কাজলদিঘী (৫১ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

৫১ নং কিস্তি
—————————

সুজিতদা।

বল।

ওখানে বসে ছেঁড়া পরটা খেলে তোমার অফিসের স্টাফেদের জাত যাবে না তো?

সুজিতদা হো হো করে হেসে ফেললো।

ভরং যতই করিনা কেন বুঝলি অনি আমরা সবাই এখনও মানসিকভাবে মধ্যবিত্তই রয়ে গেছি।

আমি সুজিতদা দুজনেই আর একটা ঘরে এলাম। সুজিতদার চেম্বারের থেকে এই ঘরটা বেশ বড়ো।

সবাই আমার সঙ্গে এসে আলাপ করলো। মেয়েগুলো আমাকে দেখে মুচকি হাসে। বিশেষ করে লীনা বলে মেয়েটি।

আমাদের প্রথম ক্যাম্পেনিং সেই চায়ের বিজ্ঞাপনটা তোমাদের মনে আছে।

ওরা সুজিতদার মুখের দিকে তাকিয়ে।

বহুবার গল্প বলেছি তোমাদের।

হ্যাঁ স্যার, চুমুকে চমক।

ঠিক বলেছো।

ওটা অনির কনসেপ্ট। সেইদিন আস্থার নাম সবাই জেনেছিল। আজ আট বছর পর ও আবার এই কাজে হাত দিল। আশা রাখছি তোমরা নতুন কিছু পাবে।

আমরা স্যার অনিদার সঙ্গে কাজ করতে পারি না।

সবই তোমরা করবে, ও শুধু লে-আউট, ডিজাইন, প্ল্যানিং করে দেবে। তোমাদের সঙ্গে ও এখুনি একটা ছোট্ট মিটিং করবে।

তাহলে খুব ভাল হয় স্যার।

ছেঁড়া পরটা ঘুগনি আর জিলিপি এলো।

আমার খাওয়ার বহর দেখে মেয়েগুলো হাসাহাসি করলো।

খেতে খেতে ওদের সঙ্গে মিটিং করলাম, ছবি আঁকলাম, ওদের যে আর্ট ডিরেক্টর তার সঙ্গে বসে আমার চিন্তা-ভাবনার আদান-প্রদান করলাম।

আবার সুজিতদার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গেঁজাবার পর উঠলাম।

দেখতে দেখতে প্রায় চার ঘণ্টা কোথা থেকে কেটে গেল বুঝতে পারলাম না।

সুজিতদাকে আমার কার্ডটা দিলাম।

মেটেরিয়ালগুলো আটটার সময় এই এ্যাড্রেসে নিয়ে এসো, আমি থাকবো।

এ তো ট্র্যাংগুলার পার্কের ঠিকানা।

হ্যাঁ।

আমার বাড়ির থেকে মিনিট পাঁচেকের দূরত্ব।

আমি এখন এখানেই থাকি। চলে এসো।

আমি ঠিক ওই টাইমের মধ্যে ফিরে যাব।

আচ্ছা।

তুই একটু চম্পককে বলে দে।

বলে দেব।

বেরিয়ে এলাম।

সুজিতদা গেটের বাইরে করিডর পর্যন্ত এল।

রাস্তায় এসে দেখলাম সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। রাস্তার নিওন আলো সবে জ্বলে উঠেছে।

পার্কস্ট্রীটের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। মোবাইলটা পকেট থেকে বার করে অন করলাম।

মিস কল আর ম্যাসেজ।

দেখলাম তার মধ্যে মিত্রার মিস কল সব চেয়ে বেশি। একটা ম্যাসেজও করেছে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিস। বড়োমাকে কথা দিয়েছিলি আজ বেরবি না।

আবার ম্যাসেজ, ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছিস কেন। অনেক জিনিষ কিনেছি। তোকে কাল সাজাব। আমার মনের মতো করে।

ম্যাসেজ দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম। পথচলতি লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেলাম।

সরি।

লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিল।

হঠাৎ রাস্তার ধারে ডাস্টবিনে বসে থাকা পাগলটার দিকে চোখ পড়তেই হেসে ফেললো।

থমকে দাঁড়ালাম।

এঁঠো পাতা থেকে খাবার খুঁটে খাচ্ছে। চিনতে পারলাম। চোখ মারলাম। সোজা হাঁটতে হাঁটতে এসে মোড়ের দোকান থেকে দুটো সিগারেট কিনলাম।

এ্যাসিয়াটিক সোসাইটির শিঁড়িতে এসে বসলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। একটা হাতে রাখলাম। সুমন হেলতে দুলতে হাঁসতে হাঁসতে আমার কাছে এসে বসলো। আমি যে শিঁড়িতে বসলাম তার তিনধাপ নিচে। সিগারেটটা ইচ্ছে করে ফেলেদিলাম। সুমন কুড়িয়ে নিয়ে টানতে শুরু করলো।

চারদিকে রাস্তার নিওন আলো গুলো ঝক ঝক করছে। হোর্ডিং-এর আলো এসে পরেছে সোসাইটির শিঁড়িতে।

আমি ওর কাঁধে হাত দিয়ে সিগারেটটা দিতে বললাম। ও চোখ মারলো। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ওর সিগারেট থেকে আমার গোটা সিগারেটটা ধরালাম। দু-একজন হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাঁকা চোখে দেখে হাসলো।

সিগারেট খাচ্ছি আর নিজের মনে কথা বলছি।

কিরে এখানে কি করতে?

সুমনও সিগারেট খাচ্ছে, মাথা নীচু করে ধুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমার কথার উত্তর দিয়ে চলেছে।

তোমার লেখার রি-অ্যাকসন। আমাদের রাতের ঘুম কেরে নিয়েছো।

যাঃ।

হ্যাঁগো। ওদিকে সাদা পোষাকের মাল তোমায় আমায় লক্ষ্য করছে।

আমাকে চেনে?

না। মাপছে।

তাহলে ফুটে যাই।

বসো, অসুবিধে নেই।

তাহলে আর দুটো সিগারেট কিনে আনি।

আমি উঠে চলে গেলাম। সিগারেটের দোকানে গিয়ে সিগারেট কিনলাম সুমন আমার পেছন পেছন এসে আমার গায়ে হাত দিয়ে সিগারেট চাইলো।

আমি একবার ওর দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকালাম।

সুমন হাত পেতে রয়েছে।

একজন নোংরা পাগল একজন ভদ্রলোকের গায়ে হাত দিয়ে সিগারেট চাইলে যা করে আমি সুমনকে তাই করলাম। উপরন্তু একটা সিগারেট দিলাম। আবার এসে বসলাম।

সুমন আমার পেছন পেছন এসে একটু দূরত্ব নিয়ে বসলো। চোখ চারিদিকে সজাগ।

গুরু দারুণ এ্যাকটিং করলে। মাল পুরো হাওয়া।

তোর কি আজকে এখানে ডিউটি।

হ্যাঁ। তোমাকে যাবার সময় দেখেছি।

তোকে লক্ষ্য করিনি।

জানতাম। তোমার চোখ। দেখলে একবার থমকে দাঁড়াতে।

তখন কোথায় ছিলি?

ব্লু-ফক্সের ধারে।

এখানে কিসের গন্ধ।

শুনছি আমেরিকান হাউসে এ্যাটাক হবে।

খবরটা দিস। আমার নম্বর আছে।

না।

ইচ্ছে করে মানি পার্টসটা বার করে উঠে দাঁড়ালাম কার্ড বার করতে গিয়ে মানিপার্টসটা হাত থেকে ফেলে দিলাম। কাগজপত্র টাকা পয়সা পরে গেল। সুমন নিজের জিনিষটা নিয়ে নিল।

আমি একটা একটা করে সময় নিয়ে গুছিয়ে তুলে মানি পার্টসে রাখলাম।

আরও কিছুক্ষণ বসে ওর সঙ্গে গেঁজালাম।

প্রবীরদার থেকে তুমি একটু সাবধানে থেকো।

কেনরে!

তোমাকে স্কিম করার ধান্দা করছে।

পারবে না।

জানি তোমার হাতটা অনেক লম্বা। আজও চারটে গাড়ি অশ্বিনীনগরে ঢুকেছে। সব অটো মাল।

এখন কি সব ছেড়ে ছুড়ে ওই ব্যবসা শুরু করেছে!

ওটা রাজনাথের।

এ্যাড্রেস।

লোকটার ফার্মাসির ডিস্ট্রিবিউটর সিপ আছে।

মুখার্জী জানে?

না। চেপে আছি। স্টেটের ব্যাপার, ওরা আগে খবর পায় কিনা দেখি।

সেদিনের মালটা?

যখন জানলাম, তখন তুমি খেল খতম করে দিয়েছ।

মোবাইলের ঘরিটা দেখলাম সাতটা বাজে।

আজ চলিরে।

যাও।

ওখান থেকে উঠে সোজা রাস্তার এপারে কালীঘাট মাঠে এসে দাঁড়ালাম।

বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে না।

সুজিতদাকে একটা ফোন লাগালাম।

কথায় তুমি?

