কাজলদিঘী (২২৯ নং কিস্তি)

❝কাজলদিঘী❞

BY-: জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

২২৯ নং কিস্তি

——————————

হাঁটতে হাঁটতে সেই জায়গায় চলে এলাম।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
মিত্রার হাসি দেখে অনিসা আমার মুখের দিকে তাকাল।
বাবা এই জায়গায়?
হ্যাঁ। তোর মাকে নিয়ে আমার এই স্বপ্নের জায়গায় অনেক স্মৃতি লুকিয়ে আছে।
সেদিনও এরকম সকাল ছিল। তার আগের দিন তোর মাকে পীরসাহেবের থানে গ্রহণ করেছি। চারিদিকে উথাল-পাতাল অবস্থা। তবু দুজনে হাতধরাধরি করে বেরিয়ে পরেছিলাম।
অনিকা, অনিসা, নম্রতা আমার চোখে চোখ রেখেছে।
তোর মা আমর মন। আর ছোটোমা আমার শরীর। তাই শরীর আর মনকে কোনদিন বিচ্ছিন্ন করতে পারি নি। তালে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। একজনকে মেনে নিয়েছি, আর একজনকে মানিয়ে নিয়েছি। একটা শরীরের দুটো অংশ, আলাদা করি কি করে বল।
চারিদিক নিস্তব্ধ। পাখির কুজনে চারদিক ম ম করছে। এক অদ্ভূত মোহময় পরিবেশ।
ওরা আমার দিকে সবাই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। এই ভাবে যে আমি কথাটা বলতে পারি ওরা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।
আমি নিজেই সেই নিস্তব্ধতা ভাঙলাম।
শুভ।
বলো।
দেখতো আশে পাশে কোথাও নিমগাছ পাশ কিনা। কয়েকটা নিমডাল ভেঙে আন।
কনি একটা সিগারেট দে, অনেকক্ষণ বকলাম।
তনুদের দিকে তাকালাম। তোমরা একটু এদিক ওদিক ঘুরে নাও। তারপর স্কুলে যাব।
তুই কোথায় যাবি?
কোথাও যাব না। এখানেই আছি। খুব বেশি হলে হয়তো ওপারে যাব।
একা।
হ্যাঁ একাই যাই, তোদের হলে বাঁধ থেকে মাঠে নামিস আমি ঠিক ধরে নেব।
আমি সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। একবার পেছন ফিরতে দেখলাম বিনদরা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।

স্কুল হয়ে লাল মাটির রাস্তা ধরলাম।
অনিসা, অনিকা, অনন্য, সুন্দরের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছি।
তবু মিত্রা কিছুটা সাহায্য করেছে। তনু শুধু শুনে গেছে। আর চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখেছে।
আমি এগিয়ে এসেছি। তনু, নীরু, বটা আমার পাশে। ওদের কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে ধরালাম।
তোর শৈশবটা দেখে বড্ড হিংসে হচ্ছে বুঝলি অনি। নীরু বললো।
কনিষ্ক হাসলো।
ওদের কি হচ্ছে জানি না। আমার ভেতর ভেতর যা হচ্ছে তোকে সরাসরি বললাম।
কেন।
এই সব দেখে মনে হচ্ছে, তুই কোন বাঁধাধরা ছকে বড়ো হোস নি। তুই বড়ো হয়েছিস তোর মতো করে। প্রকৃতির অনুশাসন তোর দেহে মনে। আর আমরা টাইমে পড়াশুনো, ছবি আঁকা, গান শেখা কত কিছু করেছি। এই যে এত কিছু করেছি কি কাজে লেগেছে বলতো।
নীরুর দিকে তাকালাম।
তুই একটু ডাইমেনসনটার কথা ভাব। তবু কনিষ্ক একটু আধটু গ্রামের স্বাদ পেয়েছে। বটা আশ্রমে ছিল। তবু সেখানে এক ঘর বন্ধু বান্ধবের মধ্যে হুড়োহুড়ি করে কাটিয়েছে। আমি বাবা মার একমাত্র সন্তান। বাবা বড়ো ডাক্তার তাই আমাকেও ডাক্তার হতে হবে। তার প্রিপারেসন সেই ছোটো থেকে। আমার শৈশবটা ঈশ্বর চুরি করে পালিয়েছেন।
তোদের ছেলে মেয়েদের একটু অন্যভাবে মানুষ কর। আমি বললাম।
দিনরাত শ্রীপর্ণার সঙ্গে ঝগড়া হয়। বার বার বলি ওদেরকে ওদের মতো বড়ো হতে দাও। শ্রীপর্ণাকে বোঝাতে পারলেও বাবা-মাকে বোঝাতে পারি না।
তোর উদাহরণ দিই।
বলে, অনি লাখে বা কোটিতে একটা জন্মায়। সিস্টেম ব্রেক করো না।
চুপ করে রইলাম। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছি।
অনি। কনিষ্ক ডাকল।
কনিষ্কর দিকে তাকালাম।
আয়েষার বাড়িটা কোন দিকে।
হেসে ফেললাম।
বল না।
থমকে দাঁড়ালাম। মিত্রারা অনেকটা পেছনে পরে গেছে।
ওই যে দূরে বাঁশ বনের ভেতর দোতলা এ্যাজবেস্টসের বাড়ি গুলো দেখতে পাচ্ছিস।
হ্যাঁ।
ওটা মুসলমান পাড়া।
মীরচাচাদের বাড়ি?
