❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
৫০ নং কিস্তি
—————————
আরে থাম থাম….। আমার কথা বলার আগেই, মিত্রা ছুটে এসে আমার হাত থেকে ফোনটা কেরে নিল।
কাকে চাই?
অনাদি মনে হয় হেসে ফেলেছে।
ও তুমি। কেমন আছো। দাঁড়াও একটু পরে তোমাকে ফোন করছি।
ফোনটা কেটেই আমার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকাল।
চল চল নিচে চল।
কেন বলবি তো?
জানি না। বড়োমা বললো, ওটাকে ধরে আনবি।
মাথায় লাল টিপ্পা লাগিয়েছিস। ব্যাপারটা কি বলতো?
আগামীকাল বিয়ে করবো তাই।
বিয়ের আর বাকি কি রেখেছিস?
সে তো তুই। তোর জন্যই সব গণ্ডগোল। চল চল।
আমার হাত ধরে টেনে খাট থেকে নামাল।
তোকে কিন্তু পাঞ্জাবীটা পরে দারুণ মানিয়েছে।
তুই কিনেছিস?
আমি না, বড়োমা। নিজে পছন্দ করেছে।
কোথায় গেছিলি?
দক্ষিণেশ্বর।
হঠাৎ।
বড়োমা কাল রাতে কথা বলতে বলতে বললো, মানত করেছি। আমি বললাম, তাহলে চলো। প্রোগ্রাম বানিয়ে নিলাম।
ভালো করেছিস। কটা বাজে দেখেছিস?
আমি তোর কাজ করে এসেছি।
তোকে এই বাসন্তী কালারের শাড়িটা কে দিল?
ভালোলাগছে?
হাসলাম।
ছোটোমা। যা পরেছি, সব ছোটোমা।
ভেতরেরটাও!
এক থাপ্পর।
মিত্রা হাত তুললো। আমি একটু সরে গিয়ে হাসছি।
দুজনে দরজা বন্ধ করে ধীর পায়ে নিচে নেমে এলাম। বাইরের ঘরে ঢুকতেই দেখলাম সোফার একপাশে ডাক্তারদা, দামিনীমাসি এবং ইসলামভাই বসে আছে। আর একদিকে দেবাশিস, নির্মাল্য।
আমাকে দেখেই দেবাশিস বললো, আমাকে কিছু বলবি না। সব বড়োমা, যদি কিছু বলার থাকে সব বড়োমাকে বল।
তাহলে বড়োমা তোর হয়ে কাজ করে দেবে?
বড়োমা দেখছো। ঘরে ঢুকেই অনি কি আরম্ভ করেছে।
দামিনীমাসির দিকে তাকালাম। কিগো সব একসঙ্গে! কোথায় দেখা হলো?
এই এলাম।
মিত্রা তোমায় খাতাটা দিয়ে এসেছে?
নিয়ে গেছিল, বলেছি কয়েকদিন পড়ে দিস।
বড়োমা পূজোর প্রসাদ আর ফুল নিয়ে এলো। আমার মাথায় পূজোর ফুল ঠেকাল। একটা পেঁড়া দিল। আমি মাথায় ঠেকিয়ে খেয়ে নিলাম।
তাহলে পূজো ভালই দিলে বলো?
হ্যাঁ।
গঙ্গার স্নানটাও জমিয়ে করলে?
তা করেছি।
মন পুরো শুদ্ধ?
তোকে আর পাকাম করতে হবে না।
দামিনীমাসির ঘরটা কেমন দেখলে?
বড়োমা আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল।
মিত্রা বলেনি। এই ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।
তুই সব জেনে বসে আছিস?
বড়োমা দামিনীমাসির দিকে তাকাল।
দামিনীমাসি অবাক হয়ে বড়োমার দিকে তাকিয়ে।
ওরা কেউ বলেনি, আমারও কিছু লোকজোন আছে বুঝলে বড়োমা।
দাঁড়া ওই দুটো মক্কেল আসুক, ঝেঁটিয়ে আজ বাড়ি থেকে বিদায় করবো।
ডাক্তারদাদা জোড়ে হেসে উঠলো।
তুমি হাসছো কেন? বড়োমা খিঁচিয়ে উঠলো।
তোমার কথা শুনে।
কেনো!
ও যতোটা না শিওর ছিল এখন পুরোপুরি শিওর হয়ে গেল।
মানে!
ওর কোনও লোকজন ছিল না, পুরোটা ভাঁওতা।
অ্যাঁ!
অ্যাঁ না হ্যাঁ।
বড়োমা ডাক্তারদার দিকে বিষ্ময় চোখে তাকিয়ে।
ও এখুনি ছিপ ফেলেছিল। মাছটা খেল। ও একটু খেলিয়ে মাছটাকে তুলে নিল।
বড়োমা আমার কানটা সজোরে মুলে দিল। তোর পেটে পেটে এতো বুদ্ধি।
বুদ্ধি আছে বলেই ও মুখার্জীর মতো লোককে পকেটে পুরে রেখেছে।
তুমি কি করে জানলে?
ডাক্তারদাদা সারাটা শরীর কাঁপিয়ে হেসে চলেছে। সবাই ডাক্তারদাদার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
ও ঢোকার পর থেকে ওকে ফলো করলাম।
ওর চাল চলন, কথাবার্তা বুদ্ধি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম।
বড়োমা ডাক্তারদার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে।
ও প্রথমে একটা ফাঁদ পাতলো। বলতে পারো মাছ ধরার জন্য চাড় ফেললো। তারপর ঝুপ করে বড়শি ফেললো। মাছ খেল। ও মাছটাকে খেলিয়ে তুলে নিল।
বড়োমা টেবিলের ওপর প্রসাদের থালাটা রেখে আমার পাশে এসে বসলো।
ছোটোমা এতক্ষণ রান্নাঘরের পাশে দাঁড়িয়েছিল, এগিয়ে এসে আমার আর এক পাশে বসলো। মিত্রা আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
বলো ডাক্তার, তুমি ওকে বেশ ভলো বুঝতে পেরেছো, ওই জন্য ও চুপ করে আছে।
আমি মুচকি মুচকি হাসছি।
ডাক্তারদাদা, বলবে না। আগে কচুরি আসুক। মাসি, তুমি ওরকম ভেটকে গেলে কেন।
তোকে দেখছি।
দেখে কোনও লাভ নেই বুঝলে মাসি। একসময় তুমি আমাকে যা বলেছ আমি চোখ কান বুঁজে শুনেছি। এখন তোমার বয়স হয়ে গেছে। আমি যা বলবো তোমাকে শুনতে হবে।
আমি কি শুনি না?
শোনো, মাঝে মাঝে বেগড়-বাই করো।
ছোটোমার দিকে তাকালাম।
সকাল থেকে এককাপ চা পেটে পরেছে আর কিছু পরেনি। তোমরা বেশ পাত পেরে ফুলকো ফুলকো লুচি সাঁটিয়ে এলে।
তোর জন্য নিয়ে এসেছি।
বড়োমা, দাদা-মল্লিকদা কোথায়?
অফিসে গেছে, এখুনি চলে আসবে। বড়োমা ডাক্তারদার দিকে তাকাল।
ও ডাক্তার বলো। না হলে আবার ভুলে যাব।
ছোটো একটু চা করো। ডাক্তারদাদা বললো।
ছোটোমা উঠে রান্নাঘরের দিকে গেল। মিত্রা।
বলো।
অনির খাবারটা নিয়ে যা।
মিত্রা আমার পেছন থেকে এগিয়ে গেল।
আগে বলো। বড়োমা বললো।
অনির লুচি খাওয়া হোক তারপর।
ছোটোমা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো।
দাদা এখন না আমি যাই আগে।
ডাক্তারদাদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
দেখছিস তোর ডায়গনসিসের কি ভ্যালু?
আমি হাসছি।
মিত্রার ফোনটা বেজে উঠলো। নম্বরটা দেখেই হেসে ফেললো।
কিরে বল, কাজ হয়েছে?
মিত্রা ভয়েজ অন করে দিয়েছে।
দারুণ একটা সুখবর আছে মিত্রাদি। মিলির গলা।
তাই! তোর কথা সবাই শুনছে।
অফিসে যেতে আর ভালো লাগছে না।
চলে আয়। সুখবরটা কি বল?