তোর মাল জোগাড় করতে গেছে। আর কিছুক্ষণ পর এসে পরবে। তারপর বেরবো।

শোনো আমি একটা কাজে ফেঁসে গেছি। তুমি আমার বাড়ির গেটে যে দারোয়ান আছে, ওর নাম ছগনলাল, ওর কাছে রেখে আসবে।

যদি কিছু হয়।

কিছু হবে না।

তুই যখন বলছিস রেখে আসবো।

সোজা একটা ট্যাক্সি ধরে চলে এলাম গঙ্গার ধার।

আমার সেই জায়গা। এই রাতে এই জায়গায় বড়ো একটা কেউ আসে না।

দূরে জেলে নৌকগুলোয় রান্না চাপিয়েছে। স্টিমারের ছেঁড়া ছেঁড়া আলো গঙ্গার বুকে পিছলে পরে কেঁপে কেঁপে উঠছে।

মিঃ মুখার্জীকে ফোন করলাম।

কি স্যার, কি খবর?

মুখার্জী হাসছে।

রবিবার একবার সময় রাখবেন। সন্ধ্যার পর আমার এখানে একবার আসতে হবে।

মুখার্জী জোড়ে হেসে উঠলো।

হাসছেন যে—

নেমন্তন্ন এই তো?

হ্যাঁ।

জানি।

কি করে?

দাদা ফোন করেছিলেন।

তাহলে সবই জেনেছেন। টোটাল টিম নিয়ে আসবেন।

যাক পাখি এবার দাঁড়ে বসবে।

পার্ক স্ট্রিটে লোকজন ঘুরতে দেখলাম।

এ খবর পেলেন কোথা থেকে!

বলুন না, আমি যা বলছি সত্যি কিনা।

সত্যি।

আমেরিকান হাউস টার্গেট।

সেরকমই খবর।

আমি যেন মালটা আগে পাই মাথায় রাখবেন।

মুখার্জী হাসছে।

আচ্ছা আপনি খবরটা পেলেন কোথা থেকে?

পেয়েছি।

সত্যি, এবার আপনার পেছনে আমাকে লোক লাগাতে হবে।

লাগান। কে বারণ করেছে।

সত্যি আপনি ইনভিজিবিল ম্যান।

হাসলাম। রাখি।

আচ্ছা।

ফোনটা পকেটে রাখতেই একটা ছায়া মূর্তি সামনে এসে দাঁড়াল।

দাদা চা আনি।

আবিদ, রতন ছাড়া ইসলামভাই-এর দলের আমি কাউকে সেই ভাবে চিনি না। তবে ইসলামভাই-এর দয়ায় এদের অনেকেই আমাকে চেনে।

দেখলেই মনে হবে নিপাট ভাল ছেলে। এদের চোখই অনেক কথা বলে।

আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

চা-এর সঙ্গে কিছু আনি।

শুধু চা আন।

ছেলেটি চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা চা ওয়ালাকে ধরে আনল। চা দিয়ে ছেলেটা এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। আলো আঁধারি পথে মিশে গেল।

একা থাকলেই বার বার মিত্রার কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে।

তাহলে কি আমি কোথাও ভুল করে ফেললাম?

কিছুতেই স্থির থাকতে পারছি না।

হাজারটা বাজে চিন্তা আমার সামনে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে। আমাকে যেন বিদ্রূপ করছে।

ধ্যুস। উঠে পরলাম।

পায়ে পায়ে বেরিয়ে এলাম। ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে বাবু ঘাটের মুখটায় এলাম।

একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে।

দাদা যাবেন নাকি?

কোথায়?

ট্র্যাংগুলার পার্ক।

চলুন।

উঠে বসলাম।

বেশ বুঝতে পারছি একটা ঘোড়ের মধ্যে আছি। এতটা পথ চলে এলাম কিছুই বুঝতে পারলাম না। ট্র্যাংগুলার পার্কের কাছে এসে ছেলটি বললো, দাদা কোনদিক দিয়ে ঢুকবেন। ওকে পথনির্দেশ দিলাম।

গেটার মুখ যখন এসে দাঁড়ালাম তখন রাত প্রায় আটটা বেজে গেছে।

ছগনলাল আলো জালায়নি। একমাত্র বড়োমার ঘরে আলো জ্বলছে।

দুটো দরজা চেন দিয়ে আটকান একটু ফাঁক করে ভেতরে ঢুকলাম।

ছোটোবাবু।

ছগনলাল এগিয়ে এসেছে। ওর মুখের দিকে তাকালাম।

একটু আগে একজন বাবু এসিছিলেন। অনেক জিনিষপত্র আর একটা ব্যাগ দিয়ে গেলেন। বড়োমার ঘরে রেখেছি।

ঠিক আছে।

ঘোরের মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় উঠে এলাম।

বাগানটা এখনও বেশ অপরিষ্কার। চারিদিকে জিনিষপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

বড়োমার ঘরে এলাম। ছগনলাল সব ডাইনিং টেবিলে গুছিয়ে রেখেছে।

ড্রইং-এর মেটিরায়ালসগুলো নিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম।

ছগনলাল গেটের মুখে দাঁড়িয়ে।

দাও আমি নিয়ে যাচ্ছি।

থাক আমি নিয়ে যাচ্ছি। তবু ছগনলাল এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে ড্রইং-এর বোর্ডটা নিল।

আমাকে একটু চা খাওয়াবে।

তুমি সকাল থেকে কিছু খাওনি।

খেয়েছি, তুমি একটু চা করো।

দু-জনে শিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এলাম। আমার ঘরটা অন্ধকার। আলো জ্বাললাম।

আমার বিছানায় বোর্ডটা রেখে ছগনলাল চলেগেল।

হঠাৎ নিজের ভেতরে কেমন যেন একটা পরিবর্তন অনুভব করলাম।

ড্রইং বোর্ড রং-তুলি হেণ্ডমেড পেপার সব কেমন যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অনি অনেক দিন পর এইগুলো পেলি। এবার কাজে লেগে পর। কবে সব ছেরেছুড়ে দিয়েছিলি। আবার একটা সুযোগ পেয়েছিস। ফাইট অনি ফাইট।

হাতটা ভীষণ উসখুস করছে ছবি আঁকার জন্য।

ধীরে ধীরে সব গুছিয়ে নিলাম। বিছানা ময় সব ছড়িয়ে দিলাম। বাথরুম থেকে বালতি করে জল আনলাম। মগটা নিয়ে এসে একমগ জল আলাদা করে রাখলাম। তুলিগুলো সব ডুবিয়ে দিলাম। জামা প্যান্টটা শরীর থেকে টেনে খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। আলনা থেকে কোনওপ্রকারে টাওয়েলটা টেনে নিয়ে শরীরে জড়িয়ে নিলাম। নিমেষের মধ্যে ঘরের চেহারাটাই বদলে গেল।

ড্রেস মেটিরিয়ালসের ছবি আগে এঁকে ফেলতে হবে।

আমার দীর্ঘদিনের অভুক্ত খাবার আজ পেয়েছি। সুজিতদার কাছেই শেষ কাজটা করেছিলাম। মাথার মধ্যে সব কেমন যেন কিল বিল করতে শুরু করলো।

ছগনলাল চা দিয়ে গেল। আমি সব সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে ড্র করতে শুরু করলাম। বার বার পিঙ্কি, চুর্ণী, তিয়া, রিমঝিমের মুখগুলো চোখের সামনে ভেসে আসছে। বিশেষ করে তিয়ার মুখটা।

পারফেক্ট মডেলের মতো চেহারা।

হাতের পেন্সিল ড্রইং পেপারের ওপর চলতে শুরু করলো। পর পর অনেক গুলো স্কেচ করে ফেললাম। ঘরের চারদিকে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলি আর এঁকে যাই।

একজন মানুষ দীর্ঘদিন অভুক্ত থাকার পর যখন খেতে পায়, সে যেভাবে খায় আমিও যেন সেই ভাবে এঁকে চলেছি।

মিঃ নেওটিয়া বলছিলেন প্রথমে উনি মেয়েদের ড্রেস মেটিরিয়াল দিয়ে শুরু করবেন। আমাকে তারও ড্রইং করে দিতে হবে। সিকোয়েন্সগুলো মনে মনে একবার সাজিয়ে নিলাম। পেপারগুলো আগে ভালো করে বালতির জলে ডুবিয়ে নিলাম। প্রথমে একটা প্রকৃতির দৃশ্য আঁকলাম, না হাতটা ঠিক আছে। তারপর ক্যাটওয়ার্ক গুলো তৈরি করলাম।

