ গুছিয়ে মোটা করে চিবচ্ছ, আমারটা কোথায়।

তোকে খেতে হবে না জিভ মোটা হয়ে যাবে। ছোটোমা বললো।

ওমা দেখি সবার গাল ফোলা। কিগো বৌদি?

আমারও মুখে ছিলো, শেষ করে ফেলেছি। কানের কাছে সুরো ঘ্যানর ঘ্যানর করলো।

ভালো করেছো, এবার পরীক্ষার আগে নোটটা চেয়ো, লবডঙ্কা দেখাব।

আমার ভেঙচি কাটাতে, সকলে হাসছে।

বল না। মিত্রা বললো।

দেরি করিস না এখুনি বিকেল হয়ে যাবে, অনেক কাজ। ছোটোমা বললো।

কি শুনবে, মরা ঘাঁটার গল্প।

বড়ম ওয়াক করে উঠলো।

দেখলে, আর হবে না। এবার বমি করে ফেলবে।

পানটা গলায় আটকে গেছিল। বড়োমা বললো।

আবার হাসি।

ওমনি ছোটো করে একটা ঠেকা দিলে।

সবাই হাসে।

আমি কিন্তু এডিট করে বলবো।

তাই বল।

সবাই বেশ গুছিয়ে বসলো।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/t3hkGgV
via BanglaChoti

Comments