কালকে আমরা অনিদার ওপর রাগ করছিলাম না।
হ্যাঁ।
সত্যি অনিদা কখনও চুপচাপ বসে থাকে না বুঝলে। ঠিক একটা কাজ বাগিয়ে নিয়ে চলে এসেছে। আমরা শুধু চিঠিটা নিতে এসেছিলাম, কয়েকটা বড়ো বড়ো রসোগোল্লা খেলাম।
ইস, আমার জন্য নিলি না।
দুর চাওয়া যায়। আমরা মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি।
চলে আয়।
বড়োমা আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকাল।
কিরে, কাল এখান থেকে বেরিয়ে কোথায় গেছিলি?
ওই যে সুখবর আনতে, শুনলে না। আজও বেরবো।
আজ তুই একপাও বেরবি না।
ছোটোমা লুচি তরকারি নিয়ে এলো। মিত্রার হাতে চায়ের ট্রে। কোনওপ্রকারে টেবিলে রেখেই ধপাস করে আমার পাশে বসলো।
আজ বেরবার নাম করলেই ঠ্যাং ভাঙবো। ছোটোমা বললো।
আমি লুচির প্লেট নিলাম। ডাক্তারদাদার হাতে চায়ের কাপ।
ছোটোমা মিত্রাকে সরিয়ে পাশে বসলো।
দাদা এবার বলুন ওর বুদ্ধিটা শুনি।
ডাক্তারদাদা চায়ে চুমুক দিয়েছে।
ইসলাম তুমি ধরতে পেরেছ?
আমি এতক্ষণ শুনলাম, কিছুতেই ধরতে পারছি না। কোন কথার ও কি মানে করলো—
ও বলে না দাবা খেলে। ডাক্তারদাদা বললো।
ইসলামভাই ডাক্তারদার দিকে তাকিয়ে।
সত্যি ও দাবা খেলে। ঠিক কথাটা ঠিক জায়গায় পুট করে দেয়। ও উত্তর পেয়ে যায়।
দেবাশিস, নির্মাল্য হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি নিশ্চিন্তে লুচি খাচ্ছি। মিত্রা একটা লুচি অলরেডি তুলে সাঁটিয়ে দিয়েছে। আবার হাত বাড়াতে গেল, আমি প্লেট সরিয়ে নিলাম।
দিবিনা কেনরে, তোর একার নাকি। মিত্রা চিল্লিয়ে উঠলো।
মামনি তুই কালকে দামিনীর ওখান থেকে কোনও খাতা নিয়ে এসেছিলি। ডাক্তারদাদা বললো।
মিত্রা লুচিটা দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে ছিঁড়তে ডাক্তারদাদার দিকে অবাক হয়ে তাকাল।
হ্যাঁ!
দামিনী মাসি হেসে ফেললো।
এবার ধরতে পেরেছ দামিনী?
সত্যি দাদা, আমি ভাবতেই পারিনি।
মাসি হাসিহাসি মুখ করে আমার দিকে তাকাল। দিদি ঠিক বলে তোর পেটেপেটে এতো বুদ্ধি!
আমি গম্ভীর হয়ে লুচি চিবচ্ছি।
এবার তুমি বান্ধবীদের বলে দাও।
না না আপনি বলুন।
সকাল বেলা তোমরা ওকে না বলে চলে গেছ। ওতো জানবেই তোমরা কোথায় গেছিলে। প্রথম অস্ত্র ও প্রয়োগ করেছে। তাতেই কাজ হয়ে গেল, না হলে নির্মাল্যকে ও জবাই করতো। দেখলে এখানে ঢোকা তক নির্মাল্যকে ও একটাও প্রশ্নও করেনি।
দামিনীমাসি হাসতে হাসতে বড়োমার দিকে তাকাল। এবার দামিনীমাসি বলতে শুরু করলো।
বড়োমা, ছোটোমা দুজনেই দামিনীমাসির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
কালকে ওরা যখন গেছিল, তখন অনি ওর বাক্সটা কবিতাকে দিয়ে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করালো, আপনাকে বাক্সটা দেখালাম না।
হ্যাঁ! বড়োমা বললো।
ওর থেকে অনির একটা খাতা মিত্রা গতকাল নিয়ে এসেছিল। আসার সময় বললো, মাসি আমি নিজে এসে তোমায় ফেরত দিয়ে যাব। কালকে ওরা চলে আসার পর মনটা ভীষণ খারাপ লাগলো। আমি, ইসলাম ছাদের ওপর মাদুর পেতে অনেক রাত পর্যন্ত বসেছিলাম ।
আজ ও এ ঘরে ঢুকেই আমাকে বললো, কিগো, সব একসঙ্গে, কোথায় দেখা হলো?
আমি বললাম, এই এলাম।
তারপরই ও বললো, মিত্রা তোমায় খাতাটা দিয়ে এসেছে।
আমি বললাম না।।
তারপরেই আপনাকে বললো, কিগো দামিনীমাসির ঘরটা কেমন দেখলে।
ওরে বাবা! তুই কি সাংঘাতিক! তোকে তো কোনও কথা লোকান যাবে না।
ছোটোমা মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠলো।
বড়োমা আমার মুখের দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে। পরিতৃপ্ত মুখখানি আমার কৃতিত্বে খুশি। আমার মাথাটা টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
তখনই তোমায় বললাম বড়োমা, একটা ফোন করে দাও বুবুনকে। মিত্রা বললো।
আমি কি তোকে বারণ করেছিলাম?
আমি ছোটোর দিকে তাকালাম, এবার চা হোক।
ছোটো কিল বাগিয়ে আমার মুখের কাছে এগিয়ে এলো, আমি বড়োমার বুকের কাছে সরে গেলাম।
নীপা যা তো মা চা-টা ঢেলে আন।
বুবুন। দেখলাম তখনও মিত্রা বুড়ো আঙুল দিয়ে আমার প্লেটটা চেঁচে জিভে লাগাচ্ছে।।
বল।
কাল তোর আর ভজুর কীর্তি বড়োমাকে বলেছি।
সবাই হেসে ফেললো। হাসি আর থামে না।
আমি গম্ভীর হয়ে মিত্রার দিকে তাকিয়ে।
হাসতে হাসতে দামিনীমাসির চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেল, ছোটোমারও একই অবস্থা।
ভজুরামও হাসে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি বলিনি অনিদা।
হাসিটা একটু থামতে আমি গম্ভীর হয়ে মিত্রাকে বললাম।
তুই এটা ভালো করলি?
তুই তো কাল বৌদিকে বললি। তারমানে সবাইকে বলে দিলি। তুই তো আর নিজের গরজে বলবি না, তাই আমি বললাম।
বুঝলি মিত্রা আমার ঘরটা ভালো করে খুঁজলে তুই ওরকম একটা ছেঁড়া নেগড়া এখনও পাবি। বড়োমা বললো।
তুমিও কি স্মৃতি করে রেখেছ।
না-রে তোর দাদার একবার শখ হয়েছিল।
আবার হাসি, এবার আর থামানো যায় না।
টিনা, মিলি, অদিতি এসে ঘরে দাঁড়াল। ওরা ঢুকে অবাক। এতো হাসির চোট কিসের।
কিগো তোমরা এতো হাসছো কেন? টিনা বললো।
মিত্রা হাসতে হাসতে বললো, কালকে সেই বুবুনের জাঙ্গিয়া….তারপর কৌপিন।
টিনা, মিলি হাসতে হাসতে খাবার টেবিলের চেয়ারে বসে পরলো।
দাদারও একবার শখ হয়েছিল কৌপিন পরার। বড়োমা বললো এখুনি।
প্রাণখোলা হাসিতে ঘরটা গম গম করছে। মিলি হাসতে হাসতে মাটিতে বসে পরলো।
অদিতি হাসতে হাসতে বললো সত্যি অনিদা তুমি জিনিষ একটা, বাঁধিয়ে রাখার মতো।
কলেজে দেখেছি, তুই তো তখন এতটা ধুর ছিলি না। দেবা হাসতে হাসতে বললো।
দুর, ধুরের কি আছে, চেয়েছি প্যাকেট করে দিয়ে দিয়েছে। খুলে দেখেছি নাকি।
হাসি থেমে নেই।
চানটান করে চুলে টেরি বাগিয়ে তাই পরে ভজুরামের কি আনন্দ। মাসির কাছে রাম কেলানি খেয়ে ভজুরাম তারপর বুঝতে পেরেছে। তার আগে আমার বোঝা হয়ে গেছে।
হাসির রেশ কিছুটা কমতে টিনা, মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললো।
তুমি কি খাওয়াবে অনিদাকে?
কেন, আবার কি আনলি!