এবার রাম্পে হাঁটার থেকে আরম্ভ করে পর পর সিকোয়েন্সগুলোর স্কেচ আঁকতে শুরু করলাম।

অনেকদিন পর তুলি হাতে পেয়ে মনেহচ্ছে আমি যেন স্বর্গ হাতে পেয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বুঝতে পারলাম, এই মুহূর্তে স্কেচগুলো আমার সবচেয়ে বেশি আপনজন। কোনওদিকে খেয়াল নেই। আমি আমার সাধনায় নিমগ্ন।

কতক্ষণ এঁকেছি, কতগুলো ছবি এঁকেছি জানি না। পর পর মনে যা এসেছে, যে ভাবে ভেবেছি তুলির রং-এ তাকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আঁকা শেষ হলে একটা একটা করে খাটের ওপর রেখে এসেছি।

আঁকতে আঁকতে হঠাৎ দেখলাম কে যেন আমার ড্রইং বোর্ডের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তার ছায়া আমার ড্রইং বোর্ডে পরেছে। চোখ তুলে তাকালাম। দেখলাম মিত্রা। হেসে ফেললাম।

ঝট করে রং-এর প্লেটটা রেখে ওকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে একপাক ঘুড়ে নিলাম। ওকে কোলে তুলে নিলাম।

মিত্রা, মিত্রা আমার মিত্রা।

ছাড়, ছাড় পড়ে যাব। তোর কোথাও লেগে যাবে আবার।

আমি ছাড়লাম না ওকে জাপ্টে ধরে বললাম, জানিষ আজ আমি জিতে গেছি।

তখনও ও আমার কোলে। আমার গলা জড়িয়ে ধরে আছে।

আমাকে নিচে নামা আমি পড়ে যাব।

আমি আছি, কেন তুই পড়ে যাবি? তুই পড়ে গেলে আমি তোকে ধরে ফেলবো।

প্লিজ তুই নিচে নামা।

আমি ওকে নিচে নামালাম।

ওর দিকে তাকালম। চোখে জল টল টল করছে।

এমা তুই কাঁদছিস কেন? আমি আজ তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। তুই বিশ্বাস কর, তুই তখন বললি না। জানিস আমি আজ একটা বিরাট কাজ পেয়েছি। আট বছর পর।

ও আমার দিকে ছল ছল চোখে তাকিয়ে।

কাঁদিস না। মনটা খারাপ হয়ে যাবে। আমি কিন্তু তোর কথা রেখেছি।

আমার দু-হাতের আঁজলায় ওর মুখ তুলে ধরলাম। বুড়ো আঙুল দিয়ে ওর চোখ মোছালাম। কপালে একটা চুমু খেলাম।

আমি হরেগেছি বুবুন।

কে বললো তুই হেরেগেছিস! তুই জিতেছিস। দেখ আমি তোর কথা রেখেছি। তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। আর কোথাও বেরইনি। ছবি আঁকছি। অনেকদিন তুলি ধরিনি বুঝলি।

মিত্রা আমার বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

এই দ্যাখো আবার কাঁদে, তুই সুজিতদাকে চিনিস?

তারপর নিজে নিজেই বলে উঠলাম।

সত্যি তো তুই সুজিতদাকে চিনবি কি করে? আমি তোকে সুজিতদার কথা আগে বলিনি। জানিস সুজিতদা আমাকে একটা বিরাট কাজ দিয়েছে। কততো টাকা দিয়েছে জানিস।

মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলেছে।

এমা, এই দ্যাখো আবার বোকার মতো কাঁদে। আমি তোর কথা রেখেছি। এবার তুই নিশ্চই আমার সঙ্গে থাকবি। আমাকে ছেড়ে যাবি না।

মিত্রা আরও জোড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, তুই আর বলিস না।

কেন। আমি আবার কি অন্যায় করলাম?

তোকে আমি সকালে অনেক খারাপ কথা বলেছি।

কই না! ওগুলো তোর মনের কথা নয়। তখন তুই আমার ওপর রাগ করেছিলি। আমি সত্যি তখন অন্যায় করেছিলাম। তাই তুই বলেছিস। তুই বিশ্বাস কর আমি একটুও রাগ করিনি।

ওকে খাটের কাছে নিয়ে গেলাম।

দেখনা দেখ, আমি এরইমধ্যে কতগুলো ছবি এঁকেছি। কেমন এঁকেছি বল?

মিত্রা ছল ছল চোখে আমার দিকে তাকাল। ভালো।

শুধু ভালো! আর কিছু নয়?

মিত্রা আমার বুকে ঠোঁট রাখলো।

হেসে ফেললাম এইবার বুঝলাম, শুধু ভালো নয়, তার থেকেও যদি কিছু থাকে, তাই।

মিত্রা হেসে ফেললো।

চা খাসনি কেন?

খেয়েছি, ছগনলাল একবার দিয়েছে।

তুই খেয়েছিস!

হ্যাঁ।

তাহলে ওটা কি?

কই দেখি।

আমি চায়ের কাপটা দেখলাম।

যেমন দিয়ে গেছিল তেমন পড়ে আছে।

তাহলে হয়তো ছগনলাল পরে আর একবার দিয়ে গেছে। এখন আমাকে একটু চা খাওয়াবি?

কটা বাজে জানিস—

কটা? তুই এখন এলি, তারমানে নটা বাজে।

মিত্রা আমার মুখে হাত দিল। কিছু খোঁজার চেষ্টা। চোখদুটো জলে টলটল, স্থির।

সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

তোরা অনেকক্ষণ এসেছিস!

হ্যাঁ।

আমাকে ডাকলি না কেন?

তোর সাধনায় ব্যাঘাত ঘটুক কেউ তা চায়নি।

হেসে ফেললাম।

ডাক ডাক সকলকে ডাক।

মিত্রা এগিয়ে গেল।

দাঁড়া দাঁড়া পাজামাটা পরে নিই, টাওয়েল পরা আছে। ওরা আবার কে কি মনে করবে।

ওরা সবাই তোকে এই অবস্থায় দেখে গেছে।

এ-মা, তুই বারন করতে পারলি না?

মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।

আমি তাড়া হুড়ো করে পাজামা পাঞ্জাবীটা পরে নিলাম।

মিত্রা গিয়ে দরজা খুললো। দেবারা সবাই ঘরের মধ্যে এলো। আমি হাসলাম।

তুই এগুলো কি করছিস!

জানিস দেবা আজ হঠাৎ একটা কাজ পেয়ে গেলাম। একটা এ্যাড প্রমোশনের।

তুমি এ্যাড প্রমোসনের কাজ করছো! টিনা বললো।

হ্যাঁগো টিনা। আগে করেছি কয়েকবার। অনেক দিন পর আবার একটা সুযোগ পেলাম, লোভ হলো কাজটা করতে, ছাড়লাম না, নিয়ে নিলাম।

এই ছবি গুলো তো ড্রেস মেটিরিয়ালের। মিলি বললো।

হ্যাঁ। ওরা প্রথমে ওদের ড্রেস মেটেরিয়াল লঞ্চ করবে। মডেলরা রাম্পে হেঁটে সেই ড্রেস মেটিরিয়াল শো করাবে। আমি এ্যাঙ্গেলগুলো ঠিক করে স্কেচ গুলো ড্র করে দিচ্ছি।

তুমি আগে করেছো কখনো!

অনেকদিন আগে করেছিলাম। তোমাদের মনে আছে কিনা জানি না, একটা চায়ের বিজ্ঞাপনে একটা ক্যাপসান খুব হিট করেছিল, চুমুকে চমক।

হ্যাঁ! মনে আছে!

ওই চায়ের টোটাল প্রোমোশনটা আমি করেছিলাম। সেই থেকে সুজিতদার ব্যাবসার উন্নতি।

সুজিতদা! আস্থা! দেবাশিস বললো।

হ্যাঁ। তুই চিনিস?

চিনব না মানে!