হ্যাঁ। ওই পাড়াতেই ওরা থকতো।
স্কুলটার থেকে ওর বাড়ি খুব কাছেই বল।
হ্যাঁ।
মাঠের পর মাঠ ধান চাষ হয়েছে দেখছি, কোন পথে আসতো।
আয় দেখিয়ে দিচ্ছি।
আমি এগিয়ে গেলাম। ওরা আমার পাশে পাশে।
কিছুদূর এসে থমকে দাঁড়ালাম।
মাঠের মধ্যে দিয়ে আইল পথটা দেখালাম।
তারমানে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি। এটা বেণীর মোড়। নীরু বললো।
হ্যাঁ।
এরকম নাম কেন।
এখানে একটা ছোটখাটো মুদির দোকান ছিল। যার দোকান ছিল তার নাম বেনু।
তারমানে তারও একটা গল্প আছে।
হাসলাম।
ওটা পরে শুনবো। আয়েষা তোকে কোথায় খাইয়েছিল? কনিষ্ক বললো।
অপজিটে পালেদের পুকুর ধারটা দেখালাম।
চল একটু দেখি।
আবার লালামাটির মোরাম রাস্তা ছেড়ে শরু আইল পথে পুকুরের ধারে এলাম।
কনিষ্ক পকেট থেকে সিগারেট বার করে একটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। বটা, নীরুকে দিল।
কনিষ্ক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললো, তোর সঙ্গে আয়েষার দেখা হলো কি করে?
হাসলাম।
কাল থেকে মনটা ভীষণ খচখচ করছে।
প্রথম দেখায় আমি ওকে চিনতে পারি নি। তবে ও আমাকে চিনেছিল।
কি রকম।
এক সেকেন্ড, ম্যাডামদের একটু ডাকি না হলে জ্যান্ত চিবিয়ে খাবে।
নীরু কথাটা বলেই ছুটে চলে গেল, মোরাম রাস্তার দিকে।
কালকে ওখানকার সবাই আয়েষা-অর্জুনের কথাটা শুনে গুম হয়েগেছিল।
কি করবো বল। যা সত্যি তাই বলেছি। আমিও ভাবি নি কনোদিন আয়েষার সঙ্গে আমার দেখা হতে পারে। যত দিন গ্রামে থেকেছি অনেক বাধ্য-বাধকতা ছিল। তার ওপর ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। মনাকাকা গ্রামের মান্যগণ্য ব্যক্তি। স্কুলের শিক্ষক। আমার বাবাও স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।
একটা অদৃশ্য গণ্ডী আমার চারপাশে ছিল। বলতে পারিস লক্ষ্মণ রেখা।
একটু পা হরকালেই কাকার কাছে খবর চলে যেত।
তবু লুকিয়ে লুকিয়ে হাঁড়ি পাড়া, বাগ্দী পাড়ায় চলে যেতাম। মুসলমান পাড়ায় যাওয়া কল্পনা করতে পারতাম না। মাঝে মাঝে আমি চিকনা মাথায় ধানের বস্তা নিয়ে ধান কুটতে আসতাম।
মীরচাচারা বর্ধিষ্ণু মুসলমান ওদের ধান কুটা কল ছিল।
তাছাড়া ওদের মহরমের মেলায় কাকার হাত ধরে মেলা দেখতে আসতাম।
ওরা কত রকমের খেলা দেখাত। লাঠি খেলা ছুঁড়ি খেলা। পইড়্যা ঘরের বুড়ো মিষ্টির দোকান দিত। কাকা ওই দোকানে বসে মিষ্টি খাওয়াত। পাঁপর ভাজা খাওয়াত। তারপর কাকার হাত ধরে বাড়ি।
নাইন-টেনে পড়ার সময় আমরা বন্ধুরা দল বেঁধে আসতাম। কিন্তু ওই যে, ব্রাহ্মণের গেড়ো থেকে কনোওদিন বেরিয়ে আসতে পারি নি।
আয়েষা আমার জীবনে একটা ক্ষতো। বলতে পারিস সেই ক্ষতো থেকে এখনো চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত ঝরছে।
আমি পায়ে পায়ে পুকুরের দিকে এগিয়ে গেলাম। পুকুরটা আগে বেশ বড়ো ছিল এখন কেমন যেন ছোটো হয়েগেছে। বেশ কয়েকটা চালাঘর মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বন কেটে বসত।
আগে এই পাশটায় সে ভাবে বসতি ছিল না।
সেই নিবিড় ঝোপ ঝাড় উধাও। শাল গাছটা অনেকদিন আগে কাটা হয়ে গেছে। অনেকটা অংশ কেমন ফাঁকা ফাঁকা। আম, জাম, সিরিষ, কাঁঠাল, অর্জুন গাছগুলো পুকুরের চারপাশে এখনো অক্ষত রয়েগেছে। অনেক গাছ কাটা পরলেও তবু জায়গাটা কোথায় যেন একইরকম থেকে গেছে। তার কোন পরিবর্তন হয় নি।
ইতিউতি শুকনো পাতা ছড়িয়ে রয়েছে। পায়ের চাপে একটা চড় চড় আওয়াজ হচ্ছে।
নিজেকে ভীষণ আনমনা লাগছে। ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এই তো সেদিনের ঘটনা। আয়েষার সেই মুখ। নিষ্পাপ চোখদুটোয় না বলা কত কথা।
অনি আমাকে কেমন দেখতে লাগছে?