মিলি ব্যাগ থেকে খামটা বার করলো।
ডাক্তারদাদা খুলুক এখানে সিনিয়ার মোস্ট। টিনা বললো।
দে। মিত্রা বললো।
মিলি খামটা ডাক্তারদাদার হাতে দিল।
কিরে অনি সাপ না ব্যাঙ। ডাক্তারদাদা আমার দিকে তাকাল।
সাপ গো সাপ। অদিতি বললো।
ডাক্তারদাদা চিঠিটা পড়ে আর হাসে।
কিগো ডাক্তার, কি লেখা আছে ওতে, তুমি ওরকম মুচকি মুচকি হাসো কেন? বড়োমা বললো।
তোমার ছেলে কালকে আবার একজনকে বধ করেছে। এবার রাজ্য সরকারের কোষাগার লুঠ। তিনকোটি টাকা।
অ্যাঁ। বলো কি!
হ্যাঁ। এই দ্যাখো তার কনসাইনমেন্ট।
মিত্রা উঠে দাঁড়িয়ে মিলিকে জড়িয়ে ধরলো। সত্যি!
সত্যি না তো কি মিথ্যে।
সেই জন্য কালকে ও কাজের হিসাব দিচ্ছিল ওদের। বড়োমা বললো।
কি বান্ধবী এবার তুমি ওর ওপর রাগ করবে। ডাক্তারদাদা বললো।
বড়োমা আমার থুতনি ধরে চুমু খেলো।
তুই তো চম্পকের মুখ একেবারে বন্ধ করে দিলি। দেবাশিস বললো।
এটা কি আমি নিয়ে এসেছি, ওরা তিনজনে নিয়ে এসেছে। সরকারি খাতায় ওরা রিসিভ করেছে।
সত্যি অনি তোর মাথাটা ফাটিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে।
আর তোমাকে মাথা ফাটাতে হবে না। অদিতি বললো।
চল এবার ওপরে গিয়ে একটু বসি। আমি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ছোটোমা।
আমি ছোটোমার দিকে তাকালাম।
ছোটোমা আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে। চোখের ভাষা, এই জন্য তোকে আমরা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই। এটা বুঝিস না।
তারপরেই কপট রাগ মুখে।
যাও আর এক রাউন্ড চা পাঠাচ্ছি।
আমি উঠে দাঁড়ালাম, মিত্রাকে ইশারায় ডাকলাম। মিত্রা আমার পেছন পেছন বারান্দায় এলো। মুখে হাসি হাসি ভাব। পরিতৃপ্ত মুখ। আমার সামনে দাঁড়াল, চোখে জিজ্ঞাসা।
কাগজগুলো কোথায়?
বড়োমার ঘরে।
চল।
আমরা দুজনে বড়োমার ঘরে এসে ঢুকলাম।
মিত্রা একটা ফাইল বার করে আমার হাতে দিল।
এতে সব আছে।
এতো কি?
অনেক দলিল আছে। এগুলো তোকে দেখাইনি।
মানে!
সব তো গেছে। এটুকু লুকিয়ে রেখেছিলাম।
তুই আগে ওই কাগজটা দে।
মিত্রা খামটা বার করলো। আমি হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলাম। হাসলাম।
এই একটা মাত্র তুই পাকা কাজ করেছিস।
তাও অনেক কাঠ-খর পুরিয়ে।
তুই তো নিজে মুখে কিছু বলিসনি, আমাকে উদ্ধার করতে হচ্ছে।
বিগত দশ মাসে বলার সময় দিয়েছিস।
তাও ঠিক।
সার্টিফিকেটটা খামে ভরে ওর হাতে দিলাম।
ফাইলে রাখ। আর একটা কাজ করতে হবে।
বল।
কাল ব্যালেন্স চেক করেছিস?
হ্যাঁ।
লকারে কতো আছে?
সাড়ে চার কোটি।
চাবি কার কাছে।
সনাতন বাবুর কাছে।
আমাকে দেড়কটি টাকা দিবি?
কেন!
এই প্রথম মিত্রা আমার কথায় বিস্ময় প্রকাশ করলো। ফিক করে হেসে ফেললাম।
হাসিসনা, বল।
বিয়ে করছি, যৌতুক দিবি না।
যাঃ, বল না। ওরকম করছিস কেন।
অনিমেষদা চেয়েছে।
অনিমেষদা! তোকে?
হ্যাঁ। কাল রাতে আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললো। পার্টি ফান্ডে দিতে হবে। আমি তোকে আবার ফেরত দিয়ে দেব।
মুহূর্তের মধ্যে মিত্রার মুখের রং বদলে গেল। কেমন যেন মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
তুই একথা বললি কেন! আমি কি এখনও তোর আপন হতে পারলাম না?
মিত্রা মুখটা নীচু করে নিল। চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো।
আমার দিক থেকে আমি কোনও খামতি রাখিনি।
মিত্রার গলাটা কেমন ভাড়ি ভাড়ি।
এই দ্যাখো।
কিরে, চা এখানে দেব, না টেবিলে রাখবো।
ছোটোমা গেটের কাছে। মিত্রার দিকে তাকাল। ছোটোমা বুঝতে পেরেছে কিছু একটা হয়েছে। এগিয়ে এলো।
কিরে মিত্রা! চোখটা ছল ছল করছে কেন?
না কিছু না।
নিশ্চই তোকে কিছু বলেছে।
না।
তাহলে!
এমনি।
দাঁড়া আমি দিদিকে ডাকছি।
না তুমি ডাকবে না।
ছোটোমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি ওর দিকে তাকালাম।
ঠিক আছে, তোকে দিতে হবে না। আমি বেরিয়ে আসতে চাইলাম। ও আমার হাতটা ধরলো।
আমি তোকে দেব না বলেছি—
তাহলে সব কিছুতে তোর চোখে জল আসে কেন?
আমি কি অপরাধ করেছি, এখনও তোর আপন হতে পারলাম না।
আমি এখনও এই জিনিষগুলো নেওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি।
তোকে এই কথাটা কে বলেছে। আমি?
না। আমার মন বলছে।
আমি তোর কাজে কোনওদিন বাধা দিয়েছি?
না।
তোর সব কাজ মেনে নিয়েছি। আমি জানি তুই আমার জন্য, আমাদের ভালোর জন্য এইসব করছিস।
একটু থেমে।
নিজের জন্য নয়।
মাথা নীচু করে রইলাম।
তাহলে তোর এতো সংকোচ কেন।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
কালকে তুই ফর্মগুলো সই করতে চাস নি। কেন?
আমি সই করে দিয়েছি।
দাদা বলার পর।
চুপ করে রইলাম।
তুই যেমন আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখিস, তোকে নিয়ে আমারও কিছু স্বপ্ন আছে, আমারও কিছু ইচ্ছে অনিচ্ছা আছে। শুধু আমার একার নয়, সবার। কেন তুই সেটা মেনে নিবি না।
আমি তোর যোগ্য হতে পারিনি।
তাহলে আমার সঙ্গে নিজেকে জড়ালি কেন?
আমার ভেতর থেকে কে যেন বললো, তোর বিপদ, তোকে সাহায্য করা উচিত।
আমার বিপদ তোর কি, তুই কি দেশোদ্ধার করতে এসেছিস?
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
তুই নিজের জীবন বিপন্ন করে সব কিছু করছিস। আমরা কেউ তোর পাশে থাকি না। বাড়িতে থেকে গুমড়ে মরি। কার জন্য তুই এইসব করছিস। তোর নিজের জন্য?
আমি চুপ। মাথাটা মনে হচ্ছে পায়ের সঙ্গে মিশে যাবে।
তাহলে তোর এতো সংকোচ কেন। কেন তুই ভাবছিস এটা শুধু আমার, তোর নয়।
বুঝলাম বেশি চুপ করে থাকলে আরও কথা বেরবে। দীর্ঘদিন মনের মধ্যে এই কথাগুলো ও পুষে রেখেছে। বলার সুযোগ পায়নি।
আমি মিত্রার দুই কাঁধ হাত রাখলাম। চোখ দুটো যেন গনগনে কয়লার এক একটা টুকরো।
আমি কথা দিচ্ছি। আর কখনও বলবো না।
তুই প্রায়ই বলিস এই কথা। আমি বুঝি। চুপ করে থাকি। তুই আমার আর তোর মাঝে একটা সূক্ষ্ম দেয়াল তুলে রেখেছিস। তুই কি ভাবিস আমি কিছু বুঝি না। তোকে আমি নিজের টাকায় কোম্পানীর শেয়ার হোল্ডার করেছি। তুই তার ঋণ শোধ করছিস।
তুই বিশ্বাস কর। আমি কখনও এই সব ভাবিনি।
তাহলে তুই কেন বার বার একই কথা বলিস।
নিজের মনের মধ্যে এখনও একটা খটকা রয়ে গেছে। আমি এর যোগ্য কিনা?