আমি ধীর পায়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়ালাম।

বাইরেটা অন্ধকার। পাঁচিলের বাইরে মিউনিসিপ্যালিটির লাইট পোস্ট থেকে যে টুকু আলো আসছে তাতেই বাগানটা আলোকিত। আকাশের তারা ফ্যাকাশে।

তখন আমি স্বাধীন সাংবাদিক বুঝলি দেবা। সুজিতদার সঙ্গে আলাপ হলো পার্ক হোটেলের একটা প্রোগ্রামে। দাদা কভার করতে পাঠিয়েছিল। কথায় কথায় বললাম আমাকে কিছু কাজ দিন না। তখন খেতে পাই না। যদি কিছু আসে।

তা বললো, তুমি কপিরাইট করতে পারো। বললাম পারি না, তবে দিলে একবার চেষ্টা করবো। উনি দিলেন, পাশ করে গেলাম।

সেই থেকে শুরু। তারপর হৃদ্যতা, এমনকি একদিন সুজিতদার অন্দরমহল পর্যন্ত পৌঁছেগেলাম। অনেকগুলো কাজ করেছি সুজিতদার। মাঝে সুজিতদার সঙ্গে একবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

তবে আস্থা যে তার নিজস্ব ঢঙে, নিজস্ব স্বকীয়তায় এগিয়ে চলেছে তার খোঁজখবর রাখতাম। তোর শ্রেণিকদাকে মনে আছে। রেডিফিউসন যার হাতে তৈরি।

হ্যাঁ। খুব ভালো করে চিনি।

শ্রেণিকদা খুব ভালো স্পোর্টসের ওপর লিখতেন।

উনি স্পোর্টস রিপোর্টার ছিলেন। সুজিতদার মতো শ্রেণিকদার সঙ্গেও আমার আলাপ খেলার মাঠে। তখন শ্রেণিকদারও প্রচুর বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল, কপিরাইট, চারলাইনের বিজ্ঞাপণী গান লিখে দিয়েছি। এককথায় বলতে পারিস দেহপসারিণী। যেখানে দুটো পয়সা সেখানেই অনি।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

জানিস দেবা, আজ সকালে মিত্রার কয়েকটা কথায় মনটা খুব খারাপ লাগলো। এতে মিত্রার কোনও দোষ নেই। দোষ সম্পূর্ণ আমার। তোরা সবাই চলে যাবার পর, নিজের সঙ্গে নিজে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করলাম। একবার ভাবলাম গঙ্গার ধারে আমার পুরনো ঠেকায় চলে যাই। কিছুক্ষণ জলে ভেসে চলে আসবো। তারপর নিজের মনে খুঁজতে শুরু করলাম আমার পুরনো ভালোবাসার লোকজন কে আছে, যার কাছে গিয়ে আমি দুদণ্ড শান্তি পাব। এক কথায় বলতে পারিস একটু ব্রেক।

ট্র্যাংগুলার পার্ক থেকে বাসে উঠলাম। কোথায় নামবো জানি না। পার্ক স্ট্রীটে এসে ভাবলাম এখানে নেমে পরি। বাস থেকে নামলাম। একবার ভাবলাম মিত্রার ক্লাবে যাই। ওখানে আমার এক পুরনো বন্ধু আছে। তারপর ভাবলাম না, তাতে মিত্রার সম্মানহানি হতে পারে। আফটার অল আমি মিত্রার একজন পার্টনার।

তারপরই সুজিতদার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। অনেকদিন সুজিতদার সঙ্গে দেখা হয়নি। গেলে চিনতে পারবে কি? তবু গেলাম। সত্যি কথা বলতে কি সুজিতদার কাছে কিছু টাকা চাইতে গেছিলাম। ওই মুহূর্তে আমার কিছু টাকার দরকার ছিল।

একটু থামলাম।

নিশ্চই তুই মনে মনে হাসছিস। অনি তোর আবার টাকার দরকার, তার জন্য সুজিতদা! হ্যাঁ দেবা, আমার হাতের মুঠোয় রাজ্য এবং রাজকন্যা। আমার আবার কিসের টাকার দরকার? আচ্ছা বলতো দেবা, আমি এখনও পর্যন্ত যা পেয়েছি, যা করেছি তার একটা পয়সাও আমার?

সুজিতদাকে মনের কথাটা বলেছিলাম। সুজিতদা থাপ্পর মারতে এলো। এটাই স্বাভাবিক। অনেকটা তোর মনে মনে হাসির মতো। আমি সুজিতদাকে আমার মনটা খুলে দেখাতে পারি নি। তারপর গঙ্গাদিয়ে অনেক জল গড়াল। আলটিমেট সুজিতদা কাজটা আমাকে অফার করলো। ভালো টাকা দেবে বললো, লোভ সামলাতে পারলাম না।

ফিরে তাকালাম ওদের দিকে, হয়তো চোখ দিয়ে দু-এক ফোঁটা জল গড়িয়ে এসেছিল। ডান হাতের তালু দিয়ে তা মুছলাম।

সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। মিত্রাকে দেখতে পেলাম না।

জানিস আমার এ সব কিছুই ছিল না। সুজিতদা কিনে দিয়ে গেল।

আদিতি আমার কাছে এগিয় এসে বললো, তুমি এতো ভালো স্কেচ করতে পার!

এগুলো আর ভালো কোথায়, মনের ভাবটা প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। বাকিটা ওরা করে নেবে।

টিনার দিকে তাকালাম।

টিনা তোমাদের জন্য একটা সুখবর আছে।

আমাদের জন্য!

হ্যাঁ। ওই ফাইলটা দাও।

আমরা দেখেছি।

তোমরা দেখেছো! কখন?

তখন তুমি একমনে স্কেচ করছিলে।

এ-মা আমাকে ডাকো নি কেন?

কিভাবে সাধনা করতে হয় তোমার কাছ থেকে শিখছিলাম। বড়োমা বললো ওকে দেখে তোরা শেখ। এখন বিরক্ত করিস না, ওর সাধনায় ব্যাঘাত ঘটবে। টিনা বললো।

বোকা বোকা কথা।

ওরা কেমন ভাবে যেন আমার দিকে তাকাল।

জানো মিঃ নেওটিয়া কাজটা অন্য একটা এজেন্সীকে দিতে চেয়েছিলেন। ভাগ্যিস আমি আজ সুজিতদার কাছে গেছিলাম। সুজিতদা আমার সঙ্গে ওনার আলাপ করিয়ে দেবার পর উনি একেবারে গদ গদ হয়ে পরলেন, আফটার অল কাগজের মালিক বলে কথা।

ওনার প্রোডাক্টগুলো শোনার পর, আমি ওনাকে ব্যাপারটা আমার দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে বোঝালাম। উনি আমার কনসেপ্ট এ্যাকসেপ্ট করলেন। সুজিতদাকে দিয়ে প্রমিস করালেন অনিবাবু যদি নিজে দায়িত্বে কাজটা করেন, তাহলে উনি কাজটা দিতে পারেন। সেই সময় সুজিতদার সেই চোখের চাহুনি আমি এড়িয়ে যেতে পারলাম না। সম্মতি দিলাম। উনি সুজিতদাকে কাজটা দিলেন।

দাদা হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল পেছন পেছন সবাই।

আমি ছুটে গিয়ে দাদাকে প্রণাম করলাম। হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেলাম।

জানো দাদা আজ অনি হঠাৎ অনেক টাকা রোজগার করে ফেলেছে।

দাদা হাসল, অনেক টাকা!

দেখো দেখো নিচের ব্যাগে টাকা আছে। বিছানার ওপর থেকে ফাইলটা নিয়ে চেকটা বার করলাম।

এই দেখো চেক।

তোর তো টাকার দরকার নেই, কি করবি এগুলো।

আমি মিত্রাকে সব দিয়ে দিয়েছি। বলেছি, এটা তোর।

দাদা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।

সকাল বেলা মিত্রা কি বললো জানো, ও আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। গলাটা ধরে এলো।

তাই বুঝি।

হ্যাঁগো। মনটা খুব খারপ হয়ে গেল। ভাবলাম কিছু একটা করতে হবে, কাজটা নিয়ে নিলাম। বলো ঠিক করিনি?

দেখলাম দাদার চোখটা ছল ছল করছে।

এ-মা তোমার চোখেও জল!

ছোটোমা, বড়োমার দিকে তাকালাম।

ধ্যুস, বুঝেছি আমি কাজটা নিয়েছি তোমাদের কারুর পছন্দ নয়। কালকে সুজিতদাকে ফেরত দিয়ে দেব।

দাদা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

বড়োমা, ছোটোমার কাছে গেলাম, তোমরাও আমার এই কাজটা অপছন্দ করছো?

ডাক্তারদাদা এগিয়ে এলো, তুই ছবি আঁক, আমরা পরে আসবো।

না ডাক্তারদাদা, এখন আর ছবি আঁকা হবে না।

কেন?

ব্রেক হয়ে গেল।

তাহলে নিচে চল।

যাও, আমি যাচ্ছি।

ওরা সবাই আসতে আসতে চলে গেল। শুধু মিত্রা দাঁড়িয়ে রইলো। আমি ড্রইংগুলো একজায়গায় পর পর সাজিয়ে রাখলাম। নিজের আঁকা স্কেচ গুলো বেশ দেখতে লাগছে। মিত্রা এগিয়ে এলো, আমাকে সাহায্য করলো। আমার দিকে তাকাচ্ছে, আর মিটি মিটি হাসছে।

তোর ছবিগুলো ভালো লাগেনি?

ও আমাকে জড়য়ি ধরলো।

তোর এই গুণটা আছে, আগে জানতাম না।

তোর ভালো লেগেছে?

হাঁ।

সত্যি বলছিস!

হ্যাঁ।

ব্যাশ।

কি!

তাহলে আমি এই পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে দেব।

পারবি?

আলবাত পারবো।

তোর জন্য একটা জিনিষ নিয়ে এসেছি।

কিরে?