আমি আয়েষার কথার কোন উত্তর দিই নি। পরিতৃপ্ত সহকারে আয়েষার আনা খেজুর, কাজু, আখরোট খাচ্ছি। মুচকি মুচকি হাসছি।
তখন কত বয়স আমার? আট কি নয়।
আয়েষা আমার মুখের দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে। চোখ বুঁজে ভাববার চেষ্টা করলাম।
না সেদিন সেই মুহূর্তে আয়েষা আমার বন্ধু বইতো আর কেউ ছিল না।
শিশুমনে ভালবাসা বলে কিছু থাকে না। তবে নিজেকে সকলের সামনে জাহির করার একটা প্রচ্ছন্ন আবেগ থাকে। আমারও ছিল, আয়েষারও ছিল।
এক্কাদোক্কা, গদিখেলা, সীতাহরণ, গুটি (পাথরের গুলি) কতো রকমের খেলা আমরা একটু ফাঁক পেলেই খেলতাম। আয়েষা কতবার সীতা হয়েছে। আমি হরণ করেছি।
সব চেয়ে মজা লাগতো বাঘ বন্দীর খেলা। এই খালায় আয়েষা বার বার জিতে যেত। আমি হেরো। আয়েষা হাসতো। আমি গুম হয়ে থাকতাম। পরদিন একটুকরো পাটালি বেশি পেতাম।
বল?
কনিষ্ক পাশে এসে দাঁড়াল।
আমি কনিষ্কর মুখের দিকে তাকালাম।
আমার এ্যাক্সিডেন্টটা হওয়ার পর আমি বেশ কিছুদিন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরেছিলাম। বলতে পারিস ছন্দপতন। চোখের সামনে সব কেমন অন্ধকার দেখতাম। নিজেকে সামলে নিতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল।
তখন আমার জীবনটা আবার নতুন ভাবে লেখা শুরু হয়েছে। বলতে পারিস আমি নিজেই তার লেখক। নিজেই তার কারিগর।
মারান সেই সময় আমাকে ভীষণভাবে সাহায্য করেছিল। বার বার আমাকে মানসিক ভাবে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছে। তুই কিছু ভাবিসনা অনি, আমি সব বুঝে নিচ্ছি।
তখন আমার একটাই টার্গেট রাজনাথকে যে ভাবেই হোক আমার চাই।
মিত্রার খবর পাই। কখনো নেপলা, কখনো সাগির, কখনো অবতার এনে দেয়।
মনটা খারাপ হয়ে যায়। ঠিক করলাম দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে যাব। মারানকে মনের কথা খুলে বললাম। বললো ঠিক আছে, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
সাগির, অবতার, নেপলা, আমি চারটে পেট।
তখন আমার সংসারটা মারানই চালাচ্ছে। ওরই দেওয়া একট ফ্ল্যাটে আশ্রয় নিয়েছি।
বাইরের জগতের সঙ্গে খুব একটা সাক্ষাৎ নেই। মাঝে মাঝে আমাদের হাউসের কাগজটা উল্টেপাল্টে দেখতাম।
একদিন মারানই টিপ দিল রাজনাথের এক আত্মীয় কানপুরে আছে ও এখানে কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকবে। দেখ তুই খুঁজে পাস কিনা। আমাকে একটা ফোন নম্বর দিল।
দিনক্ষণ দেখে আমি আগেভাগে কানপুরে পৌঁছলাম।
স্টেশনের কাছেই একটা হোটেলে উঠলাম। আমার কাজ হলো সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত স্টেশনের আশেপাশে ঘোরা।
সাতদিন ছিলাম। রাজনাথকে পাই নি।
স্টেশন চত্বরের বাইরে কখনো যাই নি। ওখানেই একদিন অর্জুনকে খুঁজে পেলাম। ব্যাটা মারপিট করছিল আর একজনের সঙ্গে। সে কি প্যাঁচ-পয়জার। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এ একবার ঘুসি মারে তো সে একবার মারে। আরও কয়েকটা ওদেরই সমবয়সী মার শালাকে ধর শালাকে করছে। কি মনে হতে কাছে গিয়ে ছাড়া ছাড়ি করে দিলাম।
অর্জুনের ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরচ্ছে। ব্যাটাকে ধরে নিয়ে স্টেশনের ড্রিঙ্কিং ওয়াটারের কলের জলের তলায় নিয়ে এসে মুখ ধোয়ালাম। ব্যাটা তখনো রাগে ফুঁসছে।
আমাদের শেয়ালদা স্টেশনের যা চিত্র কানপুর স্টেশনেরও সেই এক চিত্র। প্রচুর এরকম বেওয়ারিস বাচ্চা পাবি। যাদের ঘর-বাড়ি ওই স্টেশন চত্বর।