যাচাই কে করবে তুই না আমি।
আমি মাথা নীচু করে রইলাম।
আমার কষ্টটা তুই স্বীকার করলি। তোর কষ্টটা আমাকে স্বীকার করতে বাধা দিচ্ছিস কেন?
আমার কোনও কষ্ট নেই।
সেটা সাদা চোখে দেখার ক্ষমতা তোর নেই। নিজের আয়নায় নিজের মুখ দেখেছিস। আমি তোকে ভালোবাসিনি। তোর ভেতরে যে যাযাবরটা আছে তাকে ভালোবসেছি। তাকে আমি এখন খুঁজে পাচ্ছি না। তাই তোর মনটাকে কাছে পাওয়ার চেষ্টা করেছি।
আমার মাথা হেঁট।
বুঝতে পারছি আমার একটা ছোট্ট ভুলে কি হলো। ওর কথা শুনে কানের লতি গরম হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো জ্বালা জ্বালা করছে। নিজেকে নিজে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছি না।
তুই একটা পাথর। ভাবছিস তোকে আমি একদিন ভালোবাসতাম তার অধিকারে তোকে কিছু দায়িত্ব দিয়েছি। তুই তা পালন করছিস।
না আমি কখনও তা মনে করিনি।
মুখ তুললাম।
মিত্রা আমার চোখে চোখ রাখলো। হয়তো আমার চোখের ভাষা ও পড়তে পারলো।
আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখলো।
নিজেকে কষ্ট দিয়ে কেন এতো আনন্দ পাস। আর একজনও তো কষ্ট পায়। সে শুধু একা নয়, তোর সঙ্গে যারা জড়িয়ে আছে, তারা সকলে। এটা ভেবেছিস কখনও।
আমি শক্ত কাঠের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মিত্রার হাত থেকে নিজেক ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার দিকে ফিরলাম। দেখলাম বড়োমা, ছোটোমা ঘরের মধ্যা দাঁড়িয়ে। কারুর দিকে তাকালাম না। সোজা বেরিয়ে এলাম।
দেখলাম বসার ঘরে ওরা সবাই বেশ খোশ মেজাজে কথা বলছে। মৃদু স্বরে আমাদের একটা কথাও ঘরের দরজার বাইরে আসেনি। যা শুনেছে বড়োমা, ছোটোমা। আমি বারান্দা দিয়ে হেঁটে সোজা ওপরে চলে এলাম।
নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজালাম।
টেবিলের কাছে গিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা নিলাম। একটা সিগারেট বার করে ধরালাম। সোজা চলে এলাম জানলার কাছে। আমগাছের একটা ডাল একেবারে জানলার কাছে। হাত বারালেই ডালটার স্পর্শ পেয়ে যাব। কচি পাতা সবে মাত্র ধরেছে। তার ঠিক ওপরে আমের বকুল হয়েছে। বেশ দেখতে লাগছে। প্রত্যেকটা প্রাণের মধ্যে সন্তান ধারণের কি প্রবল লিপ্সা। এই গাছটা কথা বলতে পারে না। বোবা। তবু ওরও বেঁচে থাকার কি ইচ্ছে। নিজের বংশ বিস্তারের স্বপ্ন।
মিত্রা এভাবে আমাকে আগে কোনওদিন বলেনি। ও আমার বুকের ভেতরটা প্রবল ঝড়ে ওলট পালট করে দিল। বার বার চোখের সামনে মিত্রার মুখটা ভেসে আসছে। ওর কথা কানের কাছে বার বার শব্দ তরঙ্গ তৈরি করছে। এই কটা মাস আমার মধ্যে একটা জেদ চেপে বসেছিল। নেশার ঘোরে আমি শুধু কাজ করে গেছি। কেনো?
আমি মিত্রাকে সুরক্ষিত দেখতে চেয়েছি। হ্যাঁ আমি অনেক ঝুঁকি নিয়েছি। কখনও কখনও নিতে বাধ্য হয়েছি। কিসের জন্য? আগু পিছু কিছু ভাবিনি। যেটা নিজে থেকে ঠিক মনে করেছি, সেটাই করেছি। কারুর বাধাকে গ্রাহ্য করিনি। সত্যি তো ওরাও আমাকে বাধা দেয়নি। একবারও প্রতিরোধের কোনও দেয়াল আমার সামনে খাঁড়া করেনি।
আমি যেমন ভাবে ভাবছি, ওরাও তো ঠিক তেমন ভাবেই ভাবতে পারে।
এটা আগে কখনও ভাবিনি কেন?
নাঃ এরপর আর মিত্রার কাছ থেকে টাকা নেওয়া যাবে না।
কিন্তু এত টাকা এই মুহূর্তে একসঙ্গে পাব কোথায়?
আবার একটা সিগারেট বার করে ধরালাম।
আর সিগারেট খাবি না।
কর্কশ একটা কন্ঠ কানে এসে ধাক্কা দিল। এ গলা আমার পরিচিত নয়। আমার অচেনা অজানা।
জানলা থেকে পেছন ফিরে তাকালাম।
মিত্রা ঘরের দরজা বন্ধ করছে। চায়ের কাপের ট্রেটা বিছানার ওপর রাখা। পায়ে পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এলো। জ্বলন্ত সিগারেটটা হাত থেকে টেনে নিয়ে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। চোখ দুটো আগের মতোই গনগনে।
তোকে এই পৃথিবীতে আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক আমি বুঝেছি।
আমি ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম।
কাকে কাকে ফোন করলি টাকার জন্য?
কাউকে করিনি।
করবি। এটা ভেবেছিস তো?
মাথা নীচু করলাম।
আমি সনাতনবাবুকে ফোন করে দিয়েছি। দাদার হাতে টাকা পাঠিয়ে দেবে। কাউকে আর ফোন করতে হবে না।
আমি মাথা নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
তোর তো অনেক ক্ষমতা, মলকে সরিয়ে দিয়েছিস, সুনীতবাবুকে শাস্তি দিয়েছিস, রাজনাথের ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছিস, প্রবীরবাবুকে রিজাইন দিতে বাধ্য করিয়েছিস, ডাক্তারের এমন হাল বানিয়েছিস এই জীবদ্দশায় আর করেকম্মে খেতে হবে না, ছট্টুকে এনকাউন্টার করিয়েছিস এইবার তোর মিত্রা শেফ।
মিত্রার চোখে আগুন ঝড়ে পরছে।
এইবার মিত্রাকে আর কেউ ছুঁতে পারবে না। শেষ যেটা ছুঁতে পারবে বলে তুই মনে করছিস, তাকে তুই তোর হেফাজতে রেখে দিয়েছিস। সময় বুঝে তাকেও তুই সরিয়ে দিবি। কাক পক্ষী কেউ টের পাবে না। কেউ তোকে ছুঁতেও পারবে না। পারবি ছট্টুর মতো আমাকে এনকাউন্টার করতে। আমাকে নিয়ে তোর অনেক টেনসন। একবারে শান্তি পেয়ে যাবি।
মিত্রার প্রত্যেকটা কথা আমার শরীরের মাংস ভেদ করে ছুঁচের মতো আমার হাড়ে বিঁধছে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসছে। সত্যি আজ আমি ওর মনের সংবেদনশীল অংশে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছি। এই জায়গাটা আমারও আছে। ওরও থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
মিত্রা ওর মতো বলে চলেছে। আমার কানের মধ্যে দিয়ে এক বর্ণও আমার মাথার মধ্যে প্রবেশ করছে না।
আমার হলে আমিও যে এই ব্যাব্যহারই করতাম। মিত্রা ঠিক সেই ব্যাবহার টুকু জাস্ট আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। আমাকে এটা শুনতে হবেই। এছাড়া আমার কোনও উপায় নেই। উভয়ের মধ্যে নিবিড় সম্পর্কটা ঠিক এই ব্যাপারগুলোর ওপরই গড়ে ওঠে। লোকে বলে বোঝাপড়া। না হলে সম্পর্ক ভেঙে যায়।
আমি মিত্রার সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙতে চাইনি। চাইলে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে থাকতাম না। নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ আমি বহুবার পেয়েছি। আর শরীর! দামিনীমাসির ওখানে যখন থাকতাম, চাইলেই পেতাম। হয়তো জীবনটা অন্য খাতে বইতো। কিন্তু মিত্রার কলেজ লাইফের চিঠিগুলো ছিলো আমার সবচেয়ে বড়ো বল ভরসা। ওর চিঠিগুলো আমাকে কারুর মুখের দিকে তাকাতে বারণ করতো। বার বার ও আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলতো আমি মরিনি বুবুন। আমি তোর কাছে ফিরে আসবই। তুই শুধু মাত্র আমার।
কতোদিন ওর কথা ভেবে রাতের পর রাত জেগে কাটিয়ে দিয়েছি। কোনও অসুবিধে হয়নি। বরং পরেরদিন পূর্ণ উদ্যমে কাজ করেছি। রাতে ক্লান্ত পাখির মতো বাসায় ফিরেছি। কোনও দিন খাবার জুটেছে কোনওদিন জোটেনি। কই অসুবিধে হয়নি। বার বার মন বলেছে মিত্রা তোর সঙ্গে আছে, বুবুন তোর চিন্তা কিসের। তাহলে আমার মধ্যে এই সংকোচ কেন। মিত্রা কোনও অন্যায় কথা বলছে না।
আমি এ কি করলাম? তাহলে কি আমি আমার আধিপত্য এদের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি? আমি কারুর কাছে কোনও দিন ঋণী থাকবো না। আমি সকলকে ঋণী করবো। সেই জায়গাটা মিত্রা মেনে নিতে পারছে না।
জানি না তখন সেই মুহূর্তে আমি কি করছিলাম।
একটা প্রবল ঝাঁকুনিতে আমার সম্বিত ফিরে এলো।
বুবুন, বুবুন এই বুবুন।
আমার চোখ বন্ধ মাথা নীচু। বুঝতে পারছি আমার চোখের জলে মিত্রার মুখটা ঝাপসা দেখছি।
কিরে আমি তোকে কি বললাম, তুই কাঁদছিস!
আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি।
এটুকু বলার অধিকার কি আমার নেই!
আমি মিত্রাকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মুখ গুঁজে দিলাম।
আচ্ছা বাবা আমার অন্যায় হয়েছে। আর কোনওদিন তোকে কিছু বলবো না। আমি মেয়ে ভ্যাঁ করে কাঁদতে পারি, তুই কাঁদতে পারিস এটা জানা ছিল না।
ছাড় ছাড় এখুনি ছোটোমা চলে এলে কেলো হয়ে যাবে। বলবে আবার, আধ দামড়া ছেলে, বউকে জড়িয়ে ধরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদে।
আমি ওকে ছাড়লাম না। আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরলাম।
আমি তো তোর শত্রু। আমি কি তোর নিজের। তাই আমার কাছে কিছু চাইতে তোর লজ্জা হয়, সঙ্কোচ হয়। আমার কোনও লজ্জা নেই দখ। তাই তোর কাছে দুহাত পেতে নিয়েই যাচ্ছি। তুই আমাকে ঘড় দিয়েছিস, বড়োমা, ছোটোমাকে দিয়েছিস, দাদা, মল্লিকদাকে দিয়েছিস। আমার মৃত বাবা, মার কথা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিস। সর্বোপরি আমাকে তুই নতুন ভাবে বাঁচতে শিখিয়েছিস। আমি এখনও তোর বাবা, মার শূন্যস্থান পূরণ করতে পারলাম না। অনেক কষ্টে তোর কাছ থেকে একটা জীবন পেয়েছি। জানিনা সেটা বেঁচে আছে কিনা। জানিনা তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব কিনা।
আমি মিত্রাকে ছেড়ে দিলাম। জানলার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
আমরা এখন বেরবো, তুই কি যাবি?
না।
গেলে ভালো লাগতো।
যাব না।
কোথাও বেরোবি?
বলতে পারছি না।
ওদের সঙ্গে কি বসবি?
না। ওদের চলে যেতে বল।
দেবা, নির্মাল্য আসুক।
ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে যা। কালকে আসতে বল।
বুঝতে পারলাম মিত্রা দরজার ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে গেল।
আমি বাথরুমে গেলাম। মুখটা ভালো করে ধুলাম, চোখে জল দিলাম। টাওয়েল দিয়ে ভালো করে মুখটা মুছলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে জানলার সামনে দাঁড়ালাম। মাথার মধ্যেটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। সিগারেটটা খেতে ভালো লাগলো না। ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। বিছানার ওপর মোবাইলটা পরে রয়েছে। এগিয়ে গিয়ে তুলে নিলাম, দেখলাম স্যুইচ অফ। অন করলাম। গাদা খানেক মিস কল আর ম্যাসেজ। সবাই আছে। কার নাম বাদ দেব।
কিরে সত্যি তুই যাবি না?
একবারে আমার পেছন থেকে শব্দটা ভেসে এলো। ঘুরে তাকালাম। মিত্রা একটা নতুন শালোয়াড় পরেছে। টিয়া পাখির গায়ের রংয়ে। ঠোঁট দুটো লাল টুক টুকে। কপালে ম্যাচিং করে একটা বিন্দির টিপ লিগিয়েছে।
মন ভালো হয়েছে?
আমি ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
তুই থাকলে সব সময় জার্নিটা একটু অন্যরকমের হয়।
তবু আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
দাদা নিয়ে এসেছে। দাদার ঘরে আছে।
আমার মুখ থেকে কোনও শব্দ নেই।
তুই কি বোবা হয়ে গেলি। আমার সঙ্গে কথা বলবি না?
তোরা যা। আমার ভালো লাগছে না।
একা একা নিজের সঙ্গে বোঝা-পড়া করবি?
আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
আমি জানি আমরা বেরিয়ে যাবার পর তুই বেরিয়ে যাবি। যেতে পারতিস আমাদের সঙ্গে।
এখন বিরক্ত করিস না।
বুঝেছি।
তোর খাবারটা এখানে দিয়ে যাব।
খেতে ভালো লাগছে না। তোর ফাইলটা দিয়ে যা।
ওটা নিয়ে এখন কি করবি!
কাজ আছে।
আমার জন্য তোকে আর কিছু করতে হবে না। যেদিন আমাকে নিজের মনে করবি সেদিন করবি।
বেশি বক বক করিস না। যা বলছি কর।
কেনো তুই কি ভাবিস, আমি তোকে ভয় পাই।
না, আমি সে কথা বলিনি। সকাল থেকে তুই অনেক বাঁকা বাঁকা কথা বলছিস।
আমি বলিনি তুই আমাকে বলিয়েছিস।
এখন যা কথা বলতে ভালো লাগছে না।
যেখানেই থাকিস নটার মধ্যে আসবি।
সেটা নাও হতে পারে।
তাহলে মাথায় রাখবি আজ রাত নটার পর থেকে তোর সঙ্গে আমার আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না।
কথাটা বলেই মিত্রা গট গট করে বেরিয়ে গেল।
আমি মিত্রার চলে যাওয়াটা ধীর স্থির ভাবে দেখলাম।
আমার ওপর কি আধিপত্য! কি ডিকটেটরশিপ! কই আমি ওর ওপর এতটা আধিপত্য বিস্তার করতে পারিনি! তাহলে কি ও আমাকে একতরফা ভালোবাসে?
আমি কি এখনও সেইভাবে ওকে ভালোবাসতে পারিনি? আমার সব কিছু মেকি। আমার ভালোবাসার মধ্যে কি কোনও প্রাণ নেই? সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।
মিত্রা আবার ফিরে এলো। ফাইলটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিল। কিছুক্ষণ আমার চোখে চোখ রেখে দাঁড়াল। ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে আঁচড়ে কামরে টুকরো টুকরো করে দিই। মিত্রার চোখে বক্র হাসি।
ঘর থেক বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর গাড়ির আওয়াজ পেলাম। বুঝলাম সকলে বেরিয়ে গেল।
আমি আলমাড়িটা খুলে ফাইলটা তুলে রাখলাম। পাঞ্জাবী খুলে আমার পেটেন্ট সেই পোষাক পুরনো ছেঁড়া ছঁড়া জিনসের প্যান্ট আর আধময়লা দোমড়ানো মোচড়ানো গেঞ্জিটা লাগালাম। আঃ কি আরাম। মনে মনে বললাম, অনি নতুন পোষাকে তোকে দারুণ দেখতে লাগে, তবে এই পুরনো পোষাকে অনির আসল রূপটা ফুটে বেড়োয়। এইখানেই অনির বিশেষত্ব, অনি নিজেকে নিজে খুঁজে পায়।
গেট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। ছগনলাল আমায় দেখে হাসলো।
কি ছগনলাল হাসছো কেন?