একটা কথা দে।

বল।

কালকে আমি তোকে যেভাবে দেখতে চাইবো তুই সেই ভাবে আমাকে দেখাবি, বলতে পারিস এইটা আমার স্বপ্ন। তোর যেমন কিছু কিছু স্বপ্ন আছে, আমারও আছে।

মিত্রা আমার চোখে চোখ রাখলো।

আমি তোকে কালকে দুচোখ ভরে দেখতে চাই।

ধ্যুস আমি কি পুতুল, তুই পুতুল খেলবি?

ধরনা কালকের দিনটা আমি পুতুল খেলব।

সে দেখা যাবে।

দেখা যাবে কেন?

আমি মিত্রার গালটা একটু টিপে দিলাম।

আচ্ছা বাবা আচ্ছা, তাই হবে। খিদে পেয়েছে।

নিচে চল।

জানিস মিত্রা একটা অন্যায় করে ফেলেছি।

মিত্রা আমার দিকে তাকাল।

কি অন্যায় করেছিস!

তোকে না জানিয়ে সুজিতদার সঙ্গে ছ-মাসের এগ্রিমেন্টে সাইন করে ফেলেছি।

বেশ করেছিস।

তুই রাগ করলি না?

তোর ওপর রাগ করে নিজেই বেশি কষ্ট পাই। দেখলাম চেকও নিয়ে এসেছিস।

বাকিটা আগামী বুধবার দিয়ে দেবে। পরিষ্কার বলে দিয়েছি হান্ড্রেড পার্সেন্ট এ্যাডভান্স।

নিচে চল, খিদে পেয়েছে বললি। সকাল থেকে কি খেলি?

ছেঁড়া পরটা, ঘুগনি, কয়েকটা জিলিপি।

মিত্রা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল!

তোর কথা মনে পরেনি।

মিত্রা হাসলো।

কোথায় খেলি?

সুজিতদার ওখানে।

সুজিতদা খাওয়ালো, না তুই খেতে চাইলি?

হেসে ফেললাম।

চল।

দাঁড়া তুলিগুলো একটু ধুয়ে নিই। অনেক দামী।

তুই বালতি নিয়ে কি করছিলি?

কাগজগুলো জলে চোবালাম।

পেপারগুলো জলে চুবিয়ে ছবি আঁকছিলি!

হ্যাঁ। কালার গুলো তাতে দারুণ খোলে।

টাকা গুলো কি করবি?

ওটা তোর, তোকে তো কিছু দিতে পারিনি কোনওদিন।

আমি নিয়ে কি করবো। আমার অনেক টাকা। এটা তোর পরিশ্রমের টাকা।

মিত্রা আমার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। মাথা নীচু করে নিলাম। স্বগোতক্তির সুরে বললাম।

ধার শোধ করবি।

তার জন্য তুই বিজ্ঞাপন এনে দিয়েছিস।

তোর যা খুশি করিস, ভাবতে ভালো লাগছে না।

এখনও ওই বিজ্ঞাপনের সিকোয়েন্সগুলো তোর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তাই না?

হেসে ফেললাম।

ডাক্তারদাদা ঠিক কথা বলেছে, ও এখন আর ওর মধ্যে নেই, তোমরা কোনও প্রশ্ন করলে ঠিক ঠিক জবাব পাবে না।

কেন আমি কি কোনও অসংলগ্ন কথা বলছি?

বলছিস না, বলা হয়ে যাচ্ছে।

কি খুচুর খুচুর করছিস দুজনে, নিচে চল।

ছোটোমার গলা, দারজার মুখে দাঁড়িয়ে, আমি ছোটোমার দিকে তাকালাম।

বুঝলে ছোটোমা, গর্ধভটাকে নিয়ে চলা বড়ো কষ্ট, একটু মেরামত করার চেষ্টা করছি। মিত্রা বললো।

কি মনে হচ্ছে, পারবি?

হাল ছাড়িনি, ছাড়বও না।

দেখ চেষ্টা করে, আমি দিদি হাল ছেড়ে দিয়েছি।

আমি একবার ছোটোমা একবার মিত্রার মুখের দিকে তাকাই। কি বলছে ঠিক এই মুহূর্তে মগজে ঢুকছে না। মিত্রা ঠিক বলেছে। এ্যাডের সিকোয়েন্সগুলো এখনও মাথায় রিনিঝিনি তালে সুর রচনা করে চলেছে।

বুঝেছি, তোর এখন মাথায় কিছু ঢুকবে না। তুই এখন সব কিছুর মধ্যে রাম্প দেখছিস, মডেলদের ড্রেস মেটিরিয়াল দেখছিস।

চলো ছোটোমা। খিদে লেগেছে।

মিত্রা মুখ টিপে হাসলো।

আমি ছোটোমাকে টেনে নিয়ে নিচে চলে এলাম। দেখলাম সোফায় বসে সবাই গল্প করছে। দেবা, অদিতি, নির্মাল্যকে দেখতে পেলাম না। বড়োমাকে দেখলাম রান্নাঘরে। এগিয়ে গেলাম। পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল।

খিদে পেয়েছে।

তোর কাজ শেষ হলো?

কই হলো, ওরা চলে এলো।

দুপুরে কোথায় গেছিলি?

তুমি জানো না!

না।

পরে বলবো।

কিরে তুই যে দেখবি বললি। মিত্রা এসে রান্নাঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়াল।

কি বলতো!

আমরা যা নিয়ে এলাম।

চল। দাঁড়া টিনাকে একটা কথা বলে নিই।

বড়োমার ঘরে চল আগে।

তাই চল।

আমি মিত্রার পেছন পেছন বড়োমার ঘরে এলাম। বড়োমার খাটের ওপর ডাঁই করা কাপর জামার প্যাকেট। আমি দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম।

এতো জামা কাপড়! কার?

তোর আছে, আমার আছে, সবার আছে। মিত্রা বললো।

এতো কি হবে?

দরকার আছে। মিত্রা আমার দিকে দুষ্টুমি চোখে তাকিয়ে। মিটি মিটি হাসছে।

তুই দুপুর বেলা ওই প্যান্ট গেঞ্জিটা পরে বেরিয়েছিলি কেন! তোর আর জামা প্যান্ট নেই?

কি জানি, ভালো লাগলো, পরে নিলাম।

ওই জামা প্যান্ট পরলে অনিকে ঠিক অনির মতো লাগে তাই না।

মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

অন্য জামা প্যান্ট পরলে অনিকে বড্ডবেশি চক চকে মনে হয়।

তুই আমায় দেখেছিস!

মিত্রার স্থির চোখ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, হাসি হাসি চোখ দুটোয় না বলা অনেক কথা।

তুই একটা ভিখিরীর সঙ্গে এ্যাশিয়াটিক সোসাইটির শিঁড়িতে বসে কথা বলছিলি।

ও ভিখারী নয়—

আমার গলার স্বরটা হঠাৎ কর্কশ হয়ে গেল। মিত্রা চমকে আমার দিকে তাকাল।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গেলাম। দেখলাম টিনা, মিলি, ছোটোমা, বড়োমা ঘরের দরজা আটকে দাঁড়িয়ে।

টিনা—তোমায় কেউ ফোন করেছিল?

না অনিদা!

তোমায় একজন ফোন করতে পারে। ওদের একটা এ্যাড সানডের পেজে যাওয়ার কথা। চম্পকদা তোমার কথা বলেছে, তোমার পার্মিশন ছাড়া এ্যাডটা যাবে না।

ওরা আমার গলার স্বরে, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

আমার পার্মিশন ছাড়া এ্যাড যাবে না!

সেই রকমই বলা হয়েছে অফিস থেকে।

আমি এরকম কথা কখনও বলিনি অনিদা। টিনা বললো।

চম্পকদার সঙ্গে ওর দেখাই হয়নি কাল থেকে। মিত্রা বললো।

মিত্রার দিকে ঘুরে তাকালাম।

তাহলে বুঝতে পারছিস।

পারছি।

তুই ওদের এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে সাইন করে দিয়েছিস।

হ্যাঁ।

টিনার দিকে ঘুরলাম।

কাল তুমি চম্পকদাকে ফোন করবে। বলে দেবে আস্থা থেকে যে এ্যাডটা গেছে, ওটা রবিবার ছাপা হবে। যখন কথা বলবে তখন গলার ভলুমটা যেন হুইপের ঢঙে থাকে। মাথায় রাখবে তোমাদের এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা চম্পকদার মতো যারা আমাদের অফিসে আছেন, তাদের বস হিসাবে দেওয়া।

টিনা মাথা নীচু করলো।

তোমরা তোমাদের এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে কি লেখা আছে পড়েছো?