আমি ওদের থামাথামি করার পর অর্জুনকে একটা কেক-চা খাওয়ালাম, ব্যাটা প্রথমে খেতে চাইছিল না। নিজেও খেলাম। তখন অর্জুনের কতো বয়স হবে। বারো-তেরো।
প্রথম দর্শনেই, ব্যাটার পোষাক পরিচ্ছদ দেখে আমার ঠিক স্টেশনে পরে থাকা বেওয়ারিশ বাচ্চা বলে মনে হয় নি। কেমন যেন একটা আলগাশ্রী দেখেছিলাম ওর চোখেমুখে।
প্রথম দিনটা সেইভাবে আর কিছু ঘটে নি।
দ্বিতীয় দিন আমার ডিউটিতে গেলাম, দেখলাম অর্জুন ওদের মতো বয়সী আরও কয়েকজনের সঙ্গে বসে হল্লা করছে। আমাকে দেখে হাসলো, আমিও হাসলাম।
ওর দিকে সেদিন বেশ ভালভাবে লক্ষ্য রাখলাম। কথাবার্তা শুনে বুঝলাম ও এই দলের দলপতি। কাল যার সঙ্গে মারামারি করছিল সে আর একদলের দলপতি। কথাবার্তা শুনে বুঝলাম, গতকাল অর্জুন একটু বেশি মার খেয়েছে, আজ যে মেরেছিল সেই ব্যাটাকে ধরে উত্তম-মধ্যম দেবে।
ওদের সঙ্গে ভাব জমালাম।
একথা সেকথায় বেরিয়ে পরলো পাশেই কোথাও থাকে। সেদিনটা ওইভাবে গেল।
মারপিট। তনু বললো।
করেছিল হয়তো, চোখে পরে নি।
নীরু বিরক্তি চোখে তাকাল তনুর দিকে।
আমিও ওদের মতো তখন সারাদিন স্টেশনেই থাকি। রাতে এসে হোটেলে শুয়ে পরি।
আমাকে মনিটরিং করতো মারানের আর এক খাস লোক জামিল। ও ওই স্টেশন চত্বরটা দেখাশোনা করতো। প্রথম দিন গিয়েই মারানের দেওয়া ফোন নং থেকে ওকে ফোন করেছিলাম।
একদিন রাতে কথায় কথায় জামিলকে ব্যাপারটা বললাম। জামিল বললো চলুন আমাকে দেখিয়ে দিন। পরদিন দূর থেকে জামিলকে দেখালাম।
সরাদিন স্টেশন চত্বরে ঘুরি। অর্জুনের সঙ্গে বহুবার দেখা হয়। ওর সঙ্গে টুকটাক কথা বলি। একদিন মনে হয় কচুরিও খাওয়ালাম। নিজেও খেলাম। সেদিন ব্যাটা আর না করে নি। খায় আর টেরিয়ে টেরিয়ে আমাকে দেখে।
কথা বলার ফাঁকেই ব্যাটা আমাকে বললো, আপ জামিল ভাইয়াকো পাহচানতে?
কথাটা কানে খটাস করে বাজল। ব্যাটা জানলো কি করে! আমি যখন জামিলকে দেখিয়েছিলাম তখন ও আমাকে দেখতে পায় নি!
বললাম, হ্যাঁ।
বহুত খতরনক আদমি।
তুমহারা মাফিক।
মুচকি হাসলো। বহুত সারে মার্ডার কিয়া।
তুম পাহেচানতে হো?
হ্যাঁ।
ক্যায়সে?
হামারা পট্টি মে হর রোজ উসকা আদমি রূপিয়া লেনেকে লিয়ে আয়া কারতা হ্যায়।
তুম কাঁহাপে রাহেতো হো?
সবজি মন্ডি।
ক্যায়সা রূপায়া?
উসকো আন্ডার মে বহুত সারি রেন্ডি হ্যায়। এক মকান ভি হ্যায়।
ওর কথা কানে খট খট করে লাগছে।
সেদিন আর বিশেষ কথা হলো না।
বেলা শেষে হোটেলে ফিরে এলাম।
জামিল এলো একটু বেশি রাতে। বললো অর্জুন এই তল্লাটের এক বাইজীর ছেলে। বাইজীর অতোটা নাম ডাক নেই। কথায় কথায় নাম বললো জিন্নাত।
জামিলকে বললাম, ছেলেটাকে নজরে রাখো, আনকাট হীরে। পারলে ভালো করে কেটে কুটে খাঁটী হীরে বানিয়ে নাও।
জামিল আমার কথা শুনে হাসলো।
আমার কাজ হলো না। কানপুর ছেরে চলে এলাম।
মারান আমাদের চারজনের দুবাইতে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিল। চলে গেলাম।
আবিদ যে বলেছিল রাজনাথ ডঃ ব্যানার্জীর মতো মরেছিল। কনিষ্ক বললো।
দুবাই যাওয়ার আগে মেরে গেছিলাম। মারান সাহায্য করেছিল। সাগির, অবতার অপারেট করেছিল।
কোথায়?
ইউপিতে ওর দেশের বাড়ির কাছেই।
তুই?
আমি তখন মুম্বাইয়ে। ঘটনা শেষ হতে মারান জানিয়েছিল।
সবাই চুপচাপ। নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে দু-একটা পাখির ডাক ভেসে আসছে।
তারপর?