কাল তোমার বিয়ে। বড়োবাবু মা সব বাজারে গেল। আমাকে বললো তোমার সঙ্গে যারা গল্প করে তাদের কাল আসতে বলবে।
তুমি খুশি ছগনলাল।
তোমাকে দিদিমনিকে ভালো লাগবে।
আমি হাসলাম।
ট্র্যাংগুলার পার্ক বাসস্ট্যান্ডে এসে বাস ধরলাম। সোজা চলে এলাম পার্কস্ট্রীট। এশিয়াটিক সোসাইটির ফুট ধরে চলে এলাম আস্থার অফিসে। অনেকদিন সুজিতদার সঙ্গে দেখা হয়নি। সাংবাদিকতার প্রথম জীবনে সুজিতদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। একটা প্রোডাক্ট লঞ্চের ক্যাম্পেনিংয়ে কভার করতে গিয়ে সুজিতদার সঙ্গে প্রথম আলাপ।
তারপর জানতে পারলাম সুজিতদার এ্যাড এজেন্সি আছে। তখন সুজিতদা আমাকে দিয়ে কপি লেখাত। বেশ কিছু পয়সা পাওয়া যেত। কিন্তু ওই যে, আমার যেহেতু কোনও স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। যোগাযোগের অভাবে ঠিক মতো কাজ করে উঠতে পারতাম না। তবে রিলেসন নষ্ট হতে দিইনি। মাঝে মাঝে আসতাম।
বিল্ডিংটার সামনে আসতে একটু অবাক হলাম। কিছুই চিনতে পারছি না। কোথায় সেই আদ্যিকালের পুরনো বিল্ডিং! এখানে দেখছি একটা মাল্টি স্টোরেড ঝাঁ চকচকে বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে।
সত্যি আমি কতদিন এ তল্লাটে আসিনি! কাজের প্রয়োজনে আগে প্রায় আসতাম সুজিতদার এখানে। চাকরি পাওয়ার পর এই পথে মনে হয় একবার এসেছি। এমনি দেখা সাক্ষাৎ হতো সুজিতদার সঙ্গে। নিচের পানের দোকানটায় জিজ্ঞাসা করলাম। বললো এই বিল্ডিং-এর ফিফথ ফ্লোরে চলে যান। অগত্যা মধুসূদন তাই করলাম।
ফিফথ ফ্লোরে এসে সব কিছু কেমন গুলিয়ে গেল। আনেক অফিস। কোন দিকে যাই। আবার একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। বললো, ওই কর্নারের অফিসটা আস্থা।
কাঁচের দরজার সামনে এলাম। পুরনো অফিসের সঙ্গে আকাশ পাতাল পার্থক্য। সেই কোন যুগে এসেছিলাম। এখন সব বদলে গেছে। সেই মোটা ভ্যাটকা রিসেপসনিস্ট মেয়টা এখন আর নেই। দেখলাম রিসেপসনে একজন তরতাজা তরুণী বসে আছে। বেশ সুন্দর, শোকেশের ডল পুতুলের মতো। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। যা হয় আর কি। এগিয়ে গেলাম।
সুজিতদার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।
ভদ্রমহিলা আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন, যেন আমি একজন হরিদাস পাল, সুজিতদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি!
আপনি ঠিক বলছেন?
কেন সুজিতদা এখানে নেই!
হ্যাঁ আছেন।
তাহলে!
আপনার এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
সুজিতদার সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ঢুকতে হয় এখন?
আপনি কতোদিন আগে এসেছিলেন?
ধরুন বছর আটেক আগে। তখন এই বাড়িটা হয়নি।
তরুণী মুখের কাছে হাত নিয়ে মুখ টিপে হাসলেন।
আপনার নাম?
পকেট থেকে মানিপার্সটা বার করে কার্ডটা দিতে যাচ্ছিলাম। কি খেয়াল হতে আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম।
আপনার ভিজিটিং কার্ড আছে?
না। বলুন অনি এসেছে।
নাম বললেই হয়ে যাবে!
না হলে ফিরে যাব।
বসুন।
আমি গিয়ে ভিজিটরদের জন্য রাখা সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। এই মুহূর্তে আমি ছাড়া আর দুজন বসে আছেন। চারিদিকে সব সুন্দরী মেয়ে। ছেলেগুলোও দেখতে খারাপ নয়।
ভদ্রমহিলা ইন্টারকমে কার সঙ্গে কথা বললেন। দেখলাম কাঁচের ঘর থেকে সবাই আমাকে মাপছে। প্যান্টের চেন খোলা নেই তো? এটা আমার প্রায়ই হয়ে থাকে। আড়চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে একবার দেখলাম, আমার প্যান্টের চেন খোলা আছে কিনা। বহুবার মিত্রা হাসতে হাসতে আমাকে ইশারা করেছে। অসতর্কের ভান করে হাত দিয়ে দেখলাম, না চেনটা টানাই আছে।
কোথায় অনি, কোথায় অনি।
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ভেতর থেক বেরিয়ে এসে চেঁচামিচি শুরু করেদিলেন।
সেই রেসেপসনিস্ট ভদ্রমহিলা ঢোক গিলে উঠে দাঁড়ালেন, বার পাঁচেক স্যার স্যার বলে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এলেন।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
ভদ্রলোকের মাথায় বেশ টাক পরেছে। চোখে চশমা। হ্যাঁ, মুখের আদলের সঙ্গে সুজিতদার মুখটা মিলে যাচ্ছে। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি। ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। সুজিতদা সবার দিকে চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে স্থির দৃষ্টি ফললো।
কিরে ব্যাটা?
সুজিতদা এগিয়ে এলো।
আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে পিঠে ফটাফট তিন চারটে চাপর মেরে দিল।
আমি তোমাকে চিন্তেই পারিনি! তোমার মাথার সেই কুচকুচে কালো চুল গেল কোথায়?
সুজিতদা হাসছে।
তুমি একেবারে বুড়ো মেরে গেছো। তোমার চুলের অবস্থা এখন এপার ওপারের মতো।
বয়স কি কম হলো।
তাহলে বৌদিও বুড়ী হয়ে গেছে।
তা হবে না।
তাহলে দেখা করবো না। আট বছর আগের দেখা বৌদির মুখটাই আমার চোখে থাক।
কি লীনা তোমরা চিনতে পারছো না?
সুজিতদা রিসেপসনিস্ট মেয়াটার দিকে তাকাল।
তারপর আমার দিকে ফিরে।
তুই কিন্তু আগের মতোই রয়েছিস। একবারে মডেলদের মতো ফিগারটাকে ধরে রেখেছিস।
না খেয়ে খেয়ে।
আমার কথা শুনে, লীনা মেয়েটি আগের মতোই মুখের ওপর হাত রেখে মুখ টিপে হাসছে।
কাঁচের দেওয়ালের ওপাশ থেকে যারা এতক্ষণ আমাকে দেখছিল, তারা বেশ অবাক।
আমি ভাবতেই পারছি না তুই আমার অফিসে আসবি!
কিছু কপি দাও না, লিখে দিয়ে যাই। ভীষণ টাকার দরকার।
মারবো এক থাপ্পর।
সুজিতদা হাত তুললো, আমি হাত তুলে আড়াল করার চেষ্টা করলাম।
গুটি গুটি করে বেশ কয়েকজন সেই কাঁচের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
মেয়েগুলো আমায় তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখছে। এ কেমন জোকার!
আর যারা ভিজিটার আছেন অপেক্ষা করে তারা অবাক।
আমাদের কাগজের নাম করে একটি ছেলের দিকে তাকিয়ে সুজিতদা বললো, কিরে সাগ্নিক মেটিরিয়ালটা কাগজে পাঠিয়ে দিয়েছিস।
দিয়েছি স্যার, কিন্তু রবিবারে ছাপতে পারবে না বলেছে। কে যেন একজন ম্যাডাম নতুন জয়েন করেছেন। তিনি না বললে ছাপা যাবে না, চম্পকদা বললেন।
রাখ তোর ম্যাডাম, কিরে মালিক আমার বিজ্ঞাপন ছাপা হবে না?
আমি হাসছি।
এবার সবার চোখ প্রায় ঠেলে বেরিয়ে আসার জোগাড়। কেউ যেন হাজার পাওয়ারের বাতি জ্বেলে দিয়েছে ওদের চোখের সামনে।
এ কি শুনলো!