না।

কেন! না পড়েই এক কপি সই করে দিয়েছ।

তুমি আছো।

চিরটাকাল নয়।

টিনা, মিলি আমার মুখের দিকে ফ্যাকাশে চোখে তাকাল।

তুমি, অদিতি, মিলি এখন থেকে এ্যাডের পার্টটা একটু একটু করে দেখতে শুরু করো। দেখবে, তোমাদের সাবতাচ করার মতো লোক ওখানে অনেক পাবে। সব বাস্তু ঘুঘু। সবার সঙ্গে কথা বলে লোক চেন। একটু কিছু গন্ধ পেলে আমাকে জানাবে। আজ আমি আগামী ছয় মাসের একটা এ্যাডকেম্পেন নিয়ে এসেছি, ফাইলটা ওপরে আছে, পারলে দেখ নাও।

দেখেছি।

তোমরা কখন এলে! কখন আমার ঘরে ঢুকলে! কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিছু বললেই, বলো দেখেছি।

তুই কি তখন তোর মধ্যে ছিলি। বড়োমা দরজার সামনে থেকে এগিয়ে এলো।

তাহলে কোথায় ছিলাম, আকাশে ডানা মেলে উড়ছিলাম।

তাই হবে। সকলে তোর ঘরে গেল এটা ওটা দেখল, তুই কিছুই জানলি না।

হবে হয়তো।

টিনার দিকে তাকালম।

আগামী এক সপ্তাহ তোমাদের আমি সময় দিতে পারবো না। অসুবিধা হলে ফোন করবে।

আচ্ছা।

বড়োমা জায়গা হয়েছে?

হ্যাঁ।

এগুলো দেখবি না। মিত্রা বললো।

আগে খেয়ে নিই, তারপর।

বড়োমার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। খাবার টেবিলে না বসে সোফাতে দাদা আর মল্লিকদার মাঝখানে বসলাম। অপরজিটের সোফায় ডাক্তারদাদা বসে।

কিরে, অশান্ত মন শান্ত হলো।

ডাক্তারদাদার দিকে তাকালাম। মাথা নীচু করলাম। হাসলাম।

তোকে কিন্তু আজকে দারুণ দেখাচ্ছিল। ভাবলাম একবার গাড়ি থেকে নেমে যাই।

কোথায় দেখলে?

এ্যাসিয়াটিক সোসাইটির তলায়।

নামতে পারতে।

তুই তখন আমাকে পাত্তাই দিতিস না।

কেন!

তাহলে ওই ভিক্ষারী বেশি ভদ্রলোক উঠে চলে যেত।

হাসলাম।

আমি এদের তখনই বলেছি। ও ভিক্ষারী নয়, ও নিশ্চই অনির পরিচিত।

কি করে বুঝলে?

তোর কথা বলার ধরণ দেখে। লোকে সাদা চোখে জানছে তুইও একটা আধ পাগলা, কিন্তু আসলে তা নয়।

সত্যি বুবুন ও ভিক্ষারী নয়! মিত্রা আব্দারের ঢঙে বললো।

কেন?

ডাক্তারদাদার সঙ্গে আমারা চ্যালেঞ্জ করেছি।

তাহলে হেরে গেছিস।

ও ভিক্ষারী নয়!

না। ও একজন আইবির সিনিয়ার অফিসার। নাম সুমন চৌধুরি।

ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলে খাচ্ছিল!

প্রয়োজনে আরও অনেক কিছু করে ওরা।

কি বলছিস তুই!

ঠিক বলছি। ভেক না ধরলে ভিক্ষা পাওয়া যায় না।

সবাই চুপ। মুখ দিয়ে কারুর কোনও কথা বেরচ্ছে না।

ওদের ইনফর্মেসনের ওপর তোরা সুস্থভাবে বেঁচে-বর্তে আছিস। না হলে অনেকদিন আগে মরে হেজে যেতিস।

ওরা আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।

বড়োমার দিকে তাকালাম। খেতে দাও।

ছোট জায়গাটা করে ফেল, ও অনেক্ষণ থেকে খেতে চাইছে।

ঘরে পা দিয়েই দেখলাম বিছানায় নতুন চাদর পাতা। বালিশের ওয়ারগুলোও নতুন লাগান হয়েছে। বেশ ভালো লাগলো দেখে। চাদরের কালারটা এতো সুন্দর, মন ভরে গেল। কিছুতেই বিছানায় শুতে ইচ্ছে করছে না। টান টান করে পাতা চাদরটার দিকে এক দৃষ্টে তাকালাম। বুক থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।

কাকা স্কুলফাইন্যাল পাশ করার পর একটা বেড কভার কিনে দিয়েছিল। মনে পড়ে না কয়দিন ওই বেড কভারে শুয়েছি।

টেবিলের ড্রয়ার খুলে মানিপার্টসটা থেকে আলমাড়ির চাবিটা নিলাম। জামাকাপড়ের পেছন থেকে আমার পুরনো এ্যালবামটা বার করলাম। কাকা কলকাতায় আসার সময় এ্যালবামটা দিয়েছিল। এতে আমার বাবা, মা আমার শৈশবের কিছু ছবি আছে।

এই এ্যালবামে এখনও এবাড়ির কারুর হাত পরেনি। দেখার কথা বাদই দিলাম। সেদিন ফ্ল্যাট থেকে এটা নিয়ে এসেছিলাম।

পাতা উল্টে প্রথম ছবিটার দিকে তাকালাম। বাবা-মা একসঙ্গে, মায়ের কোলে আমি। আমার কপালে বিশাল একটা কালো টিপ। এই একটা ছবি আমি বহুবার দেখেছি। তখন আমার বয়স আঠারো মাস। বাবা কলকাতায় এসেছিলেন স্কুলের কাজে। আমাকে মাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। ছবিটা স্টুডিওতে তুলেছিলেন। মার খুব গঙ্গায় স্নান করার শখ হয়েছিল। পেছন দিকে স্টুডিওর স্ট্যাম্পটা এখনও রয়েছে। আলো স্টুডিও। এই এ্যাড্রেস ধরে ওখানে গেছি। স্টুডিও খুঁজে পাইনি তার জায়গায় একটা খাবার দোকান পেয়েছি। লোককে জিজ্ঞাসা করতে বলেছে, যিনি ছবি তুলতেন সেই ভদ্রলোক মারা যেতে তার ছেলেরা দোকান বিক্রি করে দিয়েছে।

চোখ বন্ধ করে বহুবার আমার এই আঠেরো মাস বয়সে ফিরে যাবার চেষ্টা করেছি। পারিনি। বহুবার মায়ের কোলে বসে থাকার অনুভূতি পাবার চেষ্টা করেছি। পাইনি। ছবিটা দেখলেই বুকটা ভীষণ টনটন করে, তাই দেখি না।

আজ হঠাৎ কেন দেখার ইচ্ছে হলো?

প্রশ্ন করে কোনও উত্তর পেলাম না। একবার আয়নায় নিজের মুখটা দেখলাম, একবার ছবির দিকে তাকিয়ে আমার মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম, অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মায়ের মুখের আদল আমার মুখশ্রীর সঙ্গে কিছুটা মেলে।

জানো মা তোমার ছেলের আজ অনেক পয়সা। অনেক ক্ষমতা তার। লোকে ফিসফাস করে। বলে রবিনহুড। একচ্যুয়েলি ওরা আমার মতো এতো ভ্যারাইটি লাইফ লিড করেনি। নিজের বলতে তার কিছু নেই। শুধু বিদ্যেটুকু ছাড়া। এই পৃথিবীতে রক্তের সম্পর্কের কোনও আত্মীয় আজও পর্যন্ত কাউকে খুঁজে পাইনি। তোমরা তার ক্লুও সেভাবে রেখে যাও নি যে খুঁজে বার করবো। তবে যে টুকু হাতের কাছে রয়েছে সেই নিয়ে এখনও আপ্রাণ চেষ্টা করছি। এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষের একটা শেকড় আছে। শুধু আমার নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কলমকরা গাছ। এক গাছ থেকে কেটে ঘষে মেজে আর এক গাছে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

বড়োমা-ছোটোমা আমার জন্য যথেষ্ট করে। আমি তাদের ঋণ আমৃত্যু শোধ করতে পারব না। এখন মাঝে মাঝে ভীষণ ভাবে তোমার কথা অনুভব করি। মিত্রা আমার মধ্যে অনেক কিছু দেখতে চায় বুঝলে মা। কিন্তু ওকে আমি কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারিনা, না পেতে পেতে আমার মনের সব আনন্দ, সব না-পাওয়াগুলো শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। সেখানে এক সমুদ্র জলটাও নস্যি।

আমি জানি মা ওরও অনেক স্বপ্ন আছে। আমি যেমন ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি ও নিশ্চই আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। আজকে ও অনেক কথা আমাকে বলেছে। যার একটা কথারও আমি উত্তর দিইনি। কেন জানো? ও অবুঝপনা করবে। বড়োমা ছোটোমা ওর দলে। ওরা আমার জীবনের ছটা বছর দেখেছে। কিন্তু বাইশটা বছর কি ভাবে, কি পরিবেশে, আমি বড়ো হয়ে উঠেছি, সেটা ওরা দেখেনি। ওরা আমার মুখ থেকে শুনেছে। কিন্তু সেটাই সব নয়। সেই বাইশটা বছরের একটা প্রভাব আমার ওপর থাকবেই। কি করে বোঝাই ওদের বলো। বড়ো যন্ত্রণা।