দুবাইতে প্রথমে মারানের এক পরিচিত লোকের কাছে গিয়ে উঠলাম। তারপর নিজেরা মাস খানেকের মধ্যে সমস্ত বন্দবস্ত করে নিলাম।
আমি থামলাম। কনিষ্কর মুখের দিকে তাকালাম।
আমি জানি তোর খুব সেন্সিটিভ জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছি।
ঠিক তা নয় বুঝলি কনিষ্ক একটা মিথ্যে, একটা নিষ্পাপ মেয়ের জীবনটা শেষ করে দিল। আমি যতটুকু মিশেছি তাতে বুঝেছি, আয়েষা কোনওদিন অন্যায় করে নি। মুহূর্তের ওই ঘটনাটা না ঘটলে হয়তো আয়েষার জীবনটা অন্যভাবে লেখা হতো।
তোর কথাটা একশোভাগ ঠিক। আবার ওই ঘটনা না ঘটলে আজ এখানে দাঁড়িয়ে তোর কাছে আমরা সকলে জানতে চাইতাম না।
আমি পুকুরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলাম।
মাথার ওপর দিয়ে এক ঝাঁক পাখি নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে উড়ে চলেছে।
আমি সেইদিকে কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে রইলাম। পাখির দলটা ধীরে ধীরে দৃষ্টির অগোচরে চলেগেল।
তারপর। মিত্রার গলা পেলাম।
পেছন ফিরে তাকালাম।
মিত্রা, তনু, ইসি, মিলি, টিনা, অদিতি, শ্রীপর্ণা দাঁড়িয়ে। তার পেছনে আর সকলে।
মিত্রার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। চোখদুটো কেমন চক চক করছে।
আবার ঘুরে পুকুরের টলটলে জলের দিকে চোখ চলে গেল। বাতাসের পরশে জলে কাঁপন লেগেছে। মাঝে মাঝে দু-একটা মাছ ভেসে উঠে ল্যাজের ঝাপটা মেরে আবার ডুব দিচ্ছে। ভুঁট ভুঁট মন মাতাল করা একটা শব্দ। কুচি কুচি কাগজের টুকরোর মতো হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে।
তখন কাকা মারা গেছেন। বেশ কয়েকমাস হয়েগেছে। আমি গেড়ুয়া পড়া শুরু করেছি। দাড়িটা অতো বড়ো হয় নি। তবে বেশ বড়ো হয়েছে। অনেকটা চাপদারি টাইপের।
আফতাবভাইকে নিয়ে ইন্ডিয়াতে এলাম। তেলের ব্যবসার ব্যাপারে। এর আগেও দু-তিনবার ওর সঙ্গে ইন্ডিয়াতে এসেছি। তখন অন্য কাজে।
তখন আফতাবভাই অন্যধরনের মানুষ। পয়সা থাকলে যা হয় আর কি।
মুম্বাই-দিল্লী-দুবাই এই ছিল ওর রুট।
মুম্বাইতে থাকলে ওর সঙ্গে হোটেলে থাকতে হতো। সেপারেট রুম।
দিল্লীতে এলে আমি অনুপের বাড়িতে থাকতাম। আফতাবভাই হোটেলে। সেদিনও তাই হলো।
একটু ইন্টারাপ্ট করছি। নীরু বললো।
তখন কি মিঃ মুখার্জীর বাকিগুলো খতম।
না।
তাহলে!
তখনও দুটো বেঁচে ছিল।
ও।
সেই রাতে অনুপের সঙ্গে কথা বলে রাঘবনের কাছে গেলাম। ওকে সব বললাম। পরেরদিন রাঘবনের সঙ্গে আফতাবভাই-এর মিটিং হলো। রাঘবন সব ব্যবস্থা করলো। একটা নতুন উইং চালু হলো।
সব কিছু চুকে বুকে যাওয়ার পর আফতাবভাই বললো, নতুন ব্যবসা শুরু হলো, খানা-পিনা মৌজ-মস্তি হবে না তা হয়। আমরা কয়েকজন ঘরোয়া ভাবে হোটেলে খাওয়া দাওয়া করলাম। আমি রাঘবন ভেজ, ওরা সকলে নন-ভেজ।
আমি অনুপের সঙ্গে অনুপের ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম। আফতাবভাই হোটেলে।
হোটোল থেকে ফিরে এসেছি, আফতাবভাই ফোন করলো। চল আজ তোকে একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাব।
প্রথমে না করেছিলাম। তারপর আফতাবভাই একটু গেঁই-গুঁই করতে বললাম ঠিক আছে যাব। আমি এখন অনুপের বাড়িতেই আছি ঠিক সময় চলে আসবো।
আফতাবভাই-এর আর তর সইলো না। বিকেলের দিকে ফোন করলো তুই এখুনি চলে আয়।
অগত্যা ওর হোটেলে এলাম।
এসে দেখলাম আফতাবভাই রেডি হয়ে বসে আছে।
যেতেই বললো চল দেরি করবো না। অনেকটা পথ যেতে হবে।
কোথায় যাবে বলো?
আগ্রা।
এখন!
হ্যাঁ।
তুমি কি আজ ফিরবে?
কেন বল?