আবার সাগ্নিকের দিকে সুজিতদা ঘুরে তাকাল। ওরে ওই কাগজের ওয়ান অফ দেম পার্টনার আমার সামনে দাঁড়িয়ে, আর তুই বলছিস কিনা বিজ্ঞাপন ছাপা হবে না।
উনি অনি ব্যানার্জী! লীনা বলে মেয়েটি বিষ্ময়ে বলে উঠলো।
কেন তোমায় কার্ড দেয়নি?
না!
তাহলে?
উনি একবার মানি পার্টসটা বার করেছিলেন তারপর পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন, বললেন, বলুন অনি এসেছে। আমি বললাম, এতেই উনি চিনতে পারবেন। উনি বললেন, না চিনতে পারেলে চলে যাব।
ইস কি মিস করলে লীনা, তুমি ওর কাছ থেকে কার্ডটা আদায় করতে পারলে না। একজন অতোবড়ো কাগজের মালিক তোমায় কার্ড দেবে তুমি ভাবতে পারো।
লীনা মাথা নীচু করলো, সরি স্যার।
আর সরি, এ সুযোগ বার বার আসবে তোমার জীবনে?
সবাই এবার কাঁচের ঘর থেকে বেরিয়ে ফ্লোরটায় ভিড় করেছে।
গত পর্শু ওর ঝড়তোলা লেখাটা পড়েছো।
হ্যাঁ স্যার, উনিই যে সেই ব্যক্তি বুঝবো কি করে?
ও চিরটাকাল একরকম থেকে গেল।
আমার হাতটা চেপে ধরলো।
চল চল ভেতরে চল। তুই যখন এসেগেছিস তখন সামনা সামনি তোর সঙ্গে কথা বলে নেওয়া যাবে। একজন ক্লায়েন্ট এসেছেন ভেতরে।
সুজিতদা আমার হাত ধরে হিড় হিড় করে ভেতরে টেনে নিয়ে গেল। অনেক চোখের চোরা চহুনি আমার পেছনে প্ল্যাকারের মতো সেঁটে রইলো। দুজনে মিলে সরু করিডরটা দিয়ে সুজিতদার ঘরে এলাম। ছোটো ঘর, কিন্তু দারুণ সাজান গোছান। কর্পোরেট হাউসের মালিকের ঘর যেমন হয় আর কি।
তুই আমার চেয়ারটায় বোস।
একবারে ফালতু কথা বলবে না, তাহলে ফুটে যাব।
কতোদিন পর তোর সঙ্গে দেখা। সুজিতদা আবার বুকে জড়িয়ে ধরলো।
প্রায় আট বছর। তোমার পুরনো অফিসে কপি লিখতে আসতাম।
ভুলে যা। সে তো এক যুগ। গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। তখন কাজ করেও মজা ছিল। এখন কমপিটিসনের মার্কেট টিঁকে থাকতেই দম হাল্কা হয়ে যায়।
তোমার তো ভালোই ব্যাবসা হচ্ছে।
তোদের কাগজটা আছে বলে টিঁকে আচ্ছি। তাও চম্পক সর্টিয়ালি করছে, কি বলবো।
কেন!
আজ না কাল, কাল না পর্শু। জায়গা নেই। পার্টির চয়েস মতো যদি ডেট না পাই, জায়গা না পাই, বিজ্ঞাপন দিই কি করে বল।
তুমি ইয়ার্লি কনট্র্যাক্টে যাচ্ছনা কেন?
কতোবার বলেছি, চম্পক বলেছে কাগজের লস। হবে না। যদিও বা হওয়ার মতো একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো। শুনলাম সব ওলোট পালট হয়ে গেছে। নতুন ম্যানেজমেন্ট। তাদের রেটও নাকি বেশ হাই। ভেবেছিলাম তোর কাছে একবার যাব। অতি কষ্টে তোর ফোন নম্বর জোগাড় করলাম। ওমা দেখি সারাক্ষণ স্যুইচ অফ।
তাহলে বোঝ, আমি কেমন মালিক!
সুজিতদা হেসে ফেললো।
সুজিতদা নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বললো, তুই হঠাৎ আমার অফিসে।
সকাল থেকে মনটা খুব খারাপ, ভালো লাগছে না। ভাবলাম আমার পুরনো আত্মীয়স্বজন কারা আছে। প্রথমেই তোমরা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। চলে এলাম।
এই তোর গল্প শুরু হলো, আসল কথা বল?
হ্যাঁগো বিশ্বাস করো।
আমার মুখটা তোর হঠাৎ মনে পরলো কেন?
বলতে পারবো না। মনকে জিজ্ঞাসা করিনি।
কি খাবি?
যা বলবো খাওয়াতে পারবে।
বলেই দেখ, পারি কিনা।
আসার সময় পার্কস্ট্রীটের মোড়ের মাথায় দেখলাম গরম গরম ছেঁড়া পরোটা তৈরি করছে। আর ঘুগনি। খাওয়াবে?
তুই কি আমার সঙ্গে ফাজলাম করছিস!
উঠে দাঁড়ালাম, বুকের ওপর হাতজোড় করে প্রণামের ভঙ্গিতে বললাম, তাহলে চলি।
আরে বোস বোস খেপে যাচ্ছিস কেন, সত্যি তুই খাবি!
সুজিতদা অনি এখনও মালিক হয়নি। হলে তোমার কাছে সে আসতো না।….
আমার গলার স্বরটা সামান্য হলেও পরিবর্তন হলো।
সুজিতদা আমার দিকে তাকিয়ে।
….মালিক হলে সে তোমাকে ডেকে পাঠাত। মালিক ডাকলে তুমি যেতে না?
মালিক অনির কাছে যেতাম, ছোটোভাই অনির কাছে যেতাম না।
এই তো তোমার মুখ থেকে আসল কথাটা বেরিয়ে গেল।
তাহলে ছেঁড়া পরোটা নিয়ে আসতে বলি।
অবশ্যই। আর একটা কাজ করবে।
বল।
পাশেই গরম গরম জিলিপি ভাজছে। গোটা কয়েক নিয়ে আসতে বলো।
সত্যি অনি, তুই এখনও সেরকম আছিস।
বাড়ি থেকে হেঁটে বাস স্ট্যান্ড, সেখান থেকে পাবলিক বাসে পার্ক স্ট্রীট, হেঁটে তোমার অফিস। এর মধ্যে একটুও জল মেশান নেই, ভাজলও নেই।
তোকে দেখে আমার ভীষণ ভীষণ ভাল লাগছে। সুজিতদার চোখে মুখে ইমসন্যাল হয়ে পড়ার ছবি।
তোমাকে দেখেও। মনের মধ্যে একটা শান্তি বোধ করছি। বৌদি ভালো আছে?
দাঁড়া।
সুজিতদা মোবাইল বার করে পটাপট বোতাম টিপলো। ভয়েজ অন করতে রিংটোনে রবীন্দ্রনাথের গান ভেসে এলো। আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি।
হ্যালো, বলো।
তুমি কোথায়?
একটু মার্কেটিংয়ে এসেছি।
আমার কাছে একজন এসেছে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছে, তুমি কেমন আছ।
কে গো?
অনি।
অনি! ওটা বেঁচে আছে?
বালাই ষাট ও কথা বলতে আছে।
বলবো না, দাও ওকে ওর চুলের মুটিটা ধরি।
তোমার কথা ও শুনতে পাচ্ছে।
কিরে ছাগল, পথ ভুলে।
না গো বৌদি, পৃথিবীটা যে গোল আজ অনুভব করলাম।
এভাবে তোর সঙ্গে কথা বলবো না। কবে আসবি?
হঠাৎ কোনও একদিন।
হ্যাঁগো ও কি সেরকমই দেখতে আছে। না মুটিয়েছে।
আরি বাবা একেবারে সেরকম কোনও পরিবর্তন নেই, সেই ময়লা ময়লা গেঞ্জি, আর ছেঁড়া ছেঁড়া জিনসের প্যান্ট।
মাথার চুল?
এখনও সেই রকম। দাড়ি গোঁফ ওর কোনও দিন ছিল না। একটু একটু ছাগল দাড়ি, সেটা আজ কেটেছে দেখছি।
আমি হেসে ফেললাম। ওর একটা ছবি তুলে আনো।
সুজিতদা হাসছে।
ওকে কিছু খাইয়েছ?
আমি ওকে বললাম কি খাবি? ও কি বললো জানো—
কি খেতে চেয়েছে রুটি আলুর দম।
সেইরকম। ছেঁড়া পরোটা, ঘুগনি আর জিলিপি।
ও ওই হাউসের মালিক হওয়ার যোগ্য নয়।
সুজিতদা হাসছে।
কিরে অনি কবে আসবি।
দাদাকে একটা দিন ঠিক করে দিচ্ছি, সেদিন আসব।
আয় জমিয়ে গল্প করবো। বিয়ে করেছিস?