জানো মা, মিত্রা আজ ওর মনের মতো করে আমার জন্য জামাকাপড় কিনে এনেছে। কালকে আমাকে সাজাবে। পীরবাবার থানের মাটি ওর কপালে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। তোমার গলার চেনটা ওকে দিয়েছি। তোমার সিঁদুর কৌটটা ওকে দিয়েছি। তাতেও মনে হয় ও পরিতৃপ্ত হতে পারেনি।

আজ একগাদা জামা কাপড় কিনে এনে বলেছে, তিনদিন ধরে তোকে সাজাবো। আমি যেন ওকে বাধা না দিই। ওরও কিছু কিছু সখ আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা কি জানো মা, ও স্থূলো সুখে বিশ্বাসী।

মা জানো, আমি ওকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি।

তোমাকে ঠিক মনে পড়ে না। চোখ বুঁজে তোমার অনুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করি। আর মিত্রা আমার শয়নে স্বপনে আমার শরীরের প্রতিটা তন্তুতে মিশে আছে। ও কষ্ট পেলে আমি ভীষণ কষ্ট পাই। আমি কাঁদতে ভুলে গেছি কোন জন্মে। খুব কষ্ট পেলে দু-এক ফোঁটা জল এমনি বেরিয়ে আসে। মিত্রা এখনও কাঁদতে ভালোবাসে। ওর সঙ্গে আমার অনেক পার্থক্য। তবু কোথায় যেন ওর সঙ্গে আমার একটা মিল আছে। দুজনেই মাতৃ-পিতৃ হারা সন্তান। এই পৃথিবীতে আমাদের কোনও অভিভাবক নেই।

রোদে, জলে, বৃষ্টিতে মাথার ওপর একটা ছাতার ভীষণ দরকার বুঝলে মা। তাই তো ছোটোমা, বড়োমা, দাদা…. কতো নাম করি বলো তো। সবাই আমাদের অভিভাবক।

কেউ আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। তার কোমল হাতের বাহু বন্ধনে আমি ধ্যানভ্রষ্ট হলাম। এ্যালবামটা বন্ধ করে হাতের অর্গল আলগা করলাম, বুঝলাম মিত্রা। টেবিলে এ্যালবামটা রেখে মুখো মুখি দাঁড়ালাম। মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে।

তুই কাঁদছিস!

হাসলাম। না।

তোর চোখে জল!

এমনি। নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করছি।

আজা সারাদিনে তোর চোখে দু-বার জল দেখলাম। আমাকে নিয়ে কোনও সমস্যা!

না।

তাহলে?

তোর সব প্রশ্নের উত্তর এইভাবে দিতে পারবো না। কিছু প্রশ্নের উত্তর কাজের মাধ্যেম দেব। কিছু অনুভূতি দিয়ে তোকে বুঝে নিতে হবে।

মিত্রা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। চোখের মনি স্থির, কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।

এই এ্যালবামটা কোনওদিন আমাকে দেখাসনি!

ফ্ল্যাটে ছিল, কয়েকদিন আগে নিয়ে এসেছি।

মা-বাবার সঙ্গে তুই?

হ্যাঁ।

তখন তুই ভীষণ কিউট দেখতে ছিলি।

তুই দেখেছিস!

অনেকক্ষণ ধরে দেখেছি। তুই তোর মধ্যে ছিলি না।

মাঝে মাঝে আমার এমন হয়।

মাঝে মাঝে না প্রায়ই হচ্ছে।

আমি চুপ করে থাকলাম।

তখন তুই দেবাদের তোর কষ্টের কথা বলেছিস, দাদাকেও বললি।

বলতে চাইনি, বলা হয়ে গেল। কেন জানি না।

আমি তোকে সকালে খুব কষ্ট দিয়েছি।

হয়তো ওটা আমার প্রয়োজন ছিল। সত্যি তোর স্বপ্নের দিকটা আমি কখনও ভাবিনি।

সকালবেলা তুই সবচেয়ে বেশি অপমানিত বোধ করেছিস, ফাইলটা তোর মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াতে।

না।

তুই না বললে হবে কি করে। আমি তখন তোর চোখ দেখেছি।

মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

তোকে কষ্ট দিলে আমিও কষ্ট পাই বুবুন। কেন তুই অমন করিস।

তুই তো ইচ্ছে করে দিতে চাস না। কখনোসখনো হয়ে যায়।

তখন যে আমার কি হলো। কেন তুই তোর আমার ভাগ করিস। আমি তো পারি না।

চুপ করে থাকলাম।

ডাক্তারদাদাকে বলেছিলাম।

কি বললো ডাক্তারদাদা?

ডাক্তারদাদা হাসল।

মিত্রা আমার বুক থেকে মাথাটা তুললো। সরাসরি চোখে চোখ রাখলো।

আচ্ছা বুবুন তোর কি মনে হয় আমি তোকে ভালোবাসিনা?

আমি ওর মুখটা চেপে ধরলাম।

ও কথা বলতে নেই।

বলনা আমার জানার দরকার আছে।

কেন তোর মনের মধ্যে এই প্রশ্নটা এলো।

আজ সারাদিন অনেকে অনেক ভাবে তোকে নিয়ে আলোচনা করলো। তাতে আমার হঠাৎ মনে হলো আমার দিক থেকে মনে হয় কিছু খামতি থেকে যাচ্ছে।

ভুল কথা। তুইই একমাত্র আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন।

আমি মিত্রাকে বুকের কাছে টেনে নিলাম।

আমি তোর কাছ থেকে ডিমাণ্ড করি। তুই কখনও আমার কাছে কোনও ডিমাণ্ড করিস না।

কে বললো করি না, সকাল বেলা তোর কাছ থেকে টাকা চাইলাম।

মিত্রা আমার দিকে তাকাল। চোখের পলক পড়ছে না।

তুই কি শুধু আমার থেকে টাকা চাস?

তোর কি তাই মনে হয়!

আমি তোকে জিজ্ঞাসা করছি।

ওটা ওই মুহূর্তে প্রয়োজন ছিল। আমার থাকলে তোকে চাইতাম না।

কে বললো তোর নেই?

মাথা নীচু করলাম।

এই দেখ এখনও তোর মধ্যে আমাকে গ্রহণ করা নিয়ে সংকোচ বোধ রয়েছে।

তুই বিশ্বাস কর—

তুই আমাকে গ্রহণ করতে পারছিস, আর আমার টাকা নিতে পারবি না।

আমি মিত্রাকে জড়িয়ে ধরলাম।

বিশ্বাস কর মিত্রা ওটা পুরুষের অহম বোধের জায়গা। তোকে কি করে বোঝাই।

সেই জন্য বিগত ছ-মাস তুই সেলারি নিয়েছিস। তোর ডিরেক্টরশিপের রেমুনারেশন রিফিউজ করেছিস?

তোকে কে বললো!

হিমাংশু। কেন তুই নিস নি?

তুই আমাকে ক্ষমা কর।

কিসের ক্ষমা। আমি যদি তোকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই। তুই যদি মেনে নিতে পারিস, আর আমি যদি আমার ব্যবসার অংশীদার তোকে করতে চাই তাহলে তুই মেনে নিবি না কেন। আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন, তুই এটা করতে পারতিস।

আমি মিত্রাকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

তুই একা একা নিজের মনে গুমড়ে মরবি, আমি ফুর্তি করবো তা হয় না। আজ না হোক কাল সকলে আমাকে কাঠগোড়ায় দাঁড় করাবে। আমি তখন স্বার্থপর, তুই তখন মহান।

আমি ওকে জড়িয়ে ধরে মিত্রার কাঁধে মুখ গুঁজে দিয়েছি।

তোকে বলতে হবে বুবুন। আমার দিকে তাকা।

আমি মিত্রার কাঁধ থেকে মুখ তুললাম।

বল, কি জানতে চাস—

কেন তুই রিফিউজ করেছিস?

তুই তখন বললি না, আমি মহান হতে চাইছি। তুই স্বার্থপর। বল তো আমাকে, তোর কাগজের মালিকনা স্বত্ব গ্রহণ করার এক কনাকড়ি যোগ্যতা আমার আছে।

কে বললো নেই। অনেকের থেকে বরং বেশি আছে।

তুই আমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসিস তাই বলছিস। লোকে তা বলে না। বলে কি আমি তোর ভালোবাসার, দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছি।

কে কি বললো তাতে কি এসে যায়।

মিত্রা আমার অর্গল মুক্ত হলো।

আসে মিত্রা আসে। তুই মানুষের খোলা মুখ চলা পথ সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিলেও আটকাতে পারবি না। আমরা তথাকথিত সামাজিক জীব। আধুনিকতা আমাদের শরীরে, মনে নয়। এতদিন আমরা একসঙ্গে থেকেছি লোকে বলেছে লিভ টু গেদার। বিদেশে এ ব্যাপারটার কোনও গুরুত্ব নেই, ওখানে লিভ টু গেদার করতে করতে সন্তান এসে গেলেও কারও কিছু যায় আসে না। মাথা ব্যাথাও নেই কারুর।

সেই সন্তান বহাল তবিয়েতে বড়ো হয়। এখানে কোনও সন্তানের জন্ম হলে প্রথমে তার পিতৃ পরিচয়ের দরকার হয়। তবে বার্থ সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। সিঙ্গেল প্যারেন্টের আইন সেভাবে এখনও কার্যকর হয়নি। তাদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কেন, তোর নিকট আত্মীয় বলেনি তোকে ফুসলিয়ে নিয়ে চলে গেছি। তুই তো নিজের কানে শুনেছিস সেই কথা। আমাদের সমাজটা বড্ড বেশি জটিল, বুঝেছিস।

আমি মিত্রার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে।

কালকে যে কাজটা তোর সঙ্গে করতে যাচ্ছি, সেটা সামাজিক দায়বদ্ধতা মেটাতে, পাশাপাশি তোর সঙ্গে আমার যে একটা রিলেশন তৈরি হয়েছে সেটা দশজনকে বোঝাতে। বলতে পারিস একটা সরকারি শিলমোহর।

মিত্রা আমার মুখে হাত বোলাচ্ছে।

তুই যতটুকু কর্পোরেট লাইভ লিড করেছিস আমি তার এক তিলার্ধও এখনও পর্যন্ত করিনি। কেন জানিস? পকেটে রেস্ত কোনওদিন ছিল না। আমাকে তুই তোর কাগজের মালিক বানিয়ে দিয়েছিস। কর্পোরেট লাইফের কেতা শিখতে আমার এখনও ঢের সময় লাগবে। তাই আমাকে দেখবি তোদের থেকে আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই।

মিত্রার একটা হাত আমার পাঞ্জাবীর ভেতর দিয়ে আমার বুকে।

টিনারা যেটুকু কর্পোরেট লাইফ লিড করেছে, আমি সেটুকুও করিনি। একদিন তাজে বসেই আমি ব্যাপারাটা ধরে ফেলেছিলাম। ওটা একটা আলাদা জগৎ। আমি কোনওদিন নিজেকে ওই জগতে মানিয়ে নিতে পারবো না। যদিও বা পারি মাঝে মাঝে পা হড়কে পড়ে যাব। এখন যেটুকু করছি মনে রাখবি আমার পরিচিত লেভেলে। তাদের প্রতি আমার জোড় আছে। এটা বেশিদিন চলতে পারে না। দেখবি আমি খুব ধীরে ধীরে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছি।

আমি মিত্রার কপালে চুমু খেলাম।

আমাদের মানসিক মিলন হয়ে গেছে সেদিন, যেদিন পীরসাহেবের থানে তোর গলায় মায়ের গলার চেনটা পড়িয়ে দিয়েছিলাম। ভূমি থেকে মাটি তুলে তোর সিঁথিতে লেপে দিয়েছিলাম। আগামীকালের থেকে সেই দিনের মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি। তোর কোনও কিছুকে আমি অস্বীকার করিনি, করবও না কোনওদিন। কিন্তু কি জানিস, তুই আমার জীবনের আট বছর দেখেছিস বাকি কুড়ি বছর দেখিসনি। আমিও তোর জীবনের আট বছর দেখেছি বাকি কুড়ি বছর এর তার কাছ থেকে খোঁজ খবর নিয়ে সংগ্রহ করেছি, অনুভব করেছি তোর কষ্টটা, তাই আমি মাঝে মাঝে হিংস্র হয়ে উঠেছি। যে মেয়েটা ফুলের মতো বাঁচতে পারতো, লোভের আগুনে সেই ফুলের পাঁপড়িগুলো ছেঁড়ার অধিকার কে দিয়েছে ওদের।

মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে।

তোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। আমাকে নিয়েও তোর অনেক স্বপ্ন থাকতে পারে। আমি অস্বীকার করছি না। তুই একভাবে মানুষ হয়েছিস। আমি আর এক ভাবে বড়ো হয়ে উঠেছি। আমার শৈশব তোর শৈশব এক নয়। আমার জীবনবোধ আর তোর জীবনবোধের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তোকে এগুলো অনুভূতি দিয়ে বুঝতে হবে। তোকে একটা ছোট্ট কথা বলবো। মন খারাপ করবি না।

বল।

আমি ভুল কি ঠিক জানিনা তবে আমার কথাটা খারাপ লেগেছিল। হয়তো সেই থেকেই বেশ কিছু কথা চাপান উতোরে এতোসব বেরিয়ে এলো। হয়তো এটা ভালো, হয়তো এটা খারাপ। তুই হয়তো না ভেবেই বলেছিস। আমি কথাটা অন্য ভাবে ধরেছি। পড়ে নিজের সঙ্গে নিজে সারাদিন যুদ্ধ করলাম। এই মুহূর্তে তোকে বুকে জড়িয়ে ধরেও সমানে যুদ্ধ করছি বলতে পারিস।

কি কথা বল!

তোকে তখন টাকাটা চাইতে তুই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলি।

মিত্রার চোখদুটো ছোট ছোট হয়ে গেল।

আমাকে বলেছিলি, কেন!

অনিমেষদার নামটা শুনে তুই আরও ঘাবড়ে গেছিলি। তুই বিশ্বাস করতে পারিসনি অনিমেষদা আমার কাছে টাকা চাইতে পারে।

তুই বিশ্বাস কর বুবুন। আমি সেই ভেবে বলিনি।

আমি কথাটা বলার আগে তোর অনুমতি চেয়ে নিয়েছি। আমি কিন্তু বলেছি তুই হয়তো সেই ভেবে বলিসনি, আমি ভেবে নিয়েছি।

কেন তুই ভাবলি।

এটা একটা দামী কথা। বলতে পারিস এই সমস্যাটা আমার আছে। ছোটো থেকে স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া, মমতা কি জিনিষ জানি না। অনেক দিন গেছে, আমার কোনও কাজে কাকা, কাকীমা রাগ করে আমাকে খেতে দেয়নি। আমি চিকনার বাড়িতে গিয়ে দুটো পান্তা খেয়ে স্কুলে গেছি। হয়তো সেই দিনটা বাড়ি ফিরিনি। চিকনার বাড়িতেই কাটিয়ে দিয়েছি। কখনও কখনও বাসুদের বাড়িতে থেকেছি। কাকা, কাকীমা কেউ আমার খোঁজ নেয়নি। আমি কেমন আছি কি খাচ্ছি। তারপর হয়তো পাড়া প্রতিবেশীর চাপে কাকা মেনে নিয়েছে।

তুই আমার প্রথম ভালোবাসা। আমি তোকে অন্ধের মতো ভালোবাসি। তোর কিছু হলে আমি হয়তো চোট খাওয়া সিংহের থেকেও হিংস্র হয়ে উঠবো।

আচ্ছা মিত্রা যাকে আমি এতো ভালোবাসি যার দায় অদায় সম্পূর্ণ আমার, তাকে যদি একটা জিনিষ চাই, সে যদি সন্দেহ প্রকাশ করে, আমি তার কাছ থেকে সেই জিনিষটা হাত পেতে নিই কি করে বল। আমি কি তখন বিশ্বাস করতে পারি, সে আমাকে ঠিক ঠিক ভাবে বিশ্বাস করতে পারছে না। যার জন্য তার এতো কৌতূহল।

জানিস মিত্রা, সে আমার যতো আপনজন হোক। হয় তো ক্ষণিকের জন্য তার কাছ থেকে নিই। তারপর তাকে ফেরত দিয়ে দিই। সে যদি আমার ঔরসজাত সন্তান হয়, সেও আমার এই মানসিকতার থেকে দূরে থাকবে না।

সেই জন্য তখন তুই বললি আমি তোকে ফেরতে দিয়ে দেব!

আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

তুই জানিস সেই কথাটা শুনে আমার মনটা কতোটা খারাপ হয়েছিল। যার জন্য তোকে এতো কথা শোনালাম, সারাদিন কষ্ট পেলাম।

তুই যতোটা কষ্ট পেয়েছিস তার থেকেও বেশি কষ্ট আমি পেয়েছি। তার থেকে কিছুটা দেবাদের সঙ্গে শেয়ার করেছি।

টিনা নিচে আমাকে আলাদা ভাবে সব বলেছে।

একটা উপকার হয়েছে। কাকতালীয় হলেও সুজিতদার কাছ থেকে একটা কাজ পাওয়া গেছে। অনেক টাকা পাওয়া গেছে।

মিত্রা হাসলো।

তোর সঙ্গে কিছুক্ষণ মান অভিমানের পালা চলেছে। দুজনে কিছুটা হলেও মানসিক দিক থেকে পরিশোধিত হতে পেড়েছি। তুই একটা তুচ্ছ কথায় এতটা ভেবে বসে থাকতে পারিস, আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/hTUzBVM
via BanglaChoti

Comments