কাল আমার কয়েকটা কাজ আছে।
ঠিক আছে তুই চলে আসিস, আমি আগ্রায় থেকে যাব। পর্শু ফিরবো।
দুজনে বেরিয়ে এলাম।
আগ্রায় যখন ঢুকলাম তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। রাত সাড়েনটা দশটা হবে।
প্রথমে একটা হোটেলে উঠলাম। আফতাবভাই কার কার সঙ্গে অনবরতো ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। এটা বুঝছি একজন গেস্ট আজ ওর সঙ্গে যাচ্ছে তাতে যেন আপত্তি না করে।
কোথায় যাচ্ছে কি বৃতান্ত ওকে জিজ্ঞাসা করি নি। বুঝলাম আমাকে নিয়েই কথা হচ্ছে।
আফতাবভাইদের মতো লোকেদের চেলুয়া আর ফোরের অভাব হয় না। হোটেলের প্রবেশ পথ থেকেই সেটার সূত্রপাত। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমরা হোটেল রুমে চলে এলাম।
আমার কাছে যে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ধোঁয়াশা ঠেকছে সেটা আফতাবভাই আমার চোখ মুখ দেখেই টের পেয়ে গেছে। মাঝে মাঝে কথা বলার ফাঁকে মুচকি মুচকি হাসছে।
ঘণ্টা খানেক পর ইন্টারকমে খবর এলো, নীচে কারা এসেছে। আফতাবভাই নিজেই ফোনে তাদের সঙ্গে কথা বলে নিল, তখন ঠাট উর্দুটা অতো ভাল বুঝতাম না, বলতেও পারতাম না।
নীচে নেমে এলাম। দেখলাম আমাদের জন্য গাড়ি রেডি। বেশ কয়েকটা নতুন মুখ দেখতে পেলাম। আমাকে দেখে এদের মধ্যে দু-একজনের চোখে বিষ্ময়ের ছোঁয়া। আফতাবভাই দেখলাম একজনের সঙ্গেও আলাপ করাল না।
আয় অনি। দু-জনে একটা গাড়িতে উঠলাম।
মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে গেলাম।
প্রথমটায় একটু ভিরমি খেয়েছিলাম। সম্বিত ফিরতে দেখলাম, দামিনীমাসির পাড়া।
আফতাবভাই-এর কোন হেলদোল নেই। মনে মনে ওকে একটু গালাগাল দিলাম। তুমি ফুর্তি করতে এসেছো ঠিক আছে। আমাকে সঙ্গে নিলে কেন?
আফতাবভাই আমাকে নিয়ে একটা বাড়িতে ঢুকলো। পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। সব কিছুই তার বিশাল বিশাল। ঘোরান কাঠের সিঁড়ি। আমার কাছে খুব একটা অপরিচিত ঠেকলো না।
দামিনীমাসির বাড়িটা অনেকটা এই রকমের। নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত সকলেই দেখলাম কম বেশি আফতাভাইকে চেনে। এইরকম একজন মেহমান এসেছে। ফলে তার আতিথ্যের বহরই আলাদা।
কাঠের সিঁড়ে বেয়ে ঘট ঘট করে ওপরে উঠে এলাম। দোতলায় এসে একটা ঘরে ঢুকলাম। ঘরে ঢুকেই বুঝতে পারলাম এটা বেশ্যাদের ঘর নয়, নাচঘর। তারমানে বাইজী কুঠি। সেইভাবেই ঘরের আসবাবপত্র নিখুঁতভাবে সাজান।
একবারে ভারতীয় ঘরানায় তৈরী এই বাইজীঘর। ঝাড়বাতি, কাশ্মীরি গালিচা, কার্পেট, গরগরা। কোন উপকরণ বাদ নেই। ফরাসের ওপর বালিস, তাকিয়া সাজান।
আমরা দুজনে বসলাম। যারা পৌঁছে দিতে এসেছিল তারা বিদায় নিল। ঘরের দরজা বন্ধ হলো।
কয়েকটা মেয়ে এলো। দেখেই বুঝলাম এরা বাইজীর অনুচর। তারাও আমার পোষাক পরিচ্ছদ দেখে একটু বাঁকা চোখে দেখলো। ঘরের পর্দায় দামী আতর ছড়িয়ে চলেগেল।
বাজন দাররা এলো। আফতাবভাইকে দেখে সেলাম ঠুকলো। শেষে বাইজী। বাইজী ঢুকেই প্রথমে আমার দিকে তাকাল। আমার ওই রকম সাজপোষাক দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেল। জীবনে প্রথম তার ঘরে কোন সাধু-সন্ন্যাসী মানুষ ঢুকেছে। চোখে মুখে তার বর্হিপ্রকাশ ছড়িয়ে পড়েছে।
মাথায় হাত ঠেকিয়ে সেলাম করার ভঙ্গি, তারপর আমাদের মুখোমুখি বসলো।
টিপিক্যাল বাইজী ঘরানার সাজ পোষাক। দেখতে শুনতে খারাপ নয়। চিরাচরিত পোষাকের অন্তরালে মোহনীয় শরীরটা ঢাকা পড়েছে।
এটুকু বুঝতে বেশি দেরি হল না, বাইজীর রক্ষণা-বেক্ষণের সিংহভাগটাই আফতাবভাই ব্যায় করে। না হলে এরকম ঠাটবাঁট রাখা সম্ভব নয়।
আফতাবভাই আমার সঙ্গে পরিচয় করাল। নাম বললো প্রেমানন্দ।
তারমানে তখন তুই প্রেমানন্দ নামে খ্যাত। নীরু বললো।
ইন্ডিয়াতে।
সবার চোখেই বিষ্ময়।
আফতাবভাই এও বললো আমি তার খাশ লোক। বাইজীর নাম বললো জিন্নাত।
নামটা শুনেই আমার কানে কেমন খট করে লাগলো। কোথায় যেন নামটা শুনেছি। সেই মুহূর্তে কিছুতেই খেয়াল করতে পারলাম না। তারপর ভাবলাম বাঙালীদের মতো মুসলমানদের হরেক নাম হাজারবার আছে। ফালতু নাম নিয়ে নাম মাহাত্ম্য করে লাভ? নিজেকে নিজে বোঝালাম।
কিছুক্ষণ ফর্ম্যাল কথাবার্তা বলার পর, বাইজী গান শুরু করলো। সঙ্গে গান শোনার সমস্ত উপকরন সাজানো।
আমি নিরামিষাশী।
আফতাবভাই দেখলাম দু-চারবার গড়গড়াতেও টান মারলো। একেবারে রাজকীয় মেজাজ। পরিবেশটাও সেইভাবে রচনা করা হয়েছে। অনুষ্ঠান চললো ঘণ্টা দুয়েক। বাইজীর গলাটা খারাপ মনে হলো না। সব কটা গানই মার্গীয় সঙ্গীতের ঢঙে।
আমিও ফোরন কাটার মতো দু-একটা গান বললাম। বাইজী গাইল। আমায় তারিফ করলো, ভালো শ্রোতা হিসাবে।
গানবাজনা শেষ হতে আমরা দু-জন আর বাইজী ছাড়া সকলে বিদায় নিল।
এরপর আসল কাজের কথায় আসা হলো।
বাইজীকে আফতাবভাই জিন্নাত নামেই ডাকছিল। ব্যবসার কথা হলো। আফতাবভাই যে নতুন ব্যবসা শুরু করছে তার কথা হলো। আমাকে দেখিয়ে বললো, ওর জন্যই এই ব্যবসাটা শুরু করছি। মাঝে মাঝে আমার হয়ে প্রেমানন্দ তোমার কাছে আসবে।
তখনই বুঝলাম বাইজী আফতাবভাই-এর একজন অপারেটর।
কথা বলতে বলতেই ভোর হয়ে এলো। আফতাবভাই থেকে গেল। আমি ফিরে আসব।
আফতাবভাই বললো, তোর সঙ্গে আমার আগামীকাল বিকেলে দেখা হবে। আমি হোটেলে গিয়ে তোকে ফোন করবো।
বেরিয়ে এলাম। আমাকে দিল্লী পৌঁছে দেওয়া হলো।
দিল্লীতে ফিরে এসে আমি আমার কাজ সারলাম। যথাসময়ে আফতাবভাই ফোন করলো। হোটেলে গিয়ে দেখা করলাম।
আমাকে দেখেই আফতাবভাই বললো, জিন্নাত তোর খুব প্রশংসা করলো। তারপর যখন জানলো তুই বাঙালী, তখন আমাকে খুব ডাঁটল।
কেন!
ও তো বাঙালী।
তাই।
আমি আর বেশি গা করলাম না দেখে আফতাবভাই আর এগোল না।
শুধুমাত্র বাইজী সম্বন্ধে দু-একটা প্রয়োজনীয় কথা আমাকে জানাল।
এটাও জানাতে ভুললো না, দিদির কানে যেন কথাটা না পৌঁছয়।
দুবাই ফিরে এলাম। আমার জগতে প্রবেশ করলাম। বাড়তি দায়িত্ব আফতাবভাই-এর ব্যবসা।
কখনো ও আসে ইন্ডিয়াতে কখনো আমি আসি। জিন্নাতের কাছে যাই। বেশির ভাগ সময়েই দিনের বেলা যেতাম। তখন জিন্নাত রাতপরীর পোষাকে থাকে না। সাধারণ পোষাকেই থাকে। কখনো কাপর পরা অবস্থায় দেখেছি কখনো সালোয়াড় কামিজ। অনেকটা বাড়িতে মা বনেরা যেমন আটপৌরে জামাকাপর পরে সেরকম।
প্রথমবারটা ওর সঙ্গে ফর্ম্যাল কথার বাইরে একটি কথাও বলি নি। বেশির ভাগ সময় হিন্দী আর ভাঙা ভাঙা উর্দুতে বলেছি। জিন্নাতও সেই ভাষাতেই কথা বলেছে। অনেক অনুরোধ উপরোধ সত্বেও কখনো একগ্লাস জলও মুখে তুলি নি।
জিন্নাত নিজে কোনদিন আতিথেয়তায় কার্পন্য করে নি। বরং আমি আতিথেয়তা গ্রহণ না করার জন্য নালিশ জানিয়েছে আফতাবভাই-এর কাছে।
কাজ শেষ হলেই এক মুহূর্ত ওখানে অপেক্ষা করি নি, বেরিয়ে এসেছি।
এরমধ্যে বেশ কয়েকবার বাইজীর কাছে যাওয়া আসা হয়ে গেছে।
বাইজীর সঙ্গে অনেকটা সরোগরো হয়ে গেছি। তবে কাজের বাইরে বাড়তি একটি কথাও বলতাম না। এমনকি ভাল মন্দের খবরা-খবর পর্যন্ত নিতাম না। তবে বাইজী কিন্তু যাওয়া আসার সময় আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতো। প্রথম প্রথম সেটা রিফিউজ করলেও একদিন জোড় করে আমার পায়ে লুটিয়ে পরেছিল।
সেবার যখন গেলাম তখন ওদের রমজান মাস চলছিল। একবারে শেষের দিকে।
তখন আমার চুল-দাড়ি যথেষ্ট বরো হয়েছে। চুলে জট পরতে শুরু করেছে। ঝট করে পরিচিত কেউ দেখলেও তার কাছে আমি অপরিচিত।
কয়েকদিন পরেই ঈদ। ওদের ধর্মের বড়ো উৎসব।
আমি বেশিরভাগ সময়েই সকালের দিকে যেতাম। যাতে সন্ধ্যের আগে আগে দিল্লী ফিরে আসতে পারি।
আফতাবভাই-এর কথা মতো কাজ বুঝিয়ে চলে আসছি, বাইজী আমার পথ আগলে দাঁড়াল। বললো, স্বামীজি আপনি হিন্দু, তায় সন্ন্যাসী, আপনাকে বলতে দ্বিধা হচ্ছে।
আমি বাইজীর মুখের দিকে তাকালাম। আমার তাকানর মধ্যেই বাইজীর প্রশ্নের উত্তর লেখা ছিল।
শুনেছি হিন্দু ধর্মে যাঁরা সন্ন্যাস নেন, তাদের কোন ধর্ম থাকে না।
বুঝলাম বাইজী শুধু নাচগান, দেহদান করে না একটু আধটু লেখাপড়া করে, না হলে এত গুছিয়ে কথা বলা সম্ভব নয়।
আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম।
আপনি যদি ঈদের দিন একবারটি আসেন আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো।
কেন জানিনা বাইজীর চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন সেই মুহূর্তে না বলতে পারলাম না। বললাম, যদি ফিরে না যাই, অবশ্যই আসবো।
বাইজীর চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। অদ্ভূত এক পরিতৃপ্ততা।
চলে এলাম।
আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলাম।
সেদিন আমি অনুপের বাড়িতে ছিলাম। রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পরেছি। হঠাৎ মাঝরাতে আমার কাজের ফোনটা বেজে উঠলো। দেখলাম বাইজীর নম্বরটা ব্লিঙ্ক করছে।
ধড়ফর করে উঠে বসলাম।
বলুন।
স্বামীজী এইমাত্র চাঁদ উঠলো। প্লিজ আপনি আসবেন। বাইজীর গলাদিয়ে সুরের মূর্চ্ছনা।
আমি কোন উত্তর দেওয়ার আগেই বাইজী ফোনটা রেখে দিল।
অবাক হলাম।
শুধুমাত্র এই খবরটুকু দেওয়ার জন্য বাইজী ফোন করলো!
কিছুক্ষণ ফোনটার দিকে তাকিয়ে স্থবিরের মতো চুপ চাপ বসে রইলাম। কেমন যেন একটা লাগছিল। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম।
ঠিক শুনেছি তো! ঘুমের ঘোরে ফোনটা ধরলাম। স্বপ্ন দেখলাম না তো? তারপর রিসিভ কলের লিস্টে গিয়ে দেখলাম হ্যাঁ বাইজীই ফোন করেছে। ভিউতে গিয়ে সময় পর্যন্ত দেখলাম। রেকর্ডিংটাও শুনলাম।
ভাবলাম বাইজীকে একবার রিং-ব্যাক করি। তারপর ভাবলাম না বারাবারি হয়ে যাবে।
একদিন এই ঈদের চাঁদ দেখার জন্য আমি মাঝ রাতে নিজের ঘরের চালে উঠে অনেকক্ষণ বসেছিলাম। চাঁদ দেখতে পাই নি। আজ একজন নর্তকী আমাকে ফোন করে বলছে ঈদের চাঁদ উঠেছে।
আয়েষার চোখ মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
সেদিন আমি অনুপের বাড়ির ছাদে উঠে ঈদের চাঁদ দেখেছিলাম। জীবনে সেই প্রথম।
মনটা আরও ভারি হয়ে উঠলো।
সারারাত আর ঘুম হলো না। কেমন যেন একটা আবেশের মধ্যে আমি ডুবে আছি।
সকালে অনুপের বৌ শিউলি আমার মুখ-চোখ দেখ ধরে ফেললো। আমি রাতে ঘুমই নি। একটু আধটু বকাবকি করলো।
অনুপ ঘুম থেকে উঠলো। তার কানে খবরটা পৌঁছতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। ঘুম থেকে উঠে ব্যাজর ব্যাজর শুরু করতেই আমি বললাম, আমাকে একটা গাড়ি হায়ার করে দে।
কেন?
একটু আগ্রা যাব।
এইতো সেদিন গেলি।
দরকার আছে।
কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
কখন বেরবি?
গাড়িটা এলেই বেরিয়ে যাব।
আমার কোর্ট আজ ছুটি আমার গাড়িটা নিয়ে যা।
না।
কিচ্ছু হবে না। আমার ড্রাইভার তোর ব্যাপারটা কমবেশি জানে।
ঠিক আছে।
স্নানটান সেরে নিয়ে সামান্য খাওয়া দাওয়া করে আটটা-সাড়েআটটা নাগাদ রওনা হলাম।
পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়েগেল।
যে দিকে তাকাই খুশির ঈদের আমেজ। সবাই উৎসবের অংশীদার।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/pXv2V56
via BanglaChoti

Comments