না। মেয়ে পাচ্ছি না।
এই যে শুনলাম তুই তোর মালকিনকে পটিয়েছিস।
তোমার কি বিশ্বাস হয়?
বিশ্বাস হয় না। অবিশ্বাসই বা করি কি করে?
ঠিক আছে এই বিষয় নিয়ে পরে কথা হবে।
শোনো।
বলো।
ও যা খেতে চায় ওকে খাওয়াও।
আচ্ছা।
রাখি।
হ্যাঁ।
একজন এসে ঘরে ঢুকলেন।
স্যার।
হ্যাঁ বলুন।
আমরা ওনাকে বোঝালাম। উনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
কি বুঝলে?
মনে হচ্ছে উনি ঠিক সেটিসফায়েড নন।
নিয়ে এসো।
ছেলেটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সুজিতদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
হ্যাঁরে অনি তুই এখনও স্ক্রিপ্ট তৈরি করিস।
কেন বলো!
একটা পার্টিকে কিছুতেই পটাতে পারছি না।
অনেক দিন স্ক্রিপ্ট লেখা ছেড়ে দিয়েছি। আঁকি বুকিও চুলোর দরে গেছে।
একটা ভালো পার্টি এসেছে বম্বে থেকে, ওরা এখানে প্রোডাক্ট লঞ্চ করবে। বহুদিন থেকে লেগে আছি, কিছুতেই ফাঁসাতে পারছি না। কাজটা করবি?
সব!
তুই করলে আমি নিশ্চিন্ত হই। তাছাড়া তুই এখন মালিক বলে কথা। ওয়েট ক্যারি করবে।
কতো দেবে?
প্রোজেক্টটা পঞ্চাশ কোটি। ওরা ফেজে ফেজে একবছরে খরচ করবে। পুরো ইষ্টার্ন রিজিয়ন আমাকে দেবে। তোদের কাগজের জন্য আমি ওয়ান থার্ড ধরে রেখেছি। তোকে একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বাকিটা ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ব্যানার সব কিছুতে।
আমি কিন্তু লে আউট প্ল্যানিং করে ছেড়ে দেব। বাকি তোমাকে করতে হবে।
অবশ্যই তুই ভিজুয়ালি যেমন করে দিতিস আমাকে সেই রকম করে দে।
তাই হবে। আমি কি পাব?
তোর পেছনে আমি চার খরচ করতে পারি।
চার লাখ না কোটি।
তুই কি এখন লাখে সীমাবদ্ধ, তোকে ধরতে গেলে কোটি দরকার।
গুল মেরো না।
ঠিক আছে ভদ্রলোককে আসতে দে, কথা বল।
আমি সুজিতদার দিকে তাকিয়ে হাসছি।
রাজি হলে, তোর কাগজের ব্যাপরটা আজই কিন্তু ওনার সামনে ফাইন্যাল করে নেব।
আমার কিন্তু ক্যাশ চাই হাফ এ্যাডভান্স।
তাই হবে।
পটাতে পারলে আজকেই দিতে হবে।
তুই যদি আমার হয়ে পটাতে পারিস, আমি কথা দিলাম যত রাত হোক তোর বাড়িতে আমি টাকা পৌঁছে দেব।
ডাকো। তাহলে আমার ছেঁড়া পরোটা এখন খাওয়া হবে না।
পরে খাস। আগে কাজ।
সুজিতদা ইন্টারকমে কথা বললো।
সেই ভদ্রলোক আর একজন স্যুট টাই পরিহিত টিপ টপ একজনকে নিয়ে সুজিতদার ঘরে এলেন। আমি ভ্যাবলার মতো ওনার দিকে তাকালাম। সুজিতদা প্রথমে ব্যবসায়িক ভাষণ দিলেন। নাম বললেন মিঃ নেওটিয়া। বাংলা, হিন্দী, ইংরাজী মিশিয়ে কথা বলছেন। আগামী মাস থেকে উনি ক্যাম্পেনিং করতে চান।
সুজিতদা আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
ভদ্রলোক প্রথমে আমাকে দেখে ভ্রু-কোঁচকালেন। তারপর আমার নাম শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
আপনার জন্য রাজনাথ আর ওই মিনিস্টার….।
সুজিতদা তাকিয়ে আছে।
আমি ঠিক হাসলাম না। আবার গম্ভীরও থাকলাম না।
ভদ্রলোক আমার হাতটা ধরে বেশ কয়েকবার ঝাঁকিয়ে দিলেন।
প্রায় একঘণ্টা কথা হলো। ভদ্রলোককে পটিয়ে নিলাম। দুটো কনট্রাক্ট লেটার তৈরি হলো। একটা আমার কাগজের সঙ্গে, আর একটা আমার সঙ্গে। উনি একটা কুড়ি কোটি টাকার চেক আস্থার নামে দিলেন। কনট্রাক্টগুলো আমি নিলাম। কাজ বুঝলাম। সুজিতদা সব ফাইল করে আমাকে দিল। ভদ্রলোক চলে গেলেন।
ভদ্রলোককে অফিসের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে সুজিতদা হই হই করতে করতে ঘরে ঢুকলো। আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। তোর জন্য আজকে ব্যাবসাটা পেলাম। তোর কি কনসেপ্টরে। তুই জানিষ ওই ভদ্রলোককে আমার অপনেন্ট এম.এস. এ্যাড এজেন্সি ভাগিয়ে নিয়ে চলে গেছিল। কোনও মতে অনেক কষ্টেশিষ্টে নিয়ে এসেছি। আজও কোনও মতে ওকে সেটিসফায়েড করতে পারেনি এরা কেউ।
সকাল থেকে দুটো সেসন পার করে দিয়েছে এরা। তুই এক ঘণ্টায় মালটাকে কুপকাত করে দিলি! তুই তো এখন অনেক বড়ে খেলোয়াড়।
আমার ছেঁড়া পরোটা।
আনছি আনছি। ওরে শালা! এখন বুঝছি তোকে কেন ম্যাডাম মালিক বানিয়েছে। যার হাত থেকে সহজে মাল গলে না এককথায় কুড়ি কোটির চেক দিয়ে চলে গেল।
মাথায় রাখবে আমি ক্যাশ চেয়েছি, কাগজেরটা পুরো এ্যাডভান্স চেয়েছি।
দিয়ে দেব।
দিয়ে দেব না। বুধবারের মধ্যে অফিসে চেক পৌঁছনো চাই।….
এই তুই ঝামেলা শুরু করছিস।
….না হলে পুরো সিডিউল ক্যানসেল করে দেব।
তুই কি আমাকে মারবি!
মাল পেয়ে গেলে মারব না। তাড়াতাড়ি খাবার বলো।
ও দিকটা একবার তাকা।
দেখলাম কাঁচের দরজার ওপাশে সকলে দাঁড়িয়ে আছে।
সারাটা অফিস রাষ্ট্র হয়ে গেছে।
সুজিতদা ইশারা করলো ভেতরে আসার জন্য।
দুজন ভেতরে এলো।
স্যার আমরা অফিসের সকলে অনিবাবুর সঙ্গে আলাপ করতে চাই। সবাই করিডরে জড়ো হয়েছে।
কি বুঝছিস। সবাই জেনে গেছে তুই আজ অফিসের হয়ে মাল ফাঁসিয়েছিস।
আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, আমার কমিশন।
পেয়ে যাবি।
ঘরে যে দুজন দাঁড়িয়ে ছিল তারা মুচকি মুচকি হাসছে।
ধার বাকি নেই। ক্যাশে নেব।
তোকে যখন কথা দিয়েছি, দেব।
ফুল ক্যাশ।
তাই হবে। তুই আমার ছ-মাসের ব্যবসা তুলে দিলি। তোকে দেব না তো কাকে দেব।
ছেলে দুটোর দিকে তাকিয়ে, তোরা সবাই বোস, ও তোদের সঙ্গে মিট করবে।
ওরা বেরিয়ে গেল।
সুজিতদা বৌদিকে ফোন করে সব জানাল।
বৌদি খুশিতে ডগমগ করছে।
আমার আর্ট ডিপার্টমেন্টের ছেলেগুলোর সঙ্গে তুই একটু মিটিং করে যা।
তাই চলো, ওখানে বসে সবার সঙ্গে আলাপও করা যাবে, আবার কথাও বলে নেওয়া যাবে।
দুজনেই উঠে দাঁড়ালাম।
চলবে —————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/Wb3x28z